১৩. রানুর বড় খালা সুরমা

রানুর বড় খালা সুরমা কয়েকদিন ধরে একটি ব্যাপার নিয়ে ভাবছেন। যতই ভাবছেন ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মেজাজ খারাপ হলে তার কিছু শারীরিক অসুবিধা হয়–ক্ষুধা হয় না, বুকে ধরফর করে। কদিন ধরে তাই হচ্ছে। এসব ঝামেলা থেকে মুক্তির কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। রানুকে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বললে সব সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু তা বলার জন্যে যে সাহস দরকার তা তার নেই। রানুকে বিচিত্র কারণে তিনি ভয় করেন। সে যেদিন প্রথম এসে বলল, খালা আমি কয়েকদিন তোমার এখানে থাকব। তোমার আপত্তি আছে?

তাঁর যথেষ্ট আপত্তি ছিল তবু তিনি বললেন, আপত্তি কিসের? ঘর তো খালিই পড়ে আছে। থাক যতদিন ইচ্ছা। তিনি কল্পনাও করেননি এই কথার ওপর ভর করে রানু তার ছেলেকে নিয়ে এ বাড়িতে এসে উঠে পড়বে। এবং কিছু দিন যেতে না যেতে অপলা এসে জুটবে তার সঙ্গে।

অপলা মেয়েটিকে তিনি সহাই করতে পারেন না। প্রথম দিন এসেই সে বলল খালা, ছাদের চাবিটি আমাদের কাছে দিন। আমি ছাদে খুব হাঁটাহাঁটি করি। আপনি ছাদ বন্ধ করে রাখেন কেন? তিনি ছাদ বন্ধ করে রাখেন কারণ ভাড়াটের ছেলে-মেয়েরা ছাদে উঠে বড় বিরক্ত করে। ছাদ হচ্ছে প্রেমের বৃন্দাবন। সামনের বাড়ির ছাদে তো বিরাট একটা কেলেঙ্কারিই হল। এমন কেলেঙ্কারি যে কাউকে বলার উপায় নেই। অপলাকেও বললেন না। শুধু শুকনো মুখে জানালেন চাবিটি পাচ্ছেন না। তার কিছুক্ষণ পরই নূরীর মা এসে বলল, অপলা ছাদে। সে নাকি তার ঢুকিয়ে কিভাবে তালা খুলে ফেলেছে। তালা খুলে চোর ছাঁচের, অপলা ভদ্রলোকের মেয়ে। তার এ কি কাণ্ড!

রানুকে থাকতে দিয়ে তিনি যে কি ভুল করেছেন তা মর্মে মর্মে এখন বুঝছেন। কিন্তু উপায় কি? তিনি যে সমস্ত ব্যাপারটাই এখন অপছন্দ করছেন তা আকারে-ইঙ্গিতে এখন বুঝাতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু রানু বোধ হয় বুঝেও বুঝতে চাইছে না।

সেদিন হঠাৎ কথায় কথায় বললেন, আমার টেলিফোন নাম্বার তুমি কাউকে দিও না। অচেনা মানুষদের ফোন কল আমার ধরতে ভাল লাগে না। আমি আমার ভাড়াটেদেরও নাম্বার দেই না।

রানু সহজ ভাবে বলেছে–এ নিয়ে চিন্তা করবেন না খালা, টেলিফোনে কথা বলার লোক নেই আমার। এ কথাটা ঠিক। এখন পর্যন্তও কেউ রানুকে টেলিফোন করেনি। রানু গত তিন মাসে।চার বার টেলিফোন করেছে। এটাও খারাপ না। তার প্রশংসাই করতে হয়।

সুরমা স্বীকার করেন প্রশংসা করবার মত এই মেয়ের অনেক কিছুই আছে, কিন্তু তাই বলে তিনি তাকে খামোেকা পুষিবেন কেন?

রানু চাকরি পাবার পর বাড়ি ভাড়া হিসেবে এক হাজার টাকা করে দিতে চাইল, তিনি নেননি। একবার নিতে শুরু করলে ওদের এখান থেকে সরানো মুশকিল হবে। তাছাড়া নিজের বোনের মেয়ের কাছ থেকে বাড়ি ভাড়া নেয়াটাও খারাপ দেখায়। বিশেষ করে সবাই যখন জানে রানু বিপদে পড়েছে।

সুরমা নানাভাবে নিজেকে প্রবোধ দিত্ত্বেচেষ্টা করেন। ভাবতে চান মা-বাপ মরা একটি মেয়েকে সাহায্য করছেন এবং তা বেশি দিন করতেও হবে না। সে ফিরে যাবে তার স্বামীর কাছে। একা একা কোনো মেয়ে থাকতে পারে? বিশেষ করে সেই মেয়ের যখন একটি ছেলে আছে। ছেলের কারণেই তাকে যেতে হবে। আজ হোক আর কাল হোক। জামাইকে তার কাছে খানিকটা ভোন্দা ধরনের বলে মনে হয়। মিন মিন স্বভাব। চুলের মুঠি ধরে একটা চড় দিলে এই সব মেয়ে জন্মের মত ঠিক হয়ে যায়–তা করবে না, সব সময় পুতু পুতু করবে। পুরুষ মানুষকে হতে হয় পুরুষ মানুষের মত। মাদী মার্কা পুরুষগুলির জন্যেই এত ঝামেলা।

সুরমা রোদে এসে বসলেন। মাঘ মাস শেষ হয়নি। এখনো কয়েকটা দিন আছে কিন্তু চিড়চিড়ে গরম পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ রোদে বসেই তিনি বিরক্ত হয়ে পড়লেন। উঠে গেলেন না। রোদের মধ্যে নাকি সব ভাইটামিন আছে। শরীরে যত বেশি লাগানো যায় ততই ভাল। কষ্ট হলেও লাগাতে হবে।

খালা কড়া রোদে বসে আছেন যে?

সুরমা ঘাড় ঘুরিয়ে রানুকে দেখলেন। কোন জবাব দিলেন না।

আজ একটু টগরকে রাখবেন খালা? অল্প কিছুক্ষণের জন্যে।

অফিসে যাবে?

না। আজ অফিস নেই। একটু কেনাকাটা করব।

অপলা কোথায়? অপলার কাছে রেখে যাও। এইসব পুলাপান বড় বিরক্ত করে। এটা ধরে, ওটা ধরে।

টগর বিরক্ত করবে না।

না গো মা–হাগামুতা আছে। তুমি সাথে করে নিয়ে যাও।

রানু শান্ত গলায় বলল আপনাকে বেশি বিরক্ত করব না খালা–বাড়ি ভাড়া করব। অফিসের কাছে একটা বাড়ি নেব।

ভালই তো। স্বাধীন মহিলা হওয়াটাই তো ভাল। আমরা পরাধীন ছিলাম।–স্বাধীনতার মর্ম বুঝি না। তোমরা বোঝ।

এসব কেন বলছেন খালা? ঝগড়া করতে চান নাকি?

নিজের বোনঝির সঙ্গে কি ঝগড়া করব?

ঝগড়া করতে না চাইলে টগরকে কিছুক্ষণ দেখেন। বাইরে ঘোরাঘুরি করলেই ওর শরীর খারাপ করে। টগর নানুকে বিরক্ত করবে না।

সুরমা কিছু না বলে রোদ থেকে উঠে এলেন মনে মনে রানুর প্রশংসা করলেন। অন্য কোনো মেয়ে হলে এই অবস্থায় ছেলেকে ফেলে বাজারে যেত না। সে গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে টগরকে রেখে যাওয়ায় তিনি খুশিই হলেন। এই বিশাল এক তলাটায় হ্রার খুব একা একা লাগে। নিজের মেয়েরা বিয়ের পর কোথায় কোথায় চলে গেছে। কেউ ভুলেও খোঁজ করে না। তিনি এই শূন্যপুরী পাহারা দেন। ভাড়াটেদের সঙ্গে ঝগড়া করেন। প্রতি মাসের তিন তারিখে নিজে ব্যাংকে গিয়ে পাঁচ হাজার টাকা জমা দেন। তার কাজ বলতে এইটুকুই। টগর মাঝে মধ্যে এলে তার ভালোই লাগে। যদিও এটা কাউকে বুঝতে দেন না।

টগর সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হোত ইশারা করে টগরকে ডাকলেন।

পিয়াস লাগছে নাকি রে?

টগর ভেবে পেল না হঠাৎ করে তার পিয়াস লাগবে কেন? সে মাথা নাড়ল।

পিয়াস লাগলে বল ফান্টা এনে দেব।

লাগে নাই।

লেগেছে। মুখ শুকনা।

সুরমা দু’টি ফান্টার বোতল আনালেন। তাদের দুজনের জন্যে দু’টি। তারপর শুরু করলেন ডাকাতের গল্প। খুব ছোট বেলায় নৌকা করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা ডিঙি নৌক তাদের নৌকার কাছাকাছি এসে বলল–আগুন আছে? বিড়ি ধরানির আগুন?

গল্প শুনে টগর মুগ্ধ হয়ে গেল। সে মৃদু স্বরে বলল-আরেকটা বলেন। সুরমা তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় গল্প শুরু করলেন। এই গল্পটি প্রথমটির চেয়েও ভাল–সাপের গল্প।

মিলি নিউমার্কেটে একটি বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। রানু অবাক হয়ে বলল তুমি এখানে কি করছ?

মিলি হাসি মুখে বলল, বেড়াচ্ছি।

বেড়াচ্ছি মানে— এটা বেড়াবার জায়গা নাকি? কখন এসেছ?

অনেক্ষণ আগে।

মিলি রানুর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগল। তার উৎসাহের সীমা নেই। এক সময় রানু বলল, এসো তোমাকে একটা শাড়ি কিনে দেই।

মিলি বিস্মিত হয়ে বলল, কেন আমাকে শাড়ি কিনে দেবে কেন?

বেতন পেয়েছি আজ। এসো তুমি পছন্দ কর। পাঁচশ টাকার মধ্যে। মিলি কোনো রকম আপত্তি না করে শাড়ির দোকানে ঢুকে পড়ল। প্রায় ঘণ্টাখানিক লাগিয়ে শাড়ি কিনল।

ভাবী, এখন একটা আইসক্রিম খাব।

এখন আইসক্রিম খাবে কেন? চল বাসায় চল, ভাত খাবে। ক্ষিধে লাগেনি?

লেগেছে। কিন্তু আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা হচ্ছে।

তারা আইসক্রিমের দোকানে ঢুকল। রানুর মনে হল মিলি ঠিক সুস্থ নয়। তার কথাবার্তা, আচার-আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। তবু কোথায় যেন কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। রানু বলল, তোমার শরীর এখন কেমন মিলি?

ভাল।

তোমার বাচা কেমন আছে?

জানি না।

জানি না মানে?

আমার শাশুড়ি তাকে নিয়ে গেছেন।

কোথায় নিয়ে গেছেন?

ময়মনসিংহে। ওদের বাড়িতে।

তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না মিলি। মিথ্যা কথা বলছি। ঠিক না? মিলি হেসে ফেলল।

কেন এত মিথ্যা বল?

জানি না কেন বলি। চল ভাবী উঠি। বাসায় চলে যাব। ঘুম পাচ্ছে।

আমার সঙ্গে যাবে না?

উ ছ। ভাবী, বাবা যে বিয়ে করছে তুমি শুনেছ?

রানু কিছুই বলল না। মিলির কোনো কথার গুরুত্ব দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। ওর যা মনে আসে তাই বলে।

আমার কথা বিশ্বাস করছ না, তাই না ভাবী?

ঠিকই ধরেছ। করছি না।

এবার কিন্তু সত্যি কথাই বলছি। বাবা তার সেক্রেটারিকে বিয়ে করেছেন। আমার কথা বিশ্বাস না হলে একশ টাকা বাজি রাখতে পার।

রানু চুপ করে রইল। দেড়টা বাজে। মাথা ধরে গেছে। এত সময় হাঁটাহাঁটি করা ঠিক হয়নি। মিলি গেটের কাছে এসেই বলল–ভাবী, শাড়ির রঙটা এখন আর আমার পছন্দ হচ্ছে না। পাঁচ মিনিটের জন্যে আসবে শাড়িটা বদলে নেব। প্লিজ ভাবী তোমার পায়ে পড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *