ত্রয়োদশ অধ্যায় – শিবাজীর রাজ্য এবং শাসন-প্রণালী
শিবাজীর রাজ্যের বিস্তৃতি এবং বিভাগ
শিবাজী দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর অবিরাম পরিশ্রম এবং নিদ্রাহীন চেষ্টার ফলে যে-রাজ্য গঠন করিয়া যান, তাহার বিবরণ এক কথায় দেওয়া অসম্ভব, কারণ নানা স্থানে তাঁহার স্বত্ব নানা প্রকারের এবং তাঁহার প্রভাব বিভিন্ন পরিমাণের ছিল।
প্রথম হইল তাঁহার নিজের দেশ; ইহাকে মারাঠীতে “শিব-স্বরাজ” এবং ফারসীতে “পুরাতন-রাজ্য” (মমালিক-ই-কদিমি) বলা হইত। এখানে তাঁহার অধিকার ও ক্ষমতা স্থায়ী এবং সকলেই তাহা মানিয়া চলিত। ইহার বিস্তৃতি সুরত শহরের ষাট মাইল দক্ষিণে কোলী দেশ হইতে আরম্ভ করিয়া গোঁয়ার দক্ষিণে কারোয়ার নগর পর্য্যন্ত; মাঝে শুধু পশ্চিম উপকূলে পোর্তুগীজদের গোয়া ও দামন প্রদেশ দুইটি বাদ। এই দেশের পূর্ব্বসীমার রেখা বগলানা ঘুরিয়া দক্ষিণ দিকে নাসিক ও পুণা জেলার মধ্যস্থল ভেদ করিয়া, সাতারা ও কোলাপুর জেলা বেড়িয়া, উত্তর কানাড়ার কূলে গঙ্গাবতী নদীতে গিয়া শেষ হয়। মৃত্যুর দুই বৎসর পূর্ব্বে তিনি পশ্চিম কর্ণাটক বেলগাঁও-এর পূর্ব্বে তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে কোপল প্রভৃতি জেলা অধিকার করেন; এগুলি তাঁহার স্থায়ী লাভ।
এই শিব-স্বরাজ তিন প্রদেশে বিভক্ত এবং তিনজন সুবাদারের শাসনাধীন ছিল :
(১) দেশ, অর্থাৎ নিজ মহারাষ্ট্র; পেশোয়ার শাসনে,
(২) কোঁকন, অর্থাৎ সহ্যাদ্রির পশ্চিমাঞ্চল; অন্নাজী দত্তোর অধীনে,
(৩) দক্ষিণ-পূৰ্ব্ব বিভাগ, অর্থাৎ দক্ষিণ-মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিম-কর্ণাটক; দত্তাজী পন্তের শাসনে।
দ্বিতীয়তঃ, পূৰ্ব্ব-কর্ণাটক অর্থাৎ মাদ্রাজে (১৬৭৭-৭৮) দিগ্বিজয়ের ফলে জিঞ্জি বেলুর প্রভৃতি জেলা তাঁহার হাতে আসিয়াছিল বটে, কিন্তু সেখানে তাঁহার ক্ষমতা তখনও স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে নাই; তাঁহার সৈন্যেরা যতটুকু জমি দখলে রাখিতে বা যেখানে রাজস্ব আদায় করিতে পারিত, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিতে হইত; অন্য সর্ব্বত্র অরাজকতা এবং পুরাতন ছোট ছোট সামন্তদের সংঘর্ষ। মহীশূরে বিজিত স্থান কয়টিরও সেই দশা। তাঁহার মৃত্যুর পূর্ব্ব পৰ্য্যন্ত কানাড়া অধিত্যকায়, অর্থাৎ বর্ত্তমান বেলগাঁও ও ধারোয়ার জেলায় এবং সোন্দা ও বিদনুর রাজ্যে, যুদ্ধ চলিতেছিল, সেখানে তাঁহার ক্ষমতা নিঃসন্দেহভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।
তৃতীয়তঃ, এই সব স্থানের বাহিরে নিকটবর্ত্তী প্রদেশগুলিতে তাঁহার সৈন্যেরা প্রতি বৎসর শরৎকালে গিয়ে ছয় মাস বসিয়া থাকিয়া চৌথ আদায় করিত। এই কর রাজার প্রাপ্য রাজার রাজস্ব নহে, ইহা ডাকাতদের খুশী রাখিবার উপায় মাত্র। ইহার মারাঠ নাম “খণ্ডনী” (অর্থাৎ “এই টাকা লইয়া আমাকে রেহাই দাও, বাবা!”) হইতেই তাহা স্পষ্ট বুঝা যায়। কিন্তু চৌথ আদায় করা সত্ত্বেও মারাঠারা অপর শত্রুর আক্রমণ হইতে সেই দেশ রক্ষা করা কর্ত্তব্য বলিয়া স্বীকার করিত না; তাহারা নিজেরা ঐ দেশ লুটিবে না, এইটুকু মাত্র অনুগ্রহ দেখাইত।
রাজস্ব ও ধনভাণ্ডার
শিবাজীর সভাসদ কৃষ্ণাজী অনন্ত ১৬৯৪ সালে লিখিয়াছেন যে, তাঁহার প্রভুর রাজস্বের পরিমাণ বৎসরে এক কোটি হোণ এবং চৌথ আশী লক্ষ হোণ ধাৰ্য্য ছিল। হোণ একটি খুব ছোট স্বর্ণমুদ্রা, ইহার দাম প্রথমে চারি টাকা ছিল, পরে পাঁচ টাকা হয়, সুতরাং এই দুই বাবদে শিবাজীর আয় সাত হইতে নয় কোটি টাকার মধ্যে ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদায় হইত অনেক কম এবং তাহাও সব বৎসরে সমান নহে। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার ভাণ্ডারে যে ধনরত্ন পাওয়া যায় তাহার পরিমাণ মারাঠা ভাষার সভাসদ-বখরে এবং ফারসী ইতিহাস “তারিখ-ই-শিবাজী”তে বিস্ত ারিতভাবে দেওয়া আছে। ইহার মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা ছিল ছয় লক্ষ মোহর এবং প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ হোণ ও সাড়ে বারো খণ্ডী ওজনের ভাঙ্গা সোনা; রৌপ্যমুদ্রা ছিল ৫৭ লক্ষ টাকা, এবং ৫০ খণ্ডী ওজনের ভাঙ্গা রূপা; এ ছাড়া হীরা মণিমুক্তা বহু লক্ষ টাকা দামের। [এক খণ্ডী কলিকাতার সাত মণের কিছু কম, ৬.৮ মণ।]
অষ্টপ্রধান
১৬৭৪ সালে রাজ্যাভিষকের সময় শিবাজীর আটজন মন্ত্রী ছিলেন; সেই উপলক্ষে তাঁহাদের পদের উপাধি ফারসী হইতে সংস্কৃতে বদলান হয় :-
(১) মুখ্যপ্রধান (ফারসী নাম, পেশোয়া); ইনিই প্রধান মন্ত্রী, রাজার প্রতিনিধি ও দক্ষিণ হস্ত-স্বরূপ; নিম্ন-পদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে মতভেদ হইলে ইনি তাহার নিষ্পত্তি করিয়া রাজকার্য্যের সুবিধা করিয়া দিতেন। কিন্তু অপর সাত প্রধান তাঁহার অধীন বা আজ্ঞাবহ ছিল না, সকলেই নিজ নিজ বিভাগে একমাত্র রাজা ভিন্ন আর কাহাকেও প্রভু বলিয়া মানিত না।
(২) আমাত্য (ফারসী, মজমুয়া-দার) অর্থাৎ হিসাব-পরীক্ষক (অডিটর বা একাউনট্যান্ট-জেনারেল); তাঁহার স্বাক্ষর ভিন্ন রাজ্যের আয়ব্যয়ের হিসাবের কাগজ গ্রাহ্য হইত না।
(৩) মন্ত্রী (ফারসী, ওয়াকিয়া-নবিশ); ইনি রাজার দৈনিক কার্য্যকলাপ এবং দরবারের ঘটনার বিবরণ লিখিতেন। যাহাতে রাজাকে গোপনে হত্যা বা বিষ খাওয়াইবার কোনরূপ চেষ্টা না হয়, সেজন্য রাজার সঙ্গী, দর্শনপ্রার্থী আগন্তুক ও খাদ্যদ্রব্যের উপর মন্ত্রীকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইত।
(৪) সচিব (ফারসী, শুরু-নবিস); ইনি সরকারী চিঠিপত্রের ভাষা ঠিক হইল কিনা দেখিয়া দিতেন। যাহাতে জাল রাজপত্রের সৃষ্টি না হয়, সেইজন্য সচিবকে প্রত্যেক ফর্ম্মান ও দানপত্রের প্রথম পংক্তি নিজহস্তে লিখিয়া দিতে হইত।
(৫) সুমন্ত (ফারসী, দবীর) অর্থাৎ পর-রাজ্য-সচিব (ফরেন সেক্রেটারী); ইনি বিদেশী দূতদের অভ্যর্থনা ও বিদায় করিতেন এবং চরের সাহায্যে অন্যান্য রাজ্যের খবর আনাইতেন।
(৬) সেনাপতি (ফারসী, সর্-ই-নৌবৎ)।
(৭) দানাধ্যক্ষ, অথবা মারাঠী ভাষায় ডাক-নাম “পণ্ডিতরাও” (ফারসী, সদর ও মুহতসিবের পদ মিলাইয়া); ইনি রাজার পক্ষ হইতে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের দক্ষিণা ধার্য্য করিয়া দিতেন; ধৰ্ম্ম ও জাত-সম্পৰ্কীয় বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার করিতেন, পাপাচার ও ধর্ম্মভ্রষ্টতার শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত বিধির হুকুম দিতেন।
(৮) ন্যায়াধীশ (ফারসী, কাজী-উল্-কুজাৎ), অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি ( চীফ্ জাষ্টিস); ধৰ্ম্ম-সম্বন্ধীয় মামলা ছাড়া অপর সব বিবাদের বিচারভার ইঁহার হাতে ছিল।
ইঁহাদের মধ্যে সেনাপতি ছাড়া আর সকলেই জাতিতে ব্রাহ্মণ, কিন্তু ব্রাহ্মণ হইলেও (দানাধ্যক্ষ্য ও ন্যায়াধীশ ভিন্ন) অপর পাঁচজন অনেক সময় সৈন্যদলের নেতা হইয়া যুদ্ধে যাইতেন এবং ক্ষত্রিয়ের অপেক্ষা কোন অংশে কম বীরত্ব বা রণ- চাতুর্য্য্য দেখাইতেন না। ফৰ্ম্মান, দানপত্র, সন্ধিপত্র প্রভৃতি সমস্ত বড় বড় সরকারী কাগজে প্রথমে রাজার মোহর, তাহার পর পেশোয়ার মোহর এবং সর্ব্বনীচে অমাত্য মন্ত্রী সচিব ও সুমন্ত– এই চারি প্রধানের স্বাক্ষর থাকিত ।
বর্তমান যুগে বিলাতে মন্ত্রীসভাই (ক্যাবিনেট) দেশের প্রকৃত শাসন-কৰ্ত্তা; তাঁহারা সব বিভাগে নিজ হুকুম চালান, যুদ্ধ সন্ধি রাজস্ব শিক্ষা সর্ব্ববিষয়ে রাজ্যের নীতি স্থির করেন। রাজা তাঁহাদের মত মানিতে বাধ্য, কারণ তাঁহাদের পশ্চাতে দেশের অধিকাংশ লোক আছে এবং রাজা তাঁহাদের উপদেশ অনুসারে কাজ না করিলে তাঁহারা রাগিয়া পদত্যাগ করিবেন, জনসাধারণ ক্ষেপিয়া উঠিবে এবং রাজাকে অপদস্থ (হয়ত পদচ্যুত) হইতে হইবে। কিন্তু শিবাজীর উপর মারাঠী অষ্ট প্রধানের কোন ক্ষমতাই ছিল না; তাঁহারা রাজার কেরানী (সেক্রেটারি) মাত্র, রাজার হুকুম পালন করিতেন, তাঁহাদের কোন উপদেশ শুনা না শুনা রাজার ইচ্ছা। প্রধানেরা কোন বিষয়েই রাজনীতি বাঁধিয়া দিতে পারিতেন না, এমন কি তাঁহাদের নীচের কর্ম্মচারীরা পর্য্যন্ত বিভাগীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজার কাছে আপীল করিতে পারিত। আর এই অষ্ট প্রধানের প্রত্যেকেই স্ব স্ব প্রধান, হিংসাপরাবশ –ইংরাজ ক্যাবিনেটের সদস্যদের মত সুশৃঙ্খল, একজোটে বাঁধা দল ছিল না।
লেখকেরা, এবং অনেক স্থলে হিসাব-রক্ষকেরা সকলেই জাতিতে কায়স্থ ছিলেন (চিটনবিস, ফৰ্দ্দনবিস ইত্যাদি)। সৈন্যদের বেতনের হিসাব লিখিত “সবনিস” উপাধিকারী এক শ্রেণীর কর্ম্মচারী। ইহাদের পদ সামান্য হইলেও প্রভাব ছিল খুব বেশী। শিবাজীর কর্মচারীরা (বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ সুবাদার, থানাদার প্রভৃতি) অতি নির্লজ্জভাবে পীড়ন করিয়া ঘুষ লইত এবং রাজস্ব আত্মসাৎ করিয়া টাকা জমাইত ।
শিবাজীর সৈন্য-সংখ্যা
ইংরাজ-যুগের পূর্ব্বে আমাদের দেশে দুই রকম অশ্বারোহী সৈন্য ভর্তি করা হইত; যাহারা সম্পূর্ণভাবে রাজার চাকর এবং রাজসরকার হইতে অস্ত্র বর্ম্ম ও অশ্ব পাইত তাহাদের নাম “পাগা”; আর যে-সব ভাড়াটে অশ্বারোহী নিজেই অস্ত্র বর্ম্ম ও ঘোড়া কিনিয়া, ডাক পড়িলে নানা রাজ্যে বেতনের লোভে কাজ করিত, তাহারা “সিলাদার”। পাগা সৈন্যদের ফারসী ভাষায় “বার্-গীর” (=ভারবাহী) বলা হইত, ইহা হইতে আমাদের “বরগী” শব্দের উৎপত্তি। যে বৎসর বা যে অভিযানে যত লোক আবশ্যক হইত, সেই অনুসারে রাজা কম বেশী সিলাদার ভাড়া করিতেন।
রাজ্যস্থাপনের গোড়ার দিকে শিবাজীর অধীনে এক হাজার (অথবা বারো শত) পাগা এবং দুই হাজার সিলাদার অশ্বারোহী ছিল। তাহার পর রাজ্যবিস্তার ও দূর দূর দেশ আক্রমণের ফলে তাঁহার সৈন্যদল ক্রমশঃ বাড়িয়া জীবনের শেষ বৎসরে দাঁড়াইয়াছিল– ৪৫ হাজার পাগা (২৯ জন সেনানীর অধীনে ২৯ দলে বিভক্ত) এবং ৬০ হাজার সিলাদার (৩১ জন সেনানীর অধীনে); আর এক লক্ষ মাব্লে পদাতিক (৩৬ জন সেনানীর অধীনে)।
এই পদাতিকগুলি বর্তমান সভ্যজগতের সৈন্যদের মত বারো মাস কুচ- কাওয়াজ করিত না বা রাজার কাজে সৈন্য-আবাসে আবদ্ধ থাকিত না; তাহারা চাষের সময় নিজ গ্রামে গিয়া জমি চাষ করিত, আর বিজয়া দশমীর দিন বিদেশ আক্রমণ করিবার জন্য, অথবা যুদ্ধের আশঙ্কা থাকিলে তাহার আগেই, সৈন্য- নিবাসে আসিয়া জুটিত; তখন তাহাদের অস্ত্র বর্ম্মে সজ্জিত ও দলবদ্ধ করিয়া নেতার অধীনে রাখিয়া সৈন্যদল গঠন করা হইত। দুর্গরক্ষী পদাতিকেরা ইহাদের হইতে পৃথক; তাহারা দুর্গের নীচে চাষ করিবার জন্য জমি পাইত এবং পরিবারদিগকে দুর্গে (কখন-বা ঐ নীচের গ্রামে) রাখিত। ইহারা বারোমেসে চাকর; ঘর ছাড়িয়া দূরে যাইতে হইত না।
শিবাজীর নিজের ১২৬০ (অন্য মতে তিন শত) হাতী, তিন হাজার উট এবং ৩৭ হাজার ঘোড়া ছিল।
সৈন্য-বিভাগের শৃঙ্খলা
রাজার নিজ অশ্বারোহীর (অর্থাৎ পাগা) দল এইরূপে গঠিত হইত। ২৫ জন সাধারণ সৈন্যের (বার্গার-এর) উপর এক হাবলাদার (যেমন সাজ্জেণ্ট), পাঁচ হাবলাদারের (অর্থাৎ ১২৫ জন সাধারণ সওয়ার) উপর এক জুম্লাদার (যেমন কাপ্টেন) এবং দশ জুমলাদারের (অর্থাৎ, ১২৫০ জন সওয়ার) উপর এক হাজারী (অর্থাৎ কর্ণেল)। তাহার উপর পাঁচ হাজারী (বিগ্রেডিয়ার জেনারেল) এবং সর্ব্বোচ্চ সর্-ই-নৌবৎ (কমাণ্ডার-ইন-চীফ)। প্রতি ২৫ জন অশ্বারোহীর জন্য একজন ভিস্তি ও একজন নালবন্ধ নিৰ্দ্দিষ্ট ছিল।
পদাতিক বিভাগে নয়জন সিপাহী বা ‘পাইক’-এর উপর এক নায়ক (কর্পোরাল), পাঁচ নায়কের (অর্থাৎ ৪৫ পাইকের) উপর এক হাবলাদার, দুই (বা তিন) হাবলাদারের উপর এক জুম্হ্লাদার, দশ জুলাদারের (অর্থাৎ ৯০০-১৩৫০ পাইক) উপর এক হাজারী)।
রাজার শরীর-রক্ষী (গার্ড ব্রিগেড ) ছিল দুই হাজার বাছা বাছা মাব্লে পদাতিক, খুব জমকাল পোষাক ও ভাল ভাল অস্ত্রে সজ্জিত।
প্রত্যেক সৈন্য-দলের (রেজিমেন্ট) সঙ্গে হিসাব-পরীক্ষক (মজমুয়াদার), সরকার (কারভারি), আয়-লেখক (জমা-নবিস) এক একজন করিয়া থাকিত।
পাগা জুলাদারের বার্ষিক বেতন ৫০০ হোণ
পাগা মজমুয়াদারের বার্ষিক বেতন ১০০ হইতে ১২৫ হোণ
পাগা হাজারীর বার্ষিক বেতন ১,০০০ হোণ
পাগা জমানবিস প্রভৃতি তিনজনের একুন বার্ষিক বেতন ৫০০ হোণ
পাগা পাঁচ-হাজহারীর বার্ষিক বেতন : ২,০০০ হোণ
পদাতিক জুমলাদারের বার্ষিক বেতন ২০০ হোণ
পদাতিক সবনবিসের বার্ষিক বেতন ৪০ হোণ
পদাতিক হাজারীর বার্ষিক বেতন ৫০০ হোণ
পদাতিক সবনবিসের বার্ষিক বেতন ১০০ হইতে ১২৫ হোণ
শিবাজীর রণ-নীতি
তাঁহার সৈন্যগণ বর্ষাকালে নিজ দেশে ছাউনিতে যাইত; সেখানে শস্য, ঘোড়ার আস্তাবলের ব্যবস্থা থাকিত। বিজয়া দশমীর দিন সৈন্যগণ ছাউনি হইতে কুচ করিয়া বাহির হইত, আর সেই সময় সৈন্যদলের ছোট-বড় সব লোকের সম্পত্তির তালিকা লিখিয়া রাখা হইত, তাহার পর দেশ লুঠিতে যাইত। আট মাস ধরিয়া লস্কর পরের মুলুকে পেট ভরাইত, চৌথ আদায় করিত। স্ত্রী, দাসী, নাচের বাঈজী সৈন্যদলের সঙ্গে যাইতে পারিত না। যে সিপাহী এই নিয়ম ভঙ্গ করিত তাহার মাথা কাটার হুকুম ছিল। “শত্রুর দেশে স্ত্রীলোক বা শিশুকে ধরিবে না, শুধু পুরুষ মানুষ পাইলে বন্দী করিবে। গরু ধরিবে না, ভার বহিবার জন্য বলদ লইতে পার। ব্রাহ্মণদের উপর উপদ্রব করিবে না, চৌথ দিবার জামিন-স্বরূপ কোনও ব্রাহ্মণকে লইবে না। কেহ কু-কর্ম্ম করিবে না। আট মাস বিদেশে সওয়ারী করিবার পর বৈশাখ মাসে ছাউনিতে ফিরিয়া আসিবে। তখন নিজ দেশের সীমানায় পৌঁছিলে সমস্ত সৈন্যের জিনিষপত্র খুঁজিয়া দেখা হইবে, পূর্ব্বের তালিকার সঙ্গে মিলাইয়া যাহা অতিরিক্ত পাওয়া যায় তাহার দাম উহাদের প্রাপ্য বেতন হইতে বাদ দেওয়া যাইবে। বহুমূল্য জিনিষ থাকিলে তাহা রাজসরকারে জমা দিতে হইবে। যদি কোন সিপাহী ধনরত্ন লুকাইয়া রাখে এবং তাহার সর্দ্দার টের পায়, তবে তাহাকে শাসন করিতে হইবে।
“সৈন্যদল ছাউনিতে পৌঁছিলে, হিসাব করিয়া লুঠের সোনা, রূপা, রত্ন ও বস্ত্ৰাদি সঙ্গে লইয়া সব সর্দারেরা রাজার দশনার্থ যাইবে। সেখানে হিসাব বুঝাইয়া দিয়া, মালপত্র রাজভাণ্ডারে রাখিয়া, সৈন্যদের বেতনের হিসাব যাহা প্রাপ্য তাহা রাজকোষ হইতে লইবে। যদি নগদ টাকার বদলে কোন দ্রব্য লইতে ইচ্ছা হয় তাহা হুজুরের কাছে চাহিয়া লইবে। গত অভিযানে যে যেমন কাজ ও কষ্ট সহ্য করিয়াছে তদনুসারে তাহার পুরস্কার হইবে। কেহ নিয়ম-বিরুদ্ধ কাজ করিয়া থাকিলে, তাহার প্রকাশ্য অনুসন্ধান ও বিচার করিয়া তাহাকে দূর করিয়া দেওয়া হইবে। তাহার পর চারি মাস (অর্থাৎ আবার দশহরা পর্য্যন্ত) ছাউনিতে থাকিবে।” [সভাসদ-বখর]
দুর্গের বন্দোবস্ত
প্রত্যেক দুর্গ ও থানা তিন শ্রেণীর কর্মচারীর হাতে রাখা ছিল; তাহাদের প্রত্যেকেই স্ব স্ব বিভাগে প্রধান, প্রত্যেকেই অপর দুইজনের উপর সহিংস সতর্ক দৃষ্টি রাখিত; অতএব তাহাদের পক্ষে একজোটে প্রভুর দুর্গ ধন নাশের ষড়যন্ত্র করা সম্ভব ছিল না। এই তিনজন– (১) হাবলাদার, (২) সর-ই-নৌবৎ, (৩) সবনিস্। ইহাদের প্রথম দুইটি জাতে মারাঠা, তৃতীয়টি ব্রাহ্মণ, সুতরাং জাতিভেদের ঝগড়াতে ঐ তিনজনের দল বাঁধার ভয় দূর হইল। দুর্গের রসদ মাল প্রভৃতি একজন কায়স্থ লেখকের (কারখানা-নবিস)-জিম্মায় থাকিত। বড় বড় দুর্গগুলির দেওয়াল চার- পাঁচ এলাকায় ভাগ করা ছিল, প্রত্যেক এলাকা একজন রক্ষীর (তট্-সর-ই) নৌবৎ-এর) হাতে। দুর্গের বাহিরে পাওয়াবি ও রামুশী (বংশগত চোর) –এই দুই জাতের লোক চৌকী দিত।
দুর্গের হাবলাদার নীচের আমলাদের নিয়োগ বরখাস্ত করিতে পারিত, সরকারী চিঠিপত্র তাহার নামে আসিত এবং সরকারের জন্য লিখিত চিঠিপত্রে নিজের মোহর দিয়া পাঠাইত। তাহার কর্তব্য ছিল প্রত্যহ সন্ধ্যায় দুর্গদ্বার চাবি বন্ধ করা এবং প্রাতঃকালে তাহা খোলা। এই ফটকের চাবিগুলি সে সৰ্ব্বদা সঙ্গে রাখিত, রাত্রে পর্য্যন্ত বালিসের নীচে গুঁজিয়া ঘুমাইত। সৰ্ব্বদাই চারিদিকে ঘুরিয়া দুর্গের ভিতরে ও বাহিরে সব ঠিক আছে কিনা দেখিত, আর অসময়ে খবর না দিয়া হঠাৎ গিয়া পাহারাদারেরা ঘুমাইতেছে কি সতর্ক আছে তাহার খোঁজ লইত। সর-ই-নৌব রাত্রের চৌকীদারদের কাজ দেখিত।
ভূমির কর ও প্রজাশাসন-প্রণালী
“দেশের সমস্ত জমি জরিপ করিয়া ক্ষেত্র ভাগ করিবে। আটাশ আঙ্গুলে একহাত, পাঁচ হাত ও পাঁচ মুঠিতে এক কাঠি, বিশ কাঠি লম্বা ও বিশ কাঠি প্রস্থে এক বিঘা, ১২০ বিঘায় এক চাবর। এইরূপে প্রত্যেক গ্রামের জমির কালি মাপ করা হইবে। প্রতি বিঘার ফলস নির্দ্ধারণ করিয়া তাহার দুইভাগ রাজা লইবেন, আর তিন ভাগ প্ৰজা পাইবে।
“নূতন প্রজা বসতি করাইয়া তাহাদের খাইবার বাবদে এবং গাইবলদ ও বীজশস্য কেনার জন্য টাকা অগ্রিম দিবে এবং তাহা দুই-চার বৎসরে পরিশোধ করিয়া লইবে। রায়তদের নিকট হইতে ফসল কাটার সময় ফসলের আকারে রাজকর লইবে।
“প্রজাগণ জমিদার, দেশমুখ ও দেশাইদের আজ্ঞাধীন থাকিবে না; উহারা প্রজাদের উপর কোন কর্তৃত্ব করিতে পারিবে না। অন্যান্য রাজ্যে এইসব পুরুষানুক্রমিক ভূস্বামীরা (মিরাসদার) ধন, ক্ষমতা ও সৈন্যবলে বাড়িয়া প্রায় স্বাধীন হইয়া উঠিয়াছিল; অসহায় প্রজারা সব তাহাদের হাতে; তাহারা দেশের রাজাকে অগ্রাহ্য করিত এবং প্রজার দেওয়া রাজকর নিজে খাইয়া রাজসরকারে অতি কম টাকা জমা দিত। শিবাজী এই শ্রেণীর জমিদারের দর্প চূর্ণ করিলেন। মিরাদারদের গড় ভাঙ্গিয়া দিয়া, কেন্দ্রস্থানগুলিতে নিজ সৈন্যের থানা বসাইয়া, জমিদারদের হাত হইতে সব ক্ষমতা কাড়িয়া লইয়া, তাহাদের প্রাপ্য আয় নির্দিষ্ট হারে বাঁধিয়া দিয়া, প্রজাপীড়নের ও রাজস্ব-লুণ্ঠনের পথ বন্ধ করিয়া দিলেন। জমিদারদের গড়-নির্মাণ নিষিদ্ধ হইল। প্রত্যেক গ্রাম্য-কৰ্ম্মচারী নিজ ন্যায্য পারিশ্রমিক (অর্থাৎ শস্যের অংশ) ভিন্ন আর কিছু পাইবে না।” [সভাসদ]
তেমনি জাগীরদারগণও নিজ নিজ জাগীরের মহালে শুধু খাজনা আদায় করিবেন, প্রজাদের উপর ভূস্বামী বা শাসনকর্তার মত কোন প্রকার ক্ষমতা তাঁহাদের নাই। কোন সৈন্য আমলা বা রায়তকে জমির উপর স্থায়ী স্বত্ত্ব (মোকাসা) দেওয়া হইত না, কারণ তাহা হইলে তাহারা স্বাধীন হইয়া বিদ্রোহ সৃষ্টি করিত এবং দেশে রাজার ক্ষমতা লোপ পাইত।
কমবেশী এক লাখ হোণ আদায়ের মহালের উপর একজন সুবাদার (বার্ষিক বেতন চারিশত হোণ) ও একজন মজুমুয়াদার (বেতন ১০০ হইতে ১৫০ হোণ) রাখা হইত; পালকী খরচ বাবদে সুবাদারকে আরও চারি শত হোণ দেওয়া হইত। এই সমস্ত সুবাদার জাতে ব্রাহ্মণ এবং পেশোয়ার তত্ত্বাবধানে থাকিত। [সভাসদ]
ধৰ্ম্ম-বিভাগ
রাজ্যমধ্যে যেখানে দেব ও দেবস্থান ছিল, শিবাজী তাহাতে প্রদীপ নৈবেদ্য নিত্যস্নান প্রভৃতির যথাযোগ্য বন্দোবস্ত করিতেন। মুসলমান পীরের আস্তানা ও মসজিদে প্রদীপ ও শিরণী সেই সেই স্থানের নিয়ম অনুসারে রাখিবার জন্য অর্থ সাহায্য দিতেন। বাবা ইয়াকুৎ নামক পীরকে ভক্তি করিয়া নিজ খরচে কেশী- নামক শহরে বসাইয়া জমি দান করিলেন। “বেদক্রিয়া-দক্ষ ব্রাহ্মণদের মধ্যে যোগক্ষেম ব্রাহ্মণ, বিদ্যাবন্ত, বেদশাস্ত্র-সম্পন্ন জ্যোতিষী, অনুষ্ঠানী, তপস্বী, সৎপুরুষ গ্রামে গ্রামে বাছিয়া তাহাদের পরিবারের সংখ্যা অনুসারে যে পরিমাণ অন্নবস্ত্র লাগে সেই আয়ের মহাল ঐ গ্রামে গ্রামে দিলেন। প্রতি বৎসর সরকারী আমলারা এই সাহায্য তাঁহাদের পৌঁছাইয়া দিত।” [সভাসদ্]
“লুপ্ত বেদচর্চ্চা শিবাজীর অনুগ্রহে আবার জাগিয়া উঠিল। যে ব্রাহ্মণ ছাত্ৰ এক বেদ কণ্ঠস্থ করিয়াছে তাহাকে প্রতি বৎসর এক মণ চাউল, যে দুই বেদ কণ্ঠস্থ করিয়াছে তাহাকে দুই মণ, ইত্যাদি পরিমাণে দান করা হইত। প্রত্যেক বৎসর তাঁহার পণ্ডিত রাও শ্রাবণ মাসে ছাত্রদের পরীক্ষা করিয়া তাহাদের বৃত্তি কমবেশী করিয়া দিতেন। বিদেশী পণ্ডিতদের সামগ্রী এবং মারাঠা দেশের পণ্ডিতদেব খাদ্য দক্ষিণা-স্বরূপ দেওয়া হইত। মহাপণ্ডিতদের ডাকিয়া সভা করিয়া নগদ টাকা বিদায় দেওয়া হইত।” [চিটনিস-বখর]
রামদাস স্বামী
শিবাজীর গুরু রামদাস স্বামী (জন্ম ১৬০৮, মৃত্যু ১৬৮১, খৃঃ) মহারাষ্ট্র দেশের অতি বিখ্যাত এবং সর্বজনপূজ্য সাধু-পুরুষ। তাঁহার ভক্তি-শিক্ষার বাণী অতি সরল, সুন্দর ও পবিত্র। ১৬৭৩ সালে সাতারা-দুর্গ জয় করিবার পর শিবাজী গুরুকে উহার চারি মাইল দক্ষিণে পারলী (অথবা সজ্জনগড়)-এ আশ্রম বানাইয়া দেন। এখনও লোকে বলে যে সাতারার ফটকের উপর চূড়ায় একখানা পাথরের ফলকে বসিয়া শিবাজী পাবলী-স্থিত গুরুর সঙ্গে দৈববলে কথাবার্তা কহিতেন। রামদাস আর আর সন্ন্যাসীর মত প্রত্যহ ভিক্ষা করিতে যাইতেন। শিবাজী ভাবিলেন, “গুরুকে এত ধন ঐশ্বর্য্য দান করিয়াছি, তবুও তিনি ভিক্ষা করেন কেন? তাঁহার কিসে সাধ পূরিবে?” তারপর পরদিন একখানা কাগজে রামদাসের নামে সমস্ত মহারাষ্ট্র রাজ্য ও রাজকোষ দিলাম বলিয়া দানপত্র লিখিয়া তাহাতে সহ মোহর ছাপিয়া, ভিক্ষার পথে গুরুকে ধরিয়া তাঁহার পায়ের উপর রাখিলেন। রামদাস পড়িয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “বেশ, তা, এসব গ্রহণ করিলাম। আজ হইতে তুমি আমার গোমস্তা মাত্র হইলে। এই এই রাজ্য তোমার নিজের ভোগ সুখের বা স্বেচ্ছাচাব করিবার দ্রব্য নহে; তোমার মাথার উপরে এক বড় প্রভু আছেন, তাঁহার জমিদারী তুমি তাঁহার বিশ্বাসী ভৃত্য হইয়া চালাইতেছে– এই দায়িত্বজ্ঞানে ভবিষ্যতে রাজ্যশাসন করিবে।“
রাজ্যের প্রকৃত স্বত্বাধিকারী যখন এক সন্ন্যাসী, তখন সেই সন্ন্যাসীর গেরুয়া- বস্ত্র শিবাজীর রাজপতাকা হইল– ইহার নাম “ভাগবে ঝাণ্ডা।”
“সমর্থ” রামদাস স্বামীর জীবন ও শিক্ষা
১৬০৮ সালের চৈত্র মাসে শুক্ল নবমীতে সূর্য্য-উপাসক একটি ব্রাহ্মণ-বংশে রামদাসের জন্ম, তাঁহার পিতার দেওয়া নাম ‘নারায়ণ’। বাল্যকাল হইতেই তাঁহার প্রাণ ধর্ম্মের দিকে আকৃষ্ট হইল; জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মন্ত্রগ্রহণের সময় তিনিও মন্ত্ৰ লইবার জন্য জেদ করিতে লাগিলেন। বারো বৎসর বয়সে এই পিতৃহীন বালক মাতার ব্যাকুল অনুরোধে বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন বটে, কিন্তু মন্ত্র পড়িবার সময় বিবাহ-সভা হইতে দৌড়িয়া পলাইয়া গেলেন, এবং সংসার ত্যাগ করিলেন।
*** ***
তাহার পর আরও দশ বৎসর ধরিয়া তিনি রামগড় দুর্গের নিকট শিবতর- গ্রামে নিৰ্জ্জনবাস ও চিন্তার ফলে ‘দাস-বোধ” নামক পদ্যগ্রন্থ (২০ সর্গে) রচনা করিয়া তাহাতে নিজের ধর্ম্ম-উপদেশ লিপিবদ্ধ করিলেন। সংস্কৃত ও প্রাচীন মারাঠী সাহিত্যে তাঁহার পাণ্ডিত্য ছিল, এজন্য গ্রন্থখানি বড়ই উপাদেয় হইয়াছে।
রামদাসের পুণ্য-প্রভাবে মোহিত হইয়া শিবাজী ‘শ্রীরাম, জয় রাম, জয় জয় রাম” এই মন্ত্রে তাঁহার নিকট দীক্ষা লইলেন। গুরু তাঁহাকে সংক্ষেপে অতি মহান উপদেশ দিলেন। কিন্তু যখন শিবাজী ভক্তির আবেগে বলিলেন, “আমি আপনার চরণে থাকিয়া সেবা করিব” তখন রামদাস তাঁহাকে ধমকাইয়া নিষেধ করিলেন, বলিলেন, “ইহার জন্যই কি তুমি আমার কাছে প্রার্থী হইয়া আসিয়াছ? তুমি ক্ষত্রিয়, কর্মবীর, –তোমার কর্ত্তব্য দেশ ও প্রজাদের বিপদ হইতে রক্ষা করা, দেব্রাহ্মণের সেবা করা। তোমার করিবার অনেক কাজ রহিয়াছে। ম্লেচ্ছগণ দেশ ছাইয়া ফেলিয়াছে; তোমার কর্তব্য তাহাদের হাত হইতে দেশে উদ্ধার করা। ইহাই রামচন্দ্রের অভিপ্রায়। ভগবদ্ গীতায় অৰ্জ্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ স্মরণ কর– যোদ্ধার কর্তব্যের পথে চল, কর্ম্মযোগ সাধনা কর।
১৬৭৩ সালে পারলি-দুর্গ অধিকার করিবার পর শিবাজী সেখানে রামদাস স্বামীকে আনিয়া বসাইলেন, তাঁহার জন্য মন্দির ও মঠ নির্ম্মাণ করিয়া দিলেন, দুর্গের নূতন নাম রাখিলেন সজ্জনগড়, অর্থাৎ “সাধুর গড়”; সন্ন্যাসী ও ভক্তদের ভরণ-পোষণের জন্য নিকটের গ্রামে দেবোত্তর জমি দিলেন।
কর্মযোগের আদর্শ
রামদাস শিবাজীকে শ্ৰেষ্ট কৰ্ম্মযোগী বলিয়া সৰ্ব্বদাই প্রশংসা করিতেন, তাঁহাকে সকলের সম্মুখে রাজার আদর্শ বলিয়া ধরিতেন। রামদাস কর্তৃক পদ্যে রচিত শিবাজীর নামে এক পত্র মহারাষ্ট্র দেশে প্রচলিত আছে, তাহাতে গুরু রাজাকে সম্বোধন করিতেছেন– “হে নিশ্চয়ের মহামেরু! বহুলোকের সহায়, অটলপ্রতিজ্ঞ, ইন্দ্রিয়জয়ী, দানবীর, অতুল গুণসম্পন্ন, নরপতি, অশ্বপতি, গজপতি, সমুদ্র ও কিক্ষতির অধীশ্বর, সদা প্রবল বিজয়ী, বিখ্যাত ধার্ম্মিক বীর! …পৃথিবী তোলপাড় হইয়াছে; ধৰ্ম্ম লোপ পাইয়াছে। গো-ব্রাহ্মণ, দেব ধর্ম রক্ষা করিবার জন্য নারায়ণ তোমাকে পাঠাইয়াছেন।…ধর্ম্মসংস্থাপনের জন্য নিজ কীর্তি অমর রাখিও।”
শিবাজী শেষ-বয়সে রাজকার্য্যে সর্ব্বদা স্বামীর উপদেশ লইতেন। রামদাসের শিক্ষার ভক্তিযোগ ও কর্ম্মযোগের অনির্ব্বচনীয় সামঞ্জস্য হইয়াছিল। তাঁহার জীবনের দৃষ্টান্ত এবং জটিল রাজনৈতিক সমস্যায় শিবাজীর প্রতি উপদেশ মহারাষ্ট্র-স্বাধীনতার সাধনাকে সিদ্ধির সহজ পথে আনিয়া দেয়। রামদাসের ধৰ্ম্মশিক্ষাকে “ফলিত ভগবদ্গীতা” বলা যাইতে পারে; তাঁহার শিষ্য গীতার জীবন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন।
রামদাসের রাজনৈতিক উপদেশ
শিবাজীর পর যুবক শম্ভুজী যখন রাজা হইলেন, তখন বৃদ্ধ রামদাস মৃত্যু আসন্ন বুঝিয়া নূতন রাজাকে অনেক উপদেশ দিয়া পদ্যে এক পত্র লেখেন। তাহাতে আছে–
বহু লোককে একত্র করিবে,
বিচার করিয়া লোক নিযুক্ত করিবে,
শ্রম করিয়া আক্রমণ করিবে
ম্লেচ্ছের উপর। ১৪
যাহা আছে তাহার যত্ন করিবে,
পরে আরও [রাজ] যোগ করিবে,
মহারাষ্ট্র-রাজ্য [বিস্তার] করিবে
যত্রতত্র। ১৫
লোকদের সাহস দিবে,
বাজি রাখিয়া তরবারি চালাইবে,
‘চড়িয়া বাড়িয়া’ [ক্রমে অধিকতর] খ্যাতি
লাভ করিবে। ১৬
শিব রাজারে স্মরণ রাখিও,
জীবনকে তৃণ সমান মনে করিও,
ইহলোকে পরলোকে তরিবে
কীর্তিরূপে। ১৭
শিব রাজার রূপ স্মরণ কর,
শিব রাজার দৃঢ় সাধনা স্মরণ কর,
শিব রাজার কীর্তি স্মরণ কর
ভূমণ্ডলে। ১৮
শিব রাজার বোলচাল কেমন,
শিব রাজার চলন কেমন,
শিব রাজার বন্ধু করিবার ক্ষমতা কেমন,
সেইমত। ১৯
সকল সুখ ত্যাগ করিয়া,
যোগ সাধিয়া,
রাজ্য-সাধনায় কেমন তিনি
দ্রুত অগ্রসর হইয়াছিলেন। ২০
তুমি তাহারও অধিক করিও;
তবে ত তোমাকে পুরুষ বলিয়া জানা যাইবে
***। ২১
শিবাজী-পরিবার
শিবাজীর আট বিবাহ-
১. সই বাঈ (নিম্বলকরের কন্যা); মৃত্যু ৫ সেপ্টেম্বর, ১৬৬৯, তাঁহার পুত্র শম্ভুজী।
২. সয়িরা বাঈ (শির্কের কন্যা); শিবাজীকে বিষ খাওয়াইয়া মারিয়াছিলেন এই অপবাদ দিয়া শম্ভুজী তাঁহার প্রাণবধ করেন। তাঁহার পুত্র রাজারাম।
৩. পুতলা বাঈ (মোহিতের কন্যা); স্বামীর চিতায় প্রাণ বিসর্জ্জন করেন।
৪. সাকোয়ার বাঈ (গাইকোয়াড়ের কন্যা); বিবাহ ১৬৫৬ সালে। ১৬৮৯ সালে মুঘলেরা রায়গড় অধিকার করিবার পর বন্দী হইয়া ইঁহাকে অনেক বৎসর আওরংজীবের শিবিরে থাকিতে হয়।
৫. কাশী বাঈ। মৃত্যু ১৬৭৪, মার্চ মাসে।
৬,৭. দুইজন স্ত্রী ৬৭৪ সালের মে মাসে শিবাজীর অভিষেকের পূর্ব্বে বৈদিক মন্ত্রসহ ইঁহাদের বিবাহ হয়।
৮. একজন স্ত্রী, ৮ই জুন ১৬৭৪ সালে বিবাহ হয়।
শিবাজীর দুই পুত্র ও তিন কন্যা ছিল, যথা–
১. শম্ভুজী, জন্ম ১৪ই মে ১৬৫৭, সিংহাসনলাভ ২৮ জুন, ১৬৮০। আওরংজীব কৰ্ত্তক প্রাণবধ ১১ মার্চ, ১৬৮৯।
২. রাজারাম, জন্ম ২৪ ফেব্রুয়ারী ১৬৭০, সিংহাসন-অধিরোহণ ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৬৮৯, মৃত্যু ২ মার্চ ১৭০০।
৩. সখু বাঈ, মহাদজী নিম্বলকরেব স্ত্রী।
৪. অম্বিকা বাঈ, হরজী মহাডিকের স্ত্রী।
৫. রাজকুমারী বাঈ, গণোজীরাজ শির্কের স্ত্রী।
শিবাজীর আকৃতি ও ছবি
শিবাজীর বয়স যখন ৩৭ বৎসর তখন (অর্থাৎ ১৬৬৪ সালে) সুরতের জনকতক ইংরাজ তাঁহাকে দেখিয়া এইরূপ বর্ণনা লিখিয়াছেন– “তাঁহার দৈর্ঘ্য মাঝামাঝি রকমের, কিন্তু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি বেশ পরিমাণ-সই। তাঁহার চলন-ফেরন সতেজ জীবন্ত; মুখে মৃদুহাসি লাগিয়াই আছে; চক্ষুদুটি তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল, সবদিকে ঘুরিতেছে। তাঁহার বর্ণ সাধারণ দক্ষিণীদের অপেক্ষা গৌর।” ফরাসী-পর্য্যটক তেভেনো ইহার দুই বৎসর পরে লেখেন, –“এই রাজার আকার ছোট, বর্ণ ফরসা, চক্ষুদুটি প্রচুর তেজঃপূর্ণ এবং চঞ্চল।”
শিবাজীর তিনখানি বিশ্বাসযোগ্য ছবি আছে; এগুলি যে তাঁহার সময়ে আঁকা, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়।
(১) লণ্ডন ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত প্রতিকৃতি। ইহা একজন ডচ্ ভদ্রলোক আওরংজীবের জীবদ্দশায় (অর্থাৎ ১৭০৭-এর পূর্ব্বে) ভারতবর্ষে ক্রয় করেন।
(২) হল্যাণ্ডে রক্ষিত প্রতিকৃতি। ১৭৭২ সালে ডচ্-দূত বাদশাহর নিকট লাহোরে যাইবার সময় ইহা ক্রয় করেন। ১৭২৪ সালে ভ্যালেন্টিন ইহার এক এনগ্রেডিং তাঁহার পুস্তকে প্রকাশ করেন। এই ছবির একটি অতি সুন্দর (এবং কতক পরিবর্তিত) ষ্টীল এনগ্রেডিং অৰ্ম্ম তাঁহার Historical Fragments গ্রন্থে ১৭৮২ সালে ছাপেন এবং তাহাই নানাস্থলে পুনর্মুদ্রিত হইয়া ভারতে সর্বত্র পরিচিত হইয়াছে।
(৩) কুমার মুয়জ্জমের চিত্রকর মীর মহম্মদ অশ্বপৃষ্ঠে শিবাজীর যে চিত্র আঁকিয়া ১৬৮৬ সালে মানুশীকে উপহার দেয়, তাহা এখন প্যারিসের রাষ্ট্রীয় পুস্ত কাগারে রক্ষিত আছে। ইহার সুন্দর প্রতিলিপি আভিন-সম্পাদিত Storia do Mogor গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে আছে এবং দুখানা খারাপ অনুকরণ (বোধ হয় উড়-কাট) ১৮২১ এবং ১৮৪৫ সালে দুইখানি ফরাসী গ্রন্থে মুদ্রিত হয়। কিন্তু দক্ষতার অভাবে এই চিত্রকর শিবাজীর মুখে তাঁহার চরিত্রের বিশেষটুকু ফুটাইয়া তুলিতে পারে নাই। বম্বের মিউজিয়মে এবং পুণার ইতিহাস-মণ্ডলের হস্তে শিবাজীর দুইখানা ছবি আছে; প্রথমটিতে শিবাজী অসিহস্তে দণ্ডায়মান, দ্বিতীয়টিতে তিনি অশ্বারোহণ তরবারি দিয়া সিংহ-শিকারে নিযুক্ত (মিনিএচার)। এগুলি মুঘল-যুগের হইলেও আঁকিবার কাল ঠিক নির্ণয় করা যায় না। সব ছবিতেই শিবাজীর মুখ একই গঠনের, কিন্তু প্রথম দুইখানি ছবিতে তাঁহার তেজপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ঠিক প্ৰকাশ পাইয়াছে।