১৩. মৃত্তিকা, মা আমার
স্নেহের মৃত্তিকা,
তিন বছর পর সাহস করে তোমাকে লিখতে বসেছি। বুকটা আজ খুব ভারি। তোমাদের কথা মনে করে, কেঁদেছি সারা দিন। আজ তোমার বাবার দশম মৃত্যুবার্ষিকী। সে চলে যাওয়ার পর, দু’ভাইবোন তোমরা সামান্য কারণে, যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে আমাকে ত্যাগ করলে, তা আজো আমার বোধের অনধিগম্যই রয়ে গেল। সে সূত্র নিয়ে আমি তোমাদেরকে আজ দু’চার কথা লিখবো বলে এতদিনের সঞ্চিত সাহস বুকে নিয়ে বসেছি।
তোমরা কেউ বুঝতে চাইলে না, কি যন্ত্রণায় আমি বাধ্য হয়েছিলাম তোমার বাবার মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর কামালকে বিয়ে করতে। যেজন্যে আজ তোমাদের সঙ্গে আমার এই অকারণ ভুল বোঝাবুঝি। মৃত্তিকা, আমি জানতাম, উন্নত দেশে গেলে মানুষের চিন্তা শক্তিও উন্নত হয়, হয় উদার। কিন্তু তুমি বিদেশে থাকলেও আমার দুঃখ যে, তোমার বেলায় সে কথাটি আমি ঠিক বলতে পারিনি। সোহেলের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু মা, তুমি তো পশ্চিমে রয়েছে অনেক বছর। তাহলে তোমার মনে কেন আজো এই সঙ্কীর্ণতা! কেন এই কষ্ট, এত পুঞ্জীভূত অভিমানের মেঘ! তুমি কেন বুঝতে চেষ্টা করলে না–ব্যক্তিজীবনে নিঃসঙ্গতার বোঝা কত ভারি। তুমি যেখানে আছ তুমি কি দেখোনি সেখানে জীবন কতটা রঙধনু রঙে রাঙানো!
প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, তোমার বাবাকে আমি কোনও রকমেই ভুলে যাইনি। ভুলে যাওয়ার কথাও নয়। তাকে আমি ভালোবাসি, সম্মান করি। এবং তার সমানে সমানে কাউকে দাঁড় করানোর মতো স্পর্ধা আমার নেই। কোনদিন হবে বলেও মনে করি না। সুজন আজও আমার প্রাণ। সেই ছোটবেলায় তাকে পেয়েছিলাম খেলার সাথির মতো। কিন্তু কালব্যাধি এতই দুরারোগ্য হলো যে লিভারের ক্যান্সার তাকে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম কিন্তু বড় অসময়ে নিয়ে গেল। আর সুজন চলে যাওয়ার পর তোমাদের নিয়ে আমি হয়ে পড়লাম সম্পূর্ণ একা। দুঃখেকষ্টে ভারি একা। তার মৃত্যুর পরপরই, তোমরা দুই ভাইবোন ঘুমের মধ্যে প্রলাপ বকার মতো প্রায়ই কেঁদে উঠে বলতে বাবা কই! বাবা কখন আসবে? বলতাম, হ্যাঁ, বাবা ফিরে আসবে। তোমরা এখন ঘুমোও। তোমরা, বিশেষ করে তুমি বলতে, সত্যি বলছো তো! আবার মিথ্যে না তো? তোমাকে বুকে নিয়ে কতদিন যে মিথ্যে বলেছি আজ সেসব আর মনে নেই। মা, আমি ঘুমোই। আব্ব এলে ডেকে দিও। এসব যে কত কঠিন কাজ ছিল মা-মণি সে কি করে বোঝাব তোমাকে।
আজো সুজনের জন্যে আমার একান্ত গোপন ভালোবাসা। এইসব প্রেমানুভূতি এতই ব্যক্তিগত যে সেসব আমি কারো কাছে কখনোই বলিনি। বলবোও না। সুজনের চলে যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনেরা অনেকেই এলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। হায়! আফসোস করে বলতে শুরু করলো মেয়েটার এত কম বয়স! দুটো সন্তান, এত দায়িত্ব! এত বড় সংসার এদের মানুষ করতেও তো মানুষ লাগে। বিয়ের জন্যে অনেক ছেলে নিজেরাও প্রস্তাব নিয়ে এলো। মানুষের চোখে আমি সুন্দরী, শিক্ষিতা, কর্মজীবী। কিন্তু আমি তোমাদের মুখের দিকে চেয়ে নিজের কথা কক্ষণো ভাবিনি। সবাইকেই ফিরিয়ে দিতে দিতে বলেছি, না-না-না! কিছুতেই না। আমার দুটো সন্তান। ওরা কষ্ট পাবে। কক্ষণো না। তোমাদেরকে আমি একা হাতে মানুষ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার বাবার কাছে। মৃত্যুশয্যায় তাকে কথা দিয়েছিলাম, আমার সন্তানদের জীবনে দ্বিতীয়বার কোনও বাবা আসবে না। কিন্তু মৃত্তিকা আমিই আমার সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি। আমি অনুতপ্ত। কিন্তু তার পেছনেও কারণ আছে। যুক্তি আছে। কি কারণে এই কাজটা আমি করলাম তা তোমরা কেউ বুঝতে চাইলে না। তোমরা শুধু আমার বাইরেরটাই দেখলে, সন্তান হয়ে আমার ভেতরের জ্বালাটা একবার ভেবে দেখলে না। অপার এক শূন্যতায় কিভাবে আমি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম আমার দুই চোখের নিচে এক আঙুল কালি, দেখনি! শোননি আমার প্রলাপ গভীর রাতের বেলায়! কিন্তু বুঝতেও চেষ্টা করলে না। দুঃখটা আমার সেখানেই। তোমরা আমার আত্মজা হয়েও উল্টো আমাকেই ভুল বুঝলে।
তোমরা দু’ভাইবোন ছিলে আমার প্রাণ। সুজন চলে যাওয়ার পর আমি ভালোমন্দ অনেক কিছুই করতে পারতাম। সে সুযোগ, সে প্রলোভন এবং স্বাধীনতা আমার ছিল। তোমরা কিন্তু সেসব কিছুই জান না। দেখতে দেখতে একদিন তোমরা বড় হয়ে গেলে। সমাজের রীতি অনুযায়ী একদিন তোমাদের বিয়ে হয়ে গেল। সেই সঙ্গে আমার কাজও ফুরিয়ে গেল। আর আমি হয়ে পড়লাম খাঁচায় বন্দি একটা পাখি। বেকার বিধবাবিধুর। মাঠ মাঠ সময়। তেমন কিছুই করার নেই। থাকলেও যাই না। যাও যেতাম সব বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলাম স্বেচ্ছা নির্বাসনে। ডাক্তার বললো, ডি প্রেশন।
আজ খোলাখুলিভাবে তোমাদের বলতে কোনও বাধা নেই যে বিশেষ করে একজন মাঝ বয়সী মানুষের জন্যে এই সংযম ও সংস্কার কোনও সহজ কাজ নয়। তোমাদের নিয়ে যেদিন রুকু খালার মেয়ের বিয়েতে গেলাম সেদিন যে লোকটি তোমাকে কোলে নিয়ে সমস্ত বাড়ি ঘুরে বেড়ালো, মনে আছে! তুমি বললে, আম্মু এই আঙ্কেলটা আব্দুর মতন ভালো। ওকে বিয়ে করো না কেন! আমাকে না খুব আদর করেছে। তুমি জানতে না যে, সেই কোটিপতি লোকটা কতবার আমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। বড়ই ভালো মানুষ সে। রফিক আমাকে হৃদয় থেকে চেয়েছিল। কিন্তু মা, আমি তো সুজনকে কথা দিয়েছিলাম। আর রফিক অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষে অন্য জায়গায় যেদিন বিয়ে করে ফেলো, সেদিন একসঙ্গে অনেকগুলো ঝড়ের তাণ্ডব সহ্য করতে না পেরে এত কেঁদেছিলাম যে তুমি ভয় পেয়ে রুকু খালাকে লুকিয়ে ফোন করে নিয়ে এলে যখন, তখন কত রাত! মনে আছে সেকথা!
এমনি করে একসঙ্গে বাবা-মায়ের দায়িত্ব একাকী হাতে পালন শেষে যেদিন আমি তোমাদেরকে ভালোভাবে বিয়ে দিতে পারলাম সেদিন চারপাশের সবাই বাহবা দিলো আমার ত্যাগ আর ধৈর্যের। বলতে গেলে সবাই এক নিশ্বাসে প্রশংসার ফুলঝুরি ছিটিয়ে বলতে থাকলো, আহা! কি ত্যাগী নারী! কি ভালো! কিন্তু ওরা কি কেউ আমার মন প্রাণের আসল খবর জানে? আমার হতাশা! দুঃখ! নিঃসঙ্গতা! কতখানি দারিদ্র এই ঐশ্বর্যের নিচে কাজ করছে! কতখানি আগুন এই গলিত লাভার বুকে! কেউই জানলো না।
তোমরা যাওয়ার পর বাড়িটা হঠাৎ নতুন করে ফের শূন্য হলো। এত বড় বাড়িতে আমি ছাড়া আর শুধু রেনুর মা। বহুদিনের পুরোনো কাজের লোক সে। বুড়ো হয়ে সেও ঝিমিয়ে গেছে। দেখি সেও শুধু পড়ে পড়ে খায় আর ঘুমোয়। কাজ যা থাকে, দু’ঘণ্টায় শেষ। কোনও রকমে দুটো খেয়ে আমিও শুয়ে-বসে শুধু দেখি সামনে বিশাল শূন্যতা। আর নিজেকে মনে হতে লাগলো, অপচয়–। নিষ্প্রয়োজন। অকারণ বাঁচা।
খবরের কাগজ, টেলিভিশন, ম্যাগাজিন, চা, টেলিফোন এসব বড়জোর ঘণ্টা দুই’র জিনিস। তারপর থেকে শুরু হয় বাকি সারাদিনের জন্যে বুকের মধ্যে একটা হালকা চিনচিনে ব্যথা। ভয় হয় এত সময় কি করে কাটাবো! একরাশ রুদ্ধশ্বাস, দমকা হাওয়ার মতো দাপিয়ে বের হয়ে যায় তীব্র যন্ত্রণায়। এক ধরনের পাগলামো। আমাকে গ্রাস করে বসলো। আরো মাস দুয়েক পর। এমনি এক রাতে একদিন হঠাৎ ঘুমের মধ্যে, তোমার বাবার মূর্তি, অন্ধকারে আমার সামনে এসে যখন দাঁড়াল আমি চিৎকার করলাম। দৌড়লাম। দৌড়েও পথ খুঁজে পাই না। সেও বারবার ফিরে আসে কল্পনায়, এসে কথা বলে। চা খায়, খাবার খায়। শোয়, বই পড়ে। গল্প করে। দাম্পত্য করে। জেগে খুঁজি, হাতরাই, নেই-নেই কোথাও কেউ নেই। ভয়ে আমি বিছানা ফেলে রেনুর মায়ের পাশে শুয়ে পড়ি। আর যখন অনুভূতির রোলার কোস্টার আমাকে নির্মম শারীরিক কষ্ট দিতে শুরু করলো, আমি যেন নিজের কাছে হয়ে উঠলাম একটা ক্লাউন। ক্ষণে হাসি, ক্ষণে কাঁদি। ক্ষণে পাগলি, ক্ষণে পণ্ডিত। শিউলি আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ব্যাপারটা সে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলো। ওর জোরাজুরিতেই শুরু করলাম মানসিক রোগের চিকিৎসা। ডাক্তার বললো বিয়ে করুন। সঙ্গীর প্রয়োজন আছে। আপনার মানসিক হতাশা চরমে। রোগের নাম ”ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস”, সঙ্গী ছাড়া এই রোগ নিরাময় হবে না। মন-শরীর এখন আপনার বিরুদ্ধে। চললো পাগলের চিকিৎসা আর ওষুধপত্র। আর শিউলী গোপনে গোপনে–কামালের সঙ্গেও গভীর যোগাযোগ করতে থাকলো।
আমি জানি, কামালের উপস্থিতি এই সংসারে, তোমাদের একেবারেই পছন্দ নয়। তোমরা ওর নামটি পর্যন্ত শুনতে চাও না। এবং এটাই স্বাভাবিক। এবং আমিও যে বুঝি না তা নয়। বলেছ–কখনো আর আমার মুখ দেখবে না। মা, কামালকে বিয়ে করে আমি ভুল করেছি কিনা তার চেয়ে বড় কথা ওকে বিয়ে করেছি বলে এখনো সুস্থ মনে বেঁচে আছি। কামালকে পেয়ে আমি মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছি। বিয়ের পর মানসিক রোগের ওষুধ ছাড়তে পেরেছি। ও আমার কথাসঙ্গী। আমার বলার মানুষ। খাওয়ার টেবিলে পাশে বসার মানুষ। তোমাদের তো বরং তাতে খুশি হওয়া উচিত ছিল যে, তোমাদের মা রাস্তার পাগল হয়নি যাকে দেখলে লোকেরা পেছন পেছন দৌড়তো আর ঢিল ছুঁড়ে মারতো, সেটাই কি ভালো হতো। তোমাদের চলে যাওয়ার পর একদিন ঘরে যে শূন্যতা এসেছিল পিঙ্কি এসে তা কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে পৃথিবীর কেউ-ই তোমার বা সুজনের শূন্যস্থান পূরণ করেছে। তোমরা রয়েছে আমার অন্তরে যে যার জায়গামতো। কামাল, সুজনের স্থান কখনোই পাবে না। কিন্তু তাই বলে কামালকে আমি ছোট বলেও ভাবতে পারবো না। কামালকে তোমরা গ্রহণ করবে কি করবে না সেটা তোমাদের ব্যাপার। কিন্তু তোমরা যে বিষয়টা বুঝতেই চাইবে না, সেটাও ঠিক নয়। অন্তত যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখো। আমি কতটা প্রয়োজনে বা অ প্রয়োজনে দ্বিতীয়বার বিয়ে করলাম। মা, একা একা বাস করা যায় না। মানুষ যখন জঙ্গলে ছিল তারাও দল বেঁধেই থাকতো। বনের পশু-পাখিও এমনকি জলের মাছেরাও দল বেঁধে থাকে। প্রাসাদের চেয়েও বড় মানুষ, আর মানুষের চেয়ে বড় তার সঙ্গ। নিঃসঙ্গ তাজমহলের চেয়ে জনাকীর্ণ বস্তি অনেক অনেক ভালো। নয় কি? মানুষ মানুষকে দেখতে পারে না। মনে রেখো, মানুষ ছাড়া মানুষ থাকতেও পারে না।
শূন্যতার চেয়ে বড় অভিশাপ কিছু আর নেই। নিঃসঙ্গতার কারণে হঠাৎ একদিন আত্মহত্যার চিন্তাও মাথায় এসেছিল। গিয়েছিলাম দক্ষিণের ছাদে, আমাদের পাঁচতলার ঐখানে। কামাল তারই বিকল্প। পিঙ্কি তোমাদের ছোট বোনটি তারই ফল। সে সন্তানের চেয়েও বরং বেশি বন্ধু। আমি ওর মধ্যে তোমার ছবি দেখতে পাই। পিঙ্কি তো তুমিই। আর এভাবেই চলে যায় আমার জোড়াতালি জীবন। আগামীর স্বপ্ন নেই। আশা নেই কোন। শুধু মাঠ মাঠ অতীত আর সামান্য বর্তমান। অতীত, যার মধ্যে রয়েছে তোমরা তিনজন, থাকবে যেখানে যার স্থান। দিন চলে যায়। দিন আমিও পার করে দিচ্ছি। একে যদি বলো বেঁচে থাকা, তাহলে আমি বেঁচে আছি। তার বেশি নয়। সুতরাং কি পরিস্থিতির শিকার হয়ে কেন আমি আবার বিয়ে করলাম হয়তো সামান্য হলেও বোঝাতে পেরেছি। জীবন একটি সুন্দর অনুভূতি। বইবার মতো যথেষ্ট কারণ বা আনন্দ না থাকলে তা হতে পারে একটি বোঝা। এই বোঝা বইবার শক্তি যখন ফুরোলো তখন ভাঙলো আমার প্রতিজ্ঞা।
তোমাকে আবারো বলছি, আমার মতো পরিস্থিতি হলে একা থাকার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই। বাকি জীবন বিধবা থেকে দিনের পর দিন শূন্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে সুনাম অর্জন করা যেতে পারে, মানুষ বাহবা দিতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনও মানে নেই। এবং ব্যক্তির নিজের জীবনের ওপর তা চরম নিষ্ঠুরতা।
বুঝতে পারলে, ক্ষমা নিষ্প্রয়োজন। জানি, একদিন তোমাদের বোধোদয় হবে। মান-অভিমান ভুলে ফিরে আসবে। আমার হৃদয় সে আশায় আমৃত্যু খোলা রইলো।
সবশেষে রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা থেকে বলছি —
‘আমারে
যে দেখিবারে পায়,
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি …।’
তোমাদেরই স্নেহের মা (মালবিকা)।