১৩. শুক্রবার অফিসে গিয়েই

শুক্রবার অফিসে গিয়েই তরুণ খবর পেল, ইন্দ্রাণীকে খুঁজে বার করবার জন্য ফরেন মিনিস্ট্রি যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।

খবর পাঠিয়েছেন বন এম্বাসী থেকে ফার্স্ট সেক্রেটারি মিঃ কাপুর।

মেসেজটা পেয়ে খুশিতে ভরে গেল সারা মন। বার বার পড়ল কেবগ্রামটা। ফরেন অ্যাসিওরড এভরি পসিবল অ্যাকশান, ট্রেস ইন্দ্রাণী।

বুঝতে অসুবিধা হলো না, মিঃ ট্যাভনের জন্যই এত চটপট বন থেকে আর্জেন্ট মেসেজ গেছে দিল্লিতে। অ্যাম্বাসেডরও নিশ্চয়ই বেশ ভালো করে লিখেছিলেন। তা নয়তো এত চটপট উত্তর?

ফরেন মিনিস্ট্রির অনেক অসুবিধে। সারা দুনিয়ায় পঞ্চশীল প্রচার করতে অনেকের দ্বিধা থাকলেও সহকর্মীদের এসব সাহায্য সহযোগিতা করতে কারুর দ্বিধা নেই। বরং আগ্রহই বেশি।

পাকিস্তান এক বিচিত্র দেশ। রাজনৈতিক ব্যাপারে পাকিস্তানের মতিগতি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু অরাজনৈতিক ব্যাপারে সাধারণত সাহায্য করার চেষ্টা করে। তার অবশ্য কারণ আছে। যে কোনো পাকিস্তানীর বিপদ-আপদে ভারত সরকার সাহায্য করতে শুধু আগ্রহী নয়, উন্মুখ। দিল্পির পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে হরদম এই ধরনের অনুরোধ আসছে এবং সর্বশক্তি দিয়ে ভারত সরকার সে সব অনুরোধের মর্যাদা রাখতে চেষ্টা করে।

দেশটা দুটুকরো হলেও আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে রয়েছে দুদেশেই। বিয়েসাদীতে যাতায়াত করতেই হয় ওদের। লক্ষ্ণৌতে শ্বশুরের মৃত্যু হলে লাহোর থেকে ছুটে আসতে হয় মেয়ে-জামাইকে।

আরো কত কি হয়। এইতো সেবার পাকিস্তান হাইকমিশনের এক থার্ড সেক্রেটারির স্ত্রী সন্তান প্রসবের পরই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ভদ্রমহিলা তার মাকে কাছে পাবার জন্য। বড় ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। ভারত সরকারের সাহায্যে একদিনের মধ্যে তাকে আনা হয় পেশোয়ার থেকে দিল্লি। ভারত সরকারের ঔদার্যে ও তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে কয়েকদিন পর পাকিস্তানের ফরেন সেক্রেটারি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের বহু বড় বড় অফিসারের অসংখ্য আত্মীয়স্বজন উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ছড়িয়ে আছেন। ভারত সরকারের ঔদার্যে ও সহযোগিতায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ পাকিস্তানীরাই বেশি উপকৃত হন। সেজন্য ভারত সরকার থেকে সাধারণ কোনো অনুরোধ গেলে এরাও যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করেন।

তরুণ এসব জানে। দিল্লিতে থাকতে ওর কাছেই কত অনুরোধ এসেছে। তাই তো বন থেকে মেসেজটা পেয়ে মনে হলো, বোধহয় অন্ধকার রাত্রির মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, নতুন দিনের আলো আত্মপ্রকাশ করার সময় সমাগত।

মিঃ দিবাকর কতকগুলো ফাইল নিয়ে এলেন কিন্তু তরুণের ইচ্ছা করল না ওগুলোয় হাত দিতে।

এক্সকিউজ মি মিঃ দিবাকর, আজ এগুলো রেখে দিন। সোমবার দেখব। আজ আমি উইকলি রিপোর্টটা রেডি করে দিচ্ছি। আপনি ওটা আজই পাঠিয়ে দিন।

সব দেশের সব ডিপ্লোম্যাটিক মিশনের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে উইকলি পলিটিক্যাল ডেসপ্যাঁচ পাঠানো। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ওলটপালট হয়ে যেতে পারে, ডিপ্লোম্যাট মরুক বাঁচুক, উইকলি রিপোর্ট ঠিক সময়ে যাবেই। তাছাড়া বার্লিনের গুরুত্বই আলাদা। বন-এ এম্বাসী এই রিপোর্টের ভিত্তিতে দিল্লিতে রিপোর্ট পাঠাবে এবং তার ভিত্তিতেই দিল্লি তার নীতি ও কার্যধারা ঠিক করবে। সুতরাং ইন্দ্রাণীর স্বপ্নে মশগুল হয়েও তরুণ পলিটিক্যাল রিপোর্ট পাঠাতে দেরি করল না।

রিপোর্টটা ফাইনাল চেক আপ করে নিজে হাতে সিল করে তরুণ তুলে দিল মিঃ দিবাকরের হাতে। হাসতে হাসতে বলল, এই নিন। আই হোপ আই উইল নট সী ইউ বিফোর মনডে!

দিবাকর বিদায় নেবার পর তরুণ আবার কেবগ্রামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ কি মনে হলো। চিঠি লিখতে বসল বন্দনাকে।

প্রায় তিন সপ্তাহ আগে তোমার চিঠি পেয়েও জবাব দিতে পারিনি। প্রিয়জনের চিঠির উত্তর আমি চটপট দিই না, তা তুমি জান। যাদের ভালোবাসি অথচ কাছে পাই না, তাদের চিঠি পেলে বড় ভালো লাগে। বার বার পড়ি সে সব চিঠি। একদিন নয়, পর পর কয়েকদিন ধরে। পড়ি। তোমার চিঠিটাও পড়েছি বেশ কয়েকদিন ধরে। উত্তর দিলেই তো সব শেষ! যতক্ষণ উত্তর না দিই ততক্ষণে মনে হয় চিঠির মধ্য দিয়ে তোমাদের দেখতে পাচ্ছি, কথা শুনতে পাচ্ছি। আমি উত্তর দিলেই তো তোমাদের আর দেখতে পাব না, কথা শুনতে পাব না! তাই, সেই ভয়ে উত্তর দিতে দেরি করি।

তবুও এত দেরি হওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু এমন কতকগুলো আজেবাজে লোকের উৎপাতে বিব্রত ছিলাম যে অফিসের কাজকর্মও ঠিক করতে পারিনি। তবে আজ আর চিঠি না লিখে পারলাম না। আজই এম্বাসি থেকে খবর পেলাম ফরেন মিনিস্ট্রি ইন্দ্রাণীর খোঁজ নেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে রাজি হয়েছে। খবরটা পেলে তুমি অনেকটা আশ্বস্ত হবে, খুশি হবে, তাই আর দেরি করলাম না।

চিঠির শেষে তরুণ একথাও লিখল, জানি না ইন্দ্রাণীকে পাওয়া যাবে কিনা; জানি না তাকে আর কোনোদিন দেখতে পাব কিনা তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এইটুকু মনে হয় তার সঠিক খবর হয়ত এবার পাওয়া যাবে।…

এই পৃথিবীটা মহাশূন্যের মাঝে থেকেও ঠিক নিয়মমাফিক নিত্য চব্বিশ ঘণ্টা ঘুরপাক খাচ্ছে। নিয়ম মত চন্দ্র-সূর্য উঠছে, অস্ত যাচ্ছে। গঙ্গায় জোয়ার-ভাটা খেলছে, অমাবস্যা-পূর্ণিমা হচ্ছে। দুনিয়াটা এমনি করেই চলছে। এই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো মানুষ ও প্রকৃতিরও একটা অদৃশ্য শক্তি আছে। পাহাড়ের কোলে জন্ম নেয় যে নদী, সে ছুটে যায় সমুদ্রের কোলে। মহাসমুদ্রের অনন্ত জলরাশির মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দেওয়াই তার সাধনা, তার ধর্ম। সমুদ্রের আকর্ষণেই নদী ছুটে আসে, ছেড়ে আসে তার শ্বেতশুভ্রূ পবিত্র হিমালয়-শৃঙ্গের আসন। যে। হিমালয় সবাইকে হাতছানি দেয়, সেই পর্বতরাজকে ত্যাগ করতে নদীর দ্বিধা নেই, কুণ্ঠা নেই। বরং আনন্দ আছে, আছে পরিতৃপ্তি। তাই তো সে ক্ষীণধারা নাচতে নাচতে নেমে আসে, হাসতে হাসতে সমতলভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়। সে ক্ষীণধারা হিমালয়তুঙ্গে বা তরাই-এর জঙ্গলে প্রায় পরিচয়হীন থাকে, সমতলভূমিতে অসংখ্য মানুষের স্পর্শে সে অনন্য হয়, সে বিরাট বিশাল হয়। সমুদ্রের মুখোমুখি সে দিগন্তবিস্তৃত হয়।

তরুণও ছুটে চলেছে সেই অনন্তবিস্তৃত অজ্ঞান ভবিষ্যতের দিকে। ইন্দ্রাণীর আকর্ষণে। হয়তো বা মিথ্যা প্রত্যাশা, মরীচিকা। জানে না। অন্ধকার ভবিষ্যৎ তার জানা নাই। তবুও এই একটু ক্ষীণ আলোয় সে যেন বিভোর হয়ে গেছে। তাই তো বন্দনাকে চিঠি লিখতে বসে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

…বন্দনা, তোমার বয়স হয়েছে, বুদ্ধি হয়েছে। তার চাইতেও বড় কথা তুমি আমাকে ভালোবাস, আমার মঙ্গল কামনা কর, আমাকে দাদা বলে প্রণাম কর। তোমাকে না বলার কিছু নেই। আর পাঁচজন মেয়ের মতো ইন্দ্রাণী ঠিক সাধারণ মেয়ে ছিল না। সে বড় বেশি স্বপ্ন দেখত। বড় বেশি প্রত্যাশা করত আমার কাছ থেকে। বুড়িগঙ্গার পাড়ে বাস করে আমি ঠিক অত স্বপ্ন দেখতে পারতাম না, সাহস করতাম না, বাবা কোর্টে গেলে, মা বুড়ো শিববাড়িতে পূজা দিতে গেলে ও আসত আমার কাছে। বার বার করে বলত, বিনেকাকার মতো তুমি চমকে দিতে পারে না সবাইকে?

সেদিন কল্পনা করতে পারিনি ঢাকা বা কলকাতার বাইরে পা দেব, ভাবতে পারিনি কর্মজীবনের তাগিদে সাত-সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেব বার বার। ভাবতে পারিনি আরো অনেক কিছু। তাই তো আমি বলতাম, ভবিষ্যৎ কি আমার হাতে ইন্দ্রাণী?

ও প্রতিবাদ করত, পুরুষমানুষ হয়ে এমন কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না?

ওই কটা কথা বলতেই বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ত। এলো করে বাঁধা খোঁপাটা আরো ঢিলে হয়ে যেত।

খোঁপার কাঁটাগুলি ঠিক করতে করতে বলত, তুমি এবার বি-এ পরীক্ষা দেবে, আমিও কলেজে ভর্তি হলাম। এখনও কি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটু সচেতন হবার সময় আসেনি?

কত কথা আর লিখব? আমাকে নিয়ে যার বুকভরা আশা ছিল সে যদি বেঁচে থাকে তবে কিভাবে যে দিন কাটাচ্ছে, তা চিন্তা করতেও কষ্ট লাগে।

বন্দনাকে আর কিছু লিখল না। লিখতে পারল না। লেখা সম্ভবও নয়। সব মেয়েই স্বপ্ন দেখে। কেউ বেশি, কেউ কম। কিন্তু ইন্দ্রাণী যেন অসম্ভবকে প্রত্যাশা করত।

ঢাকা থেকে অনেক দূরে বার্লিনের ইন্ডিয়ান কনসুলেটে বসেও তরুণের মন উড়ে যায় সেই সোনালি দিনগুলিতে।…

বেশ বেলা হয়েছিল। তরুণ তবুও শুয়েছিল। টেস্ট পরীক্ষা যখন শেষ হয়েছে, তখন একটু বেলা করে উঠলেই বা কি? ওপাশের বড় জানলা দিয়ে রোদ্দুর আসছিল বলে পাশ ফিরে শুয়ে আর একবার চাঁদর মুড়ি দিল। তাছাড়া বাবা যখন ঢাকায় নেই, তখন চিন্তার কি?

কে যেন দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল? এক গোছা কাঁচের চুড়ির আওয়াজ হলো না? শুয়ে শুয়েই মুচকি হাসে তরুণ। এসেছে তাহলে ডাকাত মেয়েটা!

মুহূর্তের মধ্যেই কানে ভেসে এলো, মাসিমা।

কোণার ঘর থেকে তরুণের মা জবাব দিলেন, আমি এই কোণার ঘরে।

পরের কয়েক মিনিট আর কিছু শোনা গেল না ওদের কথাবার্তা। একবার পাশ ফিরে বারান্দার দিকে তাকাল। নাঃ, এখনও এদিকে আসার সময় হয়নি।

আরো কিছুক্ষণ কেটে গেল। তবুও ইন্দ্রাণীর কথা শুনতে পায় না। তবে কি চলে গেল?, তা কেমন করে হয়! একবার দেখা না করে কি যেতে পারে?

এতক্ষণ পর তরুণের হুশ হলো, বেশ রোদ্দুর উঠেছে। চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে বিশ্রী লাগল।

দুচার মিনিট আরো কেটে গেল। না, আর দেরি করে না। উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। গায়ে চাঁদরটা জড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে একবার এপাশ-ওপাশ দেখল। পটলের মাকে না দেখে বুঝল সে রান্নাঘরে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল কোণার ঘরের দোরগোড়ায়। তরুণ বেশ বুঝল, হঠাৎ দুজনের কথাবার্তা থেমে গেল।

কি ব্যাপার? সকালবেলাতেই তোমরা ফিসফিস করছ? চোখ রগড়াতে রগড়াতে তরুণ জানতে চায়।

মাথাটা দুলিয়ে বিনুনীটা ঘুরিয়ে ইন্দ্রাণী ঘাড় বেঁকিয়ে তরুণকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, একি মাসিমা খোকনদা এখন উঠল?

ইন্দ্রাণীর কথা শেষ হতে না হতেই তরুণ ভিতরে ঢুকে চেয়ারটা টেনে নেয়। ভাগ্যবান মাত্রেই বেলা করে ওঠে; তাতে এত অবাক হবার কি আছে? নির্বিকারভাবে উত্তর দেয় তরুণ।

হাজার হোক একমাত্র সন্তান। শাসন করার ভাষাটাও যেন স্বতন্ত্র। ওর কথা আর বলিস না মা!

একটা যেন চোরা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে তরুণের অজ্ঞাতে। ইন্দ্রাণীকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমার মতো একটা মেয়ে পেতাম! তবে ও জব্দ হতো।

মুহূর্তের জন্য দুজনে দুজনকে দেখে। দুজনের চোখগুলো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইন্দ্রাণী যেন একটু লজ্জাবোধ করে।

তরুণ একটু মোড় ঘোরাতে চেষ্টা করে। যদি পেতাম আবার কি? তোমার পাশেই তো বসে আছে।

একটু থেমে আবার বলে, আচ্ছা মা, তুমি কি মনে কর বল তো? এই রকম একটা মেয়ে আমাকে জব্দ করবে?

হঠাৎ পটলের মার গলার আওয়াজ শোনা গেল। তরুণের মা ছেলের কথার জবাব না দিয়ে হাতের সেলাই নামিয়ে রেখে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলেন।

তরুণ উঠে দাঁড়াল। ইন্দ্রাণীকে বলল, দেখো তো, এক কাপ চা খাওয়াতে পার কিনা!

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ইন্দ্রাণী বলল, মুখ ধুয়েছ?

তোমার হাতের চা খেলেই মুখ দেওয়া হয়ে যাবে।

এ আর মাসিমা পাওনি যে একমাত্র ছেলের সব আব্দার সহ্য করবেন।

তরুণ একটু মজা করার জন্য বলে, মাসিমার একমাত্র ছেলের মতো আমিও তো তোমার একমাত্র ধ্যান-ধারণা।

ঠোঁট উল্টে একটু চাপা হাসি হাসতে হাসতে ইন্দ্রাণী বলে, তা তো বটেই! যে ছেলে মুনসেফ কোর্টে ওকালতি করার স্বপ্ন দেখে, সে ছেলে আমার ধ্যান-ধারণা!

ডান হাতে বুড়ো আঙুলটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে তরুণ উত্তর দেয়, মুনসেফ কোর্টে প্র্যাকটিশ করবো আমি?

তোমার দ্বারা তার বেশি কি হবে?

হাজার হোক বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনোদিনই বিশেষ চিন্তার গরজ ছিল না। ম্যাট্রিকের পর আই-এ; আই-এ-র পর বি-এ, বি-এ-র পর এম-এ।

তারপর?

তারপর দেখা যাবে। মা আছেন, বাবা আছেন। তারপর ইন্দ্রাণী আছে। অত শত চিন্তার কি আছে।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তরুণের ঔদাসীন্যই ইন্দ্রাণীর অসহ্য। কল্পনাতীত। ছেলেবেলায় যার সঙ্গে। খেলা করেছে, যৌবনে যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখেছে সে তত শুধু ওয়াড়ির মাঠে ফুটবল খেলবে না, সে তো শুধু বুড়িগঙ্গার পাড়ে আড্ডা দেবে না, চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করবে না।

তবে?

তবে আবার কি? সে বড় হবে। অনেক বড় হবে। দশজনের মধ্যে একজন হবে। সে বিনেকাকা হবে। দেশ-বিদেশে পাড়ি দেবে, ঢাকার মানুষকে চমকে দেবে।

সেই ছোট্টকালে টফি-চকোলেট খাওয়াতে খাওয়াতে বিনেকাকা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। শিশু ইন্দ্রাণী বিস্মিতা না হয়ে পারেনি। যত বড় হয়েছে, তত বেশি মনে পড়েছে ওই বিনেকাকাকে। ঢাকার আর সবাই তো ঠিক একই রকম আছে! গঙ্গাজলি আর ইলিশ মাছ খেয়েই ওরা খুশি, সুখী। মনের মধ্যে একটা বিরাট শূন্যতা অনুভব করত। কারও কাছে প্রকাশ করত না। তরুণের কাছেও না। বড় হবার পর সেই শূন্যতা পূর্ণ করতে চেয়েছে কাছের মানুষকে দিয়ে।

তাই তো কথায় কথায় খোঁচা দিয়েছে তরুণকে।

ইন্দ্রাণী চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।

তরুণ হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢোকার পরই চা নিয়ে ইন্দ্রাণী এলো। চায়ের কাপটা ওর হাতে তুলে দিতে দিতে ইন্দ্রাণী বেশ একটা মিষ্টি হাসি কিছুটা চেপে রেখে বলল, জানো, এই সাতসকালে মাসিমা কেন ডেকেছিলেন?

চেয়ারের উপর পা দুটো তুলে বসতে বসতে তরুণ বলল, কেন?

মা বুঝি মাসিমাকে বলেছেন যে, ময়মনসিংহের কোনো এক ডাক্তারের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে…।

ভ্রূ দুটো কুঁচকে তরুণ বলে, কই, সে কথা তো আমাকে বলোনি।

আমিও ঠিক জানতাম না। মাসিমার কাছেই শুনলাম।

মা কি বললেন?

জানো, আমার বিয়ের সম্বন্ধের কথা শুনে মাসিমার ভীষণ রাগ।

কেন?

তা জানি না। তবে বেশ বুঝলাম যে আমি অন্য কোথাও চলে যাই, তা উনি চান না।

এবার পরম পরিতৃপ্তিতে চায়ের কাপে চুমুক দেয় তরুণ, আঃ! ফার্স্ট ক্লাস!

প্রায় মুখোমুখি টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণী জানতে চায়, কি ফার্স্ট ক্লাস?

মুখ না তুলেই জবাব দেয়, তুমি, মা, চা-সবাই ফার্স্ট ক্লাস!

বন্দনাকে চিঠি লেখার পর আপন মনে বসে থাকতে থাকতে এসব মনে পড়ছিল তরুণের। মনে পড়ছিল মার কথা। বড় ভালোবাসতেন ইন্দ্রাণীকে। নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। বড় ইচ্ছা ছিল মেয়েটাকে কাছে রাখার।

দু চারটে আজেবাজে বিয়ের সম্বন্ধ আসার পর আর থাকতে না পেরে শেষে ইন্দ্রাণীর বাবাকেই বলেছিলেন, দেখুন ঠাকুরপো, আমাকে না জানিয়ে মেয়েটাকে যেখানে সেখানে পার করবেন না!

আপনাকে না জানিয়ে কোথায় মেয়ের বিয়ে দেব।

তা জানি না। তবে ওইসব আজেবাজে ছেলের খবর পেয়েই আপনারা যা মাতামাতি করছেন!

তা আপনার ছেলের মতো ছেলে পাব কোথায়?

সে পরে দেখা যাবে। মোট কথা আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ কোথাও!

সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। দুনিয়াটা ওলট-পালট হয়ে গেল। শাঁখা-সিঁদুর, মুখের হাসি, চোখের স্বপ্ন-সব কিছু একসঙ্গে হারিয়ে গেল।

তারপর কত কি হলো! ভেড়ার পালের মতো সর্বহারাদের সঙ্গে এলেন এপারে।

রানাঘাট, শেয়ালদা, পটলডাঙা। পিসতুতো ননদের বাড়ি, মামাতো দেওরের বাড়ি। আরো কত কি!

সুদীর্ঘ অন্ধকার রাত্রি! নবীন কুণ্ডু লেনের ওই অন্ধকার ঘর একদিন হঠাৎ সূর্যের আলোয় ভরে গেল! তরুণ আই-এফ-এস হলো।

যে সূর্য প্রায় দুপুরবেলাতেই অস্ত গিয়েছিল, সেই তার জন্য মা খুব খানিকটা কেঁদেছিলেন সেদিন। খোকার এই কৃতিত্বে সবচাইতে উনিই তো খুশি হতেন!

তরুণ কোনো সান্ত্বনা জানাতে পারেনি। এত বড় কৃতিত্বের পরও কেমন যেন পরাজিত মনে হচ্ছিল নিজেকে। চৌকির উপর মাথা নিচু করে বসে চুপচাপ ভাবছিল।

হঠাৎ একটা বিরাট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন তরুণের মা। আপন মনেই যেন বললেন, হতচ্ছাড়ি মেয়েটাও যদি কাছে থাকত।

এসব কথা, স্মৃতি, ভাবতে ভাবতে তরুণের চোখটা কেমন ঝাঁপসা হয়ে উঠেছিল সেদিন। ভুলে গিয়েছিল সে বার্লিনে বসে আছে, ভুলে গিয়েছিল অফিসের কথা।

মিঃ দিবাকর হঠাৎ ঘরে ঢুকে বললেন, স্যার! প্রায় ছটা বাজে। আমরা কি যাব?

তরুণ লজ্জিত বোধ করে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সার্টেনলি যাবেন। চলুন চলুন, আমিও যাচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *