১৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার ১৯৭১
রুমীর কোন খবর নেই। প্রতিদিন পাগলা বাবার কাছে যাচ্ছি, তার পায়ের ওপর পড়ে কান্নাকাটি করছি। তিনি বেশির ভাগ সময় চুপ করে ধ্যানে বসে থাকেন, কোন কথা বলেন না। বেশি চাপাচাপি করলে বিরক্ত হন। তবু আমরা সবাই পাগলাপীরের আস্তানায় ধরনা দিয়ে বসে থাকি–আমি, মা, লালু, মোশফেকা মাহমুদ, তার মা, ঝিনু মাহমুদ, শিমুল বিল্লাহ, তাদের চার ভাই, তাদের মা, নাজমা মজিদ, মাহমুদা হক। ধরনা দিয়ে বসে থাকেন চট্টগ্রামের অ্যান্টিকরাপসান ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টার নাজমুল হকের স্ত্রী, বরিশালের এ.ডি.সি, আজিজুল ইসলামের স্ত্রী, কুমিল্লার ডি.সি. শামসুল হক খানের স্ত্রী, রাজশাহীর সিনিয়ার রেডিও ইঞ্জিনিয়ার মহসীন আলীর স্ত্রী, চট্টগ্রামের চীফ প্লানিং অফিসার রেলওয়ে, শফী আহমদের স্ত্রী, পিরোজপুরের এস.ডি.পি.ও. ফরিদুর রহমান আহমদের স্ত্রী, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের সি.ও. লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরের স্ত্রী, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ফিল্ড ইনটেলিজেন্সের মেজর আনোয়ারুল ইসলামের স্ত্রী এবং এরকম আরো বহু। এঁদের সকলেরই স্বামী নিখোঁজ। আমরা পরস্পরের দুঃখের কাহিনী শুনি, কাঁদি, দোয়া-দরুদ পড়ি, আবার নিজেদের মধ্যে দুঃখের কথা নিয়ে আলোচনা করি, আবার কাঁদি। এত লোক আসে পাগলাপীরের কাছে! অবাক হই সারা বাংলাদেশের যত ছোবল-খাওয়া লোক–সব যেন আসে এখানে! এতগুলো লোক প্রিয়জন হারানোর দুঃখে মুহ্যমান, এদের মধ্যে বসে নিজের পুত্রশোকের ধারটা কমে যায় অনেকখানি। এক ধরনের সহমর্মিতায় মন আপ্লুত হয়ে ওঠে। সবাইকে মনে হয় আত্মার আত্মীয়, মনে হয় সবাই মিলে আমরা একটি পরিবার। পি.এস.পি, আওয়াল সাহেব আগে থেকে আমাদের পরিচিত, তিনি ও তার স্ত্রী আসেন ছোট ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে। আমি জানি, তাদের অন্য তিনটি ছেলে মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলেও তাদের কথা তুলি না। উলফাতের বাবা আজিজুস সামাদ সাহেব ছাড়া পাবার পর সাদেকা সামাদ আপা তাকে নিয়ে পাগলাপীরের কাছে এসেছিলেন। আমরা তাদের কুশল জিগ্যেস করেছি কিন্তু উলফাত, আশফাঁক কেমন আছে–একবারও শুধোই নি। ভয় হয় ফিসফিস করে। শুধোলেও বুঝিবা দেয়াল গুনে ফেলবে, ইশারায় শুধোলেও বুঝিবা আকাশ দেখে ফেলবে। পাগলা বাবার কাছে নিয়মিত আসেন গায়ক আবদুল আলীম, আসেন বেদারউদ্দিন আহমদ, আসেন আরো অনেক শিল্পী। শুধু যে ছোবল খাওয়ারাই আসেন তা নয়। ছোবল যাতে না খেতে হয় তার জন্য দোয়া নিতেও বহুজন আসেন।
ফকির পাগলাপীরের ওপর প্রসন্ন নয়। আমরা পাগলাপীরের কাছে যেতে শুরু করেছি শুনেই প্রথমদিনে মন্তব্য করেছিল : ও বাবা, বহুত এক্সপেনসিভ পীরের কাছে গেছেন। ওর বন্ধু আমিনুল ইসলাম নিয়মিত পাগলাপীরের কাছে যায়, সেটাও ফকিরের পছন্দ নয়। এই নিয়ে আমিনুল ইসলামের সঙ্গে তার প্রায় তর্ক হয়। ফকিরের দৃঢ়বিশ্বাস পাগলাপীর পাক আর্মির দালাল। সেদিন যে তিনি পাঞ্জাবি সার্জেন্টের সঙ্গে আমাদের দুজনকে ক্যান্টনমেন্টে পাঠাতে চেয়েছিলেন রুমীকে আনার জন্য, সেটা ওঁর স্রেফ ভাওতা। আসল উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকে বাঘের খোপে ঢুকিয়ে দেওয়া। কিন্তু আমিনুল ইসলাম এবং আমরা কেউই ফকিরের কথায় কান দিই নি এবং পাগলা বাবার ওপর বিশ্বাসও হারাই নি।
শরীফদের আরেক বন্ধু আগা ইউসুফ আগে যখন আর্মিতে ছিলেন, তখন তাঁর বস্ ছিলেন, আজকের সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেনারেল নিয়াজী। ঐ সময় নিয়াজীর সঙ্গে আগার বেশ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আগা ইউসুফ অনেক দিন হয় আর্মি থেকে রিটায়ার করে বর্তমানে আই.পি.বি-র চেয়ারম্যান। লেঃ জেঃ নিয়াজী ঢাকায় আসার পরপরই আগা ইউসুফকে খোঁজ করে তার বাসায় চা খেতে ডেকেছিলেন। শরীফের সঙ্গে আগা ইউসুফের প্রায় দেখা হয় ঢাকা ক্লাবে। শরীফ এবং ফকির তাকে অনুরোধ করেছে–নিয়াজীকে বলে রুমীর খবরটা বের করার চেষ্টা করতে।