১৩. মীর্জা হিন্দালের মা

মীর্জা হিন্দালের মা দিলদার বেগমের দিনলিপি। শ্রুতিলিখন করেছে তার এক দাসী হোসনা জান।

আমার রাতের ঘুম এবং এবাদত হারাম হয়ে গেছে। আমি চোখের পাতা বন্ধ করলেই দস্যু শের শাহকে স্বপ্নে দেখি। এই দাসু তার পঙ্গপাল বাহিনী নিয়ে ছুটে আসছে। তার একমাত্র ইচ্ছা মোগল বংশকে সমুলে ধ্বংস করা। হুমায়ূন তার হাতে ধরা পড়লে না জানি কী পরিণতি হবে। মনে হয় সে আমার অতি আদরের হুমায়ূনকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করবে। শুনেছি। দস্যুটা মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে পছন্দ করে, আল্লাহপাকের কাছে আমার প্রার্থনা—যেন কোনো ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে দস্যু তার দলবল নিয়ে মৃত্যুবরণ করে।

দিনলিপিতে যে অস্থিরতা দিলদার বেগম দেখালেন তার চেয়ে অনেক বেশি অস্থির সম্রাট হুমায়ূন। তিনি তাঁর দিনলিপি লেখা বন্ধ রেখেছেন। সৈন্য সংগ্রহের মতো অর্থের জোগাড় করতে পারছেন না। প্রতিটি মিত্র রাজার কাছে চড়া সুদে অর্থ চেয়ে পত্র লিখেছেন। কেউ পত্রের জবাব দেওয়ার সৌজন্যও দেখাচ্ছে না। তারা এখন এমন কিছুই করবে না যাতে দিল্লীর অধীশ্বর শের শাহ বিরক্ত হন।

হুমায়ূনের ব্যক্তিগত ঘোড়সওয়ার বাহিনীর একটি অংশ কামরান মীর্জার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কামরান মীর্জা তাতে আপত্তি করে নি কেন? সে কি হুমায়ূনকে ত্যাগ করে শের শাহ’র সঙ্গে যুক্ত হবে? এও কি সম্ভব?

কামরান মীর্জা আমীরদের নিয়ে ঘনঘন দরবার করছে। এর কোনোটাতেই হুমায়ূনকে ডাকা হচ্ছে না।

সম্রাটের কাছে খবর আছে, গভীর রাতে কামরানের এক আমীর ফতে খাঁ লাহোর ত্যাগ করেছে। তার সঙ্গে বারোজন সৈন্যের একটা দল আছে। এই আমীর কি কামরানের গোপন কোনো চিঠি নিয়ে শের শাহ’র কাছে গেছে?

হুমায়ূন সব ভাইদের এক করার জন্যে একটি আলোচনা-সভা ডেকেছিলেন। সেই সভায় তাঁর সব ভাইরা উপস্থিত থাকলেও কামরান আসে নি।

বড় অস্থির সেই সময়ে দিলদার বেগম হুমায়ূনকে গোপন এক পত্র পাঠালেন। সেখানে লেখা–

পুত্ৰসম হুমায়ূন
সম্রাট
বাদশাহ নামদার। তুমি নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েছ বলে শুনেছি। এই মুহুর্তে তোমার অর্থের অবশ্যই প্রয়োজন। আমার কাছে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং দুই লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা গোপনে রাখা আছে। তুমি আমার কাছ থেকে এই অর্থ সংগ্রহ করে কাজে লাগাও। তোমার চন্দ্রের মতো মুখমণ্ডল অনেকদিন দেখি না।
ইতি
দিলদার বেগম

হুমায়ূন দিলদার বেগমের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। হুমায়ূনের সঙ্গে তার চার পত্নী। পত্নীরা হলেন–
বেগা বেগম
মাহ চুচক বেগম
গুনবার বেগম
মেওয়াজান

হুমায়ূন পত্নীদের সঙ্গে না নিয়ে কোথাও যেতেন না। চৌসার যুদ্ধেও তাঁর পত্নীরা সঙ্গী ছিলেন। চৌসার যুদ্ধে তাঁর দুই পত্নী চাঁদ বিবি এবং সাদ বিবি পানিতে ড়ুবে মারা যান। বেগা বেগম শের শাহ’র হাতে ধরা পড়েন। শের শাহ’র মহানুভবতায় তিনি স্বামীর কাছে ফিরতে পারেন।

হুমায়ূনের সর্বশেষ পত্নী মেওয়াজন ছিলেন হুমায়ূনভগ্নি গুলবদনের দাসী। হুমায়ূন তার রূপে মুগ্ধ হয়ে মেওয়াজনকে বিয়ে করেন এবং বিয়ের রাতে আমীরদের বলেন, বেহেশতের হুর এই মেয়ের চেয়ে রূপবতী হবে আমি তা বিশ্বাস করি না।

সম্রাট তার বিমাতার কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করলেন। আনন্দে তার চোখ ভিজে উঠল। দিলদারের নির্দেশে রাজপরিবারের মহিলারা একে একে সম্রাটকে কুর্নিশ করতে এলেন। চৌদ্দ বছর বয়সী এক মেয়েকে দেখে সম্রাট চমকে উঠলেন।

সম্রাট বললেন, তোমার নাম কী?

হামিদা বানু।

তুমি কি রাজপরিবারের কেউ?

না। আমি সামান্য একজন। আমার পিতার নাম মীর আবুল বকা। তিনি একজন শিক্ষক। আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতা মীর্জা হিন্দাল আমার পিতার কাছ থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করেছেন।

তুমিও কি তোমার পিতার কাছ থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করেছ?

জি জাহাঁপনা।

তুমি খুব সহজভাবে আমার সঙ্গে কথা বলেছ। একজন সম্রাটের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাও নি।

আপনি এখন সম্রাট না। পরাজিত এক নৃপতি। নির্বাসিত।

আচ্ছা তুমি যাও।

হামিদা বানু ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র হুমায়ূন দিলদার বেগমকে বললেন, আমি এই মেয়েটিকে বিবাহ করতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।

দিলদার বেগম অবাক হয়ে বললেন, এ নিতান্তই বালিকা। এবং মুখরা।

হুমায়ূন বললেন, হোক বালিকা, হোক মুখরা।

মেয়েটি শিয়া সম্প্রদায়ের। তুমি সুন্নি।

হুমায়ূন বললেন, শিয়া সুন্নির মতের এবং প্রার্থনার কিছু পার্থক্য আছে, কিন্তু তাদের বিয়েতে কোনো বাধা নেই। আপনার কাছে অনুরোধ, আজ রাতেই আপনি তার কাছে বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।

বাবা, তুমি বিষয়টা নিয়ে আরেকটু চিন্তা করো।

চিন্তা যা করার করেছি। আর চিন্তা করব না।

হতভম্ব দিলদার বেগম নিজেই সম্রাটের ইচ্ছার কথা হামিদা বানুকে জানালেন। হামিদা বানু বলল, আমি এমন একজনকে বিয়ে করব যার হাত আমি যে-কোনো সময় ধরতে পারব। যাকে তিনবেলা কুর্নিশ করতে হয় তাকে আমি বিয়ে করব না। কোনো অবস্থাতেই না। সম্রাটের চার স্ত্রী জীবিত। তিনি আরও বিবাহ করবেন। আমি এমন একজনকে বিবাহ করব যার বিয়ে-রোগ নেই। আমিই হ’ব তার একমাত্র স্ত্রী।

তোমার কতবড় সৌভাগ্য সেটা একটু চিন্তা করো।

পরাজিত সম্রাটের সঙ্গে বিবাহ হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুৰ্ভাগ্য। সম্রাটের মন্দ ভাগ্যের সঙ্গে আমি আমার ভাগ্য জড়াতে চাই না।

তুমি নিতান্তই বালিকার মতো তর্ক করছ।

হামিদা বানু হাসতে হাসতে বলল, আমি তো বালিকাই।

সারা রাত চেষ্টা করেও হামিদা বানুকে রাজি করানো গেল না। মীর্জা হিন্দাল ঘটনা শুনে ভাইয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ করলেন। যাকে শের শাহ্ তাড়া করছে, যার পালানোর পথ প্রায় বন্ধ, সে কী করে এইসময় বিয়ের জন্যে পাগল হবে?

দিলদার বেগম হুমায়ূনের সম্মানে বিরাট ভোজের আয়োজন করেছিলেন। হুমায়ূন ঘোষণা করলেন, হামিদা বানুর সঙ্গে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করবেন না। উপবাস থাকবেন।

সম্রাট কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করছেন না শুনে হামিদা বানু বিয়েতে রাজি হলেন।

দিলদার বেগমের কাছ থেকে পাওয়া দুই লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা সম্রাট বিবাহের নিকাহানা হিসেবে হামিদা বানুর বাবা মীর আবুল বকাকে দিলেন। এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিলেন নবপরিণীতা স্ত্রীকে।

বাসর রাতে হামিদা বলল, আমি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনার ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্য জড়িয়েছি। তবে আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই, যত বড় বিপদই আপনার ওপর আসুক আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না।

সম্রাট বললেন, তোমাকে নিয়ে আমি একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছি। কবিতাটা শুনবে?

হামিদা বললেন, না। আমি এখন ঘুমাব। আমার ঘুম পাচ্ছে।

সম্রাট বললেন, আমি হুকুম না দেওয়া পর্যন্ত তুমি ঘুমাতে পারবে না। আমি হুকুম দিই নাই।

হামিদা বানু চোখ বন্ধ করলেন এবং পাশ ফিরলেন।

সম্রাট বললেন, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

না।

তোমাকে আমি একটা উপহার দেব। উঠে বসো। উপহারটা কী দেখো।

কী উপহার?

একটা হীরা। এর নাম কোহিনূর।

কোহিনূরের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি কপৰ্দকহীন একজন মানুষ। এই হীরা আপনার প্রয়োজন।

কোহিনূর তুমি নেবে না?

না। এখন অনুমতি দিন, আমি ঘুমোব।

যাও অনুমতি দিলাম।

সম্রাট ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে লেখা দীর্ঘ কবিতাটি আবৃত্তি করলেন।

আবৃত্তি শেষ হওয়ামাত্র হামিদা বানু বললেন, আপনি দুর্বল সম্রাট কিন্তু অত্যন্ত সবল একজন কবি। কবিকে অভিনন্দন।

হামিদা বানুর গর্ভেই পৃথিবীর সেরা নৃপতিদের একজন জন্মান। তিনি সম্রাট আকবর। আকবর দ্য গ্রেট।

এই প্রসঙ্গ যথাসময়ে আসবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *