ইয়াজউদ্দিন সাহেব ঠিক করে রেখেছিলেন সারা দিন ঘরেই কাটাবেন। রাতে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়াতে যাবেন। বন্ধুবান্ধবের বাসায় নয়। তেমন কোনো বন্ধুবান্দব তাঁর নেই। গাড়িতে উঠে বসবেন—ড্রাইভারকে বলবেন, ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে ধরে খানিকক্ষণ যাও। অতি দ্রুত রাস্তায় খানিকক্ষণ ঘুরলে ভালো লাগে। মানুষের জন্মই হয়েছে দ্রুত চলার জন্যে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে না। গাছ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। মানুষ গাছ নয়।
তিনি অপেক্ষা করছেন টেলিফোন কলের জন্যে। রফিকের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি খবর পেয়েছেন, তারা হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছে। তিনি কথা বলতে চান মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। ব্যবস্থা করা হয়েছে।
টেলিফোন বাজছে।
তিনি রিসিভার কানে ধরলেন। মৃদু গলায় বললেন, কে কথা বলছেন?
স্যার আমি–আমি মনিরুজ্জামান।
কী ব্যাপার? স্যার, আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি, আমি…
ঠিক আছে, আপনাকে ক্ষমা করা হলো—ঐ মেয়েটির যদি কোনোরকম সমস্যা হয়…
স্যার, কোনো সমস্যা হবে না।
গুড।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। মুন ইজ ডাউন বইটির শেষ পাতাটা পড়া বাকি ছিল। শেষ পাতা পড়লেন। বইটা তার ভালো লাগেনি। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো শেষ পাতায় নতুন কিছু বলা হবে। তাও না। বইটিতে এমন এক জগতের কথা বলা হয়েছে, যে জগতের অস্তিত্ত্ব আছে শুধুই কল্পনায়। বাস্তব পৃথিবী এমন নয়। বাস্তব পৃথিবীতে মনিরুজ্জামানরা বাস করে। শুভ্র এই সত্যটা কখন বুঝবে? যদি বুঝতে পারত তাহলে এই বইটি ডাস্টবিনে ফেলে দিত। তার নিজের সেরকমই ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু শুভ্র বই তাকে দিয়েছে জন্মদিনের উপহার হিসেবে। অসম্ভব সুন্দর একটি বাক্য লিখে দিয়েছে। এত সুন্দর কথা লেখা একটা বই তিনি দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে শুভ্রর প্রসেসমেন্ট ঠিক নয়। তিনি আদর্শ মানুষ নন। একজন আদর্শ মানুষ কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারে না। আমাদের প্রফেট আদর্শ মানুষ ছিলেন। তাঁর ছিল দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা।
আচ্ছা, শুভ্ৰ কি আদর্শ মানুষ হবে? যদি হয় একদিন তারও তো তাহলে দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা হবে। তিনি কি তা সহ্য করতে পারবেন? কিন্তু তিনি চান শুভ্র আদর্শ মানুষ হোক। শুভ্রর যে রাতে জন্ম হলো সে রাতে তিনি বড় ধরনের একটা অন্যায় করে বিশাল অঙ্কের টাকা গেলেন। ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে হাসপাতালে গেলেন ছেলেকে দেখতে–আহা, কী সুন্দর, কী ফুটফুটে ছেলে। নবজাতক শিশু হাসতে পারে না, কিন্তু তিনি পরিষ্কার দেখলেন যে, ফুলের মতো শিশু তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল। হয়তো তার চোখের ভুল। হয়তো তাঁর কল্পনা। কিন্তু তিনি দেখলেন। নার্স বলল, বাচ্চা কোলে নেবেন?
তাঁর হাত অশুচি হয়ে আছে। এই অশুচি হাতে বেহেশতের ফুল স্পর্শ করা যায় না। তবু তিনি দুহাত বাড়িয়ে বললেন–দিন। আমার কোলে দিন।
বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে তিনি তার নাম রাখলেন-শুভ্ৰ। তিনি মনে মনে বললেন-আমার এই ছেলেকে যেন পৃথিবীর কোনো মালিন্য, কোনো নোংরামি কখনো স্পর্শ না করে-সে যেন তার নামের মতোই হয়।
আচ্ছা, শুভ্ৰ কি পারবে? নিশ্চয়ই পারবে। কেন পারবে না? সৎ প্রবৃত্তি নিয়েই মানুষ জন্মায়। চারপাশের মানুষ তাকে অসৎ করে। তিনি শুভ্রকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছেন। পৃথিবীর কোনো মালিন্য শুভ্রের কাছে ভিড়তে দেন নি।
তিনি কোটি কোটি টাকা শুভ্রের জন্যে রেখে যাচ্ছেন। টাকার পরিমাণ কল্পনার উপরে। এই অর্থ সৎ অর্থ নয়। শুভ্ৰ এই অৰ্থ দিয়ে কী করে তা তার দেখার ইচ্ছা। মৃত্যুর পর কোনো—একটা জগৎ যদি সত্যি থাকে তাহলে সেখান থেকে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখবেন।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব গাড়ি বের করতে বলে স্ত্রীর খোঁজে গেলেন। নিশিরাতে হাইওয়েতে ছুটে বেড়ানো রাহেলার পছন্দের কর্মকাণ্ডের একটি নয়। তিনি হয়তো যেতে চাইবেন না।
রাহেলার ঘর অন্ধকার। তিনি বাতি জ্বালালেন। অন্ধকার ঘরে খাটের ঠিক মাঝখানে জবুথবু হয়ে রাহেলা বসে আছেন।
কী হয়েছে?
রাহেলা ক্ষীণ গলায় বললেন, কিছু না।
ঘর অন্ধকার করে এভাবে বসে আছ কেন?
আমার শুভ্রের জন্যে খুব খারাপ লাগছে।
আবার দুশ্চিন্তা করছ?
রাহেলা ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, একদিন তুমি, আমি আমরা কেউ থাকব না। আমার এই ছেলের চোখ নষ্ট হয়ে যাবে। কে তখন দেখবে আমাদের শুভ্ৰকে?
ইয়াজউদ্দিন সাহেব স্ত্রীর কাধে হাত রেখে বললেন, চলো, ঘুরে আসি। ১০০ কিমি স্পিডে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালাব। আমি চালাব, তুমি বসে থাকবে পাশে। আর শোনো রাহেলা—যা হবার তাই হবে—কে সারা সারা।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
এখনো জানি না কোথায়। আগে চলো গাড়িতে উঠি।
আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।
তোমার শরীর ঠিকই আছে। আসলে তোমার মন ভালো নেই। গাড়িতে উঠলেই তোমার মন ভালো হতে শুরু করবে। মন ভালো হয়ে গেলেই শরীর ভালো লাগতে শুরু হবে।
ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। ইয়াজউদ্দিন সাহেব এক্সিলেটারের চাপ ক্রমেই বাড়াচ্ছেন। রাহেলা বসে আছেন মূর্তির মতো। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, তোমার কি ভয় লাগছে রাহেলা?
রাহেলা যন্ত্রের মতো বললেন, না।
গুড। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো কত সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদটাও ছুটছে আমাদের সঙ্গে। দেখছ?
হুঁ।
তোমার কি মনে হয়। হাত বাড়ালেই চাঁদটাকে ছোঁয়া যায়?
রাহেলা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে?
ইয়াজউদ্দিন সাহেব গাড়ির স্পিড আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিলে বললেন, আমি কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলি নি।
তাহলে বলো, শুভ্ৰ আর কতদিন পরে চোখে দেখতে পাবে? ডাক্তারের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে। তুমি এটা জানো। আমাকে বলো।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব গাড়ির গতি কমিয়ে একসময় গাড়ি থামিয়ে ফেললেন। যতদূর দৃষ্টি যায়—ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের মাথার উপর বিশাল চাঁদ। ইয়াজউদ্দিন সাহেব গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, রাহেলা, তুমিও নামো।
তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও নি। জবাব দাও।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে প্রশ্নটা শুনতে পান নি। রাহেলা গাড়ির ড্যাসবোর্ডে মাথা রেখে কাঁদছেন।