১৩. যিনি করেন ইতুলক্ষ্মী

যিনি করেন ইতুলক্ষ্মী তার ভাগ্যে হয় ব্ৰতকথার ঈশনে–মানে ঈশানীর মত ধানকলাই, ছোলা, মুগ, যব, সরষে, তিসি, নানান ফসলে থৈ থৈ করে ক্ষেত, গাড়িতে গাড়িতে তুলে ফুরোয় না। খামার জুড়ে মরাই বেঁধে কুলোয় না। একমুঠো তুলতে দু-মুঠো হয়। তার ক্ষেতখামার ভঁড়ার ভরে মা-লক্ষ্মী অচল হয়ে বাস করেন। ঘর ভরে যায় সন্তান-সন্ততিতে, গোয়াল ভরে ওঠে গরুতে-বাছুরে; গাছ-ভরা ফল, পুকুর-ভরা মাছ, লক্ষ্মীর হাড়িতে কড়ি, আট অঙ্গ সোনারুপোয় ঝলঝল করে। বউ বেটা আসে, নাতি-নাতনীর পাশে শুয়ে স্বামীর কোলে মরণ হয় তার একগলা গঙ্গাজলে।

ব্ৰত-কথা শেষ করিয়া উল উল হুলুধ্বনি দিয়া দেবুর স্ত্রী প্রণাম করিল। সঙ্গে সঙ্গে দুৰ্গা। এবং পদ্মও হুলুধ্বনি দিয়া প্ৰণাম করিল। দুর্গার কণ্ঠস্বর যেমন তীক্ষ্ণ, তাহার জিভখানিও তেমনি লঘু চাপল্যে চঞ্চল,তাহার হুলুধ্বনিতে সমস্ত বাড়িটা মুখরিত। প্রণাম করিয়া সুপারিটি দেবুর স্ত্রীর সম্মুখে রাখিয়া সে সরবে হাসিয়া উঠিয়া বলিল—বিলু দিদি, ভাই কামার-বউ, মরণকালে তোমরা কেউ আমাকে স্বামী ধার দিয়ো ভাই কিন্তুক।

দেবুর স্ত্রীর নাম বিশ্ববাসিনী—ডাকনাম বিলু। বিলু হাসিল। তাহার স্বামীকে সে জানে, সে রাগ করিল না। অন্য কেহ হইলে এই কথা লইয়া একটা ঝগড়া বাঁধাইয়া দিত। এই সুরূপা স্বৈরিণী মেয়েটা যখন মৃদু বাঁকা হাসি হাসিতে হাসিতে পথে বাহির হয়, তখন এই অঞ্চলের প্রতিটি বই সন্ত্রস্ত হইয়া ওঠে। লজ্জা নাই ভয় নাই-পুরুষ দেখিলেই তাহার সহিত দুইচারিটা রসিকতা করিয়া সর্বাঙ্গ দোলাইয়া চলিয়া যায়।  পদ্মও রাগ করিল না। কয়েকদিন হইতেই দুৰ্গা তাহার বাড়ি আসা-যাওয়া শুরু করিয়াছে। অনিরুদ্ধকে সে একখানা দা গড়িতে দিয়াছে, সেই তাগাদায় সে এখন দুই বেলা যায়-আসে। অনিরুদ্ধের সঙ্গে রঙ্গ-রহস্য করে হাসিয়া ঢলিয়া পড়ে। মধ্যে মধ্যে পদ্মের সর্বাঙ্গ জুলিয়া ওঠে, কিন্তু খরিদ্দারকে কিছু বলা চলে না। তাহা ছাড়াও, ইদানীং পদ্ম যেন অকস্মাৎ পাল্টাইয়া অন্য মানুষ হইয়া গিয়াছে। হঠাৎ যেন তাহার জীবনে একটা সকরুণ উদাসীনতা আসিয়া তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া সারা জীবনটাকে জুড়িয়া বসিয়াছে; এই শীতকালের ভোরবেলায় কুয়াশার মত। ঘর ভাল লাগে না, অনিরুদ্ধ সম্পর্কেও তাহার সেই সর্বগ্রাসী আসক্তিও যেন হতচেতন মানুষের বাহবন্ধনের মত ক্রমশ এলাইয়া পড়িয়াছে। অনিরুদ্ধ-দুর্গার রহস্যলীলা সে চোখে দেখিয়াও কিছু বলে না, দেবুর শিশুপুত্রকে আপনার কোল হইতে বিলুর কোলে তুলিয়া দিয়া বলিল-আমার তো ভাই ওইটুকুই পুঁজি। বাদবাকি গরু-বাছুর-বউবেটা-বলে শির নেই তার শিরঃপীড়া!–নাতি-নাতনী! বলিয়া সে একটু হাসিল, হাসিয়া বলিলচলি ভাই, পণ্ডিতগিনি।

বিলু তাহার হাত ধরিয়া বলিল জল খাবার নেমত দিয়ে গিয়েছে—তোমার বরের বন্ধু। দাঁড়াও একটু মিষ্টি মুখে দিয়ে যাও।

বিলুর কোলের শিশুটির উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া বার বার চুমা খাইয়া পদ্ম বলিলখোকামণির হামি খেয়ে পেট ভরে গিয়েছে। এর চেয়ে মিষ্টি তার কিছু হয় নাকি?

–না, তা হবে না।

—তবে দাও ভাই খুঁটে বেঁধে, নিয়ে যাই। ইতুর পেসাদ মুখে দিয়ে খাই কি করে বল? পণ্ডিত না হয় এ সব জানে না, পণ্ডিতগিন্নিকে তো আর বলে দিতে হবে না।

পথে বাহির হইয়া দুর্গা বলিল—বিলুদিদি আমার ভারি ভালমানুষ। যেমন পণ্ডিত তেমনি বিলুদিদি। তবে পণ্ডিত একটুকুন কাঠ-কাঠ, রস কম।

পদ্ম কিন্তু দুর্গার কথা যেন শুনিলই না—আমাকে ভাই ছিরু পালের বাড়ির সামনেটা পার করে দাও।

—মরণ! এত ভয় কিসের? দিনের বেলায় ধরে খেয়ে নেবে নাকি? দুর্গা মুখ বাঁকাইয়া হাসিল। কথাটা বলিয়াও দুর্গা কিন্তু পদ্মের সঙ্গে সঙ্গে চলিল।

পদ্ম বলিল, ওকেই বলি ভাগ্যিমানী। বড়লোক না হোক ছচল-বচল সংসার, তেমনি স্বামী আর ছেলেটি! আহা, যেন পদ্মফুল! যেমন নরম তেমনি কি গা ঠাণ্ডা! কোলে নিলামতা শরীর আমার যেন জুড়িয়ে গেল।

–মা সোন্দার, তার ওপর বাপ কেমন সোন্দার, ছেলে সোন্দার হবে না।

পদ্ম একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল—কোনো কথা সে বলিল না। পথে একটা বছর ছয়-সাতের ছোট ছেলে আদিম কালের বর্বর আনন্দে পথের ধুলার উপর বসিয়া মুঠা-মুঠা ময়দার মত ধুলা আপন মাথায় চাপাইয়া পরমানন্দে হাসিতেছিল। দুর্গা বলিল—এই দেখ, যেমন কপালতেমনি গোপাল। যেমন লক্ষ্মীছাড়া বাপ-মা—তেমনি ছেলের রীতিকরণ।

ছেলেটি সদ্‌গোপবংশীয় তারিণীচরণের। তারিণীচরণ একজন সর্বস্বান্ত চাষী, যথাসর্বস্ব তাহার বাকি খাজনার দায়ে নিলাম হইয়া গিয়াছে। সে এখন বাউরি, ডোম প্রভৃতি শ্রমিকদের মত দিনমজুর খাঁটিয়া খায়। তারিণীর স্ত্রীও উপযুক্ত সহধর্মিণী, প্রায় সমস্ত দিনটাই ও বাউরি ডোমের মেয়েদের মত ঝুড়ি লইয়া বনে-বাদাড়ে কাঠ সংগ্রহ করে, শাক খুঁটিয়া আনে, ডোবার পাক ঘাটিয়া মাছ ধরে। ওগুলো কিন্তু তারিণীর স্ত্রীর বাহ্যাড়ম্বর, ওই অজুহাতে সে চুরি করিবার বেশ একটি সুযোগ করিয়া লয়। আম-কাঁঠাল শশা-কলা-লাউ-কুমড়া কোথায় কাহার ঘরে আছে—সে সব নখদর্পণে শাক-কাঠ সগ্রহের অছিলায় সে আশপাশেই ঘুরিয়া বেড়ায়। আর সুযোগ পাইলেই পটাপট ছিঁড়িয়া ঝুড়ির তলায় ভরিয়া লইয়া পলাইয়া আসে। আর ওই শিশুটা এমনি করিয়া পথে বসিয়া ধুলা মাথে—কাদে। কাঁদিতে কাঁদিতে ক্লান্ত হইয়া আপনিই ঘুমাইয়া পড়ে হয়ত আপনাদের ঘরের অনাচ্ছাদিত দাওয়ায় অথবা কোনো গাছের তলায়, ঠাঁই বাছাবাছি নাই। কোনো কোনো দিন দূর-দূরান্তেও গিয়া পড়ে; বাপ-মায়ে খোঁজে না, চিন্তিত হয় না। ছেলেটা আপনি আবার ফিরিয়া আসে।

সর রে, ছেলেটা সর। ধুলো দিস না বাপু, কাল বোয়া কাপড় পরেছি।–দুর্গা রূঢ় তিরস্কারে সাবধান করিয়া দিল।

–ইঃ! বলিয়া দুষ্ট হাসি হাসিয়া ছেলেটা একমুঠো ধুলা লইয়া উঠিয়া পাঁড়াইল।

–দোব ছেলের কষা নিড়ে। দুর্গা কঠোরস্বরে শাসাইয়া দিল। ধোঁয়া কাপড়ে ধুলোর ছিটা তাহার কোনোমতেই সহ্য হইবে না।

–মিষ্টি দোব, বাবা? মিষ্টি খাবে? পদ্ম ছেলেটিকে তাহার বঞ্চিত জীবনের সকল আকুতি জড়াইয়া সাদরে সম্ভাষণ করিল।

ধুলোর মুঠাটা নামাইয়াও ছেলেটা বলিল—মিছে কথা। উ, ভারি চালাক তুই!

আপনার খুঁট খুলিয়া পদ্ম বিলুর দেওয়া মিষ্টিটি বাহির করিয়া বলিল—এইবার ধুলো ফেলে দাও। লক্ষ্মীটি!

–উঁ-হুঁ। তু আগে ওইখানে ফেলে দেয়!

–ছি, ধুলো লাগবে। হাতে হাতে নাও।

–হিঃ! তা হলে তু ধরে মারবি।

–না, তু ফেলে দে ক্যানে।

–দাও হে, তাই ফেলে দাও। ধুলো! বলে অ্যাঁস্তাকুড়ের পাতা কুড়িয়ে খায়। ধুলো! দুর্গা ঝঙ্কার দিয়া উঠিল। তাহার রাগ হইতেছিল। সেও বন্ধ্যা কিন্তু তাহার ছেলে-ছেলে করিয়া আকুতি নাই।

পদ্ম কিন্তু মিষ্টিটি ফেলিয়া দিতে পারি না, একটি পরিচ্ছন্ন স্থানে সন্তৰ্পণে নামাইয়া দিয়া ছেলেটির মুখের দিকে চাহিয়া একটু হাসিল। তারপর নীরবেই পথে অগ্রসর হইল।

—কামার-বউ। সকৌতুকে দুর্গা তাহাকে ডাকিল।

দীর্ঘ অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকিয়া মাটির উপর চোখ রাখিয়া পদ্মর পথে চলা অভ্যাস; সে তেমনিভাবেই চলিতেছিল। মুখ না তুলিয়াই সে উত্তর দিল—কি?

–ওই দেখ।

–কি? কোথা? কে?

–ওই যে ছামুতে হে!

দুর্গা খুখুক করিয়া হাসিয়া উঠিল।

মাথার ঘোমটা খানিকটা সাইয়া মাথা তুলিয়া চারিদিক চাহিয়াই সে আবার তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া দিল। সম্মুখেই ছিরু পাল খামার বাড়ির দরজার মুখে মোড়া পাতিয়া বসিয়া আছে। একা নয়, পাশেই বসিয়া আছে আরও একটা লোক; লোকটার চোখ দুইটা ভাটার মত গোল-গোল এবং লালচে। নাকটা থ্যাবড়া এবং নাকের পাশে প্ৰকাণ্ড একজোড়া বাহারের গোঁফ লোকটাকে বেশ একটা চেহারা দিয়াছে। যে চেহারা দেখিয়া মেয়েরা অস্বস্তি বোধ করে। তারা দুজনেই তাহাদের দিকে চাহিয়া আছে। ও-লোকটাকেও পদ্ম চেনে—লোকটা জমিদারের গোমস্তা। দ্রুতপদে পদ্ম স্থান অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল। দুর্গার কিন্তু সেই মন্থর গতি-ভঙ্গিমা।

গোমস্তা একবার দুর্গার দিকে চাহিল—তারপর ফিরিয়া তাকাইল শ্রীহরির দিকে। তারপর প্রশ্ন করিল দুর্গার সঙ্গে কে হে পাল?

অনিরুদ্ধের পরিবার।–

–হুঁ। দুর্গার সঙ্গে সঙ্গে জোট বেঁধে বেড়াচ্ছে ক্যানে হে?

–পরচিত্ত অন্ধকার, কি করে জানব বলুন।

–দুর্গা কি বলে? খায়?

শ্ৰীহরি গম্ভীরভাবে বলিল—আমি ওসব ছেড়ে দিয়েছি, দাশ মশায়; দুর্গার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলি না।

সবিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া দাশ বলিলবল কি হে? সঙ্গে সঙ্গে তাহার শিকারী গোঁফজোড়াটা নাচিয়া উঠিল। ওইটা দাশের মুদ্রাদোষ।

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–হঠাৎ? ব্যাপার কি?

–নাঃ, ও নীচ-সংসর্গ ভাল নয় দাশজী! সমাজে ঘেন্না করে, ছোটলোকে হাসে। নিজের মান-মর্যাদাও থাকে না।

ঘরে আগুন দিবার ব্যাপারটা লইয়া দুর্গার সঙ্গে শুধু তাহার কলহই হয় নাই, মনে মনে সে একটা প্রবল অস্বস্তি বোধ করিতেছে। মনে হইতেছে শুইবার ঘরে সে সাপ লইয়া বাস করিতেছে। সাপ নয়, সাপিনী। সে দুর্গা।

হাসিয়া দাশ বলিল—বেশ তো, কামারনী তো আর নীচ-সংসর্গ নয়। বেটাকে যখন জব্দই করবে তখন ঘরের হাঁড়িসুদ্ধ এঁটো করে দাও না!

শ্ৰীহরি চুপ করিয়া রহিল। এ কামনাটা তাহার বুকে আগ্নেয়গিরির অগ্নিপ্রবাহের মতই রুদ্ধমুখ চাপা হইয়া আছে। নাড়া খাইয়া সেই প্রচ্ছন্ন অগ্নিশিখা ভিতরে ভিতরে প্রবল হইয়া ওঠে।

ওদিকে দাশ ফ্যা-ফ্যা করিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল।

শ্ৰীহরির উগ্র চোখ দুইটি সঙ্গে সঙ্গে যেন জ্বলিয়া উঠিল। ওই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা দীর্ঘাঙ্গী বধূটির প্রতি তাহার অন্তরের নগ্ন কামনার একটি প্রগাঢ় আসক্তি আছে। তাহার মনে পড়ে, ডোবার ঘাটে দণ্ডায়মানা পদ্মের অবগুণ্ঠিত মুখ; বড় বড় চোখ, ছোট কপাল ঘিরিয়া ঘন কালো একরাশি চুল, ঈষৎ বাঁকা নাক, গালের পাশে বড় একটি তিল,তাহার হাতে শাণিত দা, নিষ্ঠুর কৌতুকের মৃদু হাসিতে বিকশিত ছোট ছোট সুন্দর দাঁতের সারিটি পর্যন্ত তাহার মনোমধ্যে ঝলমল করিয়া ওঠে।

দাশ হাসি থামাইয়া বলিল—তোমার টাকা আছে, ভাগ্যিমান লোক তুমি, তুমি যদি ভোগ না কর তো করবে কি রামা-শ্যামা?

বহুক্ষণ পরে অজগরের মত একটা নিশ্বাস ফেলিয়া শ্ৰীহরি বলিল—ছাড়ান দেন, দাশজী, ওসব কথা। এখন আমি যা বললাম তার কি করছেন বলুন।

–তার আর কি, পাল কেটে ঘোষ করতে আর কতক্ষণ? তবে জমিদারি সেরেস্তার নিয়ম জান তো–ফেল কড়ি মাখ তেল, জমিদারকে কিছু নগদ ছাড়, দস্তুরী দাও! আর তা ছাড়া একটা খাওয়াও। শ্ৰীহরির মুখের দিকে চাহিয়া দাশ বলিলা হে, মদও ছেড়েছ নাকি? যে রকম গতিক তোমার! দাশ একটু বাঁকা হাসি হাসিল।

শ্ৰীহরি হাসিয়া বলিলনা, না, সে হবে বৈকি! তবে কথা হচ্ছে, ওসব আর ঢাক পিটিয়ে হইচই করে কিছু করব না। গোপনে আপনার ঘরে বসে বসে যা হয় একটু মাঝে মাঝে।

–নিশ্চয়! ভদ্রলোকের মত! দাশজী বার বার ঘাড় নাড়িয়া শ্ৰীহরির যুক্তি স্বীকার করিয়া বলিল—একশোবার, আমি আগে কতবার তোমাকে বারণ করিচি, মনে আছে? বলেছি, পাল, ঐ রকম ধারা-ধরন তোমাকে শোভা পায় না; যাক, শেষ পর্যন্ত তুমি যে বুঝে সামলেছ—এ তো ভাল!

দাশজীর কথা শ্ৰীহরিও স্বীকার করিয়া বলিলহ্যাঁ, সে আমি বুঝে দেখলাম দাশী, মানসম্মান আপনার ওরকম করে হয় না, সে-কাল এখন আর নাই।

জমিদারি সেরেস্তার বহুদৰ্শী বিচক্ষণ কর্মচারী দাশজী, সে হাসিয়া বলিল—কোনোকালেই হয় না বাবা, কোনোকালেই হয় না। ত্রিপুরা সিংয়ের কথা বল তুমিতাকে লোকে আজও বলে ডাকাত। সেইটা কি মানসম্মান নাকি? এই দেখ, এই কঙ্কণার মুখুজ্জেবাবুদের কথা দেখ! বড়লোক হল—তাতেও লোকে বাবু বলত না। তারপর ইস্কুল দিলে, হাসপাতাল দিলে, ঠাকুর পিতিষ্ঠে করলে—আমনি লোকে ধন্যি-ধন্যি করলে, বাবু তো বাবু একেবারে বড়বাবু বড়বাড়ির বড়বাবু খেতাব হয়ে গেল!

–এবার চণ্ডীমণ্ডপটা আমিও বঁধিয়ে পাকা করে দেব, দাশজী। আর চণ্ডীমণ্ডপের পাশে একটা কুয়ো।

—ব্যস্‌ ব্যস্ পাকা করে খুদে লিখে দাও কুয়োর গায়ে, চণ্ডীমণ্ডপের মেঝেতেসেবক শ্ৰী শ্ৰীহরি ঘোষেণ প্রতিষ্ঠিতং তারপর তোমার ঘোষ খেতাব মারেং কে, একেবারে পাকা হয়ে যাবে।

–আপনি কিন্তু ওটা করে দেন, সেটলমেন্টের পরচাতেও ঘোষ লেখা আমি।

–কাল-কালই করে নাও না তুমি!

শ্ৰীহরিদের বংশ-প্রচলিত উপাধি পাল। শ্ৰীহরি পাল উপাধিটা পাল্টাতে চায়। অনেকদিন হইতেই সে নিজেকে লেখে ঘোষ; কিন্তু আদালতে ঘোষ চলে না। তাই জমিদারি সেরেস্তায় তাহার নামের জমাগুলিতে পাল কাটাইয়া ঘোষ করিতে চায়। ওদিকে গভর্নমেন্ট হইতে নূতন সার্ভে হইতেছে; রেকর্ড অফ রাইটসের দপ্তরেও ঘোষ উপাধি তাহার পাকা হইয়া যাইবে। পাল উপাধিটা অসম্মানজনক; যাহারা নিজের হাতে চাষ করে, তাহাদের অর্থাৎ চাষীদের ওই উপাধি।

দাশজী আবার বলিল-আর সে-কথাটার কি করছ?

–কোন্ কথা, কামার-বউয়ের কথা?

হো-হো করিয়া দাশজী হাসিয়া উঠিল। বলিল—সে তো হবেই হে। সে কথা আবার শুধোয় নাকি? আমি বলছিলাম গোমস্তাগিরির কথাটা!

শ্ৰীহরি লজ্জিত হইয়া পড়িল। অতর্কিতে সে ধরা পড়িয়া গিয়াছে। অপ্রস্তুতের মতই বলিল-আচ্ছা ভেবে দেখি।

ঠিক এই মুহূর্তেই ক্ষুর-ভাঁড় বগলে করিয়া আসিয়া হাজির হইল তারাচরণ প্রামাণিক। গভীর ভক্তির সহিত একটি নমস্কার করিয়া মোলায়েম হাসি হাসিয়া সম্ভাষণ জানাইল—পেনাম আজ্ঞে!

কপালের উপরে দৃষ্টি টানিয়া তুলিয়া তারাচরণের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দাশজী বলিল—এস বাপধন এস। কি সংবাদ?

মাথা চুলকাইয়া তারাচরণ বলিল গিয়েছিলাম কঙ্কণায়। বাড়ি এসেই শুনলাম, মা বললে– গোমস্তামশাই এসেছেন,শুনেই জোরপায়ে আজ্ঞে আসছি—সে অকারণে হাসিতে লাগিল।

তারাচরণের এই হাসিটি তাহার ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধি হইতে উদ্ভূত। যাহার ডাকে সে সর্বাগ্রে না যায়—সেই চটিয়া ওঠে। তাই তারাচরণ মনস্তৃষ্টির জন্য এই মিষ্টি হাসিটি হাসে, শ্লেষে-তিরস্কারেও সে এমনি করিয়া হাসে। আরও একটি সত্য সে আবিষ্কার করিয়াছে–সেটিকেও সে কাজে লাগায়। প্রতিবেশীর গোপন তথ্য জানিবার জন্য মানুষের অতি ব্যর্থ কৌতূহল। সকাল হইতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত সে গ্রামে-গ্রামান্তরে নানাজনের বাড়িতে যায়। রামের বাড়ির খবর সে শ্যামকে বলে, শ্যামের সংবাদ যদুকে দেয়; আবার যদুর কথা মধুকে নিবেদন করিতে করিতে তাহার বিরক্তি অপনোদন করিয়া তাহাকে খুশি করিয়া তোলে। সেই অবসরে আবার তাদের বাড়িরও দুই-চারিটি গোপন সংবাদ জানিয়া লয়।

গাড়ু হইতে বাটিতে জল ঢালিয়া লইয়া সে আরম্ভ করিল-কঙ্কণাতে হইহই কাণ্ড। আজ্ঞে বুঝলেন কিনা! তবু পড়েছে আট-দশটা,-গাড়ি গাড়ি কাগজ জড়ো হয়েছে।

—হুঁ—সেটলমেন্ট ক্যাম্প বসেছে!

কৌশলী তারাচরণ বুঝিল এ সংবাদে গোমস্তার চিত্ত সরস হইবে না। চকিত দৃষ্টিতে শ্ৰীহরির মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল—শ্ৰীহরির মুখও গম্ভীর। মুহূর্তে সে প্রসঙ্গান্তরে আসিয়া বলিল—এবার পোয়াবারো হল দুর্গা-টুর্গার। দু হাতে টাকা লুটবে। টেরিকাটা আমিনের দল যা দেখলাম! বুঝলে ভাই পাল?

গোমস্তা ধমক দিল-পাল কি রে, ভাই কি রে? ভাই পাল বলিস কেন? ওকে তুই ভাই পাল বলবার যুগ্যি? বুঝলেন বলতে পারি না, না?

–আজ্ঞে?

—ঘোষমশায় বলবি। পাল হল যারা নিজের হাতে চাষ করে। এ গায়ের মাথার ব্যক্তি হলেন শ্রীহরি।

তারাচরণ নীরবে সব শুনিতে আরম্ভ করিল। অনেক কথাই শুনিলমায় এ গ্রামের গোমস্তাগিরিও যে শ্ৰীহরি ঘোষ মহাশয় লইতেছেন, সে কথাটা আভাসে সে অনুমান করিয়া লইল। তৎক্ষণাৎ বলিল—একশোবার হাজারবার, ঘোষ মহাশয়ের তুল্য ব্যক্তি এ কখানা গাঁয়ে কে আছে বলুন? গোমস্তার গালের উপর ক্ষুরের একটা টান দিয়া সে চাপা গলায় বলিলউনি ইচ্ছে করলে দুর্গার মত বিশটা বাদী রাখতে পারেন!

হাত তুলিয়া ইঙ্গিতে ক্ষুর চালাইতে নিষেধ করিয়া দাশজী মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিল-অনিরুদ্ধ কামারের বইটা দুৰ্গার সঙ্গে জোট বেঁধে বেঁধে বেড়ায় কেন রে? ব্যাপার কি বল্ তো?

—তাই নাকি? আজই খোঁজ নিচ্ছি দাঁড়ান! তবে কর্মকারের সঙ্গে দুর্গার আজকাল একটুকু—তারাচরণ হাসিল।

–নাকি?

হ্যাঁ। শ্ৰীহরি চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। পদ্মকে লইয়া এমনভাবে আলোচনা তাহার ভাল লাগিতেছিল না। ওই দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটির প্রতি তাহার আসক্তি প্ৰচণ্ড-কামনা প্রগাঢ়, যে আসক্তি ও যে কামনাতে মানুষ মানুষকে, পুরুষ নারীকে একান্তভাবে একক ও নিতান্তভাবে নিজস্ব করিয়া পাইতে চায়, এক জনশূন্য লোকেসে তাহাকে চায় চোরের সম্পদের মত; অন্ধকার গুহার নিস্তব্ধতম আবেষ্টনীর মধ্যে সৰ্পের সর্পিণীর মত শতপাকের নাগপাশের বন্ধনের মধ্যে।

***

পদ্মের বাড়ি আসিয়া দুৰ্গা দেখিল পদ্ম আবার স্নানে যাইবার উদ্যোগ করিতেছে। পদ্ম দ্রুতপদে চলিয়া আসিবার কিছুক্ষণ পর দুর্গা কিছুক্ষণ একটা গলির আড়ালে লুকাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। গোমস্তাটিকে সে ভাল করিয়াই জানে। শ্রীহরির তো নখ হইতে মাথার চুল পর্যন্ত তাহার নখদর্পণে। তাহাদের কথাবার্তা শুনিবার জন্যই সে লুকাইয়া দাঁড়াইয়াছিল। গোমস্তার কথা শুনিয়া সে হাসিল; শ্রীহরির কথাবার্তার ধরনে সে অনুভব করিল বিস্ময়। তারাচরণ আসিতেই সে চলিয়া আসিয়াছে। গামছা কাঁধে ফেলিয়া পদ্ম তখন বাড়ি হইতে বাহির হইতেছিল। দুর্গা প্রশ্ন করিল—এ কি? আবার চান?

–হ্যাঁ।

–ছোঁয়াচ পড়ল বুঝি? যে পাঁচহাত সান তোমার! কিছু ছোঁয়াটা আর আশ্চয্যি কি! অপ্রস্তুতের মত হাসিয়া পদ্ম বলিল–না, মাড়াই নাই কিছু।

—তবে?

–ছেলেতে ময়লা করে দিলে কাপড়।

—তোমার ওই এক বাতিক, ছেলে দেখলেই কোলে নেবে। নিজের নাই, পরের নিয়ে এত ঝাঁট বাড়াও ক্যানে বল তো? এর মধ্যে আবার কার ছেলে নিতে গেলে!

পদ্ম এবার অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইয়া একটু হাসিল,ছিরু পালের ছেলে।

দুর্গা অবাক হইয়া গেল।

পদ্ম বলিল–গলির মুখে বউটি দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, কোলে ছোটটা ঘ্যান্ঘ্যা করছে, পায়ের কাছে বড়টা কোলে চাপবার জন্যে মায়ের কাপড় ধরে টেনে ছিঁড়ে একাকার করছে আর চেঁচাচ্ছে; বাড়ির ভেতরে শাশুড়ি গাল পাড়ছে—বিয়েনখাগী, সব খেয়েছিস, আর ও দুটো ক্যানে? ও দুটোকেও খা, খেয়ে তুইও যা, আমি বাঁচি। তাই ছোটটাকে একবার নিলাম মা তখন বড়টাকে নিয়ে চুপ করাল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে আবার বলিলপালের বউটি কিন্তুক বড় ভাল মেয়ে, বড় ভাল।

তাহার মনে পড়িয়া গেল সেই সেদিনের কথা।

শ্ৰীহরির স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্গার কোনো অভিযোগ নাই, বরং তাহার কাছে তাহার নিজেরই একটি গোপন অপরাধবোধ আছে। এ গ্রামের বধূদের সক লই তাহাকে অভিসম্পাত দেয়, কটু কথা বলে—সে-কথা সে জানে। কেবল দুটি বউয়ের বিরুদ্ধে সে এ অভিযোগ করিতে পারে। না; একজন বিলু দিদি পণ্ডিতের স্ত্রী, অপরজন শ্ৰীহরির স্ত্রী। পণ্ডিতের স্ত্রী না করিবারই কথা–পণ্ডিত সম্বন্ধে তো তাহার আশঙ্কার কিছু নাই, সে সাধু লোক; কিন্তু ছিরু র সহিত তার প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও শ্ৰীহরির স্ত্রী কোনোদিন তাহাকে কটু কথা বলে নাই—অভিসম্পাত দেয় নাই। পালের স্ত্রীর সঙ্গে চোখে চোখ রাখিতে তাহার সত্যই লজ্জা বোধ হয়।

কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলিয়া, অকস্মাৎ বোধহয় শ্ৰীহরির স্ত্রীর প্রসঙ্গ হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্যই সে প্রসঙ্গান্তরের অবতারণা করিল; বলিল—কে জানে ভাই, কচি-কাচা দেখলে আমার তো গা ঘিন-ঘিন করে! মা গো?

পদ্ম অত্যন্ত রূঢ়দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিল।

দুর্গা তাহা লক্ষ্যই করিল না, অবশ্য লক্ষ্য করিলেও সে গ্রাহ্য করিত না। তাচ্ছিল্যের একটা বাঁকা হাসির শাণিত ছুরিতে উহাকে টুকরা টুকরা করিয়া ধুলায় লুটাইয়া দিত। তেমনি উপেক্ষার ভঙ্গিতে সে বলিয়া গেল—আমাদের বউটার আবার এই বুড়ো বয়সে ছেলেপিলে হবে! আমি ভাই এখন থেকে ভাবছি–সেই ট্যা-টা করে কাদবে, পাখির বাচ্চার মত ক্ষণে ক্ষণে ক্যাথা কাপড় ময়লা করবে,মা গোঃ! মুহূর্তে পদ্মের বিচিত্র রূপান্তর হইয়া গেল। সে প্রশ্ন করিল—কোন্ দেবতার দোর ধরেছিল তোমাদের বউ?

—দেবতা? দেবতা তো অনেককেই দয়া করেছে। তারপর ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল–শেষ ওই ঘোষালের–

—ঘোষালেরা কবচ দেয় নাকি?

—মরণ তোমার! ওই হরেন ঘোষালের সঙ্গে বউয়ের এতকালে আশনাই হয়েছে। বউ তো আর বাজা নয়, তাই সন্তান হবে।

পদ্ম স্থিরদৃষ্টিতে দুর্গার দিকে চাহিয়া রহিল।

দুর্গা বলিল—শুধু তো মেয়েই বাজা হয় না, পুরুষেরও দোষ থাকে। তা জান না বুঝি? সে দৃষ্টান্ত দিতে আরম্ভ করিল, আশপাশ গ্রামের বহু দৃষ্টান্তই সে জানে। এই জীবনের এই পথের পথিকদের প্রতিটি সংবাদ সে জানে, প্রতিটি জনকে চেনে। তাহারা হয়ত আড়াল দিয়া অন্ধকারে। আত্মগোপন করিয়া চলিতে চায়—কিন্তু সে যে অহরহ পথের উপর অনবগুণ্ঠিত মুখে অকুণ্ঠিত দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া আছে পথের যাযাবরীর মত; ওই পথেই যে সে বাসা বাঁধিয়াছে।

 

শীতের দিন-জলের হিম মানুষের দেহে যেন সুচ ফুটাইয়া দেয়। সকালবেলাতেই দুইবার স্নান করিয়া পদ্মের শরীর যেন অসুস্থ হইয়া পড়িল। সমস্ত দিনেও বেচারি সে অসুস্থতা কাটাইয়া উঠিতে পারিল না। রান্নাশালায় আগুনের অ্যাঁচেও সে আরাম পাইল না। রান্নাবান্না শেষ করিয়াও সে কিছু খাইল না, সমস্ত অনিরুদ্ধের জন্য ঢাকা দিয়া রাখিয়া দিল। কর্মকার সকালেই খাবার ব্ৰাধিয়া লইয়া ময়ূরাক্ষীর ওপারে জংশনে তাহার নূতন কামারশালায় গিয়াছে।

অপরাহ্নে সে ফিরিল। পদ্ম চুপ করিয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া ছিল, অসুস্থ উদাসীনতা তাহার সর্বাঙ্গে পরিস্ফুট। অনিরুদ্ধ একে ক্লান্ত, তাহার উপর পথে দুর্গার বাড়িতে খানিকটা মদ খাইয়া আসিয়াছে। পদ্মের ভাবভঙ্গি দেখিয়া তাহার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গল। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নির্বাক পদ্মের দিকে চাহিয়া থাকিয়া অকস্মাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করিয়া উঠিল—বলি, তোর হল কি?

পদ্ম এতক্ষণে অনিরুদ্ধের দিকে চাহিল।

অনিরুদ্ধ আবার চিৎকার করিয়া উঠিল হল কি তোর?

শান্তস্বরে পদ্ম জবাব দিল কি হবে? কিছুই হয় নাই।…শরীরের অসুস্থতার কথা অনিরুদ্ধকে বলিতেও তাহার ইচ্ছা হইল না, ভালও লাগিল না। পাথরকে দুঃখের কথা বলিয়া কি হইবে? অরণ্য-রোদনে ফল কি? কথার শেষে একটি বিষণা মৃদু হাসি তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল।

দাঁতে দাঁত ঘষিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—তবে? তবে উদাসিনী রাইয়ের মত বসে রয়েছিসচালকাঠের দিকে চেয়ে?

মুহুর্তে পদ্ম যেন দপ করিয়া জুলিয়া উঠিল—তাহার অলস শিথিল দেহের সর্বাঙ্গে চকিতের জন্য একটি অধীর চাঞ্চল্য যেন খেলিয়া গেল, ডাগর চোখ দুটি ক্রোধে রক্তাভ, উগ্র ভঙ্গিতে বিস্ফারিত হইয়া উঠিল। অনিরুদ্ধের মনে হইল—দুই টুকরা লোহা যেন কামারশালার জ্বলন্ত অঙ্গারের মধ্যে আগুনের চেয়েও দীপ্তিময় এবং উত্তপ্ত হইয়া গলিবার উপক্রম করিতেছে। পদ্মের দেহখানা পর্যন্ত জ্বলন্ত অঙ্গারের মত দুঃসহ উত্তাপ ছড়াইতেছে। এ মূর্তি পদ্মের নূতন। অনিরুদ্ধ ভয় পাইয়া গেল। এইবার পদ্ম কি বলিবে, কি করিবে সেই আশঙ্কায় সে অধীর অস্থির হইয়া উঠিল। পদ্ম কিন্তু মুখে কিছু বলিল না। তাহার ক্রোধ পাত্রে আবদ্ধ জ্বলন্ত ধাতুর মতই তাহার দৃষ্টি ও দেহভঙ্গির মধ্যেই গণ্ডিবদ্ধ হইয়া রহিল; কেবল একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। অনিরুদ্ধ দেখিল—পদ্ম যেন কাঁপিতেছে; সে শঙ্কিত হইয়া ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিলকি হল পদ্মঃ পদ্ম!

সর্বদেহ সঙ্কুচিত করিয়া পদ্ম বোধহয় অনিরুদ্ধের নিকট হইতে সরিয়া যাইতে চাহিল, কিন্তু পারিল নাপিতে কাঁপিতে সে দেওয়ালে ঠেস দিয়া ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল।

***

অনিরুদ্ধ ছুটিয়া জগন ডাক্তারের কাছে চলিয়াছিল।

পথে চণ্ডীমণ্ডপের উপরে ডাক্তারের আস্ফালন শুনিয়া সে চণ্ডীমণ্ডপেই উঠিয়া আসিল। চণ্ডীমণ্ডপে তখন গ্রামের প্রায় সমস্ত লোকই আসিয়া সমবেত হইয়াছে। ডাক্তার কেবল আস্ফালন করিতেছে—দরখাস্ত করব। কমিশনারের কাছে টেলিগ্রাম করব।

উর্দি-পরা একজন সরকারি পিয়ন চণ্ডীমণ্ডপের দেওয়ালের গায়ে একটা নোটিশ লাইয়া দিতেছে-আগামী ৭ই পৌষ হইতে এই গ্রামে সার্ভে-সেটেলমেন্টের খানাপুরী আরম্ভ হইবেক। অতএব প্রত্যেক ব্যক্তিকে আপন আপন জমির নিকট উপস্থিত থাকিয়া সীমানা সরহ দেখাইয়া দিতে আদেশ দেওয়া যাইতেছে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী কার্য করা যাইবেক।

গ্রামের লোকগুলি চিন্তিতমুখে গুঞ্জন করিতেছে।

শ্ৰীহরি ও গোমস্তা কথা বলিতেছে সেটেলমেন্ট হাকিমের পেশকারের সঙ্গে।–মাছ-একটা বড় মাছ।

দেবু নীরবে একপাশে দাঁড়াইয়া ছিল। অনিরুদ্ধ তাহারই কাছে ছুটিয়া গেল। জংশন হইতে ফিরিবার পথে দুর্গার বাড়িতে সে সকালবেলার কথা সব শুনিয়াছে। দেবুকে সে বরাবরই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে; সেদিন সে তাহার উপর রাগ ঠিক করে নাই—অভিমানই করিয়াছিল। আজও দুর্গার কাছে সব শুনিয়া, দেবুর উপর তাহার অভিমান দূর হইয়া প্রগাঢ় অনুরাগে হৃদয় ভরিয়া উঠিয়াছে।

আবেগকম্পিত কণ্ঠে সে বলিল দেবু-ভাই!

–কি, অনি-ভাই, কি বল?

অনিরুদ্ধ কাঁদিয়া ফেলিল।

***

দেবুই জগন ডাক্তারকে ডাকিল—শিগগির চল, অনিরুদ্ধের স্ত্রীর মূৰ্ছা হয়েছে।

জগন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে অনিরুদ্ধের দিকে একবার চাহিল, তারপর নিজেই অগ্রসর হইয়া ডাকিল—এস তা হলে।

সেটেলমেন্ট সংক্রান্ত বক্তৃতা আপাতত মুলতুবি থাকিল, চলিতে চলিতে সে আরম্ভ করিল গ্রাম্য লোকের অকৃতজ্ঞতার উপর এক বক্তৃতা—তবু আমার কর্তব্য করে যাব আমি। চিকিৎসক। যখন হয়েছি তখন ডাকবামাত্র যেতে হবে আমাকে, যাব আমি। তিন পুরুষ ধরে গায়ে ফি দেয় নি, আমিও নেব না ফি। ফি? ডাক্তার হাসিল-ওষুধের দামই কেউ দেয় না তো ফি!

দেবু পকেট হইতে বিড়ি বাহির করিয়া বলিলবিড়ি খাও ডাক্তার।

—দাও। বিড়িটা পাঁতে চাপিয়া ধরিয়া ডাক্তার বলিল তোমায় খাতা দেখাব পণ্ডিত—দশ হাজার টাকা! আমাদের দশ হাজার টাকা ড়ুবিয়ে দিলে লোকে, খাতিরের লোক হল মহাজন যারা সুদ নেয়; কঙ্কণার বাবুরা ছিরে পাল এরাই।

জগনের ডাক্তারখানার সম্মুখেই সকলে আসিয়া পড়িয়াছিল। ডাক্তারখানা হইতে একটা শিশি লইয়া ডাক্তার বলিল—চল! এক মিনিট—এক মিনিটেই চেতন হয়ে যাবে, ভয় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *