১৩. রাতে ভালো ঘুম হয় না

সাইফুল ইসলামের রাতে ভালো ঘুম হয় না।

তার ঘরটি ছোট। একটিমাত্র জানালা, তাও বন্ধ করে রাখতে হয়। কারণ জানালার ওপাশে মুন্সি সাহেব গরুর গোবর পাবার ব্যবস্থা করেছেন। জানালা ভোলা থাকলে পচা গোবরের গন্ধ বুকের ওপর চাপ হয়ে থাকে। সাইফুল ইসলাম বন্ধ ঘরের গরমে হাঁসফাঁস করে। অর্ধেক রাত পর্যন্ত তালপাতার পাখায় হাওয়া খায়। দু-তিন বার বাইরের মাঠের একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে যখন ঘুমে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তখন শুতে যায়। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমে ঘুম চটে যায়। তালপাখা দত নাড়াতে নাড়াতে ভাবে–এই জায়গায় থাকা যায় না। খোলামেলা একটা জায়গা নিতে হবে।

অবশ্যি সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। মুন্সি সাহেবের এই ঘরটায় সে বিনা ভাড়ায় থাকতে পারে। তার বদলে মুন্সি সাহেবের একটি নাতিকে পড়াতে হয়। নাতিটির নাম বজলুর রশিদ। পড়াশোনায় কোনোমন নেই। কিছু বললেই বিকট সুরে চিৎকার করে। সে চিৎকারে আশেপাশে ভূমিকম্প হয়ে যায়। ছেলেটির মা পর্দার আড়াল থেকে চিকন সুরে বলে, কি হয়েছে রে বজলু?

আমারে মারছে।

বজলুর মার চিকন গলা আরো চিকন হয়ে যায়, মাষ্টার সাব, পুলাপান মানুষরে মাইরধোইর কইরেন না।

সাইফুল ইসলাম প্রতিবারই বলে, জ্বি-না, মারি নাই। আরব কেন?

কিন্তু ছেলেটির মা বিশ্বাস করে না। কারণ সে দীর্ঘ সময় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। পর্দার নিচ দিয়ে তার ফর্সা পা দেখা যায়। এরকম ফর্সা পা সাইফুল ইসলাম আর দেখে নি। ছেলেটি অবশ্যি তার মার মতো হয় নি। শ্যামলা রঙ। দাঁতগুলো বের হয়ে আছে। কে জানে তার মার দাঁতও উচু কিনা। উচু হওয়াই স্বাভাবিক। এমন টকটকে যার গায়ের রঙ, তার কোনো খুঁত না থাকলে হয় না। মেয়েদের সঙ্গে থেকে থেকে সে এই সব জিনিস খুব খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শিখেছে। সে দেখেছে খুব ফর্সা মেয়ের ঠোটের কাছে অস্পষ্ট একটা গোঁফের রেখা থাকে, পায়ের লোমগুলো হয় বড়ো বড়ো। ইঞ্জিনীয়ার সাহেবের এক শালীকে সে গান শেখাত। সে মেয়েটি ছিল অসম্ভব ফর্সা। কিন্তু বড়ো বড়ো কুৎসিত লোম ছিল পায়ে। লোমগুলো লালচে ধরনের। বাদামীও হতে পারে। ভালো মতো লক্ষ করা যায় নি। মেয়েটি ঝট করে শাড়ি টেনে দিয়েছে। মেয়েদের বোধহয় ঘাড়ের কাছে অদৃশ্য এক জোড়া চোখ থাকে। মাথা না ঘুরিয়েও অনেক কিছু টের পায়।

লোম থাকুক আর যাই থাকুক, ফর্সা মেয়েদের সাইফুল ইসলামের বড়ো ভালো লাগে। সার্কেল অফিসার সাহেবের হোট মেয়েটিও ফর্সা। তাকেও সাইফুল ইসলামের ভালো লাগে।

যে-সব রাত্রিতে তার ঘুম আসে না, সে-সব রাত্রিতে সে ধবধবে ফর্সা কোনো একটা মেয়ের কথা চিন্তা করে–যার গায়ের চামড়া অসম্ভব মসৃণ। যেন সেই মেয়েটি পাতলা একটা শাড়ি (হলুদ বা কমলা রঙের) পরে রাতে ঘুমাতে এসেছে। সাইফুল ইসলাম বলল, এত সকাল সকাল ঘুমাও কেন গগা, একটু চা-টা কর না।

চা খেলে তো তোমার ঘুম আসবে না। না আসুক, কর একটু।

মেয়েটি হাসিমুখে চা বানিয়ে আনল। রাগ করে (কপট রাগ) বলল, চা খাওয়াটা কমাও। বড়ো বেশি চা খাও তুমি, ভালো না। এই গরমে কেউ চা খায়। আমি তো সেদ্ধ হয়ে গেলাম।

সাইফুল ইসলাম রহস্য করে বলল, বেশি গরম লাগলে কাপড় খুলে ফেললেই হয়, হা হা হা।

ছিঃ, কী অসভ্যতা যে কর! ভাল্লাগে না।

অসভ্যতা কী করলাম, কেউ তো দেখতে আসছে না।

মেয়েটি তখন সত্যি রাগ করে ঘুমাতে গেল। সাইফুল ইসলাম চা শেষ করে মশারির ভেতর ঢুকে দেখে মেয়েটি কাপড়চোপড় খুলেই শুয়েছে। গত দু-তিন রাত সে এই জাতীয় কিছুই ভাবতে পারছে না। বারবার থানার পাশ দিয়ে আসবার সময় শোনা বীভৎস চিৎকার মনে আসছে। চিৎকার যে এত কুৎসিত হয়, কে জানত!

তার জানতে ইচ্ছা করে চিৎকারটা দিয়েই লোকটা মরল কিনা। লেকটা অবশ্যি মস্ত চোর ছিল। বাজারের চুরিগুলো সেই করিয়েছে। দবির মিয়া বলেছে, তার জিনিসপত্র কিছু কিছু পুলিশ উদ্ধার করেছে। চোর-ডাকাত যত কমে ততই ভালো। থানায় দু-একটা চোর-ডাকাত মারা পড়ার ভালো দিক আছে। চোর-ডাকাত সতর্ক হয়ে যায়। ওসি সাহেব খুব কড়া লোক, এইটা প্রচার হয়। কিন্তু তবু সাইফুল ইসলাম চিৎকারটার কথা ভুলতে পারে না। সে এক রাত্রে হাতের লেখাটা অন্যরকম করে নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবকে একটা সুদীর্ঘ চিঠি লিখে ফেলে। চিঠির বক্তব্য হচ্ছে, মানুষকে পিটিয়ে মারা অত্যন্ত গৰ্হিত কাজ। তার জন্য তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে ইত্যাদি। চিঠির শেষে নাম লেখে জনৈক পথিক।

চিঠিটা সে অবশ্যি পাঠানর জন্যে লেখে নি। এ রকম চিঠি সে তার ছাত্রীদের প্রায়ই লেখে এবং কখনো পাঠায় না। কারণ সুদীর্ঘ সেই সব চিঠির প্রায় সবটাই সীমাহীন অশ্লীলতা। পাঠানর প্রশ্নই ওঠে না। ওসি সাহেবের চিঠিতেও খানিকটা অশ্লীলতা ছিল। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সে লিখেছে কি করে ওসি সাহেবকে খুশি করা হবে এবং বিচি দুটি ফেলে দিয়ে রসুনের কোয়া ভরে দেওয়া হবে।

না পাঠানর জন্যে লেখা হলেও শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পাঠিয়ে দিল। অনিদ্ৰা নোগটা তার খুব বাড়ল তার পরপরই। থানার পাশ দিয়ে সে হাঁটা ছেড়ে দিল।

পঞ্চম দিনে ওসি সাহেব লোক পাঠিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। এবং অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বললেন, কি, আপনাকে তো আজকাল দেখিই না?

সাইফুল ইসলাম ঢোক গিলল।

তা আছেন কেমন?

জ্বি, ভালে।

এসপি সাহেব আসছেন ময়মনসিংহ থেকে। একটা আসামী যে মারা গেছে। সেই তদন্তে।

সাইফুল ইসলাম ছাইবর্ণ হয়ে গেল।

এসপি সাহেব আবার গান-বাজনার খুব সমঝদার। একটু গান-বাজনার ব্যবস্থা করতে পারবেন?

জ্বি জ্বি, তা তা…

দেখেন যদি পারেন। এই শহরে আপনি ছাড়া আর কেউ তো নেই। এই, একে চা-মিষ্টি দে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *