১৩. রাত পোহালে

সুজিত সারারাত্রি শিবেনদের বাড়িতে তার ঘরে চুপ করে বসেছিল। সে খালি ভাবছিল, রাত পোহালে আর এ বাড়িতে থাকা যাবে না। শিবেনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার দুটো হাতই খানিকটা পুড়ে গেছে। সে হয়তো সকালেই ফিরবে। দীপুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সুজিতের। তাকে সে মোটামুটি ঘটনা বলে দিয়েছে। ভুজঙ্গভূষণের খোঁজ কেউ জানে না। সারারাত্রি বাড়ি ফেরেননি। এ বাড়িতে আর থাকা যায় না।

পরদিন বেলা আটটার সময়েই বীরেন্দ্র ফোন করলেন সুজিতকে। জানালেন, গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের হাসপাতাল থেকে একটা রেজেস্ট্রি চিঠি রি-ডাইরেক্ট হয়ে অলিভ রোডের ঠিকানায় সুজিতের নামে এসেছে। চিঠিটায় আর্জেন্ট ছাপ মারা আছে। সুজিত যেন দেরি না করে। পিয়ন আবার একটু বাদেই ঘুরে আসছে, সুজিত এখনি চলে আসুক।

সুজিত অলিভ রোডে গিয়ে পিয়নের কাছ থেকে চিঠিটা সংগ্রহ করল। নীচে বাইরের ঘরে, বীরেন্দ্রনারায়ণের সামনেই চিঠিটা খুলে ইংরেজি লেখা দেখে বীরেন্দ্রনারায়ণকে দেখতে দিল সে। বীরেন্দ্র চিঠিটা দেখতে দেখতে চিৎকার করে উঠলেন, কী সাংঘাতিক ব্যাপার! চিঠিটা দিচ্ছে তোমার বাবার ট্রাস্টি এবং সলিসিটর। উনি এখন খুবই অসুস্থ। প্রতাপ সিংহ গত বছর যে রকম তাদের নির্দেশ করেছিলেন, সে ভাবেই তিনি জানাচ্ছেন যে, এখন নিশ্চয়ই সুজিত সুস্থ, অতএব সে যেন তার সম্পত্তি ও অর্থের দায়িত্ব বুঝে নেয়। কলকাতার কয়েকটি বাড়ি এবং প্রায় বারো লক্ষ টাকা, ও সবই অতীন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর একমাত্র ছেলে সুজিতনাথ মিত্রকে দিয়ে গেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, অনেকগুলো টাকা, না?

বীরেন্দ্রনারায়ণ প্রায় বিষম খেয়ে বললেন, এবং কলকাতায় কয়েকটা বাড়ি! মানে তোমার বাবা, কী আশ্চর্য, তোমার কপালটা তো আমি দেখছি একটা ইয়ে, কী বলব। কিন্তু সে কথা যাক, তোমার যা কিছু পুরনো কাগজপত্র সব নিয়ে এখুনি মুর্শিদাবাদ চলে যাও। উনি তোমাকে সবই বুঝিয়ে দেবেন, সেখানে একদম পাগলের মতো যা-তা কথাবার্তা বলো না যেন। ভদ্রলোক না আবার মারা যান। আমি টাইম-টেবল দেখে দিচ্ছি।

সুজিত বলল, আমি বলছিলাম, মানে আমার কাছে আর টাকা নেই, মুর্শিদাবাদ যেতে হলে কত লাগবে

–ইমপসিবল! আরে তোমাকে আমি টাকা দিচ্ছি। পাঁচশো, হাজার, যা লাগে, তুমি এখুনি চলে যাও। আর হ্যাঁ, দাঁড়াও, তোমার মাসিমা আর দোলার সঙ্গে এক বার দেখা করে যাও। চলো আমার সঙ্গে।

সুজিত সকলের সঙ্গেই দেখা করল। দোলা কোনও রকমে ভদ্রতাসূচক দু-একটি কথা বলে অন্য ঘরে চলে গেল। সুজিত চলে আসবার আগে, দোলার ঘরে একবার গেল। দেখল, দোলা চুপ করে বসে আছে। সুজিত বলল, আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। কিন্তু আমি মিথ্যে কথা কখনও বলি না, আমার যা মনে হয়েছে, এ কদিন আমি তাই করেছি। দেখ দোলা, আমি চেয়েছি শান্তি এবং ভালবাসায় তৈরি একটা আশ্রয়। সুনীতাকে দেখে আমার এত কষ্ট হয় যে, ওকে আমি ভাল না বেসে পারি না। কিন্তু আশ্চর্য, আমি নির্বোধ বলেই বোধ হয় আমার মনে হয়, তোমার মতো একজন সুখী পবিত্র মেয়েকেও আমি ভালবাসি।

দোলা ঘাড় তুলে তাকাল। তার চোখে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা। সুজিত বলল, রাগ করছ আমার ওপর, না? রাগ কোরো না। হয়তো ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আমি আজ যাচ্ছি মুর্শিদাবাদে, তুমি সবই শুনেছ। ফিরে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করব। যাচ্ছি এখন।

দোলা চোখ না ফিরিয়ে তাকিয়েই রইল। একটু পরে বলল, তোমার কথা আমি সত্যি বুঝতে পারি না। আপনি আপনি আমাকে কী মনে করেন, একটু বলতে পারেন?

–সে কথা তো প্রথম দিনই বলেছি। তোমাকে–তোমাকে আমি স্নেহ করি, ভালবাসি। তোমাকে আমি মনে করি, একটি নিষ্পাপ ফুলের মতো।

দোলা একটু থেমে বলল, মুর্শিদাবাদ থেকে এসে দেখা করবেন, সত্যি?

নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার এখন সত্যি ভাবনা হয়েছে, এ সব টাকা-পয়সা বাড়ি-ঘর নিয়ে কী করব। আমি এ সবের কিছুই বুঝি না।

বীরেন্দ্রনারায়ণ ডাক দিলেন। গাড়ির সময় জানালেন। সুজিত বিদায় নিয়ে, চিঠিটা সঙ্গে করে চলে এল শিবেনদের বাড়িতে। টাকাও বীরেন্দ্রনারায়ণ দিয়ে দিয়েছিলেন। সুজিত দীপুকে এবং স্থবির সুনয়নীকে সব কথা বলল। সুনয়নী কাঁদলেন। কান্নার মধ্যে হাসির ঝিলিকও ছিল। দীপু নিজে চিঠিটা ভাল করে দেখল। সুজিত জানাল, তাকে দু-তিনদিন মুর্শিদাবাদে থাকতে হতে পারে।

সামান্য কিছু খেয়ে মুর্শিদাবাদ যাবার জন্যে বেরুবার মুহূর্তে, রঞ্জন এল। তার দিকে তাকিয়ে সুজিতের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। এক রাত্রের মধ্যেই তার চেহারা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। সুজিত কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই, রঞ্জন যেন চাপা গলায় গর্জে উঠল, সুনীতা কোথায়?

সুজিত অবাক হয়ে বলল, সুনীতা? তা তো জানি না! কেন, সে কি তার বাড়িতে নেই?

না। ভোরবেলা কোথায় বেরিয়ে গেছে, কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আজ বিয়ের নোটিস দিতে যাবার কথা ছিল রেজিস্ট্রি অফিসে। কাল সারারাত পাগলামি করেছে, বারে বারে তোমার নাম করেছে।

রঞ্জনের চোখ দুটি যেন হিংস্র হয়ে উঠল। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সুজিতের বুকটা আবার কেঁপে উঠল। হয়তো রঞ্জন তাকেই হত্যা করতে চায়। সে বলল, কিন্তু আমি তো কিছুই জানি না সে কোথায়? এই তো বীরেন্দ্রবাবুর বাড়ি থেকে আসছি, এখন মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি।

-মুর্শিদাবাদ কেন?

সুজিত সব বলল তাকে। রঞ্জন অবাক হয়ে সুজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। সুজিত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল।

.

সুজিত সন্ধ্যাবেলা মুর্শিদাবাদ পৌঁছল। সলিসিটরের সঙ্গে দেখা হবার পর, প্রাথমিক কথাবার্তা, আলাপ-পরিচয় হল। সুজিতকে তিনি থাকতে বললেন। প্রকাণ্ড বাড়ি, কিন্তু লোকজন সামান্যই। জানা গেল, মহিলা কেউ নেই বাড়িতে। ঠাকুর-চাকরেরাই সব কিছু করে। সাজানো-গোছানো প্রকাণ্ড অতিথি-ভবনটাই সুজিতকে ছেড়ে দেওয়া হল।

রাত্রি সাড়ে দশটার সময় সুজিতের ঘরে ঢুকে একজন চাকর সংবাদ দিল, এইমাত্র কলকাতা থেকে যে গাড়ি এসেছে, তাতে একজন মহিলা এসেছেন, সুজিতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান। সুজিত তাকে নিয়ে আসতে বলল, এবং অবাক হল, কে আসতে পারে। তার ভাবনা শেষ হতে না হতেই দরজায় এসে দাঁড়াল সুনীতা। সুজিত যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সে আধশোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। সুনীতার গায়ে দামি কাপড়চোপড় সবই আছে, কিন্তু সবই অবিন্যস্ত, বিস্রস্ত। মুখে ঈষৎ হাসি থাকলেও তার চোখে ব্যাকুল ভীতি ও চঞ্চলতা।

সুজিত বলল, তুমি?

সুনীতা ঘরে ঢুকে বলল, হ্যাঁ। পিছন ফিরে চাকরকে বলল, এই বাবুর খাওয়া হয়ে গেছে?

 চাকর জানাল, হ্যাঁ।

সুনীতা বলল, ঠিক আছে, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। আমি খেয়ে এসেছি। ইনি আমার স্বামী। তুমি যেতে পার এখন।

আজ্ঞে আচ্ছা মা-ঠাকরুন। চাকরটি চলে গেল। সুনীতা দরজাটা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াল। এ বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই, একটি সেকালের পুরনো প্রকাণ্ড দেওয়াল বাতি জ্বলছিল। সেই আলোয়, ওরা দুজনেই দুজনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর সুজিত পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল, বলল, সুনীতাই তো।

–চিনতে পারছ না?

–পারছি! কিন্তু কী করে এলে, কেমন করে জানলে এখানকার কথা?

দীপুর কাছ থেকে জেনেছি। জেনেই ছুটে চলে এসেছি।

 সুজিত আবার নির্বাক হয়ে গেল। সুনীতার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে একটি হাত তুলে সুনীতার কপালে গালে ছোঁয়াল। সুনীতার চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। সে সুজিতের বুকের মাঝখানে মুখ রেখে বলে উঠল, পারলাম না, পারলাম না গো তোমাকে ছেড়ে থাকতে। তোমাকে আর একবার দেখতে এলাম।

সুজিত দুই চোখ বুজল, স্নিগ্ধ মুখে, গভীর স্নেহে সে সুনীতার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলল, এসো, বসবে এসো সুনীতা। তোমার বুক এত ধুকধুক করছে কেন?

সুনীতা বলল, কে জানে, হয়তো রঞ্জনও আমার পিছু পিছু এসেছে। তুমি আমাকে আশ্রয় দাও, একটু লুকিয়ে রাখো তোমার কাছে।

খানিকক্ষণ ওরা কেউ কোনও কথা বলল না। তারপর সুজিত বলল, কাল রাত্রে কেন তুমি আমার কথায় রাজি হলে না?

সুনীতা বলল, আমি রাজি হলেও আর কিছুই আসত যেত না, সে কথা কি তুমি বুঝতে পারনি?

কিন্তু সুনীতা, তুমি কি সত্যি বিশ্বাস কর, তুমি আমি দুজনে ঘর বেঁধে থাকতে পারি না।

না, না, না গো। আমি যে সব বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি, তোমার এমন সরল সুন্দর জীবনটাকে আমার জন্যে আমি নষ্ট হতে দিতে পারব না।

তবে আজ কেন এমন করে ছুটে এলে?

–এলাম, কারণ সেই তোমাকে চিঠিতে লিখেছিলাম, তোমার কাছে এখুনি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে, এ সেই ইচ্ছে। আমি যে তোমার চোখেই প্রথম দেখলাম, এই অভাগিনীকে তুমি ভালবেসেছ, নিজের পাথর হয়ে যাওয়া প্রাণের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তোমার প্রাণের রসে সেখানটাও ভরে উঠেছে। তাই তো বলেছিলাম, আমার নিয়তিই সেদিন রেলের সেই কামরায় আমাকে তুলে দিয়েছিল। জীবনের এই পাওনাটা যখন বুঝেছি, তখন তাকে একেবারে ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারলাম না। হয়তো এই শেষ, এই শেষবারের জন্যে, জীবনের চরম স্বাদ পেতে এসেছি সুজিত।

–তারপর সুনীতা?

তারপর–তারপর আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে সেখানেই। যেতে হবে না, রঞ্জন নিজেই খুঁজে বের করবে। সে আমাকে স্বর্গ-নরক-পাতাল, যেখান থেকে হোক, খুঁজে বের করবে।

সুজিত একটু অপেক্ষা করে বলল, সুনীতা, একটা কথা না বলে পারব না, তোমাকে রঞ্জন ভালবাসে। ওর ভালবাসায় কোনও খাদ নেই কিন্তু।

–কিন্তু অমানুষের, পশুর ভালবাসা। আমি যে ওকে কখনও ভালবাসিনি, আমি যে ওকে কখনও সে স্থান দিতে পারি না।

দুজনেই চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপরে সুনীতার গলা শোনা গেল, চুপিচুপি, প্রায় কান্না মাখানো গলা, কেন তোমাকে দেখতে পেলাম। তোমাকে না দেখেও এ-জীবনটা তো অনায়াসে কেটে যেতে পারত।

–সে কথা আমারও সুনীতা! তুমি শুনেছ বোধ হয় আমি অনেক টাকা পেয়েছি, কলকাতায় কয়েকটা বাড়ি। আমি এ কদিন ধরে যে জীবনকে দেখলাম কলকাতায়, তারপরে আমার কথা শুনলে সবাই হাসবে। কিন্তু কী করব আমি এ সব নিয়ে?

সুনীতা একটু চুপ করে থেকে বলল, দোলাকে নিয়ে সুখে সংসার করো।

এ কথায় সুজিতের কোনও ভাবান্তর হল না। বলল, সুনীতা, দোলা খুব সুখী আর পবিত্র মেয়ে। ওকে আমি বলেছি, ওকে আমি ভালবাসি। কিন্তু সুনীতা, তফাতটা কোথায়, তা তোমাকে বোঝাতে পারছি না।

সুনীতা সুজিতের হাত ধরে বলল, বুঝতে পারছি।

সুজিত আবার বলল, তুমি যা বললে, হয়তো একদিন তাই হবে। কিন্তু সুনীতা, তুমি তো জান, এ চোখ চিরদিন কী দেখবার আশায় থাকবে, এ প্রাণের তার কোন সুরে বাজবে। হয়তো দোলা এ সবই বুঝবে, ও বুদ্ধিমতী মেয়ে, ভালবাসলে অনেক সময় ক্ষমাও করা যায়, ও হয়তো আমাকে ক্ষমাও করবে, তবু–তবু সুনীতা–

সুনীতার একটি হাত সুজিতের মুখে চাপা দিল। –এ সব শুনলে, আর তোমার কাছ থেকে পালাতে পারব না গো। হয়তো তোমার সামনেই নিজেকে শেষ করে দিতে হবে।

.

মুর্শিদাবাদে তিন দিন রইল সুজিত। সুনীতাও রইল। কাজকর্ম মিটতে মিটতে ওরা মুর্শিদাবাদের নানান জায়গায় বেড়াল। তারপর কলকাতায় ফেরার দিন সকালবেলাই সুনীতা সুজিতকে না বলে চলে গেল। কোথায় গেল, কিছুই জানতে পারল না। সে যখন স্টেশনে এসে গাড়িতে উঠল, তার পাশে এসে রঞ্জন বসল। জানতে চাইল সুনীতা তার কাছে এসেছিল কি না। সুজিত জানাল, হ্যাঁ, সে এসেছিল কিন্তু আজ সকালবেলাই চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে, সে কথা সুজিত জানে না। ওরা দুজনেই কলকাতায় ফিরল। রঞ্জন যে সুজিতকে বিশ্বাস করেনি, ওর চোখ দেখেই বোঝা গেল। শিয়ালদহ থেকে দুজনে আলাদা হয়ে গেল। সুজিত প্রথমে শিবেনের বাড়ি গেল। দীপু আর সুনয়নীর সঙ্গে দেখা হবার পর ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গেও দেখা হল। তিনি ওকে সত্যি ভালবেসে ফেলেছিলেন। সুজিত ওঁকে কিছু টাকা দিল। বীরেন্দ্র তাকে প্রায় হাজারখানেক টাকা দিয়েছিলেন। পরে সুজিত বীরেন্দ্রের সঙ্গে দেখা করল। তাঁর অনুরোধে দুদিন ওখানেই কাটাল এবং ইতিমধ্যে, দলিলের বলে ব্যাঙ্কের টাকা ও সম্পত্তি সবই তার নামে পরিবর্তিত হয়ে গেল। বর্তমানে চারটে বাড়ি থেকে মাসিক আয় প্রায় দু হাজার টাকা। কিন্তু ভাড়াটেরা কেউই বাড়ির মালিককে একটি ফ্ল্যাটও ছেড়ে দিতে রাজি হল না। অগত্যা সুজিতকে আপাতত একটি হোটেলেই উঠতে হল।

কিন্তু একটা ব্যাপার সুজিত বারেবারেই লক্ষ করল, কে যেন তাকে সবসময়েই ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। হোটেলে, রাস্তায় পথ চলতে, প্রায়ই দুটি চোখ সে দেখতে পায়, এবং একদিন শিবেনদের বাড়ি থেকে দীপু, সুনয়নী এবং ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসতেই, পাঁচিলের অন্ধকার কোণে। সহসা দুটি বলিষ্ঠ হাত তার গলা টিপে ধরল। অন্ধকারের মধ্যেও রঞ্জনকে চিনতে তার ভুল হল না। মৃত্যু আসন্ন জেনে, সুজিত একবার কেঁপে উঠল, কিন্তু পরমুহূর্তেই তার গলা ছেড়ে দিয়ে রঞ্জনের মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল। সুজিতের মনে হল, কী ঘটেছে সে জানে না। তার মস্তিষ্ক শূন্য। দেওয়ালে হেলান দিয়ে সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ভুজঙ্গভূষণ গিয়ে তাকে আবিষ্কার করে বাড়ি নিয়ে এলেন। তারপরেও সে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল এবং আস্তে আস্তে যেন বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে ফিরে আসতে লাগল। আর সহসা কেঁপে উঠল, কারণ এ সবই তার সেই আগের বোধবুদ্ধিহীন অসুখের লক্ষণ।

পরদিন সুজিত একটা চিঠি পেল রঞ্জনের। সে লিখেছে, গতকাল আমার সঙ্গেই তোমার অন্ধকারে দেখা হয়েছিল, হঠাৎ আমার মনে হল আমি ভুল করছি। আমার হাত যাকে খুঁজছে, সে তুমি নয়, সুনীতা। তার সঙ্গে আমার দেখা হবেই, তখন শেষ বোঝাপড়া হবে। এর কয়েক দিন পরেই সুজিত দীপুর কাছে শুনতে পেল, রঞ্জনের সঙ্গে সুনীতার দেখা হয়েছে। শীঘ্রই নাকি তাদের বিয়ে হবে। রেজেস্ট্রি অফিসে গিয়ে তারা নোটিস করে এসেছে। শুনে সুজিত অনেকটা আশ্বস্ত হল। সেই রাত্রির ঘটনার পর তার শরীর যতটা খারাপ হয়েছিল, তার থেকে ভাল বোধ হতে লাগল।

একদিন বিকালে হঠাৎ সুনীতাকে নিয়ে রঞ্জন হোটেলে এল সুজিতের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু রঞ্জন ভাল করে কথা বলল না। সুনীতা কিন্তু খুব হাসল, অনেক বকবক করল, অনেকটা অর্থহীন প্রলাপের মতো। তারপর সুজিতকে বলে, হোটেল থেকে ভারমূথ আনিয়ে এক বোতল খেল। রঞ্জন শুধু বিদ্বিষ্ট ঈর্ষান্বিত নিষ্ঠুর চোখে সব দেখল। সুজিত রঞ্জনের সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করল। রঞ্জন তেমন সাড়া দিল না। সে শুধু জানাল, সুনীতা আসতে চাইল বলেই তাকে আসতে হল। এবং একবার সুনীতা যখন। ঘরের জানালার কাছে গেল, তখন রঞ্জন ঠোঁট বাঁকিয়ে সুজিতকে বলল, তোমার চোখে ব্যথা ঝরে পড়ছে দেখছি। সুজিত বলল, হ্যাঁ, সুনীতার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে। তারপরে সুনীতা লাইম জিন খেতে চাইল, রঞ্জনের অনুমতিক্রমে তাই দেওয়া হল। খাওয়ার পরে সুনীতা সোফাতে এলিয়ে পড়ল, ঘুমিয়ে পড়ল। তখন রঞ্জন জানাল, একদিন তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে সুজিত, আমি ওকে ভালবাসি কি না। আমি ওকে ভালবাসি। আমি ওকে যতখানি ভালবাসি, ঠিক ততখানিই ঘৃণা করি। এত ভাল কাউকে বাসিনি। এত ঘৃণাও কাউকে করিনি। আমি জানি না, ভালবাসার উলটো পিঠে ঘৃণা লেখা থাকে কিনা। বলেই সে সুনীতাকে টেনে তুলল, প্রায় ঘুমন্ত টেনে নিয়ে চলে গেল।

.

ইতিমধ্যে কালাচাঁদ এসে জুটেছে সুজিতের কাছে। রঞ্জন আর কাউকে তার কাছে রাখে না। রাখতে পারে না। কালাচাঁদ লোকটিকে অবশ্য সুজিতের খারাপ লাগে না। সমাজের নিচু এবং অন্ধকার দিকটাই তার বেশি দেখা আছে, এবং সেই জগৎটাই সে চেনে। কিন্তু অন্যান্য কাজও সে চেষ্টা করলে পারে। এখন সে সুজিতের অনেক কাজ করে দেয়। টাকা এবং সম্পত্তি হওয়া মানেই কাজ বেড়ে যাওয়া। স্বভাবতই সুজিতের এখন প্রতি দিনই নানান কাজ। কালাচাঁদই সে সব করে দেয়। কালাচাঁদের সংসারের দায়িত্বও তাই সুজিতেরই। এতে অবশ্যই বীরেন্দ্রর আপত্তি ছিল। সুজিত সে দায়িত্ব নিয়েছে। কালাচাঁদ যে একজন দুঃখী এবং নিপীড়িত, এটা সে বুঝেছে। লোকটিকে তার ভালই লাগে।

দোলার সঙ্গে সুজিতের বিয়ের প্রস্তাবও উঠল। কিরণময়ী নিজেই সুজিতের অভিমত জানতে চাইলেন, দোলার মনোভাবের কথাও জানালেন। সুজিত জানাল, সে তার মস্তিষ্কের অসুখ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত নয়। দোলাকে বিয়ে করতে তার আপত্তি নেই, কারণ দোলার মনের ইচ্ছা সে নিজেও জানে। কিন্তু কিছুকাল অপেক্ষা করা দরকার। অসুস্থতার সব লক্ষণগুলি সে একেবারে কাটিয়ে উঠতে চায়। সেটাই সাব্যস্ত হল। দীপু রীতিমতো যোগাযোগ রাখে সুজিতের সঙ্গে। আস্তে আস্তে সুজিতকে কেন্দ্র করে একদল লোকের ভিড় বাড়তে থাকে। তারা কেউ ব্যবসায়ী, কেউ রাজনীতিক। এবং সকলেরই ধারণা সুজিত একটি বিচিত্র ধরনের নির্বোধ।

মাসখানেক পরে, যখন সুনীতারঞ্জনের বিয়ের রেজেস্ট্রি আসন্ন, ঠিক এ সময়েই শোনা গেল, সুনীতা আবার অদৃশ্য হয়েছে। রঞ্জনের সেই অদৃশ্য প্রহরা আবার শুরু হল। ঘর থেকে বেরুনো সে একেবারে বন্ধ করে দিল। বীরেন্দ্র প্রস্তাব করলেন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সীমায় নামখানার বাংলোয় কয়েক দিন সবাই মিলে বেড়িয়ে এলে হয়। সুজিত সম্মতি দিল। এবং একদিন মোটরে সবাই নামখানায় চলে এল। সুজিতের মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল সমুদ্র ও সুন্দরবনের এই সীমায় এসে।

কিন্তু যেদিন তারা এল, সেদিন সন্ধ্যাবেলায় সুনীতা এসে উপস্থিত হল। সুজিত অবাক হয়ে তাকে ঘরে তুলে নিয়ে গেল। বীরেন্দ্র, কিরণময়ী এবং দোলা এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করল। সুজিত জিজ্ঞেস করে জানল, এবারেও দীপুর কাছেই খবর নিয়ে সুনীতা এসেছে। সুনীতার চেহারা আর সেরকম নেই। চোখের কোল বসা, এবং দৃষ্টিতে উন্মাদনা। এসে সুজিতকে জড়িয়ে ধরে অজস্র কান্নায় ভেঙে পড়ল, পারছি না, পারছি না সুজিত, তোমাকে ভুলতে পারছি না, দোলার ওপর হিংসেয় মরে যাচ্ছি। এইবারটি শেষ বার, আর আসব না।

সুজিত বলল, সুনীতা, একটু শান্ত হও, তোমাকে এরকম দেখলে আমি অস্থির হয়ে উঠি। তুমি আবার কেন পালিয়ে এলে?

সুনীতা বলল, পারি না যে। মনকে অনেক বুঝিয়েও কিছুতেই তোমার কাছ থেকে সরে থাকতে পারছি না। কেন এমন হল সুজিত? সংসারে তো এমন কতই ঘটে, ভালবেসে সবাই কি সবাইকে পায়? আসলে কী জান সুজিত, আমি যে বিশ্বাস হারাবার পর বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু হাত বাড়াবার দরজা আমার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

এই সময়ে দোলা এল। দোলাকে দেখেই সুনীতা হেসে বলে উঠল, ভয় নেই, তোমার ভাবী বরকে নিয়ে পালাব না। এতে দোলা অত্যন্ত কুপিত হল, সহসা যেন ওর ভিতর থেকে বিস্ফোরণ হল, আপনার মতো মহিলার সঙ্গে আমার কথা বলতেও রুচিতে বাধে।

সুজিত ডাকল, দোলা!

সুনীতা মুহূর্তে যেন হিংস্র ডাকিনী হয়ে উঠল। বলল, তাই নাকি? তোমার ভাবী বর বলেছি, তাই যথেষ্ট। আমি ইচ্ছে না করলে তা হবে না। নিয়ে যাও দেখি তুমি ডেকে ওকে এখান থেকে?

বলে সে সুজিতের হাত ধরল। সুজিত সুনীতাকে বোঝাতে চাইল। দোলা অপলক চোখে সুজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। সুজিত বুঝতে পারল, দোলা তাকে ডাকছে। সুনীতা তখন খিলখিল করে হাসছে। দোলা অনড়, নিশ্চল, রুদ্ধশ্বাস, আরক্ত এবং চোখ সরাল না সুজিতের চোখ থেকে। সুজিত সুনীতাকে বারবার ডাকতে লাগল, সুনীতা শোনো, শোনো।…কিন্তু সে দোলার দিকে এগিয়ে যেতে পারল না।

দোলার চোখে জল এসে পড়ল। সে সহসা দ্রুতবেগে বাইরে চলে গেল। সুনীতা হাসতে হাসতে সুজিতের বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ল। সুনীতার নিজের চোখ ফেটেও জল এসে পড়েছে, তা ও নিজেই বোধ হয় জানে না। তারপর সহসা হাসি থামিয়ে বলল, আমার যাবার সময় হয়েছে সুজিত, আমি যাচ্ছি। নইলে রঞ্জন ঠিক এখানে এসে পড়বে।

ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছিল। সুনীতার কথা শেষ হবার আগেই, বাংলোর বাইরে মোটরের শব্দ হল, আর কাঁচের জানালায় গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়ল। পরমুহূর্তেই গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ শোনা গেল। মিনিটখানেক পরেই রঞ্জনকে দেখা গেল দরজায়। তার মুখ রক্তাভ, চোখ রক্তাভ, ঘৃণা ও হিংস্রতার এক প্রতিমূর্তি। তখনও সুনীতা সুজিতের হাত ধরে ছিল। তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, চলো রঞ্জন, চলো আমরা যাই।

রঞ্জন দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, সুনীতা বেরিয়ে গেল। রঞ্জন তাকাল সুজিতের দিকে, এবং হঠাৎ ছুরির ফলার মতো একটু হাসি ঝলকে উঠল তার ঠোঁটে। তারপরে সেও চলে গেল। গাড়ি ছেড়ে দেবার শব্দ শোনা গেল। সুজিত অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তার খেয়াল নেই। বীরেন্দ্র এসে ডাকতে তার সংবিৎ ফিরল, এবং রঞ্জনের সেই হাসি স্মরণ করে কেঁপে উঠল। বলল, আমি এখুনি একবার কলকাতায় যেতে চাই, আপনি একটু ব্যবস্থা করুন।

বীরেন্দ্র প্রথমে আপত্তি করলেও, পরে রাজি হলেন। প্রায় মাঝরাতে কলকাতায় পৌঁছে সুজিত কালাচাঁদকে ডাকল। তাকে বলল, যেখান থেকে হোক, রঞ্জনকে খুঁজে বের করতেই হবে। কালাচাঁদ সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় সুজিতকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজ করল। কোথাও তাদের পাওয়া গেল না। খুঁজতে খুঁজতে ভোর হল, এবং শেষপর্যন্ত এক জায়গায় জানা গেল, সে সম্প্রতি দক্ষিণেশ্বরের দিকে একটা বাসা নিয়েছিল, সেখানে খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, মস্ত বড় বাড়ি। গঙ্গার ধারে, পোডড়া বাড়ির মতো স্তব্ধ। মানুষ বাস করে কিনা সন্দেহ। কালাচাঁদ যখন দরজায় ঘা দিচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই ওপরের জানালায় সুজিত রঞ্জনের মুখটা এক বার দেখতে পেল। সুজিত বলে উঠল, রঞ্জন দরজা খোলো।

কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে গেল। রঞ্জনই খুলে দিল। সুজিত দৌড়ে ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ও কোথায়?

রঞ্জন কালাচাঁদের মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে, ঘরের ভিতর এগিয়ে এল। সবই অন্ধকার লাগছিল। কোনও কথা না বলে এক বার তাকিয়ে রঞ্জন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল। সুজিত তাকে অনুসরণ করল। তারপর একটার পর একটা ঘর পার হয়ে, চতুর্থ ঘরে রঞ্জন থামল। সেই ঘরটার দরজা জানালা সব বন্ধ, গাঢ় অন্ধকার। রঞ্জন এগিয়ে গিয়ে একটা ছোট জানালা খুলে দিতেই আলো এল। সুজিত দেখল, একটা খাটে সুনীতা শায়িত। তার সর্বাঙ্গে ঢাকা। মুখখানি খোলা। সুজিত এগিয়ে গিয়ে মুখের কাছে ঝুঁকতেই দেখতে পেল, সুনীতার চোখ বোজা। ঠোঁটের কোণে উদগত রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সুজিতের মনে হল, সে কিছু বুঝতে পারছে না। সব যেন বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। সে রঞ্জনের দিকে ফিরে তাকাল।

রঞ্জন এগিয়ে এসে, বুকের কাছ পর্যন্ত সুনীতার ঢাকা খুলে দিল। সুজিত দেখল সুনীতার গলায় কালশিরার দাগ। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সেই চিঠির লাইন, আমার হাত যাকে খুঁজছে, সে তুমি নয়, সুনীতা।

রঞ্জন আবার গলা অবধি ঢাকা দিয়ে, গভীর আগ্রহে, পরম স্নেহে যেন ঝুঁকে পড়ে, রুক্ষ চুলের গোছা সুনীতার কপাল থেকে সরিয়ে দিল। তারপর বলল, আমি ওকে মেরেছি সুজিত।

সুজিত অনেকটা ভাবলেশহীন মুখে বলল, ও! মেরে ফেলেছ?

-হ্যাঁ। আমার প্রেম, আমার ঘৃণা, আমার ঈর্ষা, আমার সুখ, আমার যাতনা, যা বলো, আমার সবকিছুর অস্তিত্বকেই আমি বিনাশ করেছি। এখন আমি শান্তি বোধ করছি।

সুজিত নির্বাক হয়ে রইল। সুনীতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রঞ্জন আবার বলল, সুজিত, ওকে মারার পর অনেক আদর করেছি। তুমি একটু করবে না? তুমি ওকে একটু আদর করো সুজিত, বেঁচে থাকতে ওর তৃষ্ণা মেটেনি, তুমি ওকে আমার সামনে একটু আদর করো। আর সময় নেই, পুলিশ আমাকে ধরতে আসবে।

আদর করব? সুজিত অন্যমনস্কের মতো বলল, সুনীতার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে গভীরভাবে দেখল। একবার বলল, গাড়ি ছেড়ে দেবার শেষ ঘণ্টায় তুমি এসে পৌঁছেছিলে, মনে আছে?

সে হাসল, কিন্তু চোখের কোণ বেয়ে জল পড়ছিল। সুনীতার ঠোঁটের কোণে রক্তের কাছে তার ঠোঁট নেমে এল। ডাকল, সুনীতা! সুনীতা!

রঞ্জন পুলিশের হেফাজতে। তার যাবজ্জীবন কারাবাসেরই সম্ভাবনা। কিন্তু সুজিতের সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। সে আবার আগের মতোই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখনও তার কথার মধ্যে ছিটেফোঁটা চিন্তা বা সংবিৎ টের পাওয়া যায়। বীরেন্দ্র যখন জানালেন, গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের সেই মানসিক চিকিৎসালয়ে আবার নতুন করে একজন মনোবিজ্ঞানী চিকিৎসা শুরু করেছেন, তখন সে সেখানেই যেতে চাইল। যাবার আগে সে দোলাকে বলল, আমার ওপর রাগ কোরো না। তোমাকে আমি মনে রাখতে চেষ্টা করব। মনটা–মানে–ঠিক আগের মতো হয়তো থাকবে না। তাই এ কথা বলছি।

দোলা কেঁদেছিল, হয়তো যেতে দিতে চায়নি। সুজিত বলেছে, ওর যাওয়া দরকার। ও কলকাতার অযোগ্য। সুজিত আবার ওর নিজের জায়গায় ফিরে চলল। কালাচাঁদ ওকে পৌঁছে দিতে গেল।