ত্রয়োদশ অধ্যায় – শিল্প
১. মন্দির
এই গ্রন্থে যে-যুগের ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে সে-যুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের বিশেষ কোন উন্নতি হয় নাই। প্রতি যুগেই রাজা, অভিজাত সম্প্রদায় এবং ধনশালী গুণী ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা শিল্পকে সঞ্জীবিত করে। অবশ্য ব্যক্তিগত প্রতিভাও অনেক সময় শিল্পের নূতন রীতির উদ্ভাবন ও অন্যান্য প্রকারে শিল্পের উন্নতি সাধন করে। কিন্তু মন্দির ও মূর্তি নির্মাণ অপেক্ষাকৃত ব্যয়সাধ্য, তাই পূর্বোক্ত তিন শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ-বিষয়ে শিল্পপ্রতিভার স্ফুরণ সম্ভব হয় না। এই কারণেই হিন্দুযুগে মন্দির ও দেবমূর্তি এবং মুসলমানযুগে মসজিদ, সমাধিভবন ও রাজপ্রাসাদ প্রভৃতির মাধ্যমে শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছিল। যে কারণে মুসলমানযুগে হিন্দুশিল্পের বিশেষ উন্নতি দেখা যায় না, কিন্তু মুসলমানশিল্পের অনেক অনবদ্য সৃষ্টি সম্ভবপর হইয়াছিল, অনেকটা সেই কারণেই –অর্থাৎ পূর্বোক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই–আলোচ্য যুগে হিন্দু বা মুসলমান কোন শিল্পেরই তাদৃশ উন্নতি সম্ভবপর হয় নাই। মুসলমান নবাবদের ও আমীর ওমরাহদের ন্যায় যদি ইংরেজ রাজা ও উচ্চপদস্থ কর্মচারী বা ধনী ব্যবসায়ীরা স্থায়ীভাবে বাংলা দেশে বসবাস করিতেন তাহা হইলে হয়ত এক নূতন আধুনিক শিল্পের প্রতিষ্ঠা হইত। ইংরেজরা এদেশে রাজ্যশাসন করিতেন মাত্র, কিন্তু ইহা তাঁহাদের দেশ নহে, পান্থশালার ন্যায় ক্ষণিক বাসস্থান মাত্র ছিল। সুতরাং মুসলমানযুগের ন্যায় নূতন কোন রীতির উদ্ভব হইয়া শিল্পসম্পদ বৃদ্ধি পায় নাই। ফলে, বাংলা দেশে আলোচ্য যুগে স্থাপত্যের নিদর্শনস্বরূপ কলিকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বা সেন্ট পল গীর্জা ব্যতীত আর কিছু বিশেষ উল্লেখযোগ্য নহে। ভাস্কর্যের বহু সুন্দর নিদর্শন-ইংরেজ শাসনকর্তাদের সুন্দর সুন্দর প্রস্তরমূর্তি–কয়েক বৎসর পূর্বেও কলিকাতার রেড রোডের শোভা বৃদ্ধি করিত; এখন তাহা স্থানান্তরিত হইয়াছে। কিন্তু এগুলি বিলাতে নির্মিত, সুতরাং বাংলার শিল্প বলিয়া গণ্য করা যায় না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালও বিদেশী শিল্পীর কীর্তি এবং আলোচ্য যুগের কিছু পরবর্তীকালে ইহার নির্মাণকার্য শেষ হয়।
কিন্তু নূতন শিল্পের গৌরব না থাকিলেও, মধ্যযুগের শিল্পধারা একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই। কারণ ইংরেজ আমলেও পূর্বোক্ত পৃষ্ঠপোষকতার সম্পূর্ণ অভাব ছিল না। জমিদার ও ধনী ব্যবসায়ীর আনুকূল্যে এ-যুগেও বহুসংখ্যক মন্দির ও মসজিদ নির্মিত হইয়াছে। ইংরেজ আমলের প্রথমযুগেও বাঙ্গালী মুসলমানেরা ধন, ঐশ্বর্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে হিন্দুদের তুলনায় অনেক পরিমাণে অনুন্নত ছিল, এবং হিন্দু শিল্পীদের ন্যায় মুসলমান শিল্পীদের উপর ইংরেজ সংস্কৃতি বা শিল্পের প্রভাব বিস্তৃতি লাভ করে নাই। এইজন্য মুসলমানশিল্পের বিশেষ উন্নতি বা পরিবর্তন দেখা যায় না। তাই নূতন মসজিদের সংখ্যা বা শিল্পকলা সম্বন্ধে কোন বিশেষ বিস্ত ত বিবরণের প্রয়োজন নাই। প্রধানতঃ হিন্দুর শিল্প সম্বন্ধেই কিছু আলোচনা করিব।
এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে মধ্যযুগের মন্দিরের যে শ্রেণীবিভাগ করা হইয়াছে আধুনিক যুগে তাহার কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। এই যুগে রেখমন্দির নির্মিত হইয়াছিল কিনা নিশ্চিত বলা যায় না, ইহার কোন নিদর্শনও পাওয়া যায় নাই। অপরদিকে নূতন এক শ্রেণীর মন্দির ক্রমশঃই জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। ইহাকে সাধারণতঃ দালান মন্দির বলা হয়। এই শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য-সমতল ছাদযুক্ত একটিমাত্র কক্ষ ও সম্মুখে খিলানযুক্ত বারান্দা। বৃহৎ কক্ষটির ছাদের জন্য কড়ি বরগার ব্যবহার করিতে হয় এবং আলোচ্য যুগের পূর্বে ইহার খুব বেশী প্রচলন ছিল বলিয়া মনে হয় না। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত মধ্যযুগে প্রচলিত কুটির দেউল–দোচালা, জোড়বাংলা, চৌচালা, ডবল চৌচালা ও বিভিন্ন শ্রেণীর রত্নমন্দির-এ-যুগেও খুব প্রচলিত ছিল, এবং বর্তমানকালে বাংলা দেশের মন্দিরের অধিকাংশই এই সমুদয় শ্রেণীভুক্ত। ইহার মধ্যেও আবার ডবল চৌচালা মন্দিরের সংখ্যাই বেশী। কলিকাতা শহরের নানা স্থানে এই শ্রেণীর বহু মন্দির এখনও দেখিতে পাওয়া যায়-কালীঘাটের প্রসিদ্ধ মন্দির এবং দক্ষিণেশ্বরের শিবমন্দিরগুলি সকলই এই শ্রেণীগুলির অন্তর্ভুক্ত। অন্য শ্রেণীর মধ্যে রত্নমন্দিরের সংখ্যা কম হইলেও একেবারে নগণ্য নহে। ওয়ার্ড সাহেব (Ward) উনিশ শতকের প্রথমভাগে লিখিয়াছেন যে, জোড়-বাংলা মন্দির এখন কদাচিৎ দেখা যায়।১
আধুনিক যুগের কুটির দেউলগুলিতে সাধারণতঃ বিশেষ কোন ভাস্কর্যের অলঙ্কার দেখা যায় না, তবে অনেকগুলি মন্দিরে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির অলঙ্করণ আছে। কিন্তু ইহার মধ্যে কতগুলি কোটি ১৭৬৫ সনের পরে নির্মিত তাহা বলা কঠিন। তবে সাধারণতঃ মধ্যযুগে অনাবৃত ‘টেরাকোটা’ অলঙ্করণের প্রচলন থাকিলেও ১৭৬৫ সনের পরে শিল্পীয় দক্ষতার হ্রাস, পৃষ্ঠপোষকদের উৎসাহের অভাব প্রভৃতি নানা কারণে টেরাকোটা শিল্পের ক্রমশঃ অবনতি ঘটে এবং তৎস্থলে অধিকতর সহজ প্রক্রিয়ার পঙ্কের অলঙ্করণ প্রচলিত হয়। দালান মন্দিরেই ইহা বেশী পরিমাণে দেখা যায়।
দালান মন্দিরের সমতল ছাদে যেমন আধুনিকতার স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়, ইহার সজ্জায়ও তেমনি ইউরোপীয় প্রভাব দেখা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘আয়োনিক’ (Ionic) স্তম্ভ, স্তম্ভশীর্ষে বিজাতীয় অলঙ্করণ বা ‘ফ্যানলাইট’ (Fan-light), দেওয়ালে ‘ভিনিশীয়’ (Venetian) দরজা ও অর্ধ-উন্মুক্ত দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষমাণা যুবতী নারীমূর্তির উল্লেখ করা যাইতে পারে। তবে এইরূপ বিদেশীয় প্রভাব খুব কম মন্দিরেই দেখা যায়। এস্থলে বলা আবশ্যক, মধ্যযুগেও হিন্দুমন্দিরে, গম্বুজ, খিলান প্রভৃতিতে অনুরূপ মুসলমান স্থাপত্যরীতির অনুকরণ প্রভাব দেখা যায়।
মধ্যযুগের ন্যায় এ-যুগেও ইটের মন্দিরে পোড়ামাটির অলঙ্করণ ব্যবহৃত হইয়াছে। অনেক স্থলে পঙ্কের সজ্জা এককভাবে অথবা পোড়ামাটির (কদাচিৎ পাথরের) অলঙ্করণের আবরণ হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। তবে মধ্যযুগে ইটের মন্দিরে ফুলকারি বা জ্যামিতিক নকশার যেরূপ বহুল প্রচলন ছিল, এ-যুগে তাহা একেবারে পরিত্যক্ত না হইলেও অনেক কমিয়াছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একই মন্দিরগাত্রে কৃষ্ণলীলা, পৌরাণিক ও রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনীই অলঙ্করণের প্রধান উপজীব্য হইয়া উঠিয়াছে। আধুনিক কোন কোন মন্দিরে বাস্তব জীবন এবং সামাজিক দৃশ্যও খোদিত হইয়াছে। পুরনারীদের প্রসাধন, কন্যাসপ্রদান, গ্রাম্য জীবনের অনেক দৃশ্য, শিকার-কাহিনী প্রভৃতি পূর্বকালের বিষয়বস্তুর সহিত ইউরোপীয় প্রভাবের চিহ্নস্বরূপ ফিরিঙ্গী ও ইঙ্গবঙ্গ সমাজের চিত্র ও তদনুযায়ী পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি পারিপার্শ্বিকও প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বর্ধমান জিলার মৌখিরা, মেদিনীপুর জিলার কানাসোল ও বীরভূম জিলার হেতমপুরের মন্দিরগুলির উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইহাদের গাত্রে সাহেব মেমদের মূর্তি যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়।
আলোচ্য আধুনিক যুগের মন্দিরের অলঙ্করণে আর-একটি বৈশিষ্ট্য-মিথুন ভাস্কর্য। ইহা সম্ভবতঃ উড়িষ্যার মন্দিরগুলির প্রভাব সূচিত করে। কারণ মেদিনীপুর ও হুগলী জিলার পশ্চিম অংশে, অর্থাৎ উড়িষ্যার পরিমণ্ডলের নিকটেই ইহার আধিক্য দেখা যায়, দূরবর্তী জিলাগুলিতে ইহা অপেক্ষাকৃত কম। তবে উড়িষ্যার মন্দিরগুলিতে ইহার যে-পরিমাণ বাহুল্য, বাংলার দালান মন্দিরে কোথাও সেরূপ দেখা যায় না। এই অলঙ্করণের অভিনবত্ব ও আধুনিকত্ব ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালী সমাজের রুচিপরিবর্তন সূচিত করে। কারণ ঠিক এই সময়কার কবি তর্জা প্রভৃতি লোকসঙ্গীতেও যে অশ্লীলতার পরিচয় পাওয়া যায় তাহা পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে।
আলোচ্য যুগের মন্দিরের আর-একটি বৈশিষ্ট্যও লক্ষণীয়। অপেক্ষাকৃত প্রাচীন মন্দিরগুলিতে অনেক সময় মন্দির-প্রতিষ্ঠাতার নাম উল্লিখিত হইয়াছে, কিন্তু স্থপতি ও ভাস্করদের নাম কদাচিৎ দেখা যায়। আধুনিক মন্দিরের অনেকগুলিতে, ‘সূত্রধর’ ও ‘রাজ’ বা ‘মিস্ত্রী’ প্রভৃতির নাম, পদবী (পাল, শীল, চন্দ্র, দত্ত, কুণ্ডু, দে, মাইতি, রক্ষিত) এবং বাসস্থান অর্থাৎ সাকিন বা গ্রামের নাম পাওয়া যায়। মেদিনীপুর জিলার মাংলোই গ্রামের রাসমঞ্চে খ্রীষ্টাব্দ, বাংলা সন ও শকাব্দযুক্ত লিপি এবং নদীয়া জিলার শিবনিবাস গ্রামের প্রতিষ্ঠালিপি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এই গ্রামের নামগুলি বিশ্লেষণ করিলে মনে হয় যে, পশ্চিমবঙ্গে মেদিনীপুর জিলার চেতুয়া-দাসপুর, হাওড়া জিলার থলিয়া রসপুর, হুগলী জিলার খানাকুল কৃষ্ণনগর, রাজহাটি, সেনহাটি, বাঁকুড়া জিলার বিষ্ণুপুর, সোনামুখী, বালসি, এবং বর্ধমান জিলার গুসকরা ও কেতুগ্রাম প্রভৃতি স্থানে স্থপতি ও ভাস্কর-সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল। অবশ্য তাহারা বঙ্গদেশের সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইত ও ফরমাশ অনুসারে বিভিন্ন রকমের ছোট বড় মন্দির প্রভৃতি নির্মাণ ও ভাস্কর্যের সাজসজ্জা করিত। মনে হয়, শিল্পীরা বিলাতী গিলডের (guild) অনুরূপ ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। গ্রাম্যভাষায় ইহার নাম ছিল ‘থাক’-যেমন ‘বিরাশি’ থাক, ‘চুরাশি’ থাক ইত্যাদি। মন্দির-নির্মাতা শিল্পীগোষ্ঠী লোপ পাইলেও এই ‘থাক’ বা শ্রেণীবিভাগ
এখনও কুম্ভকার প্রভৃতি মৃৎশিল্পীদের মধ্যে কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে। ( মোটের উপর ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের পর স্থাপত্যে নূতন কোন রীতির উদ্ভব না হইলেও, কোন কোন মন্দিরে যে অভিনবত্ব দেখা যায় তাহা সম্ভবতঃ পূর্বোক্ত বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্রের পরিচায়ক। দৃষ্টান্তস্বরূপ মুর্শিদাবাদ জিলার বড়নগরে ও রাজশাহী জিলার নাটোরে নিম্নমুখী পদ্ম-আকৃতির ছাদযুক্ত মন্দির এবং নদীয়া জিলার শিবনিবাস ও কুমিল্লা শহরের দুইটি বৃহৎ অষ্টকোণ মন্দিরের উল্লেখ করা যাইতে পারে।
এই যুগে নির্মিত মন্দিরগুলির মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করিতেছি।
(ক) মুসলমান সৌধ
১। মুর্শিদাবাদে নবাব মীরজাফরের পত্নী মণি বেগম নির্মিত মসজিদ (১৭৬৭ সন)।
২। মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা একটি বৃহৎ ইমামবরা নির্মাণ করিয়াছিলেন। সীয়র-উল মুতাক্ষরীণ ও রিয়াজ-উস-সুলতান গ্রন্থে ইহার বিবরণ আছে। ১৮৪০ সনে ইহা অগ্নিদগ্ধ হয়, পরে ইহার স্থানে ১৮৪৭ সনে যে ইমামবরাটি নির্মিত হয় তাহা এখনও বর্তমান আছে। বাংলা দেশে ইহাই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ইমামবরা। ইহার সম্মুখ ভাগ ৬৮০ ফুট লম্বা–ইহার মধ্যে তিনটি মহল এবং প্রতি মহলে চতুষ্কোণ একটি বৃহৎ প্রাঙ্গণ আছে।
(খ) হিন্দু মন্দির
১. মুর্শিদাবাদ মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে বড়নগরে রাণী ভবানী (মৃত্যু ১৭৯৫) ও তাঁহার কন্যা অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করেন (কিরীটেশ্বরী, ভুবনেশ্বরী, রাজ-রাজেশ্বরী, ও গোপাল-মন্দির)। ইহার মধ্যে ১৭৬০ সনে নির্মিত চারিটি দোচালা মন্দিরে পোড়ামাটির অলঙ্করণ আছে। কিরীটেশ্বরীর মন্দির ১৭৬৫ সনে নির্মিত হয়।
২. বাঁকুড়া [৩]
বিষ্ণুপুরের শ্রীধর মন্দির নামে পরিচিত নবরত্ন মন্দিরটি সম্ভবতঃ আঠারো শতকের শেষে অথবা উনিশ শতকের প্রথমে নির্মিত হইয়াছিল। এই মন্দিরটিতে পোড়ামাটির ভাস্কর্য উত্তীর্ণ আছে। এই অলঙ্করণগুলি সংখ্যায় বেশী নহে কিন্তু ইহার মধ্যে কৃষ্ণলীলা, রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী ও পৌরাণিক চিত্র প্রভৃতি ছাড়াও সঙ্গিন-বন্দুকধারী গোরা সৈন্যের মূর্তি দেখা যায়।
বাঁকুড়া জিলায় সোনমুখীর শ্রীধর রত্নমন্দিরটি নানা কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমতঃ মন্দিরগাত্রে (পশ্চাৎ দিকের দেওয়ালে) উৎকীর্ণ লিপি হইতে জানা যায় এই মন্দিরটি রাধাকৃষ্ণের উপাসনার জন্য ১৭৬৭ শকাব্দ, ১২৫২ বঙ্গাব্দে (অর্থাৎ ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে) কানাঞি রুদ্রদাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং হরি নামক সূত্রধর কর্তৃক নির্মিত। এরূপ বিস্তৃত ও সঠিক বিবরণ অন্য কোন মন্দিরে পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়তঃ, এটি পঞ্চবিংশতি-চূড় রত্নমন্দির। এই শ্রেণীর মন্দির সাধারণতঃ ত্রিতল হয়; শীর্ষের কেন্দ্রীয় চূড়াটি ছাড়া প্রথম তলের উপর প্রতি কোণে তিনটি, দ্বিতীয় তলের প্রতি কোণে দুইটি এবং তৃতীয় তলের প্রতি কোণে একটি শিখর থাকে। সোনামুখীর মন্দিরটি দ্বিতল এবং প্রতি তলের প্রতি কোণে তিনটি করিয়া চূড়া আছে।
তৃতীয়তঃ, এই মন্দিরের পোড়ামাটির ভাস্কর্য খুবই উচ্চশ্রেণীর অলঙ্করণ।
উপরোক্ত তথ্যগুলি বিবেচনা করিলে উনিশ শতকের বাংলার শিল্পের ইতিহাসে সোনামুখীর মন্দির যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে তাহাতে সন্দেহ নাই।
বাঁকুড়া শহরের আট মাইল উত্তর-পশ্চিমে বড় চণ্ডীদাসের জন্মস্থান বলিয়া খ্যাত ছাতনা গ্রামে বাসলি দেবীর তিনটি পঞ্চরত্ন মন্দিরও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন দুইটি মন্দির পর পর ধ্বংস হওয়ায় প্রায় শতবর্ষ পূর্বে ইষ্টকনির্মিত যে পঞ্চরত্ন মন্দিরটিতে বাসলি দেবী এখন রক্ষিত ও পূজিত হইতেছেন তাহাতেও কয়েক সারি ‘টেরাকোটা’ ভাস্কর্য নিবদ্ধ আছে। এগুলি শিল্পহিসাবে খুব উচ্চদরের না হইলেও, শতবর্ষ পূর্বেও যে অধুনালুপ্ত এই শ্রেণীর অলঙ্করণ বিদ্যমান ছিল তাহা প্রমাণিত হয়।
আধুনিক যুগের মন্দিরের পরিণতি হয় সমতল ছাদের এক-কুঠরি দালানে। বাঁকুড়া জিলায় ও অন্যান্য স্থানে সর্বপ্রকার বিশেষত্ববর্জিত এই মন্দিরগুলি প্রমাণিত করে যে, এই যুগে প্রাচীন ধর্মভাব থাকিলেও প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের শিল্পকলা প্রায় লোপ পাইয়াছে।
৩. চব্বিশ পরগণা [৪]
চব্বিশ পরগণায় আঠারো শতকের শেষভাগে নির্মিত কয়েকটি মন্দির আছে। ১৭৬৯ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত আমতলার নিকটে গোবিন্দপুর গ্রামের শিবমন্দিরটির আচ্ছাদনের ঠিক নীচেই পোড়ামাটির অলঙ্কৃত ফলক আছে। পদ্মাসনে উপবিষ্ট গণেশ, এদেশীয় সৈনিক, দ্রুতবেগে পলায়মান মৃগের পশ্চাতে ধাবমান শিকারী, ময়ূরপৃষ্ঠে আসীনা ধনুর্বাণধারিণী রমণী প্রভৃতির যেসব মূর্তি ফলকগুলিতে উত্তীর্ণ আছে তাহা শিল্পহিসাবে প্রশংসাযোগ্য।
নিকটবর্তী বাওয়ালী গ্রামে আট-দশটি এবং বাখড়া গ্রামে একটি মন্দির আছে। ইহার মধ্যে ১৭৭১ সনে নির্মিত ডবল চৌচালা রাধাকান্ত মন্দিরটিতে এখনও কয়েকটি অলঙ্কৃত ফলক আছে। ইহাতে চণ্ডী, তাঁহার উপাসক দুই সন্ন্যাসী ও শিবপূজারত তিনটি সন্ন্যাসীর মূর্তি খোদিত আছে। তবে ইহাদের শিল্প খুবই সাধারণ শ্রেণীর ও বিশেষত্ববর্জিত। ১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত বাওয়ালীর একটি নবরত্ন মন্দিরও উল্লেখযোগ্য।
১৭৮৮ সনে নির্মিত রাজারামপুরের একটি মন্দিরেও নানারূপ পোড়ামাটির অলঙ্কার আছে। রাম, রাবণ, বানরভক্ষণে রত কুম্ভকর্ণ ও দেবকী প্রভৃতির সহিত কয়েকটি বাস্তব চিত্রও খোদিত আছে, যথা-(১) অগ্নিকুণ্ডের দুইপাশে দুই বৃদ্ধ; (২) প্রসাধনে নিযুক্তা কয়েকটি রমণী; (৩) ক্রয়বিক্রয়ের দৃশ্য, ইত্যাদি।
কামারপোল গ্রামে কয়েকটি ডবল চৌচালা মন্দির আছে। ঘনশ্যাম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার তারিখ ১২০৬ বঙ্গাব্দ। নিকটবর্তী বৃহত্তর রাধাকৃষ্ণের মন্দিরটি সম্ভবতঃ আরও প্রাচীন।
জয়নগরের নিকট ১৮০৫ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত একটি ডবল চৌচালা মন্দিরের বিশেষত্ব এই যে, ইহার অলঙ্করণের বিষয়বস্তু প্রধানতঃ পদ্ম, পদ্মকোরক ও পদ্মপত্র। আচ্ছাদনের নীচে ক্ষুদ্র নরমুণ্ডও আছে।
দক্ষিণেশ্বরে ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত রাণী রাসমণির বৃহৎ নবরত্নকারী মন্দির এবং বারাকপুরের তালপুকুর পল্লীতে উনিশ শতকের শেষভাগে তাহার কন্যার প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ নবরত্ন, অন্নপূর্ণার মন্দিরও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৪. অন্যান্য জিলা
অন্যান্য জিলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্দিরের তালিকা দিতেছি : [৫]
খুলনা জিলার সোনাবাড়িয়ার ‘টেরাকোটা’-অলঙ্কৃত নবরত্ন শ্যামসুন্দর মন্দির (১৭৬৭ খ্রী.) (যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ : পৃ. ৮৬২)।
পাবনা জিলার হাতিকুমনুলের পরিত্যক্ত নবরত্ন মন্দির (১৮ শতকের প্রথমার্ধ) [‘পাবনা জিলার ইতিহাস’]।
নদীয়া জিলার শিবনিবাসে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত অতিবৃহৎ শিবমন্দির (১৭৬২ খ্রী.)।
বর্ধমান জিলার গোহোগ্রামে ‘টেরাকোটা’-সজ্জিত কুটির দেউল (১৮৭১ খ্রী.)। ঐ জিলার কালনায় ‘টেরাকোটা’-সজ্জিত দুইটি বিশাল পঞ্চবিংশতি-চূড় রত্নমন্দির (১৮ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে) ও টেরাকোটা’-সজ্জিত প্রতাপেশ্বর শিবের কুটির-মন্দির (১৮৪৯ খ্রী.)। ঐ জিলার দেবীপুরে ‘টেরাকোটা’-সজ্জিত লক্ষ্মীজনার্দনের কুটির মন্দির (১৮৪৪ খ্রী.)।
বীরভূম জিলার সুরুলে ‘টেরাকোটা’-সজ্জিত ডবল চৌচালা মন্দির (১৮৩১ খ্রী.) ও ডাবুকে বিশাল চারচালা মন্দির (১৮৮০ খ্রী.)।
হুগলী জিলার বাঁশবেড়িয়ায় বহুরত্ব হংসেশ্বরী মন্দির (১৮১৪ খ্রী.) ও আঁটপুরে টেরাকোটা’-সজ্জিত ডবল চৌচালা মন্দির (১৭৮৬ খ্র.)।
হাওড়া জিলার মাকড়দাহ মাকড়চণ্ডীর বৃহৎ ডবল চৌচালা মন্দির (১৮২১ খ্রী.)।
মেদিনাপুর জিলার ধামতোড়ে ‘টেরাকোটা’-সজ্জিত রত্নমন্দির (১৯৩১ খ্র.)। (ইহার অপেক্ষা অর্বাচীন ‘টেরাকোটা’-মন্দির সম্ভবত আর নাই)।
পূর্বে যে ‘টেরাকোটা’ অলঙ্করণের পরিবর্তে ক্ৰমশঃ পঙ্কের কাজ অর্থাৎ মিহি চূনের পলস্তারায় টাকা এক ভিন্নজাতীয় অলঙ্করণের প্রচলনের উল্লেখ করা হইয়াছে তাহার নিদর্শনস্বরূপ বাঁকুড়া জিলার পাত্রসায়ের থানার অন্তর্গত কৃষ্ণনগরের কয়েকটি ইটের মন্দির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ, এই মন্দিরগুলিতে এই দুই শ্রেণীর অলঙ্করণের যুগপৎ প্রয়োগ, প্রথমটির বিদায় ও দ্বিতীয়টির আবির্ভাবের প্রত্যক্ষ প্রমাণরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।
ইংরেজের সংস্পর্শে মন্দির অলঙ্করণে ইংরেজীপ্রভাব কিছু দেখা যায়, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। মন্দির ছাড়া অন্যান্য শ্রেণীর স্থাপত্যে এই প্রভাব আরও বেশী পরিমাণে লক্ষিত হয়। ইহার একটি বিশিষ্ট নিদর্শন সমসাময়িক ইংলণ্ডের অনুকরণে প্রাচীন গ্রীক ও মধ্যযুগের গথিক স্থাপত্যশৈলী অনুসারে নির্মিত ধনীর বাসগৃহ ও প্রমোদভবন। একজন ইউরোপীয় লেখক মন্তব্য করিয়াছেন, এই সকল “পাশ্চাত্ত্য স্থাপত্যশৈলী অনুসারে নির্মিত বিরাট হর্মগুলি দেখিলে কলিকাতা শহরকে সেন্ট পিটার্সবার্গ বলিয়া ভুল করা অসম্ভব নহে।”৬ মূল মন্দিরে না হইলেও কোন কোন স্থলে ইহার সংলগ্ন দুর্গামণ্ডপে গ্রীকদেশীয় (lonic) পদ্ধতির অনুকরণে নির্মিত স্তম্ভ ব্যবহার করা হইয়াছে। সে-যুগের অনেক ধনীর প্রাসাদেও এইরূপ স্তম্ভ থাকায় ইহা ইউরোপীয় বাসভবন বলিয়া ভুল করার সম্ভাবনা ছিল। জাতীয় শিল্পের কতদূর অবনতি হইয়াছিল ইহা তাহার একটি চূড়ান্ত প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
২. চিত্রশিল্প
মুঘলযুগে ভারতে যে নূতন চিত্রশিল্পের সূত্রপাত হয় তাহার প্রভাবে রাজস্থান, কাংড়া প্রভৃতি বহু অঞ্চলে নূতন নূতন রীতির চিত্রকলার প্রবর্তন হইয়াছিল। কিন্তু বঙ্গদেশে এই শ্রেণীর কোন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পের উদ্ভব হয় নাই। আঠারো ও উনিশ, শতকে এদেশে সাধারণতঃ পটচিত্রই চিত্রকলার প্রধান নিদর্শন ছিল। পট শব্দের অর্থ কাপড়–প্রাচীনকালে কাপড়ের উপর চিত্র আঁকা হইত, সুতরাং এইরূপ চিত্রিত কাপড়কেও পট বলা হইত। যাহারা এইরূপ চিত্র আঁকিত তাহাদের নাম ছিল পটুয়া। যদিও আধুনিক যুগে কাপড়ের পরিবর্তে কাগজের উপরই এই শ্রেণীর চিত্র অঙ্কিত হয়, তথাপি প্রাচীন সংজ্ঞার অনুকরণে ইহাও পট নামেই পরিচিত। এই পটগুলিকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায় –(১) ছোট চৌকা পট–ইহাতে একখানি মাত্র ছবি থাকে। (২) পর পর অনেকগুলি চিত্রযুক্ত দীর্ঘ পট–ইহাদিগকে ‘দীঘল পট’ বা জড়ানো পট বলা হয়। বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে পটুয়াগণ সুদীর্ঘ কাগজে অঙ্কিত পর পর অনেকগুলি ছবির সাহায্যে একটি কাহিনী বিবৃত করিয়া গ্রামে গ্রামে এই ছবিগুলি দেখায় এবং সঙ্গে সঙ্গে উক্ত কাহিনী সুরসংযোগে আবৃত্তি করে। এইরূপ কাগজের পট কখনও কখনও ৩০। ৪০ ফুট দীর্ঘ হয়। ইহার দুইপ্রান্তে দুইটি বংশদণ্ড লাগানো থাকে এবং তাহার সাহায্যে ইহা গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা হয়। দর্শকের সম্মুখে ইহা একটু একটু করিয়া খোলা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে কাহিনীর ঐ অংশ সুরসহ বিবৃত করা হয়।
এই শ্রেণীর চিত্রের মধ্যে আঠারো ও উনিশ শতকে অঙ্কিত কলিকাতার শহরতলী কালীঘাটের পটুয়াদের অঙ্কিত চিত্রপটগুলি সমধিক প্রসিদ্ধ এবং এখনও সুপরিচিত। কারণ ইহাদের সম্বন্ধে অনেক শিল্পী আলোচনা করিয়াছেন এবং ইহার বহু নিদর্শনও নানা গ্রন্থে সংগৃহীত হইয়াছে।৭ গুরুসদয় দত্ত লিখিয়াছেন : বাংলার এই পল্লীবাসী পটুয়াশ্রেণীর চিত্রশিল্পে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়া অবাক হইতে হয়।৮ ইহার রীতি ও প্রকৃতি, এবং শিল্পহিসাবে মূল্য সম্বন্ধে তিনি যে বিস্তৃত মন্তব্য করিয়াছেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“বাংলার এই নিজস্ব চিত্রপদ্ধতি বিশ্বমানবের আদিম যুগের সরল ভাব, পৌরুষের ভাব, অকৃত্রিমতার ভাব এবং সজীবতা, সরসতা, ও তেজস্বিতার ভাব হারায় নাই। ইহা কেবল রেখার সতেজ, সুনিপুণ, প্রখর ও ভাবব্যঞ্জক প্রয়োগ এবং অল্প কয়েকটি প্রাথমিক বর্ণের অমিশ্র ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। পরিপ্রেক্ষিতের মাপকাঠির খুঁটিনাটি ও আলোছায়ার লীলাখেলার চতুরতা ও বাহুল্য মিশাইয়া ইহা কখনও আপনার ব্যাকরণকে অযথা জটিল করিয়া তুলিবার প্রয়াস করে নাই। ইহার আকারবিন্যাস এবং বর্ণসমাবেশ ও সমন্বয় অতিশোভন ও অনিন্দ্যসুন্দর।…ইহাতে অঙ্কিত মনুষ্যগণের আকৃতি ও হাবভাব সম্পূর্ণভাবে কৃত্রিমতা ও মুদ্রাদোষবিহীন এবং সাধারণ মানুষের সহজ ও জীবন্ত ভাবে পরিপূর্ণ। ইহার একটি চিত্রেও কোনও রকম ভাবের অপরিস্ফুটতা অথবা ধোয়াটে ধরণ নাই। সর্বোপরি বাংলার পল্লীগ্রামের সরল প্রকৃতির স্ত্রী-পুরুষগণের চরিত্রের একটি অনির্বচনীয় ও অতুলনীয় নিজস্ব মাধুর্যরসে এইসকল চিত্রপটের রেখা, বর্ণ ও রূপকল্পনা ওতপ্রোতভাবে পরিপ্লাবিত।”৯
এই বর্ণনায় ভাবপ্রবণতা ও অতিরঞ্জন থাকিলেও ইহা হইতে বাংলার পটচিত্রের সম্বন্ধে একটি সুস্পষ্ট ধারণা করা যায়। এগুলির বিষয়বস্তু প্রধানতঃ কৃষ্ণলীলা, রামলীলা, গৌরাঙ্গলীলা, শিবপার্বতীলীলা প্রভৃতি ধর্মমূলক ও দেবদেবী বিষয়ক কাহিনী। অপেক্ষাকৃত আধুনিক পটগুলিতে শহরের বাস্তবজীবনের অনেক চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে। উনিশ শতকের ছবিগুলিতে সাহেবদের শিকার, ঘৌড়দৌড় ও আদালতের দৃশ্য, মন্দিরত্রিনী বঙ্গবন্ধুর দল, শ্যামাকান্তের ব্যাঘশিকার, প্রণয়ী প্রণয়িনীর আলিঙ্গন ও মানভঞ্জন, প্রসাধনরতা বীণাবাদিনী, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর নির্যাতন ও স্বামীর মুখে স্ত্রীর পদাঘাত প্রভৃতি এবং নানাবিধ পশু, পক্ষী, মৎস্য (বিড়ালের মুখে চিংড়ী মাছ, রোহিত মৎস্য) এবং পাঁঠাবলি প্রভৃতি বাস্তবজীবনের বহু চিত্র দেখিতে পাওয়া যায়।
বর্তমান শতকের প্রথমে যে নূতন চিত্রশিল্পের উদ্ভব হয় তাহার ফলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিষ্য যামিনী রায় পটশিল্পকেও নবজীবন দান করেন। এই শিল্পসম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পরে দেওয়া হইয়াছে।
আঠারো শতকের শেষভাগে কয়েকজন ইংরেজ চিত্রকর ভারতে আসিয়া এখানকার বাস্তবজীবনের চিত্র ইউরোপীয় পদ্ধতিতে অঙ্কিত করেন। ১৭৯৫ হইতে ১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে টমাস ড্যানিয়েল নামক একজন শিল্পী হিন্দুস্থানের বাস্ত বজীবন ও প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলম্বনে অঙ্কিত ৮৪খানি ছবি প্রকাশিত করেন। ইহর মধ্যে তৎকালীন কলিকাতার কয়েকটি দৃশ্যও আছে এবং চারি খণ্ডে সম্পূর্ণ এই দৃশ্যাবলীসম্বলিত গ্রন্থখানি কলিকাতা এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত আছে।১০
১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত Manners in Bengal গ্রন্থে Mrs. S. C. Belnos বাংলার সাধারণ জীবনযাত্রার নিখুঁত ছবি আঁকিয়াছেন। একখানি ছবিতে দেখা যায়, শ্লথবসনা একটি বাঙ্গালী বধূ ঘরের অভ্যন্তরে কাঠের উনানে ভাত চড়াইয়াছেন; পার্শ্বে দুইটি শিশু একটি ধামা হইতে কোন খাদ্যবস্তু তুলিতে নিযুক্ত; কমধ্যে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত জলের ঘটি, শিল, নোড়া, ডালা, কুলা, কৌটা ও হুঁকা; শিকায় ঝোলান হাঁড়িকলসী; দড়িতে ঝুলান কাপড়; দেয়ালের গায়ে উচ্চস্থানে জালের মধ্যে হাতপাখা প্রভৃতি, এবং কক্ষের একধারে একটি চরকা ও আরেকধারে তালাবদ্ধ কাঠের বাক্সের উপরে একটি বিড়াল।
বাঙ্গালীর বাস্তবজীবনের এই চিত্রগুলি সম্পূর্ণ অভিনব হইলেও অবশ্য ইউরোপীয় পদ্ধতিতেই অঙ্কিত। পূর্বোক্ত Mrs Belons-অঙ্কিত ছবিতে রন্ধনগৃহের দ্রব্যগুলি নিখুঁতভাবে অঙ্কিত হইলেও রন্ধনরতা শাড়ীপরিহিতা মহিলাটির মুখে ইউরোপীয় চিত্রকরের প্রভাব বেশ স্পষ্টভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। এদেশীয় পটে বাস্ত বজগতের চিত্র যে ইউরোপীয় চিত্রের অনুকরণ প্রভাবের ফল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ আঠারো শতকের পটে এইরূপ বাস্তবজীবনের চিত্র দেখা যায় না। উনিশ শতকেই ইহার আবির্ভাব হয় এবং এই যুগে সাহেবদের চিত্রও যে পটে অঙ্কিত হইত সে-কথা পূর্বেই বলিয়াছি।
একথা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না যে, প্রাচীন লোকগীতি, যাত্রা, পাঁচালি, কবিগান প্রভৃতি হইতে পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের প্রভাবে যেরূপে উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলাসাহিত্যের উদ্ভব হয়, সেইরূপ পটুয়ার চিত্র প্রভৃতি হইতে হউরোপীয় প্রভাবে উনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলায় আধুনিক চিত্রকলার সূচনা হয়।
বাংলা দেশে পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি আধুনিক শিক্ষার প্রসারে প্রথমে ছোটখাট ইংরেজী স্কুল ও পরে প্রধানতঃ হিন্দু কলেজ যেরূপ সহায়তা করিয়াছিল, আধুনিক শিল্পকলার উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠার মূলেও ছিল সেইরূপ পাশ্চাত্ত্য পদ্ধতিতে শিল্পশিক্ষা দিবার জন্য কয়েকটি বিদ্যালয়। ১৮৫৪ সনে কলিকাতা গরাণহাটায় ‘The School of Industrial Art’ স্থাপিত হয়। এখানে কারিগরী বা ব্যবহারিক (Industrial) শিল্পের সঙ্গে চিত্রকলা প্রভৃতি সুকুমারশিল্প শিখাইবারও ব্যবস্থা ছিল। ক্রমে ইহা একটি সরকারী স্কুলে পরিণত হয়। পরে নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্যদিয়া ইহা কলিকাতার বর্তমান School of Art’-এ পরিণত হয় (১৮৬৪)। প্রথমে ইংরেজ শিল্পীরাই ইহার শিক্ষক ও অধ্যক্ষ ছিলেন, ক্রমে এই স্কুলের এদেশীয় ছাত্রগণও বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিযুক্ত হইতেন। এই স্কুলের সঙ্গে যে একটি চিত্রশালা ছিল, তাহাতে প্রধানতঃ ইউরোপীয় চিত্রই সংগৃহীত হইত, এবং মাঝে মাঝে যে-সকল চিত্র-প্রদর্শনী হইত তাহাতেও পাশ্চাত্ত্য প্রণালীতে অঙ্কিত চিত্রই শোভা পাইত। ফলে কয়েকজন বাঙ্গালীও ইউরোপীয় পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কনে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেন। ইহাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের নাম উল্লেখ করিব।
১৮৬৯ সনে প্রিয়নাথ দাস কালি-কলমের রেখাদ্বারা বাস্তবজীবনের অনেক ছবি আঁকেন। এগুলির সহিত পূর্বোক্ত পটের ছবির তুলনা করিলেই দেখা যাইবে যে, উভয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। কিন্তু ১৮৩২ সনে অঙ্কিত পূর্বোক্ত Mrs. Belnos-এর চিত্রের সহিত এগুলির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। শ্ৰীঅন্নদাপ্রসাদ বাগচীও এইরূপ চিত্রাঙ্কনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। চুনিলাল দাসের লিথোপ্রিণ্ট (১৮৭৩), বি. এল, মুখার্জী ও হরিনারায়ণ বসুর আর্দ্র রং (water colour) মনোক্রোম (১৮৮৫, ১৮৮৭), শশী হেসের পেনসিলে আঁকা নারীমূর্তি (১৮৯৮) প্রভৃতি ইউরোপীয় পদ্ধতিতে অঙ্কিত চিত্রগুলির সমসাময়িক অভিজ্ঞ শিল্পীর উচ্চপ্রশংসা অর্জন করিয়াছিল। ক্রমে ক্রমে বাংলা দেশে ইউরোপীয় শিল্পের প্রভাবে সাহিত্যের ন্যায় শিল্পেও এক নূতন যুগের সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু ভারতের প্রাচীন চিত্রশিল্প-পদ্ধতি সম্বন্ধে শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না, শিল্পীর দৃষ্টিও সেদিকে আকৃষ্ট হয় নাই।
১৮৯৬ সনে হ্যাঁভেল সাহেব (Earnest Benfield Havell) কলিকাতা শিল্প বিদ্যালয়ের (School of Art) অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। তিনি প্রথমেই লক্ষ্য করিলেন, এই বিদ্যালয়ে প্রাচ্য শিল্পকলার (Oriental Art) কোন স্থান নাই, শিক্ষাপদ্ধতিতে ও চিত্রপ্রদর্শনীতে কেবল ইউরোপীয় ছবিরই প্রাধান্য। তিনি তাহার প্রথম রিপোর্টেই প্রস্তাব করিলেন যে, অতঃপর প্রাচীন ভারতের চিত্রশিল্পকেই সবরকমে প্রাধান্য দেওয়া হইবে এবং ঐ বিদ্যালয়ে শিল্পশিক্ষার ভিত্তি বলিয়া গ্রহণ করা হইবে (Oriental art will be the basis of all instruction given)। ইহার ফলে শিল্পী ও কলিকাতা শিল্প বিদ্যালয়ের ছাত্রগণের মধ্যে অসন্তোষ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হইল এবং তাহারা প্রকাশ্যে ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিল। রণদাপ্রসাদ গুপ্ত নামে একজন তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তিনি ও একদল ছাত্র কলিকাতা শিল্প বিদ্যালয় ত্যাগ করিয়া বউবাজারে এক নূতন শিল্প বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিলেন (১৮৯৭)। রণদাপ্রসাদ অতি দক্ষতার সহিত এই বিদ্যালয় চালাইতেন এবং পরবর্তীকালে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। কলিকাতার অভিজাত সম্প্রদায়ের একদল তাঁহার বিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক হইলেন এবং কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটি এই বিদ্যালয়কে অর্থ দান করিত।
কিন্তু অধ্যক্ষ হাভেল সাহেব এই সমুদয় প্রতিবাদে কর্ণপাত করিলেন না, বরং তিনি নূতন উৎসাহে অনেকটা মাত্রা ছাড়াইয়া গেলেন। কলিকাতা শিল্প-বিদ্যালয়ের প্রদর্শনী-কক্ষে (Art Gallery) বিদেশী ছবিগুলির প্রায় সমস্তই তিনি বিক্রয় করিলেন এবং তাহার বদলে ভারতীয় পদ্ধতিতে অঙ্কিত মূলচিত্র ও তাহার অনুকরণগুলি ঐ কক্ষে স্থান পাইল। জনশ্রুতি এই যে, পাশ্চাত্ত্য প্রথায় নির্মিত অনেক মূর্তি তিনি নিকটবর্তী পুষ্করিণীতে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। ছাত্র, জনসাধারণ ও সংবাদপত্রগুলিতে ইহার তীব্র নিন্দা হইল। আশ্চর্যের বিষয়, বড়লাট লর্ড কার্জন হ্যাঁভেলের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর পূর্ণ সমর্থন করিলেন।
নূতন আদর্শের সহায়তার জন্য অধ্যক্ষ হ্যাঁভেল শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সহকারী অধ্যক্ষ (Vice-Principal) নিযুক্ত করিলেন (১৯০৫)। অবনীন্দ্রনাথ একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী বলিয়া জগতে তখন সুপরিচিত এবং তাহার প্রসিদ্ধিও অপরিসীম। ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ অগষ্ট তাহার শততম জন্মদিবসে তাঁহার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বহু সভাসমিতি ও অনুষ্ঠানের আয়োজন হইয়াছিল। কিন্তু, ১৯০৫ সনে শিল্পজগতে তাঁহার প্রতিষ্ঠার কেবল সূত্রপাত হইয়াছে মাত্র। হ্যাঁভেল সাহেব যে সেই সময়ে তাঁহার আপত্তিসত্ত্বেও তাঁহাকে সহকারী-অধ্যক্ষপদ গ্রহণে সম্মত করাইয়াছিলেন, ইহা তাহার সূক্ষ্ম শিল্পজ্ঞানের ও কৃতিত্বের পরিচায়ক।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবারে সুপ্রসিদ্ধ দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণীতে উঠিয়া আর কোন বিদ্যালয়ে পড়েন নাই বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হন নাই। কিন্তু, বাড়ীতে বসিয়াই ইংরেজী ও সংস্কৃত ভাষার চর্চা করেন। কলিকাতা শিল্প-বিদ্যালয়ের ছাত্র না হইয়াও ইহার সহকারী অধ্যক্ষ (Assistant Superintendent) Mr. O. Ghilardi এবং Palmer সাহেবের নিকট ইউরোপীয় শিল্পপদ্ধতি শিক্ষা করেন। প্রাচীন ভারতের কলাশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া কেবল ভারতের নহে–পারস্য, চীন, জাপান প্রভৃতি প্রাচ্যদেশের চিরাগত অঙ্কনপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য বিশেষ মনোযোগের সহিত পর্যবেক্ষণ করিয়া এক সম্পূর্ণ নূতন পদ্ধতিতে ছবি আঁকিতে আরম্ভ করেন। অধ্যক্ষ হ্যাঁভেল সাহেবের উৎসাহে, পরিচালনায় ও নির্দেশ অনুযায়ী১১ এই প্রাচ্যপদ্ধতিতে কয়েকখানি নূতন ধরণের ছবি আঁকিয়া তিনি চিত্রশিল্পী হিসাবে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন। ১৯০২ ০৩ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লী দরবারে যে চিত্র-প্রদর্শনী হয় তাহাতে অবনীন্দ্রনাথের তিনখানি ছবি ছিল। ইহার মধ্যে শাহজাহানের অন্তিমকাল’ (The Last Hours (or Days) of Shah Jehan) নামক ছবিখানি উচ্চপ্রশংসা লাভ করিয়াছিল এবং অবনীন্দ্রনাথ একটি স্বর্ণপদক পুরস্কার লাভ করিয়াছিলেন।১২
হ্যাভেল সাহেবই বোধ হয় অবনীন্দ্রনাথের অপূর্ব শিল্পপ্রতিভার প্রথম বিশিষ্ট সমঝদার। লণ্ডন হইতে প্রকাশিত The Studio নামে একখানি শিল্পবিষয়ক পত্রিকায় হ্যাঁভেল দুইটি প্রবন্ধ লেখেন (১৯২০ অক্টোবর, ১৯০৩ জানুয়ারী সংখ্যা)। “ Some Notes on Indian Pictorial Art” নামক প্রথম প্রবন্ধে অবনীন্দ্রনাথের চিত্রই ছিল তাহার প্রধান আলোচ্য বিষয় এবং নিদর্শনস্বরূপ যে-কয়টি ছবি ছাপা হইয়াছিল তাহার সবগুলিই অবনীন্দ্রনাথের অঙ্কিত। এগুলির নাম–
১। জেনানা মহল (In the Zenana-monochrome)
২। বুদ্ধ ও সুজাতা (পুরাপুরি রঙ্গিন)
৩। পথিক ও পদ্ম (The Traveller and the Lotus-monochrome)
৪। রাজকুমারীর পদ্ম (Princess Lotus-রঙ্গিন)
৫। আঁধার রাতি (The Dark Night-রঙ্গিন)
অবনীন্দ্রনাথের চিত্রশৈলী যে সম্পূর্ণ অভিনব ইহা প্রথম হইতেই স্বীকৃতি লাভ করে। ইতালীয়, পারস্য, চীন, জাপান, মুঘল ও রাজপুত চিত্রশিল্পের যথেষ্ট প্রভাব থাকিলেও ইহা যে তাঁহার নিজের এক অপূর্ব সৃষ্টি এবং প্রকৃত শিল্পরসের প্রগাঢ় অনুভূতির পরিচায়ক, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। রেখা ও বর্ণবিন্যাসের মধ্যদিয়া শিল্পী যে প্রাণের গভীরতা ও সরসতা ছাড়াও অনুভূতি ও ভাব ফুটাইয়া তুলিয়াছেন তাহা বুঝিতে কাহারও বিলম্ব হয় নাই। তাঁহার অঙ্কিত মূর্তিগুলির শারীরিক গঠন সুপরিচিত ইউরোপীয় পদ্ধতির মত বাস্তবের হুবহু অনুকরণ নহে–এই মর্মে বিরুদ্ধ-সমালোচনা, এমনকি নিন্দাও হইয়াছিল। কিন্তু ক্রমে এই নূতন শিল্পশৈলীর ভাব ও ব্যঞ্জনার প্রকৃত স্বরূপ অনেকেই উপলব্ধি করিয়াছেন। ‘আর্ট’ বা শিল্প কেবল প্রকৃতিসৃষ্ট বাস্তব রূপের মধ্যে সীমাবদ্ধ নহে, অবনীন্দ্রনাথের চিত্র হইতেই এই গূঢ় সত্য প্রকটিত হইল। প্রাকৃতিক রীতি লঙ্ন করিয়াও শিল্পী নূতন নূতন সৌন্দর্য সৃষ্টিদ্বারা মানুষের তৃপ্তিসাধন করিতে পারেন। অনেকে মত প্রকাশ করিয়াছেন, অবনীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতীয় শিল্পরীতির পুনরুজ্জীবন করিয়াছেন। কিন্তু ইহা পুরাপুরি সত্য নহে। প্রাচীন ভারতীয় চিত্র যে তাঁহাকে অনুপ্রেরণা দিয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু, অবনীন্দ্রনাথ ইহার অন্ধ। অনুকরণ করেন নাই, করিলে তাহার শিল্প অসার ও প্রাণহীন হইত, জীবন্ত হইয়া উঠিত না। জাপানে ওকাকুরা প্রভৃতি শিল্পী যেমন প্রাচীন ভিত্তির উপর নবীন সৌধ গড়িয়া তুলিয়াছেন, বঙ্গদেশে তথা ভারতে, অবনীন্দ্রনাথও তাহাই করিয়াছেন। প্রাচীন ভারতের পোশাক-পরিচ্ছদ, আহারবিহার, সামাজিক ব্যবস্থা ও মানসিক চিত্তবৃত্তি কালানুযায়ী পরিবর্তনের ফলে অনেকটা ভিন্নরূপ ধারণ করিলেও ইহা পুরাতনের বিবর্তনমাত্র–এগুলি সম্বন্ধেও যেমন প্রাচীনের হুবহু অনুকরণ বা পুনরুজ্জীবন অযৌক্তিক, অশোভন ও অসম্ভব, শিল্প-সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা বলা যাইতে পারে। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব এই যে, তিনি ভারতের প্রাচীন শিল্পসত্তাকে যুগোপযোগী রূপে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছেন।১৩
বর্তমান গ্রন্থের আলোচ্য যুগের শেষে অর্থাৎ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প-প্রতিভার কেবলমাত্র উন্মেষ, পরবর্তীকালে তাহা পূর্ণরূপে বিকশিত হয় বলিয়াই তাঁহার শ্রেষ্ঠ চিত্রগুলি এ-যুগেই অঙ্কিত হয়। নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, সুরেন্দ্রনাথ কর, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শৈলেন্দ্রনাথ দে, প্রমোদ চট্টোপাধ্যায়, যামিনী রায়, মহীশূরের কে. ভেঙ্কটপ্পা প্রমুখ তাঁহার বহু শিল্পশিষ্য এই পরবর্তী যুগে তাহার শিল্পপদ্ধতিকে একটি চিরস্থায়ী নূতন শিল্পশৈলীতে উন্নীত করেন। বাংলার শিল্প-জগতের এই নবজাগরণ এই গ্রন্থের পরবর্তী ও শেষ খণ্ডে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইবে।
পাদটীকা
১. “Yora bungalos are not now frequently seen.” Ward, W. A view of the History, Literature and Mythology of the Hindoos (1817), II. p. 8.
২. দ্বাদশ অধ্যায়ের সঙ্গীত’ উপশিরোনাম দ্রষ্টব্য।
৩. এই মন্দিরগুলির বিস্তৃত বিবরণের জন্য শ্রী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বাঁকুড়ার মন্দির’ ও ‘বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি’ দ্র.।
৪. শ্রী অসীম মুখোপাধ্যায় প্রণীত চব্বিশ পরগণার মন্দির’ দ্র.।
৫. এই তালিকাটির জন্য আমি শ্রী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট ঋণী।
৬. চব্বিশ পরগণার মন্দির, ৮১ পৃষ্ঠা।
৭. পটচিত্রের বিস্তৃত বিবরণের জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি দ্র.।
(ক) শ্রী গুরুসদয় দত্ত-পটুয়া সঙ্গীত (১৯৩৯)।
(খ) W. G. Archer-Bazaar Paintings of Calcutta (1953).
৮. দত্ত-পৃষ্ঠা ___
৯. ঐ ___ পৃষ্ঠা।
১০. Thomas Daniell- Oriental Scenery, 84 Views in Hindoostan, Four Volumes, London, 1795–1803.
১১. অবনীন্দ্রনাথ নিজেই কলিকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ পদপ্রার্থীর আবেদনপত্রে লিখিয়াছেন : “I have studied European Art under Messrs. Ghilardi and Palmer and subsequently done original work in the Oriental style under the guidance and direction of Mr. Havell (Centenary Government College of Art and Craft, Calcutta, p. 30)
১২. Bombay Art Exhibition-এ তিনি Lady Olivant’s Prize পাইয়াছিলেন। ঐ।
১৩. এই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের নিম্নোদ্ধৃত দুইটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :
“সেকাল ছেড়ে কোন শিল্প নেই এটা ঠিক, কিন্তু একাল ছেড়েও কোন শিল্প থাকতে পারে না বেঁচে, এটাও একেবারে ঠিক।” “শিল্পের গতি কালে কালে নতুন নতুন শিল্পীর মতি ধরে চলেছে, কোনো এক কালের বা এক শাস্ত্রের মত ধরে চলেনি, চলতে পারেও না।” (লীলা মজুমদার, অবনীন্দ্রনাথ, ৬৪ পৃ.)।