সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রয়াস আনুমানিক – ১২০০-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ
উত্তর-ভারতে বিদেশি আক্রমণ বারবার ঘটেছে। আমরা দেখেছি কিভাবে গ্রীক, সিথিয়ান, পার্থিয়ান ও হুণরা উত্তর-ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু বৎসর ধরে ক্ষমতা অধিকার করেছিল। বিদেশি হিসেবে শাসন করতে এলেও শেষ পর্যন্ত তারা ভারতীয়দের মধ্যে মিলে গেল। যতদিন পর্যন্ত এদেশের সমাজের মধ্যে ম্লেচ্ছদের অঙ্গীভূত করে নেওয়া সম্ভব ছিল, বিদেশিরা যে বিধর্মী তা অনায়াসে ভুলে যাওয়া যেত। একথাও সত্য যে, বিদেশিরা ভারতের যেসব অঞ্চলে বসবাস শুরু করল, সেখানে গোঁড়া হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল না। তাই বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ও প্রতিষ্ঠানে বিদেশিদের প্রবেশ করতে অসুবিধা হয়নি। প্রাচীনপন্থীরা আগন্তুকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে দূরে সরিয়ে রাখবার তেমন কোনো চেষ্টা করেনি। বৌদ্ধরা বরং তাদের মধ্যে অনেককেই ধর্মান্তর গ্রহণ করানোতে সফল হয়।
একথাও মনে রাখা দরকার যে, গ্রীক, সিথিয়ান ও হুণরা তাদের সঙ্গে নিজেদের কোনো ধর্মতত্ত্ববিদকে নিয়ে না আসায় হিন্দু ও বিদেশি ধর্মের মধ্যে কোনো সংঘাত উপস্থিত হয়নি। কিন্তু ইসলামের আগমনের পর এই সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়াল। ইসলামের সঙ্গে এলো এক নতুন জীবনধারা। আগেকার বিদেশিদের প্রভাবে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের যেটুকু পরিবর্তন হয়েছিল তা দুই ধর্মের বিধানদাতারা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে তা হয় না। তবে তা সত্ত্বেও পরস্পরের মধ্যে মিশ্রণের কিছু কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। বাহ্যিকভাবে দেখতে গেলে তুর্কীরা স্থানীয় খাদ্য ও পোশাক গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ইসলামের কোনো কোনো সামাজিক চিন্তা ভারতীয় জীবনের অংশ হয়ে যাওয়া।
পরোক্ষভাবে দেখতে গেলে, একদিক দিয়ে এ ব্যাপারে মঙ্গোলদের দান আছে। তারা আফগানিস্তান ও পশ্চিম-এশিয়া থেকে ব্যাপকহারে জনগণের ভারতবর্ষে আসার সম্ভাবনা বন্ধ করে দেয়। সমুদ্রপথে প্রতিবছর অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ীই আসত এবং তারা পশ্চিম-উপকূলের বন্দর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করত। এইসব কারণে ধর্মান্তরিত হিন্দুরাই ইসলামের প্রধান ভরসা হয়ে উঠল। কিন্তু ধর্মান্তরকরণ চলছিল খুব ধীরগতিতে। মুসলমানরা ভাতরবর্ষে সর্বসময়েই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, অধিকাংশ হিন্দুই এমন কিছু দুরবস্থার মধ্যে বাস করত না যার জন্যে ধর্মান্তর গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষের পক্ষেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে তেমন কিছু সুযোগ-সুবিধা হয়নি। মুসলিম সমাজের অধিকাংশ মানুষই প্রাক্তন হিন্দু হওয়ার ফলে দেশের মূল জনসমাজের জীবনধারণের পদ্ধতির সঙ্গে মুসলিমদের তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।
এইভাবে অঙ্গীভূতকরণ সহজ হয়ে গিয়েছিল। দুইদল কারিগর যদি বহু বছর ধরে একই সমবায় সংঘ বা একই উপবর্ণের অঙ্গ হিসেবে পাশাপাশি থেকে একই কাজ করে, তবে তাদের মধ্যে একদল ধর্মান্তরিত হলেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে না। তবে, শাসকশ্রেণীর মানুষের ক্ষেত্রে দুই ধর্মের মিলন সম্পর্কে এত সহজে কিছু বলা সম্ভব ছিল না। উভয় ধর্মের বিধান প্রস্তুতকারীরা এবং কখনো কখনো রাজনীতিকরা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে প্রভেদ জিইয়ে রাখতে আগ্রহী ছিলেন, কারণ ধর্মের নামে তাদের একত্র করা সহজ ছিল, এবং ধর্মীয় আনুগত্যকে দরকার মতো ধর্মছাড়া অন্য কাজেও ব্যবহার করা যেত।
হিন্দু তাত্ত্বিকরা বোঝেননি যে, রাজনৈতিক স্তরে হিন্দু-মুসলমানদের একীকরণের একটা সচেতন চেষ্টা থাকা উচিত। সমাজে যেন কোনো বিধর্মীয় প্রভাব না পড়ে, তাঁদের সেইদিকেই কেবল দৃষ্টি ছিল। সমাজকে এঁরা রাজনৈতিক কাজকর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সুলতানী আমলের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগের যুগের চেয়ে এমন কিছু পৃথকও ছিল না। ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী এইসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একেবারে খাঁটি ইসলামী আখ্যা দেওয়া অসম্ভব ছিল। যেমন, দৈবশক্তির সঙ্গে রাজার কোনো সম্পর্কের কথা কোরআনে বলা হয়নি। কিন্তু পারস্যের স্যাসানীয় রাজাদের কাছ থেকে তুর্কীরা এই ধারণাটা পেয়েছিল। ভারতে এসেও তারা একই ধারণা দেখতে পেল। এরপর কেবল ধর্মতাত্ত্বিকদের সম্মতি নিয়ে রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাস নিজেদের রাজনৈতিক ধারণার অন্তর্ভুক্ত করে নিল।
মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের বলা হয় ‘উলেমা’। এঁরা সুলতানের সুবিধার্থে কোরআনের উদ্ধৃতির সাহায্যে এইসব নতুন ধারণায় সায় দিতেন। শর্ত থাকত যে, রাজ্যের ধর্মীয় আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে উলেমাদের মতই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। ধর্ম ও রাজনীতির এই মিলনের ফলে রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে উলেমাদের প্রভাবকে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। ক্রমশ মুসলমান আমলেও এই ধারণাই প্রচারিত হলো যে, রাজ্যের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার জন্যে সুলতান অপরিহার্য এবং তাঁর অবর্তমানে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। উল্লেখযোগ্য যে, আগেকার হিন্দু ধারণাতেও রাজা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে একই কথা বলা হয়েছিল। ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও উলেমাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সুলতানের পক্ষে আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়াল। ফলে, সুলতানরা উলেমাদের ভূমিদান করতেন, মসজিদ নির্মাণ করতেন এবং উলেমাদের সন্তুষ্টির জন্যে মাঝে মাঝে হিন্দুদের দেবমূর্তি ও মন্দির ধ্বংস করে বিধর্মীবিরোধী মনোভাব দেখাতেন। তবে, সব সুলতানই সমান সুযোগ-সুবিধা দিতেন না এবং সেসব ক্ষেত্রে উলেমাদের খুব বিচার-বিবেচনা করে কাজ করতে হতো। কেননা, বিধর্মীদের দেশে নিজেদের আভ্যন্তরীণ ঝগড়া বাইরে প্রকাশ করা বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। সুলতানরা সাধারণত রাজনীতি বা ধর্মনীতির খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ছিলেন সামরিক ভাগ্যান্বেষী। বিলাসব্যসনের মধ্যে যত বেশিদিন সম্ভব রাজত্ব করাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। রাজদরবারে রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও লেখকরা সমাদর পেতেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা খুব গভীরভাবে ওসব নিয়ে চর্চা করুন, এটাও সুলতানরা পছন্দ করতেন না। বরনি অভিযোগ করেছেন যে, সুলতানরা নিজেদের কর্তব্য পালন করতেন না। সুলতানরা তো ঈশ্বরেরই প্রতিনিধি, সেজন্যে তাঁদের কর্তব্যও মহান। এইকথা বলার অপরাধে বরনিকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। এইসব অভিযোগ উলেমাদের কাছ থেকেই আসা উচিত ছিল, কিন্তু তাঁরা কখনো এসব ব্যাপারে মুখ খুলতেন না।
সুলতানের রাজদরবার ছিল ধনসম্পদের রীতিমতো প্রদর্শনী। প্রতিদিন আচার-অনুষ্ঠান, নিয়মকানুন অত্যন্ত আড়ম্বর সহকারে পালন করা হতো। এত জাঁকজমক ও অনুষ্ঠানের আতিশয্য ছিল প্রধানত শাসক ও শাসিতের মধ্যে পার্থক্যটা প্রকট করে দেখাবার উদ্দেশ্যে। খাসজমি থেকে যে রাজস্ব আদায় হতো, তা খরচ হতো হারেম, দাস, প্রাসাদ ও দরবারের কর্মচারীর জন্যে। প্রাসাদে সুলতানের নিজস্ব দেহরক্ষীদল থাকত, যাতে বাইরের কেউ হঠাৎ সুলতানকে হত্যা করতে না পারে। রাজকীয় কারখানায় সুলতানের নিজস্ব জিনিসপত্র ও উপহার সামগ্রী তৈরি হতো। সুলতান তাঁর কর্মচারীদের কর্মকুশলতার জন্যে যে বিশেষ সম্মানবস্ত্র উপহার দিতেন, সেরকম কয়েক হাজার পোশাক প্রতিবছর এই কারখানাতেই তৈরি হতো।
মূল ইসলামী আইন শরিয়ত ব্যাখ্যা করতেন উলেমারা এবং সুলতানরা তাই মেনে চলতেন। প্রধান কাজীর পরামর্শ নিয়ে সুলতান প্রধান বিচারপতির ভূমিকা নিতেন। মৃত্যুদণ্ড দিতে হলে সুলতানের অনুমতি প্রয়োজন হতো। নতুন আইন প্রবর্তনের সময় তা প্রথমে রাজধানী ও মুসলমান প্রধান শহরেই প্রয়োগ করা হতো। গ্রামাঞ্চলে পুরনো আইন চলত। অ-মুসলমানরা তাদের নিজস্ব আইন বজায় রাখতে পারত। এর ফলে নানারকম আইন সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত স্থির হলো যে, রাষ্ট্রের বিপদের কারণ না হলে অ-মুসলমানরা নিজস্ব আইন মেনে চলতে পারবে। আইনের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যার ব্যবস্থা ছিল না বলে প্রয়োজন অনুসারে আইনের ব্যাখ্যা অদল-বদল হতে পারত। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের সতী হওয়া নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছিল। শরিয়া অনুসারে আত্মহত্যা ছিল বে-আইনী এবং সতী হওয়ার অর্থই আত্মহত্যা করা। কিন্তু হিন্দুনারীর ক্ষেত্রে এই প্রথা মেনে নেওয়া হয়েছিল।
আইন অনুযায়ী সুলতান ছিলেন খলিফার প্রতিনিধি। প্রকৃতপক্ষে অবশ্য তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন। কিন্তু সুলতানের পক্ষে একেবারে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা অসম্ভব ছিল, কারণ শেষ পর্যন্ত তাঁকে ইসলামের নাম করেই আনুগত্য লাভ করতে হতো। এই কারণে তাঁকে অন্তত প্রকাশ্যে ইসলামী ঐতিহ্য ও শরিয়ার অনুশাসন মেনে চলতে হতো। ষোড়শ শতাব্দীতে আকবর যে তাঁর নিজস্ব ধর্মমত ‘দীন ইলাহী’ প্রবর্তন করতে পেরেছিলেন তা দেখে মনে হয় যে, ততদিন রাজনীতির ওপর ধর্মের প্রভাব কিছুটা শিথিল হয়ে গিয়েছিল। উলেমা, ওমরাহ ও স্থায়ী সেনাবাহিনীকে সন্তুষ্ট রাখা প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল। এছাড়া কোনো কোনো সময়ে দ্রুত সুলতান বদল থেকেও বোঝা যায় যে, তাঁরা সর্বশক্তিমান ছিলেন না।
সেনাবাহিনীর মধ্যে তুর্কী, আফগান, মঙ্গোল, ফারসি ও ভারতীয় সৈনিক ছিল। প্রত্যেক ইক্তাদারের পক্ষে সৈন্য জোগানো আবশ্যকীয় ছিল বলে মনে হয় যে, সেনাবাহিনীতে ভারতীয়রাই সংখ্যাগুরু ছিল। হিন্দু সৈনিক গ্রহণে কোনো নিষেধ ছিল না। সেনাবাহিনী মঙ্গোলদের রীতি অনুযায়ী ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১ হাজার জন সৈনিকের ছোট ছোট দলে বিভক্ত থাকত।
অসামরিক শাসনব্যবস্থার প্রধান ছিলেন উজীর বা প্রধানমন্ত্রী। তিনি রাজস্ব আদায়, জমা খরচের হিসেব ও অর্থব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতেন। রাজস্ব ভিন্ন অন্যান্য ব্যাপারে সুলতান তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করবেন কিনা তা সুলতান ও উজীরের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর নির্ভর করত। উজীর এবং আরো ৩ জন মন্ত্রীকে রাজ্যের স্তম্ভ বলে ধরা হতো। অন্যান্য মন্ত্রীরা কেউ ছিলেন প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রধান। তাঁর কাজ ছিল সেনাবাহিনীর সৈনিক ও অস্ত্রের হিসেব রাখা। আরেকজন মন্ত্রীর দায়িত্ব ছিল দরবারের সঙ্গে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের যোগাযোগ বজায় রাখা; এঁর অধীনে কিছু লোক ছিল, যারা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁকে সবরকম খবরাখবর সরবরাহ করত।
প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখার দুটি উপায় ছিল। রাজধানীর কাছাকাছি প্রদেশ হলে সোজাসুজি কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ, তা না হলে কেন্দ্র থেকে পাঠানো প্রতিনিধির প্রদেশে উপস্থিতি। এছাড়াও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর ক্ষমতার পরিমাণ নির্ভর করত। দরবারের বিভিন্ন শাসনবিভাগীয় দপ্তরগুলোর শাখাদপ্তর থাকত প্রদেশগুলোতে। প্রদেশের মধ্যে আরো ছোট শাসনতান্ত্রিক বিভাগ ছিল ‘পরগণা’। এই পরগণাতেই সরকারি কর্মচারীরা কৃষকদের সংস্পর্শে আসত। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের মধ্যে ছিল— প্রধান শাসক, রাজস্ব হিসেব ও আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী, হিসাবরক্ষক এবং ১ জন নথিলেখক। নথি ফারসি ও হিন্দিভাষায় লেখা হতো। খাজনার হিসেব ও আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে বলা হতো ‘মুনসেফ’। ভূমি সংক্রান্ত বিবাদের মীমাংসার দায়িত্ব ছিল মুনসেফের ওপর। এর সঙ্গে মৌর্য আমলের রাজুকদের তুলনা করা চলে। শাসনব্যবস্থার ক্ষুদ্রতম একক ছিল গ্রাম। গ্রামের জন্যে ৩ জন কর্মচারী ছিল— গ্রামপ্রধান, হিসাবরক্ষক বা ‘পাটোয়ারী’ ও নথিলেখক বা ‘চৌধুরী’। শহরগুলো কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক অঞ্চল শাসন করত ২ জন রাজকর্মচারী। তারা আবার শহরের প্রধান প্রশাসকের অধীনস্থ ছিল।
অর্থাৎ, সুলতানী আমলের অসামরিক শাসনব্যবস্থা ছিল আগের শাসনব্যবস্থারই অনুসরণ। কোথাও কোনো মৌলিক পরিবর্তনের চেষ্টা হয়নি, কেবল কর্মচারীদের পদের নাম পাল্টে নিয়েছিল। গ্রাম ও পরগণার অধিকাংশ কর্মচারীই ছিল হিন্দু। এইসব কর্মচারীরা সাধারণত বংশানুক্রমেই এই কাজ করে আসছিল। সুলতানী যুগের শাসনরীতি এবং কর্মচারীদের পদের নাম আধুনিক যুগেও কিছু কিছু বজায় আছে।
শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরশীল ছিল যাতায়াতব্যবস্থার ওপর। ইবন বতুতা, তুঘলকী আমলের যাতায়াতব্যবস্থা ও ডাকবিভাগের কর্মকুশলতার উচ্চ প্রশংসা করে গেছেন। তিনি নিয়মিত এইসব রাস্তা দিয়ে নিজেও আসা-যাওয়া করেছেন। রাস্তা সাধারণত পাথর দিয়ে তৈরি হতো। ষাঁড়ে-টানা গাড়িই ছিল বেশি। অভিজাতশ্রেণির লোকেরা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করত। দ্রুত ভ্রমণের প্রয়োজন না থাকলে পালকির ব্যবহার হতো। রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সরাইখানা ছিল। তাছাড়া সেখানে দোকান, কুলি ও বদলি ঘোড়ারও ব্যবস্থা ছিল। ডাক বিলির জন্যে ঘোড়ার ব্যবহার হতো, আবার পায়ে হেঁটেও ডাকহরকরা চিঠিপত্র নিয়ে যেত। প্রায় সমস্ত গ্রামেই ঘোড়া বা ডাকহরকরা বদল হতো। তবে ডাক-ব্যবস্থার খরচ কম ছিল না। রাজদরবারের লোকেরা ও সম্পন্ন লোকেরাই ডাকে চিঠি পাঠাত। ডাকহরকরার হাতে একটি ঘন্টা লাগানো লাঠি থাকত। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাবার সময় ঘন্টার শব্দে জন্তু-জানোয়ার দূরে সরে যেত। আবার, ঘন্টার শব্দ শুনেই গ্রামের লোক রানার বা ডাকহরকরার আগমন বুঝতে পারত। গত শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে ডাকহরকরা ব্যবস্থা চালু ছিল।
বিদেশি তুর্কী আফগানরা অধিকাংশই শহরাঞ্চলে বসবাস শুরু করায় শহর- সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তন দেখা দিল। গ্রামাঞ্চল কিছুটা বিচ্ছিন্ন হওয়াতে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারত। অবশ্য তাদের রাজস্ব দিতে হতো নিয়মিত। গ্রামই ছিল প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র এবং গ্রামের উৎপাদনে সাধারণত স্থানীয় প্রয়োজন মেটানো হতো। প্রতি গ্রামের নিজস্ব শিল্পী ও কারিগররা কাপড় বুনত, হাল ও জোয়াল তৈরি করত, গরুর গাড়ির চাকা তৈরি করত এবং দড়ি, বাসনপত্র, ঝুড়ি, ঘোড়ার নাল, ছুরি, ছোরা, তরোয়াল ইত্যাদি সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসই তৈরি করত। নির্মাণ পদ্ধতি খুব সাবেকী ধরনের হলেও স্থানীয় প্রয়োজন মেটাবার পক্ষে তাই ছিল যথেষ্ট। কারিগররা একেকটি পেশা অনুসারে নানাবর্ণে বিভক্ত ছিল। এদের মধ্যে যারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হলো, তাদের মধ্যেও বর্ণপ্রথা বজায় রইল। মনে হয়, উচ্চশ্রেণির হিন্দুরা তখনো মুসলমানদের আরেকটি উপবর্ণ হিসেবেই গণ্য করত। কিন্তু শাসনব্যবস্থার উচ্চপদে মুসলমানদেরই সংখ্যাধিক্য হওয়ায় ক্রমশ মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের মনোভাব আরো সহনশীল হয়ে উঠল। কারিগররা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বংশানুক্রমে একই কারিগরিবিদ্যার চর্চা করত।
কিন্তু ক্রমশ একটা পরিবর্তনের সূচনা দেখা যায়। শহরগুলো আবার সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠতে শুরু করল। শহরের জন্যে পণ্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ল। তুর্কী আফগান আক্রমণের পর উত্তর-ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হলো। মঙ্গোলদের মাধ্যমে মধ্য-এশিয়ার সঙ্গে বিনষ্ট সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলো। সুলতানের সেনাবাহিনী যে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছিল— ব্যবসায়ীরা সেই সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল। অভিজাতশ্রেণির উচ্চমানের জীবনযাত্রার প্রয়োজনে দেশের মধ্যে পণ্য বিনিময় শুরু হলো। নিকটবর্তী শহরের প্রয়োজন অনুসারে গ্রামগুলো তাদের উৎপাদন বাড়িয়ে দিল। উপকূলবর্তী অঞ্চলে আগে থেকেই বহির্বাণিজ্যের প্রয়োজন অনুসারে উৎপাদন হচ্ছিল, পণ্য-বিনিময়ের জন্যে উৎপাদন বৃদ্ধি খুব আকস্মিকভাবে ঘটেনি, তবে আগেকার যুগের তুলনায় এখন উৎপাদন যথেষ্ট বেশি দেখা যায়।
শহরের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে শহরেও কারিগররা এসে কাজ শুরু করল। সেসব অঞ্চলে রপ্তানির জন্যে বিশেষ পণ্য উৎপাদন হতো, সেখানে নির্মাণ কৌশল উচ্চশ্রেণির ছিল। গুজরাট ও বাংলাদেশের শহরগুলোতে নানারকম বস্ত্ৰ উৎপাদন হতো। যেমন— শুভ্র সুতীবস্ত্র, রেশম, মখমল, সাটিন, তুলোভরা কাপড় ইত্যাদি। ক্যাম্বে অঞ্চলের বস্ত্রের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল, সেগুলোর উচ্চমান ও নিম্নমূল্যের জন্যে। শহরগুলো আন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠল। দরবারের প্রয়োজনে বিলাসদ্রব্যের চাহিদা বেড়ে গেল। দরবারের অনুকরণে প্রদেশগুলোতেও অভিজাতশ্রেণির মানুষ ওই ধরনের বিলাসদ্রব্য ব্যবহার শুরু করল।
প্রত্যেক শহরেই একটি বড় বাজার ছিল যেখানে সমস্ত ব্যবসায়ীরা এসে জমা হতো। এখানে নিয়মিত মেলা বসত। কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠী ব্যবসায়ের জন্যে বিশেষ পরিচিত লাভ করল। যেমন, গুজরাটী বেনেরা, যাদের সুদূর দক্ষিণের মালাবার পর্যন্ত কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল। এছাড়া ছিল মুলতানী ও রাজস্থানের মাড়োয়ারীরা। এছাড়া ছিল বাঞ্জারা নামক যাযাবর ব্যবসায়ী জাতি, এরা পণ্যসামগ্রী নিয়ে নানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। অনেক সময় অন্য ব্যবসায়ীরাও এদের মাধ্যমে পণ্য পাঠাত। যেসব বছরে ব্যবসা ভালো জমত না এদের বিরুদ্ধে ছিঁচকে চুরিরও অভিযোগ উঠত। এরা অনেকটা ইউরোপের জিপসীদের মতো ছিল। কোনো কোনো ব্যবসায়ী পশুর পিঠে মাল চাপিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিনিস বিক্রয় করত। এরা যদি নিজেদের শহর থেকে দূরে কোথাও যেত, পথের সরাইখানায় সাময়িকভাবে দোকান খুলত। ব্যবসায়ীদের নিয়মিত যাতায়াতের ফলে সরাইখানাগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠল।
স্থানীয় শাসনের কেন্দ্র হিসেবে প্রাদেশিক রাজধানীগুলোও ব্যবসার কেন্দ্র ছিল। শোনা যায়, বিশেষ করে দিল্লির বাজার জমজমাট ছিল। দেশবিদেশের পণ্যসামগ্রী এখানে পাওয়া যেত। ইবন-বতুতা দিল্লিকে মুসলিম জগতের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শহর বলে বর্ণনা করেছেন। এর মূলে ব্যবসায়ীদেরও দান ছিল। অনেক রাষ্ট্রীয় কারখানা দিল্লিতেই অবস্থিত ছিল এবং এগুলোতে যথেষ্ট উৎপাদন হতো। যেমন, একটি রেশম বস্ত্রের কারখানায় প্রায় ৪ হাজার লোক কাজ করত। কিন্তু ব্যবসায়ের প্রধান আকর্ষণ ছিল বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলো ছিল উপকূল অঞ্চলে। এখানে বিদেশি বণিকরাও বসবাস করত বলে শহরগুলোতে একটা আন্তর্জাতিক পরিবেশ ছিল। রপ্তানি বাণিজ্য এত লাভজনক দেখে কোনো কোনো বিদেশি স্থানীয় মেয়ে বিয়ে করে এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যেত। এখানকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈদেশিক শাখাও ছিল। সম্পন্ন মহাজনরা ব্যবসায়ীদের টাকা ধার দিত এবং অনেকে কেবল মহাজনী কারবার করেই দিন চালাত। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির নানা অনিশ্চয়তা দেখে মনে হতে পারে সে যুগের ব্যবসা অসাধুতা ও শঠতায় পূর্ণ ছিল। কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের এবং বিদেশি বণিকদের লেখা থেকে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সততার মান ছিল খুব উন্নত।
বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে ভারত এশিয়া ও ইউরোপের সংস্পর্শে এলো। এইযুগে চীনরা ভারত ও পূর্ব-আফ্রিকায় বাণিজ্যের মুনাফার জন্যে প্রতিযোগিতা করছিল এবং অন্যদিকে ইউরোপীয়েরা তখন আরবদের বাদ দিয়ে সোজাসুজি এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে আগ্রহী। ভারত ধীরে ধীরে পূর্ব ও পশ্চিমী জগতে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ হারাচ্ছিল। ধীরে ধীরে ঘটলেও এ ঘটনা অনিবার্য ছিল। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মশলা কিনত। আগে ভারতীয় জাহাজে করে মশলা যেত পশ্চিম এশিয়ায়। কিন্তু এবার আরবরাই মশলা নিয়ে যাবার কাজটা হাতে নিয়ে নিল। লোকসান হলো ভারতে। এই লোকসান অবশ্য কিছুটা পূরণ হলো ভারতীয় কারিগরি দ্রব্যের রপ্তানির ফলে। দেশের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নিয়েই ব্যবসায়ীরা এবার বেশি মনোযোগ দিল। তুর্কী ও আফগানরা সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ব্যবসার কাজে হিন্দুরাই বেশি এগিয়ে এলো। তবে বড় ব্যবসায়ী ও শাসনকর্তাদের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে নিশ্চয়ই ঐক্যমত ছিল। কিছু আরব ব্যবসায়ী ভারতে বসবাস করার ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য লাভের খানিকটা অংশ এদেশেই থেকে যাচ্ছিল।
সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে পারস্য উপসাগর দিয়ে ইরাকের মধ্য দিয়েও ভূমধ্যসাগরে যাওয়া যেত। অথবা লোহিতসাগর এবং মিশরের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরে যাওয়া যেত। তবে, আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে কয়েকটি নতুন বন্দর (মালিন্দে, মোমবাসা ও কিলোয়া) গড়ে ওঠায় একটি নতুন পথ খুলে যায়। ভারতীয় জাহাজগুলো ওরমুজ, এডেন ও জিড়া বন্দরে মাল খালাস করত। এগুলো ছিল পশ্চিম- এশিয়ার বড় বাজার। কোনো কোনো জাহাজ সোজা পূর্ব-আফ্রিকায় গিয়ে ক্যাম্বের বস্ত্রের বিনিময়ে সোনা নিয়ে ফিরত।
ভারতের আমদানির মধ্যে সবচেয়ে দামী জিনিস ছিল ঘোড়া। তুর্কীস্তানে তখনো পর্যন্ত ভালো জাতের ঘোড়া পাওয়া যেত, সেগুলো প্রায় খাঁটি আরবি ঘোড়ার সমতুল্য ছিল। কিছু কিছু আরবি ঘোড়া মঙ্গোল আক্রমণের ফাঁকে ফাঁকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপথ দিয়েও ভারতে এসে পড়ত। কিন্তু সাধারণত জাহাজে চাপিয়েই ঘোড়া আমদানির রীতি ছিল। ঘোড়া ছাড়া, এডেন থেকে জাহাজে করে সুগন্ধি, প্রবাল, সিঁদুর, সীসা, সোনা, রূপা, পারদ, কর্পূর, ফিটকিরি একরকম লাল রঙ ও জাফরান আসত। গুজরাট থেকে ভারত রপ্তানি করত চাল, বস্ত্র, দামী পাথর ও নীল।
ওদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য চলছিল। মালাক্কা এই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন দেশিয় বণিকরা ওখানে বসবাসও করত। ভারতীয় জাহাজগুলো মালাকার বন্দরে যেত প্রায়ই এবং সেখান থেকে মরিচ, ধূপ, বস্ত্র, জাফরান ও পারদ নিয়ে আসত। এইসব জিনিস এখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো জাভা, সুমাত্রা, তিমোর, বোণিও ও মালাক্কা ইত্যাদি জায়গায়। ফেরার সময় জাহাজগুলো নিয়ে আসত সোনা, লবঙ্গ, শাদা চন্দনকাঠ, জৈত্রী, জায়ফল, কর্পূর ও ঘৃতকুমারী। এর অধিকাংশই পশ্চিম উপকূলে পাঠানো হতো। তবে বাংলাদেশেও কিছু কিছু জিনিস আসত।
চীনারাও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের চেষ্টা চালাচ্ছিল। পূর্ব-আফ্রিকার সঙ্গে চীনের ব্যবসা শুরু হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আরো সহজ হয়, কারণ পথেই পড়ত ভারত। চীনা জাহাজগুলো বাংলাদেশে ও মালাবারের বন্দরে আসত। চেঙ-লো দক্ষিণ-এশিয়া ও পূর্ব-আফ্রিকায় ৭টি বাণিজ্য অভিযানের নেতৃত্ব করেন। তিনি দুবার বাংলাদেশে থেমেছিলেন, চীনা জাহাজে থাকত চীনাংশুক, তাফতা কাপড়, সাটিন, লবঙ্গ, নীল ও শাদা চীনামাটির বাসন, সোনা ও রূপো। এর সবকিছুতেই ভারতীয় বণিকদের আগ্রহ ছিল।
বাণিজ্যের প্রসারের ফলে মুদ্রার ব্যবহার বেড়ে গেল। উত্তর-ভারতের সমস্ত শহরেই মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন হলো। আগেকার চৌহান ও গাহড়বাল রাজাদের মুদ্রার অনুকরণে দিল্লির মুদ্রাগুলো তৈরি করা হলো। পরিচিত মুদ্রার সঙ্গে সাদৃশ্যের জন্যে লোকেরা সহজেই মুদ্রাগুলো মেনে নিতে পেরেছিল। এমনকি মুদ্রার ওপর শৈবধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত ষাঁড়ের ছবি খোদিত হলো। সুলতানের নামও লেখা হলো দেবনাগরী লিপিতে। মুদ্রার মধ্যে ‘জিতল’ ও ‘টঙ্কা’র কথা বেশি শোনা যায়। প্রথমটি ছিল তাম্রমুদ্রা ও দ্বিতীয়টি রৌপ্যমুদ্র (১৭২.৮ গ্ৰেণ)। রূপোর টাকা প্রচলন করেন ইলতুতমিস। সুলতানী আমলে ‘টঙ্কা’ই হলো প্রধান মুদ্রামান এবং আধুনিক ভারতীয় টাকার উৎপত্তি এর থেকেই হয়েছে।
স্বর্ণমুদ্রা বা মোহর প্রধানত ব্যবসার কাজে বা বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহার হতো। সুলতানদের অনেকগুলো টাঁকশাল ছিল। প্রাদেশিক রাজ্যগুলোর নিজস্ব মুদ্রা ছিল এবং সেগুলোর সুলতানীর মুদ্রার চেয়ে ভিন্ন ওজন ছিল, নামও থাকত অন্য। দিল্লি অঞ্চলের প্রচলিত ওজনের মাপ (যেমন মণ, সের, ছাটক) উত্তর- ভারতের সর্বত্রই প্রচলিত ছিল এবং সম্প্রতি ভারতে দশমিক পদ্ধতি চালু হবার আগে পর্যন্ত ওই মাপই চলছিল। অভিজাতদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্যে মুদ্রার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ছিল। তার ওপর ছিল নগরগুলোর ব্যবসাসংক্রান্ত কর্মব্যস্ততা। তুর্কী ও আফগানরা ভারতে যে ধনসম্পদ পেয়েছিল, তা এখানেই ব্যয় করতে চাইত। রাজ-দরবার ও উচ্চশ্রেণির লোকেরা সচেতনভাবেই প্রচুর অর্থব্যয় করত।
ভারতীয় মুসলমান সমাজ তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত ছিল— ধর্মীয় ও তার বাইরের অভিজাতশ্রেণি, কারিগর ও কৃষক। অভিজাতদের মধ্যে ছিল অনেক গোষ্ঠীর লোক— তুর্কী, আফগান, ফারসি ও আরবি। এদের মধ্যে তুর্কী ও আফগানরাই ছিল প্রধান, কারণ এরা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল। প্রথমদিকে অভিজাতদের মধ্যে গোষ্ঠী অনুযায়ী একটা পার্থক্য বজায় ছিল। কিন্তু, পরে এরা যখন ভারতবর্ষকেই স্থায়ী বাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হলো, তখন পরস্পরের সঙ্গে অবাধে মেলামেশার মধ্য দিয়ে ক্রমশ নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠল। দেশে সংখ্যালঘু হবার ফলে এদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় দেরি হয়নি।
যেকোনো লোকই অভিজাতশ্রেণিতে আসতে পারত। অভিজাতসমাজের অনেক মুসলমানই আদিতে সুলতানের বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিল। পদমর্যাদা বংশানুক্রমিক ছিল না। সুলতানের খেয়ালের ওপরই এগুলো নির্ভর করত। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন সরকারি পদগুলো বংশানুক্রমিক হয়ে উঠল, কর্মচারীরা নিজেদের অভিজাত বংশীয় বলে দাবি করতে লাগল। এইভাবে ধর্মান্তরিত মুসলমানরাও নিজেদের বিদেশি বংশজাত বলে দাবি করল। এর কারণ হলো, তুর্কী ও আফগানরাই ছিল প্রতিপত্তিশালী। অতএব, জাতিগত মর্যাদার একটা আলাদা প্রশ্ন ছিল। কিন্তু পরে ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে বিদেশিদের নিয়মিত বিয়ে হওয়া শুরু হলে জাতিগত মর্যাদার প্রশ্নটি গুরুত্ব হারায়।
অভিজাতশ্রেণির আয়ের উৎস ছিল ইক্তার রাজস্ব। এছাড়া অনেকে ছিল উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। সুলতানের জন্যে কিছু সংখ্যক সৈনিকের খরচ নির্বাহ করেও যতটা রাজস্ব পড়ে থাকত, তার সাহায্যে রীতিমতো বিলাসেই অভিজাতশ্রেণির দিন কাটত। সুলতান হয়তো সন্দেহ করতেন যে, আমীর- ওমরাহরা রাজস্ব থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে। কিন্তু জানলেও তাঁর কিছু করার উপায় ছিল না। রাজ-পরিদর্শকদের ওপর নির্ভর করা যেত না, কেননা তারা সহজেই উৎকোচের বশীভূত হতো। আলাউদ্দীন ওমরাহদের অতিরিক্ত অর্থোপার্জন কমানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আবার আগের অবস্থা ফিরে এলো। সুলতান ও ওমরাহদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ভর করত তাদের নিজস্ব শক্তি সামর্থ্যের ওপর। রাজপুত গোষ্ঠীপতি ও অন্যান্য স্থানীয় শাসকদের ক্ষেত্রেও ক্ষমতার পরিমাণ এইভাবেই নিরূপিত হতো। যখন দেখা যেত এদের আর অবজ্ঞা করা যাবে না, তখন ধীরে ধীরে তাদের অভিজাত শ্রেণির অন্তর্গত করে নেওয়া হতো।
কাজের দিক থেকে অভিজাত সম্প্রদায় দুইভাগে বিভক্ত ছিল; এদের বলা হতো অহল্-ই-সৈফ ও অহল্-ই-কলম। যাঁরা সেনানায়ক বা যাঁদের ক্ষমতা সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করত, তাঁরা ছিলেন প্রথম দলে। দ্বিতীয় দলে ছিলেন ধর্মনেতা ও শাসকেরা। দুই দলের মধ্যে যোদ্ধা ও সেনাপতিরাই বেশি শক্তিমান ছিল। দ্বিতীয় দলের মধ্যে অনেকে ছিল উলেমা। এরা কেউ কেউ ছিল বিচারপতি ও কেউ কেউ ছিল সুলতানের পরামর্শদাতা। এরা ইসলামের গোঁড়া ‘সুন্নী’ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ এরা উদারপন্থী ‘শিয়া’দের বিরোধী ছিল।
তত্ত্বগতভাবে দেখলে, ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে একদল ছিলেন যাঁরা অতীন্দ্রিয়বাদী বা সন্ত। এঁরা পার্থিব ব্যাপারের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করা সত্ত্বেও রাজনীতিতে প্রভাবশালী হতে পারতেন। যেমন, দিল্লির নিকটস্থ অঞ্চলের অধিবাসী নিজামুদ্দীন আউলিয়া ছিলেন প্রভাবশালী পুরুষ। সুলতান এঁর কথা অমান্য করতে পারতেন না। সুলতানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অস্বীকার করে তিনি সুলতান সম্পর্কে তাঁর তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছিলেন; তবুও সুলতান তাঁকে মেনে চলতেন। আরেকজন সন্ন্যাসী সিদি মৌলা দিল্লির কাছে একটি ধর্মশালা চালাতেন এবং এটি পরে খলজিদের বিরুদ্ধে তুর্কীদের ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। সন্দেহ করা হয়, ইনি প্রকৃতপক্ষে ভণ্ড সন্ন্যাসী এবং সাধারণ মানুষের ভক্তিকে নিজের কাজে লাগিয়েছিলেন। তবে ভণ্ড হলেও ইনি যে সাধুর ছদ্মবেশে রাজনীতির খেলা খেলেছিলেন, এই ঘটনা থেকেই আমরা সমসাময়িক আবহাওয়া খানিকটা বুঝতে পারি।
ভারতবর্ষে প্রাক্-ইসলাম যুগে গুরু ও সন্ন্যাসীদের ঐতিহ্যের ফলে তাঁদের তুলনীয় মুসলিম পীর ও শেখদের সমাদৃত হবার রাস্তা তৈরিই হয়েছিল। এঁরা অপেক্ষাকৃত নির্জনে বাস করতেন। সকলের ধারণা ছিল, এঁরা প্রভূত আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী। তাই, প্রয়োজন হলে এঁরা সাধারণ মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে রাষ্ট্রও অবহিত ছিল। সুলতান যে এইসব সন্ন্যাসীদের শ্রদ্ধা দেখাতেন, তার মধ্যে সুলতানের একটা অনুচ্চারিত অনুরোধ থাকত যে, সন্ন্যাসী যেন তাঁর ভক্তদের সুলতানের আনুগত্য দেখানোতে উৎসাহ দেন। কোনো কোনো সন্ন্যাসী নিয়মিত বৃত্তি পেতেন এবং এই অর্থের সাহায্যে তাঁদের ও তাঁদের উত্তরসূরীদের জীবন নিশ্চিন্তভাবেই কেটে যেত।
শহরের মুসলমান সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ছিল কারিগর। এছাড়া ব্যবসায়ীরা আসা-যাওয়া করত। ব্যবসায়ীরা ছিল আরব ও পারস্যদেশীয়। তাছাড়াও ছিল সুলতানের ক্রীতদাসের দল। তারা রাজদরবারে বা রাষ্ট্রীয় কারখানায় কাজ করত। এদের সংখ্যা কম ছিল না। এই যুগের শেষদিকে মুসলমান কৃষকদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের জীবনযাত্রার ধারা মূলত অবশ্য একই রকম ছিল।
ভারতীয় ও ইসলাম সংস্কৃতির মিলনের সবচেয়ে সুষ্ঠু প্রকাশ দেখা যায় শহরের কারিগর ও গ্রামের কৃষকদের মধ্যে। এই যুগের ধর্মীয় ও সামাজিক চিন্তায় এই মিলনের প্রমাণ আছে। এযুগের স্থাপত্যের মধ্যেও পারস্পরিক প্রভাবের পরিচয় আছে। অভিজাতশ্রেণির তুলনায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে দুই ধর্মের পারস্পরিক প্রভাব অনেক বেশি পড়েছিল। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান যেমন, জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুর আচারে দুই ধর্মের সামাজিক প্রথার মিলন লক্ষ্য করা যায়। কোনো হিন্দু ধর্মান্তর গ্রহণ করার পরও তার হিন্দু পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারী হিসেবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারত। পবিত্র ইসলামী অনুষ্ঠানের কোনো কোনোটি হিন্দু অনুষ্ঠানের ওপর তাদের ছাপ ফেলল।
ইসলামে বর্ণপ্রথায় কোনো স্থান না থাকলেও মুসলিম সমাজজীবনে বর্ণপ্রথাকে একেবারে বাদও দেওয়া হয়নি। মুসলিম বর্ণপ্রথার ভিত্তি হলো জাতিগত পার্থক্য। বিদেশি বংশোদ্ভূত যেমন, তুর্কী, আফগান বা পারস্যদেশীয় পরিবারগুলো সমাজে উচ্চতম বর্ণ হিসেবে স্বীকৃত হলো। এদের বলা হতো ‘আশরফ’ (আরবি ভাষায় এই শব্দের অর্থ হলো ‘সম্মানীয়’), এর পরের বর্ণ হলো ধর্মান্তরিত উচ্চবর্ণের হিন্দু। যেমন মুসলিম রাজপুত। বৃত্তিজাত বর্ণগুলোকে নিয়ে আরো দুটি শ্রেণিভেদ আছে। তাদের মধ্যে একটি হলো ‘পরিচ্ছন্ন’ বর্ণ এবং অন্যটি হলো ‘অপরিচ্ছন্ন’ বর্ণ। প্রথমটির মধ্যে আছে কারিগর ও অন্যান্য পেশার লোক। আর, অন্য বর্ণভুক্ত মানুষ হলো ঝাড়ুদার ও মেথরশ্রেণির লোক,–যারা নোংরা কাজ করে।* হিন্দু উপবর্ণগুলোর মতো মুসলমান সমাজেও কোনো উপবর্ণভুক্ত লোক বর্ণপ্রথার ওপরদিকে উঠতে পারত, যদি ওই উপবর্ণের (জাতের) সমস্ত লোক একসঙ্গে এই উন্নতির সুযোগ পেত। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে একত্র আহারের বাধানিষেদ হিন্দুদের তুলনায় কম হলেও সমষ্টিভোজনের প্রথা কেবল ‘পরিচ্ছন্ন’ বর্ণগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিবাহের ব্যাপারে কিন্তু বর্ণপ্রথার বাইরে কেউ যেত না। প্রতিটি পেশার সঙ্গেই একটি করে উপবর্ণ স্থির করে দেওয়া হতো এবং কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে তার বাইরে বেরিয়ে আসা কঠিন ছিল। এটিই ছিল সামাজিক সম্পর্কের মূলভিত্তি। তবে মুসলমান, জৈন, সিরীয়, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর চেয়ে হিন্দুরাই বেশি বর্ণসচেতন ছিল।
[* অল্প কয়েক বছর আগে পর্যন্ত উত্তর-প্রদেশের মুসলমান সমাজের বর্ণবিভেদের কাঠামো একই রকম ছিল। এই কাঠামোর গোড়াপত্তন হয়েছিল সুলতানী আমলে।]
অভিজাতদের অধিকাংশই ছিল বিদেশি বংশোদ্ভুত। তাদের পক্ষে এদেশের জনমণ্ডলির মধ্যে মিশে যাওয়া ছিল অনেকটা কৃত্রিম। তুর্কী ও আফগানরা একদিকে নিজেদের স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখার চেষ্টাও করত। কিন্তু অন্যদিকে আবার, খাদ্য ও পোষাকের ব্যাপারে ভারতীয় রীতি গ্রহণ করার ফলে এরা নিজেদের স্বাতন্ত্রতা কিছুটা হারিয়ে ফেলছিল। স্থানীয় পরিবারে বিয়ে করাটা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠায় সামাজিক মিশ্রণ ঘটছিল আরো দ্রুতগতিতে। আচার- ব্যবহারে এরকম কিছু পরিবর্তন মুসলমানরা স্বীকার করল, যা গোঁড়া ইসলাম ধর্মের সঙ্গে খাপ খায় না। উত্তর-ভারতীয় সংগীতের অনেকগুলো যা বিশিষ্টরূপ, তার মধ্যে এই যুগের মুসলমান অভিজাতশ্রেণির যথেষ্ট দান আছে। পোলো, অবসর বিনোদনের জন্যে মুসলমানদের প্রিয় খেলা ছিল। ঘোড়দৌড়, জুয়া, শিকার ইত্যাদি যা অনেক সময়ই ছিল ইসলাম-বিরোধী। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে উলেমারা ইসলামী আইনের চতুর ব্যাখ্যার সাহায্যে খানিকটা আপোস করতে রাজী ছিল।
হিন্দু ও মুসলমান, উভয় শ্রেণির মধ্যেই পুত্র সন্তানের জন্ম ছিল শ্রেয়। এর থেকে প্রমাণ হয়, সমাজে মেয়েদের স্থান নিচু ছিল। উচ্চবর্ণের নারী মীরাবাঈ বা রাজিয়া তাঁদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু প্ৰথমজন হয়েছিলেন সন্ন্যাসিনী, আর দ্বিতীয়জন পুরুষ শাসকদের অনুকরণ করেছিলেন। হিন্দু রাজকুমারী দেবলরাণী ও মুসলমান সুলতানী রাজকুমার খিজির খানের প্রেম এবং রূপমতী ও বজ বাহাদুরের প্রণয় নিয়ে রোমান্টিক কাহিনী রচিত হয়েছিল সাহিত্যে নারীপ্রশস্তি ও স্ত্রীপুরুষের প্রণয় নিয়ে অনেক রোমান্টিক রচনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবজীবনে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, মেয়েদের একেবারে পর্দার আড়ালেই বাস করতে হতো এবং বাড়ীর একটা পৃথক অংশ তাদের জন্যে নির্ধারিত থাকত। বাইরে যেতে হলে মেয়েদের আবৃত হয়ে বেরোতে হতো।
হিন্দু ও মুসলমান অভিজাতশ্রেণিরা বাড়ির মেয়েদের জীবনের অপ্রিয় ও আদিম ব্যাপারগুলো থেকে বাঁচিয়ে আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন। তা থেকেই হয়তো পর্দাপ্রথার শুরু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েরা বাইরের জগত থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। তাদের তাৎপর্যহীন জীবনকে চিত্তাকর্ষক করবার জন্যে মেয়েরা প্রণয়মূলক জটিলতা এবং কখনো বা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকত। অর্থনৈতিক কারণে কৃষক ও কারিগরদের পরিবারে মেয়েদের অনেক বেশি স্বাধীনতা ছিল। বর্ণ মিলিয়ে, রাশিচক্র বিচার করে, সম্পত্তির হিসেব নিয়ে তবে উভয়পক্ষ বিয়ের আয়োজন করত; বিবাহকে প্রায় পুরোপুরি সামাজিক দায়িত্ব মনে করা হতো। পরিবারের মধ্যেই সম্পত্তি রেখে দেবার জন্যে মুসলমানরা জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ইত্যাদি অতি নিকট সম্পর্কের ভাই-বোনের বিয়েতে উৎসাহ দিত।
মুসলমান অভিজাতদের মধ্যে উলেমারা কিন্তু এদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে যে কোনো রকম মিশ্রণ পরিহার করে চলত। হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণরাও বর্ণ বা ধর্মের লোক সম্পর্কে একই মনোভাব পোষণ করত। হিন্দুধর্মের ওপর মুসলমান শাসনের যাই প্রভাব পড়ে থাকুক না কেন, ব্রাহ্মণদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের অবসান হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের ভূমিদান কমে গিয়েছিল, কেননা মুসলমান শাসকদের নিজেদের ধর্মপ্রবক্তাদের প্রয়োজনও মেটাতে হতো। আগে ব্রাহ্মণদের বিশেষ কোনো কর দিতে হতো না। কিন্তু মুসলমান শাসনে ওই বিশেষ সুবিধার অবসান হলো। রাজসভাতেও ব্রাহ্মণদের আগের মতো প্রতিপত্তি ছিল না। উলেমারা বুঝেছিলেন যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে হলে নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা প্রয়োজন। মন্দির ও মসজিদের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে কিন্তু কোনো পারস্পরিক প্রভাব পড়েনি। দুই ধর্মের পুরোহিতরাই সযত্নে এই পার্থক্যকে লালন করে এসেছেন।
এই বিচ্ছিন্নতার জন্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো শিক্ষাব্যবস্থা। মন্দির ও মসজিদ সংলগ্ন বিদ্যালয়ে প্রধানত ধর্মশিক্ষা দেওয়া হতো। উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলোতে ধর্মতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব ব্যতীত অন্য কোনো বিষয় শেখানো হতো না। অধিকাংশ মুসলিম স্কুল (বা মাদ্রাসা) রাষ্ট্র থেকে আর্থিক সাহায্য পেত। সুলতানরা শিক্ষার জন্যে সাহায্যের ব্যাপারে দরাজহস্ত ছিলেন। হিসেব করে দেখা গেছে, তুঘলকী যুগে কেবল দিল্লিতেই প্রায় ১,০০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে শিক্ষার এই বিপুল আয়োজন কেবল ধর্মশিক্ষাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তা সত্ত্বেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে অন্যান্য মানুষের মধ্যে ভারতীয় ও আরবিয় জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে পারস্পরিক আগ্রহের উদাহরণ আছে। কিছুটা সাংস্কৃতিক জ্ঞানবিনিময় অনিবার্য ছিল। চিকিৎসাবিদ্যার ব্যাপারে এই বিনিময় ফলপ্রসূ হয়েছিল। ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি পশ্চিম-এশিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং অন্যদিকে আরবদের ইউনানী চিকিৎসারীতি ভারতে প্রসার লাভ করল। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার মধ্যে কারিগরি শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। কারিগরি শিক্ষাদানের দায়িত্ব ছিল সরকারি কারখানার কারিগরদের। জ্ঞানের বিনিময় কেবল দুই ধর্মের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং তার দ্বারা শিক্ষাব্যবস্থার কোনো লাভ হয়নি। তৈমুরের দিল্লি আক্রমণের ফলে পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদরা দেশের নানা অঞ্চলে পালিয়ে যাওয়ায় বিদ্যাচর্চার খানিকটা ভৌগোলিক ব্যাপ্তি হয়। *
[* তুর্কীদের বদলে যদি এসময়ে ভারতে আরবরা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করত তাহলে জ্ঞান- বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভারতের কি বিকাশ হতে পারত তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করা যায়। হয়তো সেক্ষেত্রে উভয়জাতির জ্ঞানচর্চার ঘাত-প্রতিঘাতের ফল অনেক শুভ হতো এবং অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষার প্রতি সেযুগে আরবদের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মনোভাব ও বিশ্লেষণমূলক আগ্রহ ছিল, হয়তো তার সংস্পর্শে এসে ভারতীয় পণ্ডিতরা তাঁদের সাবেকী পুঁথিগত বিদ্যার সীমাবদ্ধ গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরে আসতে পারতেন।]
ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ এদেশের জীবনযাত্রার মধ্যে বিদেশি প্রভাব খানিকটা অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল, যদিও উচ্চশ্রেণির মধ্যে আগের মতোই স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার চেষ্টা তখনো বজায় ছিল। হিন্দুরা দৈনন্দিন জীবনযাপনে কোনো অসুবিধা ভোগ না করলেও প্রকৃতপক্ষে নাগরিক মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে তারা মুসলমানদের সমতুল্য ছিল না। ধর্মান্তরিত মুসলমানরা আগে নিম্নবর্ণের হিন্দু হলেও ধর্মান্তর গ্রহণের ফলে সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি হতো, এতে বর্ণ হিন্দুরা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ ছিল। যদি মুসলমানরা সম্পূর্ণভাবে বিদেশি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে আলাদা থাকত, তাহলে হয়তো উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ইসলামী আদর্শ স্বীকার করতে আপত্তি থাকত না।*
[* জেসুইটরা সাধারণ মানুষের বদলে এশিয়ায় নানা দেশের সম্রাট ও রাজাদেরই ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিল। সাধারণ মানুষকে ধর্মান্তরিত করতে গেলে উচ্চবর্ণের এশীয়রা তাতে অসন্তুষ্ট হতো। এশিয়ায় পরবর্তী খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের এই অসন্তোষের সম্মুখীন হতে হয়েছে।]
স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার চেষ্টায় ব্রাহ্মণরা প্রাচীন সাহিত্যের ওপর নির্ভর করেছিল। এর ফলে প্রাচীন শাস্ত্র ও গ্রন্থ সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হলো। নতুন করে ব্যাখ্যা ও সংক্ষিপ্তসার রচিত হলো। যখন নতুন শাসকরা হিন্দুধর্মের আইনগত ভিত্তি জানতে চাইতেন, ব্রাহ্মণরা প্রাচীন শাস্ত্রগুলো থেকে উদ্ধৃতি দিত। ও শাস্ত্রগ্রন্থে সমাজের মধ্যে কোনো বিভেদ ও সংঘর্ষের উল্লেখ ছিল না। বর্ণাশ্রমের কাঠামোর বাইরেও যে কোনো শক্তিশালী ধর্মীয় গোষ্ঠী থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রে কি করা উচিত, সে বিষয়ে শাস্ত্রে কোনো বিধান ছিল না।
শৈব ও বৈষ্ণব, গোঁড়া হিন্দুদের এই প্রধান দুই গোষ্ঠী। কিন্তু এই গোষ্ঠী দুটির মধ্যে ছোট ছোট গোষ্ঠী ছিল এবং তাদের বিশ্বাসের কিছু কিছু তারতম্য ছিল ও উত্তর-ভারতে বৈষ্ণবরাই প্রধান গোষ্ঠী ছিল, যদিও বৈষ্ণদের দুই প্রধান প্রচারক, রামানন্দ ও বল্লভ ছিলেন দক্ষিণ-ভারতের লোক। উত্তর-ভারতের বৈষ্ণব-ধর্মসংস্কারকদের ওপর তাঁদের যথেষ্ঠ প্রভাব পড়েছিল। কোনো কোনো ধর্মপ্রচারক ভক্তি মতবাদের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। কিন্তু যেসব প্রচারকের চিন্তা ও শিক্ষা ইসলামিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তাঁদের আলাদা করে ধরা যায়। হিন্দুদের গোষ্ঠীর মধ্যে নানা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মূল ধর্মীয় বক্তব্য একই ছিল। বৈষ্ণবরা হিন্দুধর্মের মধ্যে ব্যক্তিগত উপাসনারীতি প্রচলন করার চেষ্টা করেছিল। রামানন্দ লিখেছেন—
“আমার পূর্বে অভ্যাস ছিল চন্দন ও অন্যান্য সুগন্ধিদ্রব্য নিয়ে ব্রহ্মকে (ঈশ্বরকে) নিবেদন করা। কিন্তু গুরু শেখালেন যে, আমার নিজের হৃদয়ে ব্রহ্ম বিরাজমান। যেখানেই আমি যাই সেইখানেই জল ও পাথরের পূজা হতে দেখি। কিন্তু প্রভু, তুমিই তো তোমার অস্তিত্ব দিয়ে তাদের পূর্ণ করে রেখেছ। সকলে বৃথাই বেদের মধ্যে তোমাকে খুঁজে বেড়ায়। হে আমার গুরু, তুমি আমার সমস্ত ব্যর্থতা ও মোহের অবসান ঘটিয়েছ। রামানন্দ তার প্রভু ব্রহ্মের মধ্যে আত্মহারা। গুরুর কথায় কর্মের অসংখ্য বন্ধন ছিন্ন হয়।”[১]
বাংলাদেশের এক শিক্ষক চৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে) এক ভাবসমাধির পর কৃষ্ণভক্ত হয়ে ওঠেন। তিনি এরপর ভক্তির আসরের আয়োজন করে সেখানে গান গেয়ে বৈষ্ণব ধারণার ব্যাখ্যা করেন। সারাদেশে ঘুরে বেড়িয়ে চৈতন্য রাধাকৃষ্ণের লীলার মধ্য দিয়ে দিয়ে বহুলোকের কাছে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করলেন। চৈতন্য শুধু ভক্তিভাবে আপ্লুত হয়ে ধর্মপ্রচার করেছিলেন, বিশুদ্ধ ধর্মানুভূতিই ছিল তাঁর প্রেরণা।
অন্য একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী আত্মক্লেশের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরলাভের চেষ্টা করছিল। এদের কাছে অন্যসব লক্ষ্য এই এক উদ্দেশ্যের অধীন ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর রাজপুত রাণী মীরাবাঈ কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সারাদেশে স্বরচিত গান গেয়ে বেড়াতেন। আরো ছিলেন আগ্রা শহরের অন্ধকবি সুরদাস। এছাড়া ছিলেন কাশ্মীরের লাল্লা। ইনি শিবকে উদ্দেশ্য করে অতীন্দ্রিয়ধর্মী গান রচনা করেছিলেন।
ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তারা, যাঁরা ধর্মীয় চিন্তার চেয়ে সামাজিক ধারণার ওপরই বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন, তাঁরা সকলেই ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশেষত, সূফীদের শিক্ষার প্রভাব তাঁদের ওপর বিশেষভাবে পড়েছিল।
প্রধানত অমুসলমান দেশে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টা করলেও সে চেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সুলতানরা যখন রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ় করতে ব্যস্ত, তখন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল। এর একটি সুলতানীর অস্তিত্বই বিপন্ন করেছিল। এ ঘটনা ঘটেছিল সুলতানা রিজিয়ার শাসনকালে। মুসলমানদের প্রধান দুটি গোষ্ঠী— শিয়া ও সুন্নী।* সুলতানরা সুন্নী গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ায় তাঁরা সুন্নী ধর্মপ্রচারকদেরই সমর্থন করতেন এবং শিয়াদের অপছন্দ করতেন। কিন্তু শিয়া মুসলিমরা আরবদের সিন্ধুজয়ের সময় ভারতে এসেছিল এবং সিন্ধু ও মূলতান অঞ্চলে ক্ষমতাশালী ছিল। গজনীর মামুদ মূলতানে শিয়া মুসলিমদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেও বিফল হন। ওদিকে তুর্কীদের ক্ষমতালাভের ফলে ভারতে শিয়া মুসলিমদের ক্ষমতাবৃদ্ধির সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেল। শিয়ারা অন্য কোনো কোনো গোষ্ঠীর সহায়তায় সুলতানা রাজিয়ার আমলে সুলতানীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ব্যর্থ হয়। এরপর সুলতানী আমলে শিয়ারা আর সুন্নী প্রাধান্যের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
[* ইসলামের এই বিভেদ শুরু হয়েছিল একেবারে প্রথম যুগেই। খলিফার পদের উত্তরাধিকার নিয়েই এই বিরোধ। শিয়ারা এই পদ আলিকে দিয়ে এটি বংশানুক্রমিক করতে চেয়েছিল। সুন্নীরা নির্বাচনের পক্ষপাতী ছিল। এভাবেই নানা বিরোধের শুরু। শিয়াদের মধ্য থেকেই সুফী ইত্যাদি গোষ্ঠীর উদ্ভব। সুন্নীরা আরো গোঁড়া বলে মনে করা হলো।]
কিন্তু এছাড়া সুন্নীদের আরো একদল মুসলমান এর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হলো। এদের প্রভাব পরোক্ষ হলেও এদের ক্ষমতা ছিল যথেষ্ট। এরা হলো সূফী। তুর্কীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর সূফীরা ভারতে এসেছিল। এরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করত। ভারতীয় পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিচ্ছিন্নতার একটা ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা ছিল। দশম শতাব্দীতে পারস্যে সূফীরা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের মতে ভগবানকে ভালোবেসেই তাঁর কাছে পৌঁছনো যায়।
গোঁড়া মুসলিমরা এই মতবাদকে আক্রমণ করল ও সূফীদের আখ্যা দেওয়া হলো ধর্মবিরোধী বলে। এই কারণেই সূফীরা সমাজ থেকে দূরে বাস করত। এদের ভাষা ক্রমশ প্রতীকধর্মী ও রহস্যময় হয়ে উঠল। কখনো কখনো এরা হিন্দুগুরুর মতো কোনো পীর বা শেখের নেতৃত্বে গোষ্ঠী গঠন করত। গোষ্ঠীর সদস্যদের বলা হতো ফকির বা দরবেশ। কোনো কোনো গোষ্ঠী বিশেষ ধরনের আচার-অনুষ্ঠান করত। যেমন, নাচের মধ্য দিয়ে সম্মোহিত অবস্থায় পৌঁছনো। ভারতবর্ষে এর আগে তপশ্চর্যা, উপনিষদ ও ভক্তিবাদের যুগ গেছে। অতএব, সূফীদের মতবাদ প্রচারেও অসুবিধা হলো না। ভারতীয় সূফীদের প্রধান তিনটি ভাগ ছিল— চিশতী, সোরাবর্দী ও ফিরদৌসী। চিন্তী গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন ঐতিহাসিক বরণি ও কবি আমীর খসরু। এই গোষ্ঠী দিল্লি ও দোয়াব অঞ্চলে বেশি জনপ্রিয় ছিল। সোরাবর্দী গোষ্ঠীর প্রভাব ছিল সিন্ধু অঞ্চলে। ফিরদৌসী গোষ্ঠী জনপ্রিয় ছিল বিহারে।
ভারতীয় সূফীরা গোঁড়া ধর্মকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেনি। তাদের মতে, উলেমারা কোরানের অপব্যাখ্যাকারী। সূফীরা বলত, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগসাধন করে ও সুলতানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উলেমারা কোরানের আদি গণতান্ত্রিক নীতিকে বিকৃত করেছে। উলেমারা সূফীদের উদার চিন্তার নিন্দা করত এবং সূফীরা উলেমাদের বিরুদ্ধে পার্থিব ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ করত। যেসব সূফীসমাজকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করেনি, তাদের মধ্যে অসন্তোষের বীজ লুকিয়ে আছে বলে প্রায়ই সন্দেহ করা হতো। কিন্তু সূফীরা কখনোই বিদ্রোহের কথা ভাবত না। কারণ, যা নিয়ে তাদের আপত্তি, তা থেকে তাত্ত্বিকভাবে এবং কার্যতও দূরে সরে থাকাই সূফীদের রীতি ছিল। এই সময়ে সূফীরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, পৃথিবীতে একযুগ আসন্ন যখন এক ইসলামী ‘মাহদ’ (উদ্ধারকর্তা) এসে ইসলামের আদিম বাণী আবার প্রচার করবেন। ভারতবর্ষে নির্জনবাসী ব্যক্তির অভাব ছিল না এবং সূফীদের বৈরাগী জীবনযাত্রাও এখানে কারো কাছে অদ্ভূত মনে হয়নি। এইভাবে হিন্দু গুরুদের মতো সূফী পীররাও হিন্দুদের কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মান পেতেন। হিন্দুদের কাছে গুরু ও পীর একই পর্যায়ভুক্ত ছিলেন। *
[* এখনো পর্যন্ত হিন্দুধর্মের পবিত্রস্থান কুরুক্ষেত্রে এক অখ্যাত পীরের সমাধিক্ষেত্রে প্রতি বছর মেলা বসে। হাজার হাজার হিন্দু গ্রামবাসী সমাধিটি পূজো করে। ওই একই গ্রামবাসীরা আধমাইল দূরে একটি পুকুরের মধ্যে একটি ভাঙা মন্দির দেখিয়ে বলে কাহিনী আছে, এক মুসলিম শাসকের হাতে মন্দিরটি বিধ্বস্ত হয়েছিল।]
ইসলামে যে সামাজিক সাম্যের কথা বলা হয়েছে তা উলেমাদের চেয়ে সূফীরা অনেক বেশি মেনে চলত। এর ফলে সূফীদের সঙ্গে কৃষক ও কারিগর শ্রেণির লোকের সম্পর্ক নিকটতর হয়েছিল। সূফীদের সঙ্গে যেসব মানুষের ঘনিষ্ঠতা বেশি, তাদের মধ্যে ছিল প্রচলিত সামাজিক রীতিবিরোধী ব্যক্তিরা এবং যুক্তিবাদী মানুষেরা। সূফীদের অতীন্দ্রিয়বাদ কিন্তু সবসময় ধর্মীয় পলায়নী পদ্ধতি ছিল না। অনেকে সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত না, কারণ তারা নতুন পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনে বিশ্বাসী ছিল। এরা মনে করত, ধর্মের নিয়মকানুনে আটকে পড়ে যুক্তিবাদী চিন্তা ব্যাহত হয়েছে। একজন উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদ ছিলেন নিজামুদ্দীন আউলিয়া। সাধারণ মানুষ সূফীদের সঙ্গে যাদুবিদ্যার নিকট সম্পর্ক আছে বলে ভাবত। সিদি মৌলার কোনো আয়ের উৎস ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি দরিদ্র মানুষকে প্রচুর অর্থসাহায্য করতেন। এই দেখে মানুষের সন্দেহ হতো যে, তিনি সোনা তৈরি করতে পারেন। মনে হয়, অসন্তুষ্ট ওমরাহরা তাঁকে সাহায্য করত এবং তাঁর অতিথিশালা সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রকৃতপক্ষে সূফীদের আগেও ভারতবর্ষে এই ধরনের মানুষ ছিল এবং তাদের কার্যকলাপও একই রকম ছিল।
দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, প্রথমদিকে সূফীরাই রাজনীতি ও ধর্মনীতির ব্যাপারে নতুন চিন্তার জন্ম দিলেও এরা ক্রমশ সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল। সমাজের মধ্যে থেকে গেলে সূফীদের প্রভাব হতো অনেক বেশি এবং ধর্মীয় ব্যাপারে ছাড়া অন্য ক্ষেত্রেও তারা মানুষকে সংগঠিত করতে পারত। সেক্ষেত্রে ভক্তি আন্দোলনের নতুন সামাজিক এবং ধর্মীয় চিন্তাও জোরদার হয়ে উঠত যদিও সূফী মতবাদ আগেকার ভক্তি মতবাদেরই আরেক রূপ ছিল, ভক্তি মতবাদকে সূফীরা নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিছু কিছু প্রকৃত ইসলামী ধারণাও এর মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, বিশেষত সামাজিক সুবিচার সম্পর্কিত তত্ত্বের ক্ষেত্রে।
সূফী ও ভক্তিবাদের মধ্যে অনেকাংশে মিল ছিল। দুই মতবাদেই বিশ্বাস করা হতো যে, ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের মিলন প্রয়োজন। এছাড়া, দুপক্ষই ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের প্রেমময় সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিত। দুই মতবাদই গুরু বা পীরের ওপর জোর দিত। কিন্তু সূফীদের অতীন্দ্রিয়বাদের সঙ্গে ভক্তি মতবাদের বিরোধ ছিল।* কারণ, ভক্তিমতবাদ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পক্ষপাতী ছিল না। বরং সাধারণ মানুষের কাছে সহজ ভাষায় নতুন চিন্তার কথা বুঝিয়ে বলাই ভক্তি প্রচারকদের উদ্দেশ্য ছিল।
[* ভক্তিমতবাদ প্রচারকদের বলা হতো ‘সন্ত’ অর্থাৎ পুণ্যবান ব্যক্তি। কিন্তু ইংরেজিতে তাঁদের আজকাল সুবিধার জন্যে ‘সেন্ট’ বলে উল্লেখ করা হয়।]
ভক্তিমতবাদ প্রচারক ‘সন্ত’রা ভক্তিমার্গী উপাসকদের মতোই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি থেকে এসেছিলেন। কেউ কেউ ছিলেন কারিগর এবং অনেকে ছিলেন দরিদ্র কৃষক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা ভক্তি আন্দোলনে যোগ দিলেও অধিকাংশ ভক্তিমতবাদের অনুগামী ছিল নিম্নবর্ণের মানুষ। ভক্তি মতবাদে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, উপাসনার বস্তু ও বর্ণপ্রথাকে আক্রমণ করা হলো। মেয়েদের ধর্মসভায় আসতে উৎসাহ দেওয়া হলো এবং ধর্মশিক্ষা দেওয়া হতো সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় ভাষায়।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এযুগের ভক্তি আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি দান এসেছিল নানক ও কবীরের কাছ থেকে। এঁরা শহরের মানুষ ও গ্রামের যেসব কারিগরের শহরের সঙ্গে সংযোগ ছিল, তাদের কাছে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। কবীর ও নানকের ধারণা, ইসলামিক ও প্রচলিত চিন্তাধারা উভয়ের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিল। ইসলামী চিন্তার প্রভাবের জন্যে তাঁদের সঙ্গে অন্যান্য ভক্তি- প্রচারকদের চিন্তার কিছুটা প্রভেদ আছে। তবে তাঁদের শিক্ষা প্রধানত শহরভিত্তিক ছিল। অথচ আগের যুগে শহরে যেমন প্রচার না হবার ফলে ভক্তি আন্দোলন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। অতীন্দ্রিয়বাদী গোষ্ঠীগুলো অবশ্য সবসময় শহরভিত্তিক ছিল না।
বলা হয়, কবীর (১৪৪০-১৫১৮ খ্রিঃ) ছিলেন এক ব্রাহ্মণ বিধবার অবৈধ সন্তান। কবীরের পালকপিতা ছিলেন তন্তুবায় এবং কবীরও এই নিম্নবর্ণের পেশাতেই শিক্ষিত হয়েছিলেন। কবীর যখন কবিতায় তাঁর উপদেশগুলো সংকলন করেন, তার মধ্যে কাপড় বোনা সংক্রান্ত বহু উপমা এসে পড়েছিল। কবীর প্রথমে বৈষ্ণবপ্রচারক রামানন্দের ভক্ত ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি নিজস্ব ধারণা প্রচার করা শুরু করলেন। কবীর কেবল ধর্মীয় পরিবর্তন নিয়েই চিন্তা করেননি। সমাজ- ব্যবস্থারই পরিবর্তন চাইতেন। দুই লাইনের একেকটি শ্লোকের (দোহা) মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর চিন্তা লিপিবদ্ধ করতেন। ওই শ্লোকগুলো মনে রাখতেও সুবিধা হতো এবং শ্লোকের বক্তব্যও অত্যন্ত সহজবোধ্য ছিল। কবীরের মৃত্যুর পর তাঁর রচিত শ্লোকগুলো নিয়ে দুটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
নানক (১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিঃ) এসেছিলেন গ্রামাঞ্চল থেকে, তাঁর পিতা ছিলেন গ্রামের এক হিসাবরক্ষক। এক মুসলমান বন্ধুর উদারতায় তিনি লেখাপড়া শেখার সুযোগ পান এবং পরে এক আফগান শাসকের অধীনে গুদাম রক্ষকের চাকরি পান। নানক তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তান থাকা সত্ত্বেও সব ছেড়ে সূফীদের সঙ্গে যোগ দেন। কিন্তু কিছুকাল পরে সূফীদের সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে নানক দেশের নানা জায়গায় ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লেন। শোনা যায়, তিনি মক্কাতেও গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে পরিবারের সকলকে নিয়ে পাঞ্জাবে বসবাস শুরু করলেন। এখানেই নানক তাঁর বাণী প্রচার করেন ও পরে মারা যান। নানকের বাণী ‘আদিগ্রন্থ’ পুস্ত কে লিপিবদ্ধ করা আছে।
কবীর ও নানকের প্রভাবে ভক্তি আন্দোলন অন্যদিকে মোড় নিল। তাঁরা কিন্তু হিন্দুধর্মের উপাসনারীতিকে আক্রমণও করেননি, কিংবা ভক্তিভাবে নিমজ্জিত হয়ে কোনো পলায়নী উপদেশও দেননি। নানক ও কবীর ঈশ্বরকে যেভাবে দেখেছিলেন, তা থেকেই তাঁদের চিন্তার স্বতন্ত্রতা বোঝা যাবে। কবীর হিন্দু ও মুসলিমদের ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণাকে অস্বীকার করতেন, কিংবা দুই ধর্মের ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণাকেই সমগোত্রীয় বলে বর্ণনা করতেন। ওঁর ভাষায়—
“হে আমার ভৃত্য, তুমি আমাকে কোথায় খুঁজছ; দেখ আমি তোমার পাশেই আছি। আমি মন্দিরেও নেই, মসজিদেও নেই, আমি কাবা*তেও নেই, কৈলাসেও নেই; আমি আচারেও নেই, অনুষ্ঠানেও নেই, যোগেও নেই, ত্যাগেও নেই। তুমি যদি সত্যিই আমাকে খোঁজ, আমাকে তুমি এইক্ষণেই দেখতে পাবে; তুমি মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে দেখতে পাবে। কবীর বলেন : হে সাধু, ঈশ্বরই হলেন সকল প্রাণের প্রাণ।”
[‘কাবা’ হলো মক্কায়। এখানেই মুসলমানদের পবিত্র কালো পাথরটি রাখা আছে। আর, কৈলাস পর্বত হলো শিবের আবাস।]
আরেকটি শ্লোক হলো—
“ঈশ্বর যদি মসজিদেই আছেন, এই জগত তবে কার? তীর্থস্থানের পাথরের মূর্তির মধ্যেই যদি রাম থাকেন, বাইরের জগতের খবর তবে কে রাখবেন? হরি আছেন পূর্বে, আল্লা আছেন পশ্চিমে, তুমি তোমার হৃদয় খুঁজে দেখ— করিম* ও রাম উভয়েই আছেন হৃদয়ে; এ জগতের সমস্ত মানব-মানবীই তাঁর অংশ। কবীর আল্লা ও রামের সন্তান : তিনিই আমার গুরু, তিনিই আমার পীর।” [২]
[* ইসলামে আল্লার অন্য নাম ‘করিম’।]
নানক আরো এগিয়ে গেলেন এবং হিন্দু বা মুসলমান চিন্তাধারণার উল্লেখ না করেই বর্ণনা করলেন ঈশ্বরের—
“যিনি পরম সত্য তিনি ছিলেন সূচনায়, তিনি ছিলেন আদিমযুগে, সেই পরমসত্য এখনো আছেন। হে নানক, ওই পরমসত্য ভবিষ্যতেও থাকবেন। তাঁর আদেশেই মানবদেহের জন্ম। তাঁর আদেশ বর্ণনা করা যায় না।
তাঁর আদেশেই মানবদেহে আত্মার আগমন, তাঁর আদেশেই মহত্ত্ব অর্জিত হয়।
তাঁর ইচ্ছাতেই মানুষ উচ্চ বা নিচ; তাঁর ইচ্ছাতেই মানুষ পূর্বনির্ধারিত সুখ বা দুঃখ ভোগ করে। তাঁর ইচ্ছাতেই কেউ কেউ পুরস্কার পায়। আবার তাঁর ইচ্ছাতেই অন্যেরা জন্মান্তরের ফেরে ঘুরে বেড়ায়। প্রত্যেকেই তাঁর অধীন; কেউ এর বাইরে নয়।
হে নানক, যে ঈশ্বরের ইচ্ছা বুঝতে পারে, সে কখনো অহঙ্কার দোষে দুষ্ট নয়।” [৩]
দুই ধর্মের ভাবধারা স্বেচ্ছায় যুক্ত করে গ্রহণ করে হিন্দু ও মুসলিমের পার্থক্য দূর করার উদ্দেশ্য কবীর ও নানকের ছিল না। তেমন ধারণা পরে আকবরের দীন-ই-ইলাহীতে খানিকটা আসে। কবীর ও নানক এক নতুন ধর্মগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এবং এঁদের কাছে ঈশ্বর কেবল রাম বা আল্লার নতুন সংস্করণ ছিলেন না। ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই নতুন ধারণার নানা অংশ দুই ধর্মের মধ্যেই পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু এঁরা সচেতনভাবে দুই ধর্মীয় ধারণার মিলনের চেষ্টা করেননি। এই কারণেই উলেমা ও ব্রাহ্মণরা ভক্তি আন্দোলনের এই দুই নেতার ওপর বিশেষভাবে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের ভয় হয়েছিল, কবীর ও নানক বোধহয় নতুন কোনো ধর্মপ্রচারের চেষ্টা করছেন।
কবীর ও নানকের অনুগামীরা স্বতন্ত্র ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন— কবীরপন্থী ও শিখ সম্প্রদায়। কারিগর ও কৃষকশ্রেণির মধ্যে দুই প্রচারকই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। কারণ, নতুন মতবাদে সরল জীবনযাত্রা ও সহজ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। দুই প্রচারকের লেখাই সহজবোধ্য ও বাস্তব জীবনোচিত ছিল। কোনোরকম উগ্র বা চরম জীবনযাত্রার পরিবর্তে এঁরা সহজ-সরলভাবে দিন কাটাতে উপদেশ দিয়েছিলেন। যেমন, যে যোগী জীবন থেকে অত্যধিক দূরে সরে থাকতে চাইতেন, কবীর তাঁকে ব্যঙ্গ করেছেন।
এই দুই মতবাদের জনপ্রিয়তার পেছনে কেবল ধর্মীয় কারণই ছিল না। কবীর ও নানক ভারতীয় সমাজের সমস্যার কথা বুঝেছিলেন। বর্ণের পার্থক্য, সংগঠিত ধর্মের মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য মানুষকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখত। এঁরা জোর দিতে চেয়েছিলেন যার ওপর তা হলো, বিভিন্ন আদর্শের সহাবস্থানই যথেষ্ট নয়, সমাজকে সাম্যেরভিত্তিতে পুনর্গঠিত করতে হবে। সামাজিক সাম্যের আহ্বান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল এবং কবীর ও নানক দুজনেই বর্ণপ্রথাকে অস্বীকার করেছিলেন। বর্ণপ্রথা থেকে মুক্তি পাবার অন্যতম উপায় ছিল কোনো বর্ণহীন গোষ্ঠীতে যোগদান। এর আগেও কিছু কিছু ধর্মগোষ্ঠীতে নিম্নবর্ণের মানুষ যোগ দিয়ে নিজেদের বর্ণকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। বর্ণ সম্পর্কে কবীর ও নানক যা বললেন, তাতে কারিগরশ্রেণির মানুষ— যারা উচ্চশ্রেণির হিন্দু ও মুসলিমদের কাছে চিরকাল অবজ্ঞাভাজন ছিল, তারা নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিয়েছিল।
কবীরপন্থীরা এখন আর স্বতন্ত্র কোনো সম্প্রদায় নয়। কিন্তু শিখরা এখনো পৃথক ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে টিকে আছে। এই প্রভেদের মূলে রয়েছে দুই ধর্মগোষ্ঠীর শিক্ষার পার্থক্য। কবীর হিন্দু বা মুসলমান ঈশ্বর সম্পর্কে উদাসীন হলেও দুই ধর্মেরই ঈশ্বরের কথা শিক্ষার মধ্যে বারবার উল্লেখ করেছিলেন। তাই, দুই ধর্মেরই কম গোঁড়া মানুষরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। ক্রমশ কবীরপন্থীরা হিন্দুধর্মেরই একটি গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হলো। তবে, কবীর নামটি এখনো মুসলমানদের একটি প্রচলিত নাম। কিন্তু নানকের ধর্মসম্প্রদায়ে যোগ দিতে হলে হিন্দুধর্ম বা ইসলামের বাইরের বৈশিষ্ট্যগুলো আরো বেশি করে ত্যাগ করে আসতে হতো। এইজন্যে শিখদের মধ্যে গোষ্ঠী মনোভাব দৃঢ় ছিল। নানক বলতেন, নতুন ধর্মগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না থেকে সমাজের মধ্যেই সক্রিয় থাকতে হবে। নানকের মৃত্যুর পর শিখরা স্বতন্ত্র একটি ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হলো। পরের দিকে শিখরা নিজস্ব কিছু প্রতীক গ্রহণ করায় এই পার্থক্য আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। *
[* এর মধ্যে আছে পাঁচটি ‘ক’ বহন করা— কেশ (চুলকাটা চলবে না), কাঙ্গা (ছোট চিরুণী) কড়া (হাতে লোহার বালা), কৃপাণ (ছোট ছোরা), ও কচ্ছ (অন্তর্বাস)।]
সমস্ত ভারতের ভক্তি আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে একটা সাদৃশ্য ছিল; তাঁরা সকলেই কবিতা রচনা করেছেন আঞ্চলিক ভাষায়। সাধারণ মানুষের মাতৃভাষায় তাঁরা ধর্মের সরলবাণী প্রচার করেছেন। এতে শুধু যে ভক্তিসাহিত্য সম্পর্কে জনগণের উৎসাহ হলো তা নয়, শাস্ত্র ও পুরাণ, যা সংস্কৃতে লেখা বলে এতদিন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল, আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করার চেষ্টা শুরু হলো। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের কাহিনীগুলো। সহজ ভাষায় জটিল দার্শনিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে গীতা ইত্যাদি পবিত্রগ্রন্থের আঞ্চলিক ভাষায় টীকারচনা আরম্ভ হয়। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল স্বতস্ফূর্ত প্রাণের আবেগ, যা তৎকালীন সংস্কৃত সাহিত্যের জীবনবিচ্ছিন্ন কৃত্রিমতার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। যে বিষয়বস্তু নিয়ে এই নতুন সাহিত্য রচিত হয় তা বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেদের কাছে সমভাবে আকর্ষণীয় ছিল, ফলে একভাষার রচনা সহজেই আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে অন্য ভাষায় এবং ধীরে ধীরে সারা উত্তর-ভারতে ছড়িয়ে পড়ত।
পূর্বাঞ্চলের ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা শ্রীচৈতন্য কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। কবি চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক বহু বাংলাকাব্য রচনা করেছেন। জনপ্রিয় চারণকবিরা সমসাময়িক ঘটনা সম্পর্কে রচিত গাথা স্থানে স্থানে গেয়ে বেড়াত। দিল্লির সুলতানের তুলনায় বঙ্গদেশের তুর্কী শাসকদের তুরস্ক থেকে দূরত্ব বেশি ছিল— ফলে তারা অনেক তাড়াতাড়ি আঞ্চলিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে ফেলে। শাসকদের বাংলাসাহিত্য সম্পর্কে প্রকৃত আগ্রহ থাকার ফলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভাষা ও সাহিত্যের যথেষ্ট বিকাশ হয়।
শঙ্করদেব পঞ্চদশ শতাব্দীতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমীয়াভাষাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি তাঁর বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে নতুন পন্থা নিয়েছিলেন। তিনি পুরাণগুলো থেকে নানা কাহিনী নিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট একাঙ্ক নাটক রচনা করলেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে কিছু পুঁথিপত্র রয়েছে— যাদের রচনাকাল দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু। এগুলোতে যে ভাষা ব্যবহার হয়েছে, সেটিই পরে আধুনিক ওড়িয়াভাষার রূপ নেয়। চৈতন্য তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো পুরীতে কাটিয়েছিলেন এবং তাঁর ভক্তদের সংস্কৃতের পরিবর্তে ওড়িয়াভাষা ব্যবহার করতে উৎসাহ দিতেন। বিহার অঞ্চলের মৈথিলীভাষাও বৈষ্ণব ও ভক্তি আন্দোলনের সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল।
পশ্চিম-ভারতের জৈন প্রচারকরা গুজরাটীভাষা ব্যবহার করতেন। গুজরাটী ও রাজস্থানীভাষার একটা নিকট সম্পর্ক ছিল। মাড়োয়ারের ভাষা ভিংগল রাজস্থানের নানাস্থানে ব্যবহৃত হতো এবং এই ভাষা থেকেই আধুনিক গুজরাটীভাষার জন্ম। মীরাবাঈ রাজস্থানীভাষাতেই তাঁর গানগুলো রচনা করলেও হিন্দি-ভাষার অন্যান্য ভক্তিবাদী লেখকেরা তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন।
দিল্লি ও বর্তমান উত্তর-প্রদেশ অঞ্চলের কথ্যভাষা ছিল হিন্দি। তবে, পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের হিন্দির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ছিল। প্রথমে রাজপুত রাজাদের রাজসভায় কাব্যরচনার মধ্য দিয়ে হিন্দিভাষার উন্নতি হতে শুরু করে। যেমন, ‘পৃথ্বীরাজ রসো’, ‘বিশালদেব রসো’ ইত্যাদি। এই অঞ্চলে সূফীরা বক্তৃতা করার সময় ‘হিন্দি’ ভাষা ব্যবহার করত, এটিই ছিল হিন্দির প্রাচীন রূপ। এইভাবে হিন্দিভাষার জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল। পরে কবীর, নানক, সুরদাস ও মীরাবাঈ হিন্দিভাষা ব্যবহার করে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিলেন।
সুলতানী আমলের কবি আমীর খসরু সাধারণত ফারসি ভাষায় কাব্যরচনা করলেও সময়ে সময়ে হিন্দিভাষাও ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়া, উর্দুভাষার অন্যতম জনক ছিল হিন্দিভাষা। উর্দু প্রথমে ছিল সৈন্যশিবিরের ভাষা। কিন্তু ক্রমশ এটিই সুলতানী যুগের প্রধান ভাষা হয়ে উঠল। হিন্দি বাক্যগঠন পদ্ধতি এবং ফারসি ও আরবি ভাষার শব্দসম্ভারের মিলনে উর্দুভাষার জন্ম। স্বভাবতই … যারা উর্দু ব্যবহার করত, তারা হিন্দ ও জানত।
শাসকরা ফারসি ভাষাভাষী হওয়ায় ভারতে ফারসিভাষার ব্যবহার শুরু হলো সরকারি ভাষা হিসেবে। এছাড়া, সাহিত্যের ওপরও ফারসি ভাষার প্রভাব পড়েছিল। সরকারি ভাষা হিসেবে সংস্কৃত যখন ফারসিভাষার দ্বারা স্থানচ্যুত হলো তখন অনেক উত্তর-ভারতীয় রাজ্যে স্থানীয় ভাষার ব্যবহার বেড়ে গেল। কারণ ফারসি ছিল অপরিচিত ভাষা। আরবিভাষার ব্যবহার কিছুটা সীমিত ছিল। ভারতে প্রথমদিকের ফারসিসাহিত্য প্রধানত পারস্যদেশীয় সাহিত্যেরই অনুকরণ ছিল, তার গঠন ও চিত্রকল্প ছিল পারসিক ঘেঁষা। পরে ভারতীয় বিষয়বস্তু নিয়েও সাহিত্যরচনা হতে শুরু করল, এর পেছনে ছিল মূল বা অনুবাদের মাধ্যমে ভারতীয় সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড়তর পরিচিতি। এ ব্যাপারে আমীর খসরুর লেখা উল্লেখযোগ্য। তিনিই ভারতভিত্তিক ফারসি ও ইসলামী সাহিত্যের সূচনা করেন।
ভারতবর্ষে জন্ম হলেও আমীর খসরু ছিলেন তুর্কী বংশজাত। তিনি সূফী প্রচারক নিজামুদ্দীন আউলিয়ার কাছে বিদ্যাশিক্ষা করেন। নিজামুদ্দীন থাকতেন দিল্লির কাছে। খসরুও শেষ পর্যন্ত দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মতো প্রতিভাধর যুবকের কাছে দিল্লি তখন উত্তেজনায় ভরা শহর। প্রতিভাধর আমীর খসরু ক্রমশ রাজ-দরবারে নিজের স্থান করে নিলেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও ঘটনা নিয়ে কাব্যরচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করলেন। দরবারের বিলাসের প্রভাবে তাঁর সংবেদনশীলতা ব্যাহত হয়নি এবং নিজামুদ্দীনের শিক্ষা তিনি জীবনে কখনো বিস্মৃত হননি। তিনি গীতিকবিতা, মহাকাব্য, শোককাব্য ইত্যাদি সব ধরনের কাব্যই রচনা করেছিলেন। তাছাড়াও ছিল কিছু ঐতিহাসিক রচনা। তার সমস্ত লেখাই ফারসিভাষায় লিখেছিলেন। রচনারীতি ফারসি হলেও বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয়। চারিদিকে যা দেখতেন, আমীর খসরু তা নিয়েই লিখতেন। বিদেশি বিষয়বস্তু নিয়ে লিখলে লেখককে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হতো। কিন্তু আমীর খসরু ওই মর্যাদাকে গুরুত্ব দেননি। বরং তাঁর লেখা খোদ পারস্যদেশে উচ্চ প্রশংসিত হতে দেখে ভারতবর্ষে ফারসিভাষায় সাহিত্যচর্চার উৎসাহ এলো।
সবকাজেই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার শুরু হলেও সংস্কৃতভাষায় রচনা মোটেই স্তব্ধ হয়ে যায়নি। বহু রাজাই সংস্কৃতভাষার কবিদেরই বেশি মর্যাদা দিতেন। যে রাজারা তাঁদের পারিবারিক ইতিহাস রচনার ব্যাপারে সংস্কৃতভাষার প্রশস্তিধর্মী রচনা পছন্দ করতেন, তাঁদের পক্ষে সংস্কৃতভাষার কবিদের বেশি গুরুত্ব দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এইযুগে একের পর এক রাজবংশের উত্থান-পতন হয়েছে এবং একই রীতিতে রাজবংশগুলোর প্রশস্তিমূলক ইতিহাস রচিত হয়েছে। এক জৈনপণ্ডিত নয়নচন্দ্র সূরি শেষ চৌহান রাজা হামীরের জীবন নিয়ে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। সংস্কৃতভাষায় ঐতিহাসিক কবিতাগুলো কেবল হিন্দু রাজাদের প্রশস্তি রচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আঞ্চলিক ইতিহাস ও স্থানীয় ব্যক্তিত্বে স্থানীয় মানুষের গর্ব স্বাভাবিক ছিল। বিরাট ভূখণ্ডের ইতিহাস রচনার তুলনায় ছোট রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে কাব্যরচনা সহজও ছিল। গুজরাটের সুলতান মামুদ বেগারহরে দরবারে রাজকবি ছিলেন উদয়রাজ। তিনি সুলতানের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে ‘রাজবিনোদ’* কাব্য রচনা করেছিলেন। ঐতিহাসিক রচনা ছাড়া অর্ধ-ঐতিহাসিক রচনাও লেখা হতো। সেগুলোকে বলা হতো ‘প্ৰবন্ধ’। ওইযুগে প্রচুর ‘প্রবন্ধ’ রচিত হয়েছিল। এর সবগুলো অবশ্য ইতিহাস-নির্ভর নয়। কিন্তু কয়েকটি যেমন মেরুতুঙ্গর ‘প্রবন্ধচিন্তামণি’ ও রাজশেখরের ‘প্রবন্ধকোষ’ ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
[* বর্তমান যুগেও রাজাদের জীবনী লেখার রীতি প্রচলিত আছে। রাণী ভিক্টোরিয়ার জীবৎকালেও তাঁর জীবনী ‘ভিক্টোরিয়া চরিত’ সংস্কৃতে লেখা হয়েছিল।]
উত্তর-বিহারের মিথিলায় সংস্কৃত শিক্ষার একটি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। তুর্কী আক্রমণের ঢেউ এখানে এসেছিল অনেক পরে। বেশ কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ এখানে সংস্কৃতভাষায় সাহিত্য রচনা অব্যাহত রেখেছিলেন। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণপণ্ডিত ও গুজরাটের জৈব পণ্ডিতরা সংস্কৃত রচনার ধারা বজায় রেখেছিলেন। তবে, সংস্কৃতভাষায় নতুন চিন্তাভাবনার চর্চা হয়েছিল কেবল দক্ষিণ-ভারতের কয়েকটি জায়গাতেই। ব্রাহ্মণরাই সংস্কৃতকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এবং তাদের ব্যয়নির্বাহের জন্যে অনেক সময় অর্থবান ব্যক্তিরা এগিয়ে আসতেন। তবে, এসব সত্ত্বেও যুগধর্মের প্রধান চিন্তাধারা সংস্কৃতকে বাদ দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল।
গুজরাটের জৈনরা তালপাতার ওপর লিখত এবং পাতার ধারে ধারে ছোট ছোট চিত্র আঁকা থাকত অলংকরণ হিসেবে। এই অঙ্কনরীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। মানুষের মূর্তিগুলোই ছবিতে প্রাধান্য পেত। মানুষের মুখ আঁকার সময় কেবল একপাশ থেকেই আঁকা হতো এবং ছবির বিভিন্ন মুখগুলোর মধ্যে একটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যেত। উজ্জ্বল রঙের পটভূমিতে কালো রঙ দিয়ে মুখের রেখা আঁকা হতো। দূরের চোখগুলো এগিয়ে থাকত— এটাই এই অঙ্কনশৈলীর আরেকটা বৈশিষ্ট্য, যার ফলে এতে লোকশিল্পের একটা ছাপ আছে।
জৈনদের ক্ষুদ্রাকৃতি চিত্রগুলোর মতো চিত্র এর আগেও দক্ষিণ-ভারতের মন্দিরের দেওয়ালে দেখা গেছে। আধুনিক যুগে এইসব দেওয়ালচিত্র যথেষ্ট অবশিষ্ট না থাকলেও চিত্রগুলোর ওপর মন্দির চিত্রগুলোর প্রভাব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে। বোধহয় দক্ষিণ-ভারতে জৈনধর্মের ক্রমবিলুপ্তির সময় কিছু জৈন সন্ন্যাসী পশ্চিম-ভারতে চলে আসেন। অঙ্কনশিল্পে তাঁদের স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল এবং মন্দিরগাত্রের পরিবর্তে তালপাতর পুঁথির ওপরই অলংকরণ শুরু হলো। বিহার ও বাংলাদেশে নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ পুঁথিগুলোতেও অনুরূপ অলংকরণ দেখা যায়। তবে, এগুলোর অঙ্কনশৈলী কিছুটা অন্য ধরনের; এদের সঙ্গে দক্ষিণ-ভারতের চেয়ে দাক্ষিণাত্যের দেওয়ালচিত্রের সাদৃশ্যই বেশি দেখা যায়। তুর্কী আকমণে নালন্দার গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এগুলোর সঙ্গেও পশ্চিম-ভারতের জৈন চিত্রগুলোর বিশেষ মিল নেই। পুঁথির ওপর অলংকরণ দেখে মনে হয়, যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জৈনধর্মের গোঁড়া নিয়মকানুন কিছুটা শিথিল হয়েছিল।
জৈন ধর্মশাস্ত্রখানি সংরক্ষণের জন্যে প্রাচীন গ্রন্থ থেকে প্রভূত সংখ্যায় অনুলিপি ও পুরনো গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে একেবারে নতুন গ্রন্থ রচনাও হয়েছিল। সরু ও লম্বা তালপাতার উপর আলংকারিক চিত্র আঁকবার জন্যে সামান্যই জায়গা পাওয়া যেত। লেখা অক্ষরগুলোর আকৃতি ছিল বেঁটে ও মোটা। কিন্তু পঞ্চাশ শতাব্দীতে অঙ্কনরীতিতে পরিবর্তন দেখা দিল। আরব ব্যবসায়ীরা পশ্চিম-ভারতে কাগজের ব্যবহার প্রচলন করায় জৈব পুঁথিগুলো তখন থেকে কাগজেই লেখা শুরু হলো। সরু ও লম্বা তালপাতার বদলে কাগজের আকৃতি হলো চওড়া আয়তক্ষেত্রাকার। আঁকার জায়গা পাওয়া গেল অনেক বেশি। অক্ষরগুলোও আর আগের মতো বেঁটে ও মোটা হওয়ার প্রয়োজন হতো না। পুঁথিলেখকদের ওপর আর অলংকরণের দায়িত্ব রইল না। সে ভার পড়ল দক্ষ শিল্পীদের ওপর।
দ্বিতীয় পরিবর্তন ঘটল তুর্কীদের মাধ্যমে। উত্তর-ভারতে ফারসি সংস্কৃতি প্রবর্তনের পর পারস্য থেকে অলংকরণ করা অনেক গ্রন্থ ভারতে এলো। ফারসিক শিল্পীদের রঙের ব্যবহারের খ্যাতি ছিল। এতদিন জৈবশিল্পীরা পশ্চাদভূমির রঙের জন্যে কেবল ইটলাল ও নীল ব্যবহার করতেন। এবার রঙের বৈচিত্র্য বাড়ল। অজন্তার প্রাচীন দেওয়াল চিত্রেও রঙের চমৎকার ব্যবহার দেখা যায়। জৈন চিত্রাঙ্কনের নতুন রীতি ষোড়শ শতাব্দীর রাজস্থানী চিত্রাঙ্কন রীতিকেও প্রভাবিত করেছিল।
তুর্কীদের প্রভাবে ভারতীয় স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা দিল। এর নিদর্শন হলো মসজিদ ও সমাধিসৌধ। মসজিদে অনেক মুসলিমের একত্র প্রার্থনার জন্যে একটি বড় ঘেরা জায়গার প্রয়োজন হতো। চৌকো কিংবা আয়তক্ষেত্রাকার করে এই উপাসনাস্থানটি নির্মিত হতো। ওপরে কোনো ছাদ থাকত না। তিনদিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত। কেবল পশ্চিম দিকের প্রাচীরে, যেদিকে তাকিয়ে উপাসনা করা হয়, ছোট ছোট কুলুঙ্গী থাকত। ইমাম যেখান থেকে উপাসনা পরিচালনা করতেন, সেখানে কয়েকটি গম্বুজ থাকত। মসজিদে প্রথমদিকে একটি মিনার ও পরের দিকে চারকোণে চারটি মিনার থাকত। এই মিনারের ওপর দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন দিনে পাঁচবার মুসলিম ভক্তদের উপাসনার জন্যে আহ্বান জানাতেন। একমাত্র গম্বুজগুলোর সঙ্গেই উপাসনার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। সেগুলো মসজিদের স্থাপত্য সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত। এই স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠনিদর্শন পারস্যে পাওয়া যায়। এ যুগে সমাধিসৌধও অত্যন্ত সরলভবে নির্মিত হতো। একটি চারকোণা বা আটকোণা ঘরে কবর থাকত এবং তার উপর একটি গম্বুজ।
তুর্কীদের সঙ্গে আরবি ও ফারসি স্থাপত্যরীতি ভারতে এলো, বিশেষ করে দ্বিতীয় রীতিটি। ফারসি স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল খিলান, তির্যক খিলান, গম্বুজ ও গম্বুজের নিচে আটকোণা বিশিষ্ট গৃহ। ভারতীয় স্থাপত্যে এসব আগে ছিল না। ভারতীয় রীতিতে খিলানের উপর দরজার চৌকাঠের মতো একটি জিনিস থাকত, কিংবা খিলানটি হতো গোলাকার। মন্দিরের শিখরগুলো নির্মিত হতো থাকে থাকে পাথর সাজিয়ে। খিলান ও গম্বুজের সম্মিলনে মুসলিম স্থাপত্য একটি বিশিষ্টতা লাভ করেছিল। হিন্দু বা বৌদ্ধ স্থাপত্যে এ জিনিস দেখা যায়নি। কংক্রীটের অধিকতর ব্যবহারের ফলে অনেক বেশি জায়গা আচ্ছাদন করাও সম্ভব হতো। হিন্দু ও বৌদ্ধ স্থাপত্যরীতির সঙ্গে ইসলামী রীতির যে মিলন হলো, তার একটা কারণ ছিল : নির্মাণকাজে ভারতীয় কারিগর নিয়োগ। ভারতীয় কারিগররা পারসী পদ্ধতির কিছুর পরিবর্তন করে নিল। এছাড়া বাড়িগুলোর অলংকরণের জন্যে প্রচলিত ভারতীয় পদ্ধতিই ব্যবহার হলো। ভারতীয় প্রতীক যেমন, বিভিন্ন আকৃতির পদ্মফুল, নতুন গৃহনির্মাণে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হলো। ভারতীয় প্রতীকের সঙ্গে যোগ হলো ইসলামী অলংকরণের নকশা, যেমন জ্যামিতিক আকৃতি, লতাপাতায় জড়ানো নকশা ও অক্ষর সংবলিত নকশা।
ভারতে ইসলামী স্থাপত্যের সর্বপ্রাচীন নিদর্শন হলো, দিল্লির কুয়াত-উল- ইসলাম মসজিদ। উল্লেখযোগ্য যে, এটি আগে ছিল মন্দির এবং তার ওপর নানা পরিবর্তন করে মন্দিরটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। এখানকার মন্দিরটি ছিল দশম শতাব্দীর চৌহান আমলের। মন্দিরের গর্ভগৃহটি সরিয়ে দেওয়া হলো, তবে চারদিকের আবেষ্টনীটি রেখে দেওয়া হলো। মন্দিরের পশ্চিম দিকে উপাসনাস্থলটি নির্মিত হলো। এইভাবে মন্দিরটি মসজিদের উপযোগী করে তৈরি করে নেওয়া হলো। এর পরেও অনেক মন্দিরকে একই পদ্ধতিতে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। তুর্কীরা অবশ্য মন্দিরের গায়ের হিন্দুরীতির ভাস্কর্য অপছন্দ করত। উপাসনারত মুসলমানদের সুবিধার জন্যে মন্দিরের পশ্চিম দিকে পাঁচটি খিলান তৈরি করে হিন্দু ভাস্কর্যের নিদর্শন আড়াল করে রাখা হতো। খিলানগুলোর নির্মাণকৌশল যে ভারতীয়, তা বোঝা যায় করবেলিঙ্গ পদ্ধতির ব্যবহার থেকে আর অলংকরণের নমুনা থেকে— অলংকরণে ‘পদ্ম’ ও আরবিক ক্যালিগ্রাফির সমন্বয় ঘটেছে। এই মসজিদটি সুলতানী আমলের প্রথমযুগে ক্রমাগত বড় করা হচ্ছিল। ভারতীয় ও ইসলামী রীতির মিলনে যে পাঠান স্থাপত্যরীতির জন্ম, তার সূচনা এইখান থেকে।
তুঘলকী আমলে সুলতানী স্থাপত্যের কিছু পরিবর্তন হলো। রেখার বাহুল্য বর্জিত হলো, অলংকরণ কমে গেল, বড় বড় পাথরের টুকরোর ব্যবহার ইত্যাদির ফলে মসজিদগুলো নিরলংকার হলো। সমস্ত মিলিয়ে প্রকাশ পেল শক্তি ও কাঠিন্য। গিয়াসুদ্দীনের সমাধিসৌধে ভারতীয় ও ইসলামী রীতির মিলনের অদ্ভূত কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে। এর খিলানগুলো তীক্ষ্ণ, প্রকৃত খিলান (অর্থাৎ corbelled নয়), অথচ খিলানের পাদদেশে আড়াআড়িভাবে একটি চৌকাঠও আছে, যদিও সে চৌকাঠের কোনো ব্যবহারিক যৌক্তিকতা নেই। মনে হয়, চৌকাঠটি হিন্দু খিলানের গঠনরীতির স্মারক।
লোদী আমলে আবার সুচারু আড়ম্বরের প্রবণতা ফিরে আসে। এই সময় মসজিদের বিভিন্ন অংশের আনুপাতিক সৌন্দর্য নিয়ে অনেক চিন্তা হয়। ফলে, এযুগের স্থাপত্যে দুটি গম্বুজ ব্যবহৃত হতো। মসজিদের দেওয়াল অত্যন্ত পুরু করে তৈরি করা হতো বলে গম্বুজগুলো ভারসাম্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিল— দেওয়ালের ভিতরদিকে ভার পড়বে, না বাহিরের দিকে পড়বে। দুটি গম্বুজ নির্মাণ করে এই সমস্যার সমাধান করা হলো; এতে বাইরের গম্বুজটি স্থাপত্যের বাইরের অংশের সঙ্গে সঙ্গতি রাখত। পারস্য থেকে আরো একটি নতুন অলংকরণ রীতিগ্রহণ করা হলো— এনামেল করা টালি। ধূসর বেলে পাথরের স্থাপত্যের উপর এই টালিগুলো অতি সুন্দর দেখাতো।
দিল্লির স্থাপত্যরীতি যেভাবে বিকাশ লাভ করেছিল, আঞ্চলিক স্থাপত্যের বিকাশও ঘটল সেই পথেই। তবে, বাড়ি তৈরির মাল-মশলার সুবিধা-অসুবিধা অনুযায়ী কিছু কিছু আঞ্চলিক পরিবর্তনও হয়েছিল। বাংলাদেশে পাথর সহজলভ্য ছিল না বলে ইটের ব্যবহার হতো বেশি এবং সেজন্যে বাড়িগুলোর উচ্চতাও হতো কম। বৌদ্ধ স্থাপত্যের পোড়ামাটির অলংকরণ মসজিদ ও প্রাসাদেও ব্যবহৃত হতো। গুজরাট ও মালোয়ায় স্থাপত্য বিশেষ উন্নতি লাভ করেছিল। কেননা, সেখানে স্থানীয় স্থাপত্যরীতি অত্যন্ত সজীব ছিল অন্য অঞ্চলের তুলনায় এবং বিত্তবানরা নতুন স্থাপত্যশৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেও উৎসাহী ছিলেন। রাজস্থানেও নতুন স্থাপত্যরীতির প্রভাব দেখা গিয়েছিল। এখানে বাস্তুস্থাপত্যে ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি কম। এনামেল করা টালির ব্যবহার প্রভৃতি কতকগুলো অলংকরণ বৈশিষ্ট্য থেকেও মনে হয়, নতুন পাঠান স্থাপত্যরীতির কাছে রাজস্থানী স্থাপত্য ঋণী।
মসজিদ ও সমাধিস্তম্ভের স্থাপত্যরীতিতে মুসলমান ও ভারতীয় স্থাপত্যরীতির মিলনে যে নতুন রীতির জন্ম হলো, তার সঙ্গে উভয় প্রথাগত স্থাপত্যরীতিরই যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। হিন্দু প্রতীক, যেমন পদ্মফুল, নতুন রীতির অঙ্গীভূত হয়ে গেল। এই মিলন অনেকদিক দিয়ে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির মিলনের চরিত্র- নির্দেশ করে। স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্যে ব্রাহ্মণ, উলেমা ও দরবারের ঐতিহাসিকদের চেষ্টা সত্ত্বেও মিলনের স্রোত ধীরে ধীরে গতিশীল হয়ে উঠছিল।
গত ৫০ বছরে অনেক ঐতিহাসিক বলার চেষ্টা করেছেন যে, হিন্দু ও ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে কোনো ধরনের মিলনই হয়নি, এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দুই ধর্মীয় সমাজ বিচ্ছিন্নভাবেই পাশাপাশি বাস করেছে। এই ধারণা ঠিক নয়। এটা হলো এক ধরনের ঐতিহাসিক চিন্তার উদাহরণ, যেখানে সমসাময়িক মনোভাবের যথার্থতা খুঁজে বার করার জন্যে অতীতকে সাক্ষী মানার চেষ্টা হয়। ওইযুগে হিন্দু ও মুসলিমদের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধ বলে কোনো ধারণা ছিল না। যদি তুর্কী ও আফগানরা নিজেদের বিদেশি স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখত, তাহলে হয়তো স্বতন্ত্র একটি জাতীয়তাবোধের অস্তিত্ব সম্ভব ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় মুসলমানরা অধিকাংশই হিন্দুধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত।
ধর্মতাত্ত্বিকরা ও দরবারের ঐতিহাসিকরাই স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধের স্বপক্ষে যুক্তির অবতারণা করেছেন। এঁরা হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বতন্ত্রতাকে বড় করে দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছিলেন। সেজন্যে এঁদের লেখাকে খুব নির্ভরযোগ্য মনে করা চলে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে লেখক নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে উৎসাহী, তাঁর লেখায় দুই সম্প্রদায়ের মিলনের সঠিক বিবরণ পাওয়া কঠিন। সমগ্র সমাজের সাংস্কৃতিক কাঠামো দেখেই সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে হবে। সুলতানী যুগের সামাজিক কাঠামো লক্ষ্য করলে এই কথাই মনে হয় যে, দুই ভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল। এই সমন্বয় অবশ্য সমাজের সর্বস্তরে সমানভাবে প্রতিফলিত হয়নি। তাছাড়া, এইযুগে সমন্বয়ের যে ধারার জন্ম হলো, পরবর্তীকালেই তা পাকাপোক্ত হয়ে উঠতে পেরেছিল।
ইসলামের আগমনের ফলে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোতে কোনো বড় পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ভক্তি আন্দোলন থেকে বোঝা যায় যে, প্রচলিত সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সরব হয়ে উঠছিল। রাজনৈতিক আনুগত্যের চেয়ে বর্ণভিত্তিক আনুগত্য বেশি শক্তিশালী ছিল বলে ইসলামের প্রকৃত প্রভাব পড়েছিল সামাজিক কাঠামোর ওপর। বর্ণভিত্তিক ভারতীয় সমাজে আরো অনেক নতুন উপবর্ণ ও গোষ্ঠীকে গ্রহণ করা হলো এবং এদের অনেকেই ইসলামী আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এর আগের যুগেও ভারতীয় সমাজে বিদেশিদের এইভাবেই অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়েছিল। ইসলামের সাক্ষ্যমূলক মতবাদের প্রচার সত্ত্বেও বর্ণপ্রথা লুপ্ত হয়নি। ভারতবর্ষে এসে ইসলাম বর্ণভিত্তিক সমাজকে মেনে নিয়েছিল এবং এই কারণেই ইসলামের সামাজিক প্রগতিশীলতা দুর্বল হয়ে পড়ল। মুসলিম সমাজেও শেখ ও সৈয়দদের (এরা ছিল উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আশরফ গোষ্ঠীভুক্ত) একটা আলাদা মর্যাদা ছিল। ঠিক যেমন, হিন্দুসমাজে দ্বিজর পৃথক মৰ্যাদা। অতএব এরপর ইসলামের কাছ থেকে হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথার ভয়ের কারণ থাকতে পারে না। যে বর্ণের হাতে শাসনক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদাও চিরকাল তারই বেশি ছিল। বর্ণপ্রথায় কোনো বর্ণের পক্ষে উপরে ওঠার সুযোগ ছিল না। তার ফলে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে চিন্তার বিনিময়ও হতো না। সেজন্যে এই যুগে ভক্তি আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে নানকের শিষ্যরা একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল। তবে, রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এই প্রাচীন ধারা চলেছিল ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত। তারপর বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে এক নতুন ভারতীয় মধ্যবিত্তশ্রেণির উত্থানের ফলে নতুন এক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিন্যাসের সূচনা হলো।
***
১. কালচারাল হেরিটেজ অফ ইন্ডিয়া, ২য় খণ্ড। পৃ. ২৪৯
২. আর. টেগোর (অনুবাদ) – সভ্স অফ কবীর। পৃ. ৮৫, ১১২
৩. এম. এ. মেকলিফ- দি শিখ রিলিজিয়ন, ১ম খণ্ড। পৃ. ১৯৫-৯৬