১০.
রীতা দরজা খুলতেই বৃষ্টি তাকে প্রায় ভেদ করে ভেতরে চলে এল। লিভিংরুম পার হয়ে সোজা একেবারে সুবীরের শোবার ঘরে। কোন দিকে তাকাল না।
শোবার ঘরের টেবিলে বসেই বোর্ড মিটিং-এর জন্য কাগজপত্র গোছাচ্ছিল সুবীর। তার বিশাল ফ্ল্যাটে দুটো পেল্লাই সাইজের বেডরুম, একটা স্টাডি, প্রকাণ্ড ডাইনিং কাম ড্রয়িং হল। বেশি রাত পর্যন্ত জরুরি কাজ না থাকলে সুবীর স্টাডিতে ঢোকে না। শোবার ঘরের টেবিল চেয়ারেই টুকটাক কাজ সেরে নেয়। বৃষ্টিকে দেখে সে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছে,
—কিরে তুই এখন? কোথ্থেকে? এ সময়?
বৃষ্টি উত্তর দিল না। স্টোনওয়াশ প্যান্টের ওপর সাদা শার্ট পরেছে, শার্টের ওপর হাতকাটা জ্যাকেট। কাঁধ পর্যন্ত চুল ফুলে ঝামর হয়ে আছে। দামি বেডকভার পাতা খাটে পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ল। দু চার সেকেন্ড। তারপর লাফিয়ে উঠে চলে গেছে ডাইনিং স্পেসে। ফ্রিজ খুলে এটা নাড়ছে, ওটা ঘাঁটছে। একের পর এক ঢাকা খুলে রান্নাকরা খাবারগুলো দেখল, শুঁকল, খোলাই রেখে দিল। বিয়ারের ভর্তি বোতলটা বার করে গালে ঠেকাচ্ছে, ঘ্রাণ নিল, মুখভঙ্গি করল বিচিত্র। আবার যথাস্থানে রেখে দিয়েছে।
সুবীরও মেয়ের পিছন পিছনই বেরিয়ে এসেছে,
—কিরে? কি খুঁজছিস্? খাবি কিছু?
রাজা প্রথমটা খেয়াল করেনি বৃষ্টিকে। তন্ময় হয়ে টিভিতে রঙিন বিজ্ঞাপন দেখছিল। এখন কাঠ হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাঁ করে দেখছে বৃষ্টির কাণ্ডকারখানা।
রীতাও দরজায় স্তব্ধ দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। সুবীরের দেখাদেখি সেও এবার কাছে এল,
—স্যান্ডউইচ খাবে? ফ্রেঞ্চ টোস্ট্ ভেজে দেব? ডিপ ফ্রিজে হ্যাম আছে, খেতে পারো।
বৃষ্টি যেন কথাটা শুনতেই পায়নি। সশব্দে ফ্রিজের দরজা বন্ধ করল। অস্থির পায়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে
—বিজয়, অ্যাই বিজয়, আমাকে কটা লুচি ভেজে দাও তো।
আদেশ দিয়েই আবার শোবার ঘরের দিকে গেল।
সুবীর টেবিলের কাগজপত্র গুটিয়ে ফেলল। এই সব দিনে তার কাজ মাথায় উঠে যায়।
বিজয় জিজ্ঞাসু চোখে দাঁড়িয়ে আছে রীতার নির্দেশের অপেক্ষায়। রীতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, —মাংস বার করে গরম করে দিস্ সঙ্গে।
শুনেই বৃষ্টি দাঁড়িয়ে পড়েছে। আবার বিজয়কে ডাকছে। এবার বেশ জোরে,
—লুচির সঙ্গে আলুভাজা। কিম্বা বেগুন ভাজা।
মেয়ের হাবভাবে সুবীর যথেষ্ট নাড়া খেয়েছে। গলাটাকে নরম রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল। মেয়ে যেন তার একটা কথাতেও না আহত বোধ করে,
—কোথ্থেকে আসছিস বল্ তো? খুব খিদে পেয়েছে বুঝি?
এ কথারও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না বৃষ্টি। সে যেন এ বাড়িতে কথা নয়, নিজস্ব কোন জরুরি কাজে এসেছে। সুবীরের ড্রয়ার এক টানে খুলে ফেলল। কি যেন খুঁজছে। হঠাৎ পেয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বার করে ফেলেছে সুবীরের ওয়ালেট্টা।
ওয়ালেট হাতে নতুন করে খাটে গিয়ে বসল।
রীতা দরজায় পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। রাজাও গুটি গুটি এসে গেছে তার পাশে। গোটা ফ্ল্যাট কয়েক মিনিটেই থমথমে।
সুবীর পরিবেশ হাল্কা করতে চাইল। মেয়ের পাশে গিয়ে বসেছে,
—রীতা, বিজয়কে তাড়াতাড়ি খেতে দিতে বলো। আমার মেয়ের ভীষণ খিদে পেয়েছে। তুমি নিজেই গিয়ে নিয়ে এসো না!
বৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, —আমার খাবার বিজয় দিয়ে যাবে।
সুবীর মেয়ের ব্যবহারে ক্রমশ স্তম্ভিত। বৃষ্টি এত অভদ্র হয়ে গেল কবে থেকে! এত অবুঝ! কেন কিছুতেই কিছু বুঝতে চাইছে না! বড় বিপন্ন বোধ করল সুবীর। সেই ভাবটুকু কাটাতেই বুঝি আদরের মেয়ের পিঠে হাত রেখেছে,
—কত টাকা লাগবে তোর?
বৃষ্টি সুবীরের হাত আস্তে করে পিঠ থেকে নামিয়ে দিল। ওয়ালেট থেকে কয়েকটা নোট বার করে নিজের ব্যাগে পুরতে গিয়েও, কি ভেবে থামল সামান্য। সরাসরি রীতার দিকে চোখ ফেলেছে,
—তিনশ নিলাম। এনি অবজেকশন্?
বলেই ওয়ালেট সুবীরের কোলে ছুড়ে দিল। রীতাকে ভেদ করে আবার বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। রীতার পাশে দাঁড়ানো রাজাকে কীট পতঙ্গের মত উপেক্ষা করে। রীতা দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরল। মাথা ঠিক রাখার চেষ্টা করছে।
বৃষ্টি ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। দু-হাতে তবলা বাজিয়ে চলেছে টেবিলে।
—কি বিজয়, হল?
বিজয় সভয়ে উঁকি মারছে। সে রান্না করে। ঝড়ের মেজাজ মর্জি বোঝ তার ক্ষমতার বাইরে।
রীতা বৃষ্টির পিছন থেকে হাত নেড়ে ইশারায় বিজয়কে বলল, —ভাল প্লেটে দিস্।
বৃষ্টি ঠিক শুনতে পেয়ে গেছে। শুনেছে? না বুঝে নিল? এ বাড়িতে এলেই ইন্দ্রিয়গুলো তার বেশি প্রখর হয়ে ওঠে। সুয়োরাণীর বখে যাওয়া রাজকন্যার মত হুকুম করল,—প্লেটে নয়। চারটে লুচি। হাতে দেবে।
অজস্র বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে টিভিতে চিত্রহার শুরু হয়েছে। গোটা ফ্ল্যাটের ভূতুড়ে নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে তুলতে একটা ছেলে একটা মেয়ের পিছনে দৌড়ে দৌড়ে গান শুরু করে দিল—ম্যায় তেরে পেয়ারমে পাগল···। মেয়েটাও সঙ্গে সঙ্গে সুর ধরছে,—ম্যায় তেরে পেয়ারমে পাগল···। বৃষ্টি কটমট করে টিভির দিকে তাকাল। পারলে যেন চোখ দিয়েই টিভির দৃশ্যটাকে ভস্ম করে দেয়। নিজের মনে বিড়বিড় করে চলেছে, ইডিয়েট বক্স। ইডিয়েট বক্স।
বিজয় পাশে এসে ডাকল,—দিদি, লুচি।
বৃষ্টি লুচি কটা ছিনিয়ে নিল। শুধু লুচিই নিল, আলুভাজা নয়। হাতে লুচি নিয়ে, গ্রিলে ঘেরা সাততলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। অফিস থেকে পাওয়া সুবীরের ফ্যাশনদুরস্ত যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটটা বড় রাস্তার ওপর। অসংখ্য গাড়ি-ঘোড়া সব সময় ছুটছে নিচ দিয়ে। অন্ধকারে দাঁড়ালে মনে হয় নিচে হাজার হাজার আলোর রশ্মি যেন চতুর্দিকে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে ক্রমাগত। বৃষ্টি নিষ্পলক তাকিয়ে রইল সেদিকে।
ফাল্গুন পড়তে না পড়তেই বাতাস শিশুর মত চঞ্চল। বৃষ্টির ফোলা চুল হাওয়ায় আরও এলোমেলো হয়ে গেল। মিনিট কয়েক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর ঘরে ফিরল। এখনও সে দাঁতে লুচি ছিড়ে চলেছে।
হাতের মুঠোয় লুচি চেপে বৃষ্টি এবার হানা দিল অ্যান্টিরুমটায়। রীতার নিজস্ব সাজঘরে। এক পলক নিজেকে দেখল আয়নায়। লিপস্টিক হাতে তুলেই ছুড়ে ফেলে দিল।
সুবীর তখনও শোবার ঘরের খাটে বসে। রীতা দরজায় নিথর। তার হাতের মুঠোয় পর্দার কোণ চেপে ধরা।
রীতাকে পাশ কাটিয়ে আবার সুবীরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল বৃষ্টি,
—কবে থেকে?
ভিড় বাসের পাদানিতে একটা পা রাখার জন্য যেভাবে অসহায় আর্তি জানায় অফিসযাত্রীরা, সুবীরের গলায় অবিকল সেই আর্তনাদ,
—একটু বোঝ্···একটু প্লিজ বোঝ্···একটা কথাও তো আমি তোকে···
সুবীরের প্রার্থনাকে আমলই দিল না বৃষ্টি। এই দৃশ্যে সে এখন অভ্যস্ত। রীতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
—তুমিই কথা দিয়েছিলে। ইউ। ইউ জাস্ট্ কান্ট্ ব্যাক্ আউট্ নাউ।
সুবীরের চোখ মেয়েকে অতিক্রম করে রীতার দিকে। রীতা ছেলেকে খামচে ধরে আছে। রাজাও আঁকড়ে ধরে রীতার আঁচল।
বৃষ্টি রীতার দিকে ফিরল। রাজাকেও এক পলক দেখে নিল। এতক্ষণে তার মুখে হাসি ফুটছে। নিষ্ঠুর কসাই-এর হাসি। হাসিতে আত্মপ্রসাদ ঝরে পড়ছে। রীতার চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই সুবীরকে বলল, —চার মাস হতে চলল। বি কুইক মাই সুইট ড্যাড্। বলেই ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে। রাজাকে আলগা ঠেলে সরিয়ে। সুবীরের দিকে একবারও না ফিরে।
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার বোতাম টিপল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে। ছুটতে ছুটতে।
গভীর রাত্রে আচমকা কোন শব্দ শুনলে অনেকক্ষণ তার রেশ কানে লেগে থাকে। সেরকমই বৃষ্টির জুতোর আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার অনেক পরেও শব্দটার রেশ কানে রয়ে গেল রীতার।
সুবীর ঘাড় ঝুলিয়ে বসেই আছে। রীতা খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর ছেলেকে নিয়ে নিজের মনে চলতে থাকা টিভির সামনে বসল। তাকিয়েই আছে শুধু। কিচ্ছু দেখছে না। তীব্র অপমানের ঝাপটায় তার সমস্ত বোধ বুঝি অসাড় হয়ে গেছে। রাজাও বুঝতে পারছে একটা কিছু ঘটে গেছে বাড়িতে। দমকা হাওয়াটা, যাকে মা বলে তার দিদি, এরকমই এসে ওলোট পালোট করে দিয়ে যায় তাদের সব কিছু। মাঝে মাঝেই। রাজা কার্যকারণগুলো সঠিক বুঝতে পারে না। এটুকুই বোঝে দিদিটা চলে যাওয়ার পর বাবা মা এভাবেই আলাদা আলাদা বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর দুজনেই জোরে জোরে ঝগড়া করে। এক সময় মা গিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে থাকে। বাবা চুপ করে বসে থাকে ব্যালকনিতে।
সুবীর উঠে এসেছে ঘর থেকে। রীতার পাশে এসে বসল। রাজাকে আঁকড়ে ধরে বাঘিনীর মত বসে আছে রীতা। সুবীরের আচমকা নিজেকে ভীষণ বিচ্ছিন্ন মনে হল। সম্পূর্ণ একা। উত্তাল সমুদ্রে কম্পাসবিহীন দিক্-ভ্রান্ত জাহাজের মতো। সামনে ডুবো পাহাড়। নিজের মনে বিড় বিড় করে উঠল,
—কী যে হল মেয়েটার! ···কেন যে এরকম করছে!···এত বুঝদার ছিল···কত শান্ত···
রীতা ঘাড় ঘুরিয়ে সুবীরকে দেখে নিল। তারপর হিম গলায় কাজের লোকটাকে ডাকল,
—বিজয়, রাজার খাবার দিয়ে দাও।
বিজয় কিচেনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য দিন সে নিজে নিজেই রাজার রাতের খাবার তৈরি করে। শুধু যেসব দিন তার বাবুর আগের পক্ষের এই মেয়েটা এসে তুফান তুলে দিয়ে যায়, সে সব দিনে সে কাজের দিশা হারিয়ে ফেলে। কী তিরিক্ষি মেজাজ যে মেয়েটার! তার দাপুটে বৌদি পর্যন্ত ভয়ে জুজু হয়ে যায়। আগে মেয়েটা তো আসতই না। ন মাসে ছ মাসে যাও বা আসত তাও বাবার সঙ্গে। কাঠ কাঠ বসে থাকত। শান্তশিষ্ট। দুঃখী দুঃখী। একদম চুপচাপ। দেখে বিজয়ের মায়া লাগত। হঠাৎই মেয়েটার মূর্তি একেবারে উল্টে গেছে।
বিজয় মাথা চুলকোল, —রাজার জন্য চিকেন সুপ করব?
—করো।
সুবীর পর পর সিগারেট খেয়ে চলেছে। হাতের আঙুলগুলো মৃদু কাঁপছে। আজকাল সামান্য মানসিক উত্তেজনাতেও এই এক নতুন উপসর্গ হয়েছে তার। ফরিদাবাদ ট্যুরে একদিন বিশ্রীরকম মাথাও ঘুরে গিয়েছিল। হাইপার টেনশন। ডাক্তার তাকে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে বলেছে। পারলে মদও। আরও বলেছে মান্থলি চেক আপ্ মাস্ট্।
রীতা উঠে টিভি বন্ধ করে দিল। সুবীরের অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল তাতে। টিভির অর্থহীন শব্দগুলো তাও এতক্ষণ একটা পর্দা তুলে রেখেছিল দুজনের মাঝখানে। সেটা সরে যেতেই সুবীর রীতা মুখোমুখি।
সুবীর লক্ষ করল রীতার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। এসব সময়ে কি করা উচিত সেটা সুবীর আজও রপ্ত করতে পারেনি। শেষের দিকে জয়া বলত,—স্যাডিস্ট। কাছের লোকের চোখের জল দেখে তুমি আনন্দ পাও। ভীষণ ব্রুট তুমি।
সুবীর নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলে উঠল,
—বৃষ্টিটা একেবারে পাগল হয়ে গেছে।
—পাগল হয়েছে? না আদর দিয়ে তোমরাই পাগল করে তুলেছ? রীতা ঝপ করে বলে উঠেছে।
সুবীর দুহাতে চুল খামচে ধরল, —কি করতে পারি বলো? কি করব?
—কি করবে মানে? শাসন করতে পারো না? তুমি তো তার বাবা; সহবত শেখাতে পারো না? যখন খুশি এসে আমাকে যাচ্ছেতাই অপমান করে চলে যাবে; আমাকে সেটা হজম করে যেতে হবে?
—কি শাসন করব? এখানে এলে ঘাড় ধরে বার করে দেব?
—সে কথা আমি বলেছি কোনদিন? তার বাপের বাড়ি, সে যখন খুশি আসবে যাবে, আমি বলার কে? তা বলে বাপ হয়ে জিজ্ঞেসও করবে না মেয়ে অত মুঠো মুঠো টাকা নিয়ে কি করে? কিভাবে ওড়ায়? মায়েরও বলিহারি যাই। এদিকে এত নাম আর মেয়েটিকে যা তৈরি করেছে···ঘেন্না···ঘেন্না···
সুবীর চুপ করে গেল। বৃষ্টির মুঠো মুঠো টাকা ওড়ানোর কথাটা তারও যে মাথায় আসেনি তা নয়। না দিয়ে তার উপায়ই বা কি! বাবা হয়ে কিছু তো দিতে হবে মেয়েকে। মেয়ে ঘুষ ভাবলেও। রীতাকে তো সে বলতে পারে না এই মেয়ে পৃথিবীতে এসেছে তারই ইচ্ছায়, বলতে পারে না এই মেয়েই তার বুকে বিব বিব বেজে চলে অনুক্ষণ। ভেবেছিল এই মেয়েকে দিয়েই বেঁধে ফেলা যাবে জয়াকে। বাঁধা তো গেলই না, মেয়েও ছিটকে গেল কক্ষ থেকে। এইরকম এক নির্বোধ মানুষের আবার সংসার করতে চাওয়ার ইচ্ছাটাকে একটা কুৎসিত নিটোল ঠাট্টা ছাড়া আর কিই বা মনে হতে পারে? সেই ঠাট্টাটাই বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি।
রীতা বলল, —আমার কথা নয় ছেড়েই দাও, ওইটুকু বাচ্চাটার সঙ্গে কিরকম ব্যবহারটা করে লক্ষ করেছ? চিন্তা করে দেখেছ ওই শিশুটার মনে কি রিঅ্যাক্শন হতে পারে? তোমাদের জন্য রাজাকে ভুগতে হবে কেন?
দমবন্ধ করা কষ্টের মধ্যেও সুবীরের হাসি পায়। গোটা নাটকে এখন একটাই ভিলেন। সে নিজে। রীতা দায়ী নয়, হয়ত জয়াও দায়ী নয়, বৃষ্টি দায়ী নয়, রাজা তো নয়ই। এখন শুধু সবাই মিলে তাকে বেঁধে মারার অপেক্ষা।
সুবীর রাজাকে কাছে টানল,
—কিরে, দিদিকে দেখে তোর ভয় করে?
রাজা আধ-আধ বুলিতে বলে উঠল, —দিদি খুব লাগি।
—থাক, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। রীতা ছেলেকে টেনে নিল, —মেয়েকে নিয়ে ঢং করছ করো, আমার ছেলেকে …
রীতার গলায় জয়ার স্বর। সব মেয়েই বোধহয় এরকম পোজেসিভ। ভাবতে গিয়ে হোঁচট খেল সুবীর। সে নিজেও বা কম কিসে? জয়ার প্রত্যেকটি মুহূর্তের ওপর সে কি দাবি জানাত না? রীতার ওপরই বা কি কম অধিকার ফলিয়েছে সে? জয়া মেনে নেয়নি, রীতা মেনে নিয়েছে। এটুকুই যা তফাত। সবাই তো এক ছাঁচে গড়া হয় না। সুবীরের এক কথায় তার অফিসের রীতা ব্যানার্জি চাকরি ছাড়তে দ্বিধা করেনি।
রীতা এখনও গজগজ করছে, —মেয়ে এসে আমাকে শাসিয়ে যায় বাবাকে নিয়ে চলে যাব, তুমি সেটা তারিয়ে তারিয়ে শোন, এনজয় করো। বলতে পর্যন্ত পারো না ভদ্রবাড়ির ছেলেমেয়েরা বড়দের সঙ্গে ওই আচরণ করে না।
সুবীর এতক্ষণে ধৈর্য হারাল। কোণঠাসা বেড়ালের মত ফ্যাঁস করে উঠেছে, —সব দোষ শুধু বৃষ্টিরই—না? মনে রেখো, এক হাতে তালি বাজে না। তোমার ত্রুটি নেই? মেয়েটা যে সেই তেরো চোদ্দ বয়স থেকে কোনদিন তোমাকে আপন বলে ভাবতে পারেনি তার সবটাই ওর দোষ? তুমি কতটা চেষ্টা করেছ? তুমিও তো ওকে রাইভাল ভাবো, ভাবো না?
সুবীরের কথার আঘাতে রীতা স্তব্ধ। সুবীর থামল না, —তুমিও তো ভেবেছিলে লাক্সারি বাসে বেড়াতে গেলে পাশে যে কোপ্যাসেঞ্জারটা বসে থাকে, বৃষ্টিও সেরকমই কেউ একজন। আছে থাকুক, না থাকলে আরও ভাল হত। আরও আরামের হত যাত্রাটা। জীবনটা। ভাবোনি?
অপ্রিয় সত্য হঠাৎ হাটের মাঝে এসে পড়লে সম্পর্কগুলো অনেক উলঙ্গ হয়ে যায়। রীতা কেঁদে ফেলল।
সুবীর আরও কিছুক্ষণ নির্বাক বসে থাকার পর উঠে এসেছে ব্যালকনিতে। বেতের চেয়ার টেনে বসে পড়ল পার্ক স্ট্রিটের পুরনো কবরখানার নার্সারি থেকে কিনে আনা অ্যারেলিয়া গাছটার পাশে। এক সময় জয়া তাকে গাছের নেশা ধরিয়েছিল। নেশার আনন্দ চলে গেলেও অভ্যাসটা রয়ে গেছে।
রাত্রিতে গাছে হাত দিতে নেই, তবু সুবীর বাহারি পাতাগুলোতে আলতো হাত বোলাল। রেগে গেলে সে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। রীতাকে নির্মমভাবে কথাগুলো বলে ফেলে খারাপ লাগছিল তার। যেমনই হক, তর চরম নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে এই রীতাই তো পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। একদিনের জন্যও তার কোন কাজের প্রতিবাদ করেনি। মনে যাই থাক, রীতা কখনও সামান্যতম দুর্ব্যবহারও করেনি বৃষ্টির সঙ্গে। মনের ওপর তো হাত চলে না। কোন মানুষ সম্পূর্ণ রিপুমুক্ত হতে পারে!
সুবীর আবার সিগারেট ধরাল। আঙুলের ফাঁকে জলন্ত সিগারেট টিপটিপ কাঁপছে। এত কাঁপছে কেন! তবে কি তার বাবার মত তারও পার্কিন্সনস্ ডিজিজ্ আসছে!
সুবীরের বাবার অসুখটা ইদানীং বেড়েছে। হাত পার সঙ্গে মাথা পর্যন্ত কাঁপে। কদিন আগে স্পেশালিস্ট নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে এনেছিল সুবীর।
সুবীরের শরীর শিরশির করে উঠল। অসুখটা বংশগত।
জয়া বলত, ন্যায়রত্ন লেনের গাছকে টালিগঞ্জের টবে এনে পুঁতলেই কি তার চরিত্র বদলে যায়? গাছ সেই গাছই থাকে। শুধু ফুল ফল হয় না। উপড়োনো শিকড় নিয়ে শুকিয়ে মরে তাড়াতাড়ি।
তবে কি চাইলেও রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না? একেই কি নিয়তি বলে?
ফরিদাবাদের চক্করটা মাথায় ফিরে ফিরে আসছে। ডাক্তারের কথা মনে পড়ল, চেক আপ ইজ্ মাস্ট। কি চেক করবে সুবীর? শরীর? সময়? সম্পর্ক?
নিজের অজান্তেই কাচের শোকেস থেকে স্কচের বোতলটা বার করে সোফায় এসে বসেছে। সোনালি তরল টিলটিল দুলছে বোতলে। জয়া বোধহয় আবার জিতে গেল। ভাঙাচোরা দুর্গন্ধময় সরু ন্যায়রত্ন লেনের গলিটাই রয়ে গেছে তার শরীরে।
গ্লাসে অনেকটা হুইস্কি ঢালল সুবীর।
.
১১.
ক্লাস থেকে স্টাফরুমে ফিরছিল জয়া। টানা চারটে ক্লাস নেওয়ার পর সে বেশ ক্লান্ত, তবু এখখুনি তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে কলকাতা তিনশ’র ওপর এগজিবিশন ওপেন হচ্ছে, প্রথম দিন তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া দরকার।
করিডোরে আসতেই জয়াকে একটি মেয়ে বলল, —দিদি, আপনার জন্য একজন নিচে অপেক্ষা করছেন।
এই সময় আবার কে এল! তাদের পেন্টারস্ সার্কেলের কেউ! তারা এলে তো ওপরের স্টাফরুমেই চলে আসত!
ছাত্রীটিকে জিজ্ঞাসা করল, —কে? কি নাম?
—তা তো ঠিক বলতে পারব না। ভেতরে আসতে বললাম, উনি বললেন আপনাকেই ডেকে দিতে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
জয়া অল্প ধন্দে পড়ে গেল। যাক গে, যেই হোক, বেরোনোর সময় কথা বলে নেওয়া যাবে। তার আগে একবার চোখে মুখে জল দিয়ে নেওয়া যাক্।
বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল জয়া। এখনও যে কোন এগজিবিশান শুরু হওয়ার দিন তার বুক কাঁপে অথচ জয়া ভালই জানে তার কোন ছবির তেমন নিন্দে কেউ করবে না। বড় জোর দু একটা নিয়মমাফিক খোঁচা … ফেসের কনট্যুরে ভাঙচুর চোখ ভরালেও পুরোপুরি মন ভরাতে পারেনি। অথবা নীল সবুজ অদৃশ্য হয়ে ধূসর হলুদের প্রাধান্য ছবির আবেদন ঈষৎ ক্ষুন্ন করেছে বলেই মনে হয়। কিম্বা অ্যাক্রাইলিক ছেড়ে গোয়াশে আঁকা দ্যুতিময় নিসর্গদৃশ্য আমাদের যতটা আকৃষ্ট করে, ততটা মুগ্ধ করে না। খয়েরি রঙের ব্যবহার সেভাবে গভীর ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠতে পারেনি।
ফিরোজ বলে, —নন-প্রোডাক্টিভ্ এক্সারসাইজ অফ ইন্টেলেক্ট বাই নন্ ইনটেলেক্চুয়ালস্।
শ্যামাদাস বলে, —নন্ইন্টেলেকচুয়ালস্? না সোকলড্ ইন্টেলেকচুয়ালস্?
—একই হল। যার নাম চালভাজা, তারই নাম মুড়ি।
জয়া প্রতিবাদ করে, —বারে, ক্রিটিক্রা তাদের মতামত জানাবে না?
নিখিল বলে, —সে তো তুই বলবিই। তোর যা র্যাপো ওদের সঙ্গে।
মনে মনে রাগ করলেও জয়া প্রকাশ করে না। যে যাই বলুক টেনশানটা তার থাকেই। আজকের প্রদর্শনী নিয়েও তার দুশ্চিন্তা কম নয়।
জয়াদের পেন্টারস্ সার্কেলের শিল্পীদের প্রত্যেকের দুখানা করে ছবি নিয়ে কলকাতা তিনশ’ উপলক্ষে বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে আর্টস ফোরাম। অন্য সব খ্যাতিমানদের পাশে তার ছবির কতখানি কদর হবে সে সম্পর্কে জয়া কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিল না।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে দুটো ছবি বেছেছে সে। একটা ছবিতে বাবু কাল্চারের ট্র্যাজেডি। কয়েকজন লোক উজ্জ্বল আলো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আলোর নিচে তাদের শরীরেই অন্ধকার। আলোর মধ্যে ফোটাতে চেয়েছে কলকাতার বাবুদের চেহারা। অন্ধকারটাও তাদেরই। দ্বিতীয় ছবিতে মাঝরাত্রে ভিক্টোরিয়ার পরী নেমে এসেছে কলকাতার ফুটপাথে, এক ভিখারির সংসারে। একটা চারকোল ড্রয়িং করারও ইচ্ছা ছিল; হল না। সুহাস আর শ্যামাদাসও ভিক্টোরিয়ার ওপর কাজ করেছে। মিশ্র রঙে। ফিরোজ সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রায় মুছে যাওয়া আলোয় গঙ্গার পাড়ে বাঁধা নৌকোগুলোকে ধরতে চেয়েছে জলরঙে। মূলত বাদামিতে। নিখিল শিপ্রা দেবযানী অ্যাক্রাইলিকে কাজ করেছে। নিখিল এঁকেছে ভোরের কলকাতায় জ্যামিতিক ট্রাম। দেবযানীর কলকাতায় মেট্রো রেল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক বেরিয়ে আসছে। ইমপ্রেশনিস্ট টাচে।
ব্যাগ গুছিয়ে নীচে নেমে এল জয়া। গেটের দিকে যেতে গিয়েও হঠাৎ নিথর। গেটের কাছে সুবীর না! সুবীর! কয়েক মুহূর্তের জন্য সমস্ত চিন্তা ভাবনা তালগোল পাকিয়ে গেল জয়ার। এত দিন পর সুবীর! তার কলেজে!
জয়া এগোতে চেষ্টা করল। পা দুটো নড়তে চাইছে না। সুবীর নিজেই এগিয়ে এল। কোনরকম ভূমিকা না করেই বলল,
—তোমার সঙ্গে দরকারি কথা ছিল।
সুবীর কত বদলে গেছে! প্রচুর ভাঙচুর এসেছে শরীরে। সামনের ঘন চুল পাতলা। মাথা জুড়ে রূপালি সুতোর আঁকিবুঁকি। দীর্ঘ শরীর একটু ঝুঁকে গেছে। কপালে স্পষ্ট দুটো ভাঁজ। শেষ কবে সুবীরকে দেখেছিল জয়া! পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে … প্রায় বছর চার পাঁচ আগে। জয়াকে দেখে অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল সুবীর।
জয়ার গলায় স্বর ফুটল না।
সুবীর আবার বলল, —দরকারটা খুব আরজেন্ট। তুমি একটু সময় দিতে পারবে?
সুবীরের গলা ভারী ভারী। ভাঙাও। বোধহয় মদ খাওয়া বাড়িয়েছে।
—এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবে? ওদিকে একটু চলো আমার সঙ্গে।
—কোথায়?
—মিউজিয়ামের ওপাশটায়।
দুজনে বহুকাল পর পাশাপাশি হাঁটছে। বহুকাল আগে এভাবেই হাঁটত পাশাপাশি। এই মিউজিয়ামের সামনে দিয়েই। তখন জয়া ছিল এই কলেজেরই ছাত্রী। সেদিনকার হাঁটা আর আজকের হাঁটার মাঝখানে বিশাল একটা দেওয়াল উঠে গেছে। সময়ের। সময় কত কিছু নিয়ে চলে যায়। শুধু কি নিয়েই যায়? রাখে না কিছুই? জয়া বুঝতে পারছিল না। এই মানুষটা তার শরীর মন সংপৃক্ত করে রেখেছিল বহুদিন। কত প্রেম, কত যুদ্ধ, আনন্দ, বিষাদ। …এই মানুষটাই নিষ্ঠুরের মত তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল একদিন। হিংসায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। কেন এমন হয়? আজ যাকে মনে হয় ভালবাসি কাল সে অসহ্য হয়ে পড়ে? তবে কি মানুষ নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই ভালবাসে না? অন্যকে ভালবাসা শুধুই ভ্রান্তি?
সদর স্ট্রিটের গির্জার সামনে সুবীর গাড়ি পার্ক করেছিল। সেখানে গিয়ে দাঁড়াল দুজনে।
সুবীর সোজাসুজি কথা পাড়ল,
—বৃষ্টিকে নিয়ে তোমার সঙ্গে কিছু আলোচনা করার ছিল।
জয়া মুহূর্তে সচকিত। আবেগ নিমেষে উধাও।
—কেন? কি হয়েছে বৃষ্টির?
—বৃষ্টি আমার সঙ্গে থাকতে চায়। খুব জেদ করছে। তুমি জান সেকথা? সুবীরের স্বর নয়, যেন সপাং করে একটা চাবুক আছড়ে পড়ল বুকে। জয়ার মুখ থেকে আপনাআপনি ছিটকে এল,
—মানে?
—মানে তো সহজ। ও আমার সঙ্গে থাকতে চায়। রীতা রাজার সঙ্গে নয়। শুধু আমার সঙ্গে।
শব্দগুলো গ্রহণ করতে জয়ার মস্তিষ্ক বেশ কিছুক্ষণ সময় নিল। মেয়ের পরিবর্তন লক্ষ করলেও ঠিক এতটা আশা করতে পারেনি। সেদিনের দৃশ্যটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেদিনের সেই পা দোলানো …! কানে ওয়াকম্যান্ …! এখন মনে হচ্ছে সেদিনই মেয়েকে শাসন করা উচিত ছিল। দিনের পর দিন মেয়ে বাড়ি ফিরতে আটটা নটা বাজিয়ে দিয়েছে আর সে বসে থেকেছে নিজের অভিমান নিয়ে। হায়রে, এই হিংস্র ক্রূর পৃথিবীতে কে কার অভিমানের খবর রাখে! জয়া বুকে একটা ভারী চাপ অনুভব করল।
—কবে থেকে এসব প্ল্যান শুরু করেছে?
স্থির থাকার চেষ্টা সত্ত্বেও জয়ার গলা কেঁপে গেছে।
—জন্মদিনের দিনই প্রথম বলেছিল আমাকে। ও অ্যাডাল্ট হয়ে গেছে, আর কারুর কাস্টডিতে থাকতে বাধ্য নয়, যার সঙ্গে যেভাবে খুশি থাকবে।
অভিমান থেকে অপমানবোধ সঞ্চারিত হচ্ছে মনে। জয়া ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল
—আমি কি করতে পারি এখানে? আমাকে বলতেই বা এসেছ কেন? থাকুক যেভাবে খুশি।
—তুমি আমার কথাটা বুঝছ না। ও আমাকে নিয়ে একদম আলাদা থাকতে চায়। একদম আলাদা। রীতা রাজাও নয়। তুমি বুঝতে পারছ কথার মানেটা?
জয়ার বুকের ভেতরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। হঠাৎ কোন তীব্র আঘাত পেলে বেশ খানিকক্ষণ স্নায়ু অসাড় হয়ে যায়। সেই অসাড়ভাব একধরনের নিরাসক্তি এনে দেয় মনে। চিন্তা নৈর্ব্যক্তিক হয়ে পড়ে। জয়ারও ঠিক সেরকমই হল। পরিস্থিতি তবে এই। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে তার বাবার সঙ্গে থাকতে চায়। বাবার অন্য স্ত্রী পুত্র আছে। মেয়ে বাবার সেই স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে থাকবে না। এখানে জয়ার ভূমিকা কি?
—সো? আমি কি করতে পারি?
জয়া নির্বিকার। কঠিন। মনের তোলপাড়ের টুটি নিজেই চেপে ধরে রেখেছে।
—তুমি জানোই তো বৃষ্টিকে আমি কত ভালবাসি। ও যখন আমার কাছে এসে থাকতে চাইছে … আমার কি হেল্পলেস অবস্থা …
নিরাসক্ত জয়া এবার কলে আটকে পড়া ইঁদুর দেখছে সামনে।
—মেয়েকে নিয়ে থাকতে চাইলে আবার ডিভোর্স করো। তারপর আবার সপ্তাহে একদিন করে ছেলেকে দেখে আসবে।
—এটা তুমি রাগের কথা বলছ। বৃষ্টিকে নিয়ে কি করা যায় তাই নিয়ে আমি তোমার কাছে সাজেশান চাইতে এসেছি।
—আমি বৃষ্টিকে নিয়ে তোমার সঙ্গে একটি কথাও বলতে রাজি নই। কোর্ট আমাকেই কাস্টডি দিয়েছিল, আমার দায়িত্ব ছিল, আছেও। কি করতে হবে না হবে আমি বুঝব।
কথাগুলো কেটে কেটে উচ্চারণ করল জয়া। মনে মনে বলল, ডিভোর্সের পর বিয়ে করার সময় মেয়েকে ভালবাসার কথা মনে ছিল না?
এতক্ষণে সুবীরও ধৈর্য হারাল,
—দায়িত্ব দেখিও না। মেয়ের কতটুকু খবর রাখো তুমি? কি করে বেড়াচ্ছে জানো? আমি তোমার কাছে এমনি এমনি এসেছি? বৃষ্টি প্রায়ই এসে আমার বাড়িতে উল্টোপাল্টা চেঁচামিচি করছে, যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে সবার সঙ্গে, রীতার মুখের ওপর ফস্ করে সিগারেট ধরাচ্ছে, একদিন মদ খেয়ে … ও মদ খায় সেটা তুমি জান?
সামনে থেকে এখখুনি মিউজিয়ামটা অদৃশ্য হয়ে গেলেও জয়া বুঝি এত স্তম্ভিত হত না। এই কদিন আগেও যে মেয়ে তারই শরীরের অংশ ছিল, একটু একটু করে হামাগুড়ি দেওয়া থেকে চোখের সামনে আঠেরোয় পৌছল, সেই মেয়ে মদ খেয়ে …! সুবীরের বাড়িতে গিয়ে হল্লা করছে!
—আমি বিশ্বাস করি না। সেভাবে আমি আমার মেয়েকে মানুষ করিনি।
—সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সুবীর হাত ওল্টালো। ‘আমার মেয়ে’ শব্দ দুটো তার কানে ঠক করে বেজেছে, —এই তো সেই মানুষ করার নমুনা!
জয়ার গলা অল্প চড়ল— অমানুষ হয়ে থাকলে তোমার প্রশ্রয়েই হয়েছে। আমাকে জব্দ করার জন্য দামি দামি জিনিস দিয়ে অভ্যেস খারাপ করে দিয়েছ মেয়ের। টেপ চাইলে টেপ, ওয়াকম্যান চাইলে ওয়াকম্যান, জামাকাপড়ের কথা তো বাদই দিলাম। সপ্তাহে একদিন মেয়েকে দেখার নাম করে আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা। এতদিন পর যেই নিজের স্বার্থে ঘা পড়েছে, ওমনি…
সুবীর মাথা নিচু করল। হয়ত জয়া ঠিকই বলছে। মেয়েকে দামি জিনিস দেওয়ার পিছনে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতার অনুভূতি ছিল না তা নয়। কিন্তু সত্যি সত্যি দিতেও তো ইচ্ছাও করত তার। খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করত মেয়েটাকে। আবার সেই মেয়ে যখন সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিতে চায়…।
একটা ইচ্ছার সঙ্গে আরেকটা ইচ্ছা কেন যে ঠিকঠাক মিলতে চায় না! দুটো চাওয়া যদি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে তবে মাঝের মানুষটা শুধুই পুড়তে থাকে। এ এক অসহায় দহন।
সুবীর প্রাণপণে নিজের গলা নরম রাখতে চাইল,
—জয়া, আমি তোমার সাহায্য চাইতে এসেছি। এ অবস্থায় আমরা কি করতে পারি? আমরা? বৃষ্টির মা বাবা?
জয়াও নিজেকে শান্ত করল। বুকের মধ্যে ঝোড়ো বাতাস তবু বয়েই চলেছে।
—ঠিক আছে, আমি দেখছি যাতে বৃষ্টি অন্য কারুর সংসারে অশান্তির সৃষ্টি না করে।
‘অন্য কারুর’ শব্দ দুটো কি বেশি জোর দিয়ে বলল জয়া? অন্য কেউ কে? সুবীর? নাকি রীতা, রাজা? সুবীর বুঝতে পারল না।
গাড়িতে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসেছে। স্টার্ট দেওয়ার আগে ভদ্রতা করল,
—কোন দিকে যাবে?
এখন কোন দিকে যে যাবে জয়া?
—তুমি যাও, আমার কাজ আছে।
সূর্য হেলে পড়েছে ময়দানের দিকে। প্রথম বিকেলের সাদাটে সূর্য। ক্রমশ তাপ ফুরিয়ে আসছে। তবু শেষবারের মত ভাস্বর। জয়ার মুখেও সেই পড়ন্ত বেলার রোদ। উল্টোদিকের ফুটপাথে ভিখারি পরিবারের শিশুরা উদ্দাম ছোটাছুটি করে চলেছে। রাস্তায় অবিশ্রান্ত পথচারীদের আসা যাওয়া। চৌরঙ্গিপাড়া নিজস্ব নিয়মে শব্দময়।
এত আলো এত শব্দ সবই নিষ্প্রভ হয়ে গেছে জয়ার কাছে। শরীরটা টেনে টেনে চলার চেষ্টা করল। কখনও কখনও নিজেরই শরীর নিজের কাছে এমন ভারী হয়ে যায়! কলেজের গেটের সামনে এসে দাঁড়াল একটুক্ষণ। এগজিবিশনে যাওয়ার আর স্পৃহা নেই। কি করবে এখন? কোথায় যাবে? হাত তুলে একটা ট্যাক্সি থামাল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার মুখ বাড়িয়েছে, —কোথায় যাবেন?
দু এক মুহূর্ত মাথাতেই এল না কিছু। মাথা সম্পূর্ণ ফাঁকা। ঠোঁট দুটো শুধু নিজে থেকে বলে উঠল,
—দেশপ্রিয় পার্ক।
সমস্ত অভিমান, অপমান ক্রোধ হয়ে আছড়ে পড়ল কলিংবেলে।
সুধা দরজা খুলেছে।
—ব্যাপারটা কি? এতক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছি …
—ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছ না? এই আওয়াজের মধ্যে শোনা যায় কিছু? একদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেই ঝড় তুলে দিয়েছে।
এতক্ষণে জয়ার মস্তিষ্কে ঢুকেছে। উন্মত্ত হেভি মেটাল চলছে বাড়িতে। বাজনার তোড়ে গোটা বাড়ি থর থর।
কাঁধের ব্যাগ ডাইনিং টেবিলের দিকে ছুড়ে দিয়ে জয়া মেয়ের ঘরে ঢুকেছে। উৎকট ধোঁয়ার গন্ধে ঘরটা ভরপুর। বৃষ্টির হাতে সিগারেট। দুটো পা দেওয়ালে তুলে মেয়ে চোখ বুজে অশোভন ভঙ্গিতে শুয়ে। বাজনা শুনছে।
জয়া স্টিরিও বন্ধ করে দিল।
বৃষ্টি তাকিয়েছে।
—সিগারেটটা ফ্যালো।
বৃষ্টি পাকা নেশাড়ুর মত জোরে জোরে টান দিল দুবার। বুকে ধোঁয়া ভর্তি করে নিল। তারপর যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছুড়ে দিল জানলার বাইরে।
—কবে থেকে এসব বাঁদরামি শুরু হয়েছে?
বৃষ্টি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না।
—কি হল শুনতে পাচ্ছ না? আমি তোমাকে বলছি। এসব কবে থেকে শুরু করেছ? নেশা—ভাং, মদ, গাঁজা …?
বৃষ্টি নিরুত্তর।
—তোমার বাবা আজ আমার কলেজে এসেছিল।
এতক্ষণে বৃষ্টির চোখে ভাষা এসেছে। বিস্ময়।
—তুমি তোমার বাবাকে গিয়ে বিরক্ত কর?
বৃষ্টি চোয়াল শক্ত করল। জয়ার দিকে তাকাচ্ছে না। চোখ দেওয়ালের ক্ষতস্থানগুলোর দিকে।
—তোমার বাবা বলছিল তুমি নাকি ড্রিঙ্ক করে ও বাড়িতে যাও?
বৃষ্টি তবু চুপ। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। মুখ করমচার মত টকটকে লাল।
—তোমার বাবা বলছিল …
—তুমি আমার সম্পর্কে বাবার সঙ্গে কথা বলার কে?
আগ্নেয়গিরির মুখ খুলেছে।
—তোমার মা-বাবা তোমাকে নিয়ে সব সময় কথা বলতে পারে।
—মা? বাবা? কে তারা? বাবা বউ বাচ্চা নিয়ে আরামে সংসার করছে; মা শিল্পের সাধনায় জীবন উৎসর্গ করেছে। নিজেরা নিজেদের মত ফুর্তি করো গে যাও, আমাকে আমার মত থাকতে দাও।
—আমার সঙ্গে এইভাবে কথা বলছিস তুই? আমি ফুর্তি করি? একটা ছবি আঁকার পেছনে কত যন্ত্রণা, কত নিষ্ঠা …
—বেশি যন্ত্রণা ফন্ত্রণা দেখিও না। এসব যন্ত্রণা নিষ্ঠার কথা আমাকে জন্ম দেওয়ার সময় মনে ছিল না?
চিৎকার শুনে বাবলু হুইল চেয়ার ঠেলে দরজায় এসেছে,
—হচ্ছেটা কি এখানে? অ্যাই বৃষ্টি চুপ কর।
—কেন চুপ করব? আমাকে নিয়ে ঢং দেখিয়ে দুজনে আলোচনা করছে!
—মার সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলছিস?
—মা দেখিও না। মাকে মার মত হতে হয়। বাবাকে বাবার মত।
মেয়ের মূর্তি দেখে জয়া বিমূঢ়। এই মেয়ের জন্য দিনের পর দিন মামলা লড়েছিল সে! এই পরিণতি দেখার জন্য বড় করেছে! মেয়ে মার দিকে আঙুল তুলে জবাব চাইছে! এই সেই শান্ত বিনীত বৃষ্টি! চোখে জল এসে যাচ্ছিল, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে কোনরকমে সামলালো জয়া,
—তুই বাবার কাছে গিয়ে থাকতে চাস? বাবার সংসারে অশান্তি শুরু করেছিস? রীতাআন্টিকে অপমান করিস এত স্পর্ধা তোর? এই শিক্ষা পেয়েছিস ছোটবেলা থেকে?
—শিক্ষা দেওয়ার তোমার সময় ছিল? আমার যা ইচ্ছে তাই করব। যা খুশি তাই করব। আমার আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেছে। তোমার গার্জেনগিরির পরোয়া করি না আমি।
—বেরিয়ে যা। এখখুনি বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে। বদমাইশ মেয়ে কোথাকার।
—কেন? বেরোব কেন অ্যাঁ? জন্ম যখন দিয়েই ফেলেছ তখন বেরিয়ে যা বললেই হবে? জন্মে যখন গেছিই যা চাইব তাই দিতে হবে। যেভাবে চাইব সেভাবে। হয় তুমি দেবে, নয় বাবা।
জয়ার সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল। ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেয়ের ওপর। চুলের মুঠি ধরে সপাটে চড় মেরেছে মেয়ের গালে। মেরেই চলেছে।
সুধা দুহাতে চেপে ধরে বাইরে টেনে আনল জয়াকে।
চড় খেয়ে বৃষ্টি কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব। এই তার জীবনের প্রথম মার খাওয়া। বাবলুও দরজার সামনে থেকে চলে যাওয়ার পর ঘুরে গিয়ে ব্যাগ থেকে সিগারেট বার করল। স্টিরিও চালিয়ে দিল ফুল ভল্যুমে। ম্যাডোনা তারস্বরে চেঁচিয়ে চলেছে, পাপা ডোন্ট প্রিচ্ ….
.
১২.
মার সঙ্গে ওরকম বিশ্রী ভাষায় কথা বলার পর সারা রাত ঘুমোতে পারল না বৃষ্টি। উদ্দাম বাজনা শেষ হওয়ার পর, রাগ ঝিমিয়ে পড়ল একটু একটু করে। কেন যে ওরকম অশালীন হয়ে পড়ল! মা কি তার জন্য কম করেছে এতদিন। মা’ও তো একটা বিয়ে করে ফেলতে পারত, তা না করে এত পরিশ্রম করেছে, সে তো শুধুই তার কথা ভেবে। বৃষ্টি ঠিক করল সকালে উঠেই মার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির মত বদলে যেতে শুরু করল। অন্য বৃষ্টিটা ছায়া ফেলতে শুরু করল তার মনের ওপর। সেই বৃষ্টি একটা কথাই ভাঙা রেকর্ডের মত কানে বাজিয়ে চলেছে, বৃষ্টি, তুই কি মূর্খ। মা তোকে নিয়ে ভিন্ন হয়েছিল তোর বাবার সঙ্গে যুদ্ধে জিততে চায় বলে। পরিশ্রম শুধু মেয়ের জন্য করেনি, করেছে নিজেরই প্রতিষ্ঠা আর খ্যাতির জগৎ বিস্তার করার জন্য। যদি তোর মা তোকে সত্যিই ভালবাসত, তবে কি তোর মার দিনগুলো, সন্ধেগুলো সবই চলে যেত বন্ধু বান্ধব, ছাত্রছাত্রী, ক্যানভাসের দখলে? মনে করে দেখ, কবে তোর মা শুধু তোকে নিয়েই একটা পুরো দিন কাটিয়েছে। বৃষ্টি মন দিয়ে সেরকমই একটা দিন খোঁজার চেষ্টা করল। নেই। সত্যিই সেরকম দিনের অস্তিত্ব নেই বৃষ্টির জীবনে।
যদি সেরকম দিন না’ই থাকে, তা হলে ওই নির্লজ্জ ভদ্রমহিলা তার ওপর জোর ফলায় কোন অধিকারে? ভাবে কি করে সে’ই বৃষ্টির সমস্ত চিন্তা কৰ্ম ভূত ভবিষ্যতের নিয়ন্তা?
অনুতাপ ক্রমশ ক্ষোভে, ক্ষোভ ক্রমশ রাগে পরিণত হচ্ছিল বৃষ্টির। বাবার চেহারা মনে পড়তেই রাগ রূপ নিল আক্রোশের। বাবা কিনা শেষপর্যন্ত মরিয়া হয়ে চুকলি খেল মার কাছে? মেয়ের একটা নিষ্ঠুর ঠাট্টাকেও বরদাস্ত করার শক্তি নেই? অথচ মুখে কত বড় বড় ভালবাসার কথা! কোন স্তরে নেমে গেছে তার বাবা?
টানা তিন দিন বাড়িতে শুয়ে রইল বৃষ্টি। উৎকট দেওয়াল আর লোহার গরাদের দিকে অবিরাম তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এ বাড়িতে সে আর থাকবে না। যেখানে থাকলে প্রতিনিয়ত শুধু বিরক্তি আর ক্রোধের সঞ্চার হয়, সেখানে থাকার থেকে না থাকাই ভাল। সুবীরের বাড়িতেও সে আর জীবনে পা রাখবে না। সব থেকে ভাল হয় যদি কোথাও একটা আস্তানা জোটানো যায়। পেয়িংগেস্ট হয়ে। অথবা কোন হোস্টেল টোস্টেলে।
বৃষ্টির মনে পড়ল দাদু তার নামে কিছু টাকা ফিক্সড্ ডিপোজিট করে গিয়েছিলেন। সে এখন মাইনর নয়, ইচ্ছে করলেই সে টাকা তুলে ফেলতে পারে। যত দিন না লেখাপড়া শেষ করে চাকরি বাকরি জোগাড় করা যায় ওই টাকাতে কি কোনক্রমে চলবে না? না হয় টিউশ্যনি ধরবে গোটাকয়েক। দেবাদিত্য অনেক টিউশনি করে, নিশ্চয়ই দুচারটে জুটিয়ে দিতে পারবে তাকে।
যেদিন প্রথম বাড়ি থেকে বেরোল, সেদিনই খবরের কাগজ থেকে টুকে নিয়েছে দুটো ‘পেয়িংগেস্ট চাই’ এর ঠিকানা। একটা বেহালায়, অন্যটা ঢাকুরিয়ায়। কলেজে এসেই দেবাদিত্যকে বলল,
—আমাকে কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করে দে তো।
দেবাদিত্য হাঁ করে দেখছিল বৃষ্টিকে,
—তুই টিউশ্যনি করবি! কেন বস্, গরীবদের বাজার মারবে কেন?
—ফাজলামি নয়, আমি সিরিয়াস। আমার ভীষণ দরকার। আরজেন্ট।
—রেজিস্ট্রি ফেজিস্ট্রি করে ফেলেছিস নাকি? ছেলেটা কি মীনাক্ষির হিরোর মত? চাকরি বাকরি করে না?
বৃষ্টি খেপে গেল। মানুষের যত বিপদই হক, দেবাদিত্য কিছুতেই ঠাট্টার মোড়কের বাইরে আসতে পারবে না। এরকম বন্ধু থাকার থেকে না থাকাই ভাল। বৃষ্টি দেবাদিত্যর সঙ্গে সারাদিন আর একটি কথাও বলল না।
কলেজ থেকে বৃষ্টি তৃষিতার সঙ্গে বেরোল। বাস স্টপে এসে তৃষিতা বলল, —চল, আমাদের বাড়িতে চল। আমার এক কাকা এসেছে, নেভিতে চাকরি করে, এমন অদ্ভুত অদ্ভুত অভিজ্ঞতার গল্প বলে …
বৃষ্টি বলল, —নারে, আমার কাজ আছে।
—ছাড় তো তোর কাজ। কাজ মানে তো শুভর সেই বন্ধুটার বাড়িতে আড্ডা।
—কে বলেছে তোকে?
—শুভই বলছিল। তৃষিতা চোখ ঘোরাল, —আমি বলছি বৃষ্টি ওই রাজীব ছেলেটা কিন্তু মোটেই সুবিধের নয়, রণজয় বলছিল ওর বাবার নাকি অনেক ফিশি ব্যাপার আছে।
বৃষ্টি শুভর ওপর বিরক্ত হল। শুভ কোন কথাই কি ঘোষণা না করে থাকতে পারে না? মুখে বলল,
—তোর মামা নিশ্চয়ই কয়েকদিন থাকবে। অন্য দিন যাব, আজ সত্যিই একটা কাজ আছে।
তৃষিতা কাঁধ ঝাঁকিয়ে এসপ্ল্যানেড়-এর ট্রামে উঠে পড়ল। তৃষিতার ভাব ভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যায় সে বৃষ্টির কথা বিশ্বাস করেনি।
দুটো ঠিকানার মধ্যে ঢাকুরিয়াতেই আগে যাবে বলে ঠিক করল বৃষ্টি। ঢাকুরিয়া সে মোটামুটি চেনে, মাধ্যমিকের সময় ওখানে একটা টিউটোরিয়ালে যেত সে। তাছাড়া সুবীরের বাড়িও তো ঢাকুরিয়ার কাছেই।
ঠিকানা খুঁজে, বাড়িটা বার করতে বৃষ্টির খুব একটা সময় লাগল না। ছোট্ট দোতলা বাড়ি, সামনে অল্প ফাঁকা জায়গায় ফুলের বাগান, দেখেই বৃষ্টির বেশ পছন্দ হয়ে গেল।
কলিংবেল বাজাতে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক নেমে এসেছেন। লোহার জাল দেওয়া দরজার ওপার থেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—কাকে চাই?
—আপনি কি শশধর দত্ত? যিনি কাগজে পেয়িংগেস্টের অ্যাড্ দিয়েছিলেন?
ভদ্রলোক দরজার তালা খুলে বৃষ্টিকে ঘরে এনে বসালেন।
—কে থাকবেন? আপনি … মানে তুমি থাকবে? ডোন্ট মাইন্ড, আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড় বলে তুমি বলছি।
বৃষ্টি এরকম জেঠুসুলভ কথাবার্তা একদম সহ্য করতে পারে না, তবু শান্তভাবে বলল, —হ্যাঁ, আমিই।
—তুমি কি চাকরি করো?
—না, স্টুডেন্ট। ফার্স্ট ইয়ার।
—এখন আছ কোথায়?
—দেশপ্রিয় পার্ক।
—তোমার বাবা মা?
গোড়াতেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আঠেরো বছরের বৃষ্টি ভাবতেও পারেনি। মাস গেলে টাকা নেবে, বিনিময়ে থাকতে দেবে, এতে এত জেরার কি আছে! একটু তীক্ষ্ণ গলাতেই বৃষ্টি উল্টো প্রশ্ন করল,
—কেন বলুন তো?
—বাহ্। যাকে থাকতে দেব তার সঙ্গে ভালমত আলাপ পরিচয় করব না? বৃষ্টি এক মুহূর্ত ভেবে নিল। তারপর পরিষ্কার উচ্চারণে বলল,
—আমি দেশপ্রিয় পার্কে মার সঙ্গে থাকি। বাবা যোধপুর পার্কে। আলাদা।
ভদ্রলোক সামান্য থতমত খেলেন। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে বললেন, —ওয়েল, সে তোমাদের ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার। আমার তাতে আগ্রহ নেই। আমি শুধু দুটো ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চাই। এক, মাসে বারোশ টাকা পড়বে, তুমি দিতে পারবে? যদি পারো তোমার সোর্স অফ্ ইন্কাম কি? দুই, তোমার বাবা মার নিশ্চয়ই কোন আপত্তি নেই, আমি কি সেটা কোনভাবে কনফার্ম করতে পারি?
—বাবা মার মতামতের কি দরকার? আমি তো অ্যাডাল্ট।
ভদ্রলোক হাসলেন, —অ্যাডাল্ট হলেই কি বাবা মার সঙ্গে সব সম্পর্ক ঘুচে যায়? তাছাড়া তুমি সত্যি বলছ কিনা সেটাও তো আমাকে ভেরিফাই করতে হবে।
বৃষ্টির ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। বাসস্ট্যান্ডে এসে রাগে অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করল সে। পেয়িংগেস্ট থাকতে গেলেও বাবা মার ওপর নির্ভর করতে হবে তাকে? হোস্টেলে গেলে হয়ত ঠিকুজি কুষ্ঠিই চাইবে। একটা স্বাধীন দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের একা থাকার এতটুকু স্বাধীনতা নেই? বাবা মা তাকে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দেবে না?
বেহালার ঠিকানায় যাওয়ার সমস্ত উৎসাহ বৃষ্টি হারিয়ে ফেলল। মনেও নেই কখন চলে গেছে রাজীবদের ফ্ল্যাটে।
বৃষ্টি এ কদিনে জেনে গেছে এই ফ্ল্যাটের আড্ডায় গাঁজা মদ ছাড়াও চরস, মারিজুয়ানা, নেশার ট্যাবলেট সবই চলে। যে সব ছেলেমেয়েরা আসে, তারা সবাই প্রায় এসব নেশায় অভ্যস্ত। বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের পরিবারেই বৈভবের অভাব নেই, ফলে ছেলেবেলা থেকেই সুখ, আনন্দের অনুভূতিগুলো এদের অনেক ভোঁতা। নেশার মাধ্যমে সেই ভোঁতা অনুভূতিগুলোতেই কৃত্রিমভাবে শান দেওয়ার চেষ্টা করে সবাই। বৃষ্টি শুনেছে রাজীব কখনও কখনও বন্ধুবান্ধব নিয়ে নিষিদ্ধ ছবিরও আসর বসায়। সুদেষ্ণার কাছে ওই সব জান্তব ছবির বর্ণনা শুনেছে সে। ও ব্যাপারে বৃষ্টির কণামাত্র আগ্রহ নেই, সে যায় শুধুই নেশার তালিম নিতে।
বৃষ্টি আবার একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। রাজীবের ফ্ল্যাটটাই হবে এখন থেকে তার সন্ধেবেলার স্থায়ী ঠিকানা।
.
১৩.
ভয়ংকর ভূমিকম্পের ইঙ্গিত প্রথম টের পায় পশুপাখি, জীবজন্তুরা। হয়ত তাদের প্রাকৃতিক অসহায়তার জন্য অথবা মানসিক বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ না হওয়ার জন্য। এই অপূর্ণতা থেকেই জন্ম নেয় এক প্রখর অনুমানশক্তি। সেই অনুমানশক্তি দিয়েই বাবলু বুঝতে পারছিল জয়ার সঙ্গে বৃষ্টির সেদিনের বাগবিতণ্ডা দুর্যোগের পূর্বাভাস মাত্র। প্রকৃত দুর্যোগ সামনে আসছে। দিদি যদি একটু সময় দিত বৃষ্টির জন্য? অন্তত বাবা মা চলে যাওয়ার পর? তবে জয়াকেও সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় কি? সৃষ্টিশীলতার কিছু নিজস্ব ধর্ম আছে, সৃজনশীল মানুষ এক অর্থে স্বার্থপরও বটে। আত্মকেন্দ্রিক।
বিষুব রেখা থেকে শুরু করে দুজন মানুষ যদি দুই মেরুর দিকে হাঁটতে শুরু করে, তবে তারা কোনদিন মিললেও মিলতে পারে। কিন্তু যদি তারা পাশাপাশি দুটো রেলের লাইন ধরে হেঁটে চলে তবে তারা হাঁটতেই থাকে অনন্তকাল, মেলে না কখনই, দূরত্বও কমে না এক চুল। সুবীর আর জয়ার সম্পর্কটা সেরকমই ছিল। একই পৃথিবীতে এরকম দুজন মানুষ থাকতেই পারে কিন্তু একই ছাদের নিচে এদের স্থান হওয়া কঠিন, এক বিছানায় দুর্বিষহ। এই ধরনের নিকটতম সম্পর্কের মধ্যেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধ্বংসের বীজ লুকিয়ে থাকে। যে বিষিয়ে ওঠা সম্পর্কের থেকে বীজের আবির্ভাব, সেই সম্পর্কের ছায়া তো বীজের ওপর পড়বেই। সেই ছায়াই বোধহয় ফুটে ওঠে পরবর্তী প্রজন্মের অসন্তোষের মধ্যে দিয়ে। তাই কি বাবলুর পাশে বসে থাকা ছোট্ট মেয়েটা হঠাৎ একদিন পাল্টে যায়?
মাঝে মাঝে বাবলুর খুব অবাক লাগে। এই কি সেই বৃষ্টি, যাকে পাশে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে বারান্দায় বসে থাকত! ছোট্ট মেয়ে চুপ করে মামার হাত আঁকড়ে পড়ন্ত বিকেলে তাকিয়ে থাকত সামনের সবুজ গালচেটার দিকে! কোন শব্দ উচ্চারণ না করে তারা পরস্পরের সঙ্গে কত কথাই না বলে ফেলত। নীরবতাও কখনও কখনও শব্দের চেয়ে বেশি মুখর হয়ে ওঠে। কোন কোনদিন প্রশ্নের বান ছোটাতো মেয়েটা,
—রেড সোর্ডটেল আর গাপ্পি এত আলাদা দেখতে হয় কেন?
—ডোডো পাখি কোথায় থাকে ভালমামা?
—ক্যাঙারুদের কেন বাচ্চা বয়ে বেড়ানোর থলি থাকে পেটে? মানুষের কেন থাকে না?
—ভালমামা, তুমি এত ইতিহাস পড়ো কেন?
—পেরেন্টস ডে’তে খালি দিদা যায় কেন? দিদা কি আমার পেরেন্ট?
মেয়েটা কি হঠাৎ বদলেছে? বোধহয় হঠাৎ নয়। বাবলুর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মন বলে, এটা বদল নয়, ভাঙন। পাহাড়ের ধসের মত। পাহাড়ে ধস তো আকস্মিকভাবে নামে না, ভূমিক্ষয় শুরু হয় অনেক আগে থেকে।
জয়া মিনমিন করে,
—আমার তো কোনদিন সেভাবে চোখে পড়েনি। দিব্যি হাসিখুশি ছিল? হয়ত নিজেকে নিয়ে একটু বেশি ব্যস্ত! হয়ত একটু বেশি জেদি।
বাবলুর হাসি পায়। যারা শাসন করে তারা যে কখন শাসিতের বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়, নিজেরা জানতেও পারে না। পূর্ব ইউরোপের চেহারাটা এখন কি? পাঞ্জাব? কাশ্মীর? রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যা সত্যি সমাজের ক্ষেত্রেও তাই। পরিবার বা ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে কি করে?
বাবলু আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। এগারোটা। বৃষ্টি এখনও বাড়ি ফিরল না। আজকাল রোজই তো রাত করে ফেরে, তবে সেও বড় জোর সাড়ে নটা, দশটা। এত রাত তো হয়নি কোনদিন! গেল কোথায়! বাবলুর দুশ্চিন্তা বাড়ছে ক্রমশ। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য বাবলু একটা ম্যাগাজিন খুলল। রাত নির্জন হয়ে আসছে, ঘণ্টা বাজিয়ে শেষ ট্রামটাও বোধহয় চলে গেল। রান্নাঘরে সুধা বাসনপত্র নাড়ানাড়ি করছে, গোটা বাড়ির নিস্তব্ধতার মধ্যে সামান্য শব্দও বড় কানে লাগে।
সন্ধে থেকেই বাড়ি থমথম করে আজকাল। এতদিনকার নেশা টিভিটাকেও বাবলু আজকাল বন্ধ রাখে। মনে চাপ থাকার জন্য সময়টাকে বড় দীর্ঘ মনে হয় তার। কোন কোনদিন সুধা নিঃশব্দে বাবলুর ঘরে এসে দাঁড়ায়,
—তোমাকে খেতে দেব দাদাভাই?
বাবলু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
—দিদি কোথায়?
—ওপরে। সুধা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে, —বাড়ি ফিরে ইস্তক তো ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকে।
মাঝে মাঝে সুধা হা হুতাশ করে, —বিশ্বাস করবে না দাদাভাই, মেয়েটার ঘর থেকে কি বিচ্ছিরি গাঁজার গন্ধ বেরোয় গো। ঘরে ঢুকলেই গা গুলিয়ে বমি উঠে আসে।
—দিদি ঢোকে ও ঘরে?
—কই আর ঢোকে। রোজই তো মেয়ে না ফেরা পর্যন্ত ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে থাকে, মেয়ে ফিরলে চলে যায় ছবি আঁকার ঘরে। রাতভর হিজিবিজি টানে আর কাটে, কাঁদে বসে বসে। দিদির মত মানুষকে কখনও ওভাবে কাঁদতে দেখিনি গো!
বাবল চুপ করে থাকে। দিদির বোধহয় এ কান্নটা পাওনা ছিল। কান্না নয়, শাস্তি।
ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ রেখেই বাবলু টের পেল একটা পায়ের শব্দ প্যাসেজে ঘোরাফেরা করছে। তার দরজা অবধি এসেও ফিরে গেল। শেষ পর্যন্ত তার ঘরে ঢুকেছে।
ঘরে ঢুকেও জয়া দাঁড়িয়ে রইল বেশ খানিকক্ষণ। তারপর দ্বিধাজড়িত প্রশ্ন করল,
—তোর কাছে বৃষ্টির কোন বন্ধুর ফোন নাম্বার টাম্বার আছে? মানে অনেকে তো ফোন টোন্ করে, তুই তো মাঝে মাঝে ধরিস …
যতটা পঙ্গু তার থেকে নিজেকে দশগুণ বেশি পঙ্গু মনে হল বাবলুর। সে তো আর রাস্তায় বেরিয়ে খোঁজখবর করতে পারবে না। কারুর কোন সাহায্যেই সে আর আসবে না। সে এখন একটা ভগ্নস্তূপ, দু যুগ আগের একটা অশান্ত সময়ের স্মৃতিফলক মাত্র। নিজের শীর্ণ পায়ের দিকে তাকিয়ে ছটফট করা ছাড়া আর কিছুই তার করার নেই। অথচ কত কিছু তার হওয়ার কথা ছিল। ইন্জিনিয়ার, গ্লোব ট্রটার, বিপ্লবী। এক নিমেষের ভুলে …!
দিদির দিকে বাবলু ম্লান মুখে তাকাল,
—সুবীরদাকে একটা টেলিফোন করব? যদি ওখানে গিয়ে থাকে?
কথাটা জয়ার মাথাতে আসেনি তা নয়। যদি সত্যিই ওখানে গিয়ে থাকে, তবে সেটা জয়ার পক্ষে আরও বেশি অসম্মানজনক। মুখে বলল, —না থাক। অন্য কারুর নাম্বার থাকলে দ্যাখ।
বলেই দু এক মিনিট কি ভাবল জয়া, আবারও বলল, —ছেড়ে দে। কাকে আর রাত্তিরবেলা … কোথায় আর যাবে? মিছিমিছি অন্যদের ব্যস্ত করা।
সুধা জয়ার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে হঠাৎ হাউমাউ করে উঠল,—যেভাবে ছুটে ছুটে রাস্তা পার হয়! কোনদিকে তাকায় না! দিদি তুমি বরং একবার থানাতেই…
—এমন কিছু রাত হয়নি এখনও। সবে সাড়ে এগারোটা। এমনিতেই তো দশটা বাজায়। জয়ার গলায় হাল্কা ধমক। ধমক? না সান্ত্বনা খোঁজা?
জয়া বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এ সময়ে রাতের দিকে তাও একটু ঠাণ্ডা বাতাস ওঠে, আজ যেন পৃথিবীও দম বন্ধ করে আছে। দূরে বড় রাস্তার বাতিগুলো টিমটিম। জয়ার চোখ অনেক দূর অবধি দেখার চেষ্টা করল। কোথায় গেল মেয়েটা?
বাবলুও পিছন পিছন বাইরে এসেছে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল,
—তুই সেদিন ওকে মারধোর না করলেই পারতিস।
এ কথাটা তো জয়াই নিজেকে বলতে চেয়েছে রোজ। তবু বাবলুর মুখ থেকে শুনে ধক করে লাগল বুকে। আপনাআপনি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল,
—তুই তো সামনে ছিলি। ওভাবে অপমান করার পরও যদি কিছু না বলি…
—অপমান তো আমাকেও করে। সব সময়। আমার সামনে সিগারেট ধরিয়ে….
—তুই জানতিস বৃষ্টি সিগারেট খায়! আমাকে বলিসনি তো! কবে থেকে?
—সে অনেক দিন। মাস দুয়েক তো হবেই। ভাবলাম কি জানি এটাই হয়ত এখনকার রেওয়াজ। আমি তো আর তোদের এখনকার নিয়মকানুন জানি না। ওর বয়সী মেয়ে সিগারেট খাবে, রাত করে বাড়ি ফিরবে, ঝাং ঝাং করে বাজনা চালাবে, আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, তার মা কিছুই দেখবে না, এটাই হয়ত এখনকার কাস্টম্।
বাবলুর বাঁকা বাঁকা কথায় জয়ার মুখে কাতরভাব। এ সব কথা এখন বাবলু না বললেই পারত! ভাবতে ভাবতেই জয়ার পিঠ টানটান। বৃষ্টি ফিরছে না! ল্যান্সডাউনের দিক থেকে! হ্যাঁ, বৃষ্টিই তো।
বাবলুও দেখেছে বৃষ্টিকে।
বৃষ্টি হনহন করে হেঁটে আসছিল, সিঁড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়াল,
—সরি ভালমামা, এক বন্ধুর বাড়িতে আটকে গেলাম, ওদের ফোনটাও খারাপ।
বৃষ্টির হাঁটা অসংলগ্ন। এক হাতে বারান্দার থাম ধরে আছে, যেন সংযত করছে নিজেকে। বাবলুকে নয়, যেন বিবেকের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছে। যাত্রাদলের বিবেক। যে ঘটনার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, পাত্রপাত্রীদের ওপর যার প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা নেই, এমনই এক অকর্মণ্য অস্তিত্ব মাত্র।
বাবলু একটি কথাও জিজ্ঞাসা করল না, শুধু সে দেখছিল বৃষ্টি কিভাবে ভেতরে ঢুকতে গিয়েও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়ল। জয়াকে দেখতে পেয়েই গলা কঠিন হয়েছে,
—ডোন্ট মাইন্ড ভালমামা, এরকম আমার হবে। সামটাইম সামটাইম।
বৃষ্টির গলা কি ঈষৎ জড়ানো! বাবলু বুঝতে পারল না। শুধু বুঝতে পারল কথাটা তাকে নয়, জয়ার উদ্দেশে বলা। বাবলু এখানে যাত্রাদলের বিবেক নয়, যাত্রাদলের সঙ্।
জয়া কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারছিল না। গভীর আতঙ্ক তার ক্রোধকে ছাপিয়ে গেছে। একটা হাঁটু কাঁপানো, শিরদাঁড়া নুইয়ে দেওয়া ভয়। এই মেয়েকে সে এখন সামলাবে কি করে?
জয়া পালিয়ে যাওয়ার মত দৌড়ে চলে গেল ভেতরে। সামনে সুধা দাঁড়িয়ে। সুধার চোখেও চোখ রাখতে পারল না জয়া।
.
১৪.
কদিন ধরেই করবীর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। প্রায়ই বিকেলের দিকে ঘুসঘুসে জ্বর। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘুরে যায়। ডাক্তার বলেছেন, অ্যাকিউট্ অ্যানিমিয়া, হিমোগ্লোবিন কমে গেছে, বেশ কিছুদিন টানা বিশ্রাম নিতে হবে। সঙ্গে ওষুধ, টনিক।
ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে পিকলুর সঙ্গে মার শরীর নিয়ে আলোচনা করছিল সায়নদীপ। বেশি বয়সে চাকরিতে ঢুকে মার খুবই কষ্ট হচ্ছে। এবার সায়নের একটা কাজ জোগাড় করে ফেলা উচিত।
পিকলু বলল—তোমার খেলার কি হবে?
চৈত্র মাসের সেলের বাজার এতক্ষণ গমগম করছিল দুদিকের ফুটপাতে। পসারিরা এখন একে একে দোকান গোটাচ্ছে। সারাদিন সাংঘাতিক গুমোটের পর সন্ধ্যা থেকে আকাশ রক্তবর্ণ। সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে সায়ন উদাস,
—ক্লাবে গোপালদা বলছিলেন স্পোর্টস কোটায় রেলে চান্স পাওয়া যেতে পারে। তবে তখন আর রঞ্জিতে বেঙ্গল খেলার কোন স্কোপ্ থাকবে না।
—কেন? রেলওয়েজের হয়েও তো খেলা যায়?
—যায়। কম্পিটিশান খুব টাফ্ হয়ে যাবে। অল ইন্ডিয়া ব্যাপার তো। এমনিতেই বেঙ্গলের প্লেয়ারদের ওরা তেমন পোঁছে না।
—সেটা ঠিক। এখানে থাকলে নেক্সট্ ইয়ারে তোমার চান্স শিওর ছিল।
—চেষ্টা করলে ওখানেও চান্স করে নিতে পারব। পারতেই হবে। এখনও আমার ব্যাক্লিফ্টে গণ্ডগোল রয়ে গেছে। কিছুতেই সোজা ব্যাট নামাতে পারছি না। মন্টুদা বলছিলেন আড়াআড়ি ভাবে যদি…
আচম্বিতে দমকা হাওয়া উঠল। ধুলোর ঝড়ে নিমেষে রাস্তাঘাট ঝাপসা হয়ে গেছে। সোঁও সোঁও আওয়াজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছে ধুলোবালি। কাগজের টুকরো, শালপাতা, প্লাস্টিক ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে। চোখে মুখে সূচের মত বিঁধছে ধুলোর ঝড়! লোকজন এলোমেলো দৌড়তে শুরু করেছে। সায়ন পিকলু দুজনেই চোখ বুজে ফেলল।
ঝটকা হাওয়ার সঙ্গে আলোগুলোও নিভে গেল আচমকা। কোথাও তার-ফার ছিঁড়ল বোধহয়। তালবেতাল বাতাসে সারাদিনের গুমোট ভাব কেটে গেছে পুরোপুরি। বছরের প্রথম কালবৈশাখি এসেছে।
ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করল। আকাশচেরা আলোয় ঝলসে যাচ্ছে পথঘাট। সেই আলোতেই মেয়েটাকে দেখতে পেয়ে পিকলু সায়ন চমকে উঠেছে। অদ্ভুত বেতালা পায়ে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছে বৃষ্টি।
ঝড়ের ঝাপটায় একবার ডানদিক, একবার বাঁদিকে টলে পড়েও টাল সামলাবার চেষ্টা করছে প্রাণপণ। যেন রাস্তা নয়, ভরা বর্ষার নদী পার হতে চায় মেয়েটা।
সায়ন পিকলু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বৃষ্টি সম্পূর্ণ নেশাগ্রস্ত। অন্ধকারে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে বার বার। সায়নের গলা থেকে বেরিয়ে এল,
—একি! কি অবস্থা মেয়েটার!
পিকলু সায়নের হাত ধরে টানল। সে এ সমস্ত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে রাজি নয়। পাড়ার সবাই জানে বৃষ্টি এখন পুরো বখে গেছে।
—যেতে হবে না। যত সব ঝুট্ঝামেলা। কি ব্রাইট ছিল মেয়েটা, কি হয়ে গেল! মাল-ফাল টেনেছে বোধহয়।
সায়ন তবু এগোল পায়ে পায়ে,
—মেয়েটাকে তো দেখছি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া দরকার। এভাবে রাস্তার মাঝখানে ফেলে…
—আমি নেই। উড়ন্ত ধুলো আটকাতে পিকলু হাতে মুখ আড়াল করল, —কে যাবে বাবা আগ বাড়িয়ে? ওর যা মেজাজ!
—তাবলে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে চলে যাব?
—ছাড়ো তো, ও ঠিক পৌছে যাবে। ওস্তাদ মেয়ে। প্রায়ই তো আজকাল এই দশা হয়।
সায়ন আশ্চর্য হয়ে গেল। পিকলু না বৃষ্টির ছেলেবেলার বন্ধু! এরকম সঙ্গীন অবস্থায় কেউ বন্ধুকে ফেলে চলে যেতে পারে!
সায়ন একাই এগিয়ে গেল,
—বাড়ি যাবে তো?
বৃষ্টির ঘোরলাগা চোখ পিটপিট করে উঠল। যেন সায়নকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। বাতাসের জন্য সায়নের কথাগুলোও কানে ভাল করে পৌঁছল না তার। তার কাছে এখন সবই অস্পষ্ট। আজই সে প্রথম নেশার ট্যাবলেট খেয়েছে।
সায়নের দিকে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে বৃষ্টি স্খলিত প্রশ্ন করেছে, —আমার বাড়ি কোথায়?
ঝড় বাড়ছে। দু-চারটে বড় ফোঁটা পড়ল গায়ে। পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়ার সময় পথচারিরা থমকে দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছে সুন্দরী নেশাড়ু মেয়েটাকে।
সায়নের স্বরে ধমক এল,
—একটা কথাও নয় আর। চলো আমার সঙ্গে।
হাত ধরে টানতে টানতে মেয়েটাকে বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে চাইল সায়ন।
কয়েক পা গিয়েও বৃষ্টি দাঁড়িয়ে পড়েছে,
—আমি তোমার সঙ্গে যাব কেন?
সায়ন কোন কথা বলল না। বিকট শব্দে কাছে কোথাও বাজ পড়ল। বাতাস আরও দামাল।
বৃষ্টি গলা চড়াল,
—তুমি এখানে কেন? গুড বয়রা তো এখন মায়ের আঁচল ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। যাও, বাড়ি যাও। মিষ্টি মিষ্টি স্বপ্ন দ্যাখোগে।
বৃষ্টির একটা কথার সঙ্গে অন্য কথা মিশে যাচ্ছে। চড়া গলা ধীরে ধীরে খাদে নেমে গেল।
সায়নের কষ্ট হল মেয়েটাকে দেখে। মানুষ নিজেকে নিজে এভাবে ধ্বংস করে ফেলে কেন? ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা বাবার মুখটা দেখতে পেল সায়ন। শ্মশানের হাওয়ায় মুখ থেকে চাদর সরে গিয়েছিল একবার। একবারই। কী বীভৎস ক্ষতবিক্ষত মুখ! বর্শার খোঁচা লাগল সায়নের বুকে। মেয়েটার হাত সজোরে চেপে ধরেছে!
—কেন এভাবে নিজেকে নষ্ট করছ? তোমার মত ব্রাইট মেয়ে…
—নো লেকচার। নো সারমন। নো পুরুতগিরি। হু আর ইউ? আমার গার্জেন? আমি কোন গার্জেন-ফার্জেনের তোয়াক্কা করি না।
—আমি তোমার বন্ধু। জাস্ট এ ফ্রেন্ড্।
—হেল উইথ ইওর ফ্রেন্ডশিপ। আমি বন্ধু চাই না। আমার কেউ নেই। নো বডি। নান্। আয়াম অল অ্যালোন ইন দিস্ গ্রেট প্ল্যানেট্।
মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। ঝড়ের সঙ্গে একবার এদিকে যাচ্ছে, একবার ওদিকে। বৃষ্টিকে নিয়ে সায়ন কোনরকমে তাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌছল। তখনও বৃষ্টি অবিরাম বকবক করে চলেছে,
—আমি ভালদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করব না, আমি তোমাদের ঘেন্না করি… অল মায়ের পুতুপুতু ছেলে… ক্যাবলা ক্যাবলা… গুড়ি গুডি… ড্যাম ইউ।
ঝড়ের ঝাপটায় পার্কের ভেতরের কাঁঠালি চাঁপা গাছটার ডাল মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল।
আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বিদ্যুৎ শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই ঝলকানিতে রাত ফালা ফালা। মুহূর্তের জন্য দিনের মত আলোকিত রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি। পর মুহূর্তেই কালিমালিপ্ত।
মুহূর্তের ঝলকানিতেই তিনটে মুখ স্পষ্ট হল। বাইরের বারান্দায় ঝড়ের ঝাপ্টা মেখে জয়া সুধা নিশ্চল। বাবলু হুইলচেয়ারে স্থির।
সুধারই প্রথম সম্বিত ফিরল। হুড়মুড় করে নেমে এসেছে রাস্তায়। সায়নকে সরিয়ে, সপসপে ভেজা মেয়েটাকে দুহাতে জাপটে ধরেছে।
বৃষ্টি ভেজা কাঠের মত দাঁড়িয়ে রইল।
—যাব না। ছেড়ে দাও আমাকে।
সুধা প্রাণপণে টানছে বৃষ্টিকে। সায়ন চকিতে তাকাল জয়া আর বাবলুর দিকে। সবার মুখই আবার অন্ধকারে। এখানে তার আর দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়। লজ্জায় মিশে যাওয়া মানুষদের দেখতে ভয় পায় সায়ন।
সায়ন বাড়ির দিকে দৌড়ল।