ত্রয়োদশ অধ্যায় — সহযোগ
আমরা আগেই দেখেছি, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কেবল তখনি বস্তুতঃ পক্ষে শুরু হয়, যখন প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মূলধন একইসঙ্গে তুলনামূলকভাবে বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে, যখন তার ফলে শ্রম-প্রক্রিয়া ব্যাপক আয়তনে পরিচালিত হয় এবং আপেক্ষিকভাবে বৃহৎ পরিমাণ পণ্য উৎপাদিত হয়। একই জায়গায়, কিংবা বলতে পারেন, শ্রমের এই ক্ষেত্রে একই সময়ে, একই সঙ্গে বৃহত্তর সংখ্যক শ্রমিক একজন নিকের প্রভুত্বাধীনে একই ধরনের পণ্য উৎপাদনে লিপ্ত হলে ইতিহাস ও যুক্তিবিজ্ঞান– উভয় দিক থেকেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সূচনা-ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। উৎপাদনের পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গেলে, একই ব্যক্তিগত মূলধনের অধীনে বৃহত্তর সংখ্যক শ্রমিকের যুগপৎ নিয়োগ ছাড়া অন্য কোন ভাবে প্রারম্ভিক পর্যায়ে যথাযথ অর্থে যন্ত্র শিল্পোৎপাদন থেকে গিলতগুলির হস্তশিল্পোৎপাদনকে কদাচিৎ পার্থক্য করা যায়। মধ্যযুগের মালিক-হস্তশিল্পীর কর্মশালাটিরই সম্প্রসারণ মাত্র।
অতএব, প্রথম দিকে দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কেবল পরিমাণগত। আমরা দেখিয়েছি যে একটি নির্দিষ্ট মূলধনের দ্বারা উৎপাদিত উত্তমূল্য সমান (=) প্রত্যেকজন শ্রমিকের দ্বারা উৎপাদিত উত্তমূল্য গুণ (x) একসঙ্গে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা। শ্রমিকদের নিছক সংখ্যা উত্তমূল্যের হার বা শ্রম শক্তির শোষণের মাত্রা—কোনটাকেই প্রভাবিত করে না। যদি ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম দিবস ছয় শিলিংয়ে মূর্ত হয়, তা হলে এই রকম ১,২০০টি শ্রম-দিকা মূর্ত হবে ৬ শিলিংয়ের ১,২০০ গুণ শিলিংয়ের অঙ্কে। এক ক্ষেত্রে অন্তভুক্ত হয় ১২x১,২০০ শ্রম ঘণ্টা, অন্য ক্ষেত্রে উৎপন্ন ফলের মধ্যে অন্তভুক্ত হয় এইরকম ১২ ঘণ্টা। মুল্যের উৎপাদনে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিক কেবল তত জন ব্যক্তিগত শ্রমিক হিসাবে গণ্য হয়। সেই কারণে ১,২০০ জন মানুষ আলাদা আলাদা ভাবেই কাজ করুক আর একজন ধনিকের নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ ভাবেই কল করুক, তাতে কিছু এসে যায় না।
যাইহোক, নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে একটি পরিবর্তন ঘটে। মূল্যে রূপান্তরিত এম হচ্ছে একটি গড় সামাজিক গুণমানের শ্রম; স্বভাবতই তা গড় শ্রমশক্তির ব্যয়। কিন্তু যে-কোন গড় আয়ন হল কতকগুলি আলাদা আলাদা আয়তনের গড়, যে আয়তনগুলি প্রকৃতিতে অভিন্ন, তবে পরিমাণে বিভিন্ন। প্রত্যেকটি শিল্পে, প্রত্যেকজন ব্যক্তিগত শ্রমিক, তা সে পিটার হোত বা পল হোক, গড় শ্রমিক থেকে পৃথক। এইসব ব্যক্তিগত পার্থক্য, বা গণিত শাস্ত্রে যাকে বলা হয় “বিচ্যুতি, পরস্পরের কতিপুরণ করে দেয় এবং যখনি একটি ন্যূনতম সংখ্যক শ্রমিক এক সঙ্গে কর্ম-নিযুক্ত হয়, তখনি তা অস্তৃহিত হয়। প্রসিদ্ধ তার্কিক ও স্তাবক এভণ্ড বার্ক এতদূর পর্যন্ত যান যে, কৃষক হিসাবে তাঁর বাস্তব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি সজোরে এই উক্তি করেন। পাঁচজন কৃষিশ্রমিকের একটি এত ক্ষুদ্র উপদলেও সংশ্লিষ্ট শ্রমে ব্যক্তিগত সমস্ত পার্থক্য অন্তর্হিত হয়ে যায় এবং সেই কারণে যে-কোনো পাঁচ জন বয়স্ক কৃষি-শ্রমিক সমষ্টিগত অন্য যেকোনো পাচ জনের সমপরিমাণ কাজই করবে।[১] কিন্তু সে যাই হোক না কেন, এটা পরিষ্কার যে, একই সঙ্গে নিযুক্ত একটি বৃহৎ-সংখ্যক শ্রমিকের একটি সমষ্টিগত শ্রম-দিবসকে এই শ্রমিকদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে গড় সামাজিক শ্রমের একটি দিবস পায়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ধরা যাক, প্রত্যেকজন ব্যক্তির শ্রম-দিবস ১২ ঘণ্টা করে। তাহলে একই সঙ্গে নিযুক্ত ১২ জন মানুষের সমষ্টিগত শ্রম দিবস হবে ১৪৪ ঘণ্টা; এবং যদিও এই এক ডজন মানুষের প্রত্যেক জনেরই শ্রম গড় সামাজিক শ্রম থেকে কম-বেশি বিচ্যুত হতে পারে, কেননা একই কাজের জন্য তাদের প্রত্যেকেরই লাগতে পারে বিভিন্ন সময়, তবু যেহেতু প্রত্যেকেরই এম-দিবস হচ্ছে ১৪৪ ঘণ্টার সমষ্টিগত শ্রম-দিবসটির বারো ভাগের এক ভাগ, সেই হেতু তা একটি গড় সামাজিক শ্রম দিবসের সবকটি গুণের অধিকারী। তবে কিন্তু ধনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে, যিনি এই ১২ জন লোককে নিয়োগ করেন, এম দিবসটি হচ্ছে সেই গোটা এক ডজনেরই শ্রম দিবস। প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মানুষের দিবস হল সমষ্টিগত এম-দিবসের একাংশ, তা সেই ১২ জন মা তাদের কাজে পরস্পরকে সহায়তা করুক বা তাদের কাজের মধ্যে সংযোগ কেবল এই ঘটনায় এক যে তারা একই ধনিকের জন্য করছে, তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু যদি ঐ ১২ জন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র মালিকের দ্বারা ছয়টি জোড়ায় নিযুক্ত হয়, তা হলে প্রত্যেকটি মালিক একই মূল্য উৎপাদন করে কিনা এবং, ফলত, প্রত্যেকেই উদ্বৃত্ত-মূল্যের সাধারণ হারটি আয়ত্ত করে কিনা, তা হবে একটি দৈবাৎ ব্যাপার। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রগুলিতে বিভিন্ন বিচ্যুতি ঘটবে। যদি একজন শ্রমিক সামাজিক ভাবে আবশ্যক শ্রমের তুলনায় বেশ কিছু বেশি শ্রম লাগায়, তা হলে তার ক্ষেত্রে আবশ্যিক শ্রম-সময় যুক্তিযুক্ত ভাবেই সামাজিক ভাবে আবশ্যক গড় শ্রম থেকে বিচ্যুত হবে এবং সেই কারণেই তার এম গড় শ্রম হিসাবে গণ্য হবে না, তার শ্রমশক্তিও গড় শ্রমশক্তি বলে গণ্য হবে না। তা হলে, হয়, সেটা আদৌ বিক্রয়যোগ্য হবে না, আর নয়তো, শ্রমশক্তির গড় মূল্য থেকে কিছু কমে বিক্রয়যোগ্য হবে। সুতরাং সমস্ত শ্রমেই একটা নির্দিষ্ট ন্যূনতম মাত্রায় নৈপুণ্য ধরে নেওয়া হয় এবং পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখতে পাব যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন এই ন্যূনতম মাত্রা নির্ধারণের উপায়েরও ব্যবস্থা করে। যাইহোক, এই ন্যূনতম মাত্রা গড় থেকে বিচ্যুত হয়, যদিও, অপর পক্ষে, ধনিককে দিতে হয় শ্রম শক্তির গড় মূল্য। ছয় জন ক্ষুদ্র মালিকের মধ্যে একজন আদায় করে নেবে উত্ত মূল্যের গড় মূল্যের বেশি, অন্য জন তার কম। সমগ্র সমাজের বেলায় এই বৈষম্য গুলির ক্ষতিপূরণ ঘটে যায়, কিন্তু ব্যক্তিগত উৎপাদনকারীর বেলায় তা ঘটে না। সুতরাং যখন ব্যক্তিগত উৎপাদনকারী ধনিক হিসাবে উৎপাদন করে এবং এমন সংখ্যক শ্রমিককে একসঙ্গে নিযুক্ত করে যাদের শ্রম তার সমষ্টিগত প্রকৃতির দরুণ সঙ্গে সঙ্গেই গড় সামাজিক শ্রম হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়, কেবল তখনি মূল্য উৎপাদনের নিয়মগুলি তার পক্ষে পুরোপুরি কার্যকরী হয়।[২]
এমনকি কাজের ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন ব্যতিরেকে, এক বিরাট-সংখ্যক শ্রমিকের যুগপৎ নিয়োগের ফলেই শ্রম-প্রক্রিয়ায় বাস্তব অবস্থাবলীতে একটি বিপ্লব ঘটে যায়। যে বাড়িটিতে তারা কাজ করে, যে ভাড়ার-বাড়িতে কাঁচামাল রক্ষিত হয়, যেসব সরঞ্জাম বা বাসনপত্র শ্রমিকেরা যুগপৎ বা পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করে, সংক্ষেপে উৎপাদনের উপায় উপকরণের একটা অংশ এখন সকলে যৌথ ভাবে পরিভোগ করে। এক দিকে, উৎপাদনের এইসব উপায়-উপকরণের বিনিময়মূল্য বর্ধিত হয়, কেননা কোন পণ্যের ব্যবহার-মূল্য অধিকতর পরিপূর্ণ ভাবে ও আরো বেশি সুবিধাজনকভাবে পরিভুক্ত হলেই তার বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি পায় না। অন্য দিকে,এই উপায়-উপকরণগুলি ব্যবহৃত হয় যৌথভাবে এবং কাজে কাজেই আগের তুলনায় বৃহত্তর আয়তনে। যে ঘরটিতে ২০ জন। তন্তুবায় কাজ করে ২০টি সঁতে, সেটি নিশ্চয়ই যে ঘরটিতে একজন তন্তুবায় তার দুজন সহকারীকে নিয়ে কাজ করে, তা থেকে বড় হবে। কিন্তু প্রতি কর্মশালায় দুজন করে তন্তুবায়ের স্থান সংকুলান হয় এমন দশটি কর্মশালার তুলনায় কুড়ি জন লোকের একটি মাত্র কর্মশালা নির্মাণ করতে কম খরচ হয়। সুতরাং দেখা যায়, বৃহায়তনে যৌথ ব্যবহারের জন্য উৎপাদনের উপায়াদি সংকেন্দ্রীভূত করলে, তার মূল্য সেই উপায়াদি সম্প্রসারণ ও তাদের ব্যবহারিক ফলবৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুপাতে বুদ্ধি পায় না। যখন যৌথভাবে পরিভুক্ত হয়, তারা প্রত্যেকটি উৎপাদিত দ্রব্যে তাদের মূল্যের একটি ক্ষুদ্রতর অংশ স্থানান্তরিত করে। এর আংশিক কারণ এই যে, তারা যে-মোট মূল্য হাতছাড়া করে, তা বৃহত্তর সংখ্যক দ্রব্যের মধ্যে বিস্তার লাভ করে এবং আরেকটি আংশিক কারণ এই যে, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় তাদের কর্মপরিধির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মূল্য উৎপাদনের বিচ্ছিন্ন উপায়-উপকরণের মূল্য থেকে অনাপেক্ষিক ভাবে বেশি হলেও আপেক্ষিক ভাবে কম। এই কারণে স্থির মূলধনের একটি অংশের মূল্য হ্রাস পায় এবং এই হ্রাস-প্রাপ্তির আয়তনের সঙ্গে আনুপাতিক ভাবে পণ্যটির মূল্যও হ্রাস পায়। ফলটা এমন হয় যেন উৎপাদনের উপায়-উপকরণের খরচে কমে গিয়েছে। তাদের প্রয়োগে এই যে ব্যয়-হ্রাস, তার সামগ্রিক কারণ এই যে, তারা পরিভুক্ত হচ্ছে। বিরাট-সংখ্যক শ্রমিকের দ্বারা যৌথ ভাবে। অধিকন্তু, সামাজিক এমের আবশ্যিক শর্ত হবার এই চরিত্র—এমন একটি চরিত্র যা বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র শ্রমিকদের, কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধনিকদের, বিক্ষিপ্ত ও আপেক্ষিক ভাবে বেশি ব্যয়সাধ্য উৎপাদন-উপায় সমূহ থেকে তাদের বিশিষ্টতা দান করে—সেই চরিত্র অর্জিত হয় এমনকি যখন একত্র সমবেত অসংখ্য শ্রমিক পরস্পরকে সহায়তা না-ও করে, কিন্তু কেবল পাশাপাশি কাজ করে। শ্ৰম-প্রক্রিয়া নিজে এই চরিত্র অর্জন করার আগেই শ্রমের উপকরণাদির অংশবিশেষ তা অর্জন করে।
উৎপাদনের উপায়-উপকরণে ব্যয়-সংকোচকে দুদিক থেকে বিবেচনা করে দেখতে হবে। প্রথমত, পণ্যের মূল্য হ্রাস এবং তারা শ্রমশক্তির মূল্য হ্রাসের দিক থেকে। দ্বিতীয়ত, অগ্রিম-প্রদত্ত মোট মূলধনের উত্তমূল্যের অনুপাতের সঙ্গে অর্থাৎ স্থির ও অস্থির মূলধনের মূল্যের মোট অঙ্কের সঙ্গে পরিবর্তনের দিক থেকে। এই দ্বিতীয় দিকটি তৃতীয় গ্রন্থে উপনীত হবার আগে বিবেচনা করা হবে না যাতে সেগুলিকে তাদের যথোচিত পটভূমিকায় আলোচনা করা যায়; উপস্থিত প্রশ্নটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরো অনেক বিষয় আমরা মুলতুবি রাখছি, আমাদের বিশ্লেষণের অগ্রগতি আমাদের বাধ্য করছে বিষয়বস্তুটিকে এইভাবে দুভাগে ভাগ করতেধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রকৃতির সঙ্গে যে ভাগ খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা, যেহেতু এই উৎপাদন-পদ্ধতিতে শ্রমিক দেখে যে শ্রমের উপায়-উপকরণগুলি স্বতন্ত্র ভাব বিদ্যমান থাকে অন্য একজনের সম্পত্তি হিসাবে, সেহেতু তার কাছে ব্যয়সংকোচন প্রতিভাত হয় একটি পৃথক ব্যাপার হিসাবে-এমন একটি ব্যাপার, যার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই এবং সেই কারণেই, যেসব পদ্ধতির জ্বারা তার উৎপাদনশীলতা বর্ধিত হয়, সেইসব পদ্ধতির সঙ্গেও যার কোনো যোগ নেই।
যখন বহুসংখ্যক শ্রমিক পাশাপাশি কাজ করে, তা সে এক অভিন্ন প্রক্রিয়াটি হোক কিংবা বিভিন্ন অথচ পরস্পর-সংযুক্ত প্রক্রিয়াতেই হোক, তারা সহযোগ করছে কিংবা তারা সহযোগিতায় কাজ করছে বলে কথিত হয়।[৩]
ঠিক যেমন এক স্কোয়াড্রন ঘোড়-সওয়ারের আক্রমণ-ক্ষমতা কিংবা এক রেজিমেন্ট পদাতিকের প্রতিরক্ষা-ক্ষমতা ঐ সওয়ারদের বা পদাতিকদের আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত ক্ষমতার যোগফল থেকে মূলতঃ ভিন্ন, ঠিক তেমনি একটি ভারি ওজন উত্তোলন, একটি হাতল আবর্তন, একটি প্রতিবন্ধক অপসারণ ইত্যাদির মত একটি অখণ্ড কর্মকাণ্ডে গত শত হাতের যুগপৎ অংশগ্রহণে যে সামাজিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটে, আলাদা আলাদা ভাবে সেই সামাজিক শক্তিটি থেকে এক একজন শ্রমিক যে যান্ত্রিক শক্তির প্রয়োগ ঘটায়, সেই যান্ত্রিক শক্তিগুলির যোগফল মূলতঃ ভিন্ন।[৪] এই ধরণের ক্ষেত্রগুলিতে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত শ্রম, হয়, সম্মিলিত শ্রমের যা উৎপাদন ফল, তা উৎপন্ন করতে পারে না আর, নয়তো, যদি পারেও তা হলে তাতে ব্যয় করতে হবে বিপুল পরিমাণ সময় আর, নয়তো, তা উৎপন্ন করতে হবে একান্ত স্বীকৃত আয়তনে। সহযোগের মাধ্যমে আমরা যে এখানে কেবল উৎপাদিকা শক্তিবৃদ্ধিই করতে পারি তাই নয়, উপরও একটি নোতুন শক্তির সৃষ্টিও করতে পারিসে শক্তি হল গণশক্তি।[৫]
একটি মাত্র শক্তির মধ্যে বহু শক্তির এই সম্মিলন থেকে নোতুন একটি শক্তি উদ্ভব ছাড়াও, কেবল সামাজিক সংস্পর্শ থেকেই অধিকাংশ শিল্পে জন্ম নেয় পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা ও প্রেরণার জৈব আবেগ, যার ফলে প্রত্যেক ব্যক্তিগত শ্রমিকের নৈপুণ্য উন্নীত হয়। সুতরাং আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করে এমন বার জন কিংবা পরপর বার দিন কাজ করছে এমন শ্রমিকের তুলনায়, একজন শ্রমিক তাদের ১৪৪ ঘণ্টার শ্রম-দিবসে টের বেশি উৎপাদন করে।[৬] এর কারণ এই যে, মানুষ একটি রাজনৈতিক জীব[৭], যে কথা অ্যারিস্তোতল বলে গেছেন, তা নাও হয়, তবু সে অবশ্যই একটি সামাজিক জীব।
যদিও এক দল মানুষ একই সময়ে একই কাজ বা একই ধরনের কাজে লিপ্ত থাকতে পারে, তবু প্রত্যেকের প্রম, সমষ্টিগত শ্রমের অংশ হিসাবে, শ্রম-প্রক্রিয়ার একটি বিশিষ্ট পর্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকতে পারে যে প্রক্রিয়াটির সমস্ত পর্যায়ের মাধ্যমে, সহযোগের ফলশ্রুতি হিসাবে, তাদের শ্রমের বিষয়টি অধিকতর দ্রুতগতিতে অতিক্রম করে। যেমন, যদি এক ডজন রাজমিস্ত্রি নিজেদেরকে এক সারিতে এমনভাবে স্থাপন করে, যাতে তারা একটি মইয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাথর তুলে দিতে পারে, তা হলে। তাদের প্রত্যেকেই একই জিনিস করে থাকে, তবু কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্ন কাজগুলি হয়ে ওঠে একটি সমগ্র কর্মকাণ্ডের পরম্পর-সংযুক্ত অংশ, এই অংশগুলি হচ্ছে বিশেষ বিশেষ পর্যায় যাদের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটি পাথরকেই পার হতে হয়, প্রত্যেকটি লোক যদি আলাদা আলাদা ভাবে মই বেয়ে আপন আপন বোঝা নিয়ে ওঠা-নামা করত; তা হলে তারা যত তাড়াতাড়ি তা উপরে তুলতে পারত, তার চেয়ে ঢের তাড়াতাড়ি ঐ পাথর গুলিকে উপরে তোলা যায় যদি ঐ এক সারি লোকের ২৪টি হাত সে কাজটি করে।[৮]
বিষয়টিকে একই দূরত্বে বয়ে নেওয়া যায় অল্পতর সময়ের মধ্যে। আবার যখন, দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, একটি বিডিং-এর বিভিন্ন পার্শ্বে একই সঙ্গে হাত লাগানো হয়, তখনো একটি শ্রম-সংযোজন ঘটে থাকে, যদিও এখানেও সহযোগী রাজমিস্ত্রিরা একই কাজ বা একই ধরনের কাজ করতে থাকে। একজন রাজমিস্ত্রি বারো দিন বা ১৪৪, ঘণ্টা যা করে, তার চেয়ে ১২ জন রাজমিস্ত্রি তাদের ১৪৪ ঘণ্টার সমষ্টিগত শ্রম-দিবসে ঐ বিডিংটি নির্মাণে ঢের বেশি অগ্রগতি করে। এর কারণ এই যে, একসঙ্গে কর্মরত লোকদের একটি দলের পেছনে ও সামনে উভয় দিকেই হাত ও চোখ থাকে এবং একটা মাত্রা পর্যন্ত তা সর্বচারী। আর কাজটির সমস্ত অংশ যুগপৎ এগিয়ে যায়।
উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিতে আমরা এই বিষয়টির উপরে জোর দিয়েছি যে, বহু মানুষ একই কাজে বা একই ধরনের কাজে লিপ্ত হয়, কেননা যৌথ শ্রমের সবচেয়ে সরল এই রূপটি সহযোগের ক্ষেত্রে একটি বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে, এমনকি সহযোগের সর্বাপেক্ষা পূর্ণ-বিকশিত পর্যায়টিতেও। কাজটি যদি জটিল হয়, তা হলে সহযোগকারী লোকদের নিছক সংখ্যাই বিভিন্ন কর্ম-প্রক্রিয়াটিকে বিভিন্ন হাতে ভাগ বাটোয়ারা করে দেবার এবং একই সঙ্গে সেগুলিকে চালিয়ে যাবার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। গোটা কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় এইভাবে হ্রস্বীভূত হয়।[৯]
অনেক শিল্পে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটির দ্বারা নির্ধারিত সংকট সময়সীমা আছে যার মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি ফল অবশ্যই লাভ করতে হবে। যেমন, যদি একপাল ভেড়ার লোম কেটে নিতে হয়, কিংবা একটি গমের ক্ষেতের ফসল কাটতে এবং গোলাজাত করতে হয় তাহলে উৎপন্ন জিনিসটির গুণমান ও পরিমাণ নির্ভর করবে কাজটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুরু করা ও শেষ করার উপরে। এই ধরনের ব্যাপারগুলিতে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে কতটা সময় নেওয়া উচিত তা নির্দিষ্ট করা থাকে, ঠিক যেমন হেরিং মাছ ধরার ব্যাপারে। একজন মানুষ একটি স্বাভাবিক দিবস থেকে, ধরুন, ১২ ঘণ্টার বেশি একটি শ্রম-দিবস বার করে নিতে পারে না, কিন্তু পরস্পরের সহযোগকারী ১০০ গুন মানুষ ১২… ঘন্টা পর্যন্ত একটি শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করতে পারে। উক্ত কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়কালের এই যে হ্রাস-সাধন, তা পুষিয়ে দেওয়া হয় উৎপাদন ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময়ে বিপুল পরিমাণ শ্রম কাজে লাগিয়ে দিয়ে। যথাচিত সময়ের মধ্যে কর্তব্য-কৰ্মটি সম্পূর্ণ হবে কিনা তা নির্ভর করে বহুসংখ্যক সংযোজিত শ্রম-দিবসের প্রয়োগের উপরে, প্রয়োজনীয় ফলের পরিমাণ নির্ভর করে শ্রমিকের সংখ্যার উপরে, কিন্তু ঐ একই সময়ের মধ্যে একই পরিমাণ কাজ করতে যতজন বিচ্ছিন্ন শ্রমিকের দরকার হয় তাদের সংখ্যার তুলনায় উপরিলিখিত শ্রমিকদের সংখ্যা সব সময়েই কম।[১০] এই ধরনের সহযোগের অভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশে বিপুল পরিমাণ শস্য এবং পূর্ব ভারতের সেই সব অংশে, যেখানে ইংরেজ প্রাচীন জন-সমাজগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, সেখানে বিপুল পরিমাণ তুলো প্রতি বছর নষ্ট হয়।[১১]
এক দিকে, সহযোগের কাজটিকে একটি বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়; এর জন্য কয়েক ধরনের প্রতিষ্ঠান আবশ্যিক ভাবেই প্রয়োজন হয়; যেমন পয়ঃপ্রণালীর সংস্থান, বাঁধ ( ডাইক) নির্মাণ, সেচের বন্দোবস্ত এবং খাল, রাস্তা ও রেলপথের ব্যবস্থা। অন্যদিকে, উৎপাদনের আয়তন সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে এর কারণে সম্ভব হয় কর্মাঙ্গনের পরিধির সংকোচ সাধন। আয়তনের সম্প্রসারণ, যার ফলে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের কাটছাট করা সম্ভব হয়—সেই আয়তনগত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ বা তজ্জনিত কৰ্মাঙ্গনের সংকোচন ঘটে শ্রমিকদের একত্রীভবন, বিবিধ প্রক্রিয়ার সংযোজন এবং উৎপাদনের উপায়-উপকরণের কেন্দ্রীভবন থেকে।[১২]
আলাদা আলাদা শ্রম-দিবসের যোগফল একটি সংযোজিত শ্রম-দিবসের সমান হলেও প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টি বৃহত্তর পরিমাণ ব্যবহারমূল্য উৎপাদন করে এ এইভাবে একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় ফল উৎপাদনের জন্য আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হ্রাসসাধন করে। যেহেতু তা শ্রমের যান্ত্রিক শক্তি বাড়িয়ে দেয় কিংবা তার কাজের পরিধিকে একটি বৃহত্তর জায়গায় ছড়িয়ে দেয় কিংবা উৎপাদনের আয়তনের তুলনায় উৎপাদনের ক্ষেত্রটিকে ছোট করে আনে কিংবা সংকট মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ শ্রমকে কাজে লাগায় কিংবা ব্যক্তিতে ব্যত্তিতে পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়, এবং তাদের মধ্যে জৈব কর্মোদ্যম জাগিয়ে দেয় কিংবা বহুসংখ্যক মানুষের দ্বারা পরিচালিত অনুরূপ কর্ম কাণ্ডের উপরে অনবচ্ছিন্নতা ও বহুমুখিতার ছাপ একে দেয় কিংবা একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে কিংবা যৌথ ব্যবহারের দ্বারা উৎপাদন-উপকরণাদির সাশ্রয় ঘটায় কিংবা ব্যক্তিগত শ্রমকে সামাজিক শ্রমের চরিত্র দান করে, সেই হেতু একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সংযোজিত শ্রম-দিবসটি এই বর্ধিত উৎপাদিকা শক্তি অর্জন করে কিনা—উল্লিখিত হেতুগুলির মধ্যে যে কোনটিই এই বৃদ্ধির কারণ হোক না কেন, সংযোজিত শ্রম দিবসটির বিশেষ উৎপাদিকা শক্তিটি সমস্ত অবস্থাতেই হচ্ছে শ্রমের সামাজিক উৎপাদিকা শক্তি কিংবা সামাজিক শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি। সহযোগই হচ্ছে এই শক্তির কারণ। শ্রমিক যখন নিয়মিত অবে অন্যান্যদের সঙ্গে সহযোগিতা করে, সে তখন তার ব্যক্তিগত চরিত্রের বন্ধনগুলি থেকে যুক্ত হয় এবং তার প্রজাতির চারিত্র-ক্ষমতাগুলির অধিকারী হয়। [১৩]
সাধারণ নিয়ম এই যে, এক জায়গায় আনীত না হলে শ্রমিকেরা সহযোগিতা করতে পারে না। তাদের এই এক জায়গায় সমাবেশ তাদের সহযোগের একটি আবশ্যিক শর্ত। সুতরাং মজুরি-শ্রমিকরা পরস্পরের সঙ্গে সহযোগ করতে পারে না, যদি তারা একই মূলধনের দ্বারা, একই ধনিকের দ্বারা, একই সঙ্গে নিযুক্ত না হয় এবং সেই কারণে একই সঙ্গে ক্রীত না হয়। এই শ্রমশক্তিসমূহের এক দিনের মোট মূ কিংবা এই শ্রমিকদের এক দিনের মজুরিসমূহের পরিমাণ উৎপাদন-প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের সমবেত করার আগেই ধনিকের পকেটে প্রস্তুত রাখতে হবে। একটা গোটা বছর জুড়ে সপ্তাহে সপ্তাহে একটি ক্ষুদ্রতর সংখ্যক মানুষের মজুরি দেবার জন্য যে মূলধন বিনিয়োগের দরকার হয়, তার তুলনায় ৩০০ শ্রমিকের এককালীন মজুরি দেবার জন্য, যদিও মাত্র এক দিনের জন্য, বৃহত্তর পরিমাণ বিনিয়োগের দরকার হয়। অতএব, সহযোগকারী শ্রমিকদের সংখ্যা অথবা উৎপাদনের আয়তন নির্ভর করে, প্রথমতঃ শ্রমশক্তি ক্রয়ের জন্য ব্যক্তিগত ধনিক কত পরিমাণ মূলধন খাটাতে পারে, তার উপরে, অর্থাৎ কত সংখ্যক শ্রমিকের জীবনধারণের উপকরণাদির ব্যবস্থা একজন নিক করতে পারে, তার উপরে।
এবং অস্থির মূলধনের ক্ষেত্রেও যেমন, স্থির মূলধনের ক্ষেত্রেও তেমন। নমুনা হিসাবে, ১০ জন করে শ্রমিক নিয়োগ করে এমন ৩০ জন ধনিকের প্রতিএকজনের বেলায় যে-পরিমাণ কাঁচা মাল বিনিয়োগের দরকার হয়, ৩০০ জন শ্রমিক নিয়োগ করে এমন একজন ধনিকের বেলায় তুলনায় ৩০ গুণ বেশি কঁচামালের দরকার হয়। একথা ঠিক যে, শ্রমিক-সংখ্যা যে-হারে বৃদ্ধি পায়, যৌথ ভাবে ব্যবহৃত শ্ৰম-উপকরণসমূহের মূল্য ওপরিমাণ সেই একই হারে বৃদ্ধি পায়না, কিন্তু তারা বেশ লক্ষণীয় ভাবেই বৃদ্ধি পায়। অতএব, মজুরি-শ্রমিকদের পারস্পরিক সহযোগের একটি বাস্তব শর্তই হচ্ছে ব্যক্তিগত ধনিকের হাতে বড় বড় পরিমাণ মূলধনের কেন্দ্রীভবন এবং এই সহযোগ কিংবা উৎপাদন-আয়তনের মাত্রা নির্ভর করে এই কেন্দ্রীভবনের উপরে।
পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, যাতে করে যুগপৎ নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা এবং, কাজে কাজেই, উৎপাদিত উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ স্বয়ং নিয়োগকারীকে দৈহিক শ্রম থেকে মুক্তি দেবার পক্ষে এবং তাকে ক্ষুদ্র মালিক থেকে একজন ধনিকে রূপান্তরিত করার পক্ষে এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে যথেষ্ট হয়, তার জন্য একটি বিশেষ পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন হয়। এখন আমরা দেখছি যে, বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র প্রক্রিয়াকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করার জন্যও একটি ন্যূনতম পরিমাণ মূলধন হল একটি অপরিহার্য শর্ত।
আমরা প্রথমে আরো দেখেছিলাম যে, শ্রমিক নিজের জন্য কাজ করার পরিবর্তে কাজ করে ধনিকের জন্য এবং স্বভাবতই তার অধীনে এই ঘটনারই একটি আনুষ্ঠানিক ফলশ্রুতি হচ্ছে মূলধনের কাছে শ্রমের বশ্যতা। বহু সংখ্যক মজুৰ্বি-শ্রমিকের সহযোগের মাধ্যমে মূলধনের কর্তৃত্ব খোদ শ্রম-প্রক্রিয়াটিকেই চালিয়ে নিয়ে যাবার একটি পূর্বশর্তে, উৎপাদনের একটি যথার্থ পূর্বশর্তে পরিণতি লাভ করে। রণক্ষেত্রে সেনাপতির কর্তৃত্ব যেমন অপরিহার্য, শ্রম ক্ষেত্রেও এখন ধনিকের কর্তৃত্ব তেমন অপরিহার্য।
ব্যক্তিগত শ্রমিকদের কাজকর্মগুলিকে সুশৃঙ্খল ভাবে পরিচালিত করার জন্য এবং যে সমস্ত সাধারণ কর্তব্যগুলির উৎপত্তি সম্মিলিত সংগঠনটির বিভিন্ন অঙ্গ থেকে না ঘটে, ঘটে সমগ্র সংগঠনটি থেকে, সেই সমস্ত কর্তব্যগুলি সম্পন্ন করার জন্য সমস্ত বৃহদায়তন সম্মিলিত মেরই চাই মোটামুটি একটি নির্দেশক কর্তৃপক্ষ। একজন একক বেহালা বাদক নিজেই নিজের নির্দেশক; কিন্তু বৃন্দ-বাদনে চাই একজন স্বতন্ত্র নির্দেশক। যে মুহূর্তে মূলধনের নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রম পরস্পর সহযোগী হয়, সেই মুহূর্ত থেকে নির্দেশনা তদারকি ও সমন্বয়সাধন মূলধনের অন্যতম কাজ হয়ে ওঠা মাত্র তা বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়।
ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের পরিচালিকা প্রেরণা, তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে যথাসম্ভব অধিকতম পরিমাণ উত্তমূল্য আদায় করে নেওয়া এবং স্বভাবতই শ্রমশক্তিকে যথাসম্ভব অধিকতম মাত্রায় শোষণ করা।[১৪] সহযোগকারী শ্রমিকদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায়, মূলধনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধও ততটা বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে পালটা চাপের সাহায্যে তাদের প্রতিরোধকে অতিক্রম করার আবশ্যকতাও বৃদ্ধি পায়। ধনিক যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ভোগ করে, তা কেবল সামাজিক শ্রম-প্রক্রিয়ার প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের দরুণই নয়, উপরন্তু সেই সঙ্গে এটা সামাজিক শ্রম প্রক্রিয়া শোষণের একটি অনুষঙ্গও বটে এবং স্বভাবতই এক দিকে শোষক ও অন্য দিকে জীবন্ত ও শ্রমরত কাঁচামাল, যা সে শোষণ করে—এই দুয়ের মধ্যকার অপরিহার্য বৈরিতার মধ্যে প্রথিতও বটে।
আবার উৎপাদনের উপায়-উপকরণ, যা এখন আর শ্রমিকের সম্পত্তি নয়, মালিকের সম্পত্তি, তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবার অনুপাতে, এইসব উপায়-উপকরণের সঠিক প্রয়োগের উপরে কার্যকরী নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতাও বৃদ্ধি পায়।[১৫] অধিকন্তু, মজুরি শ্রমিকদের এই সহযোগ সমগ্র ভাবেই সংঘটিত হয় মূলধনের দ্বারা, যে মূলধন তাদের নিয়োগ করে। একটি উৎপাদক-সমষ্টিতে তাদের সম্মেলন এবং তাদের ব্যক্তিগত কাজকর্মগুলির মধ্যে সংযোগ-সাধন তাদের কাছে অপরিচিত ও বহিরাগত; এই ব্যাপার দুটি তাদের কাজ নয়, কিন্তু মূলধনটির কাজ হচ্ছে যে সে তাদের এক জায়গায় জড় করে এবং একত্রিত রাখে তার কাজ। সুতরাং তাদের বিভিন্ন ধরনের শ্রমের মধ্যে এই সংযোগ তাদের কাছে ভাগবত ভাবে প্রতীয়মান হয় ধনিকের একটি পূর্ব-চিন্তিত পরিকল্পনার আকারে এবং কার্যত সেই ধনিকের কর্তৃত্বের আকারে, যে ব্যক্তি তাদের কাজকর্মকে তার নিজের উদ্দেশ্যে বশীভূত করেছে এমন অন্য একজনের ইচ্ছাশক্তির আকারে। যদি সেক্ষেত্রে ধনিকের নিয়ন্ত্রণ খোদ উৎপাদন-প্রক্রিয়ার নিজেরই দ্বিবিধ প্রকৃতির দরুণ মর্মগত ভাবে দ্বিবিধ হয়—যে-উৎপাদন-প্রক্রিয়া, এক দিক থেকে, ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের জন্য একটি সামাজিক প্রক্রিয়া এবং, অন্য দিক থেকে, উত্তমূল্য উৎপাদনের জন্যও একটি প্রক্রিয়া, তা হলে রূপগত ভাবে তা স্বৈরতান্ত্রিক। সহযোগের আয়তন যতই বৃদ্ধি পায়, এই স্বৈরতন্ত্রও ততই একান্ত ভাবে স্বকীয় বিশেষ বিশেষ ধারণ করে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন বলতে যা বোঝায়, তা শুরু করার মত ন্যূনতম পরিমাণে মূলধন পৌছে গেলেই যেমন প্রথমে ধনিক সত্যকার শ্রম থেকে নিষ্কৃতি পায়, ঠিক তেমনি এখন সে ব্যতিগত শ্রমিকদের ও শ্রমিক-গোষ্ঠীদের প্রত্যক্ষ ও নিরন্তর তদারকির কাজ এক বিশেষ ধরনের মজুরি-শ্রমিকের হাতে তুলে দেয়। সত্যকার সেনাবাহিনীর মত, শিল্প-শ্রমিক বাহিনীরও চাই একজন ধনিকের অধিনায়কত্বের অধীনে উপযুক্ত সংখ্যক অফিসার (ম্যানেজার) ও সার্জেন্ট (ফোরম্যান ও ওভারসিয়ার ), যারা কাজ চলাকালে ধনিকের নামে নির্দেশ দেয়। তদারকির কাজই হয় তাদের সুনির্দিষ্ট ও একমাত্র কাজ। দাসশ্রম কর্তৃক উৎপাদনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন কৃষক ও কারিগরদের উৎপাদন-পদ্ধতি তুলনা করার সময়ে অর্থনীতিবিদ তদারকির এই শ্রমকে গণ্য করেন উৎপাদনের ‘faux taris হিসাবে।[১৬] ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির বিবেচনাকালে তিনি কিন্তু উল্টো ভাবে, শ্রম প্রক্রিয়ার সহযোগী প্রকৃতি-জনিত এই নিয়ন্ত্রণের কাজটিকে উক্ত প্রক্রিয়ার ধনতান্ত্রিক প্রকৃতি-জনিত এবং ধনিক ও শ্রমিকের সংঘাত-জনিত এই নিয়ন্ত্রণের ভিন্নতর কাজটির সঙ্গে অভিন্ন বলে গণ্য করে থাকেন।[১৭] কোন লোক শিল্পের নেতা বলেই ধনিক নয়, বরং সে ধনিক বলেই শিল্পের নেতা। যেমন, সামন্ততান্ত্রিক আমলে ভূমি-সম্পত্তির চরিত্র বৈশিষ্ট্য ছিল সেনাপতি ও বিচারকের কাজ, ঠিক তেমনি মূলধনের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিল্পের নেতৃত্ব।[১৮]
যে পর্যন্ত না শ্রমিক তার শ্রমশক্তিকে বেচে দেবার জন্য ধনিকের সঙ্গে তার দর কষাকষি সম্পন্ন করেছে, সে পর্যন্ত সে তার শ্রমশক্তির মালিক থাকে; এবং তার যা আছে তার বেশি, অর্থাৎ তার ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন-শ্রমশক্তির বেশি, সে কিছু বিক্রি করতে পারে না। একজন মানুষের শ্রমশক্তির জায়গায় ধনিক যে ১০০ জনের শ্রমশক্তি জয় করে, এবং একজনের জায়গায় ১০০ জন অসযুক্ত মানুষের সঙ্গে আলাদা আলাদা চুত্তিতে প্রবেশ করে, এই ঘটনার দ্বারা উল্লিখিত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনা। তাদের পরস্পরের সঙ্গে সহযোগ করতে না দিয়ে ধনিক ঐ ১০০ জন মানুষকে কাজে লাগাবার স্বাধীনতা ভোগ করে। সে তাদেরকে প্রদান করে ১০০ আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র শ্রমশক্তির মূল্য, কিন্তু ঐ ১০০ জনের সংযোজিত শ্রমশক্তির মূল্য প্রদান করে না। যেহেতু পরস্পর-নিরপেক্ষ, সেহেতু শ্রমিকেরা হল ভিন্ন ভিন্ন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি, যারা ধনিকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে নয়। পরস্পরের সঙ্গে এই সহযোগ শুরু হয় কেবল শ্রম-প্রক্রিয়া শুরু হবার সঙ্গেই, কিন্তু তখন তারা আর নিজেদের মালিক থাকে না। শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে তারা মূলধনের সঙ্গে সংবদ্ধ হয়। সহযোগকারী হিসাবে, একটি কর্ম-নিযুক্ত সংগঠন হিসাবে, তারা পরিণত হয় মূলধনেরই অস্তিত্বের বিশেষ বিশেষ ধরণে। সুতরাং পারস্পরিক সহযোগে কাজ করার সময়ে শ্রমিক যে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটায়, তা মূলধনেরই উৎপাদিকা শক্তি। যখনি শ্রমিকদেরকে বিশেষ অবস্থায় স্থাপন করা হয়, তখনি বিনামূল্যে এই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটে। এবং সেই বিশেষ অবস্থায় মূলধনই তাদেরকে স্থাপন করে। যেহেতু এই উৎপাদিকা শক্তির জন্য মূলধনের কিছুই ব্যয় হয় না অথচ যেহেতু অন্য দিকে তার শ্রম মূলধনের মালিকানায় যাবার আগে শ্রমিক নিজে তা উৎপাদন করেনা, সেহেতু তা প্রতীয়মান হয় এমন একটি শক্তি হিসাবে যা দিয়ে প্রকৃতি যেন মূলধনকে সমৃদ্ধ করেছে- এমন একটি উৎপাদিকা শক্তি যা যেন মূলধনেই অন্তর্নিহিত।
সরল সহযোগের বিরাট বিরাট ফলশ্রুতি প্রাচীন এশিয়াবাসী, মিশরবাসী, এরিয়া বাসী প্রভৃতিদের অতিকায় ইমারতগুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। “অতীত কালে এমন ঘটেছে যে প্রাচ্যের এই রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সামরিক ও অসামরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের খরচ যুগিয়েও, নিজেদের অধিকারে এমন পরিমাণ উদ্বুত্ত পেত, যা তারা জমকালো বা প্রয়োজনীয় নির্মাণকার্যে প্রয়োগ করতে পারত এবং এই সমস্ত নির্মাণকার্যে প্রায় সমগ্র অ-কৃষক জনসংখ্যার হাত ও বাহুর উপরে তাদের কর্তৃত্ব সৃষ্টি করেছে বিশাল বিশাল সৌধ, যা আজও তাদের শক্তির পরিচয় বহন করে। নীল নদের উর্বর উপত্যকা দ্রুত বর্ধমান অ-কৃষক জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদন করত এবং রাজা ও পুরোহিততন্ত্রের মালিকানাধীন এই খাদ্যসম্ভার বিশাল বিশাল সৌধ নির্মাণের ব্যয়ভার যোগাত যে সৌধগুলি ভরে রেখেছিল গোটা দেশটিকে। অতিকায় মূর্তিসমূহ ও তাদের সুবিশাল আকার, যাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহণ বিস্ময় সৃষ্টি করে, সেগুলির স্থানান্তর সাধনে অমিত হস্তে ব্যবহৃত হয়েছিল প্রায় একক ভাবেই মনুষ্য-প্রম। শ্রমিকদের সংখ্যা ও একত্রীভূত চেষ্টাই ছিল যথেষ্ট। আমরা দেখি সমুদ্রগর্ভ থেকে উখিত বিশাল প্রবালশূপের দ্বীপ ও সুদৃঢ় ভূমিতে তার পরিণতি, যদিও প্রত্যেকটি প্রবালের একক অবদান ক্ষুদ্র, দুর্বল ও অবজ্ঞেয়। এশীয় রাজতন্ত্রের অধীনস্থ অ-কৃষক শ্রমিকদের ব্যক্তিগত শারীরিক পরিশ্রম ছাড়া দেবার মত আর কিছুই ছিল না। কিন্তু তাদের সংখ্যাই তাদের বল এবং এই জনসমষ্টিগুলিকে চালাবার শক্তিই উদ্ভব ঘটিয়েছে কত প্রাসাদ ও মন্দিরের, কত পিরামিড ও অতিকায় মূর্তিবাহিনীর, যাদের ধ্বংসাবশেষগুলি পর্যন্ত আমাদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। এক বা কয়েকের হাতে কেন্দ্রীভূত রাজস্ব থেকে তাদের পোষণ করা হত বলেই এই ধরনের কর্মকাণ্ড সম্ভব হয়েছিল।[১৯] এশীয় ও মিশরীয় রাজাদের এবং এরিয়ার দিব্য শাসক প্রভৃতিদের এই শক্তি এখন স্থানান্তরিত হয়েছে ধনিকের হাতে, তা সে একজন বিচ্ছিন্ন ধনিকই হোক কিংবা যৌথ মূলধনী প্রতিষ্ঠানগুলির মত সমষ্টিগত ধনিকই হোক।
মানবিক বিকাশের ঊষাকালে আমরা মৃগয়াজীবী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে[২০] অথবা, ধরুন, ভারতীয় জনসমাজগুলির কৃষিকার্যের মধ্যে যে ধরনের সহযোগ লক্ষ্য করি, তার ভিত্তি ছিল, একদিকে, উৎপাদনের উপায়গুলির উপরে যৌথ মালিকানা এবং, অন্যদিকে, এই ঘটনাটির উপরে যে, ঐসব ক্ষেত্রে, প্রত্যেকটি মৌমাছি তার মৌচাকের সঙ্গে ঘটা সংযোগ-বিচ্ছিন্ন, তার তুলনায় প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার গোষ্ঠী বা সমাজের সঙ্গে তার নাড়ির সংযোগ থেকে বেশি বিচ্ছিন্ন নয়। উল্লিখিত এই দুটি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেই এই সহযোগ ধনতান্ত্রিক সহযোগ থেকে ভিন্ন। প্রাচীন কালে, মধ্যযুগে এবং আধুনিক উপনিবেশগুলিতে যে সহযোগের বৃহদায়তন প্রয়োগের বিক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত লক্ষিত হয়, তার ভিত্তি হচ্ছে আধিপত্য ও বন্যার সম্পর্কের উপরে, প্রধানতঃ ক্রীতদাসত্বর উপরে। বিপরীত দিকে, সহযোগের ধনতান্ত্রিক রূপটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে নেয় স্বাধীন মজুরি-শ্রমিকের অস্তিত্ব, যে তার শ্রমশক্তিকে বিক্রয় করে ধনিকের কাছে। ঐতিহাসিক ভাবে, অবশ্য এই রূপটি বিকশিত হয় ক্ষুদ্র চাষীর কৃষিকর্ম ও স্বাধীন হস্তশিল্পের সঙ্গে বিরোধিতার পথে, তা সে হস্তশিল্প গিলডের অভ্যন্তরেই হোক বা না-ই হোক।[২১] এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে, ধনতান্ত্রিক সহযোগ, সহযোগের একটি বিশেষ ঐতিহাসিক রূপ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনা বরং স্বয়ং সহযোগই আত্মপ্রকাশ করে এমন একটি ঐতিহাসিক রূপ হিসাবে, যা উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বকীয় ও বিশেষ ভাবে পার্থক্য-সূচক একটি বৈশিষ্ট্য।
সহযোগিতা দ্বারা বিকশিত শ্রমের সামাজিক উৎপাদিকা শক্তি যেমন প্রতীয়মান হয় মূলধনের উৎপাদিকা শক্তি হিসাবে, ঠিক তেমনি বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র শ্রমিকের দ্বারা, এমনকি, ক্ষুদ্র নিয়োগকারীদের দ্বারা সম্পাদিত উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রতিতুলনায় স্বয়ং সহযোগও প্রতীয়মান হয় ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট রূপ হিসাবে। চলমান শ্রম-প্রক্রিয়া যখন মূলধনের নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে, তখন এই পরিবর্তনই হয় তার প্রথম অভিজ্ঞতা। এই পরিবর্তন ঘটে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে। একই অভিন্ন প্রক্রিয়ায় বহুসংখ্যক শ্রমিকের নিয়োগ, যা এই পরিবর্তনের একটি আবশ্যিক শর্ত, তাই আবার ধনতান্ত্রিক উৎপাদনেরও সূচনা-বিন্দু। স্বয়ং মূলধনের জন্ম এই সূচনা-বিন্দুর সমকালীন। তা হলে, যদি একদিকে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়া আমাদের কাছে ঐতিহাসিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করে সামাজিক প্রক্রিয়ায় শ্রম-প্রক্রিয়ায় রূপান্তরণে আবশ্যিক শর্ত হিসাবে, তা হলে, অন্যদিকে, শ্রম-প্রক্রিয়ার এই সামাজিক রূপ আত্মপ্রকাশ করে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তার অধিকতর লাভজনক ব্যবহার হিসাবে।
প্রাথমিক রূপে, যে রূপটিতে আমরা তাকে এতক্ষণ দেখেছি, সহযোগ সমস্ত বৃহদায়তন উৎপাদনেরই একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ। কিন্তু ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বিকাশে একটি বিশেষ যুগের বৈশিষ্ট্যসূচক কোন নির্দিষ্টরূপের প্রতিনিধিত্ব করেনা। বড় জোর, তা তেমন কিছু করে বলে মনে হতে পারে, তাও মোটামুটি ভাবেই, কেবল দুটি ক্ষেত্রে প্রথমত, ম্যানুফ্যাকচারের হস্তশিল্পবৎ সুচনার মধ্যে এবং, দ্বিতীয়ত, কৃষি-কর্মের সেই বৃহদায়তন রূপের মধ্যে, যা ম্যানুফ্যাকচার-যুগের সহগামী এবং যা যুগপৎ কর্মনিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ও তাদের ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীকৃত উৎপাদন উপকরণাদির বিপুল সমাবেশের দ্বারা বিশেষিত। উৎপাদনের যেসব শাখায় মূলধন বৃহদায়তনে কাজ করে এবং শ্রম ও যন্ত্রপাতির বিভাজন কেবল গৌণ ভূমিকা পালন করে, সে সব শাখায় সরল সহযোগই হচ্ছে প্রচলিত রূপ।
সহযোগ হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির চিরকালীন মৌল রূপ; যাইহোক, উৎপাদন-পদ্ধতির আরো পরিণত রূপগুলির পাশাপাশি সহযোগের প্রাথমিক রূপটিও টিকে থাকে।
————
১. এটা প্রশ্নাতীত যে, একজন মানুষের শ্রমের মূল্য এবং আরেক জন মানুষের শ্রমের মূল্যের মধ্যে শক্তি, কুশলতা ও তন্নিষ্ঠ প্রয়োগের দিক থেকে প্রচুর পার্থক্য থাকে। কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ থেকে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে, যে-কোনো পাঁচজন লোক সমষ্টিগতভাবে জীবনের উল্লিখিত সময়কালের মধ্যে অ যে-কোনো পাঁচজনের সম-পরিমাণ শ্রম করবে : অর্থাৎ, এই পাঁচ জনের মধ্যে একজন হবে ভাল কর্মীর সমস্ত গুণের অধিকারী, তিনজন খারাপ এবং বাকি একজন প্রথম ও শেষের মাঝামাঝি। তার ফলে এমনকি পাঁচজনেরও একটি ক্ষুদ্র প্ল্যাটুনে আপনি পেয়ে যাবেন পাঁচজন যা উপার্জন করতে পারে তার পরম্পর-পরিপূরক একটি ব্যবস্থা।” (ই বার্ক। “খটল অ্যাণ্ড ডিটেইলস অব সোসাইটি”, পৃঃ ১৫, ১৬)। কোয়েটংট-এর গড়পড়তা মানুষ সম্পর্কে বক্তব্য তুলনীয়।
২. অধ্যাপক রক্ষার দাবি করেন যে, তিনি আবিষ্কার করেছেন, শ্ৰীমতী রক্ষার কর্তৃক নিযুক্ত একজন নারী-সূচীকর্মী দুদিনে যে কাজ করে, তা একদিনে দু-জন নারী সুচীকর্মী যা করে, তার চেয়ে বেশি। বিজ্ঞ অধ্যাপকটির ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়াকে তার শৈশবে বা এমন অবস্থায়, সেখানে প্রধান ব্যক্তিটি—ধনিক ব্যক্তিটি — অনুপস্থিত, তেমন অবস্থায় অনুশীলন করা উচিত নয়।
৩. “Concours de forces.” ( Destutt de Tracy, “Traite de la Volonte et de ses effets”. Paris 1826 )
৪. এমন অসংখ্য প্রক্রিয়া আছে, যা এত সরল যে একাধিক অংশে ভাগ করা যায়, যা অনেক জোড়া হাতের সহযোগিতা ছাড়া সম্পাদন করা যায় না। যেমন, একটা বড় গাছকে একটা মালগাড়ির উপরে তোলা এক কথায়, এমন প্রত্যেকটি জিনিস যা অনেক জোড়া হাত একযোগে নিযুক্ত হয়ে একই সময়ে করতে হয়।” (ই. জি. ওয়েকফিল্ড : “এ ভিউ অব দি আর্ট অব কলোনাইজেশন”, লণ্ডন ১৮৪৯, পৃঃ ১৬৮)।
৫. “যেমন এক টন ওজন একজন তুলতে পারে না, দশ জনকে কষ্ট করে তুলতে হয়, অথচ ১০০ জন তা করতে পারে কেবল প্রত্যেকের আঙুলের জোরে।” (জন বেলাস “প্রাপোজালস ফর রেইজিং এ কলেজ অব ইণ্ডাস্ত্রী”, লণ্ডন, ১৬৯৬ পৃঃ ২১)
৬. (৩৩ একর করে এক-একটি জমিতে দশ জন কৃষকের দ্বারা নিযুক্ত হবার পরিবর্তে, যখন ৩০০ একর পরিমাণ একটি জমিতে একজন কৃষকের দ্বারা নিযুক্ত হয় একই সংখ্যক মুনিষ,) তখন পরিচারকদের অনুপাতেও একটি সুবিধা হয়, যে সুবিধাটি হাতে-কলমে যারা কাজ করায় তারা ছাড়া অন্যরা এত সহজে বুঝতে পারবে না। কারণ এট। বলাই স্বাভাবিক যে, s-এর অনুপাতে ১-ও যা, ১২-র অনুপাতে ৩-ও তাই; কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তা হয় না; কেননা ফসল কাটার সময়ে এৰং অন্যান্য যেসব কাজে একই সঙ্গে অনেক হাত লাগাতে হয়, কাজটা আরো ভালভাবে এবং আরো তাড়াতাড়ি যায়; দৃষ্টান্ত হিসাবে, ফসল গোলাজাত করার কাজে ১ জন গাড়োয়ান, ২ জন মুটে, ২ জন কোদালী, ২ জন ঝাড়ুদার এবং বাকিরা একটি গোলাঘরে বা খামারবাড়িতে যে পরিমাণ কাজ করে, তা সেই একই সংখ্যক লোক বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন খামারে যা করে, তার তুলনায় দ্বিগুণ।” (“অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি কয়েকজন বিটুইন দি প্রেজেন্ট প্রাইস অব প্রভিসনস অ্যাণ্ড দি সাইজ অব ফার্মস।”-এ ফার্মার, ল, ১৭৭৩, পৃঃ ৭, ৮।)।
৭. যথাযথভাবে অ্যারিস্তোতল-এর সংজ্ঞা হল, মানুষ স্বভাবতই একটি শহরবাসী নাগরিক। সংজ্ঞাটি প্রাচীন চিরায়ত সমাজের বৈশিষ্ট্যসূচক, যেমন ফ্র্যাংকলিন-প্রদত্ত ‘হাতিয়ার-তৈয়ারকারী জীব হিসাবে মানুষের সংজ্ঞাটি ইয়াংকি-সমাজের বৈশিষ্ট্যসূচক।
৮. “On doit encoreremarquer que cette division partielle de travail peut se faire quand meme les ouvriers sont occupes d’une meme besogne. Des macons par exemple, occupes a faire passer de mains en mains des briques a un echafaudage superieur, font tous la meme besogne, et pourtant il existe parmi eux une espece de division de travail, qui consiste en ce que chacun d’eux fait passer la brique par un espace donne, et que tous ensemble la font parvenir beakcoup plus promptement a l’endroit marque qu’ils ne le feraient si chacun d’eux portait sa brique separement jusqu’a l’echafaudage superieur.” (F. Skarbek: “Theorie des richesses sociales.”) paris 1839 t. I, pp. 97, 98.
৯. “Est-il question d’executer un travial complique, plusieurs choses doivent etre faites simu tanement. L’un en fait une pendant que l’autre en fait une autre, et tous contribuent a l’effet qu’un seul homme n’aurait pu produire. L’un rame pendant que l’autre tient le gouvernail, et qu’un troisieme jette le filet ou harponne le posson, et la peche a un succes impossible sans ce concours.” (Destutt de Tracy, Traite de la volonte et de ses effets. Paris 1826.)
১০. “সংকট-ক্ষণে এটা (কৃষিকাজ) করার গুরুত্ব আরো ঢের বেশি।” (“অ্যান ইনকুইরি …..”) অ্যান ইনকুইরী ইনটু দি কানেকশন বিটুইন দ্যা প্রেজেন্ট প্রাইস পৃ ৯১ “কৃষিতে সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেব।” (Liebig : “Ueber Theorie und praxis in der Landwirtschaft.” 1856, P. 23 )
১১. “দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি, যা এমন একটি দেশে, যে-দেশ সম্ভবতঃ চীন ও ইংল্যাণ্ডকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর যে-কোন দেশের চেয়ে বেশি শ্রম রপ্তানি করে, সে দেশ কেউ আশংকা করে না তুলো সাফ করার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক লোক সংগ্রহের অসম্ভাব্যতা। এর ফল দাঁড়ায় এই যে এর অনেকটাই পড়ে থাকে অ-বাছাই অবস্থায়, আরেকটা অংশ মাটি থেকে জড় করা হয় যখন তা বিবর্ণ হয়ে ও অংশত নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সুতরাং উপযুক্ত ঋতুতে শ্রমের অভাবে কৃষককে মেনে নিতে হয় সেই ফসলের একটা বড় অংশের লোকসান, যে-ফলের জন্য ইংল্যাণ্ড ব্যগ্র ভাবে তাকিয়ে আছে।” (“বেঙ্গল হরকরা,” বৈদেশিক সংবাদের সংক্ষিপ্তসার, ২২শে জুলাই, ১৮৬১)।
১২. কৃষির অগ্রগতি-ক্রমে “সমস্ত, এবং সম্ভবতঃ সমন্তেরও বেশি, মূলধন এবং শ্রম যা একসময়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে ৫০০ একর জমিতে ছড়িয়ে ছিল, তা এখন ১০০ একর জমির আরো ভালভাবে চাষের জন্য কেন্দ্রীভূত হয়েছে। যদিও “বিনিয়োজিত মূলধন ও শ্রমের অনুপাতে স্থানের পরিসর কেন্দ্রীভূত, তবু আগে উৎপাদনের একটি স্বতন্ত্র উৎপাদন যতটা উৎপাদনক্ষেত্ৰ দখল করে রাখত ও কাজে লাগাত, তার তুলনায় পরিবর্ধিত উৎপাদন-ক্ষেত্র।” (আর. জেলঃ “অ্যান এসে অন দি ডিস্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ, প্রথম খণ্ড, খাজনা প্রসঙ্গে’, পৃঃ লণ্ডন ১৮৩১ ১৯১)।
১৩. “La forza di ciascuno uomo e minima ma la riunione delle minime forze forma una forza totale maggiore anche della somma delle forze medesime fino a che le forze per essere riunite possono diminuere il tempo ed accrescere lo spazio della loro azione.” (G. R. Carli, Note to P. Verri, Meditazioni sulla Economia Politica.” In “Serittori Clessiei Italiani di Economia Politica. Parte Moderna.” vol. xv. Milano 1804.)
১৪. “মুনাফা হল ব্যবসার একমাত্র লক্ষ্য।” ( জে ভ্যাণ্ডারলিন্ট, মানি অ্যানসারস অল থিংস, লণ্ডন ১৩৭৪ পৃঃ ১১)।
১৫. ‘স্পেক্টেটর নামে ঐ ফিলিস্তিন কাগজটা লিখেছে যে, ‘ওয়্যার-ওয়র্ক কোম্পানি অব ম্যাঞ্চেস্টার’-এ ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে এক ধরনের শরিকি-ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরে প্রথম ফল হয়েছিল অপচয়ের দারুণ হ্রাস, শ্রমিকেরা বুঝতে পারল কেন তারা নিজেদের, এবং, সেই সঙ্গে, তাদের মালিকদের সম্পত্তির অপচয় ঘটাবে; সম্ভবত কারখানায় লোকসানের কারণ হিসাবে, ফেরৎ-না-পাওয়া ধারের পরেই অপচয়ের স্থান।” একই পত্রিকা আবার দেখতে পায় যে রচডেল-সমবায়-পরীক্ষার প্রধান ত্রুটিটি হল এই : “তারা দেখিয়ে দিয়েছিল যে শ্রমিকদের সংগঠন কারখানা, কর্মশালা এবং প্রায় সব রকমের শিল্পই সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করতে পারে এবং তারা তৎক্ষণাৎ লোকগুলির অবস্থার উন্নতি বিধান করল; কিন্তু তারা মালিকদের জন্য কোন নির্দিষ্ট ভূমিকা নির্দেশ করল না।” কী ভয়ানক ব্যাপার! Quella horreur।
১৬. উত্তর আমেরিকার দক্ষিণী রাষ্ট্রগুলিতে ক্রীতদাসদের দ্বারা উৎপাদনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শ্রমের তদারকি—একথা বলার পরে অধ্যাপক কেয়ার্নেস বলেন, (উত্তরের) চাষী-মালিক তার শ্রমের গোটা ফসলটাই পায়; তাই শ্রমের জন্য তার কোনো প্রেরণার দরকার হয় না। তদারকি এখানে সম্পূর্ণ বাতিল। (কেয়ার্লেস : ‘দি মেত পাওয়ার, লণ্ডন, ১৮৮২। পৃ: ৪৮, ৪৯)।
১৭. স্যার জেমস স্টুয়ার্ট, বিভিন্ন উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যেকার পার্থক্যের উপরে তার তীক্ষ দৃষ্টির জন্য যিনি উল্লেখযোগ্য, বলেন, “ক্রীতদাসদের সরলতার নিকটতর হয়ে, ম্যানুফ্যাকচার-পদ্ধতিতে উৎপাদনকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যক্তিগত শিল্পকে কেন ধ্বংস করে? (“প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লন ১৭৬৭, প্রথম খণ্ড পৃঃ ১৬৭, ১৬৮)।
১৮. এ কেঁৎ এবং তার অনুগামীরা দেখাতে পারতেন যে সামন্ততান্ত্রিক প্রভু হল একটি শাশ্বত প্রয়োজন, যেমন তারা দেখিয়েছেন ধনতান্ত্রিক প্রভুদের বেলায়।
১৯. আর. জোনস, টেক্সট বুক অব লেকচারস”, পৃঃ ৭৭, ৭৮। লল ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাজধানীতে প্রাচীন আসিরীয়, মিশরীয় ও অন্যান্য সংগ্রহগুলির কল্যাণে আমরা সহযোগমূলক উৎপাদন-পদ্ধতিগুলি কিভাবে পরিচালিত হত, তার প্রত্যক্ষ দর্শন লাভ করি।
২০. লিংগুয়েৎ বোধহয় ঠিক, যখন তিনি তার “Theorie des Lois Civiles”-এ ঘোষণা করেন, “শিকারই হল সহযোগের আদি রূপ, এবং মানুষ-শিকারই (যুদ্ধই হল শিকারের আদিতম রূপগুলির মধ্যে একটি।”
২১. চাষীরা ক্ষুদ্রায়তন কৃষিকর্ম এবং স্বাধীন হস্তশিল্প একযোগে তৈরি করে সামন্ত তান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তি; সেই পদ্ধতির অবসানের পরে তারা ধনতান্ত্রিক পদ্ধতির পাশাপাশি চালু থাকে; তারাই আবার গঠন করে চিরায়ত সমাজগুলির ভিত্তি-জমির যৌথ মালিকানার আদিম রূপ অন্তর্হিত হয়ে যাবার পরে এবং ক্রীতদাসতন্ত্রের আত্মপ্রতিষ্ঠার আগে।
২১. “একই কাজে অনেকের একত্রে ঐক্যবদ্ধ দক্ষতা, পরিশ্রম ও প্রতিযোগিতা কি তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার একটি পন্থা হবে না? এবং ইংল্যাণ্ড যে তার পশম শিল্পোৎপাদনকে এত নিখুত করে তুলেছে, তা কি অন্য কোন ভাবে সম্ভব হত? (বার্কলে, “দি কোয়েরিস্ট”, পৃঃ ৫৬, অনুচ্ছেদ : ৫২১)।