১৩. রাজার ভেক

রাজার ভেক

আমি এর আগে বলেছি সেইসব বদমাশদের কথা যারা জাল কাগজে দস্তখত করিয়ে নিয়ে টাকা আদায় করে। ছোট আদালতে মামলা করে বেগুনাহদের বরবাদ করাটাই এদের কাজ। আমি এবার আর এক কিসমের বজ্জাতির কথা বলব। রোজকার এই জুলুমবাজি করে ফেরিদারেরা (phereedar)। এরা হল ওই বদমাশগুলোরই নোকর-চাকর। এদের শিকার হচ্ছে গরিব আদমি যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মুঠ্‌ঠিভর রোজগার করে।

এক গরিব বিধবা দিনভর চাক্কিতে আটা পেষাইয়ের কাম করে যাতে তার বাচ্চাদের মুখে খানা তুলে দিতে পারে। এত মেহনতের পর তার কামাই চার আনা রোজ। কোনও জরুরত দেখা দেওয়ায় সে হয়তো পাঁচ সাল আগে এই ফেরিদারদের কাছ থেকে পাঁচ রুপিয়া ধার নেয়। এত দিনে তো সেই ধারের দু-গুণ শোধ হয়ে যায়। তবুও দেখবেন বজ্জাতগুলো রোজ ওই বিধবার কাছ থেকে দু-আনা করে আদায় করছে। একদিন সে বলার চেষ্টা করল, আমার কর্জ তো মিটে যাওয়ার কথা, তাও কেন রোজ রোজ দিয়ে যেতে হবে? বেকার গেল তার আর্জি। বেয়াদবির জন্য জুটল বেধড়ক মার যতক্ষণ না বেহুঁশ হয়ে পড়ে। পড়শিরা আওয়াজ শুনে ছুটে আসে। ফেরিদার তখনও সেখান থেকে যায়নি। সবাইকে হুমকি দিয়ে যায়, কেউ যদি নালিশ করার কথা ভাবে তবে তারও একই হাল করবে।

বেচারা বিধবা আট আনা ভিখ চেয়ে নিয়ে যায় স্ট্যাম্প পেপার খরিদ করতে। কোনও মোক্তার মেহেরবানি করে লিখে দেয় তার আর্জি। কাগজ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের কাছে সে দরবার করতে থাকে। হুজুর হুকুম দেন পুলিশকে মামলাটা তদন্ত করে দেখতে। থানেদার পড়শিদের পুছতাছ করলে, তাদের জবাব হয় কিছুই দেখিনি আমরা। ধরে নেওয়া যাক থানেদার একজন ইমানদার আদমি আর সে চায় মামলার সঠিক বিচার হোক। কিন্তু সেই বা কী করবে। যে সাক্ষীদের কথা বিধবা বলেছিল তারা তো মুখ খুলতেই নারাজ। থানেদার তখন রিপোর্ট করে, সাক্ষীরা কেউ ফরিয়াদির নালিশ মঞ্জুর করছে না। ম্যাজিস্ট্রেট এবার কাকে সাজা শোনাবেন? কানুনি সাবুদ কোথায়। সাক্ষীরা তো একরার করতেই নারাজ। আপনারা সওয়াল করতেই পারেন তা হলে কানুন-আদালত-পুলিশ এদের কাজ কী? আমি বলব এদের কাজ কমজোরকে ভয় দেখানো। এমন কোনও কানুন আজ পর্যন্ত হয়নি যার সুযোগ বদমাশরা নিতে না পারে। হালে তো হুকুমত তালিমের বন্দোবস্ত করেছেন। তাতে দেখছি আহেলাদের বাড়বাড়ন্ত। তালিম নিয়ে তারা আরও বেশি বজ্জাত হয়ে উঠেছে। হদ্দ জাহিলকেও দেখি কনট্রাকশন আর সারকুলার হুকুম থেকে নজির আওড়াতে। আদালত চত্বরে এই রকম দশজন আদমির ভিতর নয় জনই ঠিক ততটুকু আংরেজি জবান রপ্ত করেছে যা দিয়ে কান ভারী করা যায়।

কাশী শহরে সেয়ানা বদমাশদের একটা চালু ফেরেব্বাজি হল নিজেদেরই কাউকে রাজা বলে জাহির করা। শহর দর্শন করতে এসেছে যেন সেই রাজা। এই অজুহাতে ডাল-কী-মন্ডিতে তারা এক বিরাট হাবেলি ভাড়া করে। তারপর চলে সেই হাবেলিকে নিজেদের ধান্দার ওয়াস্তে মেরামত। বলভদ্র সিং সেখানে জাঁকিয়ে বসে রাজা ঘচপচ রাও নাম নিয়ে। ঝুঠা জহরত, শাল আর কিংখাবে মুড়ে ফেলে নিজেকে। শহরের নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে জুড়িদারেরা। ডাকা হয় যত শালওয়ালা আর জহরতের কারবারিদের। তারাও নিজেদের সেরা মাল নিয়ে হাজির হয়ে যায় রাজ দরবারে। কিন্তু রাজা তাদের নারাজ করেন এই বলে যে মাল ঠিক তার মনপসন্দ হচ্ছে না। কারবারিরা বলতে বসে, কাল তারা জরুর আরও উমদা (umda) মাল এনে হাজির করবে। তারই ভিতর শুরু হয়ে যায় মহফিল১। ছ’ জোড়া নাচনেওয়ালি রাজা ঘচপচ রাও-এর মেজাজ খুশ করতে শুরু করে দেয় হাত-পা ঘুরিয়ে নাচনা আর গানা। রাজা হুকুম করেন, “মেরা দৌলত লাও।” এই হুরি-পরিদের আমার তরফ থেকে শ শ আসরফি দেওয়া হোক। এক বান্দা বলে ওঠে, হুজুর গোস্তাখি মাফ আপনার দৌলত এখনও হাজির হয়নি। রাজা গর্জন করে ওঠে, “নিমকহারাম! বেহায়া!” বাকিরা তাকে ঠান্ডা করে, বেফিকর কালই ধনদৌলত হাজির হয়ে ঢুকে যাবে তোশাখানাতে। রাজা তার খেয়ালমতো মৌজ করে, তারপর একটা সময় চলে যায় মহফিল ছেড়ে। গান্ধর্বীরাও (gurdrupins) খতম করে তাদের নাচা-গানা। নিভিয়ে দেওয়া হয় মশাল।

তোশাখানার ভার নিতে চেয়ে পরদিন হাজির হয় অনেক উমেদার। তাদের উমেদ রাজার খিদমত খাটা। রাজা এলান করে, নিগাবানের ইনাম হবে ২০০ রুপিয়া মাহিনা, কোনও হিসাব-কিতাব আমার সামনে হাজির করা চলবে না। হরদম আমার আশপাশে থাকতে হবে আর হতে হবে পুরোপুরি ওয়াফাদার। অনেক ঝাড়াই বাছাই-এর পর রাজার মনে ধরে লালা অম্বিকা সহায়। খেলাত হিসাবে তাকে দেওয়া হয় একটা শাল আর মস্ত একটা চাবি। তোশাখানাটা কোথায় জানতে চাইলে জবাব মেলে, ইন্তেজার কর। ওয়াক্ত পর খোদ মালিকই বলে দেবেন। আচানক রাজার খেয়াল হয়, তাকে ১০০০ রুপিয়া দিতে হবে। তিনি হুকুম করেন, “আরে! বাহাদুর, লালা অম্বিকা সহায়ের কাছ থেকে ১০০০ রুপিয়া বুঝে নাও। ওটা গিয়ে বিশ্বেশ্বর সিং-কে দেবে। মনে করে রসিদ আনবে। বলবে, এটা আংটির কিমত। বাহাদুর তহশিলদারের কাছে টাকা চায়। বেচারা তো তখন বেয়াকুব। বুঝতে পারে না কী করবে। অথচ তোশাখানার চাবি তো তারই হাতে। বাহাদুর আবার বলতে বসে, নোকরদের বেয়াদবি রাজা ঘচপচ রাও বরদাস্ত করে না। জরুরত পড়লে তাদের কান কেটে নেয়। লালা ধরতে পারে ইশারাটা। শহরে শরফের কাছে খবর পাঠায় টাকাটা দেওয়ার জন্য। বাহাদুরও তার কাছে হাজির। সন্ধে হতে না হতেই শালওয়ালা আর জহরতের কারবারিরা তো হাজির তাদের মালপত্র নিয়ে। রাজার যদি কিছু পসন্দ হয়। সবার নজরে এল লালা অম্বিকা সহায় তহশিলদারের কাম সামলাচ্ছে। তারা তো তাকে ভাল রকম চেনে। সবাই তার কাছে জানতে চায় রাজা ঘচপচ রাও-এর তোশাখানায় কত টাকা মজুদ। অম্বিকা সহায় স্রেফ তাদের চাবিটাই দেখাতে পারে। রাজার মেজাজ বুঝে কারবারিরা মেলে ধরল তাদের পসরা। রাজার জবাব, তোমাদের ইন্তেজার করতে হবে। আগে আমার মালপত্র আসুক। তারা জানায়, বেফিকির রহিয়ে, পসরা তারা ছেড়ে যাচ্ছে। যত খুশি পসন্দ করুন না রাজা আর তাঁর বেগমরা। রেওয়াজ মাফিক গভীর রাত অবধি চলতেই থাকে মহফিল। তারপর এক সময় নিভে যায় মশাল।

সুবাহ হতে না হতেই দেখা গেল বেবাক পালটে গেছে মাহোল১। গাঁজা টেনে এক বুড়ো শুধু ঢুলছে দরওয়াজার সামনে। রাজা ঘচপচ রাও আর তার সঙ্গীদের কোনও নাম নিশান নেই। সবার আগে হাজির হল তহশিলদার। বুড়োটার কাছে জানতে চাইল কোথায় গেলেন রাজা সাহেব? জবাব মিলল, ভোর রাতেই তারা ডেরা-ডান্ডা গুটিয়েছে। এবার একে একে হাজির হতে শুরু করল পাওনাদারেরা। মহাজন, জহরতের কারবারি আর নাচনে-গানেওয়ালিরা। কোথায় তখন রাজা! দেওয়ালে লেগে আছে মশালের কালি আর পানের পিক। লালা অম্বিকা সহায়ের উপর শুরু হল চোটপাট। তারা বলতে লাগল, ফেরেব্বাজদের সঙ্গে সাজিশ করে লালাই তাদের ফাঁসিয়েছে। শুরুতে গালিগালাজ আখেরে মার। বেচারা লালা কী করে! সে শুধু দেখাতে থাকে তার মস্ত চাবিটা। আফসোস কী তারও কিছু কম। হাজার টাকা তো তারও বরবাদ হয়েছে। সবাই মিলে এবার তাকেই ধরে নিয়ে গেল কোতায়ালের কাছে। রুজু হল ফেরেব্বাজির নালিশ। বেচারা তহশিলদারকে হাজতে আটকে থাকতে হল এক হপ্তা। নিজেও সে ফেরেব্বাজির শিকার এটা সাবিত হওয়ায় মিলল রেহাই। পুলিশও মওকা পেয়ে তার ভালই মেরামত করেছিল।

রাজা ঘচপচ রাও-এর মতো মহাপ্রভুর কী আর তলাশ মেলে! হাজার হাজার পুণ্যার্থী যে শহরে রোজ হাজির হয় তাদের ভিতর থেকে কে তাকে খুঁজে পাবে।

একবার এক আজব বিচার দেখার সুযোগ মিলেছিল আমার। বিচার করবেন যে সাহেব তাকে কিছুদিনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হাকিমের। কোনও এক মহাজনের শখ হল কিংখাব পরার। সে ভাতিজাকে ডেকে বলল, খরিদ করে আন। ভাতিজা তার কথামতো কাপড় তো কিনল, কিন্তু তার থেকে একগজ কাপড় সরিয়ে রাখল নিজের জন্য। মহাজন খাপ্পা হয়ে রুজু করল চুরির নালিশ। দুই তরফের সওয়াল-জবাব শুনে হুজুর আদেশ দিলেন, মহাজনকে দিতে হবে দশ টাকা জরিমানা আর ভাতিজাকে মারা হবে দশ ঘা চাবুক। হুজুর মাইবাপ! দয়া! দয়া! বলতে লাগল মহাজন। দশ ঘা চাবুক মারতে বলবেন না। আমার পুরো পরিবার বেইজ্জত হয়ে যাবে। আমি কী করেছি যে আমাকে দশ টাকা জরিমানা দিতে হবে? সাহেব জবাব দিলেন, তোমার সঙ্গে বদমাশটার যোগসাজশ আছে; আর চুরি করেছে বলে ভাতিজাকে চাবুক মারা হবে। তামিল হল তাঁর হুকুম।

১. মহফিল: সভা, বৈঠক, আসর

১. মাহোল: পরিবেশ, মেজাজ, পরিস্থিতি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *