১৩. রশীদ আলী সাহেব

রশীদ আলী সাহেব অসীম ধৈর্যে বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সকালে নাশতা খেয়ে বের হন, ফিরেন দুপুর দুটা-আড়াইটায়। গোসল করে ভাত খান। ভাত খেয়েই ঘুমুতে যান। তার প্রথম ব্যাচ ছাত্রীরা এসে পড়লে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়। তিন ব্যাচ পড়ানোর ঝামেলা শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে আবার ঘুমুতে যান। ক্লান্তিতে তাঁর শরীর ভেঙে আসে। বিছানায় যাওয়ামাত্রই তাঁর ঘুমিয়ে পড়ার কথা–আশ্চর্যের ব্যাপার, তার ঘুম আসে না। তিনি বিছানায় এপাশ ওপাশ করেন। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে মনে হয়, ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসবে। আবার বিছানায় যাওয়ামাত্র ঘুম চলে যায়। প্রতি রাতেই মনে হয়, কোন একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ঘুমের অষুধ-টষুধ খাবেন। সারাদিনের ব্যস্ততায় মনে থাকে না। ঘুমের অযুধের কথা যখন মনে হয় তখন ডিসপেনসারি বন্ধ।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি সারাদিন কি করলেন, কার সঙ্গে কথা বললেন তা মনে করার চেষ্টা করেন। এইসব স্মৃতি সুখকর না। অন্য কিছু ভাবলে হয়ত ঘুম আসতো। কোন সুখস্মৃতি নিয়ে চিন্তা করতে পারলে হত। রশীদ আলি সাহেব অনেক চেষ্টা করেও কোন সুখস্মৃতি মাথায় আনতে পারেন না। বার বার মনে হয়, বৃদ্ধ বয়সে তিনি অর্থই পানিতে পড়েছেন। যখন বয়স ছিল–তখন অর্থই পানিতে সাঁতরে ভেসে থাকতেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জরা তাকে গ্ৰাস করতে শুরু করেছে। অর্থই পানিতে সাতরাবার মত শক্তি তিনি পাচ্ছেন না।

বাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে তাকে নানান ধরনের অপমানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই বয়সে মিথ্যা কথাও বলতে হচ্ছে। বাড়িওয়ালা যেই শুনে বাড়ি ভাড়ার জন্যে একজন এসেছে তখনই ভুরু কুঁচকে ফেলে এবং চোখ সরু করে ফেলে। পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কয়েকবার তাকায়। যাচাই করতে চেষ্টা করে ভাড়াটে কেমন। প্রাথমিক যাচাইয়ের পর শুরু হয় প্রশ্নপর্ব–

কি করেন। আপনি?

রশীদ আলি বিনীতভাবে বলেন, মাস্টারি করতাম। সম্প্রতি রিটায়ার করেছি। অবসর জীবনযাপন করছি।

বাড়ি ভাড়া কে নেবে?

জ্বি, আমি নেব।

বাড়িওয়ালার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তাকে দেখেই বোঝা যায় সে এই মূহূর্তে ভাবছে–রিটায়ার্ড স্কুল-টিচার মাসে চার হাজার টাকা ভাড়া দেবে কি ভাবে? চক্ষুলজ্জার জন্যে প্রশ্নটা করতে পারে না। অনেকে চক্ষুলজ্জার ধার ধারে না। সরাসরি জিজ্ঞেস করে–

রিটায়ার করেছেন, আপনার সোর্স অব ইনকাম কি? বাড়ি ভাড়া দেবেন। কি ভাবে?

আমি এখনো কিছু কাজকর্ম করি। ছাত্র-ছাত্রী পড়াই।

প্রাইভেট টিউশ্যনি।

জ্বি।

ফ্যামিলি মেম্বার কত?

আমার দুই ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী।

ছেলেমেয়েরা সব আপনার সঙ্গে থাকে?

বড়মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে–বাকি তিনজন আমার সঙ্গে থাকে।

ছেলে দুজন কত বড়?

এইখানে তাঁকে আবার কিছু মিথ্যা বলতে হয়–বড় ছেলে এম. এ. পাশ করে চাকরি খুঁজছে। এটা বলামাত্রই বাড়িওয়ালা না করে দেয়। কাজেই এইখানে এখন তিনি বলেন–ছেলে ব্যবসা করছে।

কি ধরনের ব্যবসা?

আমি ঠিক জানি না।

ছেলেকে একদিন নিয়ে আসুন। তার সঙ্গে কথা বলি।

ছেলেকে আনতে হবে?

জ্বি, নিয়ে আসুন। আপনি বুড়ো মানুষ। আপনার সঙ্গে কি কথা বলব? আপনার ছেলের সঙ্গেই কথা বলি। কাল বিকেলে তাকে নিয়ে আসুন।

রশীদ সাহেব ছেলেকে নিয়ে আসেন না। সামান্য একটা বাড়ি ভাড়ার জন্যে ছেলেমেয়ে সবাইকে এনে কুমীরের বাচ্চার মত দেখাতে হবে? সব বাড়িওয়ালা তাঁকে সন্দেহের চোখে কেন দেখছে তাও তিনি বুঝতে পারেন না। তিনি বুড়ো হয়ে পড়েছেন এই জন্যেই? অক্ষম। অপদাৰ্থ হয়ে গেছেন? বুড়োদের সম্পমান এবং শ্রদ্ধার চোখে দেখাই নিয়ম। সেই নিয়ম কি পাল্টে গেছে? আজকাল নাপিতের দোকান দেখলেই তার ইচ্ছা করে চুলে কলপ দিতে। সাদা চুলগুলিকে কুচকুচে কালো করে ফেলে সমাজে ফিরে আসার একটা চেষ্টা কি করা যায় না? তাঁর কাল চুল দেখে বাসার সবাই অদ্ভূত চোখে তাকাবে। সালমা বিস্মিত হয়ে বলবে, কি হয়েছে? তোমাকে অন্য রকম লাগছে কেন?

বলুক না। কি যায় আসে?

বাড়ি দেখতে দেখতে হঠাৎ হঠাৎ কোন একটা বাড়ির সামনে এসে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে যান। চোখের সামনে স্বপ্নের মত একটা বাড়ি। মনে হয় কেউ একজন তার জন্যেই এই বাড়ি বানিয়ে রেখেছে। গত বৃহস্পতিবার এরকম একটা বাড়ি দেখলেন। টিনের একটা একতলা বাড়ি। সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। চারদিকে ঝোপঝাড়ের মত গাছপালা। বেশ কয়েকটা সুপারিগাছ। বাড়ির উত্তর দিকে একটা চালতা গাছ। কতদিন পরে চালতা গাছ দেখলেন। থোকা থোকা হলুদ ফুল ফুটে আছে। বাড়ির নামটা এই বাড়ির ছাদে ঝমঝম শব্দ হবে। এই শব্দের কি কোন তুলনা হয়? বাড়িটার সামনে থেকে যেতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক বের হয়ে কর্কশ গলায় বললেন, কি চাই? তিনি লজ্জিত গলায় বললেন, জ্বি না, কিছু চাই না।

কিছু চান না, তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আধাঘণ্টা ধরে বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করছেন–আর বলেন কিছু চাই না। ব্যাপারটা কি?

কিছু না। কিছু না।

ভদ্রলোক আগুনচোখে তাকিয়ে রইলেন আর তিনি প্রায় মাথা নিচু করে চলে এলেন। হঠাৎ তাঁর শরীরটা ক্লান্ত লাগল। মনে হল পা চলছে না। পথেই মুখ থুবড়ে পড়ে।

তাঁর ধারণা তাঁকে ডায়াবেটিসেও ধরেছে। রাতে খুব ঘন ঘন পানির পিপাসা হয়। তিনি শুনেছেন, ডায়াবেটিস রোগের প্রথম লক্ষণ তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে যাওয়া, যা তার বেলায় হচ্ছে। একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। টেস্ট-ফেস্ট করানো দরকার। টেস্ট করানো মানেই একগাদা টাকা খরচ। টাকা খরচ করতে তাঁর মায়া লাগে। খুব কষ্ট করে উপাৰ্জন করা টাকা। লটারিতে জিতে পাওয়া টাকা না। ইংরেজ্বি গ্রামার, রচনা, কোশ্চেন-আনসার প্রায় নিবোধ একদল ছাত্রীকে পাখি পড়ার মত শিখাতে হয়। শিক্ষাদানের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে তিনি শিক্ষা দিচ্ছেন। মাসের শেষে টাকা নিচ্ছেন। যেন মুদি দোকান দিয়েছেন। জিনিশ বিক্রি করে টাকা নিয়ে নেয়া।

কোন কোন ছাত্রী মাস শেষ হবার পরেও টাকা দেয় না। এক ফাঁকে বলে, সামনের মাসে দেব স্যার। এই মাসে বাবার হাত খালি। তিনি মাথা নাড়েন। সেই মাথা নাড়া অর্থহীন মাথা নাড়া। তার কাছে মনে হয় এই মেয়েটি যেন বাকিতে জিনিশ নিচ্ছে।

এ রকম জীবনযাপনের কোন মানে হয়? প্রায় রাতেই তার ইচ্ছা করে পায়জামাপাঞ্জাবি এবং স্যান্ডেল পায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়তে। হাঁটতে থাকবেন। হাঁটতেই থাকবেন। মাঝে মাঝে শুধু দিক ঠিক করে নেয়া–দক্ষিণ। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় না। এক সময় সমুদ্রের পাড়ে এসে থেমে যাবেন। তাঁর সাতষট্টি বৎসর বয়স হয়েছে। তিনি সমূদ্র দেখেননি। কেউ বললে বিশ্বাস করবে? করবে না। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। যে কোন একদিন বাথরুমে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবেন। আর ওঠা হবে না। হাঁটতে হাটতে সমুদ্রের পারে এসে মরতে পারলে মন্দ হয় না।

 

রাত তিনটা বাজে। রশীদ আলি তৃতীয়বারের মত বিছানা ছেড়ে উঠেছেন। কবার তাঁর প্রায় ঘুম এসে গিয়েছিল, গুনগুন শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে। শব্দটা আসছে ফরহাদের ঘর থেকে। গানের মত শব্দ। রাত তিনটায় সে গান গাইবে কেন? এটা কি গান গাওয়ার সময়?

রশীদ আলির মাথার রাগ দপ দপ করছে। বমি-বমি ভাবও হচ্ছে। তিনি স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বারান্দায় এলেন। বারান্দা থেকে ফরহাদের গুনগুন শব্দ আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সে গান গাইছে না, পড়ছে।

তিনি ছেলের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। ফরহাদ দরজা খুলে দিল। রশীদ আলি বললেন, কি করছিস?

ফরহাদ বলল, পড়ছি।

রাত তিনটার সময় কিসের পড়া?

ফরহাদ মাথা চুলকালো। সে বুঝতে পারছে না। তার বাবা এত রেগে যাচ্ছেন কেন? ছেলেমেয়েকে গভীর রাতে পড়তে দেখলে যে কোন বাবা খুশি হন। তার বাবা হচ্ছেন না কেন?

রশীদ আলি থমথমে গলায় বললেন, ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার। রাত তিনটার সময় বিদ্যাসাগর সেজেছো? জুতাপেটা করে বিদ্যার ভূত নামিয়ে দেবী। যা, ঘুমুতে যা। বাতি নেভা।

ফরহাদ তৎক্ষণাৎ বাতি নিভিয়ে দিল।

একটা টু-শব্দ যেন না শুনি। কোন রকম গুনগুনানি শুনতে চাই না। দরজা বন্ধ করা। ছিটিকিনি লাগা।

ফরহাদ ছিটিকিনি লগোল। তিনি ছিটিকিনির খটখট শব্দ শুনে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। তার আবারো পানির তৃষ্ণ হলা। তিনি জগ থেকে ঢেলে পানি খেলেন। তখন বাথরুম পেয়ে গেল। বাথরুম সেরে চোখে-মুখে পানি দিয়ে তিনি আবার ঘুমুতে গেলেন। ঘন ঘন হাই উঠছে। ঘুম হয়ত এসে যাবে। তিনি ঘড়ি দেখলেন। তিনটা এগারো। মাত্র এগারো মিনিট পার হয়েছে অথচ তার কাছে মনে হচ্ছিল এক ঘণ্টার মত পার হয়েছে।

বালিশে মাথা লাগবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঝিমুনির মত এসে গেল। তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন–ব্যাগ গোছাচ্ছেন–ট্রেন ধরতে হবে। ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। অথচ ব্যাগ গোছানো হচ্ছে না। সারা বিছানায় অসংখ্য জিনিস। এবং অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস। পিতলের কলসি আছে, কয়েকটা খালি হরলিক্সের কৌটা একটা ফুটবল পাম্প করার পাম্পার। এইসব হাবিজাবি জিনিস তিনি কেন ব্যাগে ভরছেন বুঝতে পারছেন না। জায়গা হচ্ছে না। ঠাসাঠাসি করে ভরতে হচ্ছে। এর মধ্যে আবারো ট্রেনের হুইসেলের শব্দ। ট্রেনের হুইসেলের শব্দ ছাপিয়ে অন্য রকম শব্দ আসছে। মশার পিন পিন শব্দের মত শব্দ। শব্দটা বাড়ছে। এটা কিসের শব্দ? মশা? না, মশা না। গানের গুনগুনানির মত শব্দ। কে যেন গান গাইছে। তা হলে কি ফরহাদ আবার বই নিয়ে বসেছে? তাকে না। বলে আসা হল সে যেন বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে? স্বপ্নের মধ্যেই তিনি তাঁর স্ত্রীকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন–তুমি ওকে বল ও যেন গুনগুন না করে।

সালমা বানু বললেন, আহা পড়ুক। ভাল রেজাল্য করতে চায়।

গাধা আবার ভাল রেজাল্ট কি করবে?

আহা গাধা বলছি কেন?

গাধাকে কি বলব? মহিষ বলব?

ফরহাদ পড়ছে। তার গলার স্বর ক্রমেই উঠছে। কোমল সা থেকে মন্দ্র সপ্তকের সা। আরো বাসরে–গলা আরো চড়ছে।

তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি শুনলেন, ফরহাদ পড়ছে। গুনগুন শব্দে পড়ছে। তিনি বিছানা থেকে শান্ত ভাঙ্গতে নামলেন। দরজা খুলে বারান্দায় এলেন। ফরহাদের ঘরের বাতি নেভানো। তাকে জাগতে দেখে বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। বদমায়েশির একটা সীমা থাকা দরকার। বার করছি তোমার গুনগুনানি। তিনি ফরহাদের দরজায় লাথি দিলেন।

ফরহাদ দরজা খুলে বের হয়ে এল। বাবাকে দেখে তার মুখ শুকিয়ে গেল।

এই বদমায়েশ! তোকে না বললাম ঘুমিয়ে পড়তে? আমার সাথে রংবাজ্বি করছিস? রঙিলা হয়েছিস?

বাবা, আমি ঘুমাচ্ছিলাম।

আবার মিথ্যা কথা?

রশীদ আলি তার শরীরের প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ছেলের গালে চড় বসালেন। ফরহাদ হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। রশীদ আলির কাছে মনে হল ফরহাদের ঠোঁটের কোণে হাসি। তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন, হাসছিস কেন?

ফরহাদ কি যেন বলল। তিনি শুনতে পেলেন না। ছেলের গায়ে প্রচণ্ড এক লাথি বসালেন। ব্যথায় তার নিজের পা মনে হল খুলে পড়ে যাচ্ছে।

আতাহার তার ঘর থেকে বের হয়েছে। হৈ-চৈয়ের কারণ সে বুঝতে পারছে না। বাসায় কিছু একটা হচ্ছে। সেটা কি? মিলি বাসায় নেই, সে হাসপাতালে–মার সঙ্গে। ফরহাদের কিছু হয়েছে কি? রাত-বিরেতে হঠাৎ হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আতাহার ফরহাদের ঘরের দরজার সামনে এসে এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখল। বাবা ফরহাদের গায়েমাথায় লাথির পর লাথি মেরে যাচ্ছেন। ফরহাদ রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বাবাকে দেখছে।

আতাহার বলল, বাবা, কি হয়েছে?

রশীদ আলি দরজার দিকে তাকালেন।

আতাহার বলল, বাবা, আপনার কি শরীর খারাপ?

রশীদ আলি জড়ানো গলায় বললেন, হ্যাঁ আমার শরীরটা খারাপ। ঘুম হচ্ছে না–বলেই দেয়াল ধরার চেষ্টা করলেন। তিনি পড়েই যেতেন, তার আগেই আতাহার তাকে ধরে ফেলল এবং তার ঠিক দশ মিনিটের মাথায় তিনি মারা গেলেন।

 

মৃত্যুর আগে আগে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছিল এবং তিনি খুব ঘামছিলেন। হাঁপরের মত শ্বাস টানতে টানতে তিনি ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা রে, আমি খুবই লজ্জিত। খুবই দুঃখিত। আমি তোর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

ফজরের আজান হওয়া পর্যন্ত দুই ভাই মূর্তির মত মুখোমুখি বসে রইল। ফরহাদ মাঝে মাঝে ফোপানির মত শব্দ করছে। তবে কাঁদছে বলে মনে হচ্ছে না। আতাহার একবার শুধু বলল, কাঁদস না। তাতে ফরহাদের ফোপানি থামল না। তবে সে মনে হয় কাঁদছে না। এ রকম শব্দ করে মানুষ কাঁদে না। বড় ধরনের শারীরিক কষ্টের সময় মানুষ এরকম শব্দ করে। স্বজনের মৃত্যুর কষ্ট শারীরিক কষ্ট নয়, এই কষ্ট মাথার ভেতরে হয়।

আতাহারের মাথার ভেতরটা খালি হয়ে গেছে। খালি পেটে প্রচুর সিগারেট খেলে যে রকম লাগে। সে রকম লাগছে। বমিভাবও হচ্ছে। নাকে ঝাঁঝালো গন্ধ লাগছে। ঝাঝালো গন্ধ লাগার কোন কারণ নেই। কেন লাগছে কে জানে। রসূনের গন্ধের মত গন্ধ। মৃত মানুষের শরীর থেকে কি রসূনের গন্ধের মত কোন গন্ধ আসে?

সামনের দিনটা ভয়ংকর। সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা ছাঁটা পর্যন্ত অনেক কিছু করতে হবে। মাকে খবর দিতে হবে। তাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসতে হবে। আত্মীয়স্বজনদের খবর দিতে হবে। মনিকাকে একটা টেলিফোন করতে হবে। মৃতদেহ ধোয়ানোর একটা ব্যাপার আছে। অনেক জটিল নিয়ম কানুন। এইসব নিয়ম কানুন যারা জানে তাদের খবর দিয়ে আনতে হবে। কবর কোথায় দেয়া হবে? কবর দেয়ার নিয়মকানুন কি? কোথায় যেতে হবে? কার কাছে যেতে হবে? এইসব ব্যাপারে সবচে ভাল যে জানত তার নাম মজিদ। সে পড়ে আছে নেত্রকোনায়।

আতাহার ক্ষীণ স্বরে ডাকল, ফরহাদ!

ফরহাদ কিছু বলল না, তবে তার অদ্ভুত ফোপানি বন্ধ করল।

আতাহার বলল, ফজরের আজান হলেই আমি মাকে খবর দিতে যাব হাসপাতালে–তুই একা একা থাকতে পারবি না?

হুঁ।

বাড়িওয়ালাকে খবর দিস–চলে আসবে।

হুঁ।

কয়টা কাজে দেখ তো?

ফরহাদ নড়ল না–বসেই রইল। সময় দেখার তার কোন ইচ্ছে নেই। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। ঘরে বাতি জ্বলছে, তারপরেও অন্ধকার। আতাহার এর কারণটা ধরতে পারছে না। তার প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছে সিগারেট খাবার। সিগারেট খাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। জীবিত বাবার সামনে সে কোনদিন সিগারেট খায়নি–আজ মৃত বাবাকে খাটে শুইয়ে রেখে সিগারেট ধরানোটা কি ঠিক হবে?

না, ঠিক হবে না। অন্যায় হবে এবং ভুল হবে। আতাহার বারান্দায় এসে সিগারেট ধরাল। বাবার কাছে সে বড় একটা অপরাধ এক সময় করেছিল। সেই অপরাধের জন্যে সে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। মৃত মানুষের কাছে কি ক্ষমা প্রার্থনা করা যায়? করা না গেলেও সে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

তার বাবা তাকে দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন নাখালপাড়ায়। তার এক ছাত্রীর কাছে লেখা চিঠি। চিঠি দেবার সময় বিব্রত গলায় বলেছিলেন–ওর হাতেই দিবি। অন্য কারো হাতে না। ছাত্রীর নাম ফরিদা। আতাহার নাখালপাড়া গিয়েছিল–কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিঠিটি তার হাতে দেয়নি। হঠাৎ তার ইচ্ছা হয়েছিল–জানতে, কি এমন লেখা চিঠিতে যা অন্য কারো কাছে দেয়া যাবে না। এটা কি কোন গোপন প্ৰণয়ের ব্যাপার? মানুষের নানান দুর্বলতা থাকে। খাঁটি হীরাতেও ত্রুটি থাকে। চিঠি পড়ে আতাহার বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল–চিঠিতে রশীদ সাহেব তার ছাত্রীকে লিখছিলেন–

মা ফরিদা,

আমার বড় মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা তুমি করে দিয়েছিলে। আমার দ্বিতীয় মেয়েটির জন্যে একজন ছেলে দেখে দাও মা। জীবনযুদ্ধে আমি পরাজিত হয়েছি। নিজের উপর বিশ্বাস এবং আস্থাও হারিয়ে ফেলেছি। এখন কেবলই মনে হয়, আমি নিজে কিছুই করতে পারব না। আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। সব মানুষই তার অসুস্থ স্ত্রীর আরোগ্যের জন্যে প্রার্থনা করে। আমি একমাত্র ব্যতিক্রম। আমি সালমার আরোগ্যের জন্যে কখনো আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি নাই। আমি চাই আমার আগে তার মৃত্যু হোক। যদি তার আগে আমার মৃত্যু হয় তাহলে সে বড়ই কষ্টে পড়বে। তার জন্যে এই কষ্ট আমার কাম্য নয়।

মা, তুমি গত ঈদে আমার স্ত্রীকে যে কম্বলটি উপহার দিয়েছ, সেই কম্বল সে সব সময় ব্যবহার করে। হাসপাতালে যাবার সময়ও সে সেই কম্বললটি সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।

মা, অনেক অপ্রিয় কথা লিখে ফেললাম। বৃদ্ধ শিক্ষকের ভাবালুত ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখো।

ভাল থেকে।

তোমার স্বামী এবং পুত্র-কন্যাদের নিত্য মঙ্গল কামনা করি।

তোমার স্যার
রশীদ আলি

 

সকাল হচ্ছে। মসজিদে আজান হল। আকাশ মেঘলা বলে এখনো চারপাশ অন্ধকার। আতাহার বের হয়েছে। প্রথমে যাবে হাসপাতালে। দিনের শুরুতে কাউকে মৃত্যু সংবাদের মত ভয়াবহ সংবাদ কি দিতে আছে?

না, দিতে নেই।

রাস্তায় রিকশা আছে। তবু আতাহার হেঁটে রওনা হল। রিকশায় দ্রুত যাবার দরকার নেই। যত দেরিতে পৌঁছানো যায় ততই ভাল।

হাসপাতালের গেটের কাছে এসে আতাহার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। সে রওনা হল নীতুদের বাড়ির দিকে। হেঁটে হেঁটে রওনা হল। আজ তার ইচ্ছা করছে। সারাদিন শুধু হাঁটতে। ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি অলি-গলি হাঁটতে কতক্ষণ লাগবে? আতাহার মনে মনে বলল, আমি নাগরিক এক কবি। নাগরিক কবি হিসেবে এই শহরের প্রতিটি রাস্তায় আমার পদচিহ্ন থাকা উচিত।

নীতু দরজা খুলেই বলল, এত সকালে?

আতাহার কিছু বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

নীতু বলল, নাশতা খাবেন?

আতাহার বলল, হুঁ।

আপনার কি শরীর-টরীর খারাপ নাকি? আপনাকে কেমন যেন অদ্ভূত দেখাচ্ছে।

দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।

না, বসব না।

কি অদ্ভুত কথা! বসবেন না, মানে নাশতা খাবেন কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

নাশতা খাব না রে নীতু। চলে যাব।

আপনার কি হয়েছে আতাহার ভাই, বলুন তো? আপনি এই চেয়ারটায় বসুন। তারপর বলুন। আপনাকে ভয়ংকর ক্লান্ত লাগছে।

অনেকটা রাস্তা হেঁটে এসেছি।

হেঁটে এসেছেন কেন? রিকশাভাড়া ছিল না?

হেঁটে আসতে আসতে মনে মনে একটা দীর্ঘ কবিতা লিখেছি। কবিতার পুরোটা মাথার ভেতর লেখা হয়েছে।

কাগজ-কলম। এনে দেব? লিখবেন?

না। বাবাকে নিয়ে এই প্রথম একটা কবিতা লিখলাম।

আপনার মা কি সুস্থ আছেন আতাহার ভাই?

হ্যাঁ, মা ভাল আছেন। বাবাকে নিয়ে যে কবিতাটি লিখেছি তার পেছনে একটা মজার ইতিহাস আছে। শুনবি?

আপনার জন্যে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি–তারপর শুনি।

না, চা খাব না। ইতিহাসটা শোন। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। স্কাউট জাম্বাবুরিতে যাব। খুব ভোরে ট্রেন। আমি জেগে বসে আছি–আমার ভয়–একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর সকালে উঠতে পারব না। বাবা বললেন–বটু শোন, তুই আরাম করে ঘুমা। আমি বরাদ্দায় জেগে বসে থাকব। বাবা সারারাত জেগে বসেছিলেন। আমি নিশ্চিন্তু মনে ঘুমিয়েছি। কবিতাটা শুনিবি?

বলুন।

আমার ভোরের ট্রেন, বাবা বলিলেন,
ঘুমো তুই ডেকে দেব ফজরের আগে।

নীতু অবাক হয়ে দেখল আতাহারের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। গলা ধরে যাওয়ার‍্য কবিতার বাকি লাইনগুলি সে বলতে পারছে না। সে আতাহারের হাত ধরে বলল, কি হয়েছে আতাহার ভাই?

বাবা গত রাতে মারা গেছেন।

নীতু সঙ্গে সঙ্গেই আতাহারকে জড়িয়ে ধরল। চিরন্তন মমতাময়ী নারী তার সুবিশাল বাহু প্রসারিত করল। আতাহার কাঁপছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নীতু তার পিঠে গভীর মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

 

চৌদ্দ ঘণ্টা আগেও একটা মানুষ জীবিত ছিল। তার হৃদপিন্দ ধ্বক করে স্পাদিত হচ্ছিল। গভীর আনন্দে তার শরীরের লোহিত কণিকারা অক্সিজেন নিয়ে ছোটাছুটি করছিল। তাদের ব্যস্ততার সীমা ছিল না, এই অক্সিজেন নিয়ে ছুটে যাওয়া, আবার কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে দেয়ার জন্যে দৌড়ানো। আজ তাদের কোন ব্যস্ততা নেই। তারাও নিশ্চয়ই গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবছে–ব্যাপারটা কি?

মৌলানা সাহেব আতাহারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি কাব্বরে নামবেন?

কব্বর শব্দটা আতাহারের কানে খট করে বাজল। মৌলানা সাহেব কবর কে কব্বর বলছেন কেন? কবরের আরবী কি কব্বর?

আতাহারের ভুরু কুঁচকে গেল। কত তুচ্ছতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তার মস্তিষ্ক এখন ব্যস্ত। কবরের আরবী কবর হলেই বা কি না হলেই বা কি? তবু মস্তিষ্কের নিউরোন ব্যস্ত হয়ে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে ভাবছে। সে হয়ত অতি যত্নে মস্তিকের মেমরি সেলে এই তথ্য জমা করে রাখবে–কোন এক সময় আতাহার তার কোন কবিতায় ব্যবহার করবে–কব্বর।

তিনি শায়িত ছিলেন গাঢ় কব্বরে
যার দৈর্ঘ-প্রস্থ বেঁধে দেয়া,
গভীরতা নয়।
কব্বরে শুয়ে তার হাত কাঁপে পা কাঁপে
গভীর বিস্ময়বোধ হয়।
মনে জাগে নানা সংশয়।
মৃত্যু তো এসে গেছে, শুয়ে আছে পাশে
তবু কেন কাটে না এ বেহুদা সংশয়?

ভাইজান নামেন, কব্বরে নামেন।

আতাহার বলল, কেন, কবরে নামব কেন?

এইটাই নিয়ম। পুত্র নিজের হাতে পিতার দেহ নামাবে।

নিয়ম তো জীবিতদের জন্যে। মৃতদের জন্য আবার নিয়ম কি?

মৌলানা বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছেন। আতাহার নিজেও তার নিজের কথায় বিস্মিত হচ্ছে। কি বলছে সব পাগলের মত? সে একই শুধু পাগলের মত আচরণ করছে। কই আর কেউ তো করছে না। ফরহাদ চিৎকার করে কাঁদছে। একজন বয়স্ক পুরুষের এই ভঙ্গিতে কান্না হাস্যকর। তারপরেও এই হাস্যকর ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগছে।

পিতার মৃত্যুতে পুত্র-কন্যারা কাঁদবেই। কাদাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আতাহার কাঁদতে পারছে না। তার বিরক্তি বোধ হচ্ছে।

বৃষয়ি পড়তে শুরু করছে। বেশ ভাল বৃষ্টি। কবরের ভেতর বৃষ্টির পানি জমতে শুরু করেছে। বৃষ্টির জমা পানি রশীদ সাহেবের খুব অপছন্দ ছিল। সেই অপছন্দের জিনিসটা তাঁর মৃত্যুর সময় ঘটল। তাঁকে শুইয়ে দিতে হল পানির ভেতর।

মৌলানা সাহেব বললেন, পানির মধ্যে লাশ রাখা হয়েছে। এই জন্যে কেউ মন খারাপ করবেন না। পানি হল আল্লাহ পাকের রহমত।

না, আতাহার মন খারাপ করছে না। বরং তার ভাল লাগছে। এই ভেবে যে, প্রবল বৃষ্টি হঠাৎ শুরু হওয়ায় দাফন পর্ব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। এখন বাসায় ফেরা যায়।

আতাহারের বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। তার মাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাসায় ফিরে তাকে কি অবস্থায় সে দেখবে কে জানে? তিনি, মিলি এবং ফরহাদ মিলে কান্নার কোরাস শুরু করবে–সেখানে আতাহার যোগ দিতে পারবে না। ব্যাপারটা তার নিজের জন্যেও অস্বস্তিকর, আপেপাশে যারা থাকবে তাদের জন্যেও অস্বস্তিকর।

সালমা বানুকে যখন বাসায় নিয়ে আসা হয়েছিল তখন তাঁর জ্ঞান পুরোপুরি ছিল। কিন্তু তিনি স্বাভাবিক আচরণ করেননি। শান্ত গলায় বলেছেন, মনিকাকে কি খবর দেয়া হয়েছে? ওকে খবরটা দেয়া দরকার। আত্মীয়স্বজন সবাইকে কি বলা হয়েছে? কেউ যেন বাদ না থাকে। গ্রামের বাড়িতে খবর দেয়া দরকার। হিরনপুর পোস্টাপিসের হেড মাস্টারকে খবর দিলেই খবর পৌঁছে যাবে। এইসব কথা খুবই যুক্তির কথা। প্রবল শোকে মানুষের যুক্তির ব্যাপারটা নষ্ট হয়ে যায়। সালমা বানুর নষ্ট হয়নি–তার অর্থ প্রবল শোক তিনি অনুভব করছেন না। তিনি আছেন ঘোরের মধ্যে। মস্তিষ্কের যে অংশ শোক অনুভব করে সেই অংশ অকেজো হয়ে আছে।

মৃতদেহ ধোয়ানোর ব্যাপার যখন এল তখন সালমা বানু হঠাৎ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, এ কি, ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল দেয়া হচ্ছে? সবার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? তোর বাবা সারাজীবন গরম পানি দিয়ে গোসল করেছে। ভাদ্র মাসের গরমেও তার জন্যে পানি গরম করতে হয়। তোরা বেআক্কেলের মত ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল দিচ্ছিস? মানুষটা মরে গেছে বলে যা-ইচ্ছা-তাই করবি?

বলেই তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। সেই কান্না প্রিয়জনের মৃত্যুর শোকের কান্না না–প্রিয় মানুষটিকে কেন ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করানো হল সেই দুঃখের কান্না। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন। চারদিকে তাকান, কাউকে চিনতে পারেন না। আতাহার বলল, মাকে হাসপাতালে দিয়ে আসি?

মিলি বলল, আজ দিনটা মা থাকুক। কাল দিয়ে এলেই হবে।

এমন প্রবল শোকের বাড়িতে মানুষের যেতে ইচ্ছে করে না। তবু আতাহারকে যেতে হচ্ছে। ভিজতে ভিজতে যে সে যাবে সে উপায় নেই। অচেনা একজন মানুষ তার মাথার উপর ছাত ধরে আছে। মানুষটার গা থেকে বিকট ঘামের গন্ধ আসছে। আতাহারের বলার ইচ্ছা করছে–ভাইজান, আপনি লাইফবয় সাবান দিয়ে গোসল করবেন। টিভির বিজ্ঞাপনে দেখেছি–লাইফবয় সাবান দিয়ে গোসল করলে ঘামের গন্ধ চলে যায়। দয়া করে বগলে সাবান বেশি করে মাখবেন। একশ হর্স পাওয়ারের গন্ধ আপনার বগল থেকে আসছে। ছাতা উঁচু করে ধরায় আপনার বর্গল ফ্রি হয়েছে–ভুর ভূর করে গন্ধ আসছে। ভুর ভর করে গন্ধ আসছে বলাটা ঠিক হবে না। ভুর ভূর করে আসে মিষ্টি গন্ধু। বাদ ঘুণ অন্য কোনভাবে আসার কথা। বাংলা সাহিত্যে বন্দ ঘ্রাণ আসার কোন শব্দ কি আছে? রবীন্দ্রনাথ কোন শব্দ তৈরি করে যাননি?

ভুর ভূর করে ফুলের ঘ্রাণ আছের মত কীর কীর করে দুর্গন্ধ আসছে।

বাসার সামনে এসে আতাহার। থমকে দাঁড়াল। সাজ্জাদের লাল ঢয়োটা দাঁড়িয়ে আছে। সাজ্জাদ বসে আছে গাড়ির ভিতর। গাড়ির সব কাচ ওঠানো। মনে হয় সাজ্জাদ ক্রমাগত সিগারেট খাচ্ছে। গাড়ির ভেতরটা ধোয়ায় ভর্তি হয়ে আছে। সাজ্জাদ গাড়ির কাচ নামিয়ে বলল, আতাহার, উঠে আয়। আতাহার গাড়িতে উঠে পড়ল। সাজ্জাদ বলল, আতাহার, তোকে আমি কি ভাবে সান্তনা দেব আমি জানি না। তোর বাবার সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল। অনার্স পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার পর তোকে খবর দেবার জন্যে তোর বাসায় গেলাম। দেখি তুই নেই। তোর বাবা গম্ভীর মুখে বের হয়ে এলেন। কঠিন মুখে বললেন, কি চাই?

আমি বললাম, আতাহারের সঙ্গে একটু দরকার ছিল।

উনি আবার বললেন, দরকারটা কি?

আমি মহা বিরক্ত হয়ে বললাম, আমার অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে সেই খবরটা ওকে দিতে এসেছিলাম।

রেজাল্ট কি?

ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি।

তোর বাবা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কিছুতেই ছাড়েন না। যখন ছাড়লেন তখন দেখি তার চোখে পানি। বুঝলি আতাহার, আমার যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন সুন্দর সুন্দর দৃশ্য কল্পনা করি। তাঁর চোখের পানির দৃশ্য তার মধ্যে একটা।

আতাহার বলল, আমার বাবার সারাজীবনের শখ ছিল তার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হবে। আমরা কেউ সেকেন্ড ডিভিশনের উপর কিছু করতে পারিনি।

সাজ্জাদ সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল। আতাহার বলল, সিগারেট খাব না।

সাজ্জাদ। বলল, সিগারেট না, গাজা। দি গ্রেট গ্রাস। প্রথম শ্রেণীর। যত্ন করে তৈরি করা। থু-তিনটা খা, দেখবি ভাল লাগবে। আমি আজ সকাল থেকে খাচ্ছি।

এখন যাচ্ছিস কোথায়?

লীলাবতীর জন্মদিনের উৎসবে।

লীলাবতীটা কে?

এই পৃথিবীর সেরা রূপবতীদের একজন।

লীলাবতীর কথা তো আর কখনো শুনিনি।

সাজ্জাদ হাসল।

আতাহারের মনে হল, সাজ্জাদের অনেক কিছুই আসলে সে জানে না। পরীক্ষণেই মনে হল–শুধু আতাহার না, সাজ্জাদ নিজেও জানে না।

পরিপূর্ণভাবে নিজেকে যে মানুষ জেনে ফেলে জীবন তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। সে তখন জীবন থেকে মুক্তি কামনা করে। কবি মায়াকোভস্কি নিজেকে জেনে ফেলেছিলেন–কাজেই জীবন তার কাছে অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেই সেই জীবনের ইতি করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *