১৩. লটারি

১৩. লটারি

আমরা অনেকক্ষণ কোন কথাবার্তা বললাম না। অ্যাডভেঞ্চারে বের হবার পর যদি কাউকে পুলিসে ধরে নিয়ে যায় বাসাতে ফেরত পাঠাবে বলে তাহলে অন্যদের কি সাংঘাতিক মন খারাপ হয়ে যায় বুঝিয়ে বলতে হয় না। আমাদের সবারই মনে হচ্ছিল এসব ছেড়েছুঁড়ে বাসায় চলে যাই, নান্টু, কাসেম নেই মিশুও ধরা পড়ে গেল বাকি আমরা কজন থেকে আর কি করি?

কোন কথা না বলে আমরা মুখ গুঁজে দাঁড় টানতে লাগলাম। ডাকাতের নৌকাটাকে সেখানে ফেলে রেখে আমরা বহু এগিয়ে এসেছি। দুটি মস্তো বাঁক এর মাঝে পার হয়ে গেছে। পিছনে দেখতে দেখতে টিপু এক সময়ে বলল, ডাকাতদের নৌকাটা একটু পরেই এসে পড়বে।

কেন?

পুলিস তো আমাদের খুঁজতে বের হয়ে গেছে, কাজেই ডাকাতেরা ওর মাঝে থাকতে চাইবে না। নৌকায় খোঁজ করে যদি ডাকাতদের বন্দুক বের হয়ে পড়ে?

ঠিকই বলেছিস। রবিন মাথা নাড়ল। টেলিস্কোপ দিয়ে পিছনে তাকাতে তাকাতে বলল, আমরা আগে আগেই শুভাপুরে পৌঁছে নৌকা থামিয়ে রাখব। তাহলে ডাকাতেরা সন্দেহ করবে না।

আমি বললাম, এমনিতেও আমাদের সন্দেহ করবে না! কোন ডাকাত কি চিন্তা করতে পারবে আমরা একমাস ধরে ওদের পিছু ঘুরছি?

তা অবিশ্যি ঠিক। সলিল একটু দুঃখ দুঃখ স্বরে হঠাৎ বলল, আহা, বেচারা মিশু!

আমাদেরও দুঃখ হচ্ছিল, কিন্তু করার কিছু নেই। আর যাই করি না কেন থানা থেকে তো আর ওকে ছিনিয়ে আনতে পারি না।

এক সময় হীরা বৈঠাটাকে নামিয়ে রেখে মুখ হাঁ করে দম নিতে লাগল। বেচারা অনেকক্ষণ একটানা বৈঠা বেয়েছে। সলিল কথা না বলে হীরার জায়গায় বৈঠা নিয়ে বসল! রবিন আনমনে এক হাতে দাঁড় টানছিল, টিপু নৌকার মাঝে লম্বা হয়ে শুয়ে শুয়ে কি ভাবছে। পাশ দিয়ে মস্তো বড় একটা মহাজনী নৌকা ভেসে গেল। একটু দূরে একটা জেলে নৌকা জাল গুটিয়ে তুলছে। কালো জালে চকচকে কি একটা মাছ খলবল করে উঠল।

তুই ডাকাতদের নৌকায় কি কি শুনলি আবার বল তো। হীরা রবিনের কাছে সরে আসে, তখন ঝামেলার মাঝে ঠিক শুনতে পারিনি।

হা হা বল টিপু উঠে বসে এগিয়ে আসে, তুমি কি স্পষ্ট শুনেছ ওরা শুভাপুর গ্রামে যাবে?

রবিন মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ আমি স্পষ্ট শুনেছি। ওরা কয়েকজন বলছিল শুভাপুর গ্রামের ইদরিস খাঁর বাড়ি, অন্যেরা বলছিল মেথিকান্দা গ্রামের বিলায়েৎ উদ্দিন না কি যেন লোকের বাড়ি।

তুই এত সব মনে রাখলি কেমন করে?

মনে নেই তো।

মানে?

শুধু শুভাপুর আর ইদরিস খাঁর নাম মনে আছে। অন্যগুলি বানিয়ে বললাম।

বাঃ! আমি ঠাট্টা করে বললাম, ও দুটোও বানিয়ে বললি না কেন?

খ্যাকখ্যাক করিস না রবিন হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে, ওরা তো যাবে শুভপুরে, ইদরিস খাঁর বাড়িতে! এ দুটো মনে রাখলেই তো হল, অন্যগুলি না মনে না রাখলে ক্ষতি কি?

কোন ক্ষতি নেই। টিপু সায় দিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু এ দুটো ঠিক শুনেছ তো?

রবিন আবার ক্ষেপে উঠল, একশবার বললাম স্পষ্ট নিজের কানে শুনেছি চাঁদ ডুবে যাবার পর শুভাপুরে ইদরিস খাঁর বাড়িতে ওরা ডাকাতি করবে, তা কেউ বিশ্বাস করবে না!

আচ্ছা বাবা আচ্ছা! বিশ্বাস করলাম। সলিল বৈঠা দিয়ে পানিতে একটা হ্যাঁচকা টান মারে, নৌকাটা একটু দুলে উঠে সবাইকে শান্ত করে দেয়।

টিপু বলল, এখন তাহলে ভেবে ভেবে একটা প্ল্যান বের করো, কিভাবে কি করা যায়।

প্ল্যানের কথা মনে হতেই সবাই নড়েচড়ে ভাবতে বসল, আর প্রায় একই সাথে সবারই মনে হল এখনও খাওয়া হয়নি, ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমরা প্ল্যানের কথা তুলে রেখে খেতে বসে গেলাম, একেকবারে দুজন করে। নৌকা থামানো উচিত হবে না। আমরা ডাকাতের নৌকার আগে পৌছুতে চাই।

.

রান্না ভালই হয়েছে তবে একটু শুকনো শুকনো লাগছিল। ডিমভাজা গুলি কাঁচা কাঁচা রয়ে গিয়েছিল, অবিশ্যি খেতে খারাপ লাগেনি। ডালটা প্রায় বাসায় রাঁধা ডালের মত হয়েছিল। আমরা খেয়ে ঢেকুর তুলে পালা করে বিশ্রাম নিতে লাগলাম। তরতর করে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। বসে থেকে বারকতক টেলিস্কোপ দিয়ে ডাকাতের নৌকাটা খুঁজে দেখলাম পাওয়া গেল না। রওনা দিয়ে থাকলেও নিশ্চয়ই কোন না কোন বাঁকের আড়ালে পড়ে আছে।

আমি বললাম, শুভাপুর পার হয়ে আসিনি তো? একটু খোঁজ নিলে হতো ওটা আর কতদূর।

দাঁড়া জেনে নিচ্ছি, বলে রবিন আশেপাশে তাকাল। কাছাকাছি কোন নৌকা নেই। রবিন নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে তীর দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা লোককে জিজ্ঞেস করল, হেই চাচা! শুভাপুর কতদূর?

উত্তর আসলো, আরো ছয়সাত খান বাঁক।

টিপু বুদ্ধি করে জিজ্ঞেস করল, বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছ৷ যাবে?

লোকটা সুর্যটাকে একনজর দেখে বলল, যাতি পারে।

আমরা লোকটাকে পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে নৌকাটাকে দ্রুত মাঝ নদীতে নিয়ে এলাম। ভাঁটার প্রবল টানে নৌকা যেন উড়ে চলল।

টিপু বলল, যদি সন্ধ্যার দিকে আমরা শুভাপুর পৌঁছাই তাহলে হাতে সময় থাকবে প্রায় ছয়ঘণ্টা।

কিভাবে?

রাত বারটার দিকে চাঁদ ডুববে। গতকালও তাই ডুবেছিল, তাই না সলিল?

হুঁ। শুক্লপক্ষ চলছে। গতকাল ষষ্ঠী ছিল।

কি বলল সেই বুঝল, আমি মাথা ঘামালাম না। বললাম, এই ছঘণ্টা আমরা কি করব?

একটা দল যাবে কাছাকাছি থানাতে পুলিশকে খবর দিতে। আরেকটা দল যাবে ডাকাতদের পিছু পিছু দরকার হলে ডাকাতদের আটকাবার জন্যে।

ইয়েস! রবিন বুকে টোকা মারল। সেটার লীডার আমি!

ইহ! হীরা মুখ বাঁকায়, দেখা যাবে।

কে কে থানাতে যাবে?

আমি না। আমি আগেই হাত তুলে না করলাম।

আমি তো লীডার, যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রবিন হাতড়ে হাতড়ে রিভলবারটা বের করে।

হীরা বলল, পুলিস দেখলে আমার ভয় করে।

সলিল বলল, আমার মোটেই ভয় করে না, কিন্তু তাই বলে মনে করিস না আমি যাব।

টিপু বলল, তাহলে? তাহলে কেউ থানাতে যাবে না?

দেখা গেল সত্যি কেউ থানাতে খবর পৌঁছে দিতে রাজি না। সবাই ডাকাতদের সাথে সাথে থাকতে চায়। শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হল লটারি করা হবে। লটারি থেকে আমি আর রবিন বাদ পড়লাম, কারণ নৌকা নিয়ে থানায় যেতে হলে আমরা দুজন একেবারে অসহায়, দুজনেরই একটি করে হাত! আমি অবিশ্যি একবারও মনে করিয়ে দিলাম না হাঁটা পথেও থানাতে যাওয়ার পথ থাকা সম্ভব, তাহলে লটারির ঝুঁকিটুকু নিতে হয়!

.

টিপু কাগজ ছিঁড়ে তাদের তিনজনের নাম লিখল। ঠিক হল যে দুজনের নাম উঠবে তারা থানাতে যাবে, বাকি জন আমাদের সাথে থাকবে।

আমি লটারি করলাম। টিপুর ভাগ্যে আমাদের সাথে থাকার সৌভাগ্য হল, হীরা আর সলিলের ভাগ্যে উঠল থানায় যাওয়া।

হীরা মুখ গোঁজ করে বসে থাকল, কিন্তু তাতে লাভ কি? লটারি হচ্ছে লটারি।। তার সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *