সকালবেলা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বড়বাবু হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। চিররঞ্জনকে ডেকে বললেন, চিরু, শুনে যাও, দেখে যাও একবার!
বড়বাবু চিররঞ্জনকে খবরের কাগজের সেই বিশেষ খবরটা দেখালেন। মাঝে মাঝেই এ রকম খবর বেরোয়। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর গ্রামে একজন ইস্কুল মাস্টারের সাত বছর বয়সের ছেলে হঠাৎ একদিন এক জায়গায় একজোড়া বায়াতবলা দেখে বাজাতে শুরু করে। নিখুঁত লয়ে অপূর্ব বাজনা। ছেলেটি তার আগে বায়াতবলা কখনও ছুঁয়েও দেখেনি, শেখা তো দূরের কথা। ছেলেটির তখন মনে পড়ে যায়, পূর্ব জন্মে সে তবলা শিখেছিল, তখন সে থাকত মালদা শহরে। পূর্ব জন্মে তার বাবার নাম ছিল এই, তারা তিন ভাই-বোন ছিল, সেই বাড়িটি দোতলা এবং হলদে রঙের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। মালদায় সত্যিই সেই রকম একটি বাড়িতে সেই রকম একটি পরিবার আছে, সেই পরিবারের একটি ছেলে মারা গেছে আট বছর আগে। ছেলেটি তার পূর্ব জন্ম বিষয়ে আরও যা-যা বলে, সবই মিলে যায়! অর্থাৎ ছেলেটি জাতিস্মর। আশেপাশের বহু গ্রামের লোক ভিড় করে দেখতে আসছে ছেলেটিকে।
বড়বাবু বললেন, আমিও দেখতে যাব। চিরু, তুমি যাবে আমার সঙ্গে!
চিররঞ্জন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখন সেই পুরুলিয়া ছুটবেন? আপনি বিশ্বাস করেন এসব?
তুমি বিশ্বাস করো না?
চিররঞ্জন আমতা আমতা করে বললেন, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু যায় আসে না। তবে খবরের কাগজে যখন লিখেছে, তখন কি আর মিথ্যে লিখেছে?
বড়বাবু হো-হো করে হেসে বললেন, তুমি যে রামকৃষ্ণদেবের মতন বললে হে! সেই যে এক বাবু খবরের কাগজের ওপর এত ভক্তি যে একটা বাড়ি ভেঙে পড়েছে সেটা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছেন না, লোকটা বললেন, দেখো তো খবরের কাগজে লিখেছে কি না। খবরের কাগজে সব সত্যি লেখে?
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি এসব বিশ্বাস করেন না–তা হলে যেতে চাইছেন কেন?
আমি প্রমাণ না পেলে বিশ্বাসও করি না, অবিশ্বাসও করি না। তবে এই রকম ঘটনা প্রায়ই দেখি। আমার মনে হয় এর মধ্যে একটা কিছু রহস্য আছে।
জন্মান্তরবাদের তত্ত্বটা যদি সত্যি নাও হয়, তবু বড় মধুর। কারনা ইচ্ছে করে, আবার এই পৃথিবীতে জন্মাই, আবার নতুন করে জীবন ফিরে পাই।
মানুষ মরে গিয়ে আবার জন্মায় কি না সেটা প্রমাণ করার কোনও রাস্তা নেই। আগের জন্মের কথা তো কারওর মনে থাকে না–আর মনেই যদি না থাকে, তা হলে বার বার জন্মানোর এমন কিছু মূল্য নেই। দুটো জীবন যদি তুলনা করে দেখা না যায় তা হলে আর মজা কী! এইসব জাতিস্মরের ঘটনা যদি সত্যি হয়, তা হলে সেটাই হতে পারে একমাত্র প্রমাণ। তাই না? যে-সব জাতিস্মরের ঘটনা একবার কাগজে ওঠে, দু-চার বছর বাদে তাদের কী অবস্থা হয়, তখনও সব মনে থাকে কি না–সেটা তো আর বেরোয় না!
আমার কী মনে হয় জানেন। সত্যি তোক মিথ্যে হোক, এইসব ঘটনা কাগজে ছাপাবার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। এই যে সব ছেলে দেশের জন্য লড়াই করছে, ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিচ্ছে–এরা অনেকেই পরজন্মে খুব বিশ্বাস করে। এইসব খবর পড়লে তাদের বিশ্বাসটা অনেক জোরদার হয়।
বড়বাবু দু’-এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন চিররঞ্জনের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তোমার কথায় যুক্তি থাকতে পারে। যাই হোক–এ-ছেলেটির তো বাপের নাম, গ্রামের নাম সবই দেওয়া আছে। নিজের চোখে দেখে যাচাই করে আসতে দোষ কী! আমি কাল সকালেই রওনা হচ্ছি।
বড়বাবুর মাথায় প্রায়ই এ রকম বাতিক চাপে। তার মনের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা প্রবৃত্তিটা প্রবল। এ বাড়িতে একজন ছুতোরমিস্ত্রি আসে প্রায়ই, দরজা-জানলা সারায় কিংবা রান্নাঘরের র্যাক বানায়। লোকটি বেশ বুড়ো, মুখ-ভরতি দাড়ি, লুঙ্গি পরে খালি গায়ে আসে, তার বুকের লোমগুলোও সাদা। লোকটির একটি অদ্ভুত স্বভাব হচ্ছে এই, সে প্রায় সব সময়েই নিজের মনে কথা বলে। অনেক সময় বেশ জোরে জোরে। উঠোনের এক কোণে সে কাঠকুটো নিয়ে র্যাদা বা তুরপুন চালাতে চালাতে আপন মনে বকবক করে।
বড়বাবু এই লোকটিকে দেখে আকৃষ্ট হলেন। কাঠের মিস্তিরি যখন কাজ শুরু করত, বড়বাবু একটু দূরে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করতেন ও কী কথা বলে। দু-চার দিন শোনার পর বড়বাবু সেই মিস্তিরিকে তার বন্ধু করে ফেললেন। চিররঞ্জনকে বললেন, আমাদের এই রজ্জব মিস্তিরি খাঁটি কর্মযোগীন। কাজের সময় ও যন্ত্রপাতির সঙ্গে কথা বলে, যেন ওরা সবাই তার আপনজন। কী বলে জানো, র্যাদা ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, আরে ব্ল্যাদার পো র্যাদা, এ-দিকে যা, ও-দিকে যা! এ-দিক যা, ও-দিক যা! আমি যে-দিকে যাওয়ামু হিদিকে যাবি! এই কষ্মেই তোর জন্মো! তোর কি আমোদ আহ্লাদ করার টাইম আছে! যে-দিকে যাওয়ামু, হিদিকে যাবি! ও হাতুড়ি, তোর কাম পেরেকের মাথা পিটানা, তুই আমার আঙুলের মাথা পিটাইতে চাস ক্যান?–লোকটি মাঝে মাঝে আল্লার সঙ্গেও। সরাসরি কথা বলে। যেন কর্মে মগ্ন থাকার সময় আল্লা ওর সামনে এসে দাঁড়ান। আল্লার কাছে ও হাতুড়ির নামে নালিশ জানায়।
সেই মিস্তিরি এরপর থেকে এ বাড়িতে কোনও কাজ না থাকলেও আসে। বড়বাবুর সঙ্গে কী সব গল্প করে বড়বাবুর কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে লজ্জিত ভাবে ধরায়, পাশ ফিরে ধোঁয়া ছাড়ে। দু’জনের বেশ মনের মিল হয়েছে বোঝা যায়।
বড়বাবু আর একবার একটা ভুতুড়ে বাড়িতে রাত কাটাবেন ঠিক করেছিলেন। কলকাতা শহরে তখন অনেক খালি বাড়ি থাকত, পথে পথে টু-লেট’ নোটিশ দেখা যেত। মালিকের অভাবে বা অযত্নে দু-চারটে পোড়ো বাড়িরও অভাব ছিল না। সেইসব বাড়ি ঘিরে আস্তে আস্তে ভুতুড়ে গল্প দানা বাঁধে। দেশ বিভাগের পর রিফিউজিরা এসে কলকাতার সব ফঁকা বাড়ি দখল করে নিয়েই কলকাতায় ভূতদেরও তাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে নিছক বাজে গুজব কিংবা গালগল্প শুনে ছোটার লোক ছিলেন না বড়বাবু। সেই সময় উত্তর কলকাতার রামধন মিত্তির লেনের একটা হানাবাড়িকে কেন্দ্র করে একটি চাঞ্চল্যকর ভূতের গল্প খুব ছড়িয়ে পড়েছিল। বড়বাৰু সেখানে যেতে চেয়েছিলেন সত্যের সন্ধানে। তিনতলা এই বাড়িটি বহুকাল পরিত্যক্ত, সদর দরজায় ঘাস গজিয়ে গেছে, দেওয়ালে কার্নিসে বড় বড় বট, অশ্বথের শিকড়। মধ্য রাত্রে সেই বাড়ি থেকে বাচ্চা ছেলের চিৎকার, নারীকণ্ঠের কান্না শোনা যেত এবং দেখা যেত একটা সবুজ আলো ছাদের ওপর ঘোরাফেরা করছে। যেসব দুঃসাহসী দিনের বেলাতেও সে বাড়িতে ঢুকতে চেষ্টা করেছে, তারা নাকি রক্তবমি করতে করতে মারা গেছে। একটি প্রাইভেট ব্যাঙ্কের মালিকের ডাকাবুকো সন্তান নিজস্ব এরোপ্লেনে সেই বাড়ির ছাদের ওপর চক্রাকারে পরিভ্রমণ করেও সেই সবুজ আলো দেখতে পেয়েছে এবং তার কোনও মানে বুঝতে পারেনি।
তখন সেই বাড়ির রহস্য উদঘাটনে যান কালীকিঙ্কর ঘোষাল। এই কালীকিঙ্কর ঘোষাল শ্যামবাজার এ ভি স্কুলের হেড পণ্ডিত, তান্ত্রিক মানুষ, মুখ-ভরতি দাড়ি, মাথায় জটা। তিনি ভূত-প্রেতে অবিশ্বাস করে যাননি, গিয়েছিলেন ভূত-প্রেতদের বশ মানাতে। বড়বাবু এই কালীকিঙ্কর ঘোষালকে চিনতেন।
বেশ বলশালী, লম্বা-চওড়া পুরুষ ছিলেন কালীকিঙ্কর ঘোষাল। কিন্তু রামধন মিত্তির লেনের ভূত তাকে আচ্ছা রকম জখম করে দেয়! তার গল্পটি এই রকম: হাতে একটা লাঠি এবং হ্যারিকেন নিয়ে সন্ধ্যার পর সে বাড়িতে ঢুকেছিলেন তিনি। সারা বাড়ি ঘুরে এবং ছাদে পায়চারি করেও কিছু দেখতে পাননি। সারা বাড়ি ধুলোয় ভরতি, মানুষের আনাগোনার কোনও চিহ্ন নেই। দোতলার একটি ঘর কোনও রকম বাসযোগ্য, সেটাকেই সাফসুতরো করে তিনি বসলেন মন্ত্র পড়তে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, কোথাও কোনও শব্দ নেই, ভুতের টিকিটিরও দেখা নেই। কালীকিঙ্কর ঘোষাল ধৈর্য হারালেন না। ভূত এ বাড়িতে না থাকলেও তিনি মন্ত্রবলে প্রেতাত্মা ডেকে আনবেন। যে-কোনও প্রেতাত্মা এলেই তিনি জেনে নিতে পারবেন এ বাড়ির অশরীরী বাসিন্দাদের সঠিক খবর।
ঠিক মধ্য রাত্রিতে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কালীকিঙ্কর আসন ছেড়ে উঠলেন না। গঙ্গাজলে আচমন সেরে প্রস্তুত হয়ে রইলেন। তৎক্ষণাৎ দেখলেন দরজার সামনে একটি দীর্ঘকায় মনুষ্যমূর্তি। তাকে দেখে কালীকিঙ্কর প্রথমে খুবই চমকে উঠেছিলেন। চমকাবারই কথা, কারণ সেই পুরুষ মূর্তিটির চেহারা হুবহু কালীকিঙ্করেরই মতন। ঠিক যেন কালীকিঙ্করের যমজ ভাই। অথচ কালীকিঙ্করের যমজ কেন, কোনও ভাই-ই নেই। দরজার কাছে দাঁড়ানো কালীকিঙ্করের চেহারা একদৃষ্টে চেয়ে রইল ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট কালীকিঙ্করের দিকে।
কালীকিঙ্কর ঘোষাল বিচলিত হলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এটা মায়া। অবিকল প্রতিমূর্তি সৃষ্টি করা এক প্রকার রাক্ষসী মায়া। কালীকিঙ্কর বসে আছেন, লোকটি দাঁড়ানো, না হলে বলা যেত তিনি যেন আয়নায় নিজের ছায়া দেখছেন।
কালীকিঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, তুই কে? কী চাস?
লোকটি উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসল। তারপর ঘরের মধ্যে এক পা বাড়াল। কালীকিঙ্কর গঙ্গাজল ছিটিয়ে বলেন, যাঃ যাঃ! অমনি মূর্তিটা মিলিয়ে গেল।
এরপর দরজার কাছে এল একটি বারো-তেরো বছরের মেয়ে। কস্তাপেড়ে ধনেখালির শাড়ি পরা, আঁচলটা জড়িয়ে গাছকোমর করে বাঁধা। একে দেখে কালীকিঙ্কর আরও বেশি চমকে উঠলেন। মেয়েটিকে দেখতে অবিকল কালীকিঙ্করের নিজের মেয়ে। লীলার মতন। তার একমাত্র মেয়ে। মেয়েটিকে দেখে কালীকিঙ্কর দুর্বল হয়ে। পড়েছিলেন, কিন্তু আসন ছেড়ে উঠলেন না।
মেয়েটি ঘরের মধ্যে এক পা এগিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুই কেন এসেছিস?
(ভূত-প্রেতরা সব সময় তুই বলে। তুমি বা আপনি তাদের অভিধানে নেই।)
কালীকিঙ্কর এর দিকে গঙ্গাজল ছেটাতে পারলেন না। কুমারী মেয়ের প্রতি মন্ত্র খাটে। অপাপবিদ্ধা কুমারী অভিশাপের অতীত।
কালীকিঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, তুই কে রে বেটি!
মেয়েটি আর এক পা এগিয়ে এসে ফের জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছিস তুই এখানে? তোর মেয়ে বাড়িতে মরতে বসেছে, আর তুই এখানে বসে আছিস?
কালীকিঙ্করের বুক কেঁপে উঠল। তবু তিনি হেসে উঠে বললেন, আমার মেয়েকে জলজ্যান্ত সুস্থ দেখে এসেছি কয়েক ঘণ্টা আগে–আর এর মধ্যেই সে মরতে বসেছে?
মেয়েটি বলল, যা, বাড়ি গিয়ে দেখ!
কালীকিঙ্কর বললেন, আমার সঙ্গে ছলনা করে তোর সুবিধে হবে না! তুই এই মূর্তি ধরেছিস কেন? আমার মেয়ের কথা আমি বুঝব। তুই কে বল!
মেয়েটি তখন হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ল। মনে হল যেন অভিমান করে কঁদবে। ওই বয়সের মেয়েরা যেমন কাঁদে। তা কিন্তু নয়, মাটিতে শুয়ে গড়াতে গড়াতে চলে এল কালীকিঙ্করের দিকে। কালীকিঙ্কর জোড়াসন করে বসেছিলেন, মেয়েটি কাছে এসেই কালীকিঙ্করের বাঁ পায়ের বুড়োআঙুল কামড়ে ধরল।
কালীকিঙ্কর চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কী ছাড় ছাড়!
মেয়েটি কালীকিঙ্করের বুড়োআঙুল সম্পূর্ণটা মুখে ভরে প্রচণ্ড জোরে কামড়ে ধরেছে। কালীকিঙ্কর পাশে রাখা লাঠিখানা তুললেন তাকে মারবার জন্য। কিন্তু তিনি সাধক মানুষ, একটি মেয়েকে মারার জন্য তার হাত উঠল না, বিশেষত যে-মেয়ের চেহারা তাঁর নিজের কন্যার মতন। লাঠি রেখে কালীকিঙ্কর হাত দিয়ে মেয়েটিকে টেনে ছাড়াবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মেয়েটির গায়ে যেন অসীম শক্তি।
যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কালীকিঙ্কর উঠে দাঁড়ালেন। আসন ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জোর কমে গেল, দরজার কাছে ফিরে এল আগের সেই মূর্তি, তার পেছনে আরও কে যেন। কালীকিঙ্করের মানসিক দৃঢ়তা নষ্ট হয়ে গেল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চাচাতে লাগল, ওরে, ওরে, ছাড়, ছাড়, আর আসব না, ছেড়ে দে, মরে গেলাম, মরে গেলাম–
পাড়াসুন্ধু লোক শুনেছিল সেই চিৎকার। আশেপাশের সমস্ত বাড়ির দরজা-জানলা খুলে গিয়েছিল। কালীকিঙ্কর তখন সেই মেয়েটাকে সুষ্ঠু ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে ছুটে এসেছিলেন বারান্দায়, সেখান থেকে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লাফ দিয়েছিলেন নীচে। তার বাঁ পায়ের বুড়োআঙুল ছিঁড়ে উড়ে গেছে।
খবর পেয়ে বড়বাবু ছুটলেন হাসপাতালে কালীকিঙ্করকে দেখবার জন্য। সত্যি কালীকিঙ্করের এক পায়ের বুড়োআঙুল নেই। এবং সে-রাত্রে কালীকিঙ্করের মেয়ে। লীলার সত্যিই কলেরা হয়েছিল।
বড়বাবু বাড়ি ফিরেছিলেন খুব চিন্তিত ভাবে। চিররঞ্জনকে বলেছিলেন, এসব গাঁজাখুরি গল্পে আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু কথা হচ্ছে কী, কালীকিঙ্কর পণ্ডিত এ মিথ্যে গল্প ছড়াবেনই বা কেন? তা ছাড়া, পায়ের ওই আঙুলটা–দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়লেও কি পায়ের আঙুল ওই ভাবে উড়ে যায়? ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।
বড়বাবু সেই ভুতুড়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হলেন। বাড়ির সবাই তাকে ভীষণ ভাবে বারণ করল, বড়বাবু কিছুতেই কারওর কথা শুনবেন না। বিশেষ ভাবে তাকে আকৃষ্ট করেছিল ওই প্রতিমূর্তি দেখার ব্যাপারটা। তিনি তার প্রতিমূর্তির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন বোধহয় বিশেষ কোনও কথা তার বলার ছিল।
শেষ পর্যন্ত বড়বাবুর যাওয়া হয়নি। কালীকিঙ্কর ঘোষালের ঘটনাটা এমন ভাবে রটে যায় যে, হাজার হাজার মানুষ গিয়ে ভিড় করে সেই বাড়ির সামনে, পুলিশ জায়গাটা ঘিরে রাখে এবং শেষ পর্যন্ত কর্পোরেশন বাড়িটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
খবরের কাগজে জাতিস্মরের ঘটনাটা পড়ার পরদিন বড়বাবু চিররঞ্জনকে নিয়ে পুরুলিয়া রওনা হয়ে গেলেন। পুরুলিয়া স্টেশন থেকে রঘুনাথপুর গ্রামে যেতে হলে গোরুরগাড়ি ছাড়া আর কোনও যানবাহন নেই। কিছু খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করার পর একখানা। গোরুরগাড়ি ভাড়া নিয়ে তাঁরা চেপে বসলেন।
প্রায় এক বেলার পথ। রাস্তার অবস্থা কহতব্য নয়। ঝাঁকুনি খেতে খেতে হাড়গোড় ভেঙে যাবার উপক্রম। পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, সেদিন আর ফেরার প্রশ্ন। ওঠে না। সেই গণ্ডগ্রামে কোনও থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ভরসার কথা এই, গ্রীষ্মকাল, শেষ পর্যন্ত দরকার হলে গোরুরগাড়িতেই শুয়ে থাকতে পারা যাবে। পুরোটাই যাতে মরীচিৎকার পিছে ছোটা হয়ে না যায়, সেই জন্য পুরুলিয়া স্টেশনে তারা খবর নিয়ে এসেছেন। স্টেশনের দু’-চার জন লোকও সেই অলৌকিক ব্যাপারের কথা শুনেছে।
বড়বাবু চিররঞ্জনকে বললেন, বুঝলে, গিয়ে যাতে সম্পূর্ণ নিরাশ না হতে হয়, সে জন্য প্রস্তুত থাকা ভালো। যদি গিয়ে দেখি পুরো ব্যাপারটাই বানানো, তা হলেও একটা জিনিস ভাবতে হবে। এই রকম এক গণ্ডগ্রামের একজন ইস্কুল মাস্টারের মাথায় হঠাৎ এ রকম একটা ঘটনা বানাবার কথা জাগল কী করে? সবার মাথায় তো এ রকম চিন্তা জাগে না। এটাও তো একটা রহস্য।
চিররঞ্জন বললেন, মনে হচ্ছে, হঠাৎ যেন আমাদের বয়স কমে গেছে। ছেলেছোকরারাই এইসব অ্যাডভেঞ্চারে যায়।
বড়বাবু সচকিত হয়ে বললেন, তোমার ভালো লাগছে না? কষ্ট হচ্ছে খুব?
না, না! খুব বেশি ভালো লাগছে বলেই এ কথা বললাম। বয়স কমে যাবার অনুভূতির চেয়ে প্রিয় আর কী আছে এ বয়সে।
তুমি বড্ড বেশি বুড়ো বুড়ো ভাব করো। তোমার কী-ই বা বয়স। তোমার বয়সে আমি লছমনঝোলায় থাকতাম–রোজ একখানা পাহাড় ভেঙে যেতাম গঙ্গায় স্নান করতে।
আপনার গায়ে বয়সের আঁচড় লাগে না। আচ্ছা বড়বাবু, হরিদ্বার-লছমনঝোলায় আপনি যে বছরখানেক কাটিয়েছিলেন, কী পেয়েছিলেন সেখানে। ঈশ্বরকে পেয়েছিলেন?
ঈশ্বরকে কেউ পায়?
পায় না?
আমি অন্তত ঈশ্বরকে পেতে যাইনি। আমি দেখতে গিয়েছিলাম সত্যিই ঈশ্বরকে কেউ পায় কি না।
সে রকম কারওকে পাননি?
নিঃসন্দেহ হতে পারিনি। যারা খুব জোর দিয়ে ঈশ্বরকে সাক্ষাৎ দর্শনের কথা বলেছেন, তাদের আমার মনে হয়েছে মানসিক ভাবে অসুস্থ। তবে একথাও ঠিক, ঈশ্বর-চর্চা যারা খুব মন দিয়ে করেন তাদের মধ্যে এমন একটা পরিবর্তনের চিহ্ন দেখেছি–যা বেশ আনন্দেরই ব্যাপার। ঈশ্বর-সন্ধানী লোকদের আমার খারাপ লাগে না, কিন্তু ধার্মিক লোকদের আমি পছন্দ করতে পারলাম না। ঈশ্বর আছেন কি না আমি জানি না, থাকুন তাতে কোনও ক্ষতি নেই কিন্তু ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে যে কতগুলি ধৰ্ম গড়ে উঠেছে–সেগুলো মানুষের বড় ক্ষতি করে।
কেন, একথা বলছেন কেন?
প্রত্যেক ধর্মে আলাদা আলাদা ঈশ্বর বড় হিংসুটে। ওল্ড টেস্টামেন্টে খোলাখুলিই বলা হয়েছে, তিনি জেলাস গড! এক ধর্ম আর এক ধর্মকে সহ্য করে না। আবার এক একটা ধর্মের মধ্যেও ফাটল ধরে বিভিন্ন টুকরো হয় তারা আবার নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। এক একটা ধর্মের নামে পৃথিবীতে যত মানুষ খুন হয়েছে, প্লেগ, কলেরা বা সাপের কামড়েও অত মানুষ মরেনি।
আমাদের বেদে তো হিংসার কোনও কথা নেই।
তুমি বেদ পড়েছ?
তেমন ভালো করে পড়িনি।
পড়ে দেখো, বেশ মজা পাবে। আমি একসময় ঝোঁকের মাথায় পড়ে ফেলেছি। বেদকে অনেকে বলে হিন্দুদের একটা ধর্মগ্রন্থ, কিন্তু ওটা একটা গাঁজাখুরি কথা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমশাই বেদকে বলেছেন পলগ্রেভ সাহেবের গোল্ডেন ট্রেজারির মতন একখানা পদ্যের বইয়ের সংকলন। উনি ভূয়োদর্শী লোক, বলেছেন ঠিক কথাই। যে-সব প্রাচীন আর্যরা হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান, জরাথুষ্ট্রিয়ানসবারই পূর্বপুরুষ, তাদের লেখা কিছু কবিতাই তো বেদ নামে চলে। ওরা ছিল প্যাগন, প্রকৃতি-পূজারী। আগুন, হাওয়া, বৃষ্টি এগুলোকেই দেবতা বানিয়ে পূজা করার তবু একটা মানে বুঝতে পারি, কিন্তু জগৎ সংসারের সৃষ্টিকর্তা একজন ঈশ্বরের অস্তিত্ব তো দূরে থাক, এ রকম কল্পনার কোনও প্রয়োজন আছে বলেও আমি বিশ্বাস করি না। বেদেও কোনও ধর্মের কথা নেই, ওটা পুরোপুরি ভোগবিলাসপ্রিয় মানুষদের সাহিত্য। বৈরাগ্য, আত্মোপলব্ধি, ঈশ্বরানুভূতি এসব ভালো ভালো কথা এসেছে অনেক পরে–উপনিষদের আমলে, অনার্য আর দ্রাবিড়দের কাছ থেকে পাওয়া। পূজা শব্দটাই তো বৈদিক সংস্কৃত নয়–দ্রাবিড়দের কাছ থেকে এসে সংস্কৃতে ঢুকেছে। আমরা এখন যেটুকু হিন্দুধর্ম বলে জানি, সেটা কোনও ধর্মই নয়, একটা জগাখিচুড়ি ব্যাপার। এরা ভালো ভালো সাহিত্য বানিয়েছে, কিন্তু সেগুলোকে উপদেশ হিসেবে নেওয়ার কোনও দরকার নেই। দেখো না, এই ধর্মের মূল শাস্ত্রগুলোতে কোথাও মূর্তিপুজোর কথা নেই, অথচ সারা ভারত জুড়ে কত রকম পুতুলের কত রকম পুজো। আমাদের ব্রাহ্মরা এই ধর্মটা সাফসুফ করে একটা পরিষ্কার। চেহারা দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বেম্মদের সেই ধর্ম বাজারে তেমন চলল না। কুসংস্কার ছাড়া ধর্ম টেকে না। প্রত্যেকটা ধর্মই কুসংস্কারের ডিপো।
চিররঞ্জন আস্তে আস্তে বললেন, মানুষ যদি কুসংস্কার মেনেই আনন্দ পায়—
বড়বাবু ঝাঝের সঙ্গে বলে উঠলেন, আনন্দ পাওয়ার কথা আলাদা। কিন্তু যখন কেউ এর মধ্যে তত্ত্বের কথা বলে, তখনই আমার রাগ ধরে। বললেই পারিস, আমার গায়ে জোর আছে, মানুষ খুন করে আমি আনন্দ পাই–এর মধ্যে আবার ধর্ম টেনে আনা কেন?
গাড়োয়ান বলল, বাবু, হুই যে দেখা যায় রঘুনাথপুরের আলো, আপনারা কার বাড়িতে যাবেন? বালক-ঠাকুর দেখতে যাবেন নাকি?
বড়বাবু মুচকি হেসে চিররঞ্জনকে বললেন, দেখেছ, এর মধ্যেই ঠাকুর বানিয়ে ফেলেছে!