১৩. সাগরের ডাকে আবার

সাগরের ডাকে আবার বুঝি চঞ্চল কদম।

কদম বলে, এবার যেতে হয়রে। জিনিসগুলো গুছিয়ে দে।

নবিতুনের মনে হয়, ধড়াস করে কলজেটাই যেন খসে পড়ল ওর বুক থেকে। কদমের দিকে চোখটা তুলেই নামিয়ে নিল নবিতুন।

চাটাই বুনছে ওরা। এক পাশে কদম। অন্য পাশে নবিতুন। চটপট আঙুল চলছিল নবিতুনের। হঠাৎ আঙুলের নাচনটা ওর থেমে গেল। বেলোয়ারি চুড়ির ঝংকারটাও।

কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যই। আবার ওর আঙুল নাচে। বেলোয়ারি চুড়ি বোল ছাড়ে টুনুকি ঝুনুকি। বিকেলের এক চিলতে রৌদ্র পড়ে চিকিমিকি খেলে নকল সোনার রুলি। নবিতুনের আঙুল তো নাচে না, চেরা বেতের মতো পাতলা আর সরু সরু করে কাটা পাটিপাতার ছিলকেগুলোকে নিয়ে যেন ঝড় তোলে নবিতুনের আঙুল।

চেরা চেরা পাটিপাতা বেত। চিকন কালো গাঢ় সবুজ ওদের গা। নবিতুনের আঙুলের ছোঁয়ায় প্রজাপতির ডানার মতো ফরফর বাতাসে কেটে যায় ওরা। সিদা সিদা। আড়াআড়ি। ঘরের পর ঘর পড়ে। হেসে ওঠে চাটাইর মসৃণ বুনোট।

কাছেই বসে আছে আককি। ছেনি দিয়ে চিকন চিকন করে কেটে গুছিয়ে রাখছে পাটিপাতা বেত। হাত বাড়িয়ে দুটো গোছ টেনে নিয়ে আবার আঙুল চালায় নবিতুন।

ও পাশে পিছিয়ে পড়ে কদম।

 বাচ্ছা ধীরুয়া তুমি। ধমক ছাড়ে নবিতুন। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে বেতের ধারাল কিনারে আঙুল কাটে কদম। বুঝি রক্তও ঝরে একটু। তবু নবিতুনের সাথে তাল রাখতে চেষ্টা করে কদম। আড়চোখে তাকায় নবিতুনের দিকে। ওর যাবার কথাটা গায়েই মাখবে না, এটাই যেন ঠিক করে নিয়েছে নবিতুন।

কামাই করে যা এনেছিলাম সে তো ফুরোতে চলল। এবার যে যেতে হয়। আবারও বলল কদম।

কেন, কেন, যেতে হবে শুনি? দেশে-গেরামে কি কামাই নেই? এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল নবিতুন।

কদম জানে এর পরই আসবে জমির কথা, গেরস্তির কথা। কদম বলবে, হাতে যা রয়েছে তাতে কি আর জমি কেনা যাবে। সামনের বার না হয় দেখা যাবে। নবিতুন বলবে– বর্গা নাও, ক্ষেতের কাম করো। কদম বলবে– আমার সয় না। নবিতুন বলবে– না সইলে থাক ক্ষেতের কাম। রোজ একখানা করে চাটাই বুনবো আমি। পাটি বুনবো, হাটে হাটে বেচে আসবে তুমি। লা জবাব হওয়া ছাড়া তখন আর উপায় থাকবে না কদমের। এত কথার ভেতর না গিয়ে যেন একটু শক্ত হলো কদম। বলল, দেখ আট মাস হয়ে গেল। আর থাকা যায় না। এই চান্দের বাকি আর তিনটে দিন। সামনের পয়লা চান্দেই রওনা দেব। কদম বুঝি ওর সিদ্ধান্তটাই জানিয়ে দিল নবিতুনকে।

আবারও বুঝি টিপ করে ওঠে নবিতুনের বুকটা। উঠে দাঁড়ায় নবিতুন। ওর দিকের বুনুনিটা শেষ, কদম এখনও দুহাত পিছিয়ে।

চোখ কি নেই তোমার? কিছুই কি দেখ না? স্বরটা কেমন ভেজা নবিতুনের। গলাটা বড় ভার।

কিছুই কি দেখে না? চোখ কি নেই তোমার? যেন কদমকে দেখবার জন্য কদমের চোখের সুমুখে নিজেকে তুলে ধরল নবিতুন। নিজেকে মেলে ধরল।

কদম দেখল, একটু যেন অবাক হয়েই দেখল। তারপর নিচু করে নিল মাথাটা। বলল, আচ্ছা, তদ্দিন থাকব।

মুহূর্তে রাগ ক্ষোভ অভিমান সবই যেন গলে গেল নবিতুনের। ফিক করে হেসে দিল, খুশি আর সোহাগের সময় হাসে ও।

কদমও হাসে আর চেয়ে থাকে নবিতুনের দিকে কেমন বোকার মতো। আস্তে করে ওকে ঠেলে দিয়ে ওর জায়গাটিতে বসে পড়ে নবিতুন। পাটিপাতা বেতের গোছাটা তুলে নেয় হাতে।

এবার ছেলে হবে, আমি বলে রাখলাম। সরে গিয়ে বলল কদম।

ছিঃ। লজ্জায় বুঝি ঘোমটা টানে নবিতুন। দাঁত কিড়মিড় করে শাসায় কদমকে, এক হাত দূরে যে বসে আছে মেয়েটা, সে কি চোখে পড়ে না কদমের? জিব কেটে আর একটু সরে যায় কদম। মাটিতে বসে বসে দেখে নবিতুনের হাতের কারিগরি, আঙুলের খেলা।

ছেলের মুখ দেখবে বলে যাবার দিনটা পিছিয়ে দেয় কদম।

নবিতুন চাটাই বোনে। হাটে গিয়ে বেচে আসে কদম। চাটাইয়ের দাম আছে বাজারে। মাঝারি রকমের– দুটাকা আড়াই টাকা। ভালগুলো তিন সাড়ে তিন। সময় সময় চার টাকাতেও ওঠে।

রোজগারের টাকা হাতে থাকলে খরচ হয়ে যাবে বলে ধান কিনেছে কদম। দুজনে মিলে সে ধান ভেনে চালগুলো মটকায় তুলে রেখেছে।

হিসেব-টিসেব করে কদম বলেছে, এদিক সেদিক দিয়ে থুয়েও তোদের মায়ের-ঝিয়ের পাঁচ মাসের খোরাক। আমি যাবার আগে এক মুঠ চালও ছুঁবি না ওখান থেকে।

ঘাড় নেড়ে নবিতুন বলেছে, হ্যাঁ।

কিন্তু, কদমের সেই মনের ধন্দটা? তার যে এখনো নিষ্পত্তি হলো না। ভেতরটা যে এখনো পাক খেয়ে ওঠে!

পাটি বেঁচতে হাটে যায় কদম। পিয়লগাছার বাজারে গিয়ে একসময় গল্প জমাতে হয়, কখনোবা পিটিয়ে আসে দুহাত তাস। আর শোনে অনেক কথা।

সেসব কথার কোনটাই পুরাপুরি নয়, সবটাই আধাআধি। সেই যে লুন্দর শেখ বলেছিল, বৌটার ওপর নজর রাখিস, তেমনি।

সেসব কথা খোলাসা নয় স্পষ্ট নয়। সবই যেন বাঁকা ইঙ্গিত, পোস্টমাস্টারের হুমটার মতো।

এত যে চিঠি লিখল কদম, কোথায় গেল সেসব চিঠি? নবিতুন চিঠি দিয়েছে, এতেও এখন নিঃসন্দেহ কদম। নবিতুন কিছু বলেনি। কিন্তু আককি আর শরবতি, কথায় কথায় ওদের কাছ থেকে জেনেছে কদম– চৌধুরীবাড়ির ছোট বৌকে দিয়ে কম চিঠি লেখায়নি নবিতুন। কদম কেন পেল না সেসব চিঠি? ঘরের জিনিসগুলোইবা কেন বিক্রি করেছিল নবিতুন? প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর খুঁজে পেল না কদম।

এসবের উত্তর প্রশ্ন উঠেছে নবিতুনকে নিয়ে।

ধন্দটা শুধু গিট প্যাঁচায় না, ঘোঁট পাকায় না, ধন্দটা অস্থির করে তুলেছে কদমকে। তাই একটু যে মেল মজলিশ আর বাজারে যেতে শুরু করেছিল ও সেটাও কমিয়ে দিল।

দাওয়ায় বসে থাকে কদম। আর কেমন করে তাকায় নবিতুনের দিকে। কখনো চোখ পাকিয়ে, কখনো বিরক্তির সাথে। কদম কথা বলে না আগের মতো। কদম চাটাই বুনতে বসে না নবিতুনের পাশে।

এসব লক্ষ্য করবার সময় কোথায় নবিতুনের। নবিতুন মশগুল যে আসবে, যে আসছে ওকে নিয়ে। কদম বলেছে, ছেলে হবে এবার। নবিতুন সেটা বিশ্বাস করে নিয়েছে। ছেলে হলেই যে সুখী ও। আককি চলে যাবে পরের বাড়ি। ছেলেকে নিয়ে চমৎকার দিন কাটবে নবিতুনের।

যে আসবে, যে আসছে তার কথাটা ভাবতে গিয়ে খুশিতে ভরে যায় নবিতুনের মনটা। গোটা শরীরময় যে কথা কয়ে ওঠে সেই খুশিটা। এ এমন এক খুশি পৃথিবীর কোন খুশির সাথেই যার তুলনা হয় না। খুশির সুমুখে সারেং লোকটা যেন একান্তই গৌণ।

তবু কখনো-কখনো নজরে পড়ে যায় বৈকি, গালে হাত দিয়ে বসে আছে সারেং। নবিতুন শুধায়, কি হলো তোমার?

কদম এমন চোখে তাকায় যার অর্থ– তুই কি কিছুই শুনছিস না, কিছুই দেখছিস না? নবিতুনকে যেন ছোঁয়-ই না সে দৃষ্টি। কে কি বলল সেটা শোনার জন্য ভারি বয়ে গেছে ওর, এমনই একটি ভাব করে চলে যায় নবিতুন। আর কদমের মনে সব কিছু গিট প্যাঁচিয়ে, ঘোঁট পাকিয়ে অস্থির করে তোলে ওকে। নিজের কাছে আর লুকোতে পারে না কদম, গভীর সন্দেহ বাসা বেঁধেছে ওর মনে।

মাত্র এক মাসের জন্যে সদরে গিয়ে পাক্কা ছয় মাস কাবার করে এলো লুন্দর শেখ।

লুন্দর শেখ বলে, এ কি যে সে মামলা? সদরের লাগ সেই যে ভাটিয়ার টেক? বছরে যে টেকার মাছ রপ্তানির মুনাফা ফেলে ছড়িয়েও দুলাখ! সেই টেক নিয়েই তো মামলা আর মামলাটা কি চুনোপুঁটির সাথে? যাকে বলে চন্দনপুরার দেওয়ান, সেই দেওয়ানের সাথে। তা এবার এক্কেবারে ফয়সালা করে এলাম। এক হাত দেখিয়ে এলাম দেওয়ানদের। তাই তো ফিরতে এত দেরি।

বিরোধী পক্ষ বলে অন্য কথা। তারা বলে, আরে মিঞা, তোমরাও কি পাগল হলে? বিশ্বাস করো ওই মিথ্যাটার কথা? ব্যাটা বাটপাড় ঠগিবাজ। আজ একে ঠকাচ্ছে কাল ওর মাথা ফাটাচ্ছে। পরশু জবরদখল করছে আর একজনের হক জমি। কত মামলা যে ঝুলে আছে ওর বিরুদ্ধে তার কি কোন হিসাব আছে? তা বা হাতের কেরামতিতে কদ্দিন আর পার পাওয়া যায় বলো? ছয়টি মাস জেলখানার ঘানি টেনে এসে এখন যত চালবাজি।

 চন্দনপুরার দেওয়ানদের এক হাত অথবা দুহাত দেখিয়ে আসুক অথবা চিটিংবাজির মামলা জেলখানায় ঘানি টেনে আসুক লুন্দর শেখ, তাতে কদমের কিছু যায় আসে না। লুন্দর শেখ বলছিল, ফিরে এসে হবে সব কথা সেই সব কথা না শুনে স্থির হতে পারছে না কদম। তাই ছুটে এলো ও।

কিন্তু লুন্দর শেখের মুখেও সেই আধাআধি কথা, পুরো কথা নয় একটিও। সেই ছমাস আগে সদরে যাবার সময় থেকে ধন্দে ফেলে গেছিল কদমকে তেমনি সন্দেহ আর ধন্দ জাগাল একটি কথার অংশ, একটি ইঙ্গিত, পোস্টমাস্টারের হুমটার মতো।

প্রথমে এ-কথা সে কথা নানা কথা হলো। বিরোধী পক্ষের আদ্যশ্রাদ্ধ করল লুন্দর শেখ। আসল কথার পর লুন্দর শেখ চটি জুতোর ভেতর পা গলিয়ে দিল! চেয়ার থেকে পা তুলল। অন্দর বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

কদমও দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে যেন মরিয়া হলো। মরিয়া হয়েই বলল, মামুজান, কি সব কথা বলবেন বলেছিলেন? যখন ধনী ছিল না লুন্দর শেখ, হাল চষত নিজ হাতে সেই তখন থেকেই লুন্দর শেখ গ্রাম সুবাদে কদমের মামুজান।

ঘাড় ফিরিয়ে কদমকে দেখল লুন্দর শেখ। কদমের মনে হয় ওই দেখাটা যেন কেমন আশঙ্কা জাগানো ইঙ্গিতভরা।

এখন তো বড় তাড়া আমার। আসিস আর একদিন। অন্দর মহলের দিকেই রওনা দিল লুন্দর শেখ। কি যেন ভাবল। ভাবতে ভাবতেই থেমে গেল। শুধাল, বৌটার ওপর নজর রেখেছিলি তো? বুঝলি কিছু? কি বুঝবে কদম? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কদম।

লুন্দর শেখের ঠোঁটের কিনারে বাঁকা হাসি, চোখের ঠারে সেই বাঁকা ইঙ্গিত, যা কি এক ভয় আশঙ্কা আর সন্দেহ হয়ে শুধু পাক খায় কদমের মনের ভেতর। উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না লুন্দর শেখ। যেতে-যেতে বলে, আসিস আর একদিন।

কিছু ভালো লাগে না কদমের। দাওয়ায় বসে গালে হাত রেখে ও শুধু ভাবে কি বলতে চায় লুন্দর শেখ। সব কথা শুনে একটু থির হবে বলেই কদম গেছিল লুন্দর শেখের কাছে। কিন্তু মনের ভেতর আরো অনেক সন্দেহ অনেক অস্থিরতা নিয়ে ফিরেছে ও। আর ফিরে সেই অবধি বসে আছে দাওয়ায়।

কতক্ষণ যে বসে আছে সে খেয়াল নেই কদমের। খেয়াল হলো যখন তেষ্টায় গলা ওর শুকিয়ে এসেছে। পানি চেয়ে নবিতুনকে ডাকল কদম। সাড়া নেই নবিতুনের।

কদমের মনে হলো অনেকক্ষণ ধরেই যেন দেখছে না নবিতুনকে। ঘরের ভেতর উঁকি দিল কদম। ঘরে নেই নবিতুন। হয়তো পাতা কুড়োচ্ছে। তাই ঘরের পেছনে ডাঙার দিকে এলো কদম। না, সেখানেও নেই নবিতুন। আককিটাইবা গেল কোথায়? জোরে জোরে দুবার ডাকল কদম। পাত্তা নেই আককির। কিন্তু মুখ ঘুরাতেই নবিতুনের পাত্তা পেয়ে গেল ও। সারেংবাড়ির উত্তরের সীমানায় যে গড় সেই গড় থেকে পাতা মচমচিয়ে উঠে আসছে নবিতুন। কদমকে দেখে কি এক লজ্জায় ঘোমটা টেনে দিল নবিতুন। মুখে ওর শরমের আবির।

হঠাৎ। হঠাৎ মনের যত ধন্দ যেন মিটে গেল। যত প্রশ্ন যত সন্দেহ সবই যেন স্পষ্ট হয়ে গেল, সবই পরিষ্কার হয়ে গেল। কোন সংশয় নেই কদমের– কোথায় গেছিলি? রূঢ় আর কঠিন স্বর কদমের।

প্রশ্নের ধরনটা ভালো লাগল না নবিতুনের। মিনিটখানিক কদমের মুখের দিকে চেয়ে রইল ও। বলল, চৌধুরীবাড়ি।

চৌধুরীবাড়ি? চৌধুরীবাড়ি কেন? কদমের মেজাজটা ক্রমেই চড়ছে। লোকটার এমন মেজাজ কখনো দেখেনি নবিতুন? বুঝি ভয় পেল নবিতুন। আস্তে অতি নিচু স্বরে বলল নবিতুন, ছোটবৌর কাছে। ছোটবৌর কাছে। কি এক ব্যঙ্গ বিদ্রুপে মুখটাকে লম্বা আর বিকৃত করে উচ্চারণ করল কদম। সুধাল আবার, কেন? ছোটবৌর কাছে কি কাজ তোর?

সুচ, একটা সুচ আনতে গেছিলাম।

সুচ, হাতে ওগুলো আবার কি?

একটু সুতো। আর একটা পুরনো শাড়ি। কি এক কুণ্ঠায় আর যেন লজ্জায় জড়িয়ে জড়িয়ে বলল নবিতুন। হাতের জিনিসগুলো মেলে ধরল কদমের সুমুখে।

এসব, এসব কে দিয়েছে তোকে! কেন, কেন দিয়েছে? উত্তেজনায় এবার হাঁফাচ্ছে কদম।

নবিতুন বুঝি বলতে চায়, কেন তুমি বুঝতে পার না? দেখছ না? রয়েছে ছোটবৌর দেয়া সুই সুতো আর কাঁথা সেলাইর জন্য একখানা পুরনো শাড়ি? কিন্তু নবিতুন বলতে পারে না কিছুই। ফ্যালফ্যাল অবাক হওয়া আর ব্যথা পাওয়া চোখে শুধু চেয়ে থাকে। সারেংয়ের এমন রাগ কবে দেখেছে মনে করতে পারে না ও।

কাঁথা…বড় নরম স্বরে আর কি এক লজ্জা মিশিয়ে বলতে যাচ্ছিল নবিতুন। কিন্তু ঠোঁটটা ওর নড়ে উঠবার আগেই ছোঁ মেরে জিনিসগুলো ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিল কদম। ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে।

নবিতুন থ। কি এক হিংস্রতায় লাল কদমের মুখ। কি এক ক্রোধ গলা আগুনের মতো গলে পড়ছে ওর চোখ দিয়ে। কদমের এমন চোখ এমন মুখ কখনো দেখেনি নবিতুন।

থ মেরে নির্বাক নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইল নবিতুন। তারপর চোখ নামিয়ে জিনিসগুলো কুড়িয়ে নিল। আস্তে-আস্তে চলে এলো ঘরের দিকে।

কয়েক দিন পর।

হাট থেকে ফিরে মুখ-হাত না ধুয়েই বসে পড়ে কদম। পান সুপারির সওদাটা অকারণেই ছুঁড়ে দেয় চৌকির দিকে। মাটিতে পড়ে যায় পানের বিড়াটা।

খড়ম আর ওজুর পানিটা নিয়ে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে নবিতুন। কদম আসে না। কদম ওকে ডাকে ঘরের ভেতর।

থমথমে কদমের মুখ। সে মুখের দিকে তাকিয়ে অজানা এক ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে নবিতুনের।

তুই নাকি চৌধুরীবাড়িত বান্দীর কাম করেছিস? রাত কাটিয়েছিস? জিজ্ঞেস করল কদম।

হ্যাঁ বাবা। কি বজ্জাত চৌধুরী বুড়িটা। সারাটা দিন খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে মারত মাকে। মা…।

এই চুপ কর।

বাপজানের প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশটুকু বোধহয় শোনেনি আককি। প্রথম অংশটারই জবাব দিচ্ছিল। কিন্তু মায়ের ধমক খেয়ে চুপ করে যায় আককি।

তাহলে আমার নাম-কাম-মান-সম্মান সব ডুবিয়ে দিয়ে বান্দীগিরি করেছিস তুই? কেন?

কেনর বুঝি উত্তর নেই। নবিতুন চুপ।

আর কি করেছিস? বল, শিগগির বল। দাঁড়িয়ে পড়ে কদম। সমুদ্রের মানুষটা, ভীষণমূর্তি সমুদ্রের মতোই ফুঁসে উঠেছে, গর্জে উঠেছে।

বুঝি সামলে নেয় কদম। বসে পড়ে আবার।

দরজার গোড়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নবিতুন।

এতই যখন দেমাক তোর, ছুঁড়ে ফেলে দিস আমার টাকা, তা আমার বাপদাদার নামে কলঙ্ক না দিয়ে চৌধুরীবাড়ি উঠে গেলেই পারিস? সামলে নিয়ে বুঝি আরো হিংস্র হলো কদম।

টা-কা? শুকনো গলায় শুধু একটা ফাটা আওয়াজ করল নবিতুন।

ইস্, যেন কিছুই জানিস না তুই! কত আর ছিনালিপনা করবি। বলে পকেট থেকে মুঠোখানিক টাকার নোট বের করে আনল কদম। টাকাগুলো ছুঁড়ে দিল নবিতুনের দিকে। নোটগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে।

যেন চোখ কচলে বারবার দেখল নবিতুন। দেখল অনেক নোটের ভেতর কতগুলো দুমড়ানো-প্যাঁচানো। যে টাকা একদিন দলা পাকিয়ে লুন্দর শেখের মুখের উপর ছুঁড়ে মেরেছিল নবিতুন একি সেই টাকা?

হঠাৎ নবিতুনের মনে হলো সমস্ত ঘরটাই ঘুরছে। ভীষণভাবে ঘুরছে, ঘরের বেড়া, ঘরের পালা, ঘরের চাল! আর কাঁপছে পায়ের তলার ভিটাটি। ঘুরতে ঘুরতে গোটা ঘরটাই যেন ভেঙে পড়ল নবিতুনের মাথার ওপর। নবিতুন পড়ে গেল। পড়ে গেল কদমের ওজুর পানি ভরা বদনা আর খড়ম জোড়ার ওপর। বদনার নালটা বুঝি গেথে গেল নবিতুনের পাঁজরে। কঁকিয়ে আর্তনাদ তুলে উঠোনে গড়িয়ে পড়ল নবিতুন। আককি বুঝি দৌড়ে গিয়ে তুলতে গেল মাকে। কদম ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল ওর গালে– যেমন খানকি মা, তেমন মেয়ে। আমার মুখে চুনকালি দিয়ে মায়ে-ঝিয়ে বজ্জাতি করেছিস, চৌধুরীবাড়ি?

আচানক চড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় আককি। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বাইরে নবিতুন আর কঁকাচ্ছে না। চিত হয়ে পড়ে রয়েছে মাটির ওপর।

যা ছোট চৌধুরীর ঘরে যা। খানকি মায়া মানুষ নিয়ে ঘর করি না আমি। দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে কদম।

ভোরে ঘুম ভেঙে সারেংবাড়ির মেয়ে-মরদ সবাই দেখল একটি মরা ছেলেকে পায়ের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে নবিতুন।

বুঝি গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুমটা ভেঙে যায় নবিতুনের! ঘুম ভেঙে গায়ের উপর শাড়িটা ঠিক করে নেয় ও। তারপর মরা ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে চলে আসে ঘরে।

কোরবান এসে বলে, চল কবর দিয়ে আসি।

খানকির পোলার আবার কবর কি? যা গাংগে ফেলে দিয়ে আয়। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে কদম আর সুটকেস গোছায়। আজই চলে যাবে ও। মরা ছেলেটাকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে শুয়ে আছে নবিতুন। শরবতি এসে অনেক কষ্টে মৃতদেহটা আলগা করে তুলে দিল কোরবানের হাতে। মায়ের মেয়ে আককি। ভাত ফোটালো বাবার জন্য। বেপারি বাড়ি ছুটে বাকিতে কিনে আনল এক ছটাক সাবু দানা। লবণ দিয়ে রান্না করে তুলে ধরল মায়ের মুখে। অনেক দিনের উপবাসীর মতো দুঢোঁকেই সেটা খেয়ে নিল নবিতুন। একজোড়া লুঙ্গি, একখানি গামছা, দুটো জামা, একটা আয়না, একটা চিরুনি– টিনের সুটকেসে জিনিসগুলো ভরে নিয়ে তৈরি হয়ে গেল কদম। নবিতুন শুয়ে শুয়ে দেখল। কিছুক্ষণ ফ্যাসফ্যাসিয়ে কাঁদল, হয়তো মরা খোকার শোকে। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল ও।

সুটকেসটি হাতে নিয়ে কদম যখন উঠানে নামল আকাশে তখন মেঘ। বড় হিস্যা আর পুবের হিস্যায় গিয়ে সালাম বিদায়ের পর্বটা শেষ করল কদম। তারপর বিসমিল্লাহ বলে রওনা দিল।

শরবতি বলল, কদম ভাই, এ আপনার কেমন কাণ্ড। বুয়ার অসুখ আর আপনি চললেন? দুটো দিন থেকে গেলে কি হয়?

উত্তরে এমন করে তাকায় কদম ডর খেয়ে যায় শরবতি।

গোটা সারেং বাড়িটাই কদমের পিছে পিছে। বিদায় দিচ্ছে ওকে। ওদের মাঝে নেই শুধু নবিতুন।

কিন্তু ঘাট পর্যন্ত এসে ওরা আর এগোয় না। সেই যে মেঘ করেছিল সেই মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। পূর্ব দিকটা একেবারে কাঠকয়লার মতো কালো হয়ে গেছে। ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল।

চোখ কুঁচকে দ্রুত ফেঁপে ওঠা মেঘগুলোকে দেখল শরবতির দাদু কামিজদ্দি বুড়ো। দেখল ওদের গায়ের রঙ, ওদের চেহারা আর স্বভাব। দেখে নিয়ে বলল, না। মেঘের নমুনা বড় ভালো দেখাচ্ছে না। বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির সাথে ঝড়ও আসবে।

সত্যি, মেঘের নমুনাটা বড় ভালো নয়। সবাই আকাশের দিকে দেখল এবং সায় দিল কামিজ বুড়োর কথায়।

এমন সময় হাওয়া এলো। গরম হাওয়া। সে কি গরম, যেন ঝলসে দিয়ে গেল ওদের। প্রথম আঁচে ঝলসে গিয়ে ওরা যেন হকচকিয়ে বেবুঝ হয়ে রইল। তারপর মনে হলো ওদের, কি এক আগুন হাওয়া হয়ে দক্ষিণ থেকে ছুটে যাচ্ছে উত্তরের দিকে।

শরবতির বাপ কামিজ বুড়ো হাতখানা বাড়িয়ে বাতাসের গায়ে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। বাতাসটা কেমন গরম, শুকনো কি ভিজা গরম, তা যেন বুঝতে চেষ্টাও করছে ও। তারপর আকাশটাকে আর একবার জরিপ করে বলল কামিজ বুড়ো নারে, আজ যাস নারে কদম। আলামত বড় ভালো ঠেকছে না। কামিজ বুড়োর কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দিল সবাই। ওদের নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই ওরা জানে গরম হাওয়া অলক্ষ্মীর পূর্বলক্ষণ। গরম হাওয়া চড়ে ঝড় আসে, গরম হাওয়ায় বান ডাকে।

বান্দার জন্য খোদাওয়ানতলার মেহেরবানির কি শেষ আছে? সব বিপদের আগেই মানুষকে সাবধান করে দেন তিনি। বলতে বলতে সেই পরম করুণাময়ের প্রতি কি এক কৃতজ্ঞতায় কোমল হয়ে আসে কামিজ বুড়োর বলিত মুখখানি।

বান আসবে এতে কোন সন্দেহ নাই। সাবধান থেকে তোমরা। রাতে কেউ ঘুমিয়ে পড়ো না যেন। বাড়ির দিকে পা বাড়াল কামিজ বুড়ো। চলতে চলতে কদমের দিকে ফিরে বলল, আজ আর যাওয়া হয় না তোমার।

কামিজ বুড়ো বাড়ির মুরুব্বি। তার কথা গওর করতে হয়। তার ওপর আকাশের অবস্থাটা সত্যি সুবিধের নয়। কদম ফিরে আসে। ফিরে এসে দেখে ঘুমোচ্ছে নবিতুন।

সারা বিকেল মেঘের ঘটায় আচ্ছন্ন হলো আকাশ। গরম হাওয়া ঠাণ্ডা হলো। সে হাওয়া বইল জোরে জোরে। হাওয়ার বাড়িতে গোত্তা খেয়ে ঘূর্ণি তুলে আকাশময় উম্মতের মতো ছুটে বেড়াল ঘনকৃষ্ণ মেঘ। হাওয়ার ধাক্কায় এক মেঘ সরে গেল তো হাজার মেঘ দৌড়ে এসে ঠাসাঠাসি জুড়ে বসল শূন্য জায়গায়। কদমের মনে হলো কোথাও বুঝি প্রলয় কাণ্ড ঘটে চলেছে। বড় হিস্যার টিনের ঘরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। কদমের ছনের ঘরে ঝমঝম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির শব্দেই ঘুম ভাঙল কদমের। ঘুম ভেঙে দেখল ওর বুকের উপর মাথা রেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে নবিতুন। পাটিপাতা শাখার মতো চিকন কালো আর মসৃণ দুখান বাহু নবিতুনের, সে বাহু দুখানি জড়িয়ে রয়েছে কদমের গলায়। নবিতুনের বাহু থেকে নিজেকে আলগা করতে গিয়ে আজ বড় দুঃখ হলো কদমের। কেমন কষ্ট পেল কদম।

দিনভর বৃষ্টি চলল অবিরাম।

তার পরদিনও।

অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। ঘর ছেড়ে পা বারাবার উপায় নেই। বড় হিস্যার গোয়ালঘরে হাম্বা হাম্বা চেঁচিয়ে চলেছে গরুগুলো। এই দুর্যোগে কে যাবে ওদের মুখে খের দিতে! চৌকিতে হাত-পা ছেড়ে শুয়ে আছে কদম। চুলো ধরিয়েছে নবিতুন। রান্না চড়িয়েছে। ওকে দেখে বুঝবার উপায় নেই মাত্র তিন দিন আগে ছেলে হয়েছে ওর, তিন দিন আগে ওর সুমুখে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল কদম।

রান্না নামিয়ে কদমকে খেতে ডাকে নবিতুন। নিঃশব্দে খেয়ে এসে চৌকিটার উপর আবার হাত-পা ছেড়ে দেয় কদম।

আককি, দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। জোংরাটা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ল নবিতুন।

চোখ পড়ল কদমের। তড়াক করে চৌকি ছেড়ে দরজার দিকে লাফিয়ে পড়ল কদম। শুধাল, যাস কই? কিন্তু ততক্ষণে বৃষ্টি ধারার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে নবিতুন।

দাওয়ায় এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল কদম, নবিতুন, ও নবিতুন। এই তুফানি বৃষ্টিতে যাস কই? শুনে যা। বৃথাই চেঁচানো। কেননা কদম নিজেই বুঝছে তুফানি বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে গলার আওয়াজটা হাত তিনেকের বেশি এগোচ্ছে না–কোথায় গেল রে? আককিকেই শুধায় কদম।

জানি না। সংক্ষেপে বলে আপন কাজে মন দিল আককি। বাপের ওপর একটুও সন্তুষ্ট নয় আককি। আর সেই অসন্তুষ্টিটা গোপন করবার কোন ইচ্ছে নেই ওর।

আককি মা, এদিকে আয়। ডাকল কদম। বৃষ্টির শব্দে ডাকটা বোধহয় কানে গেল না আককির। অথবা মায়ের মতোই কোন নীরবতার অস্ত্র ধারণ করেছে আককি। এক মনে পাটিপাতা বেত চিরে চলেছে ও। পাটি পাতাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই সকাল থেকেই আককিকে এ কামে লাগিয়ে দিয়েছে নবিতুন।

নাঃ, মেয়েটাকে সেদিন অমন করে চড় মারাটা সত্যি অন্যায় হয়েছে কদমের। কদম উঠে আসে। আককির মাথায় হাত রেখে বলে, বাপ একটি চড় মেরেছে আর অমনি মেয়ের গোসা।

তা কেন হবে? শুধু চড় কেন? সেদিন থেকে বাপের কোন কাজটাই ভালো লাগছে না আককির। নীরবে চোখ তুলে সে কথাটাই যেন জানিয়ে দিল আককি।

দে, ছেনিটা দে। আককিকে সরিয়ে নিজে বেত চিরতে বসল কদম। ভিজে সপসপে গা ফিরে এলো নবিতুন। কাপড় বদলিয়ে চুলের পানি ঝাড়ল। আধবোনা চাটাইটা বিছিয়ে নিল চৌকির সুমুখে মাটির মেঝেতে। তারপর আককির হাত থেকে চেরা বেতের গোছাগুলো নিয়ে বসে গেল চাটাই বুনতে।

চৌকিতে ফিরে এলো কদম। শুয়ে পড়ল। বার কয় হাত-পা ছুড়ল। উঠে বসল। চিৎকার করে শুধায়, কোথায় গিয়েছিলি?

মাতন নেই নবিতুনের। চেরা পাটিপাতা বেত একটার পর একটা বিছিয়ে চলেছে ও। সিদাসিদি, আড়াআড়ি, কোনাকুনি। আজ হাতে চুড়ি নেই নবিতুনের।

কথা বলে না কেন নবিতুন? ছটফট করে কদম।

খাট ছেড়ে নেমে আসে কদম। একগোছা বেত নিয়ে বসে পড়ে নবিতুনের পাশে। বিছিয়ে যায় পাটিপাতা বেত। আড়াআড়ি, সিদাসিদি। কিন্তু ভালো লাগে না ওর। কেন চুপ নবিতুন? উঠে এসে আবার শুয়ে পড়ে কদম।

ঝুমঝুম ঝপঝপ বৃষ্টি পড়ছে। তো পড়ছেই। কোন লক্ষণ নেই থামার। গোটা দুনিয়াটাকেই যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

হাঁটুর উপর চিবুক রেখে একমনে চাটাই বুনে চলেছে নবিতুন।

চৌকির ওপর ছটফট করে কদম। এই নিঃশব্দ নবিতুন আর ওই ঝুপঝুপ বৃষ্টি বুঝি পাগল করে দেবে কদমকে।

তুই কি বোবা হয়েছিস? তোর কি মুখ নেই? চেঁচিয়ে ওঠে কদম। নীরব নবিতুন। ক্ষণিক দৃষ্টিতে কদমকে একটিবার দেখেই আবার কাজে মন দেয় ও।

নবিতুনের ক্ষণদৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় কি যেন দেখল কদম। এক লাফে নেমে এলো চৌকি ছেড়ে। নবিতুনের হাত থেকে কেড়ে নিল বেতের গোছাগুলো, ছুঁড়ে দিল দূরে। চিল্লিয়ে উঠল, লুন্দরমামু, পোস্টমাস্টার, ওরা কি মিথ্যা বলেছে? চুপ কেন তুই? তুই কিছু বলিস না কেন? বল, বল এসব মিথ্যা?

কি যেন বলল নবিতুন। কিন্তু শোনা গেল না ওর কণ্ঠ। পৃথিবীর সমস্ত কণ্ঠকে ডুবিয়ে আকাশের বজ্র তখন কি এক ভীষণতায় ফেটে পড়েছে মাটির জগতে। মনে হলো দুনিয়াটাকে যেন এফোঁড় ওফোঁড় করে গেল। মুহূর্তের জন্য ওরা বধির হলো। কণ্ঠ ওদের স্তব্ধ হলো। ধাক্কা সামলে নিয়ে দরজা খুলল কদম। দেখল বজ্রের সাথে সাথে বৃষ্টির তোড়টাও যেন কমে এলো।

সত্যি কমে এলো।

সত্যি কমে এলো বৃষ্টিটা।

অল্পক্ষণের মধ্যেই থেমে গেল বৃষ্টি।

উঠোনের জমা পানি গলগল করে নেমে যাচ্ছে ক্ষেতের দিকে। বেরিয়ে এলো কদম। পুবের হিস্যা আর বড় হিস্যার ছেলে বুড়োরাও বেরিয়ে এলো। উঠোনে এসে হাত-পা ছুঁড়ে একটু শান্তি পেল ওরা। দুদিন, দুরাত্রির অবিরাম বর্ষণে ঘরে বসে বসে হাত-পা যেন জমে গেছে সবার। শরবতির বাপ আর কামিজ বুড়ো গেল গোয়ালঘরে। কোরবান গেল ঘাটার দিকে ধানের শীষ ডুবে গেছে না জেগে আছে, তাই দেখতে। কদম ভাবছে, রাস্তাঘাট কি ডুবে গেল? রাস্তাঘাট ডুবে গেলে আরো দেরি হয়ে যাবে ওর রওনা দিতে। অবস্থাটা দেখার জন্য ঘাটার দিকেই পা বাড়াল কদম।

কিন্তু ওর পা-টা উঠবার আগেই গোটা আকাশটা যেন খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল, গোটা দুনিয়াটা থরথর কেঁপে উঠল। কদমের মনে হলো পায়ের তলার মাটিটা কোথায় যেন সরে গেছে, শূন্যে দাঁড়িয়ে আছে ও। ভীতা আককি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল বাপজানকে।

পরপর তিন বার বাজ পড়ল। তিন বার আকাশ ফাটল। তিন বার দুনিয়াটা ঝাঁকুনি খেল।

আলামত বড় খারাপ। আলামত বড় খারাপ। যে যার ঘরে যাও। যে যার ঘরে যাও। দোয়া পড়। দরুদ পড়। গোয়ালঘর থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে আসছে শরবতির দাদু কামিজ বুড়ো।

কামিজ বুড়ো উঠোন তক পৌঁছতে না পৌঁছতেই আবার বাজ পড়ল।

লাহাওলা লাকুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ… জোরে জোরে শয়তান বিতাড়নের অব্যর্থ দোয়াটা পাঠ করল কামিজ বুড়ো। আবারও চিল্লিয়ে বলল সবাইকে, যে যার ঘরে যাওগো। আল্লার নাম ডাক। আলামত বড় ভালো নয়। মুহুর্মুহু বজ্রের হুংকারে কোরবানও ভয় পেয়েছে। এক দৌড়ে ঘাটা থেকে এসে পড়েছে ও।

কোরবান বাবা, জোরে জোরে একবার আজান দে তো বাবা। ওকে দেখে বলল কামিজ বুড়ো।

তাড়াতাড়ি ঘড়ার পানিতে ওজু করে এলো কোরবান। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিবলামুখী হলো। কানে আঙুল দিল। তারপর গলা ছেড়ে আজান দিল।

এতক্ষণ বাজ পড়ছিল, কিন্তু বাতাস ছিল নিথর। এবার বাতাস ছাড়ল। ঠাণ্ডা বাতাস। প্রথমে দুটো একটা মৃদু ঝাপটা। তারপর অকস্মাৎ তীব্র বেগে ছুটে এলো, ঝাপটার পর ঝাপটায় ঘরদোর গাছ-গাছালির উপর আছড়ে পড়ল বাতাস। মটমট করে উঠল কদমের ঘরের নতুন তোলা চালটা। আককি তাড়াতাড়ি একটা পিঁড়ি ছুঁড়ে দিল উঠোনে। ছড়া বলল :

আইঠ্যা কলার ছাউনি
ভেরনের খাম,
পবন ঠাকুর বইসো বইসো।

কিন্তু সে আবেদনে পবনের করুণা হলো না। হাওয়ার বেগ কমল না। হিস হিস শাঁই শাঁই গাঁই গাঁই বিচিত্র ভয়-জাগানো শব্দ তুলে হাওয়ার পর হাওয়া ছুটে আসছে। ঘরবাড়ি বনজঙ্গল সবই যেন উপড়ে নিয়ে যাবে এই ক্রুদ্ধ বাতাস।

এই তোরা সব চলে আয়। বড় ঘরে চলে আয়। শিগগির চলে আয়। বাতাসের তোড় দেখে বড় হিস্যা থেকে ডেকে উঠল কামিজ বুড়ো।

বড় হিস্যার বড় ঘর যেমন উঁচু তেমনি মজবুত। তাই যে যার ঘর বন্ধ করে বড় ঘরে এসেই উঠল।

আজান দে, আজান দে বাবা। তাড়া দিল কামিজ বুড়ো।

আবারও আজান দিল কোরবান।

 কি যে তুই আজান দিলি, এই পাঁচ হাত দূরে বসেও ভালো করে কানে এলো না আমার। গলায় জোর নেই নাকি? খিঁচিয়ে উঠল কামিজ বুড়ো। কোরবান বলল, আমার কি দোষ? বাতাসের তোড়, তাতে গলা ফাটিয়ে মরলেও কয় হাত আর পৌঁছবে গলাটা।

এই কৈফিয়তে আদৌ সন্তুষ্ট নয় কামিজ বুড়ো। বলল, আসলে তোরা জানিস বুঝিস না কিছুই। আজান হলো শয়তানের যম। আজানের এক একটি শব্দ যতদূর পৌঁছবে তার ত্রিসীমানায়ও ঘেঁষতে পারবে না শয়তান। বলে নিজেই গলা ফাটিয়ে আজান দিল কামিজ বুড়ো। কিন্তু সে আজান কামিজ বুড়ো ছাড়া আর কেউ শুনল না।

কমে এলো বাতাসের বেগ? আকাশটাও একটু ফর্সা হয়ে এলো। হাসল কামিজ বুড়ো। বলল, দেখলি তো? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই কানটা খাড়া করল।

কানটা খাড়া করে কি যেন শুনতে চাইলো স্পষ্ট করে। তারপর চিন্তিত মুখে তাকাল কদমের দিকে। বলল, শুনছিস কদম?

হ্যাঁ। কদমও শুনছে। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে শোঁ শোঁ এক আওয়াজ। ক্ষীণ আওয়াজ। কিন্তু কান পাতলেই শোনা যায়।

প্রথমে মনে হয়েছিল অনেক, অনেক দূর বহু মেঘ একসাথে ডেকে উঠেছে, এ বুঝি তারই আওয়াজ। কিন্তু না এ মেঘের ডাক নয়! অন্য কিছু।

বিদ্যুৎ চমকে যায় ঘনঘন। মনে হয় কোন হিংস্র জল্লাদ আকাশময় বিজলির চাবুক ঘুরিয়ে চলেছে। ওদের চোখ ঝলসে যায়। কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায় ওরা।

লা হাওলা পড় মিঞারা লা হাওলা পড়। সবাইকে তাম্বি দিল কামিজ বুড়ো। নিজেও দম বন্ধ করে লা হাওলা পড়ে চলল।

আককি অবাক হয়ে দেখছে, এতগুলো বিজলির তীর চিরে চিরে গেল আকাশের বুকটা অথচ আকাশ যেই কে সেই। যেন কিছু হয়নি তার– তাকাস না তাকাস না আসমানের দিকে। এ হলো শয়তানের তীর। শয়তানের তীর আগুনের তীর। ওদিক তাকাতে নেই। বলতে বলতে আককির চুলের মুঠিটা ধরে ওকে ঘরের দিকে ঠেলে দিল কামিজ বুড়ো।

সহসা পুব-দক্ষিণ কোণ থেকে ছুটে এলো কতগুলো মেঘ। কালো কালো বিরাটকায় দৈত্যের মতো মেঘ! মেঘগুলো গ্রাস করে নিল আকাশটাকে। অন্ধকারে ছেয়ে গেল দুনিয়াটা।

দিনের বেলায় এমন ঘুরঘুঁটি অন্ধকার? কেউ কখনো শুনেছে, না দেখেছে। আর কি চেহারা আকাশটার।

আঁধার, আঁধার। চারদিকেই আঁধার। ওরা যেন কিছুই দেখছে না চোখে– এই শরবতি, এই কোরবানের বৌ, যা যা ঘরে যা তোরা। দোয়া পড়, দোয়া পড়, আল্লাকে ডাক। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে কামিজ বুড়ো আর বিড়বিড় দোয়া পড়ে চলে।

পশ্চিমমুখী হয়ে ফের আজান দিল কোরবান।

ও চাচা, এ তো বানের ডাক। পানির গর্জন। শুনছ না? সহসা চেঁচিয়ে ওঠে কদম।

কানটাকে বুঝি একটু সজাগ করল শরবতির দাদু। বলল, তাই তো তখন বলেছিলাম তোকে।

কামিজ বুড়োর দেখাদেখি সবাই কানখাড়া করল। এ ডাক বানের ডাক, এতে কোন সন্দেহ নেই কারো। সাগরটা এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে। গভীর রাতে কখনো ঘুম ভেঙে ওরা শোনে সমুদ্রের চাপা গর্জন, এমনি শোঁ শোঁ আওয়াজ। সাগরটা যখন ক্ষেপে যায় তখনই এমন করে ডাকে।

এতক্ষণে আঁধারিটা যেন থিতিয়ে গেছে ওদের চোখে, ভালো করে চারদিকে চেয়ে দেখল ওরা। পরস্পরের দিকে তাকাল। পরস্পরকে যেন অভয় দিল। মেয়েদের মুখে, ছেলেদের মুখে রা নেই। ঘরে বসে ভরসা পায় না। টিপটিপ করে ওদের বুক। বজ্রের এমন হুংকার কখনো শোনেনি ওরা। এমন স্তব্ধ খাওয়া থমথমে আবহাওয়া, দিনের বেলায় এমন কুচকুচে আঁধার এমন ঘনকৃষ্ণ ভয়ঙ্কর আকাশ কখনো দেখেনি ওরা। ঘর ছেড়ে দাওয়ায় আসে ওরা। দাওয়ায় পুরুষগুলোর পাশে গুটিসুটি বসে পড়ে ওরা।

শোঁ শোঁ ওঁ ওঁ। আওয়াজটা নিকটতর হচ্ছে। আওয়াজটা বাড়ছে তার ভয়ে। স্তব্ধ খেয়েছে বাতাস।

ধুক করে ওঠে কদমের বুকটা। সমুদ্রের মানুষ সে। সমুদ্রের এই হুংকার কোন্ প্রলয়ের পূর্বভাস সে জানে। কামিজ বুড়ো আর কোরবান ওরাও জানে সহস্র ফণা মেলে সাগরটা যখন আসমান উঁচু হয়ে ধেয়ে আসে কেবলমাত্র তখনই এমনি শব্দ হয়, এমনি হিংস্র গর্জনে আকাশ-বাতাস কেঁপে যায়। সেই গর্জন আর সাগরের সেই করাল মূর্তির সুমুখে অতি বড় দুঃসাহসী নাবিকেরও বুক কাঁপে।

ওরা বুঝি ভয় পেল। ভয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। আর ওদের রক্তহীন মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েরা বুঝি চোখ বুজল। শিশুরা আঁকড়ে ধরল মায়ের গলা। দৈত্যের মতো কালো কালো মেঘগুলো সরে গেল পশ্চিম দিকে। কিন্তু ফর্সা হলো না আকাশ। শুধু আঁধারির ঘোরটা সামান্য কমে একটু সাফ হলো আবহাওয়াটা।

শোঁ ওঁ ওঁ শোঁ ওঁ ওঁ। এবার আওয়াজ নয়। শব্দ নয়। লক্ষ দৈত্যদানব যেন ক্রুদ্ধ গর্জনে হুংকার ছেড়ে ছুটে আসছে।

কিসের এই গর্জন।

বামনছাড়ি পিয়লগাছা আর মাদারটেকের মতো অসংখ্য না-দ্বীপ না গ্রামকে ঘিরে যে কয়াল নদী তার? নাকি দূর সাগরের? না, কয়ালে এত পানি নেই। কয়ালের অমন শক্তিও নেই। যে সাগরের শব্দ শুনে ওদের অনেক মাঝরাতের ঘুম গেছে ভেঙে। আজকের এই গর্জনের সাথে তার তুলনা চলে না। এ যেন অজস্র সাগরের উন্মত্ত হুংকার। বুঝি সমুদ্রটা কখন এত কাছে এসে পড়ল।

বুঝেও যেন সন্দেহ থেকে যায় কোরবানের। ও জিজ্ঞেস করে, কিসের ডাক?

বানের ডাক! সর্বনাশের ডাক? বলল শরবতির দাদু কামিজ বুড়ো।

এমন ডাক তো কখনো শোনা যায়নি। বলল কোরবান।

শোনা গেছিল সেই তিরাশি সনে যখন গরকি এসেছিল। বলল কামিজ বুড়ো।

ভয়টা যেন দ্বিগুণ ভারি হয়ে জেঁকে বসল ওদের ওপর। মেয়ে আর মরদ। কি এক অমঙ্গল, কি এক ভয়ংকর দুর্যোগ আশঙ্কায় কাঁপছে ওদের বুক। ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদলার সাথে ওদের আজন্ম পরিচয়। বান আসে, বানের পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায় কয়ালের দুপাড়। এত শিশুকাল থেকেই দেখে আসছে ওরা। বানের পানিতে ডুবে যায় উঠোন, কখনো ঘরের ভিটি। তখন ঘরের ভেতরই মাচাং বানিয়ে থাকে ওরা। দুদিন-চারদিন! তারপর নেমে যায় পানি। তাই ঝড় তুফান বৃষ্টি বন্যাকে ভয় করে না ওরা।

কিন্তু আজকের দুর্যোগ যেন কোন প্রলয়ের ঘোষণা। যেন কোন নিষ্ঠুর অপদেবতার অভিশাপ হয়ে আকাশ ভেঙে পাতাল ফুঁড়ে সারা জাহান তোলপাড় করে নেমে আসছে মহাপ্রলয়। যা পৃথিবীর মানুষ দেখেনি কখনো। দয়াহীন মায়াহীন ক্ষমাহীন নিষ্ঠুর এক অজানা, তারই সুমুখে বাধ্য পশুর মতো দুরু দুরু ওরা। ওরা অসহায়।

কামিজ বুড়ো তখন বলতে সুরু করেছে, আজকের গর্জনের সাথে সেই গরকির ডাকের তুলনা হয় কখনো? সে কি গর্জন! সে কি হুংকার! মনে হয়েছিল হাজার ইস্রাফিল শিংগায় ফুঁ দিয়েছিল। সেই ডাকে কেঁপেছিল আসমান-জমিন, সারা জাহান। গরকির পানিতে ভেসে গেছিল মানুষ গরু পশু পক্ষী। একাকার হয়েছিল আসমান জমিন ঘরবাড়ি।

কামিজ বুড়ো এমন করে বলে যেন তারই জীবনের প্রত্যক্ষ ঘটনা। সারেং বাড়ির ছেলে-বুড়ো সবাই জানে এই তিরাশি সনের গরকির কথা। কামিজ বুড়োর মুখেই শুনেছে ওরা। কামিজ বুড়ো শুনেছে তার বাবা গয়েসুদ্দির কাছে, গরকির বছর গয়েসুদ্দি মোটে দশ বছরের নাবালক। গয়েসুদ্দির বাপ আজবুদ্দি ছেলেকে গামছা দিয়ে বুকের সাথে বেঁধে তিন দিন তিন রাত্রি ভেসে ছিল সেই মহাপ্লাবনের পানিতে। ওরা বাপবেটা ছাড়া সারেং বাড়ির পাঁচ হিস্যার পঁয়ত্রিশ জন বাসিন্দার ভেতর আর কেউ বাঁচতে পারেনি সেবার।

সেই গরকির কাহিনী বহুবার শুনেছে ওরা। শুনে শুনে কঠিন সেই দুর্যোগটা ওদেরই জীবনের কোন অতীত অভিজ্ঞতার মতো গেঁথে রয়েছে ওদের মনের পটে। আজকের আসন্ন দুর্যোগ কি তার চেয়েও ভয়ংকর? ওরা যেন শিউরে ওঠে।

কামিজ বুড়ো এখনো বলে চলেছে, আবশ্যক তিরাশি সনের গরকির আগেও বহুবার বানের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমাদের এই বদনসিব বদকিসমত দেশটাকে। ছিত্তিছান হয়েছিল ঘর-দোর হাট-বাজার! লাখে লাখে মানুষ, বৌ-ঝি মা-বোন বেটা-বেটি আর ওদের যত গরু-ছাগল মোষ, স-ব মরে সাফ হয়েছিল। বিরানা হয়েছিল এই মুলুকটা। সে কি আজকের কথা? আর সে একবার দুবার নয়, বহুবার। মুরুব্বিদের কাছে শোনা। তবে, মুরুব্বিরাই বলে গেছেন, তিরাশি সনের গরকির কাছে ওসব কিছুই না। আল্লার গজব।

আজও তেমনি আল্লার গজব নেমে আসছে? আল্লা কি এতই নির্দয়? ভয়ে আতঙ্কে রুদ্ধশ্বাস ওরা। রুদ্ধশ্বাস ওরা চেয়ে থাকে কামিজ বুড়োর মুখের দিকে। এই প্রশ্নটার কি জবাব দিতে পারে না কামিজ বুড়ো?

খোদার লানত যখন পড়ে তখন এমনি করেই পড়ে। দুনিয়াদারির পায়বন্দি এই আদনা মানুষ তাকে কেমন করে ঠেকাবে? বুঝি ওদের অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাবেই বলে চলে কামিজ বুড়ো। ভীত আতঙ্কিত মেয়েরা চোখ বড় বড় করে শুনে যায় ওর কথা।

হজরত নুহের কথা বলেছি না তোদের? সেই নু-সাল্লামের জামানায় পাপে ভরে গেল দুনিয়া। গোনাহ্, গোমরাহ হাজারো পাপে ভরে আছে মানুষের মন। মানুষ ভুলে গেছে খোদাওয়ানতালার কথা, নেক কথা, নেক কাজ, নেক চিন্তা স ব। নু-সাল্লাম ওদের ডেকে বললেন, হে মানুষ! তোমরা নেকির পথে ফিরে আস, পাপের রাস্তা ছেড়ে নেক কথা নেক চিন্তার পথে আস। আমি বলছি, খোদাওয়ানতালা সহ্য করবেন না এত পাপ। আসমান থেকে পানি ঢেলে তামাম দুনিয়া ডুবিয়ে দেবেন তিনি। সব পাপ, সব গোনাহগার বান্দা ভেসে যাবে। তোমরা সাবধান হও…।

নু-সাল্লামের কথা শুনে মানুষ হাসল। ঠাট্টা করল। তবু আল্লাহ পয়গম্বর নু সাল্লাম সাবধান করে ওদের। ওরা শুধু ঠাট্টা করে।

দিন যায়। মাস যায়। নু-সাল্লাম হুঁশিয়ার করে চলেন ওদের। ওরা হেসে উড়িয়ে দেয় তাঁর কথা।

শেষে এলো সেই দিন, সেই গজবের দিন। আকাশ ফেটে পানি পড়তে লাগল। মাটি খুঁড়ে পানি উঠতে লাগল। নু-সাল্লাম বানিয়ে রেখেছিলেন মস্ত বড় এক জাহাজ। নিজের পরিবার আর নেকবক্তদের নিয়ে তিনি গিয়ে উঠলেন এই জাহাজে। মানুষদের ডেকে বললেন তিনি, এখনো সময় আছে, উঠে এসো জাহাজে। ওরা ঠাট্টা করে বলল, তুমি থাক তোমার জাহাজে। পানির তোড়ে কতক্ষণ টিকবে ওই জাহাজ। আমরা চলমান পাহাড়ে। বানের পানি তো আর পাহাড়কে ছাপিয়ে যেতে পারবে না?

এদিকে পানি উঠছে তো উঠছেই তার আর ক্ষ্যান্তি নেই। জন্তু-জানোয়ার পশু-পক্ষী দুনিয়ার যত প্রাণী রয়েছে সবই একজোড়া একজোড়া করে আপন জাহাজে তুলে নিলেন নু-সাল্লাম। পানির উপরে ভেসে ভেসে চলল তার জাহাজ।

ওদিকে সেই পাপী আর মূর্খের দল। পাহাড়ে উঠেও ওরা রক্ষা পেল না। দেখতে-দেখতে ডুবে গেল তামাম দুনিয়া। সেই পাহাড়ও। উঠতে উঠতে পানি আসমান ছুঁল। পাপ আর পাপী সবাই ডুবে মরল। বাঁচল শুধু নু-সাল্লাম আর তার জাহাজের নেকবক্ত ছোট্ট দলটি। সেই এক গরকি হয়েছিল বটে।

এই কিসসাও নতুন নয়। সারেং বাড়ির ছেলেমেয়ে, এই বামনছাড়ি, কদুরখিল মাদারটেকের ছেলেমেয়েরা ভূমিষ্ঠ হয়েই শুনে আসছে এ কাহিনী।

আহা চাচা, লম্বা কিসসা তোমার থামাও না। চেঁচিয়ে উঠল কদম।

যেমন অকস্মাৎ কোন এক অজানা ত্রাসে স্তব্ধ হয়ে থমকে ছিল বাতাস তেমনি অকস্মাৎই শুরু হলো তার দাপাদাপি, তুফানি তাণ্ডব।

কি এক উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে কদম।

ওর কাঁধগুলো আর বাহুজোড়া ফুলে উঠেছে। লুঙ্গিটাকে খাটো করে কোমরের সাথে শক্ত করে গিঁট বেঁধেছে ও। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল ও, এই মেয়েরা! ভয়ে ঘুপছি মেরে বসে থাকলে বাঁচবি তোরা? দেখছিস না দুনিয়ার আলামত? শক্ত করে গিঁট দিয়ে শাড়ি বাঁধ কোমরে। খবরদার। উলটোমুখী সাঁতার কাটবি না। হাত-পা ছুড়বি না। পানির সাথে লড়তে যাবি না। শুধু ভেসে থাকবি। মুখটাকে ভাসিয়ে রাখবি পানির ওপর। সবাই তো তোরা সাঁতার জানিস– কদমের কথাটা পুরাপুরি শেষ হলো না। বাতাসের ঘূর্ণি এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল সুন্দরি কাঠের পালা। গাছের আগাগুলো বেঁকে এসে মাটি ছুঁল। এ কি ক্ষেপা বাতাস! ঝাপ্টার পর ঝাপ্টা আসছে। আসছেই। গাছ উপড়ে। ঘর ভেঙে। আকাশ পাতাল মাথায় করে।

নবিতুন দেখল ওর বরই গাছটা বাতাসের হ্যাঁচকা টানে পুবের হিস্যার উঠোনে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

সহসা ওদের মাথার উপর কামিজ বুড়ো ঘরের দুখানি টিন লাফিয়ে উঠে ঝাঁ করে উড়ে চলে গেল আকাশের শূন্যে।

ভয়ে চোখ বুজল মেয়েরা। চোখ বুজে চিৎকার করে উঠল। চিৎকার করে আককি। কামিজ বুড়োর টিন উড়িয়ে নিয়ে বুঝিবা একটু ধিমিয়ে এলো বাতাসের রোষ।

চারদিকে কান্নার রোল পড়েছে। বেরিয়ে এসেছে পাল বাড়ি, ভুঁইয়া বাড়ির মেয়ে-মরদ। ওরা ছুটছে আর চেঁচিয়ে চলেছে, বান এলো গো বান এলো, গরকি এলো।

পানি উঠেছে। পানি উঠেছে। আর রক্ষা নেই। সহসা কি এক অসহায়ের মতো বলে উঠল কোরবানের বৌ।

এক ঝটকায় নবিতুনকে কাছে টেনে নিল কদম। আককি আর নবিতুন দুজনকে দুবাহুতে বেঁধে লাফিয়ে পড়ল উঠোনে। উঠোন থেকে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডাকল ওদের, এই কোরবান! বুদ্ধি-সুদ্ধি খোয়ালি নাকি? শিগগির ওদের নিয়ে বেরিয়ে আয়।

শরবতির বাপ আর কোরবান বাচ্চাদের হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে এলো। মেয়েদের ডাকল, আয় আয়। সবাই যাচ্ছে শেখ বাড়ি। দৌড় দৌড়, সবাই শেখ বাড়ির দালানে গিয়ে ওঠে।

ওরা সবাই ছুটল শেখ বাড়ির দিকে।

কামিজ বুড়োর কি হয়েছে কে জানে। হয়তো ক্ষিপ্র প্রকৃতি আজ ওকেও ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। যেন কেউ ওকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তাই বারান্দার পালাটাকে দুহাতে আঁকড়ে রয়েছে ও আর চিল্লিয়ে চলেছে, কি হবে দৌড়ে! কোথায় পালাবে। পাপ। পাপ। পাপে ভরে গেছে দেশ। এত পাপ সইবে কেন আল্লা?

হঠাৎ শরবতির কোলে ছেলেটার দিকে চোখ পড়ল কামিজ বুড়োর। এক লাফে নেমে এলো শরবতির ছেলেটাকে তুলে নিল বুকে। আর এক হাতে শরবতিকে ধরে ছুট দিল শেখ বাড়ির দিকে।

অনেক দূর থেকে কে যেন চিৎকার করে বলে চলেছে– গরকি এলো গো। গরকি এলো। ধেয়ে আসছে বানের পানি।

পাল বাড়ির কয়েকটা মেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। শেখ বাড়ির দিক থেকে কোন এক নারীকণ্ঠ ডাকছে ওদের, আয়রে আয়। জলদি আয়। আকাশ-পাতাল চুরমার করে আসছে বানের জল।

বুঝি এসে গেল বানের পানি।

সেই সাথে বৃষ্টি।

সেই সাথে হাওয়ার তোড়।

কোন কথা, কোন কণ্ঠ আর শোনা যায় না। সমস্ত শব্দ লয় পেয়েছে সেই একটিমাত্র ভয়ংকর শব্দ গর্জনে– শোঁ ওঁ গোঁ ওঁ ওঁ গোঁ ওঁ শোঁ শোঁ ওঁ ওঁ। বুঝি বেজে উঠেছে ইস্রাফিলের শিংগা, বেজে উঠেছে রুদ্র দেবতার প্রলয় বিষাণ। আকাশ ভেঙে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। খান খান চুর চুর হয়ে মাটির পৃথিবীটা ছিটকে পড়ছে, লীন হতে চলেছে কোন শূন্যালোকে। বুঝি মহাসৃষ্টির ধ্বংস আজ।

কে যেন হুড়মুড় খেয়ে পড়ল কদমের গায়ে।

 কদম চিনল না। বৃষ্টিতে চুপছে গেছে ওর চোখ।

কিন্তু পড়ে পড়েও উঠে দাঁড়াল লোকটি, ইয়া আল্লাহ এ কি গজব, এ কি কেয়ামত নাজেল করলে তুমি!

টলতে টলতে চিল্লিয়ে চলছে লোকটি।

কেয়ামত। কেয়ামত এসে গেল। আজ আসমান-জমিন দুনিয়া-জাহান মিসমার হবে, একাকার হবে। দেখছিস না পাপ, কত পাপ ঢুকেছে আমাদের মাঝে। পাপের মুল্লুক যে আজ ছারখার হবে।

কোন সুদূর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ এক অভিসম্পাতের মতো কথাগুলো শুনল কদম। তারপর ও যেন দেখল প্রচণ্ড বাতাসে উড়িয়ে নেয়া পাতার মতো ঘূর্ণি খেতে খেতে অদৃশ্য হয়ে গেল কামিজ বুড়ো। কামিজ বুড়োর বুকের কাছে তখনো আগলে ধরা শরবতির বাচ্চা ছেলেটি।

কদমের কানের সাথে লাগিয়ে শুধাল নবিতুন, কই যাও? কেন, লুন্দর মামুর দোমালা দালানে? সেখানেই তো যাচ্ছে সবাই। বলল কদম।

কখনো না। মরে গেলেও না। বলে সামনের বরই গাছটা আঁকড়ে ধরল নবিতুন। এক পা দুপা করে চড়ে গেল গাছে। মার পিছুপিছু আককিও।

এ কি করছিস নবিতুন? গাছের ওপর কতক্ষণ, কদ্দিন থাকবি? এ গাছ স্রোত এসে উপড়ে ফেলবে। নেমে আয় নেমে আয়। নেমে আয় নবিতুন। মরিয়া হয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচায় কদম।

গাছের উপর থেকে নবিতুনও চেঁচিয়ে চলেছে ওর সমস্ত শক্তি দিয়ে। কিন্তু প্রলয়ের হুংকার গর্জনে তলিয়ে যাচ্ছে ওর গলা। কিছুই কানে আসছে না কদমের। কদম শুধু দেখল বারবার দক্ষিণ দিকে আঙুল আর হাত নেড়ে কি যেন দেখাচ্ছে নবিতুন। মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণ দিকটা দেখে নিল কদম। দেখে নিয়ে এক মুহূর্ত বিলম্ব করল না। তরতর করে উঠে এলো গাছের আগায়।

দক্ষিণ থেকে আসছে পানির পাহাড়। আসমান-জমিন তোলপাড় করে এগিয়ে আসছে বিরাট ঢেউ।

কোন সমুদ্র অদেখা কদমের। কিন্তু সমুদ্রে অত বড় ঢেউ কখনো দেখেনি কদম। কোথাও আকাশ কোথায় মাটি। আকাশ আর মাটি ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ভয়ংকর পানির প্রাচীর। সে প্রাচীর ধেয়ে আসছে ওদের দিকে।

আককি মা, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাক গাছটাকে, বলল কদম। আর নিজের বাহুর বেষ্টনে করই গাছের কাণ্ডসহ কোমরটাকে জড়িয়ে রাখল কদম।

তারপর ওরা চোখ বুজল।

ঢেউটা ওদের পায়ের তলা দিয়ে চলে গেল।

ওদের পায়ের তলা দিয়ে চলে গেল, কিন্তু ডুবিয়ে গেল বামনছাড়ি গ্রামটা। ভাসিয়ে নিল ঘরবাড়ি। ভেসে গেল গরু-ছাগল, মোষ আর কিছু মানুষ। কদম, নবিতুন, ওরা চোখ মেলে দেখল লুন্দর শেখের দোমালা দালান ছাড়া আর কোন ঘর অবশিষ্ট নেই বামনছাড়িতে।

ও কি, চৌধুরী বাড়ির দালানটা? এই একটু আগেও আমরা দেখলাম যে? উৎকণ্ঠা ঝরে নবিতুনের কণ্ঠে।

চৌধুরী বাড়ির দালান পানির তলায়। সংক্ষেপে বলল কদম।

ভীষণ বেগে স্রোত যাচ্ছে। বরই গাছটা সরু একটি কাঠির মতো থরথর কেঁপে চলেছে।

আহা ডুবে গেল চৌধুরী বাড়িটা? ছোটবৌটা বড় ভালো, বড় নেকদিল ছিল গো। আহা ছোটবৌটা কি ভেসে গেল? নবিতুনের বড় দুঃখ হলো ছোটবৌর জন্যে।

ছোটবৌর শোকে গাছের উপর কাঁদতে বসলি নাকি তুই। খিঁচিয়ে উঠল কদম।

না গো না। ছোটবৌর মতো মানুষ হয় না। ছোটবৌ-ই তো আমাকে সব বলল।

বলল? কি বলল? এক চোখ পানির দিকে আর এক চোখ নবিতুনের দিকে রেখে শুধাল কদম।

বলল, কেমন করে ওই শুয়রের জাত লুন্দর আর ওই হারামির ব্যাটা পোস্টমাস্টার সাজস করে আটকে রেখেছিল তোমার সব চিঠি। আমার চিঠিগুলোও যেতে দেয়নি। আর বলল, কার কার হাত দিয়ে তোমার টাকা আসত লুন্দরের কাছে। লুন্দর এক পয়সাও দেয়নি আমাকে…।

আর বলল কি সব মিথ্যা কথা নাকি শুনিয়েছে তোমাকে…।

নবিতুনের কথাটা শেষ হবার আগেই চেঁচিয়ে উঠল কদম, এ্যাদ্দিন– এ্যাদ্দিন এসব কথা বলিসনি কেন?

বা-রে, ছোটবৌ কি এ্যাদ্দিন জানত নাকি? আমি তো শুনলাম মোটে আজ সকালে। সেই কবে থেকে খবর দিয়েছিল ছোটবৌ, এ্যাদ্দিন যেতে পারলাম কৈ?

আজ সকালে তুফান মাথায় এজন্যই ছোটবৌর কাছে গেছিলি?

নবিতুনের হুঁটা মুখ দিয়ে বেরোবার আগেই আর একটি ঢেউ এলো।

সামাল সামাল নবিতুন, শক্ত করে আঁকড়ে থাক। চেঁচিয়ে উঠল কদম। ঢেউটা ওদের পা ছুঁয়ে চলে গেল।

ওগো আমার চোখে কুটো পড়েছে। কিছুই দেখছি না আমি। তুমি দেখ না শেখ বাড়ির দোতলার ছাদে শরবতিকে কি দেখা যাচ্ছে। আহা ওর ছেলেটা যে একেবারে বাচ্চা। এক হাতে গাছ ধরে আর এক হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বলে নবিতুন।

কিছু বলল না কদম। শুধু নবিতুনের হাতটা টেনে ইশারা করল দক্ষিণে।

এবার একটি নয়, অসংখ্য ঢেউ মার মার করে ছুটে আসছে। আগের দুটোর চেয়ে অনেক উঁচু।

কত উঁচু? দশ হাত? পনেরো হাত? কুড়ি হাত? না কিছুই আন্দাজ করা যায় না। মনে হয় সারা দুনিয়া-জাহান পানি হয়ে উন্মত্তের মতো গর্জে গর্জে ছুটে আসছে। সমুদ্রে সাঁতার-কাটা মানুষ কদম। তারও বুকটা দুরু দুরু কেঁপে যায়।

কদম টেনে নিল নবিতুনের শাড়ির আঁচলটা। শাড়ির আঁচলটা নিজের কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বলল কদম, নবিতুন শক্ত করে কোমরে গেরো বেঁধেছিস তো?

নবিতুন বলল, হ্যাঁ।

যদি মরি একসাথেই মরব, বুঝলি?

 নবিতুন বলল, হ্যাঁ।

নবিতুনের আঁচলটা নিজের কোমরে বাঁধা হয়ে গেলে আককির আঁচলটা টেনে নিল কদম। আঁচলটা নবিতুনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নে, এটা বেঁধে নে তোর কোমরে। তিন জন একসাথেই ভাসব। এ গাছ আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।

আককির আঁচলখানা কোমরে বেঁধে নিল নবিতুন।

কদম পরখ করে দেখল আককির কোমরের গেরোটা ঠিকমতো রয়েছে কি না।

গজরাচ্ছে ফুঁসছে, ফুলে ফুলে উঠছে পানি। ধেয়ে ধেয়ে আসছে কি এক আক্রোশে।

হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার নবিতুন। ওই দেখ আসছে।

এলো। একটা-দুটো-তিনটে– পরপর ঢেউগুলো প্রচণ্ড রোষে ছুটে গেল ওদের কোমর ভিজিয়ে।

ইস, নিয়ে গেল শরবতিদের? তীক্ষ্ণ আর্তনাদে চিরে গেল নবিতুনের গলাটা।

বানের তোড়ে বসে পড়ছে, ভেসে গেছে লুন্দর শেখের দ্বিতল অট্টালিকা।

সামাল সামাল নবিতুন, বলছে কদম। শালতি শালতি সেই বাহু কদমের। একখানি বাহু গাছের কাণ্ড আর আককির কোমর জড়িয়ে। আর একখানি বাহু নবিতুনের গলায়।

ভয় পেয়েছিস, নবিতুন? শুধাল কদম।

না। বলল নবিতুন।

ওদের পা কিছুতেই আর ডালের সাথে থাকতে চাইছে না।

স্রোত ওদের হাঁটুগুলোকে উপড়ে লয়ে ছুটে যেতে চাইছে।

 শক্ত হ নবিতুন। শক্ত করে ধরে রাখ গাছটাকে।

আমায় মাফ করে দিয়েছিস, নবিতুন?

 নবিতুন বলল, হ্যাঁ।

ওই দেখ, ওই দেখ আসছে।

এলো। আর ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল ঢেউটা।

আস্তে করে নেতিয়ে পড়ল গাছটা।

ওরা ভেসে চলল বানের জলে।

ভেসে চলেছে মরা মানুষ জ্যান্ত মানুষ। আর মানুষ যাদের পুষত, সেই গরু ছাগল-মোষ, হাঁস-মুরগি সেই ভেসে চলেছে। সাগরের পানি জোয়ারের পানি, গরকি– যেমন দুপুরুষ আগে ভাসিয়ে নিয়েছিল ওদের পিতামহদের, তারও আগে ওদের দাদা পিতার আরও ভাসিয়ে নিল ওদের সবকিছু। ওদের ঘর-বাড়ি, ওদের আশ্রয়, ওদের বৌ, ওদের প্রেয়সী, ওদের শিশুসন্তান।

পানির মানুষ কদম। ডুবে গিয়েও বুঝি ভেসে উঠল। ভেসে উঠেই চিল্লিয়ে উঠল।

নবিতুন, তুই কোথায়? আককি মা, সে কোথায়?

কোমরের কাছে হাতটা নিয়ে অনুভব করল কদম। শাড়িখানা এখনো বাঁধা রয়েছে ওর কোমরে। কিন্তু নবিতুন নেই, আককিও নেই। পানির মধ্যেই সমস্ত শক্তি দিয়ে শরীরটাকে বুঝি ঝাঁকিয়ে তুলল কদম। অসীম শক্তিতে মাথাটা উঁচিয়ে দেখতে চাইল চারপাশটা, না, দূরে-কাছে কাউকেই ভাসতে দেখা যায় না। পানি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না কোথাও। তবু কদম ডাকল, নবিতুন, নবিতুন। পানির বুক বয়ে ওর কণ্ঠটা নির্বোধ অনন্তের দিকে ছুটে গেল কে জানে।

আচমকা একটা ঘূর্ণি এলো। কদমকে টেনে নিয়ে গেল নিচের দিকে। শোঁ ওঁ ওঁ শোঁ ওঁ ওঁ। বাজছে ইস্রাফিলের সিংগা। ছুটে চলেছে পানি। গ্রাম ডুবিয়ে জনপদ ভাসিয়ে বিফল হাহাকার তুলে।

.

তারপর একসময় যেখানকার পানি সেখানেই ফিরে গেল। জেগে উঠল পৃথিবীর মাটি।

পৃথিবীর মাটিতে ঘর নেই, আশ্রয় নেই।

পৃথিবীর মাটিতে এখানে-সেখানে মৃত মানুষ বিবস্ত্র, বিকলাঙ্গ। এখানে সেখানে মৃত পশু।

পৃথিবীর মাটিতে চমৎকার রোদ। সূর্যালোকে খলখলিয়ে হাসছে পৃথিবীটা।

বানের জলে ধুয়ে নেয়া পরিষ্কার পৃথিবীর মাটি। আর্শির মতন বুঝি মুখ দেখা যায় এ মাটিতে।

পৃথিবীর আকাশ উজ্জ্বল। স্বচ্ছ নীলিমায় স্নিগ্ধ প্রশান্তি।

পৃথিবীর বাতাসে শান্ত শীতল কোমল ছোঁয়া।

পৃথিবীর বুকে চিরন্ত সেই সাগর ঢেউ। ঝিকিমিকি নীলের আনন্দ নৃত্য কলকল গান। বঙ্গোপসাগরে এমন প্রশান্ত আনন্দ ঢেউ দেখেনি কখনো। পলিপড়া পৃথিবীর মাটির উপর দিয়ে উজ্জ্বল রৌদে স্নান করে করে হেঁটে চলেছে দুজন মানুষ ক্লান্ত ওরা। ধীর ওদের পদক্ষেপ।

গাছ-গাছড়া কোথাও কিছুই নজরে পড়ে না। বুঝি চরঅঞ্চল। ঘরবাড়ির সাথে গাছ-গাছালি ধান-পাট যা ছিল সে সবও ভেসে গেছে গরকির পানিতে।

ওরা দুজন। দূরে দূরে। একজন বুঝি আর একজনকে দেখছে না এখনো। ওরা একজন পুরুষ, একজন নারী।

এদিকে ওদিকে দেখছে ওরা। দেখছে এদিক-ওদিক ছড়ানো প্রলয়ের অবশেষ। আর কাকে যেন খুঁজছে ওরা! ওই মৃতদের মধ্যে, খানাখন্দে, অন্তত বিস্তৃত ধু ধু-র কোন গোপন গহ্বরে।

ওরা যেন পৃথিবীর সেই প্রথম মানব-মানবী– বাবা আদম আর বিবি হাওয়া। অকস্মাৎ হৃদয়হীন বিধাতা ওদের ছিঁড়ে দিয়েছে এই রুক্ষ পৃথিবী। হঠাৎ করে অপরিচিত ভূমিতে এসে পড়ে ওরা শঙ্কিত, ওরা বিমূঢ়। কে জানে অচেনা জায়গার কোন অদৃশ্য সুরংয়ে লুকিয়ে আছে কোন্ অজানা শত্রু। তাই দুপাশ দেখে দেখে আস্তে-আস্তে চলছে ওরা। ওরা বুঝি এখনো প্রকৃতির সন্তান। তাই পোশাক নেই ওদের শরীরে। ওরা নগ্ন।

অকস্মাৎ পা টলে পড়ে গেল, পড়ে রইল পুরুষটি। বুঝি আর একজন মৃতের সংখ্যা বাড়ল।

মেয়েটি কিন্তু শক্ত। খুব বেশি টলছে না ও। পাটা ওর আস্তে-আস্তে উঠছে আর পড়ছে, একটু কাঁপছে। কিন্তু নিশ্চিত তার পদক্ষেপ।

চলতে চলতে পুরুষটির কাছাকাছি এসে পড়ল মেয়েটি। পুরুষটিকে না দেখেই বুঝি চলে যাচ্ছিল ও। যেন হঠাই নজর পড়ল। নজর পড়তেই ঝুঁকে এলো মেয়েটি। যাকে খুঁজেছিল তাকেই বুঝি পেয়ে গেল ও একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে।

কি এক আশা-আনন্দ আর উৎকণ্ঠায় চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটি, কদম, কদম সারেং।

কদমের মাথাটা কোলে তুলে নিল নবিতুন।

কদম চোখ মেলেই আবার চোখ বুজল। বলল, পানি।

পানি? দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখল নবিতুন। দেখল একটু দূরে খাদ মতন একটি জায়গায় চিকচিক করছে পানি। নবিতুন দৌড়ে গেল। কোশ ভরে তুলে পানি দ্রুত পায়ে ফিরে এলো।

কিন্তু মুখে যেতে না যেতেই থুক থুক করে পানিটা ফেলে দিল কদম। বিকৃত বিরক্ত মুখে কি যেন বলল। ঠোঁট চেপে রাখল। মুখটা ঘুরিয়ে নিল কদম।

কি হলো? একটা ঢোঁক খাও! বলতে গিয়েই মনে পড়ল নবিতুনের, সাগরের পানিতে কখনোও তৃষ্ণা মেটে না মানুষের। তবুও বুঝি আর একবার যাচাই করার জন্যেই কোশে ধরা পানির অবশিষ্টটুকু মুখে পুরে নিল নবিতুন। ইশ মুখটা বুঝি পুড়েই গেল। তাড়াতাড়ি পানিটা মুখ থেকে ফেলে দিল নবিতুন। এত লোনাও হয় পানি?

কিন্তু, কদম যে পানি চেয়েছে? তেষ্টায় দুর্বলতায় নেতিয়ে পড়েছে ও। পানি না পেলে কেমন করে বাঁচবে কদম।

অজান্তেই নবিতুনের চোখ জোড়া ঘুরে গেল সাগরের দিকে। সাগরে আজ গর্জন নেই। হুংকার নেই, সাগরে শুধু নীলানন তরঙ্গের চপল নৃত্য। তবুও চমকে ওঠে নবিতুন। দৃষ্টিটাকে ফিরিয়ে আনে কদমের দিকে। এই সাগর নবিতুনের চিরকালের শত্রু।

মুহূর্তের বেশি ইতস্তত করল না নবিতুন। কদমকে কোলে নিয়ে বুকের কাছে তুলে আনলো কদমের মুখ। সে পরম যত্নে পুরে দিল স্তনের বোঁটা।

বুঝি স্তন চুষবার শক্তিটাও নেই কদমের শরীরে। নবিতুন স্তনটা টিপে টিপে দুধ ঝরিয়ে দিল কদমের মুখে। তারপর স্তনের বোঁটাটা পুরে রাখল ওর মুখের ভিতর। শিশুর মতন নবিতুনের বুকটা আঁকড়ে থাকল কদম। উদার আকাশে বুঝি আজ অনেক স্নেহ। উদার আকাশটা সূর্য স্নেহমাখা হাতে প্রলয় বিধ্বস্ত এ পৃথিবীর খতে বুলিয়ে চলেছে প্রীতি-উষ্ণতার আরোগ্য-পরশ। বুঝি মুছে দেবে সব ক্ষত। সব ক্ষতি।

আনন্দে বিস্ময়ে ক্লান্তিতে এখনও কাঁপছে নবিতুন। কাঁপা হাতে বুকের উপর ধরে রেখেছে কদমের মুখখানি। অনিমিষ চেয়ে চেয়ে দেখছে, কদমের মুখে ফুটে উঠেছে প্রাণের আভাস। ওর কপালের শিরায়, ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ির অন্তরালে মুখের ত্বকে ধীর রক্ত চলাচলের ক্ষীণ দ্যুতি।

বুঝি সৃষ্টির সেই প্রথম নারী, আপন আধারে সুপ্ত বিপুল শক্তির সহসা আবিষ্কারের বিস্তৃত অভিভূত– তেমনি চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছে নবিতুন। আর বুঝি আপনার মাঝে সদ্য-অনুভূত। সঞ্জীবনী জীবনধারার অসহ্য আবেগে কেঁপে উঠছে, দুলে উঠছে বার বার।

অনিমিষ চেয়ে চেয়ে দেখছে নবিতুন। মুমূর্ষ কদমের দেহে ফিরে আসছে জীবন। হাত নড়ছে। পা নড়ছে। বুঝি ফোঁটা ফোঁটা শক্তির সঞ্চারে ধীরে ধীরে জেগে উঠল কোন মৃত মানুষ।

কিন্তু জেগে উঠেই নবিতুনকে আকস্মিক ধাক্কায় দূরে ঠেলে দিল কদম। কি এক বিভ্রান্ত উন্মাদ চোখে নবিতুনের মুখে মুহূর্তের জন্য কি যেন খুঁজল। দুর্বল কম্পিত পায়ে উঠে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে উঠল– পর করে দিলি? পর করে দিলি নবিতুন?

পর?

কেন? বিমূঢ় জিজ্ঞাসা নবিতুনের।

একি করেছিস? একি করেছিস নবিতুন? পর করে দিলি? এমন দুশমনি করলি?

দুশমনি?

তুই কি জানিস না বৌর দুধ– কথাটা শেষ করতে পারল না কদম। উত্তেজনার ক্লান্তিতে টলতে টলতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে।

ওই মুমূর্ষু দেহে কতটুকু শক্তিইবা সঞ্চারিত করতে পেরেছিল নবিতুন। হয়তো নিষ্ঠুর মর্মান্তিক ওই কয়েকটি কথা উচ্চারণ করার মতো শক্তি। তার বেশি নয়। কথার মাঝখানেই ফুরিয়ে গেছে নবিতুনের দেহ থেকে পাওয়া ওইটুকু শক্তি। উঠে বসল নবিতুন। ঝুঁকে এলো। আবারও কোলের উপর তুলে নিল কদমের মাথাটা। কদম নিষ্কম্প। ফেনা ঝরছে মুখ দিয়ে। চোখ বোজা। নবিতুন ডাকল, কদম।

নবিতুনের ডাক জনহীন, বৃক্ষহীন পলির প্রান্তরে আছড়ে পড়ল। হারিয়ে গেল অথৈ সমুদ্রের দূর বিস্তারে। পৌঁছল না কদমের কানে।

আবারও ডাকল নবিতুন। কদমের মুখের উপর ছুটে চিৎকার করে। কিন্তু সে ডাকে সাড়া নেই কদমের!

বামনছাড়ির সারেং বৌ নবিতুন। কুটনীর কুমন্ত্রণা, বালাখানার প্রলোভনের মুখে যে ছিল শক্তিমতি নারী। লুন্দর শেখের শয়তানি আর লালসার সুমুখে যে ছিল এক ফুলকি আগুন। অনাহার দুর্ভোগ আর ক্ষণিকের তরে সন্দেহ বিভ্রমের উন্মাদ হওয়া আপন মানুষটির ধিক্কারের মুখেও যে ছিল ধৈর্যবতী বসুন্ধরা। মহাপ্রলয়ের অতল গহ্বর থেকে, সহস্র ঘূর্ণাবর্তের অন্ধকার ফুঁড়ে যে উঠে এলো সূর্যস্নান পলিমাটির স্নিগ্ধ জীবনের রাজ্যে। ক্ষিপ্ত সাগরের সেই আসমান-উঁচু প্রলয়ংকরী তরঙ্গের টুঁটি টিপে জীবনকে সে ছিনিয়ে আনল। সেই নবিতুনের বুকের আধারে এখনও তো কত শক্তি। কত সুধা! ওই সুধার নিঝর ঢেলে কেন আপন প্রিয়তমকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে না ও?

কেন? কেন? মাথার ওপরে আকাশটাকেই যেন সুধাল নবিতুন।

আকাশ নিরুত্তর।

শুভ্ৰমুখীর কাজল চোখের মতো টুকরো মেঘ আকাশে। সেদিকেই থমকে থাকে নবিতুনের চোখ। সেখানে কি কোন প্রত্যাশা?

নবিতুনের কোলে যেমনটি ছিল তেমনি নিথর নিষ্কম্প কদম। শুধু দুপাশে চরম কোন হতাশার মতো ছড়িয়ে থাকা হাতের কটি আঙুল একটু একটু নড়ছে। সে আঙুল দুর্বল সঞ্চালনের নরম পলির মাঝেই কি যেন খুঁজছে। কদমের বুকে হাত রাখল নবিতুন। হাতের স্পর্শে কিছুই বোঝা যায় না। মাথাটা ঝুঁকিয়ে আনল নবিতুন। কান পেতে শুনল কদমের বুকের স্পন্দন। ক্ষীণ অতি ক্ষীণ সে স্পন্দন। কতক্ষণ আর কতক্ষণ বাঁচবে কদম? নবিতুনের অনুক্ত প্রশ্নের জবাবেই যেন চোখ মেলল কদম। অনেক কষ্টে চোখের অর্ধেকটুকু মেলল ও। সে চোখে কি এক মিনতি কি এক তিরস্কার।

কেন? কেন? বাতাস চিরে চিল্লিয়ে উঠল নবিতুন।

কেন এই তিরস্কার?

কিসের এই মিনতি!

এমনি সময়। নবিতুনের চিৎকার তখনো বাতাস চিরে ধেয়ে চলেছে। শুভ্ৰমুখীর কাজল চোখ ঝরে এলো অমিতের ধারা। আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামল।

জোড়া হাতের কোশ মেলে বৃষ্টি ধরল নবিতুন। কদমের ঠোঁটে ঢেলে ঢেলে দিল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি। ঠাণ্ডা আর মিষ্টি। সে পানিতে গলা ভিজল, পেট ভরল কদমের।

কদমের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফাঁকে কাদামাটি। ভিজা হাত ডলে ডলে মুখটা ওর ধুইয়ে দিল নবিতুন। কদমের চুলের জটায় চটচটে কাদা। ধীরে ধীরে আঙুল চালিয়ে জটগুলো ছাড়িয়ে দিল নবিতুন। বৃষ্টির ধারায় ধুইয়ে দিল মাথার চুল। আঙুল টেনে টেনে কেটে দিল প্রিয় তেরি।

বৃষ্টি পড়ল অনেকক্ষণ। যতক্ষণ না নিঃশেষ হলো মেঘটা ততক্ষণ। আর যতক্ষণ বৃষ্টি পড়ল– বুঝি বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়েই ঝরে পড়ল সূর্যের আলোকধারা। এমন অমিতবারি আর কখনও বুঝি নেমে আসেনি পৃথিবীতে। পৃথিবীর বুকে রোদ-বৃষ্টির এমন মিতালি আর কেউ দেখেনি কখনও।

মুখ তুলে চোখ মেলল কদম। আশ্চর্য এই পৃথিবীর সাথে যেন এই প্রথম দৃষ্টিবিনিময় ওর। উঠে বসল কদম।

আজকে স্নেহ ভরা ওই আকাশটা বৃষ্টির ধারায়, আলোর সুধায় আপ্লুত এই বিশ্বচরাচর যেন নবিতুনের চোখের কোণে ঠাঁই নিয়ে হেসে উঠল।

নবিতুনের মুখে সদ্যজাগা পরীর স্নিগ্ধতা। বিজয়িনীর গৌরব।

তারপর উঠে দাঁড়াল ওরা। হেঁটে চলল।

হাঁটতে গিয়েই ওরা দেখল ওরা নগ্ন। লজ্জা পেয়ে দুজন দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। গন্ধম উদ্যানে প্রথম প্রেমের লগ্নে তরুণ আদম আর বিবি হাওয়া নগ্নতার চকিত প্রকাশে এমনি করেই বুঝি লজ্জাকে আবিষ্কার করেছিল।

মুখ ঘুরিয়ে দেখল হাত কত দূরে অগভীর ভোবা মতন জায়গা। সেখানে এক ডোবা মরামানুষ। একজনের কোমরে জড়িয়ে আছে তবন।

গরকির পানি প্রাণটা ওর কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু পারেনি পরনের তবনটা ভাসিয়ে নিতে।

মরা লোকটার তবনটা খুলে নিল কদম। তবনটাকে ছিঁড়ে ফেলল দুটুকরায়। একটুকরো প্যাঁচিয়ে নিল নিজের কোমরে। বাকি টুকরোটা বাড়িয়ে দিল নবিতুনের দিকে।

ভালো করে দিকটা দেখল কদম। দেখল চড়ের দূর প্রান্তে সবুজ রেখা। আর দেখল কয়েক হাত দূরে বঙ্গোপসাগরের ঝিলমিলি নীল। শান্ত সংযত আর সুন্দর।

কদম বলল, আর একটু জিরিয়ে নেইরে নবিতুন। হাঁটতে হবে অনেক দূর।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
১৪ আশ্বিন ১৩৮৮
পহেলা অক্টোবর ১৯৬১

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *