১৩. লিলির যে চিঠির জন্যে

লিলির যে চিঠির জন্যে পরম আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছিলাম, সে চিঠি এসে গেছে। লিলি গোটা গোটা হরফে লিখছে, আমি জানি তুই রাগ করেছিস। কতদিন হল গিয়েছি কিন্তু কখনো তোর কাছে চিঠি লিখিনি। কি করব বল? এমন খারাপ অবস্থা গেছে আমার। তোর দুলাভাইয়ের চাকরি নেই। বসতবাটিও পদ্মায় ভেঙে নিয়েছে। একেবারে ভিক্ষা করবার মত অবস্থা। কতদিন যে মাত্র একবেলা খেয়েছি। তারপর আবার তোর দুলাভাইয়ের অসুখ হল। মরো-মারো অবস্থা। এখন অবশ্যি ঠিক হয়ে গেছে সব। তুই অতি অবশ্যি এসে যা রঞ্জু।

লিলির চিঠি পকেটে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই। সবাইকে ছেড়ে যেতে বড় মায়া লাগে। আশৈশব পরিচিত এ বাড়িঘর। বাদশা মামা, নানাজান, লালমামি, নবুমামা এদ্রের সবার স্মৃতির গন্ধ নিয়ে যে বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাকে ছেড়ে কী করে যাই? আমি উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সোনাখালির পুলের উপর অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকি। নৌকা নিয়ে চলে যাই হলদিপোতা। খুব জোছনা হলে সফুরা খালাকে নিয়ে পুকুরঘাটে বেড়াতে চাই। সফুরা খালা বলেন, তুমি কবে যাবে রঞ্জু?

যে কোনো একদিন যাব।

সেই যে কোনো একদিনটা কবে?

হবে একদিন।

একেক রাতে সফুরা খালা কাঁদেন। তার গভীর বিষাদ বুঝবার ক্ষমতা আমার নেই। বুঝতে চাই না। যে বন্ধন আমাকে এখানে আটকে রেখেছে কবে তা কাটবে, কবে চলে যাব, তাই ভাবি। নানাজানও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন,

তোমার যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে?

না।

তোমার আর লিলির নামে যে জমি-জমা আছে তার কী হবে?

যেমন আছে তেমন থাকবে।

নানাজান কথা বললেন না। আমি জানি এই জমিটুকুই তাদের অবলম্বন।

সে রাতে ভীষণ শীতই পড়েছিল। সন্ধ্যা না নামতেই ঘন কুয়াশা চারদিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। রাতের খাওয়ার পর হ্যারিকেন হাতে বাইরের ঘরে আসছি, হঠাৎ দেখি মামা দারুণ উত্তেজিত হয়ে দ্রুত আসছেন। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।

রঞ্জু, দেখ দেখি।

আমি তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে, লালমামি একটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, বাদশা মামা বলে চলেছেন, নৌকা করে সন্ধ্যার আগেই এরা দুজন এসেছে। চুপচাপ বসেছিল। আমি মসজিদে যাব বলে ওজু করতে গিয়েছি। এমন সময়…

লালমামি বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন (যে উঠানে অনেক অনেক দিন আগে আমার মা তার দুটি ছেলেমেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন)। কেউ কোনো কথা বলল না। নানাজান চিত্ৰাপিতের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। ছোট নানীজান যেন কিছুই বুঝছেন না। এমন ভঙ্গিতে

তাকাতে লাগলেন। সফুরা খালা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি নিচে নেমে এলেন। বাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর গরম শালটা কোথায় সফুরা? এলাচির শীত করছে।

নবুমামার কথা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। সবাই চুপ করে রইল। এক সময় দেখলাম লালমামি কাঁদছেন।

আমি চুপচাপ বাইরের ঘরে বসে বসে ঝিঝি ডাক শুনতে লাগলাম। অনেক রাতে বাদশা মামা আমাকে ডেকে নিলেন। মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, তোরা সবাই যদি দূরে দূরে থাকিস তাহলে এলাচি কী মনে করবে বল? চল রঞ্জু।

বাদশা মামা আমার হাত ধরলেন।

বহুদিন পর লালমামির ঘরে এসে ঢুকলাম। পালঙ্কে লালমামি আধশোয়া হয়ে আছেন। তার কোলের কাছে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বাচ্চা মেয়েটি ঘুমিয়ে। আমি এসে বসতেই লালমামি একটু সরে গেলেন। আমি বললাম, কেমন আছেন মামি?

মামি মাথা নাড়লেন। বাদশা মামা বললেন, মোটেই ভাল না রঞ্জু। দেখ না স্বাস্থ্য কী খারাপ হয়ে গেছে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। বাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে পুরোনো গ্রামোফোন খুঁজে বের করলেন।

আমি বললাম–

আজি থাক মামা।

না-না শুনি। আমার শোনার ইচ্ছা হচ্ছে।

লালমামি মৃদু কণ্ঠে বললেন, না-না থাকুক। গান বাজাতে হবে না।

তবু গান বেজে উঠল—

“আমার ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলো
তোরে আমি কোথায় রাখি বল।”

আমি চলে আসলাম। এই অচিনপুরীতে থাকবার কাল আমার শেষ হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *