1 of 3

১৩. যেমন ভ্যাতভ্যাতে বর্ষা তেমনি গুমসোনো গরম

১৩

এবার যেমন ভ্যাতভ্যাতে বর্ষা তেমনি গুমসোনো গরম। দুদিন বৃষ্টি নেই। আকাশ থমকানো মেঘলা। ভেজা মাটির ভাপ আর গুম-ধরা আকাশের মাঝখানটা যেন সেঁকা রুটির পেটের মধ্যেকার মতো। বাতাস নেই, গাছের পাতাটিও নড়ছে না। ঘাম হয়, শ্বাসকষ্ট হয়। দুপুরবেলাটা এই ভ্যাপসা গরমে বড্ড সুনসান। মানুষ দূরের কথা, পথেঘাটে নেড়ী কুকুরটাও ল্যাং ল্যাং করে ঘুরে বেড়ায় না।

একখানা রিক্সা ট্যাঙস ট্যাঙস করতে করতে চলেছে। তাতে মাইক ফিট করা। ফাটা গলায় চিঁহিঁ সুরে প্রচার চলছে। বিশ্ববিজয় অপেরার আগামী পালা আউরঙ্গজে—ব! আউরঙ্গজে—ব!

পালা নামতে এখনও পাক্কা দুটি মাস। বর্ষা না গেলে, ক্ষেতের কাজ শেষ না হলে নামবার কথাও নয়। আহাম্মক ছাড়া এভাবে কেউ গাঁটগচ্চা দেয়?

বটতলায় রিক্সা থামিয়ে পাঁচু সিট থেকে নেমে গামছায় মুখের ঘাম মুছল। নিমাই প্লাস্টিকের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খাচ্ছিল। নিম-গরম জলে তেষ্টা যেতে চায় না। যা গরমটা পড়েছে, জলের কি ঠাণ্ডা থাকার জো আছে? টিপকল থেকে যখন ভরেছিল তখন ভারি ঠাণ্ডা ছিল।

পাঁচু বলল, একটু জিরিয়ে নাও নিমাইদাদা। আমি একটু বিড়ি টেনে নিই। নইলে জুত হচ্ছে না।

নিমাইয়ের তাতে বিশেষ আপত্তি নেই। এই দুপুরে ঘুরে ঘুরে বিশ্ববিজয়ের পালার কথা বলে তেমন লাভও তো হচ্ছে না। শুনছে কি কেউ? শুনলেও গা করছে বলে মনে হয় না। রিক্সা আর মাইকের দিনভর ভাড়া, নিমাইয়ের মজুরি মিলে টাকা কিছু কম যাচ্ছে না। তবে কাকা লোকটাই অমনি। চাপল বাই তো কটক যাই। যত্র আয়, তত্র ব্যয়।

নিমাই নেমে বটতলার বাঁধানো তলায় বসতে গিয়ে আঁতকে উঠল। শান তেতে আছে। রোদ নেই, তবু যে কেন তাতে কে জানে বাবা!

পাঁচু আড়চোখে কাণ্ডটা দেখে বলল, রিক্সার সীটটা নামিয়ে ওটা পেতে বোসো। আমি মকবুলের দোকান থেকে বিড়িটা ধরিয়ে আসছি।

সীটটা পেতেই বসল নিমাই। পাঁচু শিগগির আসবে না। অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে রিক্সা টেনেছে। হাঁপাচ্ছে। মালিকের ভাগেরটা দিয়ে কটা টাকাই বা থাকবে হাতে? মাস দুয়েক আগে টিবি থেকে সেরে উঠেছে। আবার হয়তো শিগগিরই রোগে পড়বে। গরিব মানুষদের বাঁচাও যা, মরাও তা।

নিমাই বিড়িটিড়ি খায় না। শরীরে সয় না তো বটেই, তাছাড়া ওসব তার কাছে বাবুগিরির সামিল। দিনে দশটা করে টাকা আসছে, এটাকে সে টুক টুক করে জমাচ্ছে। বাজারে একখানা দোকানঘর নিয়ে কথাবার্তা চলছে। এখনো বন্দোবস্ত হয়নি। এই ফাঁকে কাকাকে বলে এ কাজে তাকে বহাল করেছে বীণাপাণি। কাজটা খাটুনির নয়। তবে এই গরমে বড় কষ্ট।

কষ্টটাকে গায়ে না মেখে টাকাটা রাখছে নিমাই। শতখানেক হলেই পালপাড়ায় গিয়ে বাবার হাতে তুলে দেবে। আর তখন বুড়োবুড়ির মুখে যে হাসিখানা ফুটবে সেটাতেই জুড়িয়ে যাবে তার প্রাণ। ওই বোকাসোকা দুটো বুড়োবুড়ির জন্য নিমাই না পারে হেন কাজ নেই। কিন্তু কাজই জুটতে চায় না মোটে। দোকানটা হলে বাঁচোয়া। একখানা দোকান হলে সারা দিনমান খদ্দের সামলে সন্ধের পর একখানা কীর্তনের আসরে গিয়ে বসবে— এর চেয়ে বেশি নিমাই আর কিছু চায় না। তার ইচ্ছে ছিল, কীর্তন করে তা থেকে যা জোটে তাই দিয়েই চালিয়ে নেবে। পয়সা না থাক, বুকভরা আনন্দ তো আছে। গলায় সুর ছিল তার। কিন্তু আজকাল গলার আওয়াজটা তার নিজের কানেই ভাল ঠেকছে না। বুকে দমেরও যেন ঘাটতি হচ্ছে।

টাকাপয়সার চিন্তা বড় দূষিত চিন্তা। মনে ঠাঁই দিতে নেই। তবে ঘুরেফিরে কথাটা মনে হয়, সে বড় গরিব। বড় টানাটানির মধ্যে সে বড় হয়েছে। খিদের কষ্ট সইতে পারত না ছেলেবেলায়। কাঁদত। তার কান্না দেখে মাও কাঁদত। ফলপাকুড় পেড়ে খাবে তা সেরকম ফলন্ত গাছও ছিল না পালপাড়ায়।

তবে ভগবানের দয়াটা আছেই। খিদের কষ্ট পেতে পেতেই আস্তে আস্তে খিদেটা সয়ে যেতে লাগল। মানুষের দাঁতে ব্যথা হয়, মাথা ধরে, জ্বরজারি হয়, লোকে সয়ে থাকে না সেসব? খিদেটাও সেরকম আধিব্যাধি ঠাউরে নিল সে। ও যেন দাঁতের ব্যথা, পেটের ব্যামো। আজ আর খিদেকে ভয় নেই তার। খাওয়ার কষ্টটাও নেই। ইদানীং বেশ খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে তাদের। গেলবার তো বীণাপাণি একটু সরু চালই কিনে ফেলল। দোবেলা মাছ হচ্ছে। ডালের পাতে পটল বা ঢ্যাড়শ ভাজা জুটে যাচ্ছে। গত দু মাসে না হোক তিনবার মাংস হয়েছে। এ সময়টায় এই অপয়া বর্ষায় বীণাপাণির হাতে বাড়তি টাকা থাকার কথাই নয়। তবে আসছে কোত্থেকে?

দুপুরের এই ঝিমধরা গরমে প্রশ্নটা নিয়ে খুব ভাবিত হল সে। গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে লাগল। কাকা ভাল লোক, কিন্তু গাড়ল তো নয় যে, এই যাত্রার আকালে বেশী করে টাকা দিচ্ছে বীণাকে!

তবে কি অন্য কেউ দিচ্ছে? দিলে তো বলতে হবে, দেওয়াটা ধৰ্মত ন্যায্যত দিচ্ছে না, ভিতরে মতলব আছে। ধর্মে টাকা নেই, অধর্মে আছে। অধর্মের টাকা বড্ড হুড় হুড় করে আসে, সামাল দেওয়া যায় না।

পাঁচু একটা বিড়ি শেষ করে আর একখানা ধরিয়ে এসে ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু কনুই চুলকুলো, একটা হাই তুললল, তারপর উদাস গলায় বলল, আরও ঘুরবে নাকি? তার চেয়ে একটু জিরোই চলো। তুমি এদিকটায় গদি মাথায় দিয়ে শোও, আমি ওদিকটায় একটু গড়িয়ে নিই। বেজায় গরম।

নিমাই রাজি হয়ে গেল। বলল, ঘণ্টাখানেকের বেশী নয় কিন্তু। বটতলা খারাপ জায়গা, কেউ দেখে ফেলতে পারে।

কেউ দেখবে না। আর দেখলেই কি? মানুষের শরীর তো, নাকি?

নিমাই কথা বাড়াল না। শুয়ে পড়ল। ঘুমটাও আসত। তবে চিন্তাটা বড্ড কুটকুট করছে বলে ঘুমটা চোখের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল। বীণাকে টাকাটা দিচ্ছে কে? এই যে সকাল থেকে বিকেল অবধি মাইক খুঁকে বেড়ানোর চাকরিটা বীণা তাকে জোগাড় করে দিয়েছে তার পিছনে মতলব নেই তো! এই ভরদুপুরে কি কেউ আসে-টাসে বীণার কাছে?

মন বড় পাপী। কথাটা মনে হতেই জিব কাটে নিমাই। ছিঃ ছিঃ, বীণা তার জন্য জান কিছু কম চুঁইয়েছে? সে চলে যাচ্ছিল, নিজেই সেধে যেচে রেখেছে। আজ অবধি এই পাপ-মুখে সে বলতে পারবে না যে, বীণার কিছু বেগোছ দেখেছে। তবে কথাটা মনে হচ্ছে কেন? একবার গিয়ে চুপি চুপি হাজির হবে নাকি বাড়িতে? গিয়ে যদি সত্যিই দেখতে পায় যে, বীণা পরপুরুষের সঙ্গ করছে, তাহলে? তাহলেই কি কিছু করতে পারবে নিমাই? দু ঘা কষাতে পারবে লোকটাকে? নাকি পারবে বীণাকেই ধমক চমক করতে? ওসব গণ্ডগোলে না পড়ে যাওয়াটাই তার পক্ষে মঙ্গল। গিয়ে কিছু বেগোছ দেখলে বিপদ তারই।

ঘুমটা এল আচমকা, নোটিস না দিয়ে। ঘুমিয়ে মেলা স্বপ্ন দেখতে লাগল নিমাই। একটা স্বপ্ন ভারি ভাল। তার মা মর্তমান কলা আর দুধ দিয়ে চিঁড়ে মেখে খুব খাচ্ছে এক ডেলা গুড় দিয়ে।

ও নিমাইচন্দ্র, ওঠো! ওঠো!

নিমাই উঠে বসে। ঘেমে একেবারে চান করে উঠেছে।

ডাকনি কেন?

মেঘ চমকাচ্ছে। নামল বলে।

নিমাই একবার ময়লা কালো আকাশের দিকে চেয়ে বলল, নামলে বাঁচি। যা পচা গরমটা পড়েছে!

কোনদিক যাবে এবার? আমাদের টাইম কিন্তু শেষ হয়েছে।

তাহলে বাজারপানেই চল। মাইক-টাইক সব বুঝিয়ে ফেরত দিয়ে দিই।

পোকাটা অনেকক্ষণ কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। মাথাটা ঠিক নেই, বীণা টাকাটা পাচ্ছে কোথা থেকে?

ব্রজবাসীর মাইকের দোকান অবধি পৌঁছাতে পারল না তারা। তার আগেই রেলগাড়ির মতো একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা এল, আর তার পিছু পিছু রসমুণ্ডির মতো বড় বড় ফোঁটায় হরির লুঠ ছড়াতে ছড়াতে বৃষ্টি।

ভিজে চুব্বুস হয়ে ব্ৰজর দোকানে উঠে পড়ল দুজন। ব্রজবাসীর ছোকরা কর্মচারী যন্ত্রপাতি তুলে নিল দোকানে। বলল, ভিজিয়ে ফেললে? এসব ইলেকট্রনিক জিনিস, বরবাদ হলে দাম দেবে কে?

নিমাই কথা বলল না। তবে পাঁচু বলল, বৃষ্টি কি আমার বাপের চাকর যে হুকুম মেনে নামবে? অতই যদি তোয়াজের জিনিস তবে ভাড়া দেওয়ার সময় সঙ্গে একটা ঢাকনা দিয়ে দিস না কেন?

ব্রজবাসীর দোকানের সামনে একখানা বারান্দা আর তাতে বেঞ্চ আছে। দুজনে বসল পাশাপাশি। বৃষ্টির ছাঁট আসছে, প্রবল বাতাস।

পাঁচু বলল, একটু চা হলে হত, কী বলো!

নিমাই মাঝে মাঝে খায়, তবে নেশা নেই। বীণাপাণির চায়ের নেশা আছে বলেই নিমাইকে মাঝে মাঝে খেতে হয়। নিমাই উদাস গলায় বলে, তা খা না। ওই তো পল্টুর দোকানে হচ্ছে।

পাঁচু নড়ল না, বসে রইল। খানিকক্ষণ বাদে বলল, এবার বৃষ্টিটা খুব ভোগাবে, বুঝলে! লক্ষণ ভাল নয়। চাষবাসের বারোটা না বাজে।

চাষবাস নিয়ে নিমাইয়ের ভাববার সময় নেই। তার মাথায় অন্য পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বীণাপাণির ঘরে যদি পরপুরুষ ঢুকেই থাকে তবে এতক্ষণ কি সে আছে? থাকলে এই বৃষ্টিতে সেও বেরোতে পারবে না। টাকাওলা লোক কি? জোয়ানমর্দ? নাকি বুড়োধুড়ো?

পাপের চিন্তা করলে শরীর শুকোয়, মন শুকোয়। দুনিয়াটাই শুকিয়ে যায়। এই বৃষ্টি-ভেজা বিকেলটা নিমাইয়ের কাছে ভারি শুকনো ঠেকছে। সে হঠাৎ বলল, হ্যাঁ রে পাঁচু, তুই ভগবান মানিস?

পাঁচু একখানা বিড়ি বের করেছে। দেশলাই রাখে না বলে ধরাতে পারছে না। বলল, তা মানি। শীতলা মানি, কালীঠাকুর মানি। তবে আমরা পাপী-তাপী লোক, ভগবানের কথা আর ভাবতে পারি কই বলো!

আমার খুব ভগবানের কথা মনে হয়। একটু শাস্তর জানা থাকলে, মন্ত্র নেওয়া থাকলে বেশ হত। কিছু হল না। সংসারের প্যাঁচে পড়ে গেছি।

পাঁচু তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, তোমার আবার সংসার! টোনাটুনি মিলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে আছো। পাঁচখানা ছেলেপুলে নিয়ে আমার মতো ফাঁদে পড়তে তো বুঝতে!

বিয়ে কি সকলের সয় রে! সংসার আমার জন্য নয়। ইচ্ছে ছিল সারাদিন কাজটাজ করব, সন্ধেবেলা প্রাণভরে কীর্তন করব। তা আর হল কই?

তোমার একটু সাধু-সাধু ভাব আছে বটে।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেঘের ছায়ায়, বৃষ্টির ঘোরে চারদিকটা ছাইরঙা হয়ে গেল। দুর্জয় গরমটা উড়ে গেল কোথায়। ভেজা গায়ে বাতাস লেগে একটু শীত-শীত করছে। আগে সঙ্গে সবসময়ে একখানা গামছা থাকত। তাতে ভারি সুবিধে। কিন্তু আজকাল বীণাপাণি গামছা নিতে দেয় না। ওটা নাকি ভারি ছোটলোকি ব্যাপার। পাঁচু দিব্যি তার গামছাখানায় ভেজা মাথা আর মুখ মুছে নিয়ে বসে আছে। নিমাইয়ের সে সুবিধে নেই। পকেটে একখানা রুমাল আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে গামছার কাজ চলে না। পাঁচুর গামছাখানা ধার নিতেও ইচ্ছে যায় না। বড্ড নোংরা।

গা গরম করতেই গুনগুন করে একখানা গান ধরেছিল নিমাই। কিন্তু কপালের এমনই ফের, যে গানটা মনে এল সেটার মধ্যেই বিষ মেশানো। আমার বধুঁয়া আন-বাড়ি যায় আমার আঙ্গিনা দিয়া…। নিয়তিই হবে। নইলে এ গানখানাই ভুস করে মাথায় ভেসে উঠল কেন? গান ধরতেই মনটা কু গেয়ে উঠল, বীণাপাণির ওসব দোষ আছে কি? নিমাই তো ঝাঁঝালো পুরুষ নয়, পয়সার জোরও নেই। বীণার আর দোষ কী?

মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুর কী জানিস পাঁচু?

পাঁচু একটু রাগ করে বলে, গানটা গাইছিলে তাই গাও না। বেশ তো শুনতে লাগছিল। এর মধ্যে আবার ওসব গন্ধমাদন কথা কেন?

না, বলছিলাম আর কি! মানুষের সব চেয়ে বড় শওুর হল তার মন।

আরে, ওসব জানি। ওসব হল তত্ত্বকথা। আমার মতো গরিবের মন কোথায় থাকে জানো? পেটে আর অণ্ডকোষে। সারাদিন রিক্সা টেনে মুখে রক্ত তুলতে তো বুঝতে, মনটন সব কোথায় গিয়ে সেঁধোয়। বরং গানটা গাও। কীর্তন শুনলে একটু ভাব আসে আমার।

নিমাই ফের গানটা ধরল। গলাটা খেলছে না ভাল। কিন্তু পাঁচু চোখ বুজে শুনছে। গানটা শেষ করে নিমাই বলল, মন ভাল থাকলে দুনিয়াটা ভারি ভাল, আর মন বিগড়োলে পরমান্নও তেতো।

আমি বলি কি, ছেলেপুলে করে ফেল এইবেলা। মনটন সব কব্জায় এসে যাবেখন। সবাই বলে বীণাপাণি সিনেমায় নামবে বলে চেহারা রাখছে। তাই ছেলেপুলে হচ্ছে না। সত্যি নাকি?

নিমাইয়ের কান একটু গরম হল। বীণাপাণিকে নিয়ে বেশ কথা হয় এ অঞ্চলে।

পাঁচু দূরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ওটাও অধর্ম হচ্ছে, বুঝলে? আত্মারা সব চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের জন্মাতে না দেওয়াটাও পাপ।

ছোটলোকে যা ভাবে তাই বলে, সবসময়ে মাথা খাটিয়ে তো বলে না। নিমাই তাই চুপ করে থাকে।

পাঁচু নিজে থেকেই বলে, অবিশ্যি সিনেমায় নামলে অন্য কথা। তখন তো সোনার খাটে মাথা, রুপোর খাটে পা। গাড়ি, বাড়ি, টাকায় ভাসাভাসি। টাকা থাকলে তখন আর পাপটাপ অর্শায় না। রাবণরাজার কথা তো জানো, স্বয়ং শিবঠাকুর তার বাড়ি চৌকি দিত।

বীণাপাণি সিনেমায় নামবে কিনা তা নিমাই জানে না। তবে ছেলেপুলে যে এখনই চায় না সেটা নিমাই জানে। স্টেজে উঠে মেলা নাচন কোঁদন করতে হয়, গলা তুলতে হয় সপ্তমে, ওসব করতে গেলে শরীরের তাগদ চাই। ছেলেপুলে হয়ে পড়লে অসুবিধে আছে। আর নিমাই-ই বা কোন মুখে চাপাচাপি করবে। নিজেই সে দাঁড়ের পাখি হয়ে আছে।

বৃষ্টিটা ছাড়ল না। তবে চাপটা একটু কমল। চারদিকটা যেমন ধোঁয়াটে হয়ে গিয়েছিল তেমনটা আর নেই।

নিমাই বলল, চল, কাকার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে বাড়ি যাই।

পাঁচু নড়ল না। বলল, অত তাড়া কিসের? আজ টাকা পেতে দেরি হবে। হাঙ্গামা আছে।

কিসের হাঙ্গামা?

বটতলায় একটা ছেলে খুন হল না সেদিন? সেটা নিয়েই কী সব হচ্ছে-টচ্ছে।

সে তো পগা।

পগাই বটে নামটা। ডলার আর পাউন্ড বিকিকিনি করত।

সে শুনেছি।

তা তার মহাজন কলকাতা থেকে লোকজন নিয়ে এসেছে। পগার কাছে নাকি মেলা সাহেবী টাকা ছিল।

হ্যাঁ, মাঝে মাঝে… বলতেই যেন ভগবান জিবখানা টেনে ধরলেন। সে বলে ফেলতে যাচ্ছিল যে, বীণাপাণির কাছেও মাঝে মাঝে টাকা গচ্ছিত রেখে যেত। কথাটা পাঁচকান হওয়া ভাল নয়।

পাঁচু উদাস গলায় বলল, বড় বড় বানরের বড় বড় লেজ। কত খুনখারাপি হচ্ছে কেউ গা করে না। পগা মহাজনের লোক বলে এখন নাড়াঘাটা পড়েছে!

তাতে কাকার হাঙ্গামা হচ্ছে কেন?

কে জানে বাপু কি বৃত্তান্ত, নাম-ধাম শুনতে চেও না, তবে শোনা যাচ্ছে খুনটা যারা করেছে তারা কাকার দলের ছোকরা সব।

আজকের দশটি টাকা পেলে নিমাইয়ের সত্তরটা টাকা হয়। আরও তিনটে ক্ষেপ মারতে পারলে পুরো একশ। একশ হলেই পালপাড়া। মা-বাবার মুখে হাসির ঢল। নিমাইয়ের নিজের রোজগার বলে টাকাটার দামও কি একটু বেশী? কে খুন হল, কে সেটা করল আর কারা তার তত্ত্বতালাশ করতে এসেছে এসব নিয়ে নিমাইয়ের মাথাব্যথা নেই। তার ভাবনা হল, হাঙ্গামায় টাকাটা যদি আজ কাকা না দেয় তা হলে কাল এই বকেয়া টাকাটা দিতে কাকা ভুলে যাবে না তো? নাটক-পাগল লোক, ভুললে দোষ কি? তবে সমস্যা হল, মুখ ফুটে সেটা চাইতে পারবে না নিমাই। দিনের হিসেব দিনকে মিটে গেলেই ভাল।

দোকানটা কবে খুলছো?

নিমাই বেজার মুখ করে বলে, হবে।

হবে সে আমিও জানি। তবে মহেন্দ্র মোটা টাকা হেঁকে বসেছে তো। ছ’হাজারের নিচে নামতে চাইছে না, না?

এ বাজারে দরটা আর নামাচ্ছে কে?

তবে তোমার বউ যখন লেগেছে ও হয়ে যাবে।

এ কথাটা নিমাই বুঝল না। বীণাপাণি তো আর বড়লোক নয়। কাকার দয়ায় খেয়ে পরে কোনওক্রমে আছে। একেবারে হাততোলা অবস্থা। শহরের বাইরের দিকটায় এবং ভিতর বাগে একটুখানি জমি কিনতে দম শেষ হয়ে গিয়েছিল বীণার। বেড়া আর টিন দিয়ে যে ঘরখানা তুলেছে সে টাকার জোরে নয়, মনের জোরে। মহেন্দ্র যে ছ’হাজার টাকা চেয়েছে সেটা জানতই না নিমাই। এই শুনল। ফলের দোকান এমন কিছু লাভের ব্যবসা নয়। বনগাঁয়ে ফলটা খাবে কে? পুজোআচ্চায় কলাটা শশাটা কিছু বিক্রি হয় আর সিজন ফল। ছ’হাজার টাকা সেলামি দিলে সে টাকা উসুল করতে নিমাইয়ের বহু বছর চলে যাবে। আজই গিয়ে বীণাকে বারণ করতে হবে।

পাঁচু উদাস মুখে বলল, মনোহারি দোকানের খরচাও আছে। কম করেও পনেরো বিশ হাজার টাকা লাগসই না করলে হবে না। তার ওপর ধরো কাচের বাক্স, আলমারি এসবেরও খরচ ভালই।

নিমাইয়ের মাথায় ছোটো একটা বজ্রাঘাত হল। একদিন ঠাট্টা করে মনোহারি দোকানের কথা বলেছিল বটে বীণা। তা হলে সে কাণ্ডই হতে যাচ্ছে! নিমাইয়ের চোখটা ঘোলাটে হয়ে এল। এসব হচ্ছেটা কী? বীণার ট্যাঁকের তো এমন জোর নেই! আর এসব ঘরের কথা তাকে পাঁচুর মুখেই বা শুনতে হচ্ছে কেন? মনোহারির কথা, ছ’হাজার সেলামির কথা তো তাকে বলেনি বীণা! এদিকে বাজারে তো চাউর হয়েছে দেখা যাচ্ছে।

পাঁচু তেমনি উদাস মুখে বলে, বিয়ে তোমার সয় না বলছিলে। তা দেখ বাপু, তোমার মতো বউ এ তল্লাটে কটা লোকের আছে। তোমার মুরোদ না থাক বউ তো দশভুজার মতো আগলাচ্ছে!

কোনও কারণ নেই, তবু নিমাই তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ, বীণার মতো মেয়ে হয় না। আসলে বলতে চেয়েছিলুম কি জানিস, বীণার মতো বউ কি আমার কপালে জোটা উচিত? আমি কি একটা মনিষ্যি?

পাঁচু তার ক্ষয়া দাঁতে হাসল, তা যাই বলো বাপু, কার ভিতরে কী আছে ভগবান জানে। তোমার কথা বলতে হয় তো বলি, যখন কীর্তন গাও তখন কিন্তু মনটা ভারি ভিজে যায়। তোমার গলায় যেন হরি এসে বসেন।

নিমাই লজ্জার হাসি হাসল, হরির আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই।

পর পর দুখানা গাড়ি, একখানা জীপ আর একখানা মারুতি বটতলার দিকে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেল।

পাঁচু বলল, ওই যাচ্ছে।

কে রে?

ওই যারা কলকাতা থেকে এসেছে। জিপ আর মারুতি নিয়ে।

এত কথা তোকে কে বলল?

সকাল থেকে কাকার বাড়িতে রিক্সা ঠেকিয়ে বসেছিলুম তো। ওখানকারই সুধীর বলল। সে কাকার অপেরার একজন বাজনদার। মুখ-পলকা লোক।

চিনি।

কলকাতার বাবুরা চলে গেল বোধ হয়। আবার আসবে ঠিক। একটা গণ্ডগোল পাকাচ্ছে। মারদাঙ্গা লাগবে মনে হয়। যাবে নাকি? গেলে বলো, এখন একটু ফাঁকায় পাওয়া যাবে তেনাকে।

নিমাই রিক্সায় উঠে বসল। তার বুকে বড় ভয়। বীণাকে এই এত এত টাকা জোগাচ্ছে কে? খুব বড় কোনও বাবু? কথাটা মুখোমুখি জিজ্ঞেস করতেও তো বাধে। কে দিচ্ছে টাকা? তার চেয়েও বড় কথা, কেন দিচ্ছে? সিনেমায় নামার যে কথা শুনছে পাঁচুর মুখে সেইটিই কি সত্যি নাকি? বীণাকে নিয়ে যে এত মাথা ঘামাতে হবে তা জানা ছিল না তার।

কাকার বাড়িতে আজ থমথমে ভাব। বাইরের ঘরখানায় যারা গম্ভীর মুখে বসে আছে কাকাকে ঘিরে, তারা কেউ যাত্রার দলের নয়। এরা কাকার অন্য দিককার লোক। স্মাগলার কাকা আর যাত্রাদলের কাকা দেহে এক হলেও দুটো আলাদা আলাদা মানুষ। এখন যে মানুষটা ঘরে সবার মধ্যমণি হয়ে বসা সে মোটেই যাত্রাদলের কাকা নয়। একে দেখলেই বুক দুরদুর করে।

কাকার বাড়িখানা পাকা আর দু মহলা। মহল না হলেও দুখানা আলাদা ভাগ আছে। সামনের বৈঠকখানা গোছের ঘরখানা বাড়ি থেকে অন্তত দশ বারো গজ তফাতে। গোটা বাড়ি দেয়ালবন্দী। গাছপালা আছে।

ঘরের ভিতরকার চেহারা বারান্দা থেকেই দেখতে পাচ্ছিল দুজন। গতিক সুবিধের নয়।

একটা ছোকরা এগিয়ে এসে বলল, কী চাই?

পাঁচু বলল, আমাদের মজুরীটা?

এখানেই দাঁড়াও। বলে ছেলেটা ঘরে গেল আর পরমুহূর্তেই বেরিয়ে এসে মজুরীর টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, কাকা বলে দিয়েছে কাল থেকে আর বেরোতে হবে না। এখন যাও।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একশ পুরল না।

বাড়ি যখন ফিরল তখন নিমাইয়ের বুকখানা বড় ভার। অনেক কথার জবাব খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক কথার জবাব সে কখনও পাবেও না।

হাতমুখ ধুয়ে যখন ঘরে ঢুকে বসল তখন বীণাপাণি উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে একটা খাতায় কী যেন লিখছে।

কী লিখছো?

ও কিছু নয়। একটা হিসেব।

নিমাই একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, শুনলুম মহেন্দ্র অনেক টাকা সেলামি চাইছে।

কে মহেন্দ্র?

যার দোকান নেবে বলে ঠিক করেছো!

বীণা মুখ তুলে বলল, নিইনি এখনও। কথা বলছি।

কী দরকার? ছ’হাজার টাকা কি সোজা কথা? আমাদের অত টাকা তো বেচলেও উঠবে না।

তোমাকে ভাবতে কে বলেছে?

না ভেবে কি পারি? তোমার জন্যই ভাবি।

আমিও তো তোমার জন্য ভাবি বলেই করছি।

সে খুব জানি। তোমার মতো মেয়ে হয় না। সদ্বংশে জন্মেছো, তোমার ধরনই আলাদা। তবু বলি টাকাপয়সা হাতে রাখো। মহেন্দ্র যা টাকা চাইছে তা আমাদের নাগালের বাইরে। আমার চাকরিটাও আজ থেকে নট হয়ে গেল।

বীণা অবাক হয়ে বলে, কেন? কাকা তো বলছিল আউরঙ্গজেব খুব ঘটা করে নামাবে। দু মাস ধরে মাইকে প্রচার হবে।

কী সব গণ্ডগোল শুনে এলুম।

কিসের গণ্ডগোল?

ওই যে পগা খুন হয়েছিল, তার মহাজন আজ এসেছে পাইক-পেয়াদা নিয়ে। অনেক নাকি সাহেবী টাকা ছিল পগার কাছে। সেই সব খোঁজ-খবর হচ্ছে আর কি!

তাতে কাকার কি?

কাকার সঙ্গেই তো গণ্ডগোল। খুনটা নাকি তার দলের ছেলেরাই করেছে।

সন্ধের মরা আলোতেও দেখা গেল বীণাপাণির মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। লেখা ছেড়ে উঠে বসল সে, আর কী শুনে এলে?

এইটুকুই। কাকার ঘরে আজ সব ষণ্ডারা জুটেছে। শলাপরামর্শ হচ্ছে।

তোমাকে কে বলল?

বাতাসে কথা উড়ছে। রিক্সাওলাটা অবধি সব জানে।

বীণা হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর আর দুঃখী হয়ে বসে রইল। এ সময়টায় নিমাই ফিরলে উঠে রুটি বা মুড়ি চানাচুর যা হোক কিছু দেয়। আজ নড়ল না।

নিমাই বিছানার একধারে পা তুলে বসল। বলল, আজ ঠাণ্ডা লেগেছে। যা আচমকা বৃষ্টিটা এল।

বীণা হঠাৎ তার দিকে চেয়ে বলল, কাল সকালে বিষ্ণুপুর যাই চলো।

বিষ্টুপুর? সেখানে কেন?

মা দেখতে চেয়েছে আমাকে। বাবার চিঠি এসেছে আজ।

তা আমার আর কাজ কি? গেলেই হয়। বাড়ি দেখবে কে?

দেখার লোক আছে। এখনই গোছগাছ করে নিই চলো। সকালের বাস ধরব।

গোছগাছ বেশী নয়। একখানা সুটকেসে সবই এঁটে যায়। বীণা তবু আর একখানা টিনের বাক্স নিল। তারপর হঠাৎ বলল, দোকান থেকে একটু মিষ্টিটিস্টি কিনে আনো তো! বাবা খুব গুজিয়া ভালবাসে।

গুজিয়া এনে নিমাই দেখল, গোছানো শেষ।

খেয়েদেয়ে সকাল সকালই বিছানায় গেল দুজন।

সকালের বাস পাঁচটায়। ভোরে না উঠলে হবে না।

কত রাত হবে কে জানে, হঠাৎ দরজায় ধাক্কা পড়ল।

বীণা? এই বীণা? দরজা খোলো!

দুজনেই উঠে বসল। ভয়ে সিঁটিয়ে থেকে বীণা বলল, কে?

আমি কাকা। দরকার আছে। দরজা খোলো।

অন্ধকারে বীণা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে নিমাইয়ের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে চাপা গলায় বলল, বড্ড ভয় করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *