এয়োদশ পরিচ্ছেদ
শুভবুদ্ধির পথ ধরে
আপনার কখনও রাগ হলে অন্যকে দুচার কথা শুনিয়ে দেন আর তাতেই আপনার মনের ভার লাঘব হয়ে যায়। কিন্তু যাকে শোনালেন তার মনের ভাবটা কেমন হয়? সে কি আপনার মত আনন্দ পাবে? আপনার ওই কলহপ্রিয়তা, ক্ষিপ্তভঙ্গী কি তাকে আপনার মতবাদ মেনে নিতে সাহায্য করবে?
‘আপনি যদি আমার দিতে ঘুসি পাকিয়ে আসেন’, উড্রো উইলসন একবার বলেছিলেন, তাহলে কথা দিতে পারি আমাকেও দুগুণ তৈরি দেখতে পাবেন। কিন্তু এর বদলে আপনি যদি এসে বলেন, আসুন, বসে আলোচনা করা যাক, আর আমাদের মতবিরোধ হলে, আসুন জানার চেষ্টা করি আমাদের মতবিরোধ কেন। এতে আমরা দেখতে পাবো আমাদের মধ্যে যে মতবিরোধ আছে তা খুবই কম। দেখা যাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা একমত। শুধু আমাদের যদি একটু ধৈর্য আর ইচ্ছে থাকে তাহলে একমত হতে অসুবিধা নেই।
উড্রো উইলসনের এই বক্তব্যের সঙ্গে জন, ডি, রকফেলার জুনিয়রের চেয়ে আর বেশি কেউ একমত হননি। সেটা ১৯১৫ সাল, রকফেলার ছিলেন কলোরাডোর সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ! আমেরিকার শিল্পজগতের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত এক ধর্মঘট দুবছর ধরে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। কলোরাডোর কলহপ্রিয় শ্রমিকরা কলোরাডো লৌহ প্রতিষ্ঠানের কাছে অতিরিক্ত মজুরি দাবি করে চলেছিল। রকফেলার ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন। বহু সম্পত্তি এতে ধ্বংস হয়, সৈন্যবাহিনীকেও ডাকতে হয়। প্রচুর রক্তপাত ঘটে, ধর্মঘটীদের দেহ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
এই রকম সময়ে, আকাশ বাতাস যখন ঘৃণায় আচ্ছন্ন রকফেলার ধর্মঘটিদের নিজের মতে আনতে চাইছিলেন। আর তিনি তা পেরেও ছিলেন। কিভাবে? সেই কাহিনীই এখানে বলছি। কয়েক সপ্তাহ বন্ধুত্ব করে রকফেলার ধর্মঘটিদের প্রতিনিধিদের কাছে বক্তৃতা দিলেন। সেই বক্তৃতাকে অনেক অর্থেই একটা অপূর্ব সৃষ্টি বলা যেতে পারে। এতে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া যায়। এতে রকফেলারের চারপাশে যে ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল সেই ভাবটি সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায়। এর ফলে তার কিছু আবার স্তাবকও জুটে গেল। এতে এমন সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণভাবে সব বলা হয়েছিল যে, ধর্মঘটিরা যে মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে ওই রক্তাক্ত পথে লড়াই করেছিল সে সম্পর্কে উচ্চবাচ্য না করেই কাজে যোগদান করল।
নিচে সেই অপূর্ব বক্তৃতার গোড়াটি উদ্ধৃত করছি। লক্ষ করবেন কীভাবে এটা ক্রমশ বন্ধুত্বের আলো ছড়াতে শুরু করেছিল।
মনে রাখবেন রকফেলার যাদের সামনে কথা বলেছিলেন সেইসব মানুষ কয়েকদিন আগে তাঁকে একটা টক আপেল গাছে গলায় ফাঁস দিয়ে মারার কথা বলেছিল। তা সত্তেও রকফেলার যা ব্যবহার করেন তার চেয়ে ভাল কিছু আর আশা করা যায় না–তিনি যেন একদল স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তারের সভায় কথা বলছেন। তাঁর বক্তৃতায় পাওয়া যায় এমন সব কথা, যেমন–এখানে আসতে পেরে আমি গর্বিত বোধ করছি। আপনাদের বাড়িতে গিয়ে, আপনাদের স্ত্রী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচিতি হয়ে, আমি এখানে আজ অপরিচিত অবস্থায় আসি নি, আমি এসেছি বন্ধু হিসেবে পারস্পরিক বন্ধুত্ব, সাধারণ স্বার্থ আর আপনাদের দয়াতেই আমি এখানে এসেছি।
‘এ আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন’, রকফেলার শুরু করেন এইভাবে। জীবনে এই প্রথম এই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের প্রতিনিধি, অফিসার আর সুপারিন্টেন্ডেন্টদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেলাম। আমি আপনাদের কথা দিতে পারি আমি এখানে এসে আজ গর্বিত আর যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন একথা আমি মনে রাখব। এই সভা যদি মাত্র দু’সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত হতো তাহলে আমি এখানে থাকলে মাত্র কয়েকজনকেই বোধহয় চিনতে পারতাম। দক্ষিণের কয়লাখনি অঞ্চলের সমস্ত শিবিরগুলি গত সপ্তাহে ভ্রমণ করার সুযোগ পাওয়ায় একমাত্র যারা ছিল না তারা ছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে আমরা এখানে অপরিচিত অবস্থায় আসিনি, এসেছি বন্ধুভাবে। আর এই পারস্পরিক বন্ধুত্বের মধ্যেই আমি খুশি যে আমাদের সব রকম সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করতে পারব।
যেহেতু এটি প্রতিষ্ঠানের অফিসার এবং কর্মচারি প্রতিনিধিদের সভা, অতএব আপনাদের অনুগ্রহেই আমি এখানে এসেছি, যেহেতু আমি এর কোনটি হওয়ার মত সৌভাগ্যবান হতে পারিনি। তা সত্ত্বেও আমি অনুভব করি আমি আপনাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবেই জড়িত, যেহেতু বলতে গেলে আমি স্টকের মালিক আর অংশীদারদের পক্ষে এসেছি।
শত্রুদের বন্ধু করে তোলার জন্য এই কৌশলটা কি চমৎকার কোন উদাহরণ নয়? ধরুন রকফেলার যদি অন্য কোন পথ নিতেন? ধরুন তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়ে তাদের মারাত্মক বাস্তব ঘটনাগুলো তাদের সামনে মেলে ধরতেন? ধরা যাক তিনি তার কথাবার্তায় তাদের ইঙ্গিত করতেন তাদের ভুল হচ্ছে। এটাও ধরুন তর্কশাস্ত্র অনুযায়ী তিনি প্রমাণও করতে পারলেন তাদের ভুল হয়েছে, তাহলে কি ঘটতো? এতে জন্মাত আরও ক্রোধ, আরও ঘৃণা আরও বিরোধিতা।
আপনার প্রতি যদি কোন মানুষের ভালো ধারণা থাকে, তাহলে কখনই আপনি তাকে নিজের মত কোন তর্কশাস্ত্রের সাহায্যেই আনতে পারবেন না। ধমকদানকারী বাবা-মা, হুকুমকারী মালিক আর স্বামী বা ঘ্যানঘ্যানে স্ত্রীদের বোঝা দরকার যে মানুষ কখনই তাদের মন বদলাতে চায় না। তাদের কোনভাবেই জোর করে আপনার বা আমার মতের বশবর্তী করা যাবে না। কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ নম্র ব্যবহার করলে তাদের হয়তো কিছুটা নমনীয় করতে পারা যাবে।
ঠিক এই কথাটাই প্রায় একশ বছর আগে বলেছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন :
‘এটা একটা পুরনো প্রবাদ যে, এক গ্যালন দুর্গন্ধ পদার্থে যত মাছি এসে বসে তার চেয়ে ঢের বেশি বসে এক ফোঁটা মধুর উপর। অতএব মানুষের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। আপনি যদি কোন মানুষকে আপনার মতের বশবর্তী করতে চান তাহলে প্রথমেই তাকে বুঝিয়ে দিন আপনি তার প্রকত বন্ধু। এর মধ্যেকার এক ফোঁটা মধুই তার হৃদয় আকর্ষণ করবে। আর এটাই তার হৃদয়ে পৌঁছবার একমাত্র পথ।
ব্যবসায়ীরা আজ বুঝতে পারছেন ধর্মঘটীদের সঙ্গে বন্ধুর মত ব্যবহার করলে আখেরে কাজ দেয়। যেমন উদাহরণ হিসেবে, হোয়াইট মোটরকার কোম্পানির আড়াই হাজার কর্মচারি যখন মাইনে বাড়ানোর দাবীতে ধর্মঘট করে, সেই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট রবার্ট এফ, ব্ল্যাক কখনই তাদের সম্পর্কে কোন নিন্দাবাদ করেননি বা ভীতি প্রদর্শন বা কমিউনিষ্ট আখ্যাও দেননি। বরং তিনি ধর্মঘটীদের প্রশংসাই করেন। তিনি ক্লীভল্যাণ্ডের খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন প্রচার করে জানান, কি শান্তিপূর্ণ পথেই না তারা তাদের কাজের যন্ত্র নামিয়ে রেখেছে। ধর্মঘটী পাহারাদারদের একটু আয়েসী হতে দেখে তিনি তাদের কয়েক ডজন বেসবল ব্যাট আর দস্তানা কিনে দিয়ে ফাঁকা এক মাঠে তাদের খেলতে আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট ব্ল্যাকের ওই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের ফলে যা হয় তাই হয়েছিল–তাতে অনেকেই তাঁর বন্ধু হয়ে পড়ে। এরপরেই ধর্মঘটীরা ঝাঁটা, বুরুশ এনে কারখানা সাফাই করতে শুরু করলো। একবার ব্যাপারটা ভাবুন! ধর্মঘটীরা বেশি মাইনে আর ইউনিয়নের স্বীকৃতি দাবী করেও কারখানা সাফাই শুরু করেছে। আমেরিকার শ্রমিক ধর্মঘটের ইতিহাসে এমন ব্যাপার আর কোনদিনই শোনা যায়নি। এক সপ্তাহের মধ্যেই মিটমাট হয়ে সব ঝামেলা দূর হলো–কোনরকম মনোমালিন্য বা বিদ্বেষ ছাড়াই এটা হয়।
ড্যানিয়েল ওয়েবস্টার, যিনি দেবতার মত সুপুরুষ ছিলেন আর জিহোভার মতই কথা বলতেন, তিনি ছিলেন একজন অতি বিখ্যাত আর সফল আইনবিদ। তা সত্ত্বেও তিনি সওয়াল করতেন এই রকম বন্ধুত্বপূর্ণ পথে : ‘এটা জুরীদের বিচার করে দেখতে হবে, অথবা ‘ভদ্রমহোদয়েরা এই ব্যাপারটি ভেবে দেখলে বোধহয় ভাল হয়, বা এই ব্যাপারগুলি আশাকরি আপনাদের খেয়াল থাকবে’, বা আপনাদের মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে জ্ঞানের জন্যে নিশ্চয়ই এই ঘটনাগুলির গুরুত্ব অনুধাবন করবেন। কোনরকম জোর বা চাপ দিয়ে নয়। নিজের মতামত কোনবারেই তিনি অপরের উপর চাপিয়ে দিতে চাননি। ওয়েবস্টার কাজে লাগান তাঁর শান্ত, বন্ধুত্বপূর্ণ ভঙ্গীকেই, আর তাই তাঁকে খ্যাতিমান হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
আপনাকে কখনও হয়তো কোন ধর্মঘট মীমাংসার জন্য বা কোন জুরীকে কিছু বোঝানোর জন্য যেতে হবে না, তবে আপনি হয়তো আপনার বাড়িভাড়া কমাতে চাইতে পারেন। তাতে কি এই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার কাজে আসবে? আসুন সেটাই একবার দেখা যাক।
ও. এল. ঐব একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি তাঁর ভাড়া কমাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বেশ ভালোমতই জানা ছিল তাঁর বাড়িওয়ালাটি বেশ পোড় খাওয়া মানুষ। মিঃ ঐব লিখেছিলেন যে কথা তিনি আমার প্লানে বলেন, আমি তাঁকে লিখেছিলাম যে আমার লীজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার এ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দেব। আসল সত্যটা হল আমি ছাড়তে ইচ্ছুক ছিলাম না। ভাড়া যদি কমানো যায়। আমি থেকে যেতেই চাইছিলাম। তবে অবস্থাটা নিরাশব্যঞ্জকই ছিল। বাকি ভাড়াটিয়ারা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। প্রত্যেকেই আমায় জানায় যে ওই মালিকের সঙ্গে কথা বলাই শক্ত। কিন্তু আমি নিজেকে বললাম : ‘আমি মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের কৌশল শিখেছি, ব্যাপারটা ওঁরই উপর কাজে লাগাতে চেষ্টা করব। দেখতে হবে ফল কি হয়।
তিনি আর তার সেক্রেটারি আমার চিঠি পেয়েই দেখা করতে এলেন। আমি তাদের চার্লি শোয়াবের কায়দাতেই দরজার সামনে অভ্যর্থনা জানালাম। বলতে গেলে তাদের অভ্যর্থনার জোয়ারে ভাসিয়ে দিলাম। আমি একবারও বললাম না ভাড়া বড় বেশি। আমি শুরু করলাম তাঁর বাড়িটা কত আরামের এই কথা বলেই। বিশ্বাস করুন আমি সহৃদয়তার সঙ্গে আন্তরিক প্রশংসা করলাম, বাড়িটা তিনি যেভাবে রেখেছেন তার প্রশংসাও করলাম। আমি বললাম আরও একবছর আমার থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু আমার সামর্থ্য নেই।
‘কোন ভাড়াটের কাছ থেকে এমন অভ্যর্থনা পাবেন তিনি মোটেও আশা করেন নি। একজন চৌদ্দটা চিঠি লিখেছিল। তার কয়েকটা আবার রীতিমত অপমানজনক। আর একজন লিখেছিলেন লীজ ছেড়ে দেবেন তিনি যদি না উপরের তলায় ভাড়াটিয়ার নাক ডাকা বন্ধ না করতে পারেন। আপনার মত ভদ্র ভাড়াটে পাওয়া অত্যন্ত আনন্দের’ ভদ্রলোক বললেন। এরপর আমি না চাইতেই তিনি আমার ভাড়া কিছুটা কমিয়ে দিলেন। আমি আরও চাইছিলাম, তাই একটা টাকার অঙ্ক বলতেই তিনি বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নিলেন।
তিনি বিদায় নেবার সময় হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ঘর কি রকম সাজালে ভালো হয়?
আমি যদি অন্য ভাড়াটেদের কৌশলে ভাড়া কমাবার চেষ্টা করতাম, তাহলে আমি নিশ্চিত যে অন্যরা যেমন ব্যর্থ হয়েছেন আমিও তাই হতাম। আমার নির্দিষ্ট ওই বন্ধুত্বপূর্ণ, সহানুভূতিসম্পন্ন, প্রশংসাময় কথার জন্যেই জয়ী হলাম।
আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি। এবার একজন মহিলার ব্যাপার। তিনি লঙ আইল্যাণ্ডের গার্ডেন সিটির নামী সামাজিক এক মহিলা, নাম মিসেস ডরোথী ডে।
মিসেস ডে লিখেছিলেন, ‘আমি সম্প্রতি কিছু বন্ধুকে এক ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করি। কাজটা আমার পক্ষে খুবই জরুরী ছিল। আমি সব কিছু ভালভাবে মিটুক তাই চাইছিলাম। তাই নামকরা হোটেলের প্রধান পাঁচক এমিলকেই আমায় সাহায্য করার জন্য লাগাতাম। কিন্তু এবার সে আমায় ডুবিয়ে দিল। এমিলকে কোথাও পেলাম না। ভোজটা মোটেই ভালো হলো না। সে শুধু একজন পরিবেশনকারীকে পাঠিয়েছিল কাজের জন্য। লোকটার প্রথম শ্রেণীর কাজে কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। সে আমার প্রধান মানী অতিথিকে সবার শেষে পরিবেশন করেছিল। একবার সে বেশ অখাদ্য খাবার মস্ত এক ডিসে পরিবেশন করলো তাঁকে। মাংসটাও বেশ শক্ত আর আলুগুলোও আঠালো। যাচ্ছেতাই ব্যাপার, আমি রেগে আগুন হয়ে গেলাম। প্রাণপণ চেষ্টায় কোন রকমে হাসিমুখে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম। কিন্তু মনে মনে বলতে লাগলাম, এমিলকে একবার পাই। মনের সুখে তাকে গায়ের ঝাল ঝাড়বো’।
ব্যাপারটা ঘটে বুধবার। পরের রাতেই মানবিক সম্পর্ক নিয়ে একটা বক্তৃতা শুনলাম। শুনতে শুনতে বুঝতে পারলাম এমিলকে গালাগাল দিয়ে কিছুই আসে যাবে না। এতে কেবল সে গম্ভীর হয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকবে। এর ফলে ভবিষ্যতে তার কাছ থেকে আমি আর কোনরকম সাহায্য পাব না। আমি ব্যাপারটা তার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে চাইলাম। সে খাবার কেনেনি বা রান্নাও করেনি। তার কিছু পরিবেশনকারী বোকা হওয়ার জন্য সে দায়ী নয়। সম্ভবত আমি একটু তাড়াহুড়ো করেই সব ভেবে বসেছিলাম। তাই তার সমালোচনা করার বদলে আমি বন্ধুত্বের স্বরেই কথা বলতে শুরু করলাম। আমি ঠিক করলাম ওর প্রশংসা করেই শুরু করবো। এইরকম ভঙ্গীতে চমৎকার কাজ হল। পরের দিন এমিলের সঙ্গে দেখা হল আমার। এমিল মনে মনে বেশ রেগে লড়াই করার জন্যেই তৈরি ছিল। আমি বললাম, ‘দেখ, এমিল, তুমি হচ্ছে নিউ ইয়র্কের সবার সেরা পাঁচক। অবশ্য, আমি বুঝতে পারছি খাবার তুমি কেনোনি বা নিজে রান্নাও করোনি। বুধবার যা ঘটেছে তার জন্য তুমি কোনভাবেই দায়ী নও। আমি চাই তুমি ভবিষ্যতে আমায় সাহায্য করবে।‘
সব মেঘ কেটে গেল। হাসলো এমিল, তারপর বললো সঠিক বলেছেন, মাদাম। গণ্ডগোলটা হয় রান্নাঘরে। এটা আমার দোষ নয়।
অতএব আমি বললাম, আমি অন্য এক পার্টির ব্যবস্থা করেছি, এমিল আমার ইচ্ছা তুমিই আমায় সাহায্য করো। আমি তোমার পরামর্শ চাই। তোমার কি মনে হয় ওই রান্নাঘরে আবার রান্না করতে দেব?’
‘ওহ্ নিশ্চয়ই, মাদাম, অবশ্যই। এরকম ভুল আর হবে না।’
পরের সপ্তাহে আমি আবার একটা মধ্যাহ্নভোজ দিই। এমিল আর আমি মেনু ঠিক করি। আমি আগের ভুলের একবারও উল্লেখ করিনি।
আমরা যখন উপস্থিত হলাম, দেখলাম খাবার টেবিলে দু ডজন চমৎকার লাল আমেরিকান গোলাপ ফুল রাখা আছে। সারাক্ষণই হাজির রইল এমিল। কুইন মেরী অথবা কাল-মহারাণীকে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করলেও সে বোধহয় এর চেয়ে বেশি যত্ন করতে পারত না। খাবারগুলো যেমন সুস্বাদু আর তেমনই গরম ছিল। পরিবেশনও চমৎকার। একজনের বদলে চারজন পরিবেশন করছিল। শেষ কালে এমিল নিজে আইসক্রীম পরিবেশন করল।
বিদায় নেবার সময় আমার নানা অতিথি বললেন, আপনি কি ওই পাঁচককে বশ করেছেন? এমন চমৎকার পরিবেশন আর যহ তিনি আগে কখনও দেখেন নি।
.
তিনি ঠিকই বলেছিলেন। আমি তাকে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার আর আন্তরিক প্রশংসা দিয়েই বশ করি।
অনেকদিন আগে আমি যখন খালি পায়ে গ্রামের স্কুলে যাওয়ার সময় মিসৌরীর উত্তর পশ্চিমের কোন জঙ্গল পার হতাম তখন সূর্য আর বাতাসের একটা নীতিগল্প পড়েছিলাম। তারা ঝগড়া করছিল দুজনের মধ্যে কার শক্তি বেশি তাই নিয়ে। বাতাস বলল, আমি প্রমাণ করতে পারি আমারই জোর বেশি। ওই কোট গায়ে বুড়ো লোকটিকে দেখছ। আমি বাজী রাখতে পারি তোমার চেয়ে তাড়াতাড়িই আমি ওর গায়ের কোট খোলাতে পারি।
সূর্য তখন মেঘের আড়ালে সরে গেল আর বাতাস এমন প্রচণ্ড বেগে বইতে লাগল যেন প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। কিন্তু বাতাস যতই জোরে বইতে শুরু করল বুড়ো লোকটি তার কোট ততই চেপে রাখতে চাইল।
শেষ পর্যন্ত বাতাস হতাশ হয়েই হাল ছেড়ে দিল। সূর্য তখন মেঘের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে দয়ার্দ্র ভঙ্গিতে লোকিটর দিকে তাকিয়ে হাসলো। লোকটি তার কপাল মুছে নিয়ে গায়ের কোট খুলে ফেলল। সূর্য তখন বাতাসকে বলল তা আর দয়ার্দুভাবই ক্রোধ আর শক্তির চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী।
এই নীতিগল্প পড়ার সময় আমি ছেলেমানুষ থাকলেও এর সত্যতা বহুদূরের বোস্টন শহরে প্রমাণিত হয়ে চলেছিল। সংস্কৃতি আর শিক্ষার প্রাচীন যে জায়গাটা আমি স্বপ্নেও কোনদিন দেখব বলে ভাবিনি। এটা বোস্টনে হাতে কলমে দেখাচ্ছিলেন ড. এ. এইচ. বি। তিনি ছিলেন নামকরা একজন চিকিৎসক, ত্রিশ বছর পরে তিনি আমার ছাত্র হয়েছিলেন। এখানে ড. বি-এর বলা কাহিনী শোনাচ্ছি।
বোস্টনে সে সময় সংবাদপত্রে নানা ধরনের বাজে ডাক্তারী বিজ্ঞাপন প্রচুর পরিমাণে ছাপা হত। এইসব বিজ্ঞাপনে মানুষের নানা গোপন রোগ সারানোর কথা ফলাও করে লিখত আর তাদের আহ্বান জানাত। তারা পুরুষত্ব হারাবার ভয় দেখিয়ে আতঙ্কিত করত। তাদের চিকিৎসার পদ্ধতিই ছিল রোগীকে ভীত করে তোলা আর আসলে কোন রকম চিকিৎসাই না করা। এর ফলে বহু লোক মারাও যায়, কিন্তু এজন্য শাস্তি তেমন দেওয়া যায়নি। বেশির ভাগই সামান্য জরিমানা দিয়ে বা রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে ছাড়া পেয়ে যায়।
অবস্থাটা এমনই গুরুতর পর্যায়ে নেমে আসে যে বোস্টনের সৎ লোকজন একসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। গির্জায় পাদ্রীরা বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন, খবরের কাগজের বিরুদ্ধেও বলে ঈশ্বরকে কাতর প্রার্থনা জানাতে লাগলেন। নাগরিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী, মহিলা সমিতি, গির্জা, তরুণদের ক্লাব–সবাই এর বিরুদ্ধে কোন আইন প্রণয়ন সম্ভব হলো না, রাজনৈতিক চাপের ফলে। ডঃ বি-তখন ছিলেন বোস্টনের সৎ নাগরিক সমিতির চেয়ারম্যান। তাঁর সমিতি সব রকম চেষ্টাই করেছিল। এটা ব্যর্থ হয়। ওইসব ডাক্তার অপরাধীদের বিরুদ্ধে সব লড়াই-ই হতাশ বলেই মনে হতে থাকে।
তখন এক রাতে, প্রায় মাঝরাতের পর ডঃ বি–এমন কিছু করতে চাইলেন যা বোস্টনে আগে কেউ কখনও ভাবেনি। তিনি দয়ালুভাব, সহানুভূতি, আর প্রশংসা দিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করলেন। তিনি চেষ্টা করলেন যাতে প্রকাশকরা ওই বিজ্ঞাপন প্রকাশ স্থগিত রাখতে চায়। তিনি ‘দি বোস্টন হেরাল্ডে’র সম্পাদককে লিখলেন, কাগজটা তিনি কত ভালবাসেন। তিনি বরাবর এটাই পড়ে এসেছেন, খবরের অংশগুলি পরিচ্ছন্ন, উত্তেজনার ব্যাপারে থাকে না, সম্পাদকীয় তো চমৎকার। কাগজটি পরিবারে পক্ষে আদর্শ। ডঃ বি-জানান যে তাঁর মতে কাগজটি নিউ ইংল্যাণ্ড আর এমন কি আমেরিকার মধ্যেও শ্রেষ্ঠ। তিনি লেখেন, ‘আমার এক বন্ধুর একটি অল্প বয়সের মেয়ে আছে। সে সেদিন একটা বিজ্ঞাপন জোরে জোরে পড়ে তার কিছু অর্থ জানতে চায়! সত্যিই আমার বন্ধুটি একটু বিহ্বল হয়ে পড়েন, কি বলবেন বুঝতে পারেন না। আপনাদের কাগজ বোস্টনের সেরা পরিবারেই যায়। আমার একজন বন্ধুর পরিবারেই যদি এইরকম ঘটে তাহলে আরও কত বাড়িতে যে ঘটছে কে জানে? আপনার যদি কোন অল্পবয়সী মেয়ে থাকে তাহলে কি চাইবেন সে ওই পড় ক? আর পড়ে সে ওই রকম প্রশ্ন করলে কি উত্তর দেবেন?
আমি দুঃখিত যে আপনাদের এমন সুন্দর কাগজ-সবদিক দিয়েই যা আদর্শ–তাতে দেওয়া এমন বিজ্ঞাপন দেখে সবাই আতঙ্কিত। এটাও কি সম্ভব নয় আমার মত আরও পাঠক একই ভয় পাচ্ছেন?’
দুদিন পরে বোস্টন হেরাল্ডের প্রকাশক ডঃ বি কে একটা চিঠি লিখেছিলেন। ডঃ বি–চিঠিখানা আমার ক্লাসে যোগদান করে আমাকে দেন। ডঃ বি-সেটা প্রায় ত্রিশ বছর রেখেছিলেন। সেটা এই কাহিনী লেখার সময় আমার সামনেই রয়েছে। এই চিঠির তারিখ হলো ১৩ই অক্টোবর ১৯০৪।
এ. বি. এইচ–, এম. ডি.
বোস্টন, মাস।
প্রিয় মহাশয়,
আপনার এ মাসের ১১ তারিখের চিঠির জন্যে আমি অত্যন্ত বাধিত। আপনি সম্পাদককে চিঠিটি লিখলেও আমিই জবাব দিচ্ছি। এই কাগজের তত্ত্বাবধানে থাকার পর থেকেই একটি সিদ্ধান্ত নেবার কথা আমাকে চিন্তা করতে হচ্ছিল।
সোমবার থেকে দি বোস্টন হেরাল্ডে সবরকম আপত্তিকর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে। কোন রকম বাজে ডাক্তারি বিজ্ঞাপন আর কোন ভাবেই প্রকাশ করা হবে না। যে সব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হবে তা সংশোধন ও পরীক্ষা করেই ছাপা হবে।
আবার আপনাকে আপনার চিঠির জন্য ধন্যবাদ জানাই। এ চিঠি আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেছে।
আপনার বিশ্বস্ত,
ড. এ. ন্যাসকেল
প্রকাশক।
.
ঈশপ ছিলেন একজন গ্রীক ক্রীতদাস। তিনি ক্রোসাসের রাজসভায় থেকে খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে অমর কিছু নীতি গল্প লিখেছিলেন। তা সত্ত্বেও যে সত্য তিনি মানব চরিত্র সম্পর্কে লিখে গেছেন তা আজ এথেন্সের ২৫ শতক পরেও বোস্টন বা বার্মিংহামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সূর্য ঢের বেশি তাড়াতাড়ি আপনার কোট খুলে নিতে পারে–তেমনই আবার দয়ার্দ্রতা, বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার বা প্রশংসা ও অন্যান্য যে কোন উপায়ের চেয়ে ঢের দ্রুত কাজ করে মানুষের মন পরিবর্তন করতে পারে।
লিঙ্কন কি বলেছিলেন মনে রাখবেন : ‘এক ফোঁটা মধু এক গ্যালন তেতো জিনিসের চেয়ে বেশি মাছিকে আকর্ষণ করে।’
যখন মানুষকে নিজের মতে আনতে চাইবেন তখন চার নম্বর নীতিটি ভুলবেন না :
‘বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার দিয়েই শুরু করবেন।‘