১৩. লালবাগ থানার ওসি সাহেব

লালবাগ থানার ওসি সাহেব এসেছেন। শুভ্রর সামনে চেয়ারে বসে আছেন। তার মুখ হাসি হাসি। সিভিল ড্রেসে এসেছেন বলে তাঁকে পুলিশ অফিসার বলে মনে হচ্ছে না। তাকে স্কুল টিচারদের মত দেখাচ্ছে। অংক স্যারের মত কঠিন স্যারও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে বাংলা স্যার। তার নাকের নিচে ছোট্ট বাটার ফ্লাই গোঁফ শুধুমাত্র বাংলা স্যারদের মুখেই মানায়। তবে এই গোঁফ সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যাবে ভদ্রলোক যখন ইউনিফর্ম পরবেন। হিটলারেরও বাটারফ্লাই গোঁফ ছিল।

ওসি সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে হালকা গলায় বললেন, শুভ্র সাহেব কেমন আছেন বলুন!

শুভ্ৰ বলল, ভাল।

আপনার ব্যবসার অবস্থা কী?

ভাল।

আমি কী জন্যে এসেছি। সেই খবর নিশ্চয়ই আগেই পেয়েছেন?

জ্বি খবর পেয়েছি।

আমি আর দেরি করব না। ব্যবস্থা করুন। আমার একটু তাড়া আছে। ছেলেকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতে হবে। চিড়িয়াখানায় হাতির পিঠে চড়ার ব্যবস্থা আছে। সে হাতির পিঠে চড়বে।

চা খাবেন?

চায়ের অভ্যাস আমার তেমন নাই। যাই হোক আপনি বলছেন যখন খাই। চিনি কম দিতে বলবেন।

শুভ্ৰ বেল টিপে মঞ্জুকে চা দিতে বলল। ওসি সাহেব বিশেষ ভঙ্গিমায় সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে বললেন-– আপনাদের এখানে নতুন একটা মেয়ে এসেছে বলে খবর পেয়েছি। লাইসেন্স হয়েছে?

আমি বলতে পারছি না লাইসেন্স হয়েছে কি-না।

ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেবিট করা লাগবে। আপনি নতুন মানুষ এই জন্যে বললাম।

আমি নতুন হলেও আমার অফিসের লোকজন পুরনো। এরা আইন মেনেই চলবে। তাছাড়া আপনারাতো আছেনই– আইনের রক্ষক।

কথাটা যেন কেমন কেমন করে বললেন।

শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, কথাটা কেমন কেমন করে বললেওতো আপনার গায়ে লাগা উচিত না।

ওসি সাহেব্ব থমথমে গলায় বললেন, গায়ে লাগা উচিত না কেন?

শুভ্র সহজ গলায় বলল, গায়ে লাগা উচিত না। কারণ আপনাদের আমরা টাকা দিয়ে কিনে রেখেছি। আপনারা মাসিক বেতন নিচ্ছেন। বেতনভুক্ত কেউ মালিকের কথা; গায়ে লাগবে না। গায়ে লাগানো উচিত না।

ওসি সাহেব শুভ্রর দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, শুভ্র আপনার বয়স অল্প রক্ত গরম। পুলিশের সঙ্গে রক্ত গরম করবেন না। আপনার পিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল তাকে শ্ৰদ্ধা করতাম। আপনাকেও স্নেহ করি।

শুভ্র সহজ গলায় বলল, আপনার স্নেহ আমার প্রয়োজন নেই ওসি সাহেব। স্নেহ অন্য কারোর জন্যে রেখে দিন। টাকা নিতে এসেছেন টাকা নিয়ে চলে যান।

মঞ্জু, চা নিয়ে ঢুকল। সেকি বাইরে থেকে কিছু শুনেছে, কেমন ভীত চোখে শুভ্ৰকে দেখছে। শুভ্র খুবই মজা পাচ্ছে। ওসি সাহেবকে আরো কঠিন কিছু কথা বলতে ইচ্ছা করছে। শুধু কঠিন কথাই না, হাস্যকর অপমানসূচক কথা। এই মুহুর্তে শুভ্ৰর মাথায় যে কথাগুলি ঘুরছে তা হল— ওসি সাহেব শুধু চা কেন খাবেন। পিরিচে করে এক পিরিচ, গু এনে দিক। চামচ দিয়ে পায়েসের মত খান। কথাগুলি মাথায় ঘুরলেও মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না। বের হলে শুভ্রর মনে হয় ভাল লাগত।

ওসি সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। শুভ্ৰ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরিয়ে নিল না। এক ধরনের খেলা শুরু হয়েছে। এই খেলার काशी ইদুর-বেড়াল CT-Cat and Mouse game. এই খেলার মজাটা হচ্ছে ইদুর হঠাৎ করে বিড়াল হয়ে যায়। আর বিড়াল হয়ে যায় ইদুর। কে কখন বদলাবে কিছুই আগে থেকে বলা যায় না।

ওসি সাহেবের প্রথম সিগারেটটি শেষ হয় নি। আধা খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে তিনি আরেকটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন- আপনি যে সব কথাবার্তা বলছেন তার ফলাফল কী হতে পারে তা কী আপনি জানেন?

শুভ্ৰ চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বলল, ফলাফল শূন্য। আপনি আমাকে ভয় দেখাবার হাস্যকর চেষ্টা করছেন। আপনার ক্ষমতা খাকি পোশাকের আর আমার ক্ষমতা টাকার। টাকার ক্ষমতা ব্যবহার করে আমি আপনাকে আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর যে লালবাগ থানা থেকে চিটাগাং হিলট্ৰেকসে বদলি করে দিতে পারি তা-কি জানেন? অফিসের পুরনো কাগজপত্র দেখে জেনেছি। আমার আগে আমার বাবাও এরকম কাজ করেছেন। হিসাধের খাতায় লেখা- ওসি এবং সেকেন্ড অফিসারকে বদলির খরচ বাবদ তিন লাখ একুশ হাজার টাকা মাত্র।

ওসি সাহেবের হাতের সিগারেট নিভে গেছে। তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বড় রকমের ধাক্কার মত খেয়েছেন। ধাক্কা সামলাবার চেষ্টা করছেন।

শুভ্ৰ বলল, আপনি সিভিল ড্রেসে আমার অফিসে এসেছেন। আমি কী করতে পারি জানেন? আপনাকে এখান থেকে ধরে নিয়ে আমার বেশ্যাখানায় কোনো এক বেশ্যার ঘরে ঢুকিয়ে দিতে পারি। পত্রিকায় আপনার ছবিসহ নিউজ করতে পারি। তারপর অন্য পুলিশ দিয়ে আপনাকে গ্রেফতার করাতে পারি। কাকের মাংস কাক খায় না। পুলিশের মাংস পুলিশ খায়। বলুন এই কাজটা করতে পারি বললাম, সেটা পারি কি-না?

ওসি সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, পারেন।

শুভ্র বলল, আমাকে ভবিষ্যতে কখনো ভয় দেখানোর চেষ্টা করবেন না। নিন এখন চা খান।

ওসি সাহেব ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিলেন। শুভ্র বলল, চাটা মনে হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ দিক।

ওসি সাহেব মাথা কাত করতে করতে বললেন, জ্বি আচ্ছা দিতে বলেন। আর শুনুন ভাই সাহেব আমার উপর কোনো রাগ রাখবেন না। আপনি হয়ত শুনে বিশ্বাস করবেন না। আপনার পিতা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমার প্রথম ছেলের জন্মদিনে উনাকে দাওয়াত করেছিলাম। উনি গিয়েছিলেন। আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে তিনি ছবিও তুলেছেন। সেই ছবি আমাদের এলবামে আছে! একদিন যদি গরিবখানায় যান। ছবিটা দেখাব। আপনাকে যেতেই হবে। কবে যাবেন বলেন। আমার স্ত্রী অত্যন্ত খুশি হবে।

যাব কোনো একদিন। বাবা যখন গিয়েছেন। আমিও যাব। যথা পিতা তথা পুত্র।

আজই চলুন। আজ আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। বলেছিলাম না, ছেলেকে চিড়িয়াখানায় নিতে হবে। ছুটিই পাই না— এমন এক চাকরি করি। ভাই আমার রিকোয়েষ্ট। আজ চলুন।

আজ যেতে পারব না। আজ আমি আমার ব্যবসা দেখতে যাব। মেয়েগুলির সঙ্গে কিছু সময় কাটাব। আপনি যেমন চিড়িয়াখানায় যাচ্ছেন আমিও সে রকম চিড়িয়াখানাতেই যাচ্ছি।

কোনোরকম সমস্যা হলে বলবেন। কোনো সংকোচ করবেন না। স্কু টাইট দিয়ে দিব। Consider me as your brother, আপনার অফিসের চা খুব ভাল হয়। আপনি রাগ করেন আর যাই করেন মাঝে মাঝে এসে চা খেয়ে যাব।

 

কার্পেটে পা ছড়িয়ে আসমানী বসে আছে। মেয়েটার শরীর মনে হয় ভাল নেই। চোখ লাল। মাথার চুল এলোমেলো। শুভ্ৰ নিজের মনে হাসল। শরীর ভাল না থাকার সঙ্গে চুল এলোমেলোর কোনো সম্পর্ক নেই। সুস্থ মানুষের চুলও এলোমেলো থাকতে পারে। তার নিজের চুলই এখন এলোমেলো। তবু কেন জানি মেয়েটার চুল এলোমেলো দেখেই মনে হল তার শরীর ভাল নেই। সে নিশ্চয়ই খুব অসুস্থ কাউকে দেখেছিল যার চুল ছিল এলোমেলো। মস্তিষ্ক সেই স্মৃতি যত্ন করে রেখে দিয়েছে।

আসমানীর গায়ের শাড়িটার রঙ সবুজ। প্রথমবার যখন তার সঙ্গে দেখা সেদিনও তার গায়ে সবুজ রঙের শাড়ি ছিল। এই মেয়েটির মনে হয় সবুজ রঙ পছন্দ। মেয়েটিকে আজ অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। যে সুন্দর তাকে যে সব সময় সুন্দর লাগবে এমন কোনো কথা নেই। সুন্দর মানুষকেও মাঝে মাঝে অসুন্দর লাগে। আবার অসুন্দর মানুষকেও হঠাৎ হঠাৎ খুব সুন্দর লাগে। শুভ্র বলল, আপনি কেমন আছেনে?

প্রশ্নের উত্তরে আসমানী মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল। প্রশ্নের উত্তর দিল শরীরের ভাষায়। এই ভাষা শুভ্রর ভাল জানা নেই বলে সে প্রশ্নের উত্তরটা ধরতে পারল না। প্রশ্নের উত্তর হয়ত বা— আমি ভাল নেই। তাতে কী হয়েছে? আপনি যে ভাল আছেন এতেই আমি খুশি।

শুভ্র বলল, আমার অফিসের কেউ কি আপনাদের বলে নি আজ আমি আসব? আমিতো খবর পাঠিয়েছিলাম।

আসমানী আবারো ঠিক আগের ভঙ্গিতে মাথা ঝাকিয়ে বলল, আপনের দোকান। আপনে যখন ইচ্ছা আসবেন। সওদাপাতি দেখবেন, বলাবলির কী আছে?

শুভ্র বলল, আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি। আমি জানতে চেয়েছি— কেউ কি আপনাদের বলেছে যে আমি আসব?

জ্বি বলেছে।

আমার পছন্দ।

জ্বি আচ্ছা। এখন থেকে সোজা জবাব দিব।

আপনার কি শরীর খারাপ?

জ্বি, আমার মাসিক চলতেছে। আজ দ্বিতীয় দিন।

শুভ্ৰ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কী বলছে এই মেয়ে। মেয়েটাকে কি প্ৰচণ্ড ধমক দেয়া উচিত না? রাগে শুভ্রর শরীর কাপতে শুরু করেছে। এই রাগকে কিছুতেই প্রশ্ৰয় দেয়া যায় না। তার বাবা দিতেন না। সে কেন দেবে?

শুভ্র কিছু বলার আগেই আসমানী বলল, প্রশ্ন করলে ঠিকঠাক জবাব দিতে বলছেন বলে দিয়েছি। রাগ করবেন না।

শুভ্র বলল, আমার ধারণা। আপনি আমাকে বিব্ৰুত করার জন্যে এই কথাটা বললেন। আপনি আমাকে অপদস্ত করতে চাচ্ছেন। চাচ্ছেন না?

আসমানী তাকিয়ে আছে। শুভ্ৰ মুগ্ধ হয়ে গেল। কী সুন্দর বড় বড় চোখ! তার মনে হল মানুষের সব সৌন্দৰ্য আসলে চোখে। যার চোখ সুন্দর তার সবই সুন্দর। মেয়েটা চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। তাকিয়েই আছে। শুভ্ৰ বলল, আপনারা ম্যানেজার সাহেবের কথা শুনছেন না কেন?

কী কথা?

উনার সঙ্গে আপনাদের কথা হয় নি?

উনার সঙ্গে কত কথাইতো হয়েছে। কোনটার কথা জিজ্ঞেস করেন? আপনে নিজেও সোজা প্রশ্ন করতে পারেন না। যে নিজে সোজা প্রশ্ন করে না সে অন্যের সোজা উত্তর ক্যামনে চায়?

শুভ্ৰ অবাক হয়ে লক্ষ করল— মেয়েটা হাসছে। হাসাহসি করার মত কথাবার্তাতো হচ্ছে না। শুভ্র তার নতুন ম্যানেজারকে বলে দিয়েছিল- সব কটা মেয়েকে যেন তাদের বাড়ি ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সবাই নগদ পনেরো হাজার করে টাকা পাঝে। একটা করে সেলাই মেশিন পাবে; কেউ যদি সেলাই মেশিন নিতে না চায়— সম পরিমাণ টাকা পাবে। মেয়েটার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা এ জাতীয় কথা শুনে নি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার— মেয়েটার আচার আচরণ হাসার ভঙ্গি সব কিছুর মধ্যে এক ধরনের তাচ্ছিল্য আছে। এই মেয়ে কি সবার সঙ্গেই এ রকম করে না-কি তার সঙ্গেই করছে?

শুভ্র বলল, নগদ টাকা, আর সেলাই মেশিনের ব্যাপারটা আপনারা জানেন না?

আসমানী হেসে ভেঙে পড়তে পড়তে বলল, সেলাই মেশিন দিয়া কী করব? আমরা কি দর্জি?

আসমানী হাসি থামাতে পারছে না। শুভ্রর কাছ থেকে এমন মজাদার কথা সে শুনবে তা যেন ভাবতেই পারে নি।

শুভ্ৰ বলল, দর্জি হওয়া কি খারাপ?

খারাপ ভাল-র কথা না। যে কাজ জানি না, সেই কাজ করব ক্যামনে? কাজ একটাই জানি। খরিদারের সাথে বসা।

মেয়েটা আবারো হাসছে। সর্ব শরীর দিয়ে হাসছে। এই ভঙ্গিতে শুভ্ৰ কাউকে হাসতে দেখে নি। হাসির শব্দটা কেমন? শুভ্ৰ বুঝতে পারছে না। হাসির শব্দে সে মন দিতে পারছে না। আসমানী চট করে অবসি থামিয়ে বলল, চা খান। খাবেন?

শুভ্র বলল, না।

তাহলে এক কাজ করেন। আপনের মিজাজ খুব খারাপ— আপনি ঘুমান।

ঘুমাব?

হুঁ। অসুবিধা কী? আমি মাথার চুলে বিলি দিয়া ঘুম পাড়ায়ে দিব। পাঁচ দশ মিনিটের ছোট্ট ঘুম। শরীর ঝরঝরা হয়ে যাবে।

ও।

আপনের আব্বারে কত ঘুম পাড়ায়ে দিয়েছি।

শুভ্ৰ ভুরু কুঁচকে তাকাল। এই মেয়ে এর আগের বারেও তার বাবার প্রসঙ্গ টেনে এনেছে। আবার কখনো দেখা হলেও হয়ত এই কাজটা সে করবে। তবে আবারো তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

আপনের বাবা আমারে খুবই স্নেহ করতেন।

ভালতো। আপনাকে স্নেহ না করলেও তার চলত। স্নেহটা আপনি বাড়তি পেয়েছেন।

আমারে তুমি করে বলেন।

কেন আমার বাবা আপনাকে তুমি করে বলতেন। সেই জন্যে?

জ্বি-না। তুমি করে বলতে বলতেছি। কারণ এর আগের বার আপনে আমারে তুমি করে বলেছেন।

আমি আপনাকে কখনো তুমি বলি নি।

সরবত খাবেন? সরবত বানায়ে দেই! পেস্তাবাদাম দিয়া খুব ভাল সরবত।

আমার বাবা কি এই সরবত খেতেন? তিনি পছন্দ করতেন?

উনি দুই তিনবার খেয়েছেন। উনার পছন্দ হয় নাই। সব ভাল জিনিস সবের পছন্দ হয় না। আপনের পছন্দ হবে।

বেশতো সরবত বানাও, খেয়ে দেখি।

বলেই শুভ্ৰ চমকে উঠল। মেয়েটাকে সে তুমি বলেছে। তুমি করে সে বলতে চায় নি— ভেতর থেকে চলে এসেছে। মেয়েটিও তা বুঝতে পেরেছে? তুমি বলার সঙ্গে সঙ্গে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েছে। হোসেছে। এই হাসি আগের মত শরীর কাঁপানো হাসি না। অন্যরকম হাসি।

আসমানী উঠে চলে গেল। যাবার আগে খুব ভালমত পর্দা টেনে দিল। ঘর কেমন জানি অন্ধকার অন্ধকার হয়ে আছে। এই অন্ধকারটাও ভাল লাগছে। সব ঘরের আলাদা আলাদা গন্ধ থাকে। এই ঘরেরও আছে। প্রতিটি মানুষকে যেমন গায়ের গন্ধ দিয়ে আলাদা করা যায়, প্রতিটি ঘরকেও তেমন গন্ধ দিয়ে আলাদা করা যায়। বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর ঘরগুলির মধ্যে গন্ধ বিষয়ক মিল থাকে। আসমানীদের মত মেয়েরা যে সব ঘরে থাকে। সেসব ঘরাও হয়ত গন্ধের কারণেই অন্য রকম। শুভ্ৰ ঘড়ি দেখল— তিনটা বাজে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। সামান্য ক্ষুধাবোধও হচ্ছে। আজ সকাল থেকেই সে বাইরে বাইরে ঘুরছে। দুপুরে খাওয়া হয় নি। দুটা বাজার দশ মিনিট আগে অফিসে গিয়েছিল। ভেবেছিল অফিসে কিছু একটা খেয়ে নেবে। ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল বলে কিছু খাওয়া হয়। নি। নতুন ম্যানেজার সিদ্দিক বলল, ঐ সব জায়গায় আপনার ঘনঘন যাওয়া ঠিক না। কী বলতে হবে। আমাকে বলে দিন। আমি বলব।

শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, ঘনঘন যাবার কথাটা উঠছে কেন? আমিতো আজ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত যাচ্ছি।

ম্যানেজার বলল, দ্বিতীয়বার যাবারও দরকার নেই।

দরকার আছে কী নেই সেটা আমি দেখব।

জ্বি আচ্ছা।

নতুন ম্যানেজারকে শুভ্রর পছন্দ হয়েছে। সে শুভ্ৰকে ভয় পাচ্ছে না। তার যেটা বলার দরকার সে বলছে। সিদ্দিককে এনে দিয়েছেন ক্যাশিয়ার সাহেব। ক্যাশিয়ার সাহেব ছেলেটিকে দেবার সময় শুধু বলেছেন— ছেলে ভাল। একে দিয়ে কাজ করায়ে আরাম পাবেন। শুভ্র আরাম পাচ্ছে। এবং বুঝতে পারছে সিদ্দিক ছেলেটি অল্পদিনের ভেতর তার ডান হাত হয়ে উঠবে। যখনি সে ডান হোত হবে তখনি তাকে বিদেয় করতে হবে। বড় প্রতিষ্ঠানে মালিকের ডান হাত থাকতে নেই। ডান হাত কেন, বা হাতও থাকতে নেই।

শুভ্রের ধারণা সে বদলে যাচ্ছে। মানুষ এক রাতে বদলায় না; মানুষের বদলানোর প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত মন্থর। যে বদলায় সে নিজে বুঝতে পারে না। যারা তার আশেপাশে আছে তারাও কিছু বুঝতে পারে না। কারণ যে বদলায় সে আশেপাশের সবাইকে নিয়েই বদলায়।

শুভ্ৰ আসমানীর ঘরে নতুন ম্যানেজার ও মঞ্জুকে নিয়ে এসেছে। মঞ্জু এখন বারান্দায় বসে আছে। মঞ্জু বসেছে মেঝেতে পা ছড়িয়ে। তার পাশে চেয়ারে বসে আছে সিদ্দিক। সিদ্দিকের চোখ মেঝের দিকে। মঞ্জু তার জায়গা থেকে নড়বে না। ম্যানেজার সাহেবও নড়বে না।

আসমানী বড় একটা গ্লাসে করে সরবত এনেছে। মনে হচ্ছে দুধের সরবত। ফেনা উঠা দুধে বরফের কুচি ভাসছে। দুধটা পুরোপুরি সাদাও না, হালকা সবুজাভ। গ্লাসে চুমুক দিয়ে শুভ্ৰর ভাল লাগল। অদ্ভুত স্বাদ— ঝাঁঝালো, টক মিষ্টি কেমন যেন নোনতা নোনতা। সারবতটা মুখে দেয়া মাত্র জিভের সঙ্গে চকলেটের মত জড়িয়ে যাচ্ছে।

আসমানী বলল, আস্তে আস্তে খান। এই সরবত ধীরে ধীরে খাইতে হয়।

এই সরবীতে বিশেষ কিছু কি দেয়া হয়েছে?

আসমানী হাসল। কী সুন্দর হাসি! মেয়েটার দাঁতগুলি যে এত সুন্দর তা আগে লক্ষ করা হয় নি।

আসমানী!

তোমাদের এখানে নতুন একটা মেয়ে এসেছে না?

জ্বি।

মেয়েটার নাম কী?

আমাগোর এইখানে যারা আসে তাগোর কোনো নাম থাকে? ঘরে ঢুকনের আগে নাম থাকে। একবার টুইক্যা গেলে আর নাম নাই। এই যেমন ধরেন আপনে। এখন কিন্তু আপনেরও নাম নাই।

তোমার কথাবার্তা কিছু বুঝতে পারছি না।

সরবতটা এত তাড়াতাড়ি খাওন ঠিক না। ধীরে খান।

আসমানী তোমাদের এখানে কি টেলিফোন আছে? আমার একটা টেলিফোন করা দরকার।

এখানে টেলিফোন নাই। আপনে টেলিফোন করবেন?

হ্যাঁ।

খুব দরকার?

হ্যাঁ খুব দরকার।

খুব দরকার হইলে আমি একটা টেলিফোনও জোগাড় করে দেব। এখানে রাণী নামের একজন আছে— তাকে তার সাহেব একটা মোবাইল টেলিফোন দিয়েছে।

ও।

বুড়া সাহেব! রাতে ঘুমাইবার আগে টেলিফোনে খারাপ কথা না বললে বুড়ার ঘুম হয় না। এই জন্যেই দিয়েছে। সে প্রতি রাতে রাণীর সাথে খারাপ কথা বলে। এর জন্যে মাসকাবারি টাকা দেয়।

ও।

আপনি অস্তে আস্তে সরবত খান। আমি টেলিফোন এনে দিব।

তোমার সরবীতটা খেতে খুবই ভাল। আমি আরেক গ্লাস খাব।

আসমানী আবাৱে হাসল। শুভ্ৰর মনে হল এবারের হাসিটা আগের বারের চেয়েও সুন্দর।

 

টেলিফোন ধরল বিনু। শুভ্ৰ বলল, বিনু তুমি কি একটা কাজ করে দিতে পারবে? আমার ঘরে একটু যাও। টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে দেখতো দুটা ক্যাসেট আছে কি-না। একটায় লেখা মীরা, অন্যটায় বিনু! ক্যাসেট দুটা কীসের বুঝতে পারছতো?

পারছি।

আমি টেলিফোন ধরে আছি। তুমি ক্যাসেট নিয়ে এসো বেশি দেরি করবে না। আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি। আমার খুবই ঘুম পাচ্ছে।

শুভ্ৰ তার গ্লাস প্ৰায় শেষ করে এনেছে। সে এখন নিশ্চিত— সরবতে বিশেষ কিছু দেয়া হয়েছে। সেই বিশেষ কিছুটা কী জানতে ইচ্ছা করছে না। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আবার জেগে থাকতেও ইচ্ছা করছে।

বিনু বলল, হ্যালো।

শুভ্ৰ আগ্রহের সঙ্গে বলল, ক্যাসেট পেয়েছ?

হ্যাঁ।

আমার একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেট এবং ক্যাসেট প্লেয়ার দরকার। আরেকটা মেয়ের হাসি রেকর্ড করব। সমস্যা হল ঘরেতো কোনো রেকর্ডার নেই। কী করা যায় বিনু বলতো। প্রবলেমে পড়ে গেলাম।

আপনি বলেন কী করা যায়।

আচ্ছা ঠিক আছে আমি নিজেই ব্যবস্থা করছি। মঞ্জুকে ক্যাসেট কিনতে পাঠাব। মঞ্জু যে বসে আছে খেয়াল ছিল না।

শুভ্ৰ মোবাইল সেটটা আসমানীর দিকে এগিয়ে দিল। আসমানী বলল, আপনার কাছে রেখে দিন। যদি কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে কথা বলবেন।

শুভ্ৰ বলল, আচ্ছা? আমি আপনার মাথার চুলে বিলি দিয়ে দিব?

দাও।

আপনি আরাম করে ঘুমান। আপনাকে দেইখা মনে হইতাছে আপনি খুব অস্থির হয়ে আছেন। অস্থির হইয়া লাভ নাই। আপনে অস্থির হইলেও দুনিয়া যেমনে চলাব, সুস্থির হইলেও তেমনই চলব।

সরবতে কী দিয়েছ?

ভাংয়ের সরবত। ভাং খুব সামান্য দেয়া হয়েছে। আপনার খুব ভাল ঘুম হবে।

ভাং এর সরবত কীভাবে বানায়?

ধুতুরা গাছের পাতা দুধের মধ্যে কচলে বানায়।

ধুতুরা গাছের বোটানিক্যাল নাম কি তুমি জান?

জ্বি না।

মীরা জানবে। মীরার অনেক পড়াশোনা। দেখি টেলিফোনটা। মীরাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেই। আরেকদিন হয়ত জানতে ইচ্ছা করবে না।

জানতে ইচ্ছা না করলে জানবেন না।

পান খেতে ইচ্ছা করছে। আসমানী একটা পান আনিয়ে দেবে? হাফিজ মিয়ার পান।

হাফিজ মিয়া কে?

আছে একজন— খুব ভাল পান বানায়। সবাই তার পান খায়।

আচ্ছা আনায়ে দিতেছি।

শুভ্ৰ ঘুমিয়ে পড়ল। পুরো রাতে তার একবারও ঘুম ভাঙল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *