আমি মেকাপ নিচ্ছি। সুবীরদা যন্ত্রের মত হাত চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মধ্যে চাপা টেনশান। আগের মেকাপের সঙ্গে আজকের মেকাপের মিল থাকতে হবে। মেকাপ কনটিনিউটি অনেক বড় ব্যাপার। মওলানা সাহেব আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আগ্রহ নিয়ে তিনি দৃশ্যটা দেখছেন। মেকাপ নেবার সময় অন্য কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে খুব অস্বস্থি লাগে। এখন অবশ্যি লাগছে না। মওলানা সাহেবের বিস্ময় দেখতে ভাল লাগছে। যে কোন মানুষের বিস্ময় ও আনন্দ দেখতে ভাল লাগে। আমি মওলানা সাহেবের সঙ্গে টুকটাক গল্পও করছি।
মা জ্বরে প্রায় অচেতন হয়ে আছেন। তাঁর কথা এখন আর সেভাবে মনে পড়ছে না। মেকাপ ম্যান সুবীরদা ক্রমেই আমাকে দিলু বানিয়ে দিচ্ছেন। আমি যতই দিলু হচ্ছি ততই চারপাশের জগৎ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি। পুরোপুরি যখন দিলু হয়ে যাব তখন আর রুমালীর জগৎ নিয়ে ভাবব না। আমার জগৎটা চলবে দিলুর মত। দিলু খুব হাসি খুশি। সে সবার সঙ্গেই কথা বলে। অকারণে কথা বলে।
মওলানা সাহেব!
জ্বি আম্মাজী।
আপনি দেখি মেকাপ দেয়ার সব কৌশল শিখে ফেলছেন।
মওলানা সাহেব হাসলেন। তার হাসি সুন্দর। হাসির মধ্যে শিশু শিশু ভাব আছে। দিলুর সঙ্গে খুব সূক্ষ্মভাবে তার কিছু মিল আছে। তার কৌতূহল বেশি। তিনি কথা বলতে পছন্দ করেন।
আমি বললাম, মওলানা সাহেব! মেকাপ নেয়া কি গুনাহর কাজ?
গুনাহ হবে কেন?
আল্লাহ্ যে চেহারা দিয়ে পাঠিয়েছেন, সেই চেহারা বদলে ফেলা হচ্ছে এটা গুনাহ না?
আমি এত কিছু জানি না মা। আমার জ্ঞান বুদ্ধি খুবই কম। তবে মেকাপ দিয়ে চেহারা সুন্দর করা হয়— এর মধ্যে দোষের কী? আল্লাহ্ পাক সুন্দর পছন্দ করেন।
সুন্দর পছন্দ করেন কেন?
কারণ তিনি সুন্দর।
তিনি সুন্দর আপনাকে কে বলল?
কেউ বলে নাই। আমার অনুমান।
সুবীরদা বিরক্ত মুখে বললেন, মওলানা সাহেব এখান থেকে যান। আমার অসুবিধা হচ্ছে। মেকাপ নিতে নিতে আর্টিস্ট যখন কথা বলে তখন চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। সেই ভঁজ উঠতে চায় না।
মওলানা সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, জি আচ্ছা জনাব যাচ্ছি। তিনি লজ্জিত মুখে চলে যাচ্ছেন। আমার মায়া লাগছে। সুবীরদা এমন কঠিন আচরণ কখনো করেন না। আজ করছেন, কারণ আজ তার মন খারাপ। আমার আগে তিনি পাপিয়া ম্যাডামকে মেকাপ দিয়েছেন। ম্যাডাম তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছেন। মেকাপ শেষ হবার পর ম্যাডামের হাতে আয়না দেয়া হল। তিনি আয়নায় কিছুক্ষণ নিজেকে দেখে বললেন, এটা কী মেকাপ দিয়েছ? আমি কি সার্কাসের সঙ? এই বলে তিনি থেমে থাকেন নি–আয়না ছুঁড়ে ফেলেছেন। আয়নাটা ঘাসের উপর পড়েছে বলে ভাঙ্গে নি। পাপিয়া ম্যাডাম বলেছেন, মেকাপ তুলে আবার দাও। মন বসিয়ে কাজ কর। কাজ করবে বাংলাদেশে মন পড়ে থাকবে কোলকাতায় তাতো হবে না।
সুবীরদা পাপিয়া ম্যাডামের মেকাপ তুলে আবার মেকাপ দিলেন। এরপরেও যে তিনি শান্ত ভঙ্গিতে আমার মেকাপ দিতে পারছেন তাই যথেষ্ট। সুবীরদা না হয়ে অন্য কেউ হলে পারত না।
সুবীরদা!
কী মা?
আপনার মন খারাপ ভাব কি কমেছে?
পাপিয়া ম্যাডামের ব্যাপারটার কথা বলছ?
জ্বি।
দূর কোন মন খারাপ না। ছোট কাজ যারা করে তাদের এইসব অপমান গা সহা। যখন অপমানটা করে তখন কষ্ট হয়। তারপর আর কষ্ট থাকে না।
এখন নেই?
একটু একটু আছে।
একটু একটু আছে কেন?
ঐ যে ম্যাডাম বললেন, কাজ কর বাংলাদেশে মন পড়ে থাকে কোলকাতায় এই জন্যে। আমাদের স্বজাতির অনেকেই ভারতে চলে গেছে এটা যেমন ঠিক আবার অনেকেই মাটি কামড়ে এখানে পড়ে আছে এটাও ঠিক। কেউ যখন বলে তোমার মন পড়ে আছে কোলকাতায় তখন তারাই মনে করিয়ে দেয় যে বাংলাদেশটা পুরোপুরি আমার না।
সুবীরদা, মানুষ রাগ করে যে কথা বলে সে কথা ধরতে নেই।
মাগো রাগের সময়ই মানুষ সত্য কথাগুলি বলে। মনের ভেতর চাপা পড়ে থাকা কথা তখন বের হয়ে আসে।
আপনি ঠিক বলেন নি। রাগের সময় আমরা সব সময় উল্টা পাল্টা কথা বলি। মা খুব রেগে গেলে আমাকে বলেন— তুই মর। তুই মরলে আমার শান্তি হয়। আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না যে মা আমার মৃত্যু চান।
না বিশ্বাস করি না।
তাহলে কি আপনি স্বীকার করলেন যে রাগের সময়ই মানুষ ভুল কথাগুলি বলে?
সুবীরদা হেসে ফেলে বললেন, হ্যাঁ স্বীকার করলাম। তোমার বুদ্ধি খুব ভাল। ধারাল বুদ্ধি।
ধারাল বুদ্ধিটা কী?
যে বুদ্ধি কেটে কেটে যায়–সেটাই ধারাল বুদ্ধি।
বুদ্ধি তাহলে অনেক প্রকার?
অবশ্যই। শান্তি-বুদ্ধি যেমন আছে অশান্তি-বুদ্ধিও আছে। শান্তি-বুদ্ধির কেউ তোমায় আশে পাশে থাকলে তোমার শান্তি শান্তি লাগবে। অশান্তি-বুদ্ধির কেউ তোমার আশে পাশে থাকলে তোমার অশান্তি লাগবে।
আমার কোন ধরনের বুদ্ধি?
ঐ যে বললাম, ধারাল বুদ্ধি।
শান্তি-বুদ্ধি, না অশান্তি-বুদ্ধি?
অশান্তি-বুদ্ধি!
আমি হেসে ফেললাম। সুবীরদাও হাসছেন। কী আশ্চর্য ব্যাপার আমি কত সহজ ভাবে হাসছি। গল্প করছি। অথচ আমার মা জ্বরে ছটফট করছেন। এতক্ষণে তাঁর কথা একবার মনেও পড়ে নি। আমি দিলু হয়ে যেতে শুরু করেছি। মেকাপ শেষ হবার পর দিলুর পোশাকটা পরব। দিলু হবার দিকে আরকটু এগুব।
সোহরাব চাচা গম্ভীর মুখে আমার দিকে আসছেন। তিনি একই সঙ্গে গম্ভীর, এবং বিরক্ত। অথচ তাঁরই এখন সবচে হাসি খুশি থাকার কথা। লোকজন সব চলে এসেছে। ডিরেক্টর সাহেব সুস্থ। পুরোপুরি শুটিং শুরু হতে যাচ্ছে। জেনারেটারের অভাবে রাতের কাজ আগে কিছু হয় নি। জেনারেটার চলে এসেছে। এখন রাতেও কাজ হবে। শুটিং বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে।
রুমালী।
জ্বি চাচা।
স্যার তোমাকে ডাকছেন।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার মার যে এত জ্বর সেটাতো তুমি আমাকে বল নি। অসুখ বিসুখ হলে আমাকে জানাবে না?
আপনি এত ব্যস্ত। আপনাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করছিল না।
এটাতো বিরক্ত হবার কিছু না। অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যাই হোক, আমি সব ব্যবস্থা করেছি। ডাক্তার চলে আসবেন। জালালের মাকে বলে এসেছি মাথায় পানি ঢালতে।
থ্যাংক য়্যু চাচা।
স্যার কী বলে শুনে, মার কাছে গিয়ে বোস। সব রেডি হলে আমি তোমাকে ডেকে নিয়ে যাব।
সোহরাব চাচা চলে যাচ্ছিলেন। আমি ডাকলাম, চাচা একটা কথা শুনে যান। তিনি থমকে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, আজ আপনি আমার সঙ্গে এমন রেগে রেগে কথা বলছেন কেন? প্লীজ রেগে থাকবেন না। আপনি রেগে থাকলে আমার অভিনয় খারাপ হবে।
সোহরাব চাচা আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, রুমালী তোমার অভিনয় খারাপ হবে না। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের মধ্যে তুমি একজন। যে কোন অবস্থায় তোমার অভিনয় ভাল হবে।
সুবীরদা একটা ভেজা কাপড় আমার মুখের উপর দিয়ে দিলেন। আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। আমি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের একজন, সোহরাব চাচা এই কথা কেন বললেন, তা বের করার চেষ্টা করছি। তিনি কি কিছু জানেন? না কিছু অনুমান করেছেন?
ডিরেক্টর সাহেবকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে তাঁর বয়স দশ বছর কমে গেছে। তিনি ধবধবে শাদা প্যান্টের উপর লাল-নীল স্ট্রাইপ দেয়া হাফ সার্ট পরেছেন। আজ কি তিনি চুল অন্যরকম করে আঁচড়েছেন? তাকে একটু যেন অচেনা লাগছে। তার চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এই ভদ্রলোকের চশমা প্রীতি আছে। তার অনেকগুলি চশমা। তিনি একেক সময় একেক চশমা পরেন। তিনি আমাকে দেখে হাসি মুখে বললেন, রুমালী তোমার খবর কী?
ঝড় বৃষ্টির রাতে স্কুল ঘরের কথা তাঁর কি কিছু মনে নেই?
আমিও তার মতই সহজ এবং স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছি। পারছি না। আমার হাত পা ভারী হয়ে আসছে। গলার স্বর বসে যাচ্ছে। সোহরাব চাচার কথা মত আমি যদি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হয়েও থাকি–এই মানুষটার সামনে সহজ হবার সাধারণ অভিনয় করতে পারছি না। কিংবা কে জানে সহজ হবার অভিনয়ই হয়তো সবচে কঠিন।
তোমাকে একটা জরুরি কথা বলার জন্যে ডেকেছি।
বলুন।
বোস! জরুরি কথাটা এমন না যে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে হবে।
আমি বসলাম। তিনি চেয়ার টেনে আমার সামনে বসলেন। হাসি মুখে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, জরুরি কথার আগে জরুরি না এমন একটা জিনিস দেখ। আমার হাতে এটা কী দেখ? নাও হাতে নিয়ে দেখ। এটা হচ্ছে একটা বুনো ফল। ফটার নাম হল–মন-ফল। ইংরেজী করলে হবে Mind-Fruit.
মন-ফল?
হ্যাঁ মন-ফল। পাহাড়ি অঞ্চলের গাছে হয়। কাটায় ভর্তি গাছ। ঢল যখন নামে তখন পানিতে ভেসে আসে।
কাগজী লেবুর সাইজের ফলটা আমি হাতে নিলাম। পচা টাইপ গন্ধ আসছে। বুনো ফলের বুনো গন্ধ। আমি বললাম, ফলটার বিশেষত্ব কী?
কাচা অবস্থায় ফলটা বিষাক্ত। যখন পাকে তখন অল্পবয়েসী মেয়েরা ফলটা খুব আগ্রহ করে খায়। তখন তাদের মন না-কি অন্য রকম হয়ে যায়। এই জন্যেই ফলটার নাম মন-ফল Mind-Fruit. মেয়েরা এই ফল লুকিয়ে চুরিয়ে খায়।
শুধু মেয়েরাই খায়? ছেলেরা খায় না।
শুনেছি ছেলেরা খায় না। তাদের উপর ফলের তেমন প্রভাবও নেই। ফলটা অবিবাহিত কুমারী মেয়েদেরই প্রিয়। তোমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে না?
জ্বি লাগছে।
আমার ধারণা এই ফলে কোন হেলুসিনেটিং ড্রাগ-ট্রাগ আছে। মাইন্ড অলটারিং ড্রাগ, ধুতরায় যেমন আছে তেমন। ঠিক করেছি ফলের কার্যকারিতা আমি পরীক্ষা করে দেখব।
খাবেন?
হ্যাঁ খাব।
আপনিতো বললেন, ছেলেদের উপর কোন প্রভাব পড়ে না।
এই জন্যেই বেশি করে খাব। আমি গোটা চারেক ফল জোগাড় করতে বলেছি। সহজে পাওয়া যায় না।
এই ফলটা কি পাকা?
বাইরের খোসা সবুজ হলেও ফলটা না-কি পাকা।
আপনার খেয়ে দরকার নেই। আমাকে দিন–আমি খেয়ে কী হয় আপনাকে বলব।
আরে না। তুমি কী খাবে! আমি আগে পরীক্ষা করে নেই। ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে তখন তোমাকে বলব। এই সব পরীক্ষা মাঝে মাঝে খুব ফ্যাটালও হয়। সিদ্ধির শরবত খেয়ে একবার প্রায় মরতে বসেছিলাম। গল্পটা শুনবে?
আমি গল্পটা শুনতে চাচ্ছি না। কারণ আমি দ্রুত দিলু হয়ে যাচ্ছি। দিলু অন্যের গল্প শুনতে তেমন আগ্রহী না। সে নিজের গল্প করতে চায়। আমার অনেক গল্প আছে যা আমি উনাকে শুনাতে চাই। মুখে সাবানের ফেনা নিয়ে ফু দিয়ে আমি খুব সুন্দর বাবল বানাতে পারি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে মুখ থেকে একের পর এক বেলুন বের হচ্ছে। কিন্তু উনি নিজেই এখন গল্প করবেন। সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরানো মানে লম্বা গল্পের প্রস্তুতি।
সে এক মজার গল্প। না মজার না, টেনশানের গল্প। এখনো মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। এই দেখ গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
তিনি হাত এগিয়ে দিলেন। হাতের লোম সত্যি খাড়া হয়ে আছে।
আমি হাসলাম, তিনি গল্প শুরু করলেন। খুব আগ্রহ করে যে গল্পই বলা হোক শুনতে ভাল লাগে। অসাধারণ গল্প ও অনাগ্রহের সঙ্গে বললে শুনতে ভাল লাগে না। ডিরেক্টর সাহেব সব গল্পই খুব আগ্রহের সঙ্গে করেন। তবে আমার সমস্যা হচ্ছে—আমি উনার কোন গল্পই মন দিয়ে শুনতে পারি না। গল্পের মাঝামাঝি জায়গায় সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। মনে হয় তিনি অনেক দূর থেকে কথা বলছেন। তাঁর চেহারা অস্পষ্ট হয়ে আসে। কেন এ রকম হয়?
রুমালী শোন, সিদ্ধির সরবতের ব্যাপারটা তোমাকে বলি— শাক্ত হিন্দুরা কালীপূজার রাতে এই সরবত তৈরি করে। মহাদেব শিব তাঁর সঙ্গী নন্দি ভূঙ্গিকে নিয়ে এই সরবত খেতেন বলে শিবের অনুসারিরাও পূজার অঙ্গ হিসেবে খায়। পেস্তা বাদাম পিশে, দুধ চিনি মিশিয়ে এই সরবত তৈরি করা হয়। ঘটিতে করে বরফ কুচি মিশিয়ে পরিবেশন করে। খেতে অতি স্বাদু। তবে সরবতের আসল ইনগ্রেডিয়েন্ট ধুতরো পাতার রস। ধুতরো পাতা কচলে সেই রস সরবতে মিশিয়ে দেয়া হয়। ফল ভয়াবহ। ধুতরো পাতার রসে আছে—পাওয়ারফুল মাইন্ড। অলটারিং হেলুসিনেটিং ড্রাগ। যে খায় কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জগৎটা যায় পাল্টে। সে ভয়ংকর ভয়ংকর সব জিনিস দেখতে থাকে।
কী রকম ভয়ংকর?
নির্ভর করে সরবতটা কে খেয়েছে তার মানসিকতার উপর। কেউ ভূত-প্রেত দেখে, কেউ দেখে তার আত্মা শরীর থেকে বের হয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে।
আপনি কী দেখেছিলেন?
আমি দেখলাম আমার দুটা হাত লম্বা হতে শুরু করেছে। হাতটা যেন রবারের। কেউ টানছে আর লম্বা হচ্ছে। গল্পে জ্বীনের হাতের কথা পড় না? জ্বীন খেতে বসেছে। কাগজি লেবু দরকার। লম্বা হাত বাড়িয়ে বাড়ির উঠোনের কোণার কাগজি লেবু গাছ থেকে লেবু ছিড়ে নিয়ে এল। সেই রকম।
অদ্ভুত তো! অদ্ভুততো বটেই।
সিদ্ধির সরবত খাবার পরই গাছ গাছড়ার ব্যাপারে আমার খুব কৌতূহল হয়। এই বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করি। বোটানীর ছাত্র না হয়েও—গাছ গাছড়া সম্পর্কে আমি অনেক জানি। প্রমাণ দেব?
না প্রমাণ দিতে হবে না। প্রমাণ দেবেন কেন? আপনি যা বলবেন, আমি তাই বিশ্বাস করব।
যে যা বলে তুমি কি তাই বিশ্বাস কর?
না।
সিদ্ধির সরবতের গল্পটা তোমার মনে হয় ভাল লাগে নি।
আপনার এ রকম মনে হচ্ছে কেন?
যাদেরকেই আমি সিদ্ধির সরবত খাবার গল্পটা বলেছি তারাই গল্পের এক পর্যায়ে বলেছে—আমি একটু খেয়ে দেখতে চাই। কোথায় পাওয়া যায়? তুমি কিছু বল নি।
আপনি কি একই গল্প সবাইকে করেন?
আমি একা কেন সবাইতো তাই করে। সব মানুষেরই তার নিজের কিছু গল্প থাকে। এই গল্পগুলিই সে সবাইকে করে।
ও।
আচ্ছা দেখি তোমার জ্ঞান। বল কত রকমের শাক আমাদের দেশে পাওয়া যায়?
জানি না।
অবশ্যই জান। অন্তত কিছু কিছুতো জান—পুঁই শাক, লাল শাক, কলমী শাক, পালং শাক…. এর বাইরে কী জান?
এর বাইরে কিছু জানি না।
আচ্ছা দাঁড়াও তোমাকে কিছু শাকের নাম শুনিয়ে দেই…. সরিষা শাক, জয়ন্তি শাক, গুলঞ্চ শাক, হিঞ্চ শাক, ঘেঁটু শাক, সুষনি শাক, কালকাসুন্দে শাক, বেতো শাক, লাউ শাক, শেভেঞ্জে শাক….। এদের মধ্যে একটা শাক আছে যা খেলে পাগল ভাল হয়। মনোবিকারগ্রস্তদের বিকার কমে। শাকটার নাম হল সুষনি শাক। বোটানিক্যাল নাম হল—Marsilea quadrifolia. তোমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে কি-না বল?
লাগছে।
ভেরি গুড। আচ্ছা এখন যাও—আমাদের ক্যামেরা ওপেন করার সময় হয়ে এসেছে।
আপনি কী জরুরি কথা যেন বলবেন বলেছিলেন।
জরুরি কথা? ও হ্যাঁ জরুরি কথা। আচ্ছা এখন থাক—পরে বলব। অনেক অপ্রয়োজনীয় কথার মাঝখানে হঠাৎ একটা প্রয়োজনীয় কথা, শুনতেও ভাল লাগে না। বলতেও ভাল লাগে না।
আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম তিনি খুব অস্বস্থি বোধ করছেন। না অস্বস্থি না, অস্থিরতা। মনে হচ্ছে তিনি কোন কিছুতে মন বসাতে পারছেন না। চেয়ারে বসেছিলেন, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আবার বসলেন। ড্রয়ার খুলে সোনালী ফ্রেমের চশমা বের করে পরলেন। আয়নায় নিজেকে দেখলেন। এই চশমাটাও তার পছন্দ হল না। তিনি ড্রয়ার হাতড়াচ্ছেন। ড্রয়ারের জিনিসপত্র নামাচ্ছেন। তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন— রুমালী তোমার সঙ্গে কি নীরার কথা হয়েছে?
জ্বি হয়েছে।
কী ধরনের কথা?
সাধারণ কথা।
সাধারণ কথার ফাঁকে সে কি বলেনি— আমি অসুস্থ?
জ্বি বলেছেন।
কী ধরনের অসুস্থ তা বলে নি?
জ্বি না।
তুমি জানতে চাও নি?
জ্বি না।
তোমার কাছে কি আমাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে?
জ্বি-না।
অনেক অসুখ আছে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আমি আসলেই অসুস্থ।
তিনি আবার আগের জায়গায় এসে বসেছেন। এখন তাকে শান্ত মনে হচ্ছে। অস্থিরতা কেটে গেছে। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু ক্লান্ত গলায় বললেন–নীরা যুক্তি-তর্ক খুব ভাল পারে। সে তার যুক্তি দিয়ে নিমিষের মধ্যে প্রমাণ করে দিতে পারে যে আমি সুস্থ আবার প্রমাণ করতে পারে আমি অসুস্থ। ও অনেকটা গার্গীর মত।
গার্গী কে?।
প্রাচীন ভারতের এক মেয়ে, যাজ্ঞবল্ক্য নামের এক মহাজ্ঞানী পন্ডিতকে যুক্তিতে হারিয়ে সে লেজেগোবরে করে দিয়েছিল। তর্কে হেরে ভূত হয়ে যাজ্ঞবল্ক্য শেষ পর্যন্ত বললেন,— গার্গী তুমি প্রশ্নের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। তুমি যদি না থাম তাহলে তোমার মাথা খসে পড়বে। পৌরাণিক গল্প।
আমার ইচ্ছা করছিল বলি, তর্কে হেরে আপনিও কি যাজ্ঞবল্কৈর মত বলেন— তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি থাম নয়তো তোমার মাথা খসে পড়বে। তা বললাম না। কুণ্ঠিত গলায় জানতে চাইলাম, আজ আমার কোন অংশটা হবে?
সবাইকেইতো সবারটা বলেছি তোমাকে বলা হয় নি?
জ্বি না।
আচ্ছা পরে বলব।
পরে কেন। এখনি বলুন। আমি নিজের মনে একটু ভাবব।
তিনি চিন্তিত মুখে আরেকটা সিগারেট হাতে নিলেন। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সিগারেটে আগুন ধরালেন। সিগারেটে টান দিয়ে খুব কাশতে লাগলেন। জীবনের প্রথম সিগারেটে টান দিলে মানুষ যে ভাবে কাশে তিনি সেই ভাবে কাশছেন। মনে হচ্ছে তাঁর জগৎটা আবারো এলোমেলো হয়ে গেছে। তিনি এ রকম করছেন কেন?
দিলুর যে অংশটা আজ শুট করা হবে সেটা হচ্ছে সিক্লোয়েন্স ওয়ান হানড্রেড থার্টি টু। দিলুর এক কাল্পনিক বান্ধবী আছে— Imaginary friend. তার নাম তৃণা। দিলু যখন কোন ব্যাপারে খুব আপসেট হয় তখন সে কোন এক নির্জন জায়গায় চলে যায়। তার কল্পনার বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে। ঐ অংশটা।
কল্পনার বান্ধবীকে কি সত্যি সত্যি দেখানো হবে?
না দেখানো হবে না। দিলুর এই কাল্পনিক বান্ধবী কখনো দিনে আসে না। আসে রাতে। কাজেই আমি কী করব শোন দিলুকে রাতে আধো আলো, আধো অন্ধকারে বসিয়ে দেব। লাইট সোর্স এমন রাখা হবে যেন দেয়ালে দিলুর দুটা ছায়া পড়ে। দিলু তার একটা ছায়ার সঙ্গে কথা বলবে। দিলু এবং তার দুটা ছায়াকে নিয়ে থ্রি শর্টে শুট করা হবে। থ্রি শট থেকে টু শট। দিলু এবং দিলুর। একটা ছায়া। টু শট থেকে সিঙ্গেল শট। ক্লোজ আপ। দিলুর ক্লোজ আপ, ছায়ার ক্লোজ আপ।
বাহ সুন্দর তো।
সুন্দরতো বটেই। মানুষ এবং তার ছায়া নিয়ে টু শট বানানো–কনসেপ্ট হিসেবে ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা তুমি এখন যাও।
আপনার কি শরীর খারাপ? না শরীর খারাপ না। I am just fine.
আমি তার ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ঘরের বাইরেই সোহরাব চাচা। দেখে মনে হল তিনি আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
তাঁর মুখ আগের মতই বিরক্ত ও বিষণ্ণ। মনে হচ্ছে তিনি রেগেও আছেন। কার উপর রেগে আছেন? আমার উপর? সোহরাব চাচা আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছেন। আমি বললাম, চাচা আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন? সোহরাব চাচা নিচু গলায় বললেন, হ্যাঁ বলব। স্যারের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?
হ্যাঁ।
কী কথা হয়েছে?
শাক নিয়ে কথা হয়েছে। বাংলাদেশে কত রকম শাক পাওয়া যায় এইসব।
আর কোন কথা হয় নি?
না।
শাক সজির বাইরে কোন কথা হয় নি?
জ্বি না। কী কথা হবে?
সোহরাব চাচা জবাব দিলেন না। তিনি হন হন করে উল্টো দিকে যাচ্ছেন। খুব সম্ভব ডিরেক্টর সাহেবের ঘরে যাচ্ছেন। কোন সমস্যা কি হয়েছে? আমাকে নিয়ে কোন সমস্যা? হোক সমস্যা। আমি মার ঘরের দিকে রওনা দিলাম।
আশ্চর্য মার ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করছ না। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ডাকবাংলোর সামনে একটা জীপ গাড়ি এসে থেমেছে। জীপ থেকে বেশ কিছু অচেনা মানুষজন নামছে। এদের মধ্যে একট মেয়ে আমার বয়েসী। খুব মিষ্টি চেহারা। মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল। মেয়েটি অভিভূতের মত চারদিকে তাকাচ্ছে। একবার তাকাল আমার দিকে। আমি হাসলাম। এত দূর থেকে সে নিশ্চয়ই আমার হাসি দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পেলে তার ভাল লাগতো। সে দ্বিতীয়বার আমার দিকে তাকাতেই আমি হাত নাড়লাম। দিলু হলে তাই করতো। মেয়েটি এখন অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। সোহরাব চাচা ওদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। জীপের ড্রাইভার বড় বড় স্যুটকেস টেনে নামাচ্ছে। এরা মনে হয় আমাদের সঙ্গে থাকবে।
পাপিয়া ম্যাডামের মেয়েটা উঠোনে একা একা হাঁটছে। এর সঙ্গে আমার এখনো কথা হয় নি। আজ কোন এক ফাঁকে তার সঙ্গে ভাব করব। একী মেয়েটা বিড় বিড় করে কথা বলছে নাকি? কার সঙ্গে কথা বলছে? কল্পনার কোন বান্ধবী। দিলুর মত তারও কি কোনো ইমাজিনারি ফ্রেন্ড আছে?
আমি মার ঘরে ঢুকলাম। ঘরে মা একা। তাঁর মাথায় পানি দেয়া হয়েছে। চুল ভেজা। মা চাদর গায়ে অসহায় ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। আমি ঘরে ঢুকতেই চোখ মেললেন। তার চোখ টকটকে লাল। তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, বকু একটা গাড়ি এসে থেমেছে না? শব্দ শুনলাম। আমি বললাম, হ্যাঁ।
কে এসেছে তোর বাবা?
বাবা আসবে কীভাবে? বাবার কি আসার কথা?
সোহরাব ভাইকেতো বলেছি উনাকে খবর দিতে।
উনি খবর পাঠালেও বাবার আসতে আসতে দুতিন দিন লাগবে।
দুতিনদিন লাগবে কেন? ঢাকা থেকে এখানে আসতে পাঁচ ছঘন্টা লাগে। পাগলের মত কথা বলিস কেন?
মা তোমার জ্বর মানে হয় খুবই বেশি। তুমিতো কথাই বলতে পারছ না। তোমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
আমি মার কপালে হাত রেখে চমকে উঠলাম–জ্বর আসলেই বেশি। পানি ঢেলে কোন লাভ হয় নি। জ্বর কমে নি। মার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। কেমন টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছেন।
জীপে করে কে এসেছে বকুল?
জানি না মা।
জীপের শব্দ শুনে মনে হল তোর বাবা এসেছে।
একবারতো বলেছি মা, বাবা আসে নি।
তোর বাবা এলে থাকবে কোথায়?
এই ঘরেই থাকবে, আর থাকবে কোথায়?
আরে না। তা কী করে হয়! তোর বাবার সঙ্গে আমি কি আর এক ঘরে থাকতে পারি? তুই আর তোর বাবা এইখানে থাকিস। আমি অন্য কোথাও চলে যাব।
বাবা এসে কোথায় থাকবে সেটা নিয়ে তোমাকে এখন মাথা গরম করতে হবে না। বাবা আসুক তারপর দেখা যাবে। আমার মেকাপ কেমন হয়েছে মা?
মা আমার দিকে না তাকিয়েই অনাগ্রহের সুরে বললেন, ভাল।
তুমি কী ভাবছ মা?
কিছু ভাবছি না। আচ্ছা শোন, তোর বাবা আবার সঙ্গে করে ঐ ধুমসী মাগীটাকে আনবে নাতো?
আনতেও পারে। মা শোন-ধুমসী মাগী টাইপ কথা বলো নাতো শুনতে খারাপ লাগে।
ধুমসী মাগীকে কী বলব–শুকনো মাগী বলব?
আচ্ছা ঠিক আছে—যা বলতে ইচ্ছে করে বলো।
মা শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে আছেন। যেন হাত ছেড়ে দিলেই আমি কোথাও চলে যাব। আমাকে আটকে রাখতে হবে।
মা তোমার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?
হুঁ।
পানি খাবে?
খাব।
আমি মাকে পানি এনে দিলাম। মা খেতে পারলেন না। একটু মুখে দিয়েই রেখে দিলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, বকু পানিটা ভয়ংকর তিতা লাগছে। পানি তিতা লাগা খুব অলক্ষণ। মৃত্যুর আগে আগে আল্লাহ পাক পানি থেকে স্বাদ উঠিয়ে নেন। পানি তিতা বানিয়ে দেন।
কত অদ্ভুত কুসংস্কারের মধ্যে যে তুমি বাস কর না মা। রাগ লাগে। জ্বর-জ্বারি হলে পানি তিতা লাগে। পানি কেন সব খাবারই তিতা লাগে।
এই তিতা সেই তিতা না-রে মা। অন্য রকম তিতা।
মা চুপ কর। তোমার কথাবার্তা অসহ্য লাগছে। সামান্য জ্বর হয়েছে আর তুমি কী শুরু করেছ!
মা অনেক কষ্টে পাশ ফিরলেন, একটা হাত আমার কোলে দিলেন। মাকে দেখে আমার এখন ভয়ংকর মায়া লাগছে। ইচ্ছে করছে আমিও মার সঙ্গে চাদরের নীচে চলে যাই। মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি। দিলুতো তাই করবে। সে মাকে এই অবস্থায় ফেলে কোথাও যাবে না।
বকু!
কী মা?
তোর বাবার খুব ভাল একটা গুণ কী জানিস? অসুখ বিসুখে সে খুব সেবা করতে পারে। আমাদের একটা কাজের ছেলে ছিল রুসমত নাম। তার একবার টাইফয়েড হল। উঠে বসতে পারে না, নড়তে চড়তে পারে না এমন অবস্থা। তোর বাবা তাকে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিত। সেই ছেলে এমনই হারামজাদা তোর বাবার পকেট থেকে একদিন মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়ে গেল।
মা তোমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তুমি চুপ করে শুয়ে থাক।
আমার কোন অসুখ বিসুখে তোর বাবা খুবই অস্থির হয়ে পড়ত। অফিস কামাই দিয়ে ঘরে বসে থাকত।
ভাল। বাবার পত্নী প্রেমের কথা শুনে আমি মুগ্ধ।
আমি মাঝে মাঝে অসুখের ভান করতাম। অসুখ বিসুখ কিচ্ছু না। সকালবেলা তোর বাবার অফিসে যাবার সময় শুয়ে পড়ে উহ্ আহ্।
এইসব ন্যাকামীর কথা শুনতে আমার একটুও ভাল লাগছে না মা। চুপ কর।
আচ্ছা যা–চুপ করলাম।
তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতো মা। আমি সোহরাব চাচাকে ডাক্তারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আসি।
আমি মার ঘর থেকে বের হয়েই দেখি সোহরাব চাচা ডাক্তার নিয়ে এদিকেই আসছেন। অল্পবয়সের একজন ডাক্তার। দেখে মনে হয় কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সোহরাব চাচা বললেন, রুমালী তুমি আমার ঘরে গিয়ে একটু বোস। তোমার সঙ্গে কথা আছে। আমি ডাক্তারকে রুগী দেখিয়ে আসি।
রুগী দেখার সময় আমিও সঙ্গে থাকি।
তোমার সঙ্গে থাকার কোন দরকার নেই। তোমাকে যা করতে বলছি কর।
আমি সোহরাব চাচার ঘরের দিকে রওনা হলাম। চারদিক কেমন ফাকা ফাকা লাগছে। মনে হচ্ছে ক্যাম্প খালি–কেউ নেই। একজন লাইটবয় ইলেকট্রিক তার নিয়ে কী যেন করছে। তাকে বললাম, লোকজন সব কোথায়?
সে বলল, শুটিং স্পটে চলে গেছে আপা।
কখন গেছে।
দশ পনেরো মিনিট আগে।
আমাকে ফেলে রেখে সবাই চলে গেল কেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সোহরাব চাচা গম্ভীর ভঙ্গিতে চৌকির উপর বসে আছেন। আমি তার সামনে চেয়ারে বসে আছি। সোহরাব চাচার হাতে মগভর্তি চা। তিনি ঘন ঘন চায়ের মগে চুমুক দিচ্ছেন। চা তাঁর অপছন্দের পানীয় বলে জানতাম। আজ দেখি তিনি আগ্রহ করেই চা খাচ্ছেন।
আমি বললাম, ডাক্তার কী বলেছে সোহরাব চাচা?
বলেছে— প্রেশার খুব হাই। জ্বর কমার অষুধ দিয়েছে। আশংকা করছে নিউমোনিয়া। এরা নতুন ডাক্তার কেঁচো দেখলে ভাবে সাপ। আমার ধারণা সন্ধ্যার মধ্যে জ্বর কমবে। তুমি থাক তোমার মার পাশে-— তাঁর সেবা যত্ন কর। রোগের আসল চিকিৎসা সেবা যত্ন। অষুধ রোগের কোন চিকিৎসা না।
আমি থাকব কী করে? আজ আমার শুটিং হবে!
সোহরাব চাচা কথা না বলে চায়ের কাপে ঘন ঘন কয়েক বার চুমুক দিলেন। কেশে গলা পরিষ্কার করে হুট করে বললেন, বকুল শোন আসল ব্যাপারটা তোমাকে বলি। তোমাকে ছবি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
আমার উচিত ছিল প্রচন্ড ধাক্কা খাওয়া। কেন জানি ধাক্কা খেলাম না। হয়ত আমার অবচেতন মন ব্যাপারটা আগেই বুঝে ফেলেছিল। কিংবা আমি হয়ত অসাধারণ অভিনেত্রী। বড় বিপর্যয়েও শান্ত থাকার অভিনয় করছি। আমি শান্ত গলায় বললাম, আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে?
হ্যাঁ।
যেসব অংশ শুট করা হয়েছে সেগুলো কী হবে?
রিশুট হবে।
নতুন যে মেয়েটা এসেছে সেই আমার অংশ করবে?
হ্যাঁ।
মেয়েটার নাম কী?
ওর নাম তিথি। তিথিকণা।
তুমি বাদ পড়লে কেন জানতে চাও না?
জ্বি না। বাদ পড়েছি এইটাই বড় কথা। কেন বাদ পড়েছি এটা বড় কথা air
সোহরাব চাচা চায়ের মগ নামিয়ে রেখে ক্লান্ত গলায় বললেন, নীরা ম্যাডাম তোমাকে বাদ দেবার কথা বলে দিয়ে গেছেন। তাঁর কথার বাইরে যাবার সাধ্য স্যারের নেই। নীরা ম্যাডাম এই ছবির প্রযোজক।
বুঝতে পারছি। ডিরেক্টর সাহেব যে জরুরি কথাটা বলতে চাচ্ছিলেন সেটা কি এটাই যে আমি বাদ পড়েছি?
হুঁ। স্যার বলতে পারেন নি বলেই আমাকে বলতে হল।
আমরা কি এখন ঢাকায় চলে যাব?
তোমার মার শরীরটা একটু ভাল হোক— তারপর যাও। আমি গাড়ি দিয়ে দেব।
গাড়ি লাগবে না। বাসে তুলে দিলেই আমরা চলে যেতে পারব। চাচা শুনুন–আমি যে বাদ পড়েছি এটা এখন মাকে শুনানোর দরকার নেই। মাকে বললেই হবে যে আমার অংশ শেষ। অসুস্থ অবস্থায় মা যদি শোনেন আমি বাদ পড়েছি খুব কষ্ট পাবেন।
ঠিক আছে তাকে কিছু বলার দরকার নেই। সবাইকে বলে দেব তাকে কিছু না জানাতে।
আমি যে বাদ পড়েছি এটা সবাই জানে?
হ্যাঁ জানে।
কী কারণে বাদ পড়েছি এটা জানে?
স্যার বলেছেন— তুমি অভিনয় খুব ভাল করলেও চরিত্রটার গেটাপের সঙ্গে তোমার গেটাপ মিশছে না। দিলু খুব হাসি খুশি লাইভলী একটা মেয়ে। আর তুমি হলে বিষণ্ণ প্রকৃতির। ঠিকই বলেছেন।
বকুল শোন— পরে তোমাকে সুযোগ দেয়া হবে। তুমি মন খারাপ করো
বাদ পড়েছি বলে মন খারাপ করছি না। আমি মন খারাপ করছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে।
অন্য কারণটা কী?
আগে আপনি কথায় কথায় আমাকে মা ডাকতেন। বাদ পড়ার পর একবারও মা ডাকেন নি। তার মানে হচ্ছে— আগে যে আপনি মা ডাকতেন ভালবেসে ডাকতেন না। হিসেব নিকেশ করে ডাকতেন।
সোহরাব চাচা চুপ করে আছেন। আমি সহজ গলায় বললাম, চাচা শুনুনআমি শুটিং স্পটে যাব। কাউকে বিরক্ত করব না। দূর থেকে শুটিং দেখব। এখন মার কাছে গিয়ে বসে থাকলেই মা সন্দেহ করবেন।
ঠিক আছে। যাও শুটিং স্পটে যাও। তবে বাদ পড়া নিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলবে না। স্যারের কনসানট্রেশন নষ্ট হবে।
আপনি মোটেই চিন্তিত হবেন না চাচা। আমি কাউকেই বিরক্ত করব না। আমি অত্যন্ত লক্ষ্মী টাইপ মেয়ে এবং ভাল অভিনেত্রী।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
দিলু সেজে থাকলেও আমি এখন আর দিলু না, আমি রুমালী। শুটিং স্পটে চলে যাব। রুমালী হয়ে চুপচাপ বসে থাকব। শুটিং দেখব। ক্যামেরাম্যান বলবেন, অল লাইটস। সব বাতি জ্বলে উঠবে। খুলে যাবে অন্য ভুবনের দরজা। যে ভুবনে আমার জায়গা নেই।
শুটিং স্পটে যাবার আগে মেকাপ তুলে ফেলব? না যে ভাবে আছে সে ভাবে যাব? বুঝতে পারছি না। মেকাপ নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। মুখে মেকাপ থাকলে মনে হবে আমি সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে আছি— সবাইকে বলতে চেষ্টা করছি— তোমরা আমার দিকে তাকিয়ে দেখ, আমি তৈরি হয়ে এসেছিলাম তারপর ওরা আমাকে বাদ দিল। তার কোন দরকার নেই। এখন আমি মার কাছ যাব। মাকে বলব, শুটিং-এ যাচ্ছি, দোয়া করোতো মা। এই বলে বিদায় নিয়ে নীচে এসে মেকাপ তুলব। তারপর এক কোণায় চুপচাপ বসে শুটিং দেখব। শুটিং এর ফাঁকে ফাঁকে আশে পাশের মানুষের সঙ্গে টুকটুক করে গল্প করব। হাসব। পাপিয়া ম্যাডামের গম্ভীর মেয়েটার সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করব।
মা জেগেই ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, এখনো যাস নি।
আমি বললাম, না। ডাক্তার তোমাকে কী বলল?
মা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ডাক্তার ছেলেটাকে দেখেছিস? কী রকম রাজপুত্রের মত চেহারা। কী অসম্ভব ভদ্র। এখনো বিয়ে করে নি।
এর মধ্যে সব জিজ্ঞেস করে ফেলেছ?
জিজ্ঞেস করতে অসুবিধা কী? ছেলের বাড়ি কোথায় বলতো?
সুন্দরবন?
সুন্দরবন বাড়ি হবে কেন? ওদের দেশের বাড়ি নেত্রকোনা কী রকম যোগাযোগ লক্ষ্য করেছিস? তোর বাবার দেশের বাড়িও নেত্রকোনা।
আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। এতো পাগলের প্রলাপ! মা আনন্দিত গলায় বললেন— ছেলেটার ভাল নাম শাহেদুর রহমান। ডাকনাম মিঠু।
তোমাকে সে ডাকনামও বলে ফেলল?
নিজ থেকেতো বলে নি। জিজ্ঞেস করেছি বলেই বলেছে। তোকে সে দেখেছে। একদিন শুটিং এর সময় ছিল।
আমাকে পছন্দ করেছে?
তোকে অপছন্দ করবে কে? তোকে যেই দেখবে তারই মাথা ঘুরে যাবে।
মা শোন তুমি মিঠু বাবাজীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসো নিতো?
বাবাজী বলছিস কেন? এইসব আবর কী রকম ঢং? মিঠু বলেছে আমাদেরকে নিয়ে এখান থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে একটা পাহাড় দেখতে যাবে। পাহাড় ভর্তি সুন্দর সুন্দর পাথর। মিঠুর ধারণা দামী পাথর।
মা তোমার বকবকানি অসহ্য লাগছে। আমি শুটিং-এ গেলাম। তুমি শুয়ে শুয়ে ডাক্তার ছেলেকে বড়শি দিয়ে খেলিয়ে ডাঙ্গায় তোলার নানা ফন্দি ফিকির বের করার চেষ্টা করতে থাক।
ঘর থেকে বের হয়েই আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশে মেঘ জমছে। বৃষ্টি হলে শুটিং বন্ধ হয়ে যাবে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম— বৃষ্টি যেন না হয়। চারদিকে যেন ঝলমল করে সূর্যের আলো। শুটিং যেন ঠিকমত হয়। মঈন নামের মানুষটা যেন তার কাজ সুন্দর মত গুছিয়ে শেষ করতে পারেন।