১৩. শস্যবৈচিত্র ও চুক্তি-চাষ, খাদ্য অনিশ্চয়তা ও পৌষ্টিক দারিদ্র

ত্রয়োদশ অধ্যায়

শস্যবৈচিত্র ও চুক্তি-চাষ, খাদ্য অনিশ্চয়তা ও পৌষ্টিক দারিদ্র

সনাতন খাদ্যশস্য-নির্ভরতার সমস্যা

গত প্রায় তিন দশক ধরে ভারতীয় কৃষি একটা পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলেছে। অন্তর্দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর বাধানিষেধগুলি অপসৃত প্রায়। উন্নত দেশগুলি তাদের দেশের বাজারকে উন্নয়নশীল দেশের রফতানি-বাজার হিসেবে উন্মুক্ত করতে উৎসাহী না হলেও উন্নয়নশীল দেশের রফতানি এবং আমদানির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে ভরতুকি হ্রাস, কৃষিতে পুঁজিগঠনের কাজে ও কৃষির উন্নয়নমূলক কাজে সরকারি ব্যয় হ্রাস, ফান্ড-ব্যাংকের নির্দেশে বেসরকারি কোম্পানি ও বহুজাতিক সংস্থার কৃষি-উপকরণ শিল্পে অনুপ্রবেশ, এই সমস্ত পরিবর্তনের সংযোগে কৃষি-উপকরণের দাম বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে কৃষি-উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি, ভরতুকি হ্রাস ছাড়াও, সার উৎপাদন-শিল্পের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়া, এবং অত্যন্ত দুর্মূল্য বীজ কেনার ওপর নির্ভরতা কৃষি-উপকরণের ব্যয় অত্যধিক বাড়িয়ে তুলেছে। পুঁজিগঠনের সরকারি বিনিয়োগ হ্রাস যদিও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করেছে কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ সরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন মেটাতে পারে না। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ পরস্পরের পরিপূরক। ফলে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত সরকারি বিনিয়োগের অভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের মাত্রা কম থাকে। সরকারি বিনিয়োগ হ্রাসের ক্ষতিকারক প্রভাব সবচেয়ে বেশি বোঝা যায় স্থির পুঁজি গঠনের ক্ষেত্রে। স্থির পুঁজিগঠনে সরকারি ব্যয় হ্রাসের ফলে বড় সেচ প্রকল্পগুলি শুরু হতে পারে না, বা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ১৯৮১–’৮৫ সালে কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিগঠনের পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৩.১ ভাগ থেকে ১৯৯১–২০০২ সালের মধ্যে শতকরা ১.৬ ভাগে নেমে আসে। এই পর্বে কৃষিতে মোট পুঁজিগঠনের শতকরা অংশ হিসেবে স্থির পুঁজিগঠনের পরিমাণ লক্ষণীয়ভাবে নেমে যায়। ফলে এইসময়ে বিভিন্ন শস্যের উৎপাদন-বৃদ্ধির হারও কমে। উপরন্তু স্থির পুঁজিগঠনে সরকারি বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে বেসরকারি সেচ ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সেচের জলকে দুর্মূল্য করে তোলে। এর নিট ফল এই হয় যে, অধিক জলনির্ভর সনাতন খাদ্যশস্যকেন্দ্রিক কৃষিব্যবস্থা সংকটের মধ্যে পড়ে। জলনির্ভর সনাতন খাদ্যশস্যকেন্দ্রিক কৃষিতে প্রতি একক বিনিয়োগ থেকে আয় কমে আসে। এবং কখনও কখনও দেখা যায় নিট আয় ঋণাত্মক। একটি ক্ষুদ্র ও ছোট জোত অধ্যুষিত কৃষি-অর্থনীতিতে যেখানে বহুদিন ধরে অধিক সার প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে এসেছে এবং প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন অত্যন্ত কম, সেখানে এই ধরনের অতি উচ্চ উৎপাদন-ব্যয় কৃষিকে অর্থনৈতিকভাবে অচল করে দেয়। আমরা দেখেছি এমনকী পঞ্জাবের মতো রাজ্যে, যেখানে সবুজ বিপ্লবের প্রযুক্তি সবচেয়ে সফলভাবে প্রযুক্ত হয়েছে, সেখানেও উৎপাদন-হার কমেছে, চাষের ব্যয় অতিরিক্ত বেড়েছে, চাষির পক্ষে উৎপাদন অলাভজনক হয়ে উঠেছে, ফলে চাষিকে প্রাথমিক মূলধনের জন্য ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের অপ্রতুলতা চাষিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করে, কৃষি উপকরণ-বিক্রেতা বহুজাতিক সংস্থার দেশি এজেণ্ট যারা ঋণ, উপকরণ ও পণ্যের বাজারে যুক্ত বাজার-ব্যবস্থা চালু করে এবং উপকরণের বাজারে বিক্রয়ের পরিমাণ স্থির হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, চাষিরা তাদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়।

ভারতের কৃষিকে এই স্থবিরত্বের অবস্থা থেকে মুক্ত করতে হলে কৃষিকে অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়নিক সার-নির্ভর প্রযুক্তি থেকে মুক্ত করে সেখানে স্থানীয় অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জৈবপ্রযুক্তি নির্ভর প্রকৌশলের প্রয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, জৈবপ্রযুক্তি-নির্ভর প্রকৌশলের উদ্ভাবনে বহুজাতিক সংস্থাগুলিই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। ভারতের কৃষি-প্রযুক্তি ও উপকরণের বাজারে এই বহুজাতিক সংস্থার এজেন্টরা পেটেন্টের সাহায্যে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করে। মনসান্টো কোম্পানি এই ক্ষেত্রে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি বিদেশি কোম্পানি যারা নতুন জৈব বীজ বিষয়ে এদেশের জৈবপ্রযুক্তি গবেষণা ও উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এদেশে জৈবপ্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণারত বেসরকারি কোম্পানিগুলি বিদেশ থেকে আমদানি করা আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি জোগানদাতা কোম্পানির সঙ্গে প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় নতুন বীজ নির্মাণ করে। এই বীজের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। এবং এই বীজের ওপর নির্ভরতা চাষিদের দুর্দশার অন্যতম কারণ। চাষিদের দুর্দশার দ্বিতীয় কারণ হল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশ অনু্যায়ী অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে খোলা-বাজার নীতিটির যথাযথ প্রয়োগের বাধ্যবাধকতা। এর ফলে সরকারি রেশন ব্যবস্থা ও সরকারের তরফে পারিবারিক শ্রমের দামের ওপর খানিকটা উদ্বৃত্ত বজায় রেখে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করা ও সেই মূল্যে চাষিদের কাছ থেকে শস্য সংগ্রহের যে-ব্যবস্থা এতদিন চালু ছিল তা বেশ কিছুটা অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে অধিক ব্যয়ে উৎপাদিত চাল, গম, তুলার বিক্রি এবং দাম অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। চাষিদের দুর্দশার তৃতীয় কারণ হল, বিশ্বব্যাংক নির্দেশিত বহির্বাণিজ্যে খোলা-বাজার নীতির কারণে ব্যয়বহুল আধুনিক প্রযুক্তিতে তুলা বা গমের মতো যে-সনাতন পণ্যগুলি ভারতে উৎপন্ন হচ্ছে তা আমাদের বাজারেই বিদেশ থেকে আমদানি করা ভরতুকি-যুক্ত সস্তার পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে। বিশ্বব্যাংক-আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার প্রভাবিত নতুন সরকারি নীতি প্রয়োগের পরিণামে সনাতন খাদ্যশস্য যেগুলিতে ভারত এতকাল তুলনামূলক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল এখন সেই পণ্যগুলিতেই তারা প্রতিযোগিতায় হটে যায়। চাষিদের পণ্যগুলি অবিক্রীত পড়ে থাকে। চাষের খরচ মেটাবার জন্য নেওয়া ঋণ সুদে-মূলে মেটাতে না পেরে তারা অনেকসময়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গমের মতো অধিক জলনির্ভর পণ্য উৎপাদকরা বিশেষভাবে দুর্দশায় পড়ে। তার কারণ, দীর্ঘদিন সবুজ বিপ্লব-প্রযুক্তি কাজে লাগাতে গিয়ে ভূগর্ভস্থিত জল পরিমাণে তুলে ফেলা হয়েছে, জলের খরচ বেড়েছে, ফলে উৎপাদন-ব্যয়ও অতিরিক্ত অত্যধিক বেড়েছে। আমরা আগেই দেখেছি, ভারতীয় চাষির আত্মহত্যার ঘটনাগুলিকে কয়েকটি স্থানীয়, তাৎক্ষণিক, বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা যায় না। এই ঘটনাগুলির মূল রয়েছে নতুন নীতিগুচ্ছের প্রভাবে ভারতীয় কৃষির বর্তমান অবস্থার মধ্যে। প্রথমত কৃষি-উৎপাদনে ও উৎপাদনের বৃদ্ধির হারে এবং আমদানি ও রফতানিতে পরিমাণগত ও অন্যান্য দিকের পরিবর্তনে সংস্কারের প্রভাব। দ্বিতীয়ত, এইসব উপকরণের দাম ও উৎপাদন ব্যয়ের পরিবর্তন, বিভিন্ন মাপের জোতে চাষে যুক্ত চাষিদের ওপর এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব, সরকারের তরফে উৎপাদন-ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হ্রাস ও বেসরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি। এইসব বিষয়ে সংগৃহীত পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন গবেষকের পর্যবেক্ষণনির্ভর আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি, ভারতীয় কৃষিতে বিভিন্ন নীতির প্রয়োগ তাকে পিছিয়ে-পড়া বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে মুক্ত করতে পারেনি। কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটায়, কৃষিপণ্য আরও বেশি রফতানিমুখী হওয়ায় যেমন কৃষি-উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, তেমনই কৃষিপণ্যের দামের অনিশ্চয়তা, অত্যধিক উৎপাদন-ব্যয় দেশের বাজারে আমদানি করা ভরতুকি-যুক্ত পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছে। সরকার তার সহায়ক মূল্যের নীতিটি উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে, কৃষিপণ্য, কৃষি-উপকরণ ও কৃষি-ঋণের বাজারের যুগ্ম কার্যকারিতার ফলে কৃষি-উদ্বৃত্ত উৎপাদনক্ষেত্র থেকে অনুৎপাদক ক্ষেত্রে সরে যাচ্ছে। এইরকম বিভিন্ন পশ্চাদগামী প্রক্রিয়ার সমাবেশ কৃষি-উৎপাদনকে দীর্ঘকালীন স্থবিরত্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিকে তার দীর্ঘস্থায়ী জাড্য থেকে মুক্ত করার উপায় হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদল ভারতের কৃষিকে সনাতন, অধিক জলনির্ভর শস্যগুলির উপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত করে হালকা, অধিক মূল্যের ফল, সবজি ইত্যাদি চাষের মাধ্যমে শস্যবৈচিত্র বাড়ানোর পরামর্শ দেয়। সেই অনুযায়ী এই শতাব্দীর শুরুতে কৃষি-অর্থনীতির কয়েকজন পর্যবেক্ষক দ্বারা প্রস্তাবিত এবং বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সমর্থিত তিনটি বিশেষ পরামর্শ (বিশ্বব্যাংক ২০০৫) সামনে আসে। এই তিনটি প্রস্তাবিত নতুন নীতি হল: প্রথমত, কৃষিতে শস্যবৈচিত্র প্রসারে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে, যার অর্থ ভারতীয় কৃষিকে সনাতন খাদ্যশস্যে কেন্দ্রীভূত অবস্থান থেকে সরে ফল-সবজি, দুধ, ডিম ইত্যাদি উৎপাদনে বেশি মনোযোগী হতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় কৃষিকে রাসায়নিক সার-নির্ভর প্রযুক্তি থেকে সরে গিয়ে জৈবপ্রযুক্তি-নির্ভর সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহার বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষিপণ্যের বাজার, কৃষি-ঋণের সমস্যা, ও বাজারের অনিশ্চয়তাজনিত সমস্যার সমাধানের জন্য চুক্তি-চাষে রাজি হতে চাষিদের উৎসাহ দিতে হবে। বিশ্বব্যাংক সমর্থিত এই তিনটি প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতীয় কৃষির পরিকাঠামো ও আইনগত নানাদিকে উপযুক্ত পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ভারতের কৃষি-অর্থনীতির বিশ্বব্যাংক-আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার নির্দেশিত এই পরিবর্তনের ছকটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের মানুষের খাদ্য-স্বনির্ভরতার ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই পরিবর্তনের অর্থ আরও বেশি বেশি করে কৃষি-জমি সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যশস্য উৎপাদনের জায়গা থেকে ফলমূল, শাক-সবজি উৎপাদনে নিয়োজিত হবে। এই ছকটি বিশ্বায়িত বাজার-ব্যবস্থায় এক নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের জন্ম দেবে ও সেটাকে পুষ্ট করবে। উন্নত দেশগুলি খাদ্যশস্য তৈরিতে বেশি জমি ও উপকরণ ব্যবহার করবে ও পিছিয়ে-পড়া প্রাচ্যের দেশগুলি, যাদের মূল আহার-অভ্যাসে খাদ্যশস্যের গুরুত্ব অপরিসীম, তারা প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের জন্য এইসব উন্নত দেশের জোগান দেওয়া খাদ্যশস্যের ওপর নির্ভর করবে। এদেশের সাধারণ মানুষের খাদ্য, অর্থাৎ চাল, গম ও নানাপ্রকার মোটা শস্যদানা জোগানের কাজে এদেশের কৃষির গুরুত্ব ক্রমশ কমে আসবে। এদেশের কৃষি-অর্থনীতি দানাশস্যের জায়গায় বিকল্প শাক-সবজি, ফল-মূল, দুধ ও দুধজাত খাদ্য, মাছ-মাংস ইত্যাদি দিয়ে তাদের খাদ্যের প্রয়োজন মেটাবে ও আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করবে। গত ৩০/৪০ বছর ধরে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ইত্যাদি কতিপয় উন্নত দেশ সারা বিশ্বের খাদ্যশস্যের রফতানি বাজারে কর্তৃত্ব করে আসছে, কিছুদিন ধরে জাপানও সেখানে নিজেদের তুলনামূলক প্রাধান্যের জায়গায় নিয়ে গেছে। আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য ভরতুকি খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে। ভারতের মতো তুলনামূলক পিছিয়ে-পড়া দেশ শস্যবৈচিত্রের নীতি প্রয়োগ করলে আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো অতি উন্নত দেশগুলি আমাদের মতো দেশের বাজারে তাদের জোগান দেওয়া খাদ্যশস্যের তৈরি বাজার পেয়ে যাবে। এইসব দেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংভর থাকলে তা হবে উন্নত দেশের কৃষি-রফতানি প্রক্রিয়ার পক্ষে ক্ষতিকর, তাই আমরা শস্যবৈচিত্রের নীতিটি যত বেশি সার্থকভাবে প্রয়োগ করব, ততই খাদ্যশস্যের রফতানিকারক উন্নত দেশগুলির বাণিজ্যিক স্বার্থ পরিপূরণের বাধা দূর হতে থাকবে। এই নীতিটি খাদ্যশস্য রফতানিকারক উন্নত দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থের অনুকূল। একই সঙ্গে চুক্তি-চাষ ও চুক্তি-চাষের কাঠামোতে কৃষি-উপকরণের বেসরকারি ব্যবসার প্রসার হবে। শুধুমাত্র এই কৃষি-উপকরণ বাজারেই নয়, একই সঙ্গে কৃষি-ঋণ ও কৃষিপণ্যের যুক্ত বাজার-প্রক্রিয়ার প্রধান পরিচালক হিসেবেও বহাল থাকবে বহুজাতিক সার ও বীজ কোম্পানিগুলি। সেইসঙ্গে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের প্রসার ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের উৎপাদন ও রফতানিতে বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলি প্রাধান্য বিস্তার করবে। এই ধরনের একটি কৃষি-কাঠামোর প্রসারই ফান্ড-ব্যাংক নির্দেশিত এই নতুন কৃষিনীতির লক্ষ্য।

অর্থনীতির এই বিশেষ ছকটিকে সামনে রেখে আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতিগুলিকে পরিবর্তিত করা হয়েছে। ধান, গম, মোটা শস্যদানার উৎপাদনে ব্যবহৃত কর্ষণযোগ্য জমির বেশি-বেশি অংশ হালকা ও উচ্চ মূল্যসম্পন্ন সবজি-ফলের চাষের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেলে চাষিদের আয়ের সঙ্গে বিশেষ উৎসাহভাতা এবং এই ধরনের অন্যান্য কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়েছে। রফতানি-নীতিতেও নতুন, হালকা, অধিক মূল্যযুক্ত এই পণ্যগুলির রফতানি বাড়ানোয় উৎসাহ দিতে গিয়ে নানা সুযোগ-সুবিধার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সার, বীজ ইত্যাদি চাষের উপকরণের বেসরকারি ব্যবসার ওপর থেকে বাধানিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে।

চুক্তি-চাষ

খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগকে সমর্থন জোগানোর জন্য চুক্তি-চাষকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম হিসেবে উৎসাহ দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়েছে। এই নীতি অনুযায়ী বেসরকারি বিনিয়োগ সংস্থা চুক্তি-নির্ধারিত পরিমাণে এবং দামে জিন-পরিবর্তিত আধুনিক উচ্চফলনশীল বীজ, সার ও ঋণ চাষিকে সরবরাহ করবে। তেমনই চাষির কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য পাবে পূর্বনির্ধারিত পরিমাণে ও দামে। ভাবা হচ্ছে এই ব্যবস্থা কৃষি-ঋণ ও কৃষিপণ্যের দামকে চাষির অনুকূলে রাখতে পারবে এবং সেইসঙ্গে তার কৃষিপণ্যকে বাজার-জাত করার সমস্যারও সমাধান করবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পসংস্থাগুলির কাজ হবে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ-চাহিদা অনুমান করা এবং সেই হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন-পরিকল্পনার মাধ্যমে চুক্তির শর্ত গঠন করে চাষিদের কাছ থেকে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উপকরণ অর্থাৎ শস্য সংগ্রহ করা। চুক্তি-চাষ পদ্ধতিতে চাষিদের পক্ষে যেমন ফল-সবজির বাজার সন্ধান করতে অসুবিধা হবে না, তেমনই প্রক্রিয়াকরণ শিল্পগুলিও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল চুক্তির মাধ্যমে সহজেই পাবে।

কৃষি ও শিল্পের পারস্পরিক আদানপ্রদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই রফতানিমুখী কৃষি-ব্যবস্থাটি গড়া হয়েছে বিশ্বব্যাংক আর আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের মতো আন্তর্জাতিক স্তরের পরামর্শদাতা সংস্থার নির্দেশমাফিক। এর অর্থনৈতিক মডেলটার বর্ণনা দেওয়া হল নীচে।

কৃষি অর্থনীতি এখানে দু’ভাগে বিভক্ত। একটি কৃষি উৎপাদন বিভাগ, অন্যটি কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ভাগ। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বিভাগ নির্দিষ্ট পরিমাণ সবজি ও ফল ইত্যাদি উচ্চমূল্যের হালকা কৃষিপণ্য উৎপাদন করে থাকে। কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ভাগটি কৃষি-উৎপাদন বিভাগ থেকে কাঁচামাল হিসেবে ওই পরিমাণ কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে, প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তাতে নতুন অতিরিক্ত মূল্য যোগ করে এবং সেই মোট মূল্যে এই পণ্য তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে, আন্তর্জাতিক মূল্যে। চাষির কাছ থেকে কাঁচামাল হিসেবে কৃষিপণ্য কিনতে গিয়ে চাষির সঙ্গে দামের রফা করার সময় দু’টি বিষয় তাকে মনে রাখতে হয়। প্রথমত, কৃষিপণ্যটির বাজার-দাম, এবং বাজার-দামের সঙ্গে যুক্ত করা একটি উৎসাহ-মূল্য, যাতে চাষি পণ্যটি বাজারে বিক্রি না করে তার কাছেই বিক্রি করে। ধরে নিচ্ছি বাজার-দামটি সরকারের সহায়ক মূল্যের চেয়ে কম নয় এবং সহায়ক মূল্য স্থির হয় মোট উৎপাদন-ব্যয়ের সঙ্গে একটি বাড়তি মূল্য যোগ করে, যাতে করে উৎপাদন-ব্যয় মিটিয়ে চাষির হাতে খানিকটা উদ্বৃত্ত থাকে। অর্থাৎ বাজার-দাম হল উৎপাদন-ব্যয় এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে উৎপাদন-ব্যয়ের ওপর যে-বাড়তি মূল্য যুক্ত করা হয় তার যোগফলের সমান। আমরা আরও মনে করি, প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা চাষিকে যে-দাম দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার সঙ্গে আবার বাজার-দামের ওপর খানিকটা বেশি উদ্বৃত্ত মূল্য যোগ করা হয় [অর্থাৎ প্রক্রিয়াকরণ সংস্থার প্রতিশ্রুত চুক্তিতে নির্ধারিত দামেও উৎপাদন-ব্যয়ের ওপর কিছুটা উদ্বৃত্ত মূল্য যোগ করা হয়, কিন্তু এই বাড়তি মূল্যটি সরকারের দেওয়া বাড়তি মূল্যের চেয়ে কিছু পরিমাণ বেশি]।

প্রক্রিয়াকরণ সংস্থার মোট শস্য সংগ্রহের খরচ ও প্রক্রিয়াকরণের খরচ মেলালে পাওয়া যায় তার মোট বিনিয়োগ বা মোট ব্যয়। এছাড়াও প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতির উন্নতির জন্য একটি ব্যয় হয়। এসবের যোগফল তার মোট বিনিয়োগ বা প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে খরচের মোট পরিমাণ। প্রতি একক প্রক্রিয়াকরণ ব্যয় মোট কী পরিমাণ শস্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য নেওয়া হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে। এই কাঁচামালের পরিমাণ যত বেশি হয়, একটা সীমা পর্যন্ত প্রতি একক শস্যের প্রক্রিয়াকরণের ব্যয় ততই কমে। প্রক্রিয়াকরণ থেকে একটি নূতন মূল্য সৃষ্টি হয়। প্রক্রিয়াকরণের মোট পরিমাণ যত বাড়ে, প্রতি একক প্রক্রিয়াকরণ থেকে সৃষ্ট নতুন মূল্যের পরিমাণ তত বাড়ে, একটা সময় আসে যখন এক একক প্রক্রিয়াকরণ বাড়ার জন্য যে-নতুন মূল্য সৃষ্টি হয় তা ওই শেষ একক প্রক্রিয়াকরণের জন্য যে-বাড়তি ব্যয় হয় তার সমান। অর্থাৎ এই পরিমাণ শস্য প্রক্রিয়াকরণই তার কাছে সবচেয়ে লাভজনক। এইভাবে প্রক্রিয়াকরণের জন্য কতটা শস্য ব্যবহার করা তার পক্ষে লাভজনক সেটা সে স্থির করে। এই পরিমাণ প্রক্রিয়াকরণের মোট ব্যয় হল তার প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে মোট বিনিয়োগ। তার লাভ নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াজাত নতুন মূল্য-যুক্ত শস্যের দাম কত, তার ওপর। দেশের বাজারে শস্যের বাজার-দাম যদি খুব কম থাকে এবং কৃষি-উৎপাদনের ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, যদি নতুন মূল্য-যুক্ত প্রক্রিয়াকৃত শস্যের দামও তুলনামূলক ভাবে কম থাকে, তাহলেও তার কাছে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগ করে লাভের সম্ভাবনা থাকবে। কিন্তু সে যদি দেখে বিকল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে দেশের অসংগঠিত বাজারে বিনিয়োগ করলে সুদ হিসেবে যে-আয় সে করতে পারত সেটা প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে সমপরিমাণ বিনিয়োগ থেকে আসা লাভের তুলনায় অনেক বেশি, তাহলে সে আদৌ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে না। সামান্য দামে বাজার থেকে শস্য কিনতে পারলে তার শস্য প্রক্রিয়াকরণের মোট ব্যয় হয়তো সে কম রাখতে পারত, কিন্তু অসংগঠিত ঋণের বাজারে সুদের হার যদি খুব বেশি থাকে, তবে ঋণ-ব্যবসায়ে টাকা বিনিয়োগই তার কাছে কম ঝুঁকিপূর্ণ ও বেশি লাভজনক।

একজন দেশি ব্যবসায়ী— কৃষিপণ্য, কৃষি-উপকরণ ও কৃষি-ঋণের যুক্ত বাজারে ঋণদাতা ব্যবসায়ী হিসেবে যে কাজ করছে, সে যখন বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগের কথা ভাবে, সে অবশ্যই চায় কৃষিপণ্যের বাজার-দাম কম থাকুক। কৃষি-বাজারে উদ্বৃত্ত কম থাকলে বিদেশি বহুজাতিক সার-বীজের জোগানদাতা সংস্থা দু’টি ভিন্ন উপায়ে তার ব্যবসায়িক কাজকর্ম চালাতে পারে। সে সরাসরি আমাদের কৃষি-অর্থনীতির ওপর তার ব্যবসায়িক কাজ চালানোর জন্য দেশি এজেন্ট মারফত ঋণ, পণ্য ও উপকরণের যুক্ত বাজারে ঋণদাতা পণ্যবিক্রেতা ও উপকরণের জোগানদার ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করতে পারে— যাতে পণ্যের দামের ও উপকরণের দামের হেরফের ঘটিয়ে, অন্যদিকে চড়া সুদের মাধ্যমেও বিপুল লাভ করা সম্ভব— আবার, এর বিকল্প হিসেবে একই কাজ সে আরও একটি বাড়তি ক্রিয়া, অর্থাৎ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমেও করতে পারে। প্রথম কাজে তুলনায় ঝুঁকি খুব কম। প্রথম ধরনের বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক কাজকর্ম যেহেতু সম্পূর্ণভাবে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন বা আইনের চৌহদ্দির বাইরে ঘটে, তাই দাম ও সুদের ওপর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের কাজটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় চালাতে হয়।

আমাদের কৃষি-অর্থনীতি দুর্বল হলে কৃষিপণ্যের— অর্থাৎ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের কাঁচামালের, দাম কম থাকবে। অন্যদিকে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে উৎপাদন-ব্যয় তুলনায় বেশি হলে অসংগঠিত বাজারে সুদের হার সংগঠিত বাজারের তুলনায় বেশি হলেও বিনিয়োজিত টাকার প্রতি এককে অন্য ক্ষেত্রে লভ্য উদ্বৃত্তের তুলনায় কম হবে। তাই বিনিয়োগকারী সে ক্ষেত্রে কৃষি-বাণিজ্যের যুক্ত বাজারে বিনিয়োগের তুলনায় প্রক্রিয়াকরণের মতো শিল্পে বিনিয়োগ করা বেশি লাভজনক মনে করবে। উপরন্তু কৃষি থেকে প্রাপ্ত কাঁচামালের দাম কম থাকলে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে লাভের পরিমাণ বেশি থাকবে, যা কৃষিপণ্যের দেশি ব্যবসায়ীকে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহ দেবে। তারা বিদেশি উপকরণ জোগানদার কোম্পানির কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করার চেয়েও প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিদেশি সার-বীজের জোগানদাতা বিনিয়োগকারীর দেশি সহযোগী হিসেবে কাজ করা বেশি লাভজনক মনে করবে। অপর পক্ষে দেশের কৃষি-বাজারে পণ্যের দাম তুলনায় বেশি থাকলে ও উৎপাদন-ব্যয় তার তুলনায় কম থাকলে অসংগঠিত ঋণের বাজারে ঋণের চাহিদা বাড়ে। এর কারণ হল, এর ফলে সম্পন্ন চাষি চাষে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বাড়ানোয় উৎসাহিত হয়, ফলে তার ঋণের চাহিদা বাড়ে। অন্যদিকে প্রান্তিক ও অতি প্রান্তিক চাষি এবং ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিকের দুর্দশা বাড়ে কারণ তাদের খাদ্যের জন্য বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। দাম বাড়লে এদের ভোগের জন্য ঋণ নিতে হয়। ঋণের চাহিদা বাড়লে সুদ বাড়ে। সেক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ ফল-সবজির ব্যবসা অথবা প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা চুক্তি-চাষে বিনিয়োগের চেয়ে সরাসরি কৃষিপণ্য, কৃষি-উপকরণ, কৃষি-ঋণের যৌথ বাজারের কার্যক্রমে বিনিয়োগ অধিক লাভজনক। তখন এইসব বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় নেমে কৃষি উদ্বৃত্তের বড় অংশ আত্মসাৎ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াকৃত পণ্যের দাম যথেষ্ট বেশি না থাকলে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পভিত্তিক চুক্তি-চাষ অলাভজনক হয়ে পড়ে।

ফল-সবজি চাষ বিশেষভাবে বাজারের অনিশ্চয়তার শিকার। বড় সমস্যা হল এগুলো পচনশীল, বেশিদিন টাটকা রাখা শক্ত। যথাযথ সংরক্ষণ করা না গেলে প্রচুর পরিমাণে পচে নষ্ট হতে পারে। বাজারজাত করার যথেষ্ট উন্নত পদ্ধতি না থাকলে এই চাষে ক্ষতির সম্ভাবনা খুব বেশি। এই চাষ সর্বদাই ঝুঁকিপূর্ণ। উপরন্তু ভারতের কৃষি-জমির মালিকানা-কাঠামো ও জোতের বিন্যাস বিচার করলে এখানে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির প্রাধান্য। তাদের পক্ষে লাভজনকভাবে এই ধরনের চাষ চালানো সম্ভব হয় না। উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব আছে, কৃষিতে স্থির মূলধনি কাঠামোর স্তরও যথেষ্ট উন্নত নয়। কাজেই এরকম একটি ক্ষুদ্র ও ছোট চাষের প্রাধান্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কৃষি-অর্থনীতিতে চুক্তি-চাষের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এইরকম ক্ষেত্রে চুক্তি-চাষে নিযুক্ত সার-বীজের জোগানদার বহুজাতিক সংস্থাকে অনেক বেশি সংখ্যায় ছোট ও ক্ষুদ্র চাষির কাছ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়। প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি সময় ও ব্যয়সাধ্য। ব্যবসায়ী সংস্থার পক্ষে প্রতিটি ক্ষুদ্র ও ছোট চাষির সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে চুক্তিসংক্রান্ত বিরোধ মেটানো সহজ নয়; তাই ছোট জোত অধ্যুষিত কৃষি-অর্থনীতিতে চুক্তি-চাষ প্রক্রিয়াকে কতটা সার্থকভাবে রূপায়িত করা সম্ভব, বিশেষ করে চুক্তি-ব্যবসায়ীর পক্ষে সেটি কতটা গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

সারণি ১৩.১ নথিভুক্ত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট

উৎস : Annual Survey of Industries. Various reports

পঞ্জাবে ও অন্ধ্রপ্রদেশে যে-সমস্ত শস্যবৈচিত্র ঘটানোর উদ্যোগ ও চুক্তি-চাষের চেষ্টা শুরু হয়েছে, তার ফলাফল মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ২০০৪ সালের একটি সমীক্ষানির্ভর পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, নানা সমস্যার কারণে পঞ্জাব এবং অন্ধ্রে এইধরনের প্রচেষ্টা বেশি দিন চালানো যায়নি। পঞ্জাবে ১৯৯৮ সালে টম্যাটো ও লংকার চুক্তি-চাষ চালু হয়, পেপসি ও ইউনিলিভারের মতো বড় বড় বহুজাতিক সংস্থা এবং তাদের দেশি এজেন্ট (হিন্দুস্তান লিভার) হাইব্রিড বীজ নিয়ে খুব বড় আকারে মঞ্চে অবতরণ করে। এরা চুক্তি-ভিত্তিতে বীজ জোগান দেওয়া, টম্যাটো কিনে নেওয়া, প্রক্রিয়াকরণের পর তা বাজারজাত করা শুরু করে। দেখা যায় বড় চাষি, যারা গমের জমি টম্যাটো উৎপাদনে সরিয়ে এনেছিল, তাদের পক্ষে চুক্তি অনুযায়ী সবজি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার কোম্পানির পক্ষে একসঙ্গে বহুসংখ্যক ছোট চাষির সঙ্গে কারবার চালানো অসুবিধাজনক হওয়ায় তারা কয়েকজন মুষ্টিমেয় বড় চাষির সঙ্গেই কারবার করতে আগ্রহী হচ্ছে। কিন্তু বড় চাষিরা চুক্তিতে আসার পরেও চুক্তি অনুযায়ী বীজ ও প্রয়োজনীয় আগাম নেওয়ার পর উৎপাদিত সবজি চুক্তি-নির্ধারিত দামে কোম্পানিকে বিক্রি না করে বেশি দামে খোলা বাজারে বিক্রি করছে। বাজার-দাম যখন চুক্তি-ধার্য দামের তুলনায় বেশি থাকছে, তখনই তারা কোম্পানিকে ধার্য পরিমাণ বিক্রি না করে বাজারে বিক্রি করছে ও সে অর্থের অংশ ব্যবহার করে কোম্পানির ঋণ সুদ-সহ শোধ করছে। কখন কখনও উৎপাদনের পর কোম্পানি তাদের চুক্তি-নির্ধারিত দামে মোট চুক্তি-নির্ধারিত পরিমাণ কিনতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং তারা চুক্তি-চাষের বাইরে অন্য চাষিকেও নগদে বেশি দামে বীজ বিক্রি করছে। ফলে চুক্তি-চাষ পদ্ধতি অচিরে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে, পঞ্জাবের চুক্তি-চাষিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের চিরায়ত গম উৎপাদনে। কোম্পানির লিজ নেওয়া জমিতেও টম্যাটোর বদলে আবার গম উৎপন্ন হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পঞ্জাবে শস্য বৈচিত্রকরণের মাত্রা কমেছে এবং পঞ্জাব আবার তার সনাতন প্রধান ফসল গম উৎপাদনেই বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে।

আমরা সিম্পসনের শস্যবৈচিত্র সূচকটি ব্যবহার করে সি এম আই-এর (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০২ সাল অবধি সারা ভারতে শস্যের বৈচিত্রমাত্রার যে পরিমাপ করেছি সেটি নীচে দেওয়া হল।

সারণি ১৩.২ সারা ভারতে শস্যবৈচিত্র সূচকের দীর্ঘকালীন বৃদ্ধির প্রবণতা

বছরশস্যবৈচিত্র
১৯৮৬০.৪২
১৯৮৭০.৪২
১৯৮৮০.৪৪
১৯৮৯০.৪৪
১৯৯০০.৪৫
১৯৯১০.৪৭
১৯৯২০.৪৯
১৯৯৩০.৪৮
১৯৯৪০.৪৯
১৯৯৫০.৪৯
১৯৯৬০.৫১
১৯৯৭০.৫১
১৯৯৮০.৫০
১৯৯৯০.৫০
২০০০০.৫১
২০০১০.৫১
২০০২০.৫১

Source: Directorate of Economics and Statistics

সারা ভারতের এই গড়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে শস্যবৈচিত্রের মান ছিল: গুজরাত ০.৭১ (২০০১ সাল), তামিলনাডু ০.৬১ (২০০২ সাল), অন্ধ্রপ্রদেশ ০.৬১ (২০০০ সাল)। পঞ্জাবের শস্যবৈচিত্রের মাত্রা ছিল ০.২৫-এর মতো। পরবর্তীতে সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা যথেষ্ট বাড়লেও তুলনামূলকভাবে পঞ্জাব এ বিষয়ে পিছিয়ে-পড়া রাজ্যগুলির মধ্যে একটি।

আমরা যে-সূচকটি ব্যবহার করেছি (সিম্পসন শস্যবৈচিত্র সূচক) সেটি হল:

শস্যবৈচিত্র সূচক (CDI) = 1 – Σ (Pi/ΣPi)2 যেখানে Pi = i তম শস্য এবং i এর মান ১, ২, ৩, ৪, …. মোট শস্যের সংখ্যা।

শস্যবৈচিত্র: ভারতীয় কৃষির গঠনগত পরিবর্তন

শস্যবৈচিত্র সম্বন্ধে যেসব আলোচনা কৃষি-অর্থনীতির গবেষকরা করেছেন তার একটি বড় অংশ ভারতীয় কৃষিতে এই নতুন গঠনগত পরিবর্তনের পিছনে মূল চালিকাশক্তির সন্ধানেই নিয়োজিত হয়েছে। সহজেই বলা যায়, শস্যবৈচিত্র বিস্তারের পিছনে ছিল প্রথমত বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের মতো আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা সংগঠনগুলির প্রত্যক্ষ উৎসাহ, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ছিল দেশের সরকারের শস্যবৈচিত্র প্রসারের অনুকূলে নানা উপাদান ও বাণিজ্য সংক্রান্ত শর্ত, উচ্চফলনশীল সার ও বীজের উদ্ভাবন ও লভ্যতা বৃদ্ধি, রফতানিতে উৎসাহব্যঞ্জক সরকারি অবস্থান। তাছাড়া, সনাতন শস্যগুলির উৎপাদনের হারে দীর্ঘকালীন হ্রাসের প্রবণতা ও চাষিদের নানা দুর্দশাও পরোক্ষভাবে শস্যবৈচিত্রের অনুকূলে কাজ করেছে। শস্যবৈচিত্রের বিস্তারের পিছনে এইসব উৎসাহ সঞ্চারকারী নানা বিষয়ের প্রভাব থাকলেও যে-প্রশ্নটি বিচারের অপেক্ষা রাখে তা হল, কোন কোন অবস্থা শস্যবৈচিত্রের প্রক্রিয়াকে চাহিদার দিক থেকে অপরিহার্য করে তুলেছে।

রাজ্যওয়ারি বিশ্লেষণ করার আগে আমরা এই বিষয়ে বিভিন্ন গবেষকের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা করব। পি কে যোশি, অশোক গুলাতি এবং অন্যান্যরা (২০০৪) ভারতের ১৯টি রাজ্যে উচ্চমূল্যের হালকা পণ্য, যেমন শাকসবজি ইত্যাদির মোট উৎপাদনের সূচকের তফাতে কোন কোন উপাদান নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে সেগুলিকে চিহ্নিত করেন এবং বিভিন্ন উপাদানের নির্ণায়ক হিসেবে গুরুত্বের পরিসংখ্যানগত মান পরিমাপ করেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী প্রথমত সেচের অভাব শস্যবৈচিত্রের একটি প্রধান নির্ণায়ক উপাদান। কম খরচে সেচের জলের যথেষ্ট জোগান থাকলে চাষি শাকসবজি ইত্যাদি উচ্চমূল্যের হালকা ফসল উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হয় না। তারা সনাতন জলনির্ভর খাদ্যশস্যই চাষ করে। যেসব অঞ্চলে জলের জোগান যথেষ্ট নয়, সেখানেই চাষি হালকা উচ্চমূল্যের বাগান-ফসল, যেমন শাকসবজি, ফলমূল চাষ করে। একই কারণে নিয়মিত ও যথাযথ পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হলে সনাতন খাদ্যশস্য চাষ করতে চাষির অসুবিধা হয় এবং তারা শস্যবৈচিত্রের দিকে ঝোঁকে। দ্বিতীয়ত, বাজার এবং বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ-ব্যবস্থা এই শাকসবজি, ফলমূল চাষের জন্য বিশেষ জরুরি। এইসব পরিকাঠামোগত উপাদান যথেষ্ট না থাকলে এইসব উচ্চমূল্যের পণ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাজারজাত করা অসুবিধাজনক, পণ্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই এই ধরনের চাষের জন্য যথাযথ পরিকাঠামো একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান, যেখানে তা উপস্থিত সেখানে ফলমূল-সবজি চাষ বেশি হয়। এখানে লাভজনক দামের নিশ্চয়তা ও বিক্রির নিশ্চয়তা একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। চুক্তি-চাষকে এই কারণেই শস্যবৈচিত্রের স্বার্থে একটি সুবিধাজনক উপাদান বলে ধরা হয়। এই সব উপাদান ছাড়াও শস্যবৈচিত্রের পক্ষে আর-একটি প্রয়োজনীয় শর্ত হল, ছোট জোতের মালিকের উপস্থিতি। দেখা যাচ্ছে, ছোট জোতেই এই সব হালকা বাগান-পণ্যগুলির উৎপাদন বেশি হয়, তাই যে-অঞ্চলে ছোট জোতের প্রাধান্য যত বেশি, সে-অঞ্চলে হালকা বাগান-ফসল উৎপাদনেরও তত বেশি প্রাধান্য। ছোট চাষি ভালভাবে, সচ্ছলতার সঙ্গে বেঁচে থাকার স্বার্থে শস্যবৈচিত্র ঘটায়। ছোট জোত-অর্থনীতিতে বাজারের ও পরিকাঠামোর যথেষ্ট সুবিধা যদি থাকে, ওদিকে সেচের জল যদি অপ্রতুল হয়, তবে শস্য বৈচিত্রকরণের মাধ্যমে ছোট চাষি তার আয়ের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারে। চাহিদার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ আরও দু’টি উপাদানের গুরুত্ব তাঁরা বিবেচনা করেছেন। এই উপাদান দু’টি হল নগরায়ণের মাত্রা এবং মাথাপিছু আয়। এই দু’টি উপাদানই শস্যবৈচিত্রের মাত্রা সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে, কারণ এদের প্রভাবে মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটে, খাদ্যতালিকায় দানাশস্যের জায়গায় বেশি করে ফল-সবজি-মাছমাংসের প্রাধান্য বাড়ে, ফলে দেশের বাজারে এসবের চাহিদা সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে এই দু’টি উপাদানই গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে, শস্যবৈচিত্রের মাত্রাবৃদ্ধিতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।

বেশির ভাগ পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, শস্যবৈচিত্র বেশি করে প্রসারিত হয়েছে যে-অঞ্চলে, সেখানে ছোট চাষির উপস্থিতি অনেক বেশি এবং সেচের জলের সমস্যা তীব্র (যোশি এবং অন্যান্য, ২০০৪; সিং ও সিধু, ২০০৪; রাও এবং অন্যান্য, ২০০৬)। কোনও কোনও গবেষক (যোশি এবং অন্যান্য ২০০৪) আরও দেখেছেন, সনাতন কৃষি-উৎপাদনের কাঠামোতে ছোট চাষিরা, বিশেষ করে যেখানে জলের অভাব তীব্র সেইসব অঞ্চলে, মুনাফা বাড়ানোর জন্য নয়, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার উপযোগী ন্যূনতম আয় সুনিশ্চিত করার তাগিদ থেকেই শস্যবৈচিত্রের পথ নিয়েছে। রাও এবং অন্যান্যরা (২০০৬) জেলা স্তরের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখিয়েছেন, যদিও বাজারের চাহিদা উচ্চমূল্যের শস্য উৎপাদনের প্রসারে একটি বড় নির্ধারক উপাদান, তবুও যেসব জেলা ছোট চাষি-অধ্যুষিত, সেইসব জেলাতেই শস্যবৈচিত্রের মাত্রাধিক্য ঘটেছে। পঞ্জাবে শস্যবৈচিত্রের অবনতি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সিং এবং সিধু দেখেছেন, পঞ্জাবে সেচের জলের জোগান বৃদ্ধিই শস্যবৈচিত্রের অবনতির কারণ। তাঁদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, যেসব অঞ্চলে সেচের জল যথেষ্ট পরিমাণে লভ্য, সেখানে চাষিরা সাধারণত দু’-একটি সনাতন শস্যের ওপর নির্ভর করে। যেখানে সেচের জলের অভাব রয়েছে সেখানেই চাষি শস্যবৈচিত্রর সাহায্যে কৃষি-আয়ের অনিশ্চয়তা কাটানোর চেষ্টা করে। এইসব বিশ্লেষণ থেকে শস্যবৈচিত্রের প্রসারের পিছনে উৎপাদনের তাগিদ বা বাজারের উপস্থিতি অর্থাৎ চাহিদার ভূমিকা ততটা প্রধান হয়ে দেখা দিচ্ছে না, এ থেকে বরং প্রমাণ মিলছে যে, শস্যবৈচিত্র আমাদের দেশে পর্যাপ্ত সেচরহিত অঞ্চলে ছোট চাষির বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম কৃষি-আয় নিশ্চিত করার উপায়।

অপরপক্ষে ২০০৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক নিয়োজিত একটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, ভারতের কৃষিতে, বিশেষ করে শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈচিত্রকরণের মাত্রা বৃদ্ধির পিছনে, ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা নেই, বরং এখানে মুখ্য ভূমিকায় আছে বাজার প্রসারিত হওয়ার ফলে আয় বাড়ানোর যে-সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা ব্যবহার করে সর্বোচ্চ লাভের তাগিদ।

অন্যদিকে গুলাটি এবং বাতিলা (২০০১ সালে) দেখিয়েছেন, কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ হ্রাস এবং বেসরকারি বা ব্যক্তিগত স্তরে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। সরকারি স্তরে বিনিয়োগ হ্রাসের ফলে বড় সেচপ্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগ কমেছে। ফলে সনাতন অধিক জলনির্ভর খাদ্যশস্যের চাষ কমেছে, ওদিকে বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ বৃদ্ধির ফলে লাভজনক শস্য চাষের দিকে আগ্রহ বেড়েছে। ব্যক্তিগত স্তরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি প্রয়োজনীয় হওয়ার ফলে ব্যক্তিগত স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে এবং সর্বোচ্চ লাভের দিকে তাকিয়ে উৎপাদনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে চাষি সনাতন শস্য থেকে সরে গিয়ে উচ্চমূল্যের হালকা ও লাভদায়ক ফসল তৈরিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে।

সি এইচ রাও (২০০০) বিষয়টির বিশ্লেষণে অন্য একটি মাত্রা যুক্ত করেছেন। অনেকে লক্ষ করেছেন, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন শুধুমাত্র, বা প্রধানত, সনাতন খাদ্যশস্য গ্রহণ করে না। আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা এখন খাদ্যশস্যের জায়গায় অন্যান্য উচ্চমূল্যের শস্য, যেমন শাক-সবজি-ফলমূল বেশি করে গ্রহণ করতে আগ্রহী। চাষি যখন ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগ করছে, তখন এই নতুন ভোগের কাঠামো তাকে ফল ও সবজি চাষে আগ্রহী করছে। রাজুলাদেবি (২০০১) ২০০ জন ভূমিহীন কৃষকের ভোগের ধরন লক্ষ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, দরিদ্র পরিবারগুলিতে সনাতন খাদ্যশস্যের চাহিদার কোনও পরিবর্তন হয়নি। এন এস এস ও-র ৫৯তম সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, আয়ের বিন্যাসে সর্বনিম্নে অবস্থিত শ্রেণিটির ভোগ বাদ দিলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষের ভোগের ধরনে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে, চাল-গমের মতো খাদ্যশস্যের জায়গায় ফল-সবজির মতো উচ্চমূল্যের হালকা শস্যের দিকে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। চাহিদা এবং বাজারের প্রসার এইভাবে কৃষির উৎপাদন-কাঠামোকে ধান-গমের মতো খাদ্যশস্য থেকে সরিয়ে ক্রমশ এইসব উচ্চমূল্যের খাদ্যশস্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে আরও বিস্তৃত বিশ্লেষণের প্রয়োজনে জোত স্তরে সমীক্ষার সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা করেছি।

শস্যবৈচিত্র: একটি জোতস্তর বিশ্লেষণ

ধান-গমের জায়গায় ফল-সবজির মতো উচ্চমূল্যের পণ্যের উৎপাদন-বৃদ্ধির পিছনে কার্যকর উপাদানগুলি সম্বন্ধে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য আমরা একটি জোতস্তর সমীক্ষা করেছিলাম। দেশের সবচেয়ে কম বৈচিত্রপূর্ণ চাষের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। এ রাজ্যের তিনটি জেলা, হুগলি, বর্ধমান ও উত্তর চব্বিশ পরগনার ছয়টি গ্রামের মোট ৩৬০টি কৃষক পরিবারকে বেছে নিয়ে আমরা সমীক্ষা চালাই।

এই তিনটি জেলা পরিকাঠামো আর সেচ ব্যবস্থার নিরিখে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বর্ধমান জেলার শতকরা ৯০ ভাগ সেচ-যুক্ত জমিতে সরকারি খাল-সেচের সুবিধা আছে। এবং এখানে জমির উর্বরতাও বিশেষ উচ্চমাত্রার। হুগলি জেলার সেচসেবিত অঞ্চলের শতকরা ৩০ ভাগেরও কম জমি সরকারি খাল অথবা গভীর নলকূপের দ্বারা সেচের সুবিধা পায়। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় কোনও সরকারি সেচের ব্যবস্থা নেই, উপরন্তু এই জেলার অধিকাংশ অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ অংশের চাষের মাটি লবণাক্ত। তিনটি জেলায় শস্য উৎপাদনের ধরন বিভিন্ন। বর্ধমান মূলত সনাতন খাদ্যশস্য ধান উৎপাদক অঞ্চল। হুগলি ধান ও আলুচাষের জন্য পরিচিত, যদিও এর কোনও কোনও অংশে যথেষ্ট পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হয়ে থাকে। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলাটি নানাধরনের সবজি ও ফলের চাষের জন্য বিখ্যাত, এই জেলা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা নগরী ও তার উপকণ্ঠের বিস্তীর্ণ শহরাঞ্চলে সবজি ও ফলের জোগান দিয়ে থাকে। কলকাতা আবার বিদেশের বাজারে কৃষিজাত পণ্য জোগান দেওয়ার অন্যতম দ্বার। আমরা প্রত্যেক জেলা থেকে দু’টি করে ব্লক বেছে নিয়েছি— একটি ব্লক সেচ ও পরিকাঠামোর দিক থেকে অধিক সুবিধাযুক্ত, অন্য ব্লকটি তুলনায় অনেকটা বঞ্চিত। প্রত্যেকটি ব্লকের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন এক-একটি গ্রাম বেছে নিয়ে প্রত্যেক ব্লক থেকে ‘স্ট্রাটিফায়েড রান্ডম’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে এমনভাবে ৬০টি করে কৃষক পরিবার নির্বাচন করা হয়েছিল, যাতে করে <০.৫ হেক্টর (খুব প্রান্তিক), ০.৫ থেকে <১ (প্রান্তিক), ১ থেকে <২ (ছোট) এবং ২ থেকে <৪ (মাঝারি) জোতের এই চারটি মাপের অন্তর্গত কৃষকদের সংখ্যার প্রকৃত অনুপাতটি আমাদের বাছাই করা কৃষকদলেও যথাযথভাবে ভাবে বজায় থাকে। এইভাবে বাছাই করা ৩৬০টি কৃষক পরিবারের চাষ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য, সেচ ও পরিকাঠামো, এমনকী চাষি পরিবারগুলির প্রাত্যহিক খাদ্যের তালিকা সমেত বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহ করি। আমরা তিনটি শস্য বিশেষ বিশ্লেষণের জন্য বেছে নিই: আউস এবং আমন ধান, বোরো ধান, এবং সবজি। নীচের দু’টি সারণিতে প্রথমত আমরা আমাদের বাছাই করা ৩৬০টি কৃষক পরিবারের চাষে অংশগ্রহণের ধরন সংক্রান্ত তথ্য এবং দ্বিতীয়ত শস্যবৈচিত্রের মাত্রার ওপর বিভিন্ন সূচকের প্রভাব দেখেছি টবিট রিগ্রেশন বিশ্লেষণ করে। যে-ছয়টি ব্লক বিভিন্ন ধরনের সেচ ও পরিকাঠামোগত নানা বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করেছে তাদের জন্য পাঁচটি ডামি ব্যবহার করে শস্যবৈচিত্রের মাত্রার ওপর সেসবের প্রভাব দেখা হয়েছে। মেমারি ও পান্ডুয়া এই দু’টি ব্লক যথাক্রমে বর্ধমান ও হুগলি জেলার অন্তর্গত। দু’টি ব্লকই একই ধরনের সেচের সুবিধাযুক্ত, দু’টি ব্লকই সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিগত সেচের জল পেয়ে থাকে। এদের মধ্যে বর্ধমান সরকারি খাল-সেচের সুবিধা বেশি পায়। পরিকাঠামোর দিক থেকেও এরা সবচেয়ে এগিয়ে থাকা, অবশ্য তুলনায় পান্ডুয়াই বেশি এগিয়ে। বলাগড় ও গলসি সেচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও বলাগড় পরিকাঠামোর দিক থেকে গলসির তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগনার দু’টি ব্লক, হাসনাবাদ ও বনগাঁ, সেচ ও পরিকাঠামো উভয় দিক থেকেই সবচেয়ে পশ্চাদবর্তী। আমরা পরিকাঠামো ও সেচের নানা সুযোগসুবিধার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি অনুযায়ী যে-কোড ব্যবহার করেছি তার ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্লকের ক্রমসংখ্যা নীচে দেওয়া হল

সারণি ১৩.৩ পরিকাঠামো কোডের ক্রমসংখ্যা

আলোচিত ব্লকগুলির মধ্যে প্রথম তিনটি ব্লক সেচ ও পরিকাঠামো সবদিক থেকেই বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। শেষ তিনটি ব্লক বিশেষ করে পরিকাঠামোয় যথেষ্ট পিছিয়ে-পড়া, সেচের দিক থেকে বনগাঁ ও হাসনাবাদ পিছনে থাকলেও গলসির অবস্থা তুলনায় ভাল। নীচের সারণিতে আমরা দেখছি প্রথম তিনটি ব্লকেই শস্যবৈচিত্রের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম, শেষ তিনটি ব্লকে তা অনেকটাই বেশি। বেশি শস্যবৈচিত্রের অঞ্চলগুলিতে প্রান্তিক ও অতি প্রান্তিক চাষির অনুপাতও বেশি। এখান থেকে এটা স্পষ্ট যে, জোত-স্তর বিশ্লেষণে যে-স্থানে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা অধিক, সেখানে ছোট চাষিদের উপস্থিতি বেশি অনুপাতে দেখা যাচ্ছে, ফলে জোতের গড় মাপ অপেক্ষাকৃত কম। প্রতি হেক্টরে পারিবারিক শ্রমদিবসের সংখ্যা বেশি এবং মোট শ্রমে পারিবারিক শ্রমের অনুপাতও— বিশেষ করে সবজি চাষের ক্ষেত্রে, লক্ষণীয়ভাবে বেশি। আর একটি লক্ষ করার মতো বিষয় হল, যে-অঞ্চলে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা তুলনায় বেশি, সেখানে চাষি পরিবারের প্রতিটি সদস্য গড়ে অনেক বেশি সময় ধরে জমিতে শ্রম দিয়ে থাকে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, সরকারি সেচের সুবিধা যেসব অঞ্চলে তুলনায় যথেষ্ট কম, সেসব অঞ্চলে পরিকাঠামো যথেষ্ট উন্নত না হলেও ছোট চাষির অনুপাত বেশি এবং ছোট চাষি অধিক পরিমাণে শ্রম দিয়ে সবজি, ফল ইত্যাদির চাষ করে থাকে। লক্ষণীয়, বলাগড় অঞ্চলে সরকারি সেচ না থাকলেও এখানে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা যথেষ্ট বেশি। এখানে ছোট চাষি সর্বাধিক মাত্রায় পারিবারিক শ্রম দিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে নির্মিত সেচ-ব্যবস্থা্র সুযোগ নিয়ে ফল-সবজি চাষ করে থাকে, এখানকার অপেক্ষাকৃত উন্নত পরিকাঠামোকে কাজে লাগায়।

এই বিশেষ পরিস্থিতিতে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা বৃদ্ধিতে কোন কোন উপাদানগুলি কার্যকর ভূমিকা নেয় তা বোঝার জন্য আমরা শস্যবৈচিত্রের মাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধিতে পারিবারিক শ্রম, গড় জোতের মাপ, সেচের পরিমাণ ও সারের ব্যবহারের প্রভাব দেখতে চেয়েছি। এই উদ্দেশ্যে আমাদের নমুনার ৩৬০টি চাষি পরিবারকে বিবেচনায় রেখে টবিট রিগ্রেশন মডেল (ডামি সহ) গঠন করার পরিসংখ্যান-গণিত পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। সেচ পরিকাঠামোর গুরুত্ব দেখার জন্য একই সঙ্গে যে-ছয়টি ব্লক ছয় ধরনের সেচ-পরিকাঠামো ধরনকে বোঝায়, তাদের জন্য পাঁচটি ডামি ব্যবহার করেছি। ছেদকটিকে সবচেয়ে কম শস্যবৈচিত্রের ব্লক পান্ডুয়ার জন্য ব্যবহার করেছি। এই রিগ্রেশন সমীকরণটির হিসাব থেকে পাওয়া পর্যবেক্ষণের গাণিতিক মূল্য নীচের সারণিতে দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, শস্যবৈচিত্রের মাত্রার তফাতে পারিবারিক শ্রম ধনাত্মক প্রভাব ফেলে, অর্থাৎ পারিবারিক শ্রমের ব্যবহারের সঙ্গে শস্যবৈচিত্রের সরাসরি সম্পর্ক আছে। শস্যবৈচিত্রের মাত্রা সেখানেই বেশি, যেখানে পারিবারিক শ্রম বেশি ব্যবহার হয়। এর কারণ হয়তো এই যে, ফলমূল-সবজি চাষ সনাতন শস্যের তুলনায় অনেক বেশি শ্রমঘন; ছোট চাষি সহজে ও সস্তায় জল না পেলে পারিবারিক শ্রম ব্যবহার করে সবজি চাষকেই বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করে। আমরা সেচের উৎস সম্পর্কে কোনও তথ্য ব্যবহার করিনি, কেবল সেচসেবিত অঞ্চলের পরিমাণের তথ্যটি ব্যবহার করেছি। ফলে সস্তায় ও সহজে সরকারের জোগান দেওয়া সেচের জল বেশি থাকলে চাষি অধিক জলনির্ভর সনাতন শস্য চাষ করে, এই অনুমানের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে এই বিশ্লেষণ থেকে আমাদের বিশেষ কিছু বলার নেই। তবে, আমরা দেখেছি, সহজে ও সস্তায় সরকারি খাল-সেচের পর্যাপ্ত সুবিধাযুক্ত পান্ডুয়া বা মেমারিতে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা সবচেয়ে কম। আমাদের ব্যবহৃত ডামিগুলির সহগের মাপের বৃদ্ধির ধরন থেকে সেই অনুমানটির সত্যতাই প্রমাণিত হচ্ছে। পান্ডুয়া সরকারি সেচের জোগানের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ব্লকগুলির একটি। তারপরই মেমারির স্থান। এই অঞ্চলদু’টিতে পরিকাঠামো যথেষ্ট উন্নত হওয়া সত্ত্বেও শস্যবৈচিত্রের মাত্রা খুবই কম, এরা সনাতন খাদ্যশস্যের উৎপাদনেই সবচেয়ে বেশি জোর দেয়। অপরপক্ষে হাসনাবাদ ও বনগাঁতে সেচের সুবিধা একেবারেই কম, এইসব অঞ্চল পরিকাঠামোতেও অত্যন্ত পিছিয়ে-পড়া, কিন্তু এরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার ও একইসঙ্গে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের সিংহদুয়ার কলকাতার কাছাকাছি থাকায় অবশ্যই বাণিজ্যিক যোগাযোগের যথেষ্ট সুবিধা ভোগ করে। এই অঞ্চলে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। অপরপক্ষে বলাগড় অঞ্চলে সরকারি সেচের ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় সনাতন জলনির্ভর শস্য উৎপাদন সেখানে কম সুবিধাজনক। বলাগড়ের পরিকাঠামো উন্নত, ফলে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা এখানে শুধু পান্ডুয়ার তুলনায় নয়, মেমারি ও গলসির তুলনায়ও বেশি। এখানে চাষি অধিক পরিশ্রম করে ও নিজস্ব ব্যক্তিগত বিনিয়োগ করে সেচ-ব্যবস্থা গড়ে তুলে ফল-সবজির চাষ করে।

সারণি ১৩.৪ পারিবারিক শ্রম ও শস্য

সারণি ১৩.৫ টবিট রিগ্রেশন মডেল

তৃণমূল স্তরে সংগৃহীত পরিসংখ্যান থেকে নিজস্ব পরিমাপ।

সনাতন খাদ্যশস্য ও ফল-সবজি চাষে নিট আয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ

তিনটি জেলার বাছাই-করা গ্রামের এবং বাছাই-করা চাষি পরিবারের উৎপাদিত খাদ্যশস্য, আলু ও সবজির মূল্য ও উৎপাদন-ব্যয় হিসাব করে আমরা বিভিন্ন শস্যের চাষে আলোচ্য চাষি-পরিবারের মাথাপিছু নিট আয়ের হিসাব করেছি। এই হিসাবটি জোতের মাপ অনুযায়ী নীচের সারণিতে উপস্থিত করা হল।

সারণি ১৩.৬ বিভিন্ন মাপের জোতে চাষি পরিবারের মাথাপিছু নিট আয় (হেক্টর-পিছু)

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রথমত, চাষি পরিবারের মাথাপিছু আয় জোতের মাপ বাড়ার সঙ্গে ক্রমশ বেড়েছে। অর্থাৎ ছোট ও প্রান্তিক জোতের চাষি পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু আয় বড়দের তুলনায় কম এবং জোতের মাপ বাড়ার সঙ্গে আয় বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, শস্যবৈচিত্রের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে মাথাপিছু আয় কমেছে। যেসব চাষি-পরিবার মূলত সনাতন খাদ্যশস্যের উৎপাদনে তাদের জমির বেশি অংশ নিয়োজিত করে, তাদের আয় সাধারণ খাদ্যশস্যের সঙ্গে ফল-সবজি চাষে যারা জমি নিয়োগ করে তাদের তুলনায় বেশি। অবশ্য সবধরনের চাষির মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ অত্যন্ত কম, দারিদ্রসীমার আয়ের থেকেও কম। শস্যবৈচিত্র বাড়লে সনাতন খাদ্যশস্যের ওপর কম জোর দেওয়ার ফলে মাথাপিছু আয় কমে দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গেলে চাষি ফল-সবজি চাষ করে তাদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে। আমরা ‘অ্যানালিসিস অফ ভ্যারিয়ান্স’ পরিসংখ্যানগত পদ্ধতিটি প্রয়োগ করে এই পর্যবেক্ষণে উপস্থিত হয়েছি যে, আয়ের অসাম্য জোতের মাপের তফাতের তুলনায় স্থানগত তফাতের দ্বারা বেশি প্রভাবিত। জোতের মাপ যত ছোট, ততই প্রধান খাদ্যশস্য থেকে আয় অপ্রতুল হয় এবং ছোট চাষিকে ন্যূনতম আয় সুনিশ্চিত করার জন্য শস্যবৈচিত্রের উপর নির্ভর করতে হয়। এই প্রয়োজন আরও তীব্র হয় বৃষ্টিসেবিত অঞ্চলগুলিতে, যেখানে সরকারি সেচের কোনও সুবিধা নেই। এই পর্যবেক্ষণ সাধারণভাবে সত্যি হলেও কোনও কোনও অঞ্চলে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলাগড় ব্লকের উল্লেখ করা যেতে পারে। বলাগড় অঞ্চলে সরকারি সেচের তত সুবিধা না থাকলেও এখানে চাষি ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি সেচের সাহায্য নেয়। তারা শ্রম ও অর্থবিনিয়োগ করে খাদ্যশস্য ছাড়াও হালকা ধরনের উচ্চমূল্যের ফল-সবজি ইত্যাদির চাষ করে, এবং তার মাধ্যমে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে। ফলে এই অঞ্চলে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা যথেষ্ট বেশি।

আমরা সনাতন আউস, আমন ও বোরো ধান এবং সবজি চাষ থেকে ব্যবসায়িক আয় ও মুনাফার পরিমাণ ও প্রতি-টাকা বিনিয়োগের ওপর এই লাভের হার তুলনা করে দেখার চেষ্টা করেছি। দেখা যাচ্ছে সনাতন শস্য উৎপাদনের জায়গাগুলি, যেমন বর্ধমান ও হুগলি জেলার মেমারি, গলসি ও পান্ডুয়ার তুলনায় অধিক শস্যবৈচিত্রের অঞ্চল বলাগড়, হাসনাবাদ ও বনগাঁতে আউস ও আমন ধানে ব্যবসায়িক আয়ের পরিমাণ অনেক কম। অবশ্য বোরো ধানের ক্ষেত্রে চিত্রটি একরকম নয়। অধিক শস্যবৈচিত্রের দু’টি অঞ্চল বলাগড় ও বনগাঁয় অপেক্ষাকৃত কম শস্যবৈচিত্রের অঞ্চলগুলির তুলনায় ব্যবসায়িক আয় বেশি। ওদিকে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্রের অঞ্চলগুলির একটি, হাসনাবাদে অনুপাতে অনেক বেশি জমি সবজি চাষে নিয়োজিত, কিন্তু সবজি চাষ থেকে আয় ঋণাত্মক। অর্থাৎ সবজি চাষ করে চাষিদের সম্পূর্ণভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। বলাগড় সম্বন্ধেও একই কথা বলা যেতে পারে। চাষ থেকে প্রকৃত উদ্বৃত্তের হার সংক্রান্ত ধারণা পাওয়ার জন্য আমরা প্রতি-টাকা বিনিয়োগের ওপর লাভের পরিমাণ মাপার চেষ্টা করেছি। এটা মাপা হয়েছে ফসলের প্রকৃত মূল্য ও প্রকৃত উৎপাদন-ব্যয় হিসাব করে (অর্থাৎ এখানে পরিবারের মানুষের নিজস্ব শ্রমের মূল্য উৎপাদন-ব্যয় থেকে বাদ দিয়ে ধরা হয়েছে)। লাভের হারের ক্ষেত্রে যে-বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট তা হল, বিনিয়োগের ওপর মুনাফার হার একমাত্র সেই অঞ্চলেই অপেক্ষাকৃত বেশি, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি সেচের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত উন্নত পরিকাঠামোর সহাবস্থান ঘটেছে। প্রকৃত লাভের জন্য চাষির পক্ষে যথাযথ বাজারের নাগাল পাওয়া এবং যথাযথ দাম পাওয়া বিশেষ জরুরি, বিশেষ করে সবজি চাষের ক্ষেত্রে। দেখা যাচ্ছে, সনাতন শস্য চাষে নির্ভরশীল অঞ্চলগুলিতে অধিক শস্যবৈচিত্রসম্পন্ন অঞ্চলের তুলনায় প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই আয় অনেক বেশি। সবজি চাষ এতই ব্যয়সাধ্য যে, পিছিয়ে-পড়া পরিকাঠামো আছে এমন অঞ্চলে বাজারের সুবিধা যথেষ্ট না থাকায় সবজি চাষে ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হয়। ফলে এইসব অঞ্চলে সবজি চাষে লাভের হার বজায় রাখা শক্ত।

সারণি ১৩.৭ বিভিন্ন শস্য চাষ থেকে আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসান: সনাতন চাষ বনাম শস্যবৈচিত্র

তৃণমূল স্তরে সংগৃহীত পরিসংখ্যান থেকে নিজস্ব পরিমাপ।

সারণি ১৩.৮ শস্যবৈচিত্র ও খাদ্য সুনিশ্চয়তা, প্রতিদিনের গড় মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ (কিলোগ্রাম)

উৎস: নিজস্ব সমীক্ষানির্ভর পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে নির্মিত।

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে কম শস্যবৈচিত্রের অঞ্চল পান্ডুয়াতে চাষি প্রতিদিন গড়ে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি পরিমাণ দানাশস্য, আলু ও মাছ-মাংস খেয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি শস্যবৈচিত্রের অঞ্চল হাসনাবাদের চাষির প্রতিদিনের গড় দানাশস্য বা মাছ-মাংস খাওয়ার পরিমাণ যৎসামান্য। তবে এই সবজি উৎপাদক অঞ্চলের চাষিরা প্রতিদিন গড়ে সবজি খায় অনেক বেশি। অন্য দু’টি বেশি শস্যবৈচিত্রের অঞ্চল বলাগড় ও বনগাঁ, সনাতন শস্যনির্ভর মেমারির তুলনায় কিছুটা বেশি পরিমাণে দানাশস্য, মাছ-মাংস ও সবজি খেয়ে থাকে। সেচের জল ও পরিকাঠামোর নিতান্ত অপ্রতুলতা হাসনাবাদে সনাতন দানাশস্যের চাষ থেকে আয় যেমন কমিয়ে রাখে, তেমনই তার দৈনিক গড় খাদ্যগ্রহণের পরিমাণও কমায়। ওই অঞ্চলে সবজি সংরক্ষণ ও বিক্রির মতো উন্নত পরিকাঠামো যথেষ্ট পরিমাণে না থাকায় চাষি সরাসরি সবজি খেয়ে তার অন্যান্য খাদ্যের অভাব কিছুটা পূরণ করতে পারলেও সামগ্রিকভাবে তার পুষ্টির অভাব থেকেই যায়।

সারণি ১৩.৯ ফ্যাট, প্রোটিন ও ক্যালোরির মাথাপিছু ভোগ ও শস্যবৈচিত্র সূচক

NSSO Report no ৪৭১(৫৫/১.০/৯), সংযোজন-বি থেকে পাওয়া বিভিন্ন খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের হার ব্যবহার করে আমাদের সংগৃহীত খাদ্য ভোগের তথ্য থেকে পুষ্টি ভোগের হিসেবটি নির্ণয় করা হয়েছে।

এই সমীক্ষাটিতে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মাপের জোতের অন্তর্গত চাষিরা খাদ্য থেকে প্রতিদিন গড়ে যে পুষ্টি পেয়ে থাকে তার হিসাব করা হয়েছে। উপরের সারণিতে দেখা যাচ্ছে, মেমারি থেকে পাওয়া তথ্যগুলিকে ব্যতিক্রম ধরে নিলে, কম বৈচিত্রের অঞ্চল থেকে যতই আমরা বেশি বৈচিত্রের অঞ্চলে যাচ্ছি, ততই চাষির বিভিন্ন পুষ্টি-উপাদান ভোগের পরিমাণ কমছে। কম শস্যবৈচিত্রের অঞ্চল, যাদের আয় তুলনায় বেশি, তাদের মধ্যে পান্ডুয়া ও গলসির চাষিরা দারিদ্রসীমার ওপরে আছে এবং সে কারণে ন্যূনতম যতটা ক্যালোরি ও প্রোটিন আহার স্বাস্থ্যসম্মত তারা তার অধিক ভোগ করে। সবচেয়ে বেশি শস্যবৈচিত্রের অঞ্চল হাসনাবাদের চাষিদের মাথাপিছু গড় পুষ্টির পরিমাণ অত্যন্ত কম। এরা দারিদ্রসীমার অনেকটা নীচে আছে। অবশ্য বাকি দু’টি অধিক শস্যবৈচিত্রের অঞ্চল বলাগড় ও বনগাঁর অবস্থা হাসনাবাদের মতো অত খারাপ নয়। শস্যবৈচিত্র সত্ত্বেও হাসনাবাদের সেচ ও পরিকাঠামোগত অনুন্নয়নের অপপ্রভাব পড়েছে তাদের দৈনিক গড় পুষ্টিগ্রহণের মাত্রার ওপর। কিন্তু বলাগড় ও বনগাঁর চাষিরা ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সাহায্যে সেচ ও পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার প্রভাব কাটিয়েছে। এদের পুষ্টির মাত্রা কম শস্যবৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চল পান্ডুয়া বা গলসির তুল্য না হলেও এরা সেচের কাজে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ এবং পরিবারের সদস্যদের কঠিন পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রায় ন্যূনতম নির্ধারিত পুষ্টি-সীমার কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে। হাসনাবাদের চাষিদের পরিবারের সদস্যরা আরও বেশি কঠিন পরিশ্রম করেও এই সীমার অনেক নীচে থেকে গেছে। [বেশি শস্যবৈচিত্রের অঞ্চলগুলিতে চাষিদের হেক্টর-প্রতি পারিবারিক শ্রমের পরিমাণ শুধু যে বেশি তাই নয়, পারিবারিক শ্রমদাতারা কম শস্যবৈচিত্রের অঞ্চলের তুলনায় বছরে গড়ে অনেক বেশি দিন জমিতে খাটে।] উপরের সারণি থেকে মনে হচ্ছে ক্যালোরি ও পুষ্টির পরিমাণের সঙ্গে শস্যবৈচিত্রের একটি বিপরীতগামী সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যে-তথ্যটি বেরিয়ে আসছে তা হল, যে সব অঞ্চলে সরকারের জোগান দেওয়া সস্তা সেচের জল অপ্রতুল, সেখানে চাষিদের পক্ষে একটি-দু’টি সনাতন জলনির্ভর শস্য চাষ করে জীবন ধারণ অসম্ভব, এবং তাই তারা বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে শস্যবৈচিত্রের দিকে ঝোঁকে। অপরপক্ষে বলাগড় ও বনগাঁর মতো অঞ্চল, যেখানে ব্যক্তিগতভাবে সেচ-ব্যবস্থায় উন্নতি আনার উপায় আছে, সেইসব অঞ্চলে যদি পরিকাঠামো তুলনামূলকভাবে উন্নত হয় তাহলে চাষি আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের মাধ্যমে সেচের অসুবিধা কাটিয়ে শস্যবৈচিত্র আনে।

রাজ্যওয়ারি বিশ্লেষণ

রাজ্যওয়ারি বিশ্লেষণ পঞ্জাব দিয়ে শুরু করব। কারণ পঞ্জাবে শস্যবৈচিত্রকরণের অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো, আবার সারা দেশের মধ্যে পঞ্জাবেই শস্যবৈচিত্রায়ণের প্রক্রিয়া থেকে আবার সনাতন চাল-গম-নির্ভর খাদ্যশস্যে বিশেষীকরণের দিকে ফিরে যাওয়ার নজির আছে। তাই ভারতের কৃষি অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে কোন অবস্থা শস্যবৈচিত্রের জন্য আবশ্যিক শর্তগুলিকে তৈরি করে এবং কোন অবস্থায় শস্যবৈচিত্রকরণের তুলনায় শস্য-বিশেষীকরণ বেশি সুবিধাজনক তা বুঝতে পঞ্জাবের উদাহরণটিই বেশি সহায়ক হবে।

পঞ্জাব সবুজ বিপ্লব এলাকা হিসেবে ভারতের কৃষি-অর্থনীতিতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সবুজ বিপ্লবের কৃৎকৌশল পঞ্জাবে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বিস্তৃতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। গমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব যে-বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল তা প্রধানত পঞ্জাবে গম উৎপাদনের অভাবনীয় উন্নতির কারণে। অন্যান্য ফসলের চাষ হলেও পঞ্জাব প্রধানত চাল-গম এই সনাতন জলনির্ভর শস্য চাষেই বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল। চাল-গম ভিন্ন অন্য যে-পণ্যটি উৎপাদনে পঞ্জাব উল্লেখ্য, সেটি হল তুলা। ১৯৯৮–’৯৯ সালে পঞ্জাবের শতকরা ৭৪.৫ ভাগ জমিতে চাল-গমের চাষ হত, তুলার চাষ হত শতকরা ৯.২ ভাগ জমিতে। বাকি জমিতে অন্যান্য নানাপ্রকার পণ্য উৎপাদন হত। ভারতের সবুজ বিপ্লব অঞ্চলগুলি— উত্তর ভারতের পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক, অন্ধ্র, ও মহারাষ্ট্র— গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দশক অবধি কৃষি-অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল। পরিণামে বিপুল সংখ্যক ঋণগ্রস্ত চাষি আত্মহননের পথে যায়।

এই সংকটময় অবস্থার একটু গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এর কারণ লুকিয়ে আছে সবুজ বিপ্লবের কৃৎকৌশলের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। সবুজ বিপ্লবের কৃৎকৌশলের মূল কথা ছিল উপযুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত জলের সহযোগে নতুন ধরনের বীজ ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগ। এই নতুন হাইব্রিড বীজ যেমন একদিকে উচ্চ উৎপাদনশীল, অন্যদিকে এই বীজের সঙ্গে আনুষঙ্গিক যেসব উপকরণ আবশ্যিক সেগুলি সবই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিশেষত এই আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে অতিরিক্ত যন্ত্র ব্যবহার অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। একদিকে দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জমির উৎপাদিকা শক্তি কমতে থাকে, অন্যদিকে অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে চাষে স্থির পুঁজির ঘনত্ব বাড়ে। অর্থাৎ জমির একক-পিছু স্থির পুঁজির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মোট উৎপাদিত পণ্যের একক-পিছু উৎপাদন ব্যয় অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা ছোট ও প্রান্তিক চাষিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মধ্যে ফেলে। একটি ট্রাক্টর যতক্ষণ ব্যবহার করলে তার ব্যবহার আর্থিক দিক থেকে পুষিয়ে যায়, জমির আয়তন ছোট হওয়ার ফলে ততটা মেটে না। ফলে উৎপাদনের একক-প্রতি ব্যয় বা প্রতি হেক্টর জমি চাষের ব্যয় যথাযথ অবস্থার তুলনায় অনেক বেশি হয়। নয়া অর্থনীতির খোলা-বাজার নীতির কারণে কৃষিজ পণ্য দেশের বাজারে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও অসম প্রতিযোগিতার শিকার হয়। চাল-গমের মতো কৃষিজ পণ্য দেশের বাজারে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। এর উপর জলের খরচ অত্যধিক বাড়ে। অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার চাষে অতিরিক্ত জলের ব্যবহারকে আবশ্যিক করে তোলে। ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত ব্যবহার জল-স্তর নামিয়ে দেয় এবং জল তোলার খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ’৯০-এর দশকের পঞ্জাবে জমির উৎপাদনশীলতা কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কমে আসে, উৎপাদন-ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। চাষ অতিরিক্ত মূলধন-নির্ভর হয়ে ওঠার কারণে নিয়োগের মাত্রা কমে। চাল ও গম উৎপাদনে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমের নিয়োগের স্থিতিস্থাপকতা শতকরা ০.২-এ নেমে আসে। এই বিশেষ অবস্থায় পঞ্জাবে জোল কমিটি ২০০২ সালে দ্বিতীয়বার যে শস্যবৈচিত্রকরণের পরামর্শ দেয় (প্রথমবার এই কমিটি ১৯৮৬ সালে একই পরামর্শ দিয়েছিল), তার মূল বক্তব্য, চাল ও গমের আওতায় থাকা ১০ লাখ হেক্টর জমি তৈলবীজ ও ডালের মতো উচ্চ মূল্যের হালকা ফসলে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু চাষিদের কাছে এই পরামর্শ অনুযায়ী ডাল বা তৈলবীজের চাষ মোটেই লাভজনক মনে হয়নি। অধিকাংশ চাষি ধান-গম থেকে চাষ সরিয়ে নিয়ে যেতে রাজি ছিল না। ফলে প্রথমে সূর্যমুখী চাষে তাদের উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু কোনও নতুন ফসল নিয়ে পরীক্ষাই চাষিদের শস্যবৈচিত্রে উৎসাহিত করতে পারে না। তাদের মধ্যে কয়েকজন বরং তুলা, ভুট্টা, ও আখ চাষে উৎসাহী ছিল। অবশেষে চুক্তি-চাষের মাধ্যমে শস্যবৈচিত্রে উৎসাহ দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালে পেপসি কোম্পানি ভলটাস ও পঞ্জাব অ্যাগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন-এর যৌথ উদ্যোগে পঞ্জাব কৃষিকে ধান-গমের মতো সনাতন শস্য থেকে সরিয়ে ফল-সবজির মতো বাগান-ফসলের চাষে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রকল্প পেশ করে, যা ভারত সরকারের অনুমোদন লাভ করেছিল। ১৯৮৬ সালেই রাজ্য সরকারের উদ্যোগে প্রথম যে-বিশেষজ্ঞ কমিটি পঞ্জাবে শস্যবৈচিত্রের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে, সেই কমিটির পরামর্শ ছিল, পঞ্জাবে ফল-সবজির আওতায় থাকা জমি শতকরা ২ ভাগ থেকে শতকরা ৬ ভাগে নিয়ে যেতে হবে। তখন থেকে পঞ্জাবে ধীরে ধীরে পেপসি কোম্পানির একাধিক সহযোগী দেশি কোম্পানি শস্যবৈচিত্রকরণ, বিশেষ করে ফল-সবজি চাষের প্রসারে চেষ্টা চালায়। টম্যাটো, লংকা ও আলুতে চুক্তি-চাষ বিস্তৃত হয়। বহুজাতিক সংস্থা পেপসির সহযোগী হয়ে কয়েকটি দেশি কোম্পানি কাজ করতে থাকে। বিশাল টম্যাটো প্রক্রিয়াকরণ বহুজাতিক সংস্থা ইউনিলিভার-এর দেশি সহযোগী হিন্দুস্থান লিভার, ভারতের অন্যতম সর্ববৃহৎ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা। তারাও পেপসির সঙ্গে সহযোগিতায় চুক্তি-চাষে অবতীর্ণ হয়। হিন্দুস্থান লিভার-এর পাশাপাশি নাইজের অ্যাগ্রো ফুড কোম্পানি টম্যাটো প্রক্রিয়াকরণে বিনিয়োগ করে। এছাড়াও বহু বেসরকারি সংস্থা ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাত করার কাজ করে।

বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার ও সমবায়, বীজ সংরক্ষণ ও বীজ উৎপাদন সংস্থা, কৃষক ও সংগ্রাহক-প্রক্রিয়াকারক কোম্পানির মধ্যে মধ্যস্থকারীর ভূমিকা নেয়।

যদিও চুক্তি-চাষের মাধ্যমে শস্যবৈচিত্রকরণের প্রসার ঘটেছে এমন ভাবা হয়, আসলে শস্যবৈচিত্রকরণের ফলেই চুক্তি-চাষ প্রসার পায়। সনাতন শস্যের চাষ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লে খাদ্যশস্যের জায়গায় ফল-সবজি চাষকেই চাষি নির্ভরযোগ্য মনে করে। কিন্তু ফল বা সবজির সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও তা বাজারজাত করার যথেষ্ট ভাল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা পুনর্গঠিত না হলে ওরকম পচনশীল ও বিভিন্ন গুণসম্পন্ন পণ্যকে লাভজনক করার জন্য জরুরি প্রক্রিয়াগুলোর সবটা মেটানো যায় না। এ থেকেই চুক্তি-চাষ ফল-সবজি চাষের পাশাপাশি একটি আবশ্যিক প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম হিসেবে প্রসার লাভ করে। কিন্তু পঞ্জাবের কৃষিতে আবার সেচের উন্নতি ও প্রকৌশলগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হলে চাল-গম নির্ভর কৃষি তার অলাভজনক অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। দেখা যায়, চাল-গম নির্ভর চাষ অন্য পণ্যের তুলনায় অনেক কম ব্যয়বহুল শুধু নয়, এই চাষ কম ঝুঁকিপূর্ণ, সংরক্ষণের সুযোগ বা গুণমানে তফাত কম, ফলে নানা দিক থেকে কম ব্যয়বহুল। অর্থাৎ চাষির পক্ষে কম অসুবিধাজনক হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা বেশি। এ সবের মিলিত পরিণতিতে পঞ্জাবে শস্যবৈচিত্রকরণের মাত্রা কমতে থাকে। সারা পঞ্জাবে শস্যবৈচিত্রকরণের মাত্রা ১৯৭০–’৭১–এর মান ০.৭০৭ থেকে ২০০১–’০২ সালে ০.৫৯১-এ এসে দাঁড়ায়। ধান এবং গমের চাষ একদিকে ক্রমাগত আরও বেশি অঞ্চলে প্রসারিত হতে থাকে, অন্যদিকে উৎপাদনের দিক থেকে শস্যগুলির, অথবা বলা যায় খাদ্যশস্যেরই প্রাধান্য বাড়তে থাকে, তুলনায় কমতে থাকে অন্যান্য ফসলের গুরুত্ব। পঞ্জাবের সব অঞ্চলেই শস্যবৈচিত্রের মাত্রা কমে, তবে মধ্য পঞ্জাবের জেলাগুলিতে তা কমতে থাকে দ্রুততর গতিতে। এর ফলে পঞ্জাবে শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কয়েকটি অঞ্চল বিশেষীকরণের দিকে অগ্রসর হয়। এই অঞ্চলে বৈচিত্রকরণের মাত্রা ১৯৭০–৭১ সালে ০.৬২৫ থেকে ২০০১–০২ তে ০.৫০৮-এ নেমে আসে। পঞ্জাবের মতো কৃষি উৎপাদনে অত্যন্ত অগ্রসর একটি রাজ্যে শস্যবৈচিত্রায়ণে এই তথাকথিত পশ্চাদপদতা আরও বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। আমরা দেখেছি, পঞ্জাবে জমির একক-পিছু বিনিয়োগের মাত্রা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি। এখানে চাষ-ব্যবস্থা আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও উৎপাদনশীলতার নিরিখে ক্ষুদ্রচাষির উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। জোতের গড় মাপ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ এখানে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা তুলনায় যথেষ্ট কম। পঞ্জাব মূলত একটি গম ও চাল উৎপাদনকারী রাজ্য। সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তি প্রয়োগের সার্থক উদাহরণ হিসেবে পঞ্জাবের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই প্রযুক্তির কয়েকটি আবশ্যিক শর্ত যেমন ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োগ এখানে জলের অভাব ডেকে এনেছে ও জমির উৎপাদিকা শক্তিকে ক্রমশ কমিয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলের অতি ব্যবহারের সূত্রে অতিরিক্ত ব্যয় বেড়েছে, স্থির পুঁজির ব্যবহার উচ্চ গতি পেয়েছে, ফলে প্রতি একক উৎপাদনে স্থির মূলধনের ব্যবহার অত্যধিক হওয়ায় একক প্রতি উৎপাদন ব্যয় বাড়তেই থেকেছে। পঞ্জাবে স্বাভাবিক সেচের ব্যয়ও অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন-ব্যয় বাড়ার প্রবণতা আরও তীব্র হয়েছে। এসবের ফলে ’৮০-র দশকে কৃষি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে গম-চালের মতো অধিক জলনির্ভর খাদ্যশস্যের বদলে উচ্চমূল্যের হালকা শাকসবজি-ফলমূল চাষের ওপর অধিক জোর দেওয়ার যে-পরামর্শ এসেছিল, ২০০২ সালেও সেই একই পরামর্শ আসে।

পঞ্জাব কৃষির এই বিশেষ উদাহরণটি রাজ্য স্তরে তুলনামূলক আলোচনার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনে। চাষির কাছে কোন কোন কারণে ফল-সবজির মতো চাষ বেশি লাভজনক মনে হতে পারে এবং ভারতীয় কৃষিকে এই নতুন চাষ ব্যবস্থায় পরিবর্তিত করলে সামগ্রিকভাবে কৃষির ও কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ওপর তার প্রভাব কী এটি আলোচনার দাবি রাখে। আমরা রাজ্যওয়ারি তুলনামূলক বিশ্লেষণের সাহায্যে এই বিষয়গুলি বোঝার চেষ্টা করব।

আমরা যে তথ্যভিত্তিক পারিসাংখ্যিক বিশ্লেষণ করেছি তার ফলাফল দিক নির্দেশক হিসাবে কাজ করতে পারে।

অনেক ক’টি রাজ্যেই মোটা দানাশস্য এবং মোট দানাশস্যে নিয়োজিত জমির অনুপাতের হ্রাস চোখে পড়ার মতো। খাদ্যশস্যেও এই হ্রাসের প্রবণতা কোনও কোনও রাজ্যে বেশ প্রকট। মোটা দানাশস্য সাধারণত বাজারে ধান-গমের মতো অন্য খাদ্যশস্যের তুলনায় কম দামে পাওয়া যায়। এই ধরনের শস্যের পুষ্টিগুণ বেশি হলেও এগুলি সাধারণত আর্থিকভাবে সম্পন্ন ভোক্তারা পরিহার করে চলে। এইসব শস্য অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষের খাদ্য হিসেবেই পরিচিত। ১৯৮৮–৮৯ থেকে ২০১৬–১৭ এই চার দশকের মধ্যে এই শস্যগুলির উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির অনুপাত যতটা কমেছে তা অবশ্যই গরিব মানুষের খাদ্যনিশ্চয়তায় ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছে। পঞ্জাব ও হরিয়ানা বাদে প্রায় সব রাজ্যেই এই চার দশকে, বিশেষ করে শেষ দশকে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে নিয়োজিত জমির শতকরা ভাগ নেমে গেছে। বেশি করে নেমেছে গুজরাত, মহারাষ্ট্রের মতো এগিয়ে থাকা রাজ্যে।

আমরা শস্যবৈচিত্র সূচকটি ব্যবহার করে ভারতের প্রধান ১২টি রাজ্যে চার দশকের শস্যবৈচিত্রের সূচক মেপেছি, যা নীচের সারণিতে দেওয়া হল। সূচকগুলিকে সারণিতে চারভাগে ভাগ করে দেখানো হয়েছে: ক) >০.৮; খ) ০.৭ থেকে <০.৮; গ) >০.৬থেকে <০.৭; এবং ঘ) <০.৬। ’৮০ সাল থেকে ২০১৭ সাল অবধি গড় সূচকগুলিকে নীচে উপস্থিত করেছি।

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, কর্ণাটকে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা সবচেয়ে বেশি, তারপরই গুজরাত ও তামিলনাডুর স্থান। শস্যবৈচিত্রের মাত্রার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাবের স্থান তার ঠিক ওপরেই, কিন্তু ’৮০ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা গড়ে ০.৩৭ থেকে ০.৫৫-এ উঠেছে। বিহার আর-একটি রাজ্য, যা শস্যবৈচিত্রের দিক থেকে পিছিয়ে। কিন্তু বিহারে শস্যবৈচিত্রের মাত্রা আলোচ্য সময়ের মধ্যে যেখানে ০.৬০ থেকে বেড়ে ০.৭২-এ এসে দাঁড়িয়েছে, পঞ্জাবের শস্যবৈচিত্রের মাত্রা ০.৬৬ থেকে ০.৬০-তে নেমে এসেছে। ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যের গড় শস্যবৈচিত্রের সঙ্গে জোতের গড় মাপের তুলনা করলে দেখা যায় কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে মোটামুটি একটা ঋণাত্মক সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য এই ঋণাত্মক সম্পর্কটি খুব বেশি স্পষ্ট নয়। যেসব রাজ্যে গড় জোতের মাপ কম, তুলনামূলকভাবে এই শেষ সাত বছরের গড় শস্যবৈচিত্রের মাত্রা সেখানে কম। রাজ্য-স্তরের এই পর্যবেক্ষণটি আমাদের জোত-স্তর সমীক্ষার সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন করছে। জোত-স্তর সমীক্ষায়ও দেখা যায়, জোতের মাপের সঙ্গে শস্যবৈচিত্রের মাত্রার বিপরীতগামী সম্পর্ক। ছোট জোতগুলিই মূলত বেশি মাত্রায় শস্যবৈচিত্রের দিকে ঝোঁকে।

সারণি ১৩.১০ খাদ্যশস্য উৎপাদনে জমির শতকরা ভাগ ১৯৭৯–২০১৭ সালের মধ্যে (বিভিন্ন দশকের বাৎসরিক গড়)

Source: Directorate of Economics and Statistics DAC&FW Website

সারণি ১৩.১১ বিভিন্ন রাজ্যে ’৮০ সাল থেকে ২০১৭ অবধি সূচকের দশকওয়ারি গড়

Source: Directorate of Econommics and Statistics

জেলা-স্তর বিশ্লেষণেও জোতের মাপের সঙ্গে শস্যবৈচিত্রের মাত্রার বিপরীতগামী সম্পর্ক দেখা গেছে। ফলে আমাদের এই রাজ্য-স্তর বিশ্লেষণকে আরও পূর্ণাঙ্গ তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। পূর্ববর্তী বিভাগে আমাদের জোত-স্তর সমীক্ষার ফল এবং বিভিন্ন গবেষকের জেলা-নির্ভর বিশ্লেষণে পাওয়া তথ্যগুলির ভিত্তিতে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ আলোচনা উপস্থিত করা হয়েছে। এই বিভাগে আমরা রাজ্য-স্তর আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যে ২০১০–১৭ এই সাত বছরের গড় শস্যবৈচিত্রের মাত্রাকে নির্ভরকারী উপাদান ধরে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এই মাত্রার সাপেক্ষে সেচ, পরিকাঠামো, কৃষি-জোতের মাপ ও পারিবারিক শ্রম ইত্যাদি নির্ধারক উপাদানগুলির ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করেছি। রাজ্যে রাজ্যে নির্দিষ্ট কালপর্বে এই সূচকের মানের তফাত নির্ণয়ে এই বিভিন্ন উপাদানের পরিসংখ্যানগত গুরুত্ব মাপার জন্য টবিট রিগ্রেশন মডেল ব্যবহার করা হয়েছে।

সারণি ১৩.১২ শস্যবৈচিত্রের নির্ণায়ক উপাদান

উৎস: নিজস্ব গবেষণা

দেখা যাচ্ছে, শস্য বৈচিত্রের ওপর সেচের ঋণাত্মক প্রভাব রয়েছে। যার অর্থ, সরকারি সস্তা সেচের ব্যবস্থা ভাল থাকলে সনাতন জলনির্ভর শস্যের ওপরই চাষি নির্ভর করে। এই ধরনের সেচের জল কম সুলভ হলে, সনাতন জলনির্ভর শস্যের ওপর নির্ভর করতে গিয়ে চাষির পক্ষে চাষ থেকে জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই পরিস্থিতিতে চাষি শস্যবৈচিত্রের মাত্রা বাড়িয়ে সবজি ইত্যাদি চাষ মারফত লাভের হার বজায় রাখার চেষ্টা করে। অপরপক্ষে পরিকাঠামোর গুরুত্ব মাপার জন্য আমরা নিয়ন্ত্রিত বাজারের সংখ্যা ও রাজ্যের আয়তনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য, এই দুটি উপাদান সংক্রান্ত তথ্য বিবেচনা করেছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, শস্যবৈচিত্রের সূচকটির মানের তফাত সৃষ্টিতে জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্যের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা জোত-স্তর আলোচনায় দেখেছি শস্যবৈচিত্রের গুরুত্ব যেসব অঞ্চলে বেশি, সে সব অঞ্চলে চাষি তার ন্যূনতম পুষ্টির পাওয়ার মতো খাদ্যও জোগাড় করতে পারে না। আমরা আমাদের রাজ্য-স্তর আলোচনা থেকে দেখার চেষ্টা করব এই হালকা উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে মাথাপিছু খাদ্যের লভনীয়তা কতটা কমেছে।

নীচের সারণিতে আমরা ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৭ সাল অবধি, প্রতি পাঁচ বছরে খাদ্যশস্যের মাথাপিছু গড় বাৎসরিক বৃদ্ধি হার, প্রতি পাঁচ বছরের বাৎসরিক গড় সুলভতা এবং এই গড় সুলভতা হ্রাস-বৃদ্ধির হার উপস্থিত করেছি।

খাদ্যশস্যের মাথাপিছু গড় সুলভতা ১৯৯৫-এর পর থেকে ক্রমাগত কমেছে। ২০০৫–১০-এর গড় সুলভতা ছিল ১৯৬১–৬৬ সালের গড় সুলভতার থেকেও কম। ’৮০-র দশকে কৃষি-উৎপাদনের হার কিছুটা বৃদ্ধি পায় ও খাদ্যের সুলভতার ওপর এর প্রভাব ’৯০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর অবধি স্থায়ী হলেও ১৯৯৫-এর পর থেকে খাদ্যশস্য উৎপাদনের বৃদ্ধি কমতে থাকে, ফলে খাদ্যশস্যের সুলভতার প্রতি পাঁচ বছরের গড় কমতে দেখা যায়। ওই সময়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাথাপিছু ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রা বিশেষভাবে কমে আসে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার বিভিন্ন রাউন্ডে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী (ডেটোন এবং দ্রেজ ২০০৯)১০ ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ পরিবারের মাথাপিছু ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রা ছিল ২২৪০, ১৯৮৭–৮৮ সালে কমে দাঁড়ায় ২২৩৩ এবং ২০০৪–০৫-এ তা নেমে আসে ২০৪৭-এ। অর্থাৎ ১৯৮৩ থেকে ২০০৪-এর মধ্যে গ্রামীণ পরিবারের মাথাপিছু ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রা শতকরা ৮.৬ ভাগ কমেছে। শহরের মানুষের মাথাপিছু ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রাও কমে, কিন্তু গ্রামের তুলনায় অনেক কম, শতকরা ২.৪ ভাগ। ওই একই সময়ে গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের মাত্রাও কমে শতকরা ১২.১ ভাগ, শহরে কমে শতকরা ৪.৬ ভাগ। কিন্তু ওই একই সময়ে মাথাপিছু প্রকৃত ব্যয় গ্রাম ও শহরাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চ হারে বাড়ার প্রবণতা দেখা যায়। প্রতি ১০০০ ক্যালোরি পিছু প্রকৃত ব্যয়ের মাত্রা বাড়ে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার দেওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ডেটন ও দ্রেজ-এর এই পর্যবেক্ষণটি যদিও দারিদ্রসীমা নির্ণয়ে ও সুস্থতার বিচারে ক্যালোরির ভূমিকা নিয়ে নতুন করে নানা বিরুদ্ধ-মতামতের অবতারণা করেছিল, তবুও আমাদের মতে ন্যূনতম ক্যালোরির সংস্থান না থাকাটা দুঃস্থতার লক্ষণ। উচ্চ আয়-বিশিষ্ট অনেক মানুষই আজকাল ইচ্ছাকৃত ভাবে খাদ্যে ক্যালোরির মাত্রা কম রাখতে চেষ্টা করে ও সেই অনুযায়ী আহারের অভ্যাস পালটে দানাশস্যের পরিবর্তে বেশি করে ফল-সবজি খেয়ে থাকেন। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ, যেমন গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক চাষি বা কৃষি-শ্রমিকের পক্ষে খাদ্যসামগ্রী বাছাইয়ের সময় কম দামি খাদ্য থেকে বেশি দামি খাদ্যসামগ্রীর দিকে যাওয়া হয়তো ইচ্ছাকৃত না-ও হতে পারে। আমাদের জোত-স্তর আলোচনায় ধরা পড়েছে যে, ছোট জোতের চাষিরা যে-খাদ্য প্রতিদিন গ্রহণ করে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম, ফলে তাদের ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যল্প। গ্রামীণ মানুষ কেন তার সাধ্যের মধ্যে দৈনিক আহার থেকে যথেষ্ট পুষ্টি পাচ্ছে না তার নানাবিধ কারণের কয়েকটি হল: গ্রামীণ মানুষের বেকারত্ব, কৃষি-শ্রমিকের নিয়মিত যথেষ্ট কাজ না পাওয়া, খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি, মোটা দানাশস্যের উৎপাদন হ্রাস, ফলে পুষ্টিকর খাদ্যের অপ্রতুলতা, এবং তার জায়গায় ফল-সবজির মতো হালকা উচ্চমূল্যের খাদ্যের প্রসার, নতুন নানা শিল্পজাত খাদ্য ও ভোগ্যসামগ্রীর আবির্ভাব ও গণমাধ্যমে সেসবের বিজ্ঞাপন ও প্রচার, সাধারণভাবে গ্রামে মেলে এবং সস্তা এমন খাদ্যের সুলভতা কমে আসা, ইত্যাদি।

সারণি ১৩.১৩ খাদ্যশস্যের সুলভতা

Source: Directorate of Economics and Statistics

মোট জনসংখ্যার সাপেক্ষে দারিদ্রসীমা-নির্ধারিত ন্যূনতম ক্যালোরিরও নীচে পুষ্টি পাওয়া গ্রাম ও শহরবাসী পরিবারগুলির শতকরা অনুপাত উপস্থিত করেছি নীচের সারণিতে। এখানে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্যের ভিত্তিতে ডেটন ও দ্রেজের (২০০৯)১১ হিসাব ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা দেখিয়েছেন, ১৯০৫ থেকে ২০০৪–০৫-এর মধ্যে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ পৌষ্টিক দীনতার মধ্যে বাস করত। ১৯৮৩-র পর, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, এই অনুপাতটির মান বেড়েছে, যদিও তাঁদের হিসাব অনুযায়ী শহরাঞ্চলের জনসংখ্যায় তা সেভাবে বাড়েনি। আমরা ডেটোন ও দ্রেজ-এর হিসাবটি নীচের সারণিতে উপস্থিত করেছি।

সারণি ১৩.১৪ মোট জনসংখ্যার সাপেক্ষে মাথাপিছু ২১০০ ক্যালোরি ও গ্রামে ২৪০০ ক্যালোরি ভোগ করতে অপারগ মানুষের শতকরা অনুপাত

(একজন মানুষের দৈনিক ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ক্যালোরির পরিমাণের ভিত্তিতে দারিদ্ররেখার হিসেব করা হয়। ধরা হয় শহরের মানুষের দৈনিক প্রয়োজন ন্যূনতম ২১০০ ক্যালোরি এবং গ্রামের মানুষের জন্য ২৪০০ ক্যালোরি)

Source: NSSO Report

আমাদের জোত-স্তর সমীক্ষায় আমরা এই ইঙ্গিত পেয়েছি, যে-সব ক্ষুদ্র চাষি সেচের সুবিধা না থাকায় একটি/দু’টি শস্যের ওপর নির্ভর না করে শস্য-ফল-সবজি সহ নানাধরনের হালকা ও উচ্চমূল্যের ফসল তৈরি করে, তারা চাষের কাজে যথেষ্ট পারিবারিক শ্রম দিয়েও ন্যূনতম পুষ্টি পাওয়ার মতো খাদ্যসামগ্রী ভোগ করতে পারে না।

তথ্যসূত্র

১. World Bank Report. 2005.

২. Sing, S. 2004. “Crisis and Diversification in Punjab Agriculture.” EPW. (25th December, 2004).

৩. Joshi, P. K., A. Gulati, P. S. Birthal, L. Tewari. 2004. “Agriculture Diversification In South Asia: Patterns, determinates and policy implications.” Economic and Political Weekly. (12th June 2004).

৪. তদেব, এছাড়াও

Singh, Joginder and R. S. Sidhu. 2004. “Factors In Declining Crop Diversification: Case Study of Punjab.” Economic and Political Weekly. vol 39, no 52.

Rao, P. P., P. S, Birthal, P. K. Joshi. 2006. “Diversification towards high value agriculture.” Economic and Political weekly. vol 41, no 26.

৫. Rao, C. H. H. 2000. “Decline in demand for Foodgrains in Rural India.” Economic and Political Weekly.

৬. Rajuladevi, A. K. 2001. “Food Poverty and Consumption among Landless labour households.” Economic and Political Weekly. (22nd January, 2001)

৭. A Study on Transformation of Indian Agriculture in the Post Doha (2001) Scenario by Aparajita Mukherjee and Saumya Chakrabarti, under the research project sponsored by South Asia Network of Economic Research Institutes, World Bank GDN, 2001.

৮. বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানগুলির মান মাপার উদ্দেশ্যে আমরা খাদ্য উপাদানকে পুষ্টি উপাদানে পরিবর্তন করার জন্য এন এস এস ও (জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা)-র দেওয়া নির্দিষ্ট পরিবর্তনের হারগুলি ব্যবহার করেছি।

৯. তদেব

১০. Deaton, Angus and Jean Drèze. 2009. “Food and Nutrition in India: Facts and Interpretation.” Economic and Political Weekly. (14th Februray, 2009)

১১. তদেব

১২. তদেব

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *