১৩. শেষ পর্বে শঙ্খনদী

শেষ পর্বে শঙ্খনদী

পচাগড় থেকে বাবা বদলি হলেন রাঙ্গামাটিতে।

দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ। ভাগ্য ভালো হলে দেখা যাবে রাঙ্গামাটি খুব জলি জায়গা– স্কুল নেই। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্কুল আছে নাকি?

তিনি বললেন, অবশ্যই আছে। স্কুল থাকবে না কেন? রাঙ্গামাটি বেশ বড় শহর। খুব সুন্দর শহর!

স্কুল আছে শুনে একটু মনমরা হয়ে গেলাম। নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে কিছুই নেই। কাবাবে হাড্ডি থাকে, চাঁদে থাকে কলঙ্ক। স্কুলের যন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে বলে মনে হচ্ছে।

চিটাগাং থেকে রাঙ্গামাটি যেতে হয় লক্কর-মার্কা বাসে। রাস্তা অসম্ভব খারাপ। পাহাড়ের গা-ঘেঁষে বাস যখন উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন বাসে, হেল্পার চেঁচিয়ে বলে, আল্লাহর নাম নেন। ইসটার্ট বন্ধ হইতে পারে।

সত্যি সত্যি স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। ভবিষ্যদ্বাণী এমন ফলে গেছে দেখে কন্ডাকটারের মুখে বিমলানন্দের হাসি। ড্রাইভার বাস থেকে বের হয়ে নিশ্চিন্ত মনে বিড়ি খাচ্ছে। তার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রায়ই ঘটে।

বাস কখন ছাড়বে জিজ্ঞেস করতেই সে সুফি-সাধকের মতো নির্লিপ্ত গলায় বলল, আল্লাহর হুকুম হইলেই ছাড়ব। আমরা বাসযাত্রীরা বাস থেকে নেমে আল্লাহর হুকুমের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

মা আমাদের সর্বকনিষ্ঠ বোনটির কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দীর্ঘ ভ্রমণে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ক্রমাগত কাঁদছে। বাবা আমাদের নিয়ে বের হয়েছেন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগুচ্ছি-এ কোথায় এসে পড়লাম। স্বপ্নপুরীর মতো সুন্দর দেশ! চারদিকে পাহাড়ের সারি ঢেউয়ের মতো দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। মাথার উপর ঘন নীল আকাশ বাতাসে কেমন যেন বুনো বুনো গন্ধ। রাস্তার পাশ ঘেঁষে ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। কী পরিষ্কার তার পানি! বাসযাত্রীরা আঁজলা ভরে সেই পানি খাচ্ছে।

কিছুদূর এগুতেই যে-দৃশ্য দেখলাম তা দেখার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি ছিল। হাতির খেদা থেকে ধরে-আনা একপাল হাতি। প্রতিটি হাতির পা দড়ি এবং শিকল দিয়ে বাঁধা। রুগ্‌ণ ভয়ার্ত চেহারা। সব মিলিয়ে সাত থেকে আটটা হাতি। দুটি হাতির বাচ্চাও আছে। এরা বাধা নয়, ছোটাছুটি করছে। দেখতে অবিকল পুতুলের মতো। বাচ্চা দুটি দেখে মনে হল তারা সময়টা কাটাচ্ছে খুব আনন্দে।।

খেদার মালিক এগিয়ে এলেন। বাবাকে বললেন-সর্বমোট একুশটা হাতি ধরা পড়েছে। দশটা বিক্রি হয়েছে, তিনটা মারা গেছে। এখানে যে-ক’টা আছে। সে-ক’টাও মারা যাবে। কোনো হাতি কিছু খাচ্ছে না। খেদার মালিক বলল, হাতির বাচ্চা একটা নেবেন নাকি স্যার?

বাবা কিছু বলবার আগেই আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম, নেব নেব।

বাবার মুখ দেখে মনে হল প্রস্তাবটা তিনি একেবারে ফেলে দিচ্ছেন না। বিবেচনাধীন আছে। তিনি নিচু গলায় বললেন, দাম কত?

দাম নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বলতে গেলে বিনা দামে বিক্রি হবে। আপনি চান কি না বলেন। নিলে আমার উপকার হয়। বাচ্চা দুটা এখন সমস্যা। ডিসি সাহেব একটা নিবেন বলেছিলেন, এখন বলছেন–না।

হাতির বাচ্চা শেষ পর্যন্ত কেনা হল না। কারণ এরা এখনও দুগ্ধপোষ্য। প্রতিদিন আধমণ দুধ এদের খাওয়াতে হবে। আমরা মন খারাপ করে বাসে ফিরে এলাম। বাবা বললেন, পাহাড়ি জায়গায় আছি–হাতির বাচ্চা জোগাড় করা কোনো সমস্যা হবে না। একটা হাতির বাচ্চা কেনা যেতে পারে। আগে একটু গুছিয়ে বসি। তোমাদের মন খারাপ করার কোনো কারণ নাই! এই বলে তিনি নিজেই সবচে’ বেশি মন-খারাপ করলেন। বাসা ঠিকঠাক হতে অনেক সময় লাগল। আমরা রাঙ্গামাটি পৌঁছলাম দুপুর-রাতে। আমাদের বাসা মূল শহর থেকে অনেকখানি দূরে। একটা পাহাড়ের মাথা কেটে ছ’টা বাড়ি বানানো হয়েছে। ঐ ছ’টা বাড়ির একটা আমাদের। অতি নির্জন জায়গা। চারদিকে ঘন বন। অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে বন থেকে। মা ভীতগলায় বললেন, এ কোথায় এনে ফেললে? বাবার মুখও শুকিয়ে গেল। এরকম বিরানভূমিতে বাসা, তা বোধহয় তিনিও ভাবেননি।

বাসা আমাদের খুব পছন্দ হল। পাহাড়ের উপর বাসায় আমরা থাকব এরকম তো কখনো ভাবিনি। এরকম বাসায় থাকা মানে আকাশের কাছাকাছি থাকা। কী সৌভাগ্য আমাদের! তারপর যখন শুনলাম আশেপাশে কোনো স্কুল নেই, আমাদের স্কুলে যেতে হবে না, তখন মনে হল আনন্দে পাগল হয়ে যাব।

সারাদিন খেলা। নতুন একটা খেলা বের করেছি। পাখি-পাখি খেলা। দুহাত পাখির ডানার মতো উঁচু করে এক দৌড়ে পাহাড় থেকে নিচে নামা। একসময় আপনা-আপনি গতি বাড়তে থাকে-মনে হয় সত্যি উড়ে চলেছি–পাখি হয়ে গেছি।

সন্ধ্যার পর বই নিয়ে বসি। সেটাও একধরনের খেলা। পড়া-পড়া খেলা। কারণ পড়া দেখিয়ে দেবার কেউ নেই। শাসন করার কেউ নেই।

বাবা প্রায় সারা মাস টুরে থাকেন। মা সবচে ছোট বোনটিকে নিয়ে ব্যস্ত। বড় মামাও সঙ্গে নেই। এই প্রথম উনি ঠিক করেছেন আমাদের সঙ্গে আসবেন না। বড় বোনের পরিবারের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জীবন নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন।

ছোট ছোট এতগুলো বাচ্চা সামলিয়ে মাকে একা সংসার দেখতে হয়। তার উপর ভৌতিক সমস্যা দেখা দিল। আমাদের রান্নাঘর অনেকখানি দূরে। মা রান্না করার সময় প্রায়ই দেখতে পান-একটা ছায়ামূর্তি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে। তিনি আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়লেন। সন্ধ্যা মেলাবার পরই সবাইকে একটা ঘরে বন্ধ করে হারিকেন জ্বালিয়ে বসে থাকেন। ঘুমাতে পারেন না। ঐ ছায়ামূর্তিকে অনেক দেখার চেষ্টা করলাম, সে দেখা দিল না। মা ছাড়া তাকে আর কেউ দেখে না। তবে এক সন্ধ্যায় তার খড়মের খটখট শুনলাম। কে যেন খড়ম পায়ে বারান্দায় হাঁটছে। মা ভয়ে সাদা হয়ে গেলেন। উঁচু গলায় আয়াতুল কুরশি পড়তে লাগলেন। সারারাত ঘুমুলেন না। আমাদেরও ঘুমুতে দিলেন না। পরদিন একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটল। বড়মামা এসে উপস্থিত। তিনি খুব সিরিয়াস গলায় বললেন, বুবু ভাববেন না যে আপনাদের সঙ্গে থাকব। দুদিনের জন্যে এসেছি। আমাকে রাখার জন্য শত অনুরোধ করলেও লাভ হবে না। আমার নিজের একটা জীবন আছে। আপনার ফ্যামিলির সঙ্গে ঘোরাই আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।

মা বললেন, ঠিক আছে, দুদিন পরে চলে যাস।

আগেভাগে বলে রাখছি যাতে পরে যন্ত্রণা না করেন।

যন্ত্রণা করব না।

দুদিন থাকব। মাত্র দুদিন। দুই দিন এবং দুই রাত।

আচ্ছা ঠিক আছে।

মামার সেই দুদিন পরবর্তী আট বছরেও শেষ হল না। তিনি আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরতে লাগলেন।

রাঙ্গামাটি এসে তিনি সংগীতের দিকে মন দিলেন। জারিগান। নিজেই গান লেখেন-সুর দেন। জারিগান একা একা হয় না। তাল দিতে হয়। তাল দেবার জন্যে একদল শিশু জুটে গেল। মামা মাথায় গামছা বেঁধে একটা লাইন বলেন, আমরা হাততালি দিতে দিতে বলি-আহা বেশ বেশ বেশ।

শুধু বেশ বেশ বললে হয় না, সঙ্গে সঙ্গে মাথাও নাড়তে হয়। মাথা নাড়া এবং হাততালির মধ্যে একধরনের সমন্বয় থাকতে হয়। ভুল করলে বড়মামা রাগ করেন।

রাতের বেলা গল্পের আসর। লেপের নিচে বসে তুলারাশি রাজকন্যার গল্প শোনার আনন্দের সঙ্গে কোনো আনন্দেরই তুলনা হয় না।

এক রাতে এরকম গল্প শুনছি। হঠাৎ শুনি মটমট শব্দ। তারপর মনে হল চারদিক যেন আলো হয়ে উঠেছে। আগুন আগুন বলে চিৎকার উঠল। আমাদের ঠিক সামনের বাসায় আগুন ধরে গেছে। বাড়ি কাঠের। টিনের ছাদ। পুরো বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলছে। পাহাড়ের উপর পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। আগুনে বাড়ি পুড়ে ছাই হবে—কিছুই করা যাবে না। অবস্থা এমন যে আর সবগুলি বাড়িতেই আগুন ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা! বড়মামা আমাদের কোলে করে আগুন থেকে যতটা সম্ভব দূরে রেখে আসলেন। আমাদের পর উপর ভেজা কম্বল–কারণ আগুনের ফুলকি উড়ে উড়ে আসছে। চোখ বড় বড় করে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দেখলাম। ভয়ংকরেরও একধরনের সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্য থেকেও চোখ ফেরানো যায় না। একসময় অবাক হয়ে দেখি, জ্বলন্ত বাড়ির টিনের চালগুলি আকাশে উড়তে শুরু করেছে। প্লেনের মত ভোঁভোঁ করতে করতে একেকটা টিন একেক দিকে উড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বাড়িতে আগুন লেগে গেল, সেখান থেকে তৃতীয় বাড়ি। চারদিকে আগুন নিয়ে ভেজা কম্বল মাথায় দিয়ে আমরা বসে আছি। মনে হচ্ছে, যে-কোনো মুহূর্তে আগুন আমাদের গ্রাস করবে।

আমাদের এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতা!

রাঙ্গামাটিতে আমরা ছিলাম পাঁচ মাসের মতো। অগ্নিপর্বের কিছুদিন পরই বাবা আবার বদলি হলেন বান্দরবনে। দোহাজারী পর্যন্ত ট্রেনে। সেখান থেকে নৌকায়। সারারাত নৌকা চলল শঙ্ঘনদীতে। ভোরবেলা এসে পৌঁছলাম বান্দরবন। ঘন অরণ্যঘেরা ছোট্ট শহরতলি। অল্পকিছু বাড়িঘর। ইট-বিছানো ছোট্ট একটা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে কয়েকটি দোকানপাট।

গ্রামে যেমন সাপ্তাহিক হাট বসে এখানেও তা-ই। বুধবারের সাপ্তাহিক হাট। পাহাড়ি লোকজন বুধবারে এসে উপস্থিত হয়। কত বিচিত্র জিনিসই তারা বিক্রি করতে আনে! বাঁদরের মাংস, সাপের মাংস। মুরং মেয়েরাও আসে। তাদের কোমরে এক চিলতে কাপড় ছাড়া সারা গা উদোম। কী বিচিত্র জায়গা। বান্দরবন অনেকটা উপত্যকার মতো। চারপাশেই পাহাড়। এইসব পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে ঝুম চাষ হয়। প্রতি সন্ধ্যায় একটা-না-একটা পাহাড় জ্বলতে থাকে।

বান্দরবনের বাসায় প্রথম দিনেই এক কাণ্ড হল। রাত নটার মতো বাজে। বাইরে হুম হাম হিউ–বিকট শব্দ। একসঙ্গে সবাই জানালার কাছে ছুটে এলাম। কী সর্বনাশ! একটা রাক্ষস দাঁড়িয়ে আছে। রাক্ষসের হাতে কেরোসিনের কুপি। সে কেরোসিনের কুপিতে ফুঁ দিতেই তার মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হল। আমরা সবাই ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার মা পর্যন্ত ভয় পেয়ে বললেন–এইটা কী?

রাক্ষস তখন মানুষের মতো গলায় বলল, ভয় পাবেন না। ছোট খোকাখুকিরা ভয় পাবেন না। আমি বহুরূপী। ভয় পাবেন না।

বান্দরবনেই আমার প্রথম এবং শেষ বহুরূপী দেখা। এই জিনিস আর কোথাও দেখিনি। সে প্রতিমাসে দুতিন বার সাজ-পোশাক পরে বের হত। কোনো রাতে সাজত ভালুক, কোনো রাতে জলদস্যু। ভোরবেলা দীনহীন মুখে বাসায় এসে বলত, খোকাখুকিরা আম্মাকে বলেন, আমি বহুরূপী। কিছু সাহায্য দিতে বলেন।

তখন আমার খুব কষ্ট লাগত। মনে হত সমস্ত পৃথিবীর রহস্য যার হাতের মুঠোয়-সে কিনা দিনে এসে মলিনমুখে ভিক্ষা করে! এত অবিচার কে এই পৃথিবীতে?

এরকম বুনো এবং জংলা জায়গায়ও রাজপ্রাসাদ আছে। মুরং রাজার বাড়ি। দূর থেকে দেখি। কাছে যেতে ভয়-ভয় লাগে। মুরংরা রাজাকে দেখে দেবতার মতো। রাজবাড়ির দিকে চোখ তুলে তাকায় না-এতে নাকি পাপ হয়।

বান্দরবনের সবই ভালো–শুধু মন্দ দিকটা হল-এখানে একটা স্কুল আছে।

আমাদের স্কুলে ভরতি করিয়ে দেয়া হল।

মন পুরোপুরি ভেঙে গেল। স্কুলে আমার একমাত্র আনন্দের ব্যাপার হল মুরং রাজার এক মেয়ে পড়ে আমাদের সঙ্গে। গায়ের রং শঙ্খের মতো সাদা। চুল হাঁটু ছাড়িয়েও অনেকদূর নেমে গেছে। আমরা ক্লাস সিক্সে পড়ি, কিন্তু তাকে দেখায় একজন তরুণীর মতো। তার চোখ দুটি ছোট ছোট, গালের হনু খানিকটা উঁচু। আমার মনে হল চোখ দুটি আরেকটু বড় হলে তাকে মানাত না। গালের হনু উঁচু হওয়ায় যেন তার রূপ আরও খুলেছে।

ক্লাসে আমি স্যারদের দিকেও তাকাই না। বোর্ডে কি লেখা হচ্ছে তাও পড়তে চেষ্টা করি না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রাজকন্যার দিকে। সত্যিকার রাজকন্যা।

আমার এই অস্বাভাবিক আচরণ রাজকন্যার চোখে পড়ল কী না জানি না, তবে একজন স্যারের চোখে পড়ল। তিনি আমাকে বিষদৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। প্রতিটি ক্লাসেই তিনি আমাকে প্রশ্নে-প্রশ্নে জর্জরিত করেন, কিন্তু আমাকে আটকাতে পারেন না। কারণ ইতিমধ্যে আমি একটা জিনিস বুঝে ফেলেছি-আমার স্মৃতিশক্তি অসম্ভব ভালো। যে-কোনো পড়া একবার পড়লেই মনে থাকে। সব পড়াই একবার অন্তত পড়ে আসি। স্যার আমাকে কিছুতেই কায়দা করতে পারেন না। বারবার জাল কেটে বের হয়ে আসি।

কোনো অধ্যবসায়ই বৃথা যায় না। সারের অধ্যবসায়ও বৃথা গেল না, আমাকে আটকে ফেললেন। সমকোণ কাকে বলে জিজ্ঞেস করলেন, আমি বলতে পারলাম না।

রাজকন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন। সে-ও পারল না। না পারারই কথা। রাজকন্যারা সবসময়েই খানিকটা হাবা ধরনের হয়। স্যার রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন–পড়া পারনি কেন?

রাজকন্যা জবাব দিল না। তার ছোট ছোট চোখ থেকে টপটপ করে পানি তে লাগল। সেই অশ্রুবর্ষণ-দৃশ্যে যে-কোনো পাষাণ দ্রবীভূত হবে। স্যার দ্রবীভূত হলেন। রাজকন্যাকে বসতে বললেন। আমার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা হল। বিচিত্র শাস্তি। বড় একটা কাগজে লেখা হল–

আমি পড়া পারি নাই।
আমি গাধা।

সেই কাগজ গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হল। স্যার একজন দপ্তরিকে ডেকে আনলেন এবং কঠিন গলায় বললেন, এই ছেলেকে সবকটা ক্লাসে নিয়ে যাও। ছাত্ররা দেখুক।

আমি অপমানে নীল হয়ে গেলাম। টান দিয়ে গলার কাগজ ছিড়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বললাম, আপনি গাধা। তারপর এক দৌড় দিয়ে ফুল থেকে বের হয়ে গেলাম। বাসায় ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আমি শঙ্খনদীর তীর ঘেঁষে দৌড়াচ্ছি। আমাকে যেতে হবে অনেক অনেক দূরে। লোকালয়ে আমার থাকা চলবে না। কেউ যেন কোনোদিন আমাকে আর না দেখে।

সন্ধ্যাবেলা লোক পাঠিয়ে শঙ্খনদীর তীর থেকে বাবা আমাকে ধরিয়ে আনলেন। আমি আতঙ্কে কাঁপছি। না জানি কী শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্যে!

বাবা শান্ত গলায় বললেন, তুমি তোমার স্যারকে যা বলেছ তার জন্যে কি তুমি লজ্জিত।

আমি বললাম,–না।

বাবা দ্বিতীয়বার বললেন, তুমি আবার ভেবেচিন্তে বলল, তুমি কি লজ্জিত?

না।

লজ্জিত হওয়া উচিত। স্যারেরা তোমাকে পড়ান। তোমাদের শাস্তি দেয়ার অধিকার তাদের আছে। তুমি আমার সঙ্গে চলো। স্যারের কাছে ক্ষমা চাইবে।

আমি বাবার সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে রওনা হলাম। স্যারের কাছে ক্ষমা চাইলাম। আমার ক্ষমা প্রার্থনার পর বাবা বললেন, মাস্টারসাহেব, আমার এই ছেলেটা খুব অভিমানী। সে বড় ধরনের কষ্ট পেয়েছে। অপমানিত বোধ করেছে। তাকে আমি কোনোদিন এই স্কুলে পাঠাব না। সে বাসায় থাকবে।

কী বলছেন আপনি।

আমার ছেলের অপমনি আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। পরদিন হেডমাস্টার সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে স্কুকের সব শিক্ষক বাসায় উপস্থিত। তারা বাবাকে রাজি করাতে এসেছেন যাতে আমি আবার স্কুলে যাই। বাবা রাজি হলেন না। তাঁর এক কথা, আমি তাকে স্কুলে পাঠাব না।।

সারাদিন একা একা বাসায় থাকি। কিছুতেই সময় কাটে না। ছোট্ট দুই ভাইবোন স্কুলে। মা ব্যস্ত। আমার কিছু করার নেই। আমি স্কুলের সা শঙ্খনদীর তীর ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে কাটাই।

বাবা মাঝে মাঝে আমাকে ট্যুরে নিয়ে যান। কখনো রামু, কখনো থানছি, কখনো নাইক্ষ্যংছড়ি। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরার পেছনে বাবার যে-উদ্দেশ্য কাজ করছিল তা হল প্রকৃতির রূপের দিকে আমার চোখ ফেরানো। তিনি আমাকে মোটা একটা খাতা এবং কলম দিলেন যাতে আমি কী কী দেখছি তা গুছিয়ে লিখি। একদিন খাতা দেখতে চাইলেন।

যা যা লেখা হয়েছে তা পড়ে বড়ই বিরক্ত হলেন। প্রকৃতি সম্পর্কে খাতায় কিছুই লেখা নেই। যা লেখা তা পড়ে বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে।

মঙ্গলবার।

আজ আমরা রামু থানায় পৌঁছিয়াছি।

দুপুরে ভাত খাইয়াছি। মুরগির গোশত এবং আলু।

ডাল ছিল। ভাল খাই নাই।।

বাবা বললেন, তুই কী দিয়ে ভাত খেলি তা বিতং করে লেখার কী দরকার? অন্যরা এই খবর জেনে কী করবে?

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, অন্যদের জন্যে তো আমি লিখি নাই। আমি লিখেছি আমার জন্য।

কোনদিন কী খেয়েছিস তার খোঁজেই-বা তোর কী দরকার? এই যে এত সুন্দর জলপ্রপাত তোকে দেখিয়ে আনলাম সেই প্রপাতটার কথা লিখলি না কেন?

জলপ্রপাতের কথা লিখলে কী হবে?

যারা জলপ্রপাতটা দেখেনি তারা তোর লেখা পড়ে বুঝবে জিনিসটা কেমন। যা, লিখে নিয়ে আয়। দেখি পারিস কি না।

সেই জলপ্রপাত আমাকে মোটেই আকর্ষণ করেনি। ছোট্ট পানির ধারা উপর থেকে নিচে পড়ছে। নিচে গর্ত মতো হয়েছে। গর্ত ভরতি ঘোলা পানি। জলপ্রপাতের একটি জিনিস আমার ভালো লাগল–পানির ধারার চারদিকে সূক্ষ্ণ জলচূর্ণের জন্যে অসংখ্য রামধনু দেখা যায়। আমি রামধনু সম্পর্কেই লিখলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে–ষষ্ঠ শ্রেণীর একটি বালকের সেই লেখা পড়ে আমার সাহিত্যিক বাবা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। শুধু মুগ্ধ না—প্রায় অভিভূত হবার মতো অবস্থা।

জলপ্রপাতবিষয়ক রচনার কারণে উপহার পেলাম–রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’। গল্পগুচ্ছের প্রথম যে-গল্পটি পড়ি তার নাম ‘মেঘ ও রৌদ্র’। পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তারপর চোখ মুছে আবার গোড়া থেকে পড়া শুরু করলাম। আমার নেশা ধরে গেল।

বান্দরবন পুলিশ লাইব্রেরিতে অনেক বই।

বাবা সেই লাইব্রেরির সেক্রেটারি। রোজ বই নিয়ে আসেন। আমি সারাদিন পড়ি। মাঝে মাঝে অসহ্য মাথার যন্ত্রণা হয়। সেই যন্ত্রণা নিয়েও পড়ি। বিকেলে শঙ্খনদীর তীরে বেড়াতে যাই।

নদীর তীরেই আমার পরিচয় হল নিশাদাদার সঙ্গে। তাঁর ভালো নাম নিশানাথ ভট্টাচার্য, তার বাবা পুলিশের এ.এস.আই,। নিশাদাদা বিরাট জোয়ান। কয়েকবার ম্যাটিক দিয়েছেন–পাশ করতে পারেননি। পড়াশোনায় তাঁর কোনো মন নেই, তাঁর মন শরীরচর্চায়। নদীর তীরে তিনি ঘণ্টাখানিক দৌড়ান। ডন বৈঠক করেন। শেষ পর্যায়ে সারা গায়ে ভেজা বালি মেখে নদীর তীরে শুয়ে থাকেন। এতে নাকি রক্ত ঠাণ্ডা হয়। রক্ত ঠাণ্ডা হওয়া শরীরের জন্য ভালো।

স্বাস্থ্যরক্ষার নানান উপদেশ তিনি আমাকেও দেন। কথায়-কথায় বলেন Health is wealth. বুঝলে হুমায়ূন, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। তার সঙ্গে যে কোনো গল্প করলেই তিনি কীভাবে জানি সেই গল্প স্বাস্থ্যরক্ষায় নিয়ে যান। আমার বড় মজা লাগে।

তখন ঘোর বর্ষা।

বৃষ্টি পড়ছে অবিশ্রান্ত। নিশাদাদা ভিজতে ভিজতে আমাদের বাসায় এসে উপস্থিত। আমার মাকে ডেকে বললেন, মাসিমা, মাছ ধরতে যাচ্ছি। খেপজালে মাছ ধরব। হুমায়ূনকে নিয়ে যাচ্ছি। একা একা মাছ ধরতে ভালো লাগে না। দর্শক ছাড়া মাছ ধরা যায় না। ছাতা দিয়ে দিন। ছাতা থাকলে বৃষ্টিতে ভিজবে না।

নিশাদাদার সঙ্গে ছাতা-মাথায় আমিও রওনা হলাম। নদীর তীরে এসে মুখ শুকিয়ে গেল। বর্ষার পানিতে শঙ্খনদী ফুলেফেঁপে উঠেছে। তীব্র স্রোত। বড় বড় গাছের গুঁড়ি ভেসে আসছে। এই শঙ্খনদী আগের ছোট্ট পাহাড়ি নদী না– নদী মূর্তিমতী রাক্ষুসী।

নিশাদাদা জাল ফেললেন। কী যেন ঘটে গেল। শঙ্ঘনদী যেন তার হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে নিয়ে নিল। একবারের জন্যও তার মাথা ভেসে উঠল, আমি ছুটতে ছুটতে চিৎকার করতে করতে বাসায় ফিরলাম।

নিশাদাদার লাশ পাওয়া গেল সন্ধ্যায়। সাত মাইল ভাটিতে। আমার সমস্ত পৃথিবী উলটপালট হয়ে গেল। পরের অবিশ্বাস্য ঘটনাটি লিখতে সংকোচ লাগছে। না লিখেও পারছি না।

সেই রাতের ঘটনা।

আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। বাবা মাত্র শশ্মান থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে বসেছেন। মা জেগে আছেন। পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় তারা দুজনই আচ্ছন্ন। হঠাৎ তাদের কাছে মনে হল কে যেন বারান্দায় হেঁটে হেঁটে আসছে। আমাদের ঘরের সামনে এসে পদশব্দ থেমে গেল। অবিকল নিশাদাদার গলায় কে যেন বলল, হুমায়ূনের খোঁজে এসেছি। হুমায়ূন কি ফিরেছে?

বাবা তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে বের হলেন। চারদিকে ফকফকা জোছনা। কোথাও কেউ নেই।

এই ঘটনার নিশ্চয়ই কোনো লৌকিক ব্যাখ্যা আছে। বাবা-মা দুজনেই ঐ রাতে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। অবচেতন মনে ছিল মৃত ছেলেটি। তারা একধরনের অডিটরি হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়েছেন। এই তো ব্যাখ্যা।

আমি নিজেও এই ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছি। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, অন্য ব্যাখ্যাটিই-বা খারাপ কী? একজন মৃত মানুষ আমার প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে ছুটে এসেছে অশরীরী জগৎ থেকে। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করছে-হুমায়ূন কি ফিরেছে?

আমার শৈশব কেটে গেল মানুষের ভালোবাসা পেয়ে পেয়ে।

কী অসীম সৌভাগ্য নিয়েই-না আমি এই পৃথিবীতে জন্মেছি!

নিশাদাদার মৃত্যুর পরপর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। শিশুমন মৃত্যুর এই চাপ সহ্য করতে পারল না। প্রচণ্ড জ্বরে আচ্ছন্ন থেকে কয়েকদিন কেটে গেল। মাঝে মাঝে মনে হত আমি শূন্যে ভাসছি। শরীরটা হয়ে গেছে পাখির পালকের মতো। সারাক্ষণ একটা ঘোর-ঘোর অবস্থা। এই ঘোরের মধ্যেই আমাকে দেখতে এল মুরং রাজার মেয়ে। সহপাঠী রাজকন্যা। আচ্ছন্ন অবস্থায় তাকে সেদিন আরও সুন্দর মনে হল। পৃথিবীর সমস্ত রূপ যেন সে তার শরীরে ধারণ করেছে।

সে অনেক কথাই বলল। তার কিছুই আমার মনে নেই, শুধু মনে আছে, একসময় মাথা দোলাতে দোলাতে বলছে-তুমি এত পাগল কেন?

তার এই সামান্য কথা–কী যে ভালো লাগল! সেই ভালোলাগায় একধরনের ও মিশে ছিল। যে কষ্টের জন্য এই পৃথিবীতে নয়–অন্য কোনো অজানা ভুবনে।

আমার শৈশবটা কেটে গেছে দুঃখমেশানো আনন্দে-আনন্দে। যতই দিন যাচ্ছে সেই আনন্দের পরিমাণ কমে আস।ে আমি জানি, একসময় আমার সমস্ত পথিবী দুঃখময় হয়ে উঠবে। তখন যাত্রা করব অন্য ভুবনে, যেখানে যাবতীয় আনন্দ-বেদনার জন্ম।

আজ থেকে তিরিশ বছর আগে সিলেটের মীরাবাজারের বাসায় এক গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, দেখি মশারির ভেতর ঠিক আমার চোখের সামনে আলোর একটা ফুল ফুটে আছে। বিস্ময়, ভয় ও আনন্দে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম-এটা কী?

বাবা জেগে উঠলেন, মা জাগলেন, ভাইবোনেরা জাগল। বাবা আমার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, জোছনার আলো ঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে মশারির গায়ে পড়েছে। ভেন্টিলেটরটা ফুলের মতো নকশা-কাটা। কাজেই তোমার কাছে মনে হচ্ছে মশারির ভেতর আলোর ফুল। ভয়ের কিছুই নেই, হাত বাড়িয়ে ফুলটা ধরো।

আমি হাত বাড়াতেই সেই আলোর ফুল আমার হাতে উঠে এল, কিন্তু ধরা পড়ল না। বাকি রাতটা আমার নির্মুম কাটল। কতবার সেই ফুল ধরতে চেষ্টা করলাম-পারলাম না। সৌন্দর্যকে ধরতে না-পারার বেদনায় কাটল আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন। আমি জানি সম্ভব না, তবু এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি যদি একবার জোছনার ফুল ধরতে পারি-মাত্র একবার। এই পৃথিবীর কাছে আমার এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবার নেই।

1 Comment
Collapse Comments

It was great. Thanks for upload.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *