১৩
প্রবাসে গেলে বাঙালি মাত্রেরই যা হয়, ভাষা আর ভাতের জন্যে হা-পিত্যেশ করা, তা তো আজাদের বেলায়ও ঘটে ৷ অন্য লক্ষণটাও বাদ থাকে না ৷ সমিতি করা ৷ বাঙালি সমিতি করা ৷
আর এইসব সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থাকায় আজাদের আরেকটা লাভ হয় ৷ করাচিতেই এক বাঙালি মেয়েকে তার ভালো লেগে যায় ৷ একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে মেয়েটা ৷
বাঙালি সমিতির অনুষ্ঠানে মেয়েটা গান গেয়েছিল ৷ আধুনিক গান ৷ সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই, জানি না তো কেমন করে নিজেকে সাজাই ৷ শাদা রঙের জামা, সে তো ভালো নয়, হলুদ না হয় নীলে কেমন জানি হয়!
মেয়েটা পরে এসেছিল শাড়ি ৷ কপালে দিয়েছিল টিপ ৷ আজাদের চোখে লেগে গিয়েছিল সে ৷ আজাদ সুযোগ খুঁজছিল মেয়েটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করার ৷ সুযোগ সহজেই মিলে যায় ৷ অনুষ্ঠানশেষে ছিল চা-পর্ব ৷ হলঘরের পেছন দিকে বড় টেবিলে চায়ের কাপ আর কেতলি সাজানো ৷ পিরিচে পিরিচে বিস্কিট আর সামুচা ৷ অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই একসঙ্গে উঠে পড়ে চায়ের টেবিলের দিকে যাত্রা শুরু করলে খানিকটা মানবজট লেগে যায় ৷ আজাদ কিন্তু প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে না চায়ের কাপের দিকে ৷ তার নজর শাড়ি পরা গায়িকাটির ওপরে ৷ সে যখন যাবে, আজাদও তখন যাবে টেবিলের দিকে ৷ ভিড় এড়াতে মেয়েটা দর্শক-চেয়ারেই বসে থাকে ৷ তার মাথার ওপরে একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে ৷ মেয়েটার চুল সেই বাতাসে উড়ছে ৷ আজাদ এগিয়ে যায় তার কাছে, গলার স্বর ঠিকমতো বেরুতে চাইছে না, একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে যথাসম্ভব স্মার্টভাবে সে বলে, ‘আপনি গাইলেন, আপনি জানেন না কেমন করে কী দিয়ে সাজবেন, কিন্তু খুব সুন্দর করে সেজেছেন ৷’
মেয়েটা সপ্রতিভ ৷ হাত দিয়ে উড়ন্ত কেশদাম শাসন করতে করতে সে বলে, ‘ওমা ৷ গাইলাম গান, প্রশংসা করলেন সাজের ৷ ব্যাপার কী ? গান বুঝি ভালো হয়নি ?’
‘আরে না ৷ গানও ভালো হয়েছে ৷ বোঝেনই তো, কত দিন পরে নিজের দেশের গান শুনলাম ৷ আপনি কি ফার্স্ট ইয়ারে ?’
‘হ্যাঁ ৷ আপনি ?’
‘সেকেন্ড ইয়ার চলছে ৷ কেমন লাগছে ?’ আজাদ বলে ৷
‘উর্দু বুঝতে কষ্ট হচ্ছে ৷’
‘আমারও খুব হয় ৷ স্যাররা ভালো পড়ায়, কিন্তু কেন যে উর্দুতে পড়ায়, বুঝি না ৷ ইংলিশে পড়ালে কিন্তু বুঝতাম ৷ চা নেবেন না ?’
‘নেব ৷ ভিড়টা একটু কমুক ৷’
‘চলেন ৷ এখন নেওয়া যাবে ৷’
মেয়েটা ওঠে ৷ হাতব্যাগটা কাঁধে ঝোলায় ৷
‘ঢাকায় কোথায় বাসা আপনার ?’ আজাদ জিজ্ঞেস করে ৷
‘পুরানা পল্টন ৷’
‘পুরানা পল্টন কোন বাসাটা বলেন তো!’
‘ওই যে পানির ট্যাঙ্কটা আছে না, ওখানে ৷’
‘ও ৷’
‘আপনাদের বাসা কোথায় ?’
আজাদ বিপদে পড়ে ৷ কোন বাসার কথা বলবে ৷ শেষে বলে, ‘ফরাশগঞ্জ ৷’ আজাদ কেতলি থেকে চা ঢালে পেয়ালায় ৷ মেয়েটিকে এগিয়ে দেয় ৷ নিজে নেয় এক কাপ ৷ তারপর দুজনে এক কোণে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে ৷
আর বেশি গল্প করা যায় না ৷ অন্য ছাত্ররা এসে পড়ছে ৷ চা নিয়ে সামুচা নিয়ে আশপাশে দাঁড়িয়ে পড়ছে ৷ মেয়েটাও তার পরিচিতজন, ক্লাসমেটদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে ৷ আজাদ চায়ের কাপ হাতে তার বন্ধুদের দিকে এগিয়ে যায় ৷
বাশার, রানা, কায়েসরা সব একসঙ্গে ৷ তাদের সঙ্গে গল্পগুজবে নিজেকে নিয়োজিত করে সে ৷
বাশার বলে, ‘আজাদ, তোমার সাথে আগে থেকেই আলাপ ছিল নাকি মিলির ?’
আজাদ বলে, ‘হ্যাঁ ৷ ওই তো পুরানা পল্টনে বাসা ৷ আপনি চিনবেন ৷’
বাশার বলে, ‘আমি চিনব কী করে! টাঙ্গাইলে বাড়ি হলে না চিনতাম ৷’
আজাদ বলে, ‘আমি ওদের বাসায় আগেও গেছি ৷ ওর মাকে খালাম্মা বলে ডাকি!’
মেয়েটা কাছে আসে ৷ আজাদ বলে, ‘শোনেন, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি হলেন আবুল বাশার, আর ইনি হলেন রানা ৷ আর ইনি মিলি ৷ খুব ভালো গান করেন ৷ ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছেন ৷’
মিলি বলে, ‘তা তো হলো ৷ কিন্তু আপনি তো আপনার নামটাই বললেন না ৷ নিজের পরিচয়টা আগে দেন ৷
‘আমার নাম আজাদ ৷’
‘ঠিক আছে ৷ আপনার নামটা জানার জন্যেই আমি আবার এদিকটায় এলাম ৷’
মিলি চলে যায় ৷ রানা আজাদের গায়ে চাপড় মেরে বলে, ‘তুমি তো দেখি এক নম্বরের গুলবাজ, উনি তোমার নামই জানেন না, আর বলছ বাসায় অনেকবার গেছ ৷’
‘গেছি ৷ কিন্তু ও আমার নাম ভুলে গেছে ৷’
মিলির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর, কথা হওয়ার পর, আজাদের নিজেকে কেমন যেন তুচ্ছ লাগতে শুরু করে ৷ মনে হয়, এ জীবনের কোনো মানে নাই ৷ মনে হয়, ইস্ আবার যদি তার দেখা পাওয়া যেত! আবার কবে বাঙালি সমিতির অনুষ্ঠান হবে ? সে মনে মনে মিলির সঙ্গে কথা বলে ৷ রাতের বেলা বই নিয়ে পড়ছে, খানিকক্ষণ পর হুঁশ হয়, আসলে সে পড়ছে না, মিলির কথা ভাবছে ৷ সে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে নিজের অজান্তেই খুঁজতে থাকে মিলিকে ৷ যদি আরেকবার মিলির দেখা পাওয়া যায়!
দেখা না পাওয়ার কোনো কারণ নাই ৷ ওদের ক্লাস যেখানে হয় সেখানে দু-একবার ঘুরঘুর করতেই মিলিকে করিডরে দেখতে পাওয়া যায় ৷ কী আশ্চর্য, মেয়েটা তার চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আজাদের বুক কাঁপতে থাকে ৷
‘কেমন আছেন ?’ আজাদ গলায় যথাসম্ভব জোর এনে বলে ৷
মিলি চোখ তুলে তাকায় ৷ বাংলায় তার সঙ্গে কথা বলে কে রে ? আরে, এ তো সেদিনের ছেলেটা ৷ বাহ্ ৷ আজকে তো আরো চমৎকার পোশাক পরে এসেছে! মিলি মনে মনে তারিফ করে ৷
‘ভালো ৷ আপনি ভালো ?’ মিলি বলে ৷
‘আছি ৷ আপনার আরো ক্লাস আছে ?’
‘না ৷ ক্লাস শেষ ৷ বাসায় চলে যাব ৷’
‘বাসাটা কোন দিকে যেন ?’
‘পিইসিএইচ ৷ আমার খালার বাসা ৷ ওদের সঙ্গে থাকি আমি ৷’
‘আরে, ওদিকে তো আমিও যাব! ওখানে আমার এক বোনের দেবর থাকেন ৷’
‘চলেন তাহলে ৷ আমি একটা বাস ধরব ৷’
‘আমিও ৷’
বাসস্টপেজে দুজন গিয়ে দাঁড়ায় ৷ আজ রোদটা ভীষণ চড়া ৷ মিলি বলে, ‘আমি যদি ছাতা বের করি, আপনি মাইন্ড করবেন না তো ?’
‘না ৷ মাইন্ড করব কেন! রোদ লেগে আপনার রঙ ময়লা হলে তো জাতীয় ক্ষতি!’
‘মানে ?’
‘মানে বাঙালি মেয়ে তো এখানে বেশি নাই ৷ আপনি আছেন ৷ আপনাকে দেখতে সুন্দর লাগলে আমরা সব বাঙালি ছেলেরাই সেটা নিয়ে গর্ব করতে পারি ৷ আপনার রঙ যদি একটু রোদে পুড়ে যায়, তাহলে সেটা আমাদের ন্যাশনাল লস না!’
‘আপনি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলেন ৷ মেয়ে-পটানো কথা ৷ কার কাছ থেকে শিখেছেন ?’
‘মনে হয় জন্মগত প্রতিভা ৷’ আজাদ হাসতে হাসতে বলে বটে, তবে তার এই প্রতিভাটার জন্যে সে তার জন্মদাতা পিতাকেই কৃতিত্ব দিতে প্রস্তুত আছে ৷
দুজনে এক বাসে ওঠে ৷ গল্প করতে করতে যায় ৷ একই স্টপেজে নামে তারা ৷ মিলি বলে, ‘আপনি কোন দিকে যাবেন ?’
আজাদ বলে, ‘এই তো এই রাস্তা ৷ সামনের দুটো লেন পরেই বাসাটা ৷’ আজাদ তাড়াতাড়ি করে যা হোক একটা কিছু বলে ৷
মিলি বলে, ‘আমি তো যাব উল্টো পথে ৷ আসবেন আজকে আমাদের বাসায় ?’
মনে মনে আজাদ বলে, ‘যাব, একশবার যাব’; মুখে বলে, ‘না, আজ না ৷ আরেক দিন ৷ আসি!’
তারপর সামনে গিয়ে একটা বাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে, চুপিসারে তাকিয়ে থাকে মিলির চলে যাওয়ার দিকে, তার মনে হয়, প্রতিটা পদক্ষেপে মেয়েটা সমস্তটা পথকে ধন্য করে দিয়ে চলে যাচ্ছে, তার মনে হয়, ওই পথের ধুলোগুলোও কতটা ধন্য হয়ে যাচ্ছে তার পদস্পর্শ পেয়ে ৷ মিলি অদৃশ্য হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সে উল্টো পথে হেঁটে আবার ফিরে যায় বাসস্টপেজে ৷ কিসের বোন, আর কিসের দেবর ?
আবার বাঙালি সমিতির অনুষ্ঠান করার জন্যে আজাদ মরিয়া হয়ে উঠেছে ৷ আসলে এই সুযোগে সে যেতে চায় মিলিদের বাসায় ৷ তাকে অনুষ্ঠানে গান গাইতে বলতে ৷ তা ছাড়া একটা কোরাসও রাখা উচিত ৷ ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ গানটা হতে পারে ৷ তা কোরাস গাইতে হলে তো রিহার্সাল লাগবে, নাকি!
এইসব ছুঁতোয় আজাদকে যেতে হয় মিলির বাসায় ৷ মিলির খালার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে ৷ খালা জানতে চান আজাদের সম্পর্কে ৷ তার বাবার নাম ৷ আজাদ জানায় ৷ সঙ্গে সঙ্গে মিলির খালা ঝলমলিয়ে ওঠেন : ‘ইউনুস চৌধুরীর ছেলে তুমি ? বাপরে!’
আজাদ চলে গেলে খালা শতমুখে বলতে থাকেন, ‘উরে বাবা ৷ মিলি তুই জানিস না ওরা কত বড়লোক ৷’
মিলি রোজ ক্লাস শেষে বাঙালি সমিতির রিহার্সালে আসে ৷ আজাদ মিলিদের ক্লাসের সামনে থেকে তাকে নিয়ে আসে ৷ মিলির রিহার্সাল শেষ হলে তাকে বাসস্টপেজ পর্যন্ত এগিয়ে দেয় ৷
বাশার, রানা, কায়েস-আজাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আজাদকে ধরে ৷ ‘আজাদ, তুমি তো কিল্লা ফতে করে দিয়েছ, আমাদের খাওয়াও ৷’
‘খেতে চাইলে খাবে ৷ এর সাথে অন্য কোনো কিছুকে মিলিও না ৷’ আজাদ জবাব দেয় ৷
‘মিলিও না মানে কী’ ? রানা বলে, ‘মিলিও না নয়, কথাটা হবে মিলি ও হ্যাঁ ৷’
খাওয়ানোর বেলায় মায়ের মতোই দিলদরিয়া আজাদ ৷ সোৎসাহে বন্ধুদের নিয়ে যায় গ্রান্ড জাহাঙ্গীর হোটেলে ৷ কাবাব-তন্দুর খাইয়ে দেয় ভরপেট ৷
মাকে চিঠি লিখে মিলির কথা জানায় আজাদ ৷ মা ছাড়া এ পৃথিবীতে কে আছে আর তার! তাঁকে তো অবশ্যই তার জীবনের সব কথাই বলতে হবে ৷
মা মনে মনে খুশিই হন ৷ ছেলের বউয়ের জন্যে তিনি অনেক ভরি গয়না আলাদা করে রেখে দিয়েছেন ৷ এগুলো বউয়ের হাতে দিতে পারলে না তাঁর শান্তি!
কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই ক্লাসে আসা বন্ধ করে দেয় মিলি ৷ কী ব্যাপার ? মিলির কী হলো ? অসুখ-বিসুখ ? আজাদের বুক কাঁপে ৷ দুদিন মিলিকে না দেখে ভেতরে ভেতরে দারুণ অস্থির বোধ করে সে ৷ তারপর সে যায় মিলির খালার বাসায় ৷ দরজায় নক করে ৷ মিলির খালা তাকে বৈঠকখানায় বসতে দেন ৷ তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে দু হাতের আঙুল কচলাতে কচলাতে বলেন, ‘বাবা, এসেছ ৷ খুব ভালো করেছ ৷ তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি ৷ মিলির তো বিয়ে হয়ে গেছে ৷ হঠাৎই ভালো সম্বন্ধ এসেছে ৷ বিয়ে দিয়ে দিয়েছি ৷ ছেলে বাঙালি ৷ লাহোরে পোস্টিং ৷’
আজাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে ৷ নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে, ‘আশ্চর্য তো ৷ মিলি আমাকে কিছুই বলল না ৷’
‘বলবে কী করে ? ও জানে নাকি! আমরাই জানি না ৷ মেয়ে দেখার কথা বলে ওরা এসেছিল ৷ পছন্দ হয়ে গেছে ৷ বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে গেছে ৷ নাও মিষ্টি খাও ৷ ওর বিয়ের মিষ্টি ৷’
ব্যাপার আজাদ এটুকুনই শুধু জানতে পারে ৷ বেশি কিছু নয় ৷ কিন্তু এর-ওর মাধ্যমে আজাদের বন্ধুরা জেনে যায়, আজাদের বাবা যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, এই খবর, আর তার বাবার সঙ্গে আরো আরো মেয়ের সম্পর্ক আছে-এ ধরনের গুজব মিলিদের বাসায় গিয়ে পৌঁছেছিল ৷ মিলির বাবা-মা তাই চাননি আজাদের সঙ্গে মিলির কোনো সম্পর্ক হোক ৷ সে কারণেই তড়িঘড়ি করে মিলিকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ আজাদকে জানতেও দেওয়া হয়নি ৷
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বেধে যায় ৷ করাচিতে ব্লাক আউট হয় মাঝে মধ্যেই ৷ আজাদের এই অন্ধকার সহ্য হয় না ৷ অন্ধকার হলেই তার মনে পড়ে যায় মিলির কথা ৷ মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলত ৷ তার দু চোখে সে দেখতে পেয়েছিল মুগ্ধতা ৷ এমনকি আজাদের মধ্যে কী কী দেখে সে পটে গেছে, এসব নিয়েও সে কথা বলেছিল ৷ তা বলে সে হঠাৎ এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারল! মেয়ে মাত্রই কি অভিনেত্রী! শুধু মিলি প্রসঙ্গ নয়, তার খারাপ লাগে যখন মনে পড়ে পরীক্ষার রেজাল্ট ৷ পরীক্ষা সে তত খারাপ দেয়নি, কিন্তু তার রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি ৷ এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না ৷ স্যাররা কি বাঙালি বলে তাকে কম নম্বর দিয়েছেন ? এটা কি হতে পারে! তাও কি হয়! তার খারাপ লাগে ৷ চারদিকে অন্ধকার ৷ ইন্ডিয়ান বিমান আসবে, এই ভয়ে ৷ মরার বিমান আসে না কেন ? কেন মাথায় বোমা মেরে সবকিছু ধ্বংস করে দেয় না! একটা মোমবাতি জ্বালাবে নাকি সে ? না ৷ জ্বালাবে না ৷ এই অন্ধকারই তার ভালো লাগে ৷
আজাদ নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে আরো বেশি করে বাঙালি সমিতি আর বাংলা ক্লাবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ফেলে ৷
পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ভারত-বিরোধিতার ধুয়া তুলে রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে হিন্দু লেখকদের গান প্রচার করা, দেশে ভারতীয় বই আমদানি করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হতে থাকে ৷ সিনেমা হলে আর আসবে না উত্তম-সুচিত্রার ছবি ৷ এরই প্রেক্ষাপটে আসে ২১শে ফেব্রুয়ারি ৷ পূর্ব পাকিস্তানে ২১শে ফেব্রুয়ারি মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে শুনতে পেয়ে করাচিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছেলেরা বাঙালি সমিতির মাধ্যমে জোরেশোরে ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান পালন করে ৷ দুদিন অনুষ্ঠান হয় ৷ এক দিন ছিল আলোচনা অনুষ্ঠান ৷ আরেক দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ৷ দুদিনই অনুষ্ঠান শুরু হয় আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গান দিয়ে ৷
আজাদ এ অনুষ্ঠান নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি করে ৷ ক্লাস করার সময় তো সে পায়ই না, মাকে চিঠি লেখার সময়ও সে করে উঠতে পারে না ৷ পরে, ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে সময় করে নিয়ে মাকে সে লেখে :
মা,
চিঠির উত্তর দিতে অনেক দেরি হয়ে গেল ৷ মাফ কেরো ৷ একে ত পরীক্ষা কাছে অর্থাৎ ১২ জুন শুরু হবে ৷ এদিকে ২১ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি সমিতির দুইটা ফাংকশন করতে হয়েছে ৷ তাই চিঠি লেখার এমনকি ক্লাস করার সময় পাই নাই ৷ যা হোক, আমি এখন ভালোই আছি ৷ পড়াশুনা শুরু করি নাই ৷ করব ৷ দোয়া কোরো ৷ তুমি কেমন আছ, চিঠির উত্তরে জানাইও ৷ খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত কোরো ৷ এবং বসন্তের টিকা মনে করে নিও ৷
আর সেই যে একটি মেয়ের কথা লিখেছিলাম, ওর বিয়ে হয়ে গেছে ৷ জীবনের একটা বিরাট দিক আমি হারালাম, আর পাব না ৷ আমি বুঝতে পারছি না আমার সব ব্যাপারে কপাল খারাপ! জীবনে শান্তি বোধহয় মৃত্যু পর্যন্ত পাব না ৷ দোয়া কোরো যেন কিছু মনে শান্তি পাই ৷ চারদিক থেকে অশান্তি আমাকে ঘিরে রেখেছে ৷ যা হোক, এখন আসি ৷
ইতি তোমার আজাদ
এ চিঠির জবাবে মা লেখেন, ‘ফাংশন নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার দরকার নাই ৷’ আজাদকে তিনি মনে করিয়ে দেন, করাচিতে তাকে পাঠানো হয়েছে লেখাপড়া করার জন্যে ৷ ভালো রেজাল্ট করার জন্যে ৷ অন্য কোনো কিছু করে সে যেন সময় নষ্ট না করে ৷ মা আরো লেখেন, ‘পড়াশোনা করে মানুষ হয়ে তুমি মাকে খাওয়াবে, পরাবে ভালো রাখবে, এ আশায় আমি তোমাকে পড়তে বলছি না ৷ তোমার নিজের জন্যেই তুমি পড়াশোনা করবে ৷ ভালো রেজাল্ট করবে ৷ মানুষের মতো মানুষ হবে ৷ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে ৷’