১৩. সিমডেগা একটি প্রায় ঘুমন্ত নির্জন শহর

সিমডেগা একটি প্রায় ঘুমন্ত নির্জন শহর। ছাড়া ছাড়া কিছু বাড়িঘর কয়েকটা সরকারি অফিস, কিছু দোকানপাট, একটা ইস্কুল—এই নিয়ে পুরো জনপদ। মূল নগরসীমানার বাইরে আরণ্য পরিবেশে হো, ওরাওঁ বা মুন্ডাদের গ্রাম। একটিই মাত্র পাকা রাস্তা শহরের মাঝখান দিয়ে রাঁচির দিকে চলে গিয়েছে। এই রাস্তারই অপর প্রান্ত দিয়ে আমরা সিমডেগায় ঢুকলাম।

সামান্য এগিয়ে বাঁদিকে একটা মোরামে ঢাকা পথে ঢুকল গাড়ি। পথের দুপাশে বেগুনি-সাদা-কমলা ফুলওয়ালা পুটুস গাছের ঝোপ। পাহাড়ি অঞ্চলের একটা বিশিষ্ট প্রভাতী আমেজ আছে, কড়া রোদ্র উঠে তা এখনো নষ্ট হয়নি। রাস্তার ধারে টালিছাওয়া পাকা দেওয়ালের একখানা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ির সামনে এসে আমরা থামলাম। জলধর তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে হাতজোড় করে গৃহস্বামীর মত সবাইকে বলল—আসুন। বাবুরা, আসুন। থাকার ঘর সব এদিকে, ওদিকে রান্নাঘর, গোসলখানা আর ভাড়ার। আসুন–

আধঘণ্টার মধ্যে পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে তিনজনে এসে বসলাম বারান্দায় পাতা চেয়ারে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে গেল গরম চা। কোম্পানি কাজের কোনও অসুবিধা যাতে না হয় তার জন্য রান্নার লোক, ঘরদোর পরিষ্কার বা বাজার করার কর্মী সব নিয়োগ করে রেখেছে। নিজের বাড়ি গ্রামে, থাকি কলকাতার মেসে, তার তুলনায় একে রাজকীয় আরাম বলা যেতে পারে। কাজ করি বিলিতি মার্কেন্টাইল ফার্মে মধ্যমবগীয় করণিকের পদে, সেটা এমন কিছু গৌরব করে বলে বেড়াবার মত কিছু নয়। কিন্তু সদর দপ্তরের বাঁধাধরা নিয়মনীতির বাইরে এখানে এসে এই প্রথম চাকরির একটা স্বস্তিজনক মৃদু আরাম অনুভব করলাম। বাংলোবাড়ির বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছি, দুজন ওপরওয়ালার সঙ্গে সমানে সমানে আচরণ করছি, কাছে-দূরে শাল-সেগুনের সারি, নীলচে পাহাড়শ্রেণী। আঃ! সুখের আর কী বাকি রইল!

জলধর পণ্ডার পেছনে যে লোকটি ট্রে-তে করে চা নিয়ে এসেছিল, সে বিনীত মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেজকর্তা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন-তোমার নাম কী?

লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল—আমার নাম ডহরু লোহার।

বাঃ, বেশ। তুমি অনেকদিন আছ এখানে?

—আজ্ঞে, বাপ-পরদাদার সময় সময় থেকে আছি। বহুদিন হল–

জলধর বলল-এরা সব স্থানীয় লোক বাবু। চারদিকে সব পাহাড় দেখছেন না? ওই পাহাড়ের ভেতরে অনেক গ্রাম আছে। এরা সেই গ্রামে থাকে। তুমি তো মুন্ডা, না ডহরু?

ডহরু বলল—আজ্ঞে হ্যাঁ–

তার কথায় হিন্দি বাংলা ওড়িয়া এবং আমাদের অপরিচিত-সম্ভবতঃ মুন্ডারি ভাষার–মিশ্র একটা টান। জলধরকে জিজ্ঞাসা করলাম—এখানে কি বাঙালীও আছে নাকি?

–আইজ্ঞাঁ, আছে কয়েক ঘর। সবকারি অফিসে কাজ করে। আর আছে বিশ্বাসবাবু, এখানকার ইস্কুলের মাস্টারমশাই। খুব ভাল লোক, আলাপ হয়ে যাবে আস্তে আস্তে—

ভারতের যে কোনো দুর্গম প্রত্যন্ত প্রদেশের মতই সিমডেগাতেও কিছু বাঙালী এসে বাস করছে বুঝতে পারলাম। তাদের সংস্পর্শে এসে ডহরুর ভাষায় বাংলার টান লেগেছে।

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, কাপ-ডিশগুলো আবার ট্রে-তে তুলে চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে ডহরু বলল—জলধরদা, আজ সকালে আবার একটা মরা পাখি দেখলাম–

—আবার! কোথায় দেখলি?

সকালবেলা সবজি তুলতে বাগানে গিয়েছিলাম। খিড়কির দরজার একেবারে সামনে মরে পড়েছিল। আমি তুলে বেড়ার বাইরে ফেলে দিয়েছি–

—কী পাখি? সেদিনের মত কাক?

—না, শালিক। দু-চারটে পালকও ছেড়া ছিল। সব গুছিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি।

—আচ্ছা, যা এখন তুই। ডাল, ভাজি আর আন্ডার ঝোল হবে দুপুরে—

ডহরু চলে গেলে মেজকর্তা বললেন—এই পাখি মরার ব্যাপারটা কী জলধর?

—আইজ্ঞাঁ, কিছু না। পরশুদিন বাড়ির ফটকের সামনে একটা কাক মরে পড়েছিল। আর আজকে নাকি একটা পেছনের বাগানে পেয়েছে। ও কিছু না বাবু, বেড়াল-কুকুরে কামড়ে মেরেছে আর-কি। পালক ছেড়া ছিল শুনলেন তো–

কথাটা সেইখানেই তখনকার মত চাপা পড়ে গেল। কিন্তু কেন যেন এই ধরনের কী একটা ব্যাপার আমি আগে শুনেছি। সেখানে এমনই মরা পাখি দিয়ে একটা ভয়ঙ্কর অমঙ্গলের পর্ব শুরু হয়েছিল। কোথায়? কোথায়?

তারপরেই বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল তারানাথের কাছে শোনা সেই মাকালীর কৌটোর গল্প। সেখানেও চণ্ডিকাপ্রসাদ মিত্রের বাড়িতে ঢোকবার পথে মরা চড়ুই পাখি দেখে তারানাথ ভাবী অমঙ্গলের আভাস পেয়েছিল। অবশ্য–

অবশ্য সর্বদাই কোথাও পাখি মরলে সেখানে খারাপ কিছু ঘটবে এমন মনে করাটা যুক্তিসিদ্ধ নয়। পাখি তো মরেই, নইলে সমস্ত পৃথিবী পাখিতে ভরে যেত না!

কিন্তু যতই ভোলবার চেষ্টা করি না কেন, মনের কোণে চিন্তাটা রয়েই গেল। কাক বা শালিক খুব চতুর পাখি, হঠাৎ তাদের ওপর লাফিয়ে পড়ে পালক ছিঁড়ে মেরে ফেলা বেশ কঠিন কাজ।

মেজকর্তা বললেন—নির্মলবাবু, আজকের দিনটা আমরা ছুটি করি, কেমন? সকলেই ক্লান্ত, নতুন জায়গায় এসে খাপ খাইয়ে নিতেও একটু সময় লাগে। আজ শুয়ে বসে কাটিয়ে কাল থেকে কাজ শুরু করা যাবে। জলধর, যে সাইট সার্ভে হবে সেটা এখান থেকে কতদূর?

—ছাব্বিশ মাইল আই। জিপে একঘণ্টা। পাহাড়ি পথ—

–সেখানে লোজন, তবু এসব পাঠাবার কী ব্যবস্থা করেছ? কাল আমরা সাইট দেখতে যাব, পরশু বা তার পরের দিন থেকে তো গিয়ে সেখানে বাস করতে হবে

–সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। তিনদিন আগে তোক পাঠিয়ে দিয়েছি, তারা জঙ্গল কেটে সাফ করে তাঁবু খাটিয়ে রাখবে। ইচ্ছে করলে কাল থেকেই থাকতে পারেন–

মেজকর্তা বললেন—দেখি।

সারাটা দিন আলস্যে কেটে গেল। বাড়িটায় পাঁচ-ছখানা ঘর, আমি একটা আলাদা ঘর পেয়েছি। কলকাতার মেসে চারসিটের ঘরে থাকার পর এটাও আমার কাছে বড় বিলাসিতা। দুপুরে খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যখন উঠলাম তখন রোদুর পড়ে এসেছে। জলধর পণ্ডা এসে বলল—বাইরের বারান্দায় চা দিয়েছি বাবু। আর বিশ্বাসবাবু এসেছেন আপনাদের কথা শুনে। আসুন বাবু–

চায়ের টেবিলের পাশে আর একখানা বেতের চেয়ার বাড়তি পাতা, তাতে ধুতিপাঞ্জাবি পরা একজন সৌম্য চেহারার মানুষ বসে আছেন। বয়েস বছর পঞ্চাশেক হবে, কিন্তু চেহারায় প্রৌঢ়ত্ব শুরু হবার বিশেষ কোনো ছাপ পড়েনি, রগের পাশে দু-একগাছা পাকা চুল ছাড়া। চোখের চাউনিতে বিবেচনার প্রকাশ।

মেজকর্তা বললেন—এই যে, আসুন। ইনিই হচ্ছেন বিশ্বাসবাবু, যাঁর কথা আজ জলধর সকালে বলছিল। এখানকার ইস্কুলের ইংরিজির মাস্টারমশাই—

নমস্কার এবং প্রতিনমস্কারের পর বসলাম।

বাইরের প্রান্তরে আর অরণ্যে একটু একটু করে দিনাবসানের ছায়া নামছে। সকাল আর দুপুরের ঝকঝকে আলোয় যে জায়গাটা উজ্জ্বল, কবিত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছিল, এখন তারই ওপরে যেন কেমন একটা স্লান বিষণ্ণতা নেমে আসছে। কলেজজীবন থেকে কলকাতার জাঁকজমক আর বিদ্যুতের আলোর মধ্যে বাস করে অভ্যেস, সন্ধের মুখে সিমডেগার রূপ মনকে একটু দমিয়ে দিল। দুপুরে খাওয়ার সময় জলধরকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি শহরে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি, দু-একজন ধনী ব্যবসায়ী পরিবার জেনারেটর চালিয়ে নিজেদের বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো জ্বালায়।

বিশ্বাসবাবু বেশ অমায়িক আর মিশুকে মানুষ। চা শেষ করে টেবিলে কাপ নামিয়ে রেখে বললেন—অরিজিনালি আমার বাড়ি মেদিনীপুর জেলায়। পানিপারুল নাম শুনেছেন? সেই পানিপারুলে আমার জন্ম হয়। এগরা নয়তো রামনগর দিয়ে যেতে হয়। কলকাতায় রিপন কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে এখানে কাজ নিয়ে চলে আসি। এক আত্মীয় ব্যবসার সূত্রে সিমডেগায় যাতায়াত করতেন, তিনিই যোগাযোগ করিয়ে। দিয়েছিলেন। তখন স্কুল নতুন হয়েছে, শহরেরও পত্তন হয়েছে সবে। সামান্য কিছু বাড়িঘর, দোকানপাট—এই। তারপর রাঁচি জেলার সাবডিভিশন হওয়ার পর থেকে চটপট বসতি গড়ে উঠল, ব্যবসা জেঁকে উঠল—

নির্মলবাবু জিজ্ঞেস করলেন—এখানে বেশ মন বসে গিয়েছে আপনার?

—তা গিয়েছে। এখন তো এই আমার দেশ, ঘরবাড়ি—

–কেন, মেদিনীপুরে আপনার বাড়িতে কেউ নেই এখন?

—কেউ না। বাবা-মা মারা গিয়েছেন, ভাই গুজরাটে চাকরি করে আজ বিশবছর, তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ব্যস, দেশের সঙ্গে সম্পর্ক মিটে গিয়েছে। তাছাড়া কী জানেন, হৈ-হট্টগোল থেকে দূরে থাকতে থাকতে একটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। এই বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত নির্জনতা আর পাখির ডাক-মানুষের আদি বাস তো এর মধ্যেই ছিল, তাই না? সেকথা যখন ভাবি তখন কোনো কষ্ট হয় না–

মেজকর্তা নিজে একটু ভাবুক ধরনের মানুষ, বিশ্বাসবাবুর কথাগুলো বোধহয় তার ভাল লাগল। তিনি বললেন—বাঃ, আপনি তো দেখছি রীতিমত একজন কবি! সুন্দর বলেছেন–

অসিত বিশ্বাস বললেন (নামটা একটু আগে জেনেছি)–না, না, কবি নই। তবে ঈশ্বরের এই অদ্ভুত সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখতে ভাল লাগে–

তারপর কথার গতি পরিবর্তন করে বললেন–আপনারা কি কালই কাজের জায়গায় যাচ্ছেন? যান, ভাল লাগবে, খুব সুন্দর জায়গা–

—সুন্দর বলতে কী অর্থে? আপনি গেছেন সেখানে?

—অনেকবার। এখান থেকে কাঠ-ব্যবসায়ীদের লরি যায়, তাতে চড়েই গিয়েছি। সুন্দর মানে রামরেখা পাহাড়ের রূপ দেখলে আপনারা মোহিত হয়ে যাবেন। নিবিড় জঙ্গল পাহাড়ের ঢালুতে, কোথাও জনমানব নেই, এত নিস্তব্ধ পরিবেশ যে পাতা খসে পড়ার শব্দ শুনতে পাবেন। সারাজীবন ধরে গল্প শোনাবার মত জায়গা–

মেজকর্তা একটু কী ভেবে বললেন—অসিতবাবু, আপনিও কাল চলুন না আমাদের সঙ্গে। প্রিয় জায়গায় আপনারও আর একবার বেড়ানো হয়ে যাবে, আমরাও একজন ভাল ভ্রমণসঙ্গী পাব। যদি খুব জরুরী কাজ না থাকে তাহলে–

অসিতবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বোঝা গেল বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন। আমি বললাম–চলুন না, আমার তাবুতে দুজনে ভাগাভাগি করে থাকা যাবে–

অসিতবাবু বললেন—বেশ তো, তাই হবে তাহলে। সামনের দু-দিন ইস্কুল ছুটি আছে, দরকার হলে আরও বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। ছুটি তো নেবার দরকার হয় না, জমে জমে পচে যাচ্ছে—

আমি মনে মনে পুলকিত হয়ে উঠলাম। মেজকর্তা আর সার্ভেয়ার সাহেব দুজনেই লোক ভাল, আমার সঙ্গে অত্যন্ত দ্র ব্যবহারও করছেন। কিন্তু হাজার হলেও তারা আমার ওপরওয়ালা, একেবারে খোলা মনে কাঁধে হাত রেখে কথাও বলা যায় না, পুরোপুরি সহজ হতেও বাধোবাধো ঠেকে। বিশ্বাসবাবু কবিপ্রকৃতির লোক, মাস্টারমশাই—ইনি সহজেই বন্ধু হতে পারবেন।

–কাল কখন রওনা হচ্ছেন আপনারা?

মেজকর্তা বললেন—সকাল আটটা নাগাদ। আপনি সাতটায় চলে আসুন, একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরুনো যাবে–

অসিতবাবু সম্মতি জানিয়ে যাবার জন্য উঠলেন। বললাম চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

অসিতবাবু হেসে বললেন–আমাকে? আপনি তো এখানে নতুন লোক, ফেরবার সময় আবার আপনাকে পৌঁছে দিতে আমাকে না আসতে হয়। তা চলুন, মন্দ কী? টর্চ নিয়ে নেবেন একটা, ফেরবার সময় পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসবে।

গোধূলির শেষ পর্যায়। পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্যাস্তের রঙ প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে। পাশ রাস্তায় উঠে কিছুদূর হেঁটে আবার বাঁদিকের কাচা পথে নামলেন বিশ্বাসবাবু। ওদিক থেকে কে যেন আসছে আমাদের দিকে, সাদা আলখাল্লার মত পোশাক পরা, লম্বা-চওড়া মানুষ। কাছে আসতে অসিতবাবু হাতজোড় করে বললেন-নমস্কার ফাদার। ভাল আছেন?

এবার বুঝলাম মানুষটি বিলিতি সাহেব, প্রায় সাড়ে ছ-ফিট লম্বা। পরণে ক্রীশ্চান ধর্মযাজকের পোশাক। তিনি নমস্কার করে বললেন—ভাল আছি। ইনি কে?

আলাপ করিয়ে দিয়ে অসিতবাবু বললেন—ইনি কলকাতা থেকে মাসখানেকের জন্য এসেছেন অফিসের কাজে, উঠেছেন নাথমল শরফের বাংলোতে। আর ইনি হচ্ছেন ফাদার ও’ব্রায়েন, এখানকার সেন্ট বার্থোলোমিউ ক্যাথলিক চার্চের যাজক–

—যাজক বোলো না, বিশ্বাস, যাজক বোললা না। বল ঈশ্বরের কর্মী–

ও’ব্রায়েনের কণ্ঠস্বর মৃদু এবং ব্যক্তিত্ব-উষ্ণ। তিনি বললেন—আচ্ছা, চলি। আবার দেখা হবে।

হাঁটতে শুরু করে টর্চ জ্বালতেই পথের একপাশে চোখ পড়ে আমার মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল। সেদিকে তাকিয়ে অসিতবাবুও বলে উঠলেন—আরে! এটা কী?

রাস্তার ঠিক ধারেই একটা ছাতারে পাখি মরে পড়ে আছে!

ও’ব্রায়েন আমাদের কথা শুনতে পেয়ে আবার ফিরে এলেন। কী হল? কী হয়েছে? তারপর টর্চের আলোকবৃত্তির মধ্যে মরা পাখিটাকে দেখতে পেয়ে বললেন-আঃ, পুওর ক্রিয়েচার! বেশিক্ষণ না, একটু আগেই বেচারা মারা পড়েছে—

বললাম-কী করে বুঝলেন ফাদার?

ও’ব্রায়েন বললেন-বেশি আগে হলে কুকুরে কিম্বা শেয়ালে টেনে নিয়ে যেত। পাখির মৃতদেহ দেখলে আমার বড় খারাপ লাগে। জানেন, আমরা যারা ক্রীশ্চান ধর্মে দীক্ষিত, তারা পাখিদের দেবতার দূত বলে মনে করি। উইং অ্যাঞ্জেল–

এটা অবশ্য জানতাম না। বললাম-তাই নাকি?

-হ্যাঁ। সেন্ট ফ্রানসিস অফ আসিসির কথা জানেন তো? যাঁর নামে ব্রাদারহুড অফ দি ফ্রানসিসকান অর্ডার গড়ে উঠেছিল? তাঁর মৃত্যুর সময় পাখির দলের ছদ্মবেশে দেবদূতরা এসেছিলেন তাঁর আত্মাকে স্বর্গে নিয়ে যেতে। পাখি মারা গেলে আমার বড় খারাপ লাগে–

বললাম—এখানে কিন্তু খুব পাখি মরছে। কোনো রোগ বা কিছু ওদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েনি তো?

অসিতবাবু সকালে জলধরের সঙ্গে আমাদের আলোচনার ব্যাপারটা জানতেন না। তিনি অবাক হয়ে বললেন—আপনি কী করে জানলেন? আপনি তো আজ এসেছেন–

—আজ সকালে জলধর বলছিল। আমরা যেখানে আছি, সেই বাড়িটার পেছনের বাগানে, বেরুবার গেটের সামনে নাকি পরপর দুদিন দুটো মরা পাখি পাওয়া গিয়েছে মা আমার কথা শুনে ফাদার ও’ব্রায়েন কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন—তার মানে এটা নিয়ে তিনটে হল। আরো হয়ত এদিক-ওদিক মরেছে, আমাদের কাছে খবর নেই। ভেরি, ভেরি ব্যাড ওমেন! জানতাম না এমন শুরু হয়েছে–

অসিতবাবু বললেন—আপনি কি এর আগে এরকম ঘটতে দেখেছেন?

—দেখেছি, একবার। বছর দশ-বারো আগে। তারপরেই স্মল-পক্সের মহামারী শুরু হয়। মনে আছে সেই এপিডেমিকের কথা? তখন তো আপনি এখানে এসেছেন–

বিশ্বাসবাবু বললেন-মনে আছে। কিন্তু এপিডেমিকের আগে পাখি মরার ব্যাপারটা জানতাম না!

ফাদার বললেন—যাই হোক, ঈশ্বর সব দুর্যোগ কাটিয়ে দেবেন। অপশক্তি যত বড়ই হোক, ঈশ্বরের শুভশক্তি তার চেয়েও বড়। আমি আজ থেকেই প্রার্থনা করব সকলের ভালোর জন্য–

ফাদার লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁর দীর্ঘ চেহারা টর্চের সংক্ষিপ্ত আলোকবৃত্তের বাইরে মিলিয়ে এল। একটু এগিয়েই অসিতবাবুর বাড়ি, ভদ্রলোক বললেন—আসুন না ভেতরে, একটু বসে যান—

—নাঃ, আজ নয়। একটু কাজকর্ম বুঝে নিতে হবে কালকের জন্য। পরে একদিন বরং–

বাংলোতে ফেরবার পথে মনের ভেতর সকালের সেই প্রফুল্ল ভাবটা আর খুঁজে পেলাম না।

 

রাত্তিরে ভালই ঘুম হল। আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভেঙে বাইরের বারান্দায় এসে দেখলাম, কোথাও আশঙ্কার কোনো কালো ছায়া নেই, সব ঝকঝক করছে সকালের আলোয়। সার্ভে করার জিনিসপত্র, কুলিদের হাতিয়ার, আমাদের বাক্স-বিছানা, সবার জন্য রসদপত্র আর কুলিরা যাবে বলে এবার জিপের সঙ্গে একটা লরিও যাচ্ছে। কুলিদের মধ্যে কিছু আগে চলে গিয়েছে, কিছু পথে একটা গ্রাম থেকে উঠবে। লরি এর মধ্যেই এসে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ডহরু আর হলধর মিলে মালপত্র তুলছে। বেশ একটা সাজো সাজো ভাব।

স্নান সেরে বারান্দায় এসে দেখি মেজকর্তা আর সার্ভেয়ার সাহেবও তৈরি। ডহরু পুরি আর আলুর তরকারির থালা এনে টেবিলে রাখছে। আমাকে দেখে মেজকর্তা বললেন— আসুন, বসে যান। একেবারে হাতে-গরম পুরি। এই তো অসিতবাবুও এসে গিয়েছেন–

সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। কাঁটায় কাঁটায় আটটায় রওনা হওয়া গেল।

জিপ আগে চলেছে, পেছনে লরির। কারণ লরি আগে গেলে যে পরিমাণ লাল ধুলো উড়বে, তাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে, জামাকাপড়ের কথা বাদই দিলাম।

অসিত বিশ্বাস বললেন—যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেই রামরেখা জায়গাটা বিহার, উড়িষ্যা আর মধ্যপ্রদেশের সীমান্ত ছুঁয়ে আছে। একটা ঝরণা আছে খুব সুন্দর, অবশ্য এখন তাতে কতটা জল আছে জানি না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জঙ্গলে ঘুরবেন, ভাল লাগবে।

রাস্তা কখনো উঠছে, কখনো নামছে। এক জায়গায় একটা তিনমাথার মোড়, আমরা সোজা চললাম। বিশ্বাসবাবু বললেন—বাঁদিকের পথটা গিয়েছে ছিন্দা নদীর ধারে কোঘাঘ নামে একটা জায়গায়। ছোট্ট নদী, কিন্তু বর্ষায় তার ভয়ঙ্কর রূপ হয়। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে নদীতে ফ্ল্যাশ ফ্লাড আসে। নিয়ে যাব এখন আপনাকে একদিন।

—আর ডানদিকের পথ কোথায় গেল?

-ওটা আবার ঘুরে শহর ছাড়িয়ে কোলেবিরার কাছে রাঁচি যাবার পাকা রাস্তায় পড়েছে। কোলেবিরা থেকে আপনি গুগুমলা, লোহারডাগা হয়ে রাঁচি যেতে পারেন, কিম্বা খুঁটি হয়েও যেতে পারেন। তবে খুঁটিত হয়ে গেলে রাস্তা অনেকটা কম পড়লেও ওদিকে আজকাল নানা গোলমাল চলছে বলে সবাই ঘুরপথেই রাঁচি যায়।

—কী গোলমাল?

—ওদিকে মুন্ডারা বিদ্রোহ করেছে। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে তারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পরিবেশ ঠাণ্ডা থাকলে ওই পথে আপনাকে কোয়েল নদী দেখিয়ে আনতাম।

 

মাইল দশ-বারো গিয়ে সাম পাহাড়টোলি নামের একটা গ্রামে জিপ আর লরি থামল। এখান থেকে কুলিরা উঠবে। জলধর পথের পাশের গ্রাম থেকে তাদের ডেকে আনতে গেল।

আমি জিপের পেছন দিয়ে নেমে হালকা হবার জন্য পথ থেকে জঙ্গলে ঢুকলাম। বিশ্বাসবাবু ডেকে বললেন—কোথায় চললেন, ও মশাই?

পেছন ফিরে হেসে বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা দেখালাম।

কয়েক পা হেঁটেই চোখে পড়ল একটা শালগাছের গোড়ায় পড়ে থাকা দুটো মরা ঘুঘু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *