সমাজে স্বাধীনতার পরিধি
সামাজিক মানুষের জন্য কি পরিমান স্বাধীনতার প্রয়োজন এবং কতোদূর স্বাধীনতা সমাজে আচরনকরা সম্ভব এ সাধারন সমস্যাটি হলো আমার আলোচনার বিষয়।
‘স্বাধীনতা‘ এমন একটি শব্দ যাকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন রকমের সংজ্ঞার মধ্যে যুক্তিসহকারে আলোচনা করে লাভবান হতে হলে একটি বিশেষ সংজ্ঞার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। সুতরাং স্বাধীনতার সংজ্ঞাসমূহের সম্বন্ধে আমাদের আলোচনা শুরু করা অধিকতর সুবিধাজনক হবে। ‘সমাজ’ শব্দটির মধ্যে দু রকমের কোন অর্থ নেই। কিন্তু তার সংজ্ঞায়ন প্রচেষ্টার মধ্যে যে কোন রকমের গলদ থাকতে পারেনা এমন কোন কথা নেই।
আমিও শব্দগুলোকে মামুলি অর্থে ব্যবহার করা উচিত মনে করি না; দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, হেগেল এবং তার শিষ্যবেন্দর ধারনা ছিল, পুলিশের হুকুম যা তারা নৈতিক আইনে মনে করত, তামিল করার অধিকারের মধ্যেই সত্যিকারের স্বাধীনতার পুরোপুরি তাৎপর্য বিদ্যমান। অবশ্য পুলিশকেও বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের উচ্চপদস্থ অফিসারদের মেনে চলতে হয়। সরকারের কি কর্তব্য এ সংজ্ঞার মধ্যে তার কোন সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ব্যক্ত করা হয়নি। প্রচলিত মতানুসারে এ মতবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে বক্তব্য সে অনুসারে রাষ্ট্র হলো সংজ্ঞামতে নিরংকুশ নিষ্পাপ একটি প্রতিষ্ঠান। যে দেশে গণতন্ত্র এবং পার্টি সরকার বর্তমান সেখানে এ সংজ্ঞা বলতে গেলে অচল। কেননা ওসব দেশে অর্ধেক মানুষ সরকারকে মন্দ বলে বিশ্বাস করে। সুতরাং আমরা ওপরে বর্ণিত সত্যিকারের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতার বদলে গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে পারিনা।
মূলতঃ বিমূর্ত অর্থে আকাঙ্খর রূপায়নে বাহ্যিক বাধার অভাবকেই স্বাধীনতা বোঝায় এ বিমূর্ত অর্থ মেনে নিলে ক্ষমতা বৃদ্ধি করে অথবা অভাব কমিয়ে স্বাধীনতার হ্রাস বৃদ্ধি ঘটান সম্ভবপর। একটি পতঙ্গ কয়েকদিন জীবন ধারণ করে ঠাণ্ডায় মারা গেলে উল্লেখিত সংজ্ঞানুসারে বলতে হবে তার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। শীতের কারণে মারা গেলে পতঙ্গের সকল ইচ্ছার পরিসমাপ্তি ঘটবে, তখন অসম্ভবকে সম্ভব করা তার দ্বারা হয়ে উঠবে না। মানুষ এ পদ্ধতি অনুসরণ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনা। একজন রাশিয়ান, অভিজাত যিনি সাম্যবাদী হওয়ার পর লাল ফৌজের কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন আমার কাছে ব্যখ্যা করেছিলেন, ইংরেজদের রাশিয়ানদের মতো বাহ্যিক কোন সোজা জ্যাকেট পরতে হয় না; যেহেতু তাদের আত্মা সকল সময় মানসিক জ্যাকেটের আবরণে আবৃত থাকে। সম্ভবতঃ এ বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা সত্যতা আছে। ডষ্টয়েভস্কির উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে আসল রাশিয়ানদের কোনও সাদৃশ্য নেই; কিন্তু ওসব চরিত্রগুলো আবিষ্কার একমাত্র রাশিয়ানদের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল। তাদের আশ্চর্য দুর্দান্ত সকল রকমের মারাত্মক আকাঙ্খ রয়েছে, অন্ততঃপক্ষে সচেতনভাবে গড়পড়তা ইংরেজেরা যার থেকে মুক্ত। সুতরাং যে সমাজের সকল মানুষ একে অন্যকে হত্যা করতে চায় সে সমাজের মানুষ শান্ত ইচ্ছাসমপন্ন সমাজের মানুষ থেকে বেশি পরিমাণে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। ক্ষমতার বৃদ্ধি সাধন করার মতো আকাঙ্খকে বিশুদ্ধ করে নেয়ার মধ্যেই স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকাংশ সুযোগ সুবিধা নিহিত।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করার ফলে যে আরেক রকমের প্রয়োজন আমরা অনুভব করি সব সময় রাজনৈতিক চিন্তা ধারার আলোক সম্পাতে তা সন্তুষ্টি বিধান করা যায় না। আমি সে প্রয়োজন সমূহের কথাই বলছি যেগুলোকে মনস্তাত্ত্বিক গতিবিজ্ঞান বলা যেতে পারে। বাহ্যিকভাবে যে অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়, তার মানে রাজনীতির স্বীকৃত সত্য তার সঙ্গে মানুষের প্রকৃতির কোন মিল নেই। কিন্তু বাহ্যিক অবস্থা যে মানুষের আকাঙ্খকে পরিশুদ্ধ করে এটা স্বীকৃত সত্য। বাহ্যিক অবস্থা এবং মানব প্রবৃত্তির মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সঙ্গতি রক্ষা করা হয়। একজন মানুষকে তার চির পরিচিত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে হঠাৎ অচেনা পরিবেশে ফেলে দেয়া হলে কিছুতেই স্বধীনতা অনুভব করবেনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন পরিবেশে অভ্যস্থ মানুষ স্বাধীন অনুভব করতে পারে। সুতরাং নতুন পরিবেশের ফলে মানুষের বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষার মধ্যে যে পরিবর্তন আসে তা স্মরনে না রেখে আমরা স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা করতে পারি না। এর অনেকগুলো ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জন অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ, কেননা নতুন পরিবেশ পুরনো আকাঙ্ক্ষার সন্তুষ্টি বিধান করে কিন্তু নূতন জাগা আকাঙ্ক্ষাগুলো অপরিতৃপ্ত থেকে যায়। শিল্পায়নের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার ফলে এর অনেকগুলো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু তা আবার অনেকগুলো নতুন স্বভাবের জন্ম দিয়েছে। যেমন একজন মানুষ মোটর গাড়ি কিনতে পারেনা বলে অসন্তুষ্ট এবং খুব শিগগির ব্যক্তিগত এ্যারাপ্লেন পেতে চাইবে। আবার একজন মানুষ তার অবচেতন মনের অভাব বোধের জন্য অসন্তুষ্ট হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ আমেরিকানদের প্রয়োজন বিশ্রাম, কিন্তু বিশ্রাম কি জিনিস তা আমেরিকানরা জানেনা। আমার বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের যে অপরাধের ঢেউ এসেছে তার প্রধান কারণ অস্থিরতা।
যদিও মানুষের আকাঙ্খার মধ্যে বিভিন্নতা আছে তবুও কতিপয় মৌলিক প্রয়োজন রয়েছে যে গুলোকে সার্বজনীন অভাবের পর্যায়ে দেখা যায়। খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য পোশাক, বাসস্থান, যৌন প্রয়োজন এবং পিতৃত্ব ইত্যাদি তার মধ্যে প্রধান। (গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ সমূহে পোশাক এবং বাসস্থানের অভাব এত তীব্র এবং প্রখর নয়, বিষুবীয় অঞ্চল ছাড়া অন্যান্য দেশের মানুষের প্রয়োজনের তালিকায় এ দুটোকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।) স্বাধীনতা বলতে যাই বোঝাক না কেননা; ওপরের তালিকায় যে সকল প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে, কোন মানুষ তার একটি থেকে বঞ্চিত হলেও তাকে স্বাধীন বলা যায় না; যেহেতু উপরের তালিকার মধ্যে স্বাধীনতার ন্যূনতম প্রয়োজনের কথাই বলা হয়েছে।
এজন্যে আমাদের সমাজের সংজ্ঞায় ফিরে আসতে হয়। ওপরে যে ন্যূনতম স্বাধীনতার কথা বলা হলো রবিনসন ক্রুশোর মতে নির্জন বাসের চাইতে সামাজিক জীবনে তার রূপায়ন অধিকতর সহজ। যৌন প্রয়োজন এবং পিতৃত্ব এ উভয় প্রয়োজন নিতান্তই সামাজিক। একদল মানুষ কতেক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে সহযোগিতার ফলশ্রুতিই যে সমাজ, যে কোন লোক সমাজের এ সংজ্ঞায়নই দান করবে। মানুষের আদিমতম সামাজিক সংগঠন হলো পরিবার। অর্থনৈতিক সামাজিক সংগঠনের উৎপত্তিও আদিম যুগে হয়েছিল। আপাততঃ দৃষ্টিতে দেখা যায় যে সকল সংগঠন যুদ্ধ করার জন্যে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উৎপত্তি তত আদিম কালে নয়। আধুনিক যুগে অর্থনীতি এবং যুদ্ধ হলো সামাজিক সংঘর্ষের প্রধান কারণ। পরিবার এবং গোত্রের চাইতে বৃহত্তর সামাজিক সংগঠন না থাকলেও আমরা সকলে আমাদের শারীরিক প্রয়োজন খুবই ভালোভাবে মিটাতে পারত। ঐ অর্থে সমাজ আমাদের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করার কাজে নিয়েজিত রয়েছে। সুসংগঠিত রাষ্ট্রে বসবাস করলে আমাদের শত্রু কর্তৃক নিহত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, তা হলো একটি সন্দেহজনক বক্তব্য।
একজন মানুষের আকাঙ্খা সমূহকে যদি আমরা সত্য বলে গ্রহণ করি তার মানে, তার মনস্তাত্ত্বিক গতিবাদকে অস্বীকার করি তাহলে তার স্বাধীনতার দুরকম প্রতিবন্ধক আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাব; সেগুলো তার শারীরিক এবং সামাজিক প্রতিবন্ধক। স্কুল দৃষ্টান্তের সাহায্যে তা দেখানো যায়, যেমন, পৃথিবী তার বেঁচে থাকার মতো খাদ্য উৎপাদন করে অথবা অন্য মানুষ তার খাদ্য সংগ্রহে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ স্বাধীনতার শারীরিক বাধায় অবসান ঘটিয়ে সামাজিক বাধার সৃষ্টি করেছে। সে যাহোক, এখানে আমরা আকাঙ্খর ওপর সামাজিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকেবহাল না হলে ভুল পথে যেতে বাধ্য হব। একজন মানুষ ধরে নিতে পারে যে, পিঁপড়ে এবং মৌমাছি যদিও সংঘবদ্ধ সমাজে বাস করে তবুও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সামাজিক কর্তব্য করে যায়। উন্নত শ্রেণীর প্রাণী যেগুলো সমাজবদ্ধভাবে বাস করে, তাদের প্রত্যেকটি সম্বন্ধে একই কথা সত্য। রিভার্সের মতে কম বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। তা আবার দেখা যায় অধিক পরিমাণ ইঙ্গিতময়তার উপর নির্ভরশীল কম বেশি ইন্দ্রজালে যা ঘটে থাকে সে সমস্ত উপাদানের সমগোত্রীয়। এ ভাবে মানুষের সমাজ গঠিত হলে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে স্বাধীনতা বিসর্জন না দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে এবং আইনের খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। কি আশ্চর্য যদিও সভ্য মানুষের অসভ্যদের থেকে অধিকতর উন্নত সামাজিক সংগঠন রয়েছে, কিন্তু প্রবৃত্তির দিক দিয়ে তাদেরকে অসভ্য মানুষের তুলনায় কম সামাজিক আচরণ করতে দেখা যায়, যা তাদের উপর সমাজের প্রতিক্রিয়া অসভ্যদের তুলনায় অধিকতর বাহ্যিক এবং পোশাকী। সে কারণে তাদেরকে স্বাধীনতার সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে হয়।
সবচেয়ে সভ্য সম্প্রদায়েও সামাজিক সহযোগিতার মর্মমূলে যে প্রবৃত্তিগত ভিত্তি বর্তমান তা আমি তা স্বীকার করতে চাইনে। মানুষ প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে এবং তাদের ভালোবাসা পেতে আগ্রহ পোষণ করে। তারা পরস্পরের অনুকরণ করে এবং ইঙ্গিত মারফত মনোভাব বুঝতে পারে। তা সত্বেও সভ্য হওয়ায় চরিত্রের এ উপাদান নিচয় শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ে তাদের যে পরিমান শক্তি তাদের থাকে না, সামগ্রিকভাবে কম বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন মানুষের ওপর তারা ক্ষমতা বিস্তার করে সামাজিক সহযোগিতার ফলে যে সুবিধা পাওয়া যায়, ক্রমশঃ জ্যান্ত প্রবৃত্তির ঢিলে ঢালা স্তর অতিক্রম করে বিচার বুদ্ধির উপর নির্ভর করতে শুরু করছে। অসভ্যদের সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন প্রশ্ন জাগতে পারে না। যেহেতু তারা এর কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। সভ্য মানুষেরা আরো সভ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তীব্র হতে তীব্রতর রূপে অনুভব করেছে। একই সঙ্গে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা ধারাবাহিক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সরকার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকে যে আমাদের স্বাধীনতাকে মুক্ত করতে পারে আগের তুলনায় তা অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সুতরাং সামাজিক স্বাধীনতা সমস্যার দিকে নজর দেয়া খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে, তা না হলে আমরা অধিকতর সভ্য হয়ে উঠতে পারব না।
এ কথাও পরিস্কার যে শুধু মাত্র সরকারি শাসনের কড়াকড়ি হ্রাস করে স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা যাবে না। একজন মানুষের আকাঙ্ক্ষা অন্য একজন মানুষের আকাক্ষার সঙ্গে মিলে না। সে জন্য অরাজকতা বলতে বেঝায় শক্তিমানের স্বাধীনতা এবং দুর্বলের দাসত্ব। আজকে পৃথিবীর যে জনসংখ্যা সরকারি শাসন না থাকলে অনাহার এবং শিশুমৃত্যুর ফলে, দশভাগের এক ভাগও থাকত কিনা সন্দেহ। শারীরিক দাসত্বের স্থলে সভ্য সমাজ স্বাভাবিক অবস্থায়ও যে জঘন্য সামাজিক দাসত্বের প্রবর্তন করেছে তা আরো ভয়াবহ এবং মারাত্নক। এখন আমাদের যে সমস্যাটি বিবেচ্য, তা হলো কি করে সরকার ছাড়া চলতে হয় তা নয়, বরঞ্চ স্বাধীনতার ওপর বিন্দুমাত্র হামলা না হয় মতো এর সুবিধা গুলো ভোগ করা। তাহল শারীরিক এবং সামাজিক স্বাধীনতার মধ্যে সামাঞ্জস্যবিধান করা। সুলভাবে দেখতে হলে তা এই দাঁড়ায় যে, বেশী খাদ্য এবং ভালো স্বাস্থের জন্য আমরা কি পরিমান সরকারি চাপ সহ্য করতে রাজি থাকব?
এ প্রশ্নের জবাব বাস্তবে দিতে গেলে একটা সহজ বিবেচনা আমাদের করতে হবে; আমাদের কি খাদ্য এবং স্বাস্থ্য দুটোই চাইতে হবে না কোন বিশেষ একটি চাইলে আমাদের চলবে? কোন লোক বন্দী অবস্থায় অথবা ১৯১৭ সনের ইংল্যান্ডে মানুষ যে কোন ধরনের সরকারি চাপ সইতে রাজি ছিল, কেননা স্পষ্টতঃ তা ছিল সকলের স্বার্থের অনুকুলে। কিন্তু কাউকে যদি সরকারি চাপ সহ্য করতে হয় এবং কাউকে যদি খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় সম্পূর্ন ভিন্ন রকম। এতে আমরা সমাজতন্ত্রবাদ এবং ধনতন্ত্রবাদের মাঝামাঝি এক অবস্থার সম্মুখনি হই। ধনতন্ত্রের সমর্থকরা স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতার পবিত্র নীতির নামে আবেদন করবে যার সবটুকু একটি মাত্র নীতিবাক্যের অন্তরালে নিহিত। নীতিবাক্যটি হলো, “ভাগ্যবানদেরকে হতভাগ্যদের ওপর অত্যাচার করতে অবশ্যই বাধা দিতে হবে।”
এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীনতাই হলো হস্তক্ষেপহীন অবাধ স্বাধীনতা, তাকে কোনমতেই অরাজকতা বলে গ্রহন করা চলে না। হস্তক্ষেপহীন স্বাধীনতা আইন বলে খুন-জখম দমন করে এবং দুর্ভাগাদের সশস্ত্র বিপ্লব দমন করতে যত কাল পর্যন্ত সাহস করছে ততকাল টেড ইউনিয়ন করতে বাধা দান করছে। এই ন্যূনতম সরকারি সুবিধা ছাড়া বাদবাকিগুলো অর্থনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা পূরণ করাই ছিল অভীষ্ট লক্ষ্য। স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে একজন মালিক কর্মচারীদের বলতে পারে, “তোমরা তিলে তিলে অনাহারে মরবে।” কিন্তু স্বাধীনতা এমন কোন সুযোগ কর্মচারীদের দেয়নি যার ফলে তারা দাঁতভাঙ্গা জবাব বলতে পারে মালিককে,”তার আগে তোমাকে আমাদের গুলিতে মরতে হবে। কোন রকমের আইনের পাণ্ডিত্যের কচকচি ছাড়া এ দুপ্রকার ভীতির মধ্যে কোনরকম ইতর বিশেষ করা অনেকটা হাস্যাস্পদ। দুটোর প্রত্যেকটাই স্বাধীনতার ন্যূনতম প্রয়োজনকে সংকুচিত করে রাখে, এতে শুধু একটা নয় দু’টা কারণই সক্রিয় সমানভাবে। একমাত্র অর্থনৈতিক দিগন্তে এ অসাম্য সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতার পবিত্র নীতি স্বামীকে স্ত্রীর ওপর পিতাকে পুত্রের ওপর নির্যাতন করার আইনতঃ অধিকার দান করেছে, কিন্তু প্রচার করেছে স্বাধীনতা অবশ্যই সর্বপ্রথম এ বিরোধ সমূহের নিস্পত্তি করবে। কারখানাতে কাজ করতে বাধ্য করতে পুত্রের পিতা যে নির্যাতন করেছে উদারনৈতিকদের উপস্থিতি সত্ত্বেও তার ফয়সালা হয়ে গেছে।
কিন্তু বিষয়টি হলো আলোচিত, সে জন্যে আমি এর ওপর বিশেষ কিছু বলে সময় নষ্ট না করে সাধারণ প্রশ্নের প্রতি আলোকপাত করতে চাই তাহলো সমাজ কতকাল ব্যক্তির ওপর, ব্যক্তির কারণে নয় সামাজিক কারণে হস্তক্ষেপ করবে? এবং কি উদ্দেশ্যের জন্য হস্তক্ষেপ করবে?
শুরুতেই আমাদের বলা উচিত, স্বাধীনতার ন্যূনতম প্রয়োজন খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পোশাক জৈবিক প্রয়োজন এবং পিতৃত্বের দাবিকে অন্যান্য সকল রকমের দাবীর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। ওপরে বর্ণিত ন্যূনতম প্রয়োজন সমূহ মানুষের জৈবিক প্রয়োজন এবং পিতৃত্বের দাবিকে অন্যান্য সকল কর্মের দাবীর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। ওপরে বর্ণিত ন্যূনতম প্রয়োজন সমূহ মানুষের জৈবিক বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। একটু আগে যে সকল বিষয়ের কথা বলেছি সেগুলো প্রয়োজনীয়তার বাইরে যে বিষয় সমূহ আছে সেগুলো অবস্থানুসারে স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। একজন মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত করে অন্য একজন মানুষের প্রয়োজনে সাড়া দেয়াকে আমি প্রাথমিকভাবেই যুক্তিযুক্ত মনে করি। কোন বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোন বিশেষ সমাজে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানুসারে তা হয়ত প্রয়োগক্ষম নাও হতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তা কখনো আপত্তিজনক নয়। একজন মানুষকে তার প্রয়োজনীয় দাবি থেকে বঞ্চিত করলে তার স্বাধীনতার ওপর যে হস্তক্ষেপ করা হয়, বাড়তি দাবি থেকে বঞ্চিত করা হলে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর তার চেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ করা হয়।
যদি একথা স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে তা আমাদেরকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ স্বাস্থ্যের কথা ধরা যাক ব্যুরো কাউন্সিলের নির্বাচনের সময় সরকারি অর্থের কি পরিমাণ জনস্বাস্থ্য, প্রসূতি সদন এবং শিশু মঙ্গলের কাজে ব্যয়িত হবে, সে প্রশ্ন খুবই উল্লেখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। হিসাব করে দেখা গেছে এ সকল কাজে ব্যয়িত অর্থ জীবন রক্ষার কাজে প্রচুর উপকারে আসে। লণ্ডনের প্রায় প্রত্যেক ব্যুরোর ধনীরা একযোগে এসবে যাতে ব্যয় বৃদ্ধি না হয়, বরঞ্চ ব্যয় সঙ্কোচের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের অভিপ্রায় হলো, হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যু গহবরে ঠেলে দিতে তারা প্রস্তুত যার বদৌলতে তারা মোটর গাড়িতে চড়তে পারে এবং নৈশভোজের ব্যবস্থা করতে পারবে। তারা সমস্ত সংবাদ পত্র নিয়ন্ত্রণ করবে বলেই তাদের কীর্তি কলাপের কাহিনী তারা যে সকল মানুষকে নির্যাতন করে তারা জানতে পারে না। মনঃসমীক্ষকদের কাছে পরিচিত এমন এক পদ্ধতি অবলম্বন করে তারা নিজেরাও সত্যকে এড়িয়ে যায়। তাদের কার্যকলাপের মধ্যে বিস্মিত হওয়ার কোন কিছু নেই; সকল যুগের অভিজাতদের এইই পরিচয়। আমার যা বক্তব্য তা হলো স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের সকল কীর্তি কলাপ কোন ক্রমেই সমর্থন যোগ্য নয়।
আমি যৌন প্রয়োজন এবং পিতৃত্বের অধিকার সম্বন্ধে কোন আলোচনা করব না। আমি শুধু বলব যে দেশে নরনারীর মধ্যে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর তুলনায় ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রচলিত ব্যবস্থা মতে কদাচিত যৌন প্রয়োজন এবং পিতৃত্বের দাবি মিটানো যায় সে দেশে, তদৃপরি কঠোর খ্রিষ্ঠান ঐতিহ্যের অশুভ প্রতিক্রিয়া মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। রাজনৈতিকদের পক্ষে মানব প্রবৃত্তি সম্পর্কে অবগত হওয়ার কোন সময় নেই যে বিশেষ বিশেষ আকাঙ্খ সাধারণ নরনারীকে চালিত করে সে বিষয়ে তাদরেকে একেবারে অজ্ঞই বলতে হবে। রাজনৈতিক পার্টির নেতাদের সামান্য মাত্র মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকলেও তারা সমগ্র দেশকে পরিষ্কার অনাচারমুক্ত করে গড়তে পারত।
সকলের জৈবিক প্রয়োজন সরবরাহ করার জন্যে সমাজ ব্যক্তির ওপর যে হস্তক্ষেপ করে বিমূর্ত ভাবে তা স্বীকার করলেও একজন মানুষ অন্যজনের বদৌলতে কিছু অর্জন করলে তার ওপর যে সমাজ হস্তক্ষেপ করবে, এটা আমি স্বীকার করতে পারি নে। আমি এসকল বিষয়কে মতামত, জ্ঞান এবং শিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে চিন্তা করি। যেহেতু অধিকাংশ মানুষ অন্যের অধিকারের যা আছে তার ওপর যে মতবাদ হস্তক্ষেপ করে না সে মতবাদকে পছন্দ করেনা। সমাজের অধিকাংশ মানুষ কতেক বিষয় সম্বন্ধে জানতে অনাগ্রহী, কিন্তু যারা জানতে চায় তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করার কোন অধিকার তাদের নেই। আমি একজন মহিলাকে জানি যিনি টেক্সাসের পারিবারিক জীবনের ওপরে একটি বই লিখেছেন এবং বইটিকেও আমি সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই প্রয়োজনীয় মনে করি। ব্রিটিশ পুলিশ মনে করে যে কোন বিষয়ের সত্য জানার কারো অধিকার নেই, সুতরাং ডাক যোগে ঐ বই প্রেরণ করাকে বেআইনী ঘোষণা করল। সকলেরই জানা কথা অনেক সময় মনঃসমীক্ষকেরা অন্তরের মধ্যে চীর ধরা অবদমিত স্মৃতিকে জাগরিত করে রোগীকে আরোগ্য করে তোলে। সমাজও কিছু অংশে মনোবিকল রোগীর এত। কিন্তু অরোগ্য লাভ করার চাইতে যে চিকিৎসকেরা অপ্রিয় সত্যকে দিনের আলোকে প্রকাশ করে, সে চিকিৎসকদেরকে কারারুদ্ধ করে রাখে। স্বাধীনতার ওপর এ হামলা কোনক্রমেই সমর্থন করা যায় না। একই যুক্তিতে ব্যক্তিগত নৈতিকতার উপর হস্তক্ষেপ করা হয়, যেমন একজন মানুষ যদি দুটি স্ত্রী গ্রহণ করতে চায় অথবা একজন স্ত্রীকে দু’জন স্বামী, এটা তার বা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, এর বিরুদ্ধে কারো কোন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না।
এতক্ষণ পর্যন্ত বিমূর্ত যুক্তির আলোকে স্বাধীনতার ওপর ন্যায় সঙ্গত হস্তক্ষেপের সীমারেখা সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এখন আমি কতকগুলো অধিকতর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনা করব।
আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক দুরকমের। সামাজিক এবং শারীরিক। বাধা তা সামাজিক এবং শারীরিক যে রকমই হোক না কেননা স্বাধীনতার ঘাটতি হলো প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। কিন্তু সামাজিক বাধা অধিকতরো ক্ষতিজনক কেননা এর ফলে অতৃপ্তির সৃষ্টি হয়। একটা ছেলে গাছে চড়তে চায়, আপনি তাকে বারণ করলে সে ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠবে; কিন্তু যদি তার শারীরিক কারণে চড়তে না পারে তাহলে সে শরীরকেই দোষী করবে। সময়ে গীর্জায় যাওয়া; সেগুলো করতে দেয়া উচিত। অতৃপ্তিকে অবদমন করার জন্যে সরকার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের যোগসুত্র আবিষ্কার করে এবং অতৃপ্তি সৃষ্টি করার জন্যে বিরোধীদলীয় মানুষের কাজকেই দায়ী করে। রুটির দাম বেড়ে গেলে সরকার বলে খারাপ শস্যোৎপাদনের কারণে হয়েছে, বিরোধীদল বলে মুনাফাখোরদের চক্রান্তেই রুটির দাম বেড়েছে। শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মানুষের অসীম শক্তিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। তারা ভাবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিরসন করার জন্যে মানুষ যা করতে পারে তার কোন সীমারেখা নেই। সমাজতন্ত্রও ঠিক তেমনি এক ধরণের বিশ্বাস, দারিদ্র্য, আল্লাহতাআলা প্রেরণ করে বলে আমরা মনে করি না, বরঞ্চ মনে করি মানুষের নিষ্ঠুরতা এবং বোকামির ফল। এই বিশ্বাস সঙ্গতিবানদের প্রতি সর্বহারার দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিয়েছে। মানুষের অসীম ক্ষমতাকে অনেকদূর নিয়ে বেশী বড় করে দেখানো হয়েছে। ভূতপূর্ব স্বাস্থ্যমন্ত্রী সহ অনেক সমাজতন্ত্রী বিশ্বাস করেন যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষ প্রচুর খেতে পাবে, যদি ভূ-পৃষ্ঠে জনসংখ্যা প্রবলভাবে বেড়ে যায় তবুও কেনো খাদ্য ঘাটতি হবে না। এরকমের বাড়াবাড়িকে আমি ভয় করি। সে যাহোক, মানুষের অসীম শক্তিতে আধুনিক কালে যে বিশ্বাস জন্মেছে, পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিলে তা অতৃপ্তিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। দায়ী করার উপযুক্ত কারণ থাকা সত্ত্বেও এখন দুর্ভাগ্যের জন্য প্রকৃতি এবং খোদা ইত্যাদিকে দায়ী করা হয় না। তার ফলে অতীতের সমাজকে যত সহজে শাসন করা যেতো বর্তমান সমাজকে তত সহজে শাসন করা যায় না; এর কারণ হলো শাসক শ্ৰেণী অত্যধিকভাবে ধার্মিক এবং তাদের কৃত অপরাধের ফলে যে দুর্ভাগারা ভোগে তাদের তারা আল্লাহর নির্দেশ বলে চিহ্নিত করে। আধুনিক যুগে পূর্বকালের এত নূন্যতম প্রয়োজনীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা যুক্তিসঙ্গত তা প্রমাণ করা যাবে না, কেননা হস্তক্ষেপ ক্রিয়াকে অপরিবর্তনীয় আইনের ছদ্মবেশ পরিয়ে আত্নগোপন রাখা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও পুরাতনেরা প্রত্যেকদিন দৈনিক টাইমসে চিঠি লিখে এ পুরনো পদ্ধতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তা ছাড়াও আরো দুটো কারণে সামাজিক স্বাধীনতার বিরোধিতা করা হয়। প্রথমটা হলো মানুষ অন্যের উন্নতি কামনা করে না বরং দ্বিতীয়টি হলো কিসে পরের উন্নতি হয় তা তারা জানে না। বোধহয় মূলতঃ দুটো কারণই, একটি কারণের এপিঠ ওপিঠ। যখন আমরা আন্তরিকভাবে কোন মানুষের ভালো কামনা করি তখন আমরা তার আসল অভাব কি সে সম্বন্ধেও অবগত হই। মানুষ প্রতিহিংসা বশতঃ ক্ষতি করুক অথবা অজ্ঞতার কারণেই ক্ষতি করুক বাস্তবে তা একই রকমের ফলদান করে। সুতরাং আমরা একসঙ্গে দুটো কারণকে নিয়ে বলতে পারি একটি মানুষকে অন্য একটি মানুষের একটি শ্রেণীকে অন্য একটি শ্রেণীর স্বার্থের সংরক্ষক বলে এখনো বিশ্বাস করা যায় না। অবশ্য গণতন্ত্রের ভিত্তি এ যুক্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের গনতন্ত্রকে বিভিন্ন কর্মচারীর মাধ্যমে কাজ করতে হয় বলে ব্যক্তিসাধারণের কাছে এর আবেদন অপ্রত্যক্ষ এবং ভাসাভাসা।
কর্মচারীদের নিয়ে আবার বিশেষ ধরণের বিপত্তি হতে পারে, কারণ সাধারণতঃ তারা যে সকল লোককে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের থেকে দূরে অফিসে বসে কাজ করে। শিক্ষার কথাই ধরা যাক না কেননা, শিক্ষকেরাই সর্বাঙ্গীনভাবে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দীর্ঘকালের মেলামেশার পর তাদেরকে বুঝতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে যত্নবান হতে পারে। তাদেরকে যে সরকারি অফিসারেরা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কোনও বাস্তব অভিজ্ঞা নেই এবং তাদের কাছে শিশুরা নোংড়া ছোকরা ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং শিক্ষকদের স্বাধীনতার ওপর অফিসারদের হস্তক্ষেপ ক্ষতিজনক। সব ব্যাপারে ক্ষমতা তাদের হাতেই কুক্ষিগত যাদের টাকা আছে কিন্তু তাদের হাতে নয় যারা কোথায় টাকা খরচ করতে হবে তা ভালোভাবেই জানে। সুতরাং যাদের হাতে ক্ষমতা আছে সাধারণতঃ তারা অজ্ঞ এবং প্রতিহিংসাপরায়ন; তাদের হাতে যত কম ক্ষমতা থাকে ততই মঙ্গল।
যেখানে বাধতামূলকভাবে নৈতিক স্বীকৃতি আদায় করা যায়, সেখানে বাধ্যতার শক্তিও খুব প্রচণ্ড; যদিও সম্ভব হলে যা তার কর্তব্য বলে ধরে দেয়া হয়, সে ইচ্ছা করলে, তা ফাঁকি দিতে পারে। কোন খোলা পথ না পেলে আমরা বরঞ্চ কর দিতে রাজি হই, যদিও কর আদায়কারী যাদু-মন্ত্র বলে আমাদেরকে উপেক্ষা করে চলে যায়, তখন আমাদের অনেকেই তাকে আমাদের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অনুভব করিনা। এ সকল ক্ষেত্রে আমরা কোকেন বন্ধের জন্য তাড়াহুড়া করি, যদিও সময়-সময়ে তারা বিদ্রোহের খেলা খেলতে ভালবাসে। ছেলেদের অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো তাদের ওপর যাদের শাসন চলে তাদেরকে তারা ভালোবাসে মাঝে মাঝে; যেখানে এ অবস্থা, সেখানে শিশুরা সাধারণতঃ শাসনকর্তাদের সম্পর্কে কোন অশ্রদ্ধা পোষণ করেনা, যদিও তারা মাঝে মাঝে তাদের বিরোধিতা করে থাকে। শিক্ষাবিভাগীয় কর্তাদের শিক্ষকদের মত এ গুণ নেই। তারা যেভাবে রাষ্ট্রের ভালো হবে মনে করে সেভাবে দেশপ্রেম শিক্ষা দিয়ে শিশুদের কোরবান করে। তাহলে সামান্যতম কারণে হত হওয়ার এবং হত্যা করার ইচ্ছাকে শাণিয়ে তোলা। যারা শাসিতদের হিত কামনা করে তাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতি সাধিত হতো। কিন্তু এ ব্যাপারে সফলতা লাভ করার কোন পদ্ধতি আমাদের জানা নেই।
শাসিতেরা যখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, আইনের বলে তাদেরকে শাসন করা হচ্ছে তা দূরভিসন্ধিমূলক এবং ক্ষতিকর, তখন বাধ্যবাধকতার বিষময় ফল হবে। একজন মুসলমানকে শুকরের মাংস অথবা একজন হিন্দুকে গোমাংস বাধ্য করে খাওয়ান সম্ভব হলেও কাজটা যে চূড়ান্ত ঘৃণ্য হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যারা টিকা দেওয়া অন্যায় মনে করে তাদেরকে টিকা নিতে বাধ্য করাও উচিত নয়, তবে প্রশ্নটা স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, কেননা দু’ব্যাপারে কোনটাতেই তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় না। প্রশ্নটি পিতামাতার সঙ্গে রাষ্ট্রের কোন সাধারন নীতি অনুসারে তা সমাধান করা যাবেনা। যে পিতামাতার সন্তানকে শিক্ষা দেয়ার বিরুদ্ধে সুচিন্তিত মতবাদ রয়েছে, তাদের শিশুদেরও অশিক্ষিত করে রাখবার কোন অধিকার নেই। তার পরেও সাধারণ নীতি যতদূর যায়, দুটি ব্যাপারই পরস্পর সাদৃশ্যাত্মক।
একজন মানুষ যে জিনিস সমূহ অন্যের বদৌলতে লাভ করে এবং একজনের যে জিনিস লাভের ফলে পরের কোন অনিষ্ট হয় না, এ দুয়ের মধ্যবর্তী প্রভেদটুকুই হলো স্বাধীনতার ব্যাপারে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমি যদি খাদ্যদ্রব্যের ন্যায্য অংশের চাইতে বেশি দাবি করি তাহলে অন্য একজন মানুষকে সেজন্য উপোষ করতে হবে, কিন্তু যদি আমি অসাধারনভাবে গণিতশাস্ত্রে আত্ননিয়োগ করি তাহলে শিক্ষাব্যবস্থাকে সুযোগ সুবিধা একচেটিয়া না করে ফেললে কারো কোন ক্ষতি করবে না। এখানে আরো একটি প্রসঙ্গ রয়ে গেছে খাদ্য, বাসস্থান এবং পোষাক হলো জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়, সে ব্যাপারে একজন মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের বিশেষ কোন মতভেদ নেই। সুতরাং গণতন্ত্রে সরকারি কার্যপরিচালনার পক্ষে সেগুলো খুবই উপযুক্ত এবং প্রয়োজনীয়। এসব ব্যাপারে ন্যায়বিচার শাসনতান্ত্রিক রীতি হওয়া উচিত। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে ন্যায়বিচারের অর্থ হলো সমতা। কিন্তু যে দেশে উত্তরাধিকারসূত্রে শ্রেণীসমূহের পরম্পরা বর্তমান, উচ্চ-নীচ সকলের দ্বারা স্বীকৃত সে দেশে ন্যায়বিচারের অর্থ সমতা নয়। এমনকি ইংল্যাণ্ডের অধিকাংশ মজুরদের কাছেও যদি বলা হয় তাদের এত রাজারও কোন জাকজমক থাকা উচিত নয়, তাহলে তারা মূচ্ছা যাবে। সুতরাং একেবারে কম ঈর্ষার সঞ্চার করে মত ন্যায় বিচারের সংজ্ঞায়ন করতে চাই। কুসংস্কার, মুক্ত সমাজে সমতাই হলো ন্যায়বিচার, কিন্তু যে সমাজ দৃঢ়ভাবে সামাজিক অসামোর উপর বিশ্বাস প্রবণ সে সমাজে নয়।
কিন্তু নীতি, চিন্তা, শিল্প ইত্যাদির দিক নিয়ে একজন মানুষ অন্যের বদৌলতে, নিজের অধিকার অর্জন করতে পারে না। অধিকন্তু এ ক্ষেত্রে কোনটা ভালো তাও যথেষ্ট সন্দেহজনক। কেননা কেউ পোলাও-কোর্মা খায় আর কেউ পান্তাভাতও খেতে পায় না। যদি সুখি পোলাও কোরমা খাওয়া মানুষ দারিদ্রের সুফল প্রচার করে তখন তাকে একজন কপট ভাবা হবে। যদি আমি অঙ্ক পছন্দ করি এবং অন্য একজন মানুষ গান পছন্দ করে, তখন আমরা পরস্পরের ওপর কোন হস্তক্ষেপ করিনা, যখন আমরা পরস্পরের প্রশংসা করি তখন আমরা পরস্পরের প্রতি ভদ্রতা পোষণ করি। মতামতের ক্ষেত্রে স্বাধীন প্রতিযোগিতা হলো সত্যে পৌঁছুবার একমাত্র পন্থা। প্রাচীন উদারনৈতিক নীতি বাক্যগুলো অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অপব্যবহারই করা হয়েছে। মানসিক ক্ষেত্রেই সেগুলো সত্যিকারভাবে প্রযোজ্য। আমরা ব্যবসায়ে নয় আদর্শের ক্ষেত্রেই স্বাধীন প্রতিযোগিতা কামনা করি। মুশকিল হলো, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে স্বাধীন প্রতিযোগিতা মারা গেলে বিজয়ীরা মানসিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিস্তার করে এবং সৎচিন্তা এবং সজীবনধারণের নামে সকলকে মজুর বানিয়ে ছাড়ে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, কেননা চিন্তার অর্থ হলো কপটতা এবং সৎজীবন ধারণের অর্থ হলো বোকামি। সমাজতন্ত্র অথবা গণতন্ত্রে শ্রেষ্ঠতম বিপদ হলো, অর্থনৈতিক নির্যাতনের জন্য সর্বপ্রকার মানসিক এবং নৈতিক উন্নতি উভয় পদ্ধতির মধ্যেই অসম্ভব। কোন মানুষের ধর্ম যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ শ্রদ্ধা পোষণ করা উচিত। তা না হলে আমাদের নির্যাতনকারী প্রবৃত্তিসমূহ ষোড়শ শতাব্দীর স্পেনের মতো একটি ছাঁচে ঢালা সমাজের সৃষ্টি করবে। বিপদ সত্যিকার এবং সন্নিকট। আমেরিকা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার মূল্য না বুঝতে পারলে আমাদের ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। সে স্বাধীনতা আমাদের চাওয়া উচিত তা অপরকে অত্যাচার করার অধিকার নয়, আমাদের পছন্দ এবং ধারণা অনুসারে জীবনধারণ করার অধিকার যা জীবনধারণ করতে বাধা দান করে না।
উপসংহারে মনস্তাত্ত্বিক গতিবাদ যে শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম শুরুতে, সে সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে চাই। যে সমাজে একজাতীয় চরিত্রের মানুষ অধিক, সে সমাজ বিভিন্ন জাতীয় চরিত্রের সমবায়ে গঠিত সমাজ থেকে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। মানুষ এবং বাঘে মিলে যে সমাজ গঠিত সে সমাজে অধিক স্বাধীনতা থাকতে পারে না, মানুষকে অথবা বাঘকে অবশ্যই দাসত্বের শৃঙ্খল পরতে হবে। সুতরাং পৃথিবীর যে অঞ্চলের মানুষ কৃষ্ণকায়দের শাসন করে সেখানে কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না। অধিক পরিমাণ স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে, শিক্ষার সাহায্যে চরিত্র গঠনের প্রয়োজন, যাতে করে মানুষ যে সব কাজ নির্যাতনমূলক নয় তার মধ্যে সুখের সন্ধান করতে পারে। জীবনের প্রথম ছ’ বছরে চরিত্র গঠন যখন হয় তখনই এই শিক্ষা দিতে হয়। ডেপটফোর্ডে মিস ম্যাকমিলান ছেলেদেরকে যেভাবে শিক্ষা দিচ্ছেন, তার ফলে শিশুরা একটি স্বাধীন সম্প্রদায় গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর পদ্ধতি অনুসারে ধনী দরিদ্র সকলকে শিক্ষা দান করা যায়, তাহলে এক পুরুষকালে আমাদের সামাজিক সমস্যা সমাধান করার পক্ষে যথেষ্ট। শিক্ষার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কি তার অবিচার না করে পদ্ধতির ওপর, জোর দেয়ার দিকে সকল পার্টি অন্ধ হয়ে উঠে-পড়ে লেগেছে। পরবর্তী বছরগুলোতে অনেক আকাঙ্ক্ষার মূলতঃ পরিবর্তন না করে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, সেজন্য শৈশবাবস্থায় বাচ এবং বাঁচতে দাও এ শিক্ষা শিশুদেরকে অবশ্যই দিতে হবে। যে সকল জিনিষ অন্যের ক্ষতি করা ছাড়া অর্জন করা যায় না; অনাগ্রহী নর-নারীকে সে সকল জিনিস দেয়া হোক। সামাজিক স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক দ্রুত অপসারিত হবে।