১৩. সুদীর্ঘ আমেরিকা সফরে

সুদীর্ঘ আমেরিকা সফরে কবি বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারেননি বটে, কিন্তু একটি রত্ন লাভ করেছিলেন।

সেক্রেটারি পিয়ার্সনের কাছে তিনি জেনেছিলেন, একটি ইংরেজ যুবক নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করছে, তার খুব ইচ্ছে সে ভারতের কোনও গ্রামে গিয়ে গরিব মানুষদের জন্য কিছু কাজ করবে।

কবি যুবকটিকে ডেকে পাঠালেন।

যুবকটির নাম লিওনার্ড এল্‌মহার্স্ট, ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে তার জন্ম, সে ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করেছে কেমব্রিজে। মহাযুদ্ধ শুরু হলে তাকেও যথারীতি যুদ্ধে যেতে হয়, সৈনিকরূপে সে প্রেরিত হয় ভারতে।

শাসক সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও সে ভারতের গ্রামগুলির দৈন্যদশা দেখে বিস্মিত ও ব্যথিত হয়েছিল। কৃষিপ্রধান দেশ, অথচ বিজ্ঞানসম্মত উন্নত প্রথায় চাষবাসের কোনও ব্যবস্থাই নেই, সরকার থেকেও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় না। চাষিদের জীর্ণশীর্ণ চেহারা, স্বাস্থ্যবিধি জানে না, পশুপালন পদ্ধতিতেও পিছিয়ে আছে কয়েকশো বছর। ইংরেজরা এ দেশ শাসন ও শোষণ করবে, বিনিময়ে কিছু দেবে না?

তখনই সে ঠিক করেছিল, তাদের পক্ষ যদি যুদ্ধে জয়ী হয় এবং সে প্রাণে বাঁচে, তা হলে সে আবার ফিরে আসবে ভারতে। তার জাতির পক্ষ থেকে ভারতের ঋণ সে কিছুটা শোধ করার চেষ্টা করবে, একক, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়।

যুদ্ধে তার প্রাণটি গেল না, জয়ীর বেশেই সে ফিরল স্বদেশে। ভারতের দরিদ্র মানুষদের জন্য কিছু একটা করার সঙ্কল্প সে ভোলেনি। কিন্তু ইতিহাসের জ্ঞান নিয়ে সে আর কতটা সাহায্য করতে পারবে? কৃষি ও ফসল উৎপাদনে আমেরিকা বিশেষ উন্নত, সে বিষয়ে উচ্চশিক্ষারও ব্যবস্থা আছে, তাই সে ইতিহাস-পাঠ ছেড়ে আমেরিকায় এসে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো শুরু কIে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে।

কবির কাছ থেকে আহ্বান পেয়ে সে একদিন উপস্থিত হল হোটেলে।

এল্‌মহার্স্ট যুদ্ধে যোগদান করার জন্য যখন জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছিল, তখন তার কাছে ছিল ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের এক কপি। মাঝে মাঝেই সেই কবিতাগুলি পড়ে সে এক মহান সভ্যতার স্বাদ পেয়েছে। অনেক কবিতা তার কণ্ঠস্থ। সেই কবির সন্নিধানে সে। এসেছে, তাতেই তার রোমাঞ্চ হয়।

কবি কিন্তু অধ্যাত্মবাদ, শান্তি কিংবা বিশ্ব মৈত্রী নিয়ে কিছু বললেন না, তাকে পরিষ্কার ভাষায় জানালেন, তুমি ভারতের গ্রামে গিয়ে কাজ করতে চাও শুনেছি, আমি বাংলার গ্রামাঞ্চলে শান্তিনিকেতন নামে একটি বিদ্যালয় খুলেছি, সেখানে পড়াশুনোর কাজ ভালই হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, শান্তিনিকেতন আশ্রমটি যেন একটি দ্বীপ, কাছাকাছি গ্রামগুলির সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগই নেই। বীরভূমের গ্রামগুলি দিন দিন যেন ধ্বংসের পথে যাচ্ছে, অনেক মানুষ নিরুপায় হয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। গ্রামের মানুষ যদি খাদ্যপুষ্টিহীন, ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে নৈরাশ্যে ড়ুবে থাকে, তা হলে আমার বিদ্যালয়ে কিছু ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে কী লাভ? তাতে দেশের উন্নতি হতে পারে না। শান্তিনিকেতনের কাছেই সুরুল গ্রামে আমি কিছু জমি কিনে রেখেছি, আমার খুব ইচ্ছে, সেখানে উন্নত ধরনের কৃষি, পশুপালন, হাতের কাজ শিক্ষার একটা কেন্দ্র গড়ে তুলি। কিন্তু তেমন উপযুক্ত লোকবল নেই। তোমার সাহায্য কি পেতে পারি?

এল্‌মহার্স্ট বলল, আপনি আমাকে সুযোগ দিতে চান, এতে আমি অবশ্যই ধন্য। আপনার সঙ্গ পাওয়াই আমার দারুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমি কৃষি বিষয়ে নিজে ভাল করে না জানলে গ্রামের মানুষদের সাহায্য করব কীভাবে? এখানে তা নিয়েই পড়াশুনো করছি, সম্পূর্ণ করে পরীক্ষাটা দিতে চাই।

কবি বললেন, বেশ তো, পরীক্ষা শেষ হলে আমায় জানিও।

তারপর কবি দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। এল্‌মহার্স্টও পরীক্ষা শেষ হলে ইংল্যান্ডে এসে কবিকে চিঠি লিখলেন, এখন আসতে পারি?

কবির বদলে উত্তর দিলেন অ্যান্ড্রুজ। না, এসো না। এখানে তোমার কাজ চালাবার মতন অর্থের জোগান দেবার মতন সামর্থ্য আমাদের নেই।

অ্যান্ড্রুজের ওপর শান্তিনিকেতন পরিচালনার অনেকখানি ভার। তিনি নিজের দায়িত্বেই এই সিদ্ধান্ত নিলেন, না কবিও মত বদলেছেন, তা বোঝা গেল না।

এতেও দমবার পাত্র নন এল্‌মহার্স্ট।

সে আমেরিকায় গিয়ে শুধু চাষবাস নিয়ে পড়াশুনোতেই ড়ুবে থাকেনি, সে রসেবশে থাকার মানুষ, সেখানকার সমাজের নানান স্তরে মিশেছে, আমোদ-ফুর্তিও করেছে, ডরোথি স্ট্রেইট নামে এক বিধবা রমণীর সঙ্গে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা ও প্রণয়ও হয়ে গেছে এর মধ্যে।

ডরোথির অনেক গুণ, শুধু দোষের মধ্যে এই, সে বড় বেশি ধনী। বিশাল পৈতৃক সম্পত্তি তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৃত স্বামীর বিশাল ঐশ্বর্য। আমেরিকার উচ্চ সমাজে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাওয়ার মতন অবস্থা, কিন্তু সে আকৃষ্ট হয়েছে এক সাধারণ ঘরের ইংরেজ যুবকের প্রতি।

এল্‌মহার্স্ট ইচ্ছে করলেই ডরোথিকে বিবাহ করে বিলাসী জীবন কাটাতে পারে, কিন্তু ভারতের গ্রামে গিয়ে কিছুদিন অন্তত শ্রমদান করতে সে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। প্রণয় ও বৈভব লাভের বিনিময়েও সে সেই সঙ্কল্প পরিত্যাগ করতে চায় না। আবার ডরোথির পক্ষেও তার সঙ্গিনী হয়ে ভারতের গ্রামের জল-কাদায়, মশা-মাছির মধ্যে দিন কাটানোর প্রশ্নই ওঠে না। একেই বলে উভয় সঙ্কট।

এই ডরোথি স্ট্রেইট নামে ধনবতী মহিলাই কবির আমেরিকা সফরের সময় বিশ্বভারতীয় জন্য পঞ্চাশ হাজার ডলার সাহায্য করার জন্য উদ্যত হয়েও অন্যের প্ররোচনায় নিরস্ত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইস্কুল সম্পর্কে তার এখনও কোনও আগ্রহ নেই, কিন্তু তার প্রেমিক যদি কোনও শখ মেটাতে চায়, তাতে ডরোথির কার্পণ্য নেই, যাকে বলে গড ফরসেকেন প্লেস, সেরকম কোনও গ্রামে গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছে হয়েছে এমহাস্টের, কিছুদিন সে সাধ মিটিয়ে আসুক, সে জন্য ডরোথি এখনই পাচিশ হাজার ডলার দিতে প্রস্তুত।

টাকার কথা জানিয়ে, অবিলম্বে শান্তিনিকেতনে এসে উপস্থিত হল এল্‌মহার্স্ট।

কবি দুই ইংরেজ তত্ত্বে বিশ্বাসী। এক ধরনের ইংরেজ অস্ত্র উঁচিয়ে অন্য দেশ দখল করতে যায়, সেখানে যথেচ্ছ শোষণ ও অত্যাচার চালায়, জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার মতন বর্বরতা প্রদর্শন করে। আবার সেই ইংরেজ জাতির মধ্যে এমন মানুষও আছে যারা কাব্যসাহিত্যে, দর্শনে-বিজ্ঞানে কত উন্নত, নিষ্ঠাবান মানবতাবাদী। পরদুঃখে কাতর। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর ইংরেজদেরই প্রতিনিধি অ্যান্ড্রুজ, পিয়ার্সন, এল্‌মহার্স্ট।

অ্যান্ড্রুজ, পিয়ার্সন শান্ত ও প্রৌঢ়, এদের তুলনায় এমহার্স্ট বয়েসে নবীন তো বটেই, দীর্ঘকায়, সুদর্শন ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। কয়েক দিনেই সে মাতিয়ে তুলল শান্তিনিকেতন। বাংলা শিখতে শুরু করে এগিয়ে যেতে লাগল চমকপ্রদভাবে।

কবির ভাই বোনদের মধ্যে একমাত্র বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ পাকাপাকিভাবে বসতি নিয়েছেন শান্তিনিকেতনে, অন্য কেউ কদাচিৎ আসেন। ওঁর ছেলে দীপেন্দ্রনাথ বা দীপুবাবুও এখানে থাকেন অধিকাংশ সময়, তিনি সাহায্য করেন তদারকিতে। এল্‌মহার্স্ট এঁদের সঙ্গে আলাপ করে এঁদের অভিজাত অথচ সহজ, সরল ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যায়। দীপুবাবুর স্ত্রী হেমলতা সকলের বড়মা, তিনিই নিয়েছেন এই তরুণ, উৎসাহী ইংরেজ ছাত্রটিকে বাংলা শেখাবার ভার।

গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনকে উপলক্ষ করে কিছুটা অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। গান্ধীজি অসহযোগের ডাক দিয়েছেন, সরকারের সঙ্গে, কোনও ইংরেজের সঙ্গেই দেশের মানুষ সহযোগিতা কিংবা যোগাযোগ রক্ষা করবে না। ছাত্র-ছাত্রীরা ছেড়ে আসবে স্কুল কলেজ, বিলিতি বস্ত্র বর্জন করে সকলে চরকায় সুতো কাটবে। এই উপায়ে এক বৎসরের মধ্যে এসে যাবে স্বরাজ।

কবি এই নীতি ও পথ মানতে পারেননি। জ্ঞান অর্জনের পথ রুদ্ধ করে দেবার তিনি ঘোর বিরোধী। এল্‌মহার্স্টও তো ইংরেজ, তার নিঃস্বার্থ সহযোগিতা গ্রহণ না করার কী যুক্তি থাকতে পারে? এর মধ্যে কলকাতায় গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি আলোচনা হয়েছে সুদীর্ঘ সময় ধরে। কবিকে দলে টানতে না পেরে তিনি শেষ পর্যন্ত অনুরোধ করেছিলেন, গুরুদেব, আপনি অন্তত চরকা কেটে সুতো বুনতে শুরু করুন, তাতে আপনার দৃষ্টান্তে অনেকে অনুপ্রাণিত হবে। কবি সহাস্যে বলেছিলেন, মহাত্মাজি, আমি শব্দের সঙ্গে শব্দ বয়ন করে গান বা নাটক রচনা করতে পারি, কিন্তু আপনার ওই তুলো থেকে সুতো বুনতে গেলে সেই তুলোরই চরম দুর্গতি হবে।

এই আলোচনার সময় কবির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করবার জন্য একদল লোক জোড়াসাঁকোর প্রাসাদের প্রাঙ্গণে কিছু বিদেশি কাপড়ে আগুন ধরিয়ে বিকট উল্লাসের ধ্বনি তুলেছিলেন। পত্র-পত্রিকাতেও বিদ্রুপ বর্ষিত হচ্ছিল তাঁর নামে। কবি তবু নিজের বিশ্বাসে অটল।

তাঁর অনুপস্থিতিতে শান্তিনিকেতন বিদ্যাশ্রমেও কিছু ছাত্র ও অধ্যাপক মেতে উঠেছে রাজনীতিতে, এক বছরের মধ্যেই স্বরাজ আসবে এই উন্মাদনায় তারা কবির বদলে গান্ধীজির পথ ধরে চলতে চায়, এর পেছনে আছে অ্যান্ড্রুজের প্রশ্রয়। কবি এ জন্য বেদনা বোধ করছেন, প্রয়োজনে অবাধ্য ছাত্র-শিক্ষকদের আশ্রম থেকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করবেন না। এল্‌মহার্স্টকে বলে দিয়েছেন তার কাজের প্রস্তুতি পূর্ণ উদ্যমে চালিয়ে যেতে।।

বাংলা শিখতে গিয়ে এল্‌মহার্স্টের সঙ্গে দীপুবাবুর প্রায়ই দেখা হয়। মানুষটি ভোজন ও আচ্ছা, দু’ব্যাপারেই খুব রসিক। এল্‌মহার্স্টকে দেখলেই গল্প করেন কিছুক্ষণ। একদিন বললেন, জানো সাহেব, একবার আমার খুব পেট খারাপ হয়েছিল। তখন গান্ধীজি এসেছিলেন আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। আমার অসুখের কথা শুনে বললেন, নিশ্চয়ই তোমার ভেতরে কোনও গোপন পাপ আছে। পাপ থাকলেই তা রোগ হয়ে ফুটে বেরোয়। কী অদ্ভুত কথা! আসলে আমি তখন খুব দুধ খেতাম, তা হজম হত না। কিছুদিন আগে শুনলাম, গান্ধীজি খুব আমাশায় ভুগছেন। আমি অমনি টেলিগ্রাম করলাম, এবার আপনার ভেতরে কী পাপ আছে খুঁজুন! হা-হা-হা! উনি তো ছাগলের দুধ খান, বেশি বাড়িয়েছেন বোধহয়। বলল সাহেব, মানুষের পেটে ছাগলের দুধ সহ্য হয়!

গল্প বলতে বলতে নিজেই উচ্চহাস্যে ঘর ফাটান। এল্‌মহার্স্টও এই সব গল্প উপভোগ করে, এতে তার বাংলা শিক্ষা এগোয়।

ডরোথির টাকায় একটা ট্রাক কেনা হয়েছে, তাতে মালপত্র পাঠানো হচ্ছে সুরুলে। সেখান তার নিজের এবং কর্মীদের জন্য আবাস নির্মাণের কাজও চলেছে। কবির পুত্র রথীকে সে সঙ্গে পেয়েছে, রথীও কৃষি বিষয়ে শিক্ষা নিয়ে এসেছে আমেরিকা থেকে, এতদিনে তা বিশেষ কাজে লাগায়নি, এ ছাড়া রয়েছে সন্তোষ ও কালীমোহনের মতন কয়েকজন, এখানকার গ্রাম সম্পর্কে যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। সবাই মিলে তৈরি করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

এখানে মাঝে মাঝে এল্‌মহার্স্ট একটি তরুণী মেয়েকে দেখতে পায়, সে যেন সবার চেয়ে আলাদা।

সে যেন হাঁটে না, বাতাসে ওড়ে। সত্যিই সে যখন ছুটে ছুটে চলে, তার শাড়ির আঁচল ওড়ে পতাকার মতন। সে যখন কোনও গাছতলায় দাঁড়ায়, মনে হয় যেন স্থির চিত্র।

তাকে প্রায় সময় দেখা যায় কবির কক্ষে, আবার কখনও গাছতলার ক্লাসে বসে থাকে, কখনও এমনকী রান্নাঘরে। মাঠের মধ্য দিয়ে যাওয়া আসার সময় কয়েকবার এমহার্স্ট তার মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু কথা বলেনি। এ দেশীয় মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় না হলে কথা বলা যায় কিনা, তা সে জানে না। একবার একেবারে সামনাসামনি চোখাচোখি হতে এল্‌মহার্স্ট অভ্যেসবশত বলেছিল, হ্যালো। মেয়েটি উত্তর না দিয়ে শুধু তাকিয়েছিল ডাগর চোখে। এল্‌মহার্স্ট পরে ভেবেছে, হয়তো তার বলা উচিত ছিল, নমস্কার।

মেয়েটির মুখশ্রী অতি অপূর্ব তো বটেই, চমৎকার তার শরীরের গড়ন। মাঝে মাঝে সে উত্তর ভারতীয়দের মতন সালোয়ার কামিজ পরে, তখন বোঝা যায়, তার পা দুটি অনেক ইউরোপীয় রমণীরও ঈর্ষাযোগ্য। সবচেয়ে আকর্ষণীয় অবশ্যই তার দুটি চক্ষু, যেন সব সময় বিস্ময়ে ভরা, যেন সে স্বপ্নরাজ্যের অধিবাসী, এখানকার কেউ নয়।

ঠাকুর পরিবারের ক’জন এখানে থাকেন, তা এল্‌মহার্স্টের জানা হয়ে গেছে। পরিচয় হয়েছে অধ্যাপকদের সঙ্গে, তাঁদের স্ত্রীদেরও দেখেছে। কবির দু’একজন বন্ধু এখানে আলাদা বাড়ি করেছেন, মাঝে মাঝে এসে থাকেন, এ মেয়েটি কিন্তু তাঁদের কেউ নয়।

একদিন কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে এমহার্স্ট দরজার কাছে। দাঁড়িয়ে দেখল, কিছু একটা পরিহাসের পর সেই মেয়েটি আর কবি খুব হাসছেন। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে কবির কাঁধ ঘেঁষে।

এ সময় প্রবেশ করা উচিত কিনা ভেবে সে দ্বিধাগ্রস্ত হল। অবশ্য কবিই তাকে তলব করেছেন। সেই মেয়েটিই প্রথম তাকে দেখতে পেয়ে ভেতরে আসার জন্য চোখের ইঙ্গিত করল। কবি মুখ ফিরিয়ে বললেন, এসো লেওনার্ড।

শুরু হল কাজের কথা।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। বাকিটা লেওনার্ড ও তার সহকর্মীরাই শেষ করতে পারবে। শান্তিনিকেতনের আটটি ছাত্র ওখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এল্‌মহার্স্টের একটা শর্ত আছে, ছাত্রদের চব্বিশ ঘণ্টাই ওখানে থাকতে হবে, রাত্রে শান্তিনিকেতন ফেরা চলবে না। কোনও ভৃত্য রাখা হবে না। ঘর পরিষ্কার থেকে রান্নাবান্না সবই প্রত্যেককে করতে হবে নিজের হাতে। কবি কি এতে সম্মত আছেন?

কবি বললেন, অবশ্যই। রাত্রে ফেরার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। যেসব নিয়ম-কানুন ঠিক করে দেওয়া হবে, তা কেউ অমান্য করলে শাস্তি দিতে দ্বিধা কোরো না। তবে রান্নার ব্যাপারটা, আমি জানি না এরা কতখানি পারবে, হয়তো প্রথম প্রথম সাহায্যের দরকার হবে।

একটি ছাত্র সম্পর্কে এল্‌মহার্স্টের খটকা আছে। তার নাম সুবীর, সে কবির মধ্যম ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথের নাতি, সুরেন ঠাকুরের ছেলে। তার ঠাকুমা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী অতি জাঁদরেল মহিলা, এল্‌মহার্স্ট এর মধ্যেই লোকমুখে শুনেছে, এবং নাতিটি তাঁর খুব আদরের। সেও কি অন্যদের মতন সুরুলে রাত্রিবাস করবে?

এই প্রশ্ন করতেই কবি বললেন, ঠাকুর পরিবারের ছেলেরা অন্যদের থেকে আলাদা কীসে? আমার ছেলে রথী এখানকার অন্য ছাত্রদের সঙ্গেই মিলেমিশে থেকে লেখাপড়া শিখেছে।

মেয়েটি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়, এল্‌মহার্স্ট কথাবার্তা শেষ করে চলে যাবার পরেও সে এখানে থাকবে।

কিছুক্ষণ পরে কবির খেয়াল হল।

তিনি বললেন, ও তোমাদের তো ফর্মালি পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। এই বালিকাটির নাম–

রাণু চোখ পাকিয়ে বলল, বালিকা?

কবি সহাস্যে বললেন, তাই তো, কখন যে বড় হয়ে গেছে, মনেই থাকে না। ইয়াং লেডি বলা উচিত। এই ইয়াং লেডির নাম শ্রীমতী রাণু অধিকারী, আর এই তরুণ ইংরেজটি লিওনার্ড এন্মহার্স্ট, রাণু এস্রাজ বাজায় আর আমার লেখায় বিঘ্ন ঘটায়, আর এই সাহেবটি গ্রাম বাংলা সুজলা সুফলা করে দেবে।

রাণু বলল, এঁকে আমি অনেকবার দেখেছি।

এল্‌মহার্স্ট করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে নিয়েও তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে নিয়ে যুক্তকরে বলল, নমস্কার।

রাণুও নমস্কার করে জিজ্ঞেস করল, আপনি বাংলা জানেন?

এল্‌মহার্স্ট বলল, একটু একটু।

রাণু বলল, আমিও একটু একটু ইংরিজি জানি।

কবি বললেন, একজন এক ঝুড়ি ভাল আম দিয়ে গেছে। লিওনার্ড, তুমি আম খাও?

তক্ষুনি ঘরে ঢুকলেন অ্যান্ড্রুজ।

কবি বললেন, স্যার চার্লস তো ওসব ছুঁয়েও দেখেন না।

অ্যান্ড্রুজকে কবি মাঝে মাঝে কৌতুক করে স্যার চার্লস বলে সমোধন করেন। উনি পেটরোগা মানুষ, খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে খুব খুতখুতে।

তিনি দু’হাত নাড়লেন।

এমহার্স্ট বলল, আম তো অতি উপাদেয় আর স্বাস্থ্যকর ফল।

রাণু একটা পাকা আম দিল এল্‌মহার্স্টের হাতে। এল্‌মহার্স্ট সেটা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। ছুরি দিয়ে খোসা না ছাড়িয়ে খাবে কী করে।

রাণু আর একটা আম নিয়ে বলল, এই দেখুন। প্রথমে দু’হাতে আমটাকে একটু পাকিয়ে তুলতুলে করতে হয়। তারপর–

রাণু সেই প্রক্রিয়াটি দেখাতে দেখাতে তার শুভ্র দাঁতে আমটার তলার দিকের খোসা খানিকটা ছিঁড়ে ফেলল। তারপর চুষতে চুষতে এল্‌মহার্স্টের দিকে চোখের ইঙ্গিতে বলল, এরকম করুন।

এল্‌মহার্স্ট কবির দিকে তাকিয়ে বললেন, কত কিছু শেখার আছে।

অ্যান্ড্রুজের সব সময় অতি ব্যস্ততার ভঙ্গি। তিনি বললেন, গুরুদেব, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

তারপর তিনি অপর দু’জনের দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন এরা থাকলে সেই গোপন কথা বলা চলবে না।

রাণু ওঁর পেছন থেকে এমন একটা মুখভঙ্গি করল, যা দেখে এল্‌মহার্স্ট হাসি চাপল অতি কষ্টে।

রাণুই বেরিয়ে গেল আগে।

অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কবি একবার জানলা দিয়ে দেখলেন, আম্রকুঞ্জ দিয়ে এল্‌মহার্স্ট আর রাণু হেঁটে যাচ্ছে পাশাপাশি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *