১৩. মায়ের কবর জেয়ারত

তেরো

এ মহান সম্রাটের দর্শন ও তার সময় দয়া-দাক্ষিণ্য লাভের সুযোগ গ্রহণ করে আমি মায়ের কবর জেয়ারতের জন্য রওয়ানা হলাম। আমার বাসস্থান তাজিয়ার শহরে পৌঁছে সেখান থেকে সাবটা (সেউটা) গিয়ে কয়েকমাস কাটালাম। সেখানে এক অসুখে পড়ে আমাকে তিন মাস ভুগতে হয়। খোদ পরে আমাকে সুস্থ করেন। পরে আমি জেহাদে এবং সীমান্ত রক্ষার কাজে যোগদান করবো বলে প্রস্তাব করি। কাজেই, আসিলার বাসিন্দাদের একটি ছোট জাহাজে উঠে সেউটা থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দালুসিয়ায় গিয়ে পৌঁছলাম (খোদা এদেশকে রক্ষা করুন)। দশমাস কাল জেবেল (জিব্রাল্টার) অবরোধ করে অত্যাচারী খৃষ্টান আদফুনা তখন মৃত্যু বরণ করেছেন। তার ইচ্ছা ছিল তখনও মুসলমানদের আন্দালুসিয়ায় যা-কিছু অবশিষ্ট আছে তার সবই তিনি গ্রাস করবেন। কিন্তু খোদা তাকে হিসাব-নিকাশের বাইরে নিয়ে গেলেন। তিনি ভয়াবহ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। যে আন্দালুসিয়া আমি দেখেছি তার প্রথম অংশ মাউন্ট অব কংকোয়েষ্ট (জিব্রালটার)। পাহাড়ের চারদিক পজে প্রদক্ষিণ করে আমি মরক্কোর ভূতপূর্ব সুলতান আবুল হাসানের কীর্তি এবং তাঁর সঞ্চিত যুদ্ধোপকরণ দেখতে লাগলাম, সে সঙ্গে দেখলাম আমাদের অধিনায়ক পরে যা-কিছু অর্জন করেছেন। খোদা তাকে শক্তিশালি করুন। আমি এদেশ রক্ষাকারীদের একজন হয়ে বাকী জীবন কাটাইতে চাই।

ইব্‌নে জুজায়ী বলেছেন, “মাউন্ট অব কঙ্কোয়েষ্ট ইসলামের একটি দূর্গ স্বরূপ। পৌত্তলিকদের গলায় এটি যেনো একটি হাড়ের মতো বিধে আছে। এখান থেকেই আরবদের দ্বারা বিখ্যাত স্পেন বিজয়ের আরম্ভ। মুসা ইনবে নুসাইর দ্বারা আজাদীপ্রাপ্ত তারিক ইব্‌নে জিয়াদ এখানেই অবতরণ করে ৭১১ হিজরীতে প্রণালী অতিক্রম করেন। তার নামানুসারেই এর নাম হয়েছে জেবেল তারিক (তারিকের পর্বত শৃঙ্গ)। এ জায়গাকে বিজয় শৃঙ্গ বা মাউন্ট অব কঙ্কোয়েষ্টও বলা হয়, কারণ বিজয় এখান থেকেই আরম্ভ হয়। তারিকের নির্মিত প্রাচীরের এবং তার সেনাদলের স্মৃতিচিহ্ন এখনও এখানে বিদ্যমান আছে তা আরবদের প্রাচীর বলে পরিচিত। আলজেসিরাস অবরোধের সময় আমি নিজেও তা দেখেছি।

বিশ বৎসরেরও অধিককাল খ্রীষ্টানদের দখলে থাকবার পরে আমাদের ভূতপূর্ব অধিপতি আবুল হাসান জিব্রাল্টার পূর্নদখল করেন। বিপুল অর্থ ও শক্তিশালি সেনাদলসহ তিনি তাঁর পুত্র শাহজাদা আবু মালিককে পাঠান জিব্রাল্টার অবরোধের জন্য। ছ’মাস অবরোধের পর ৭৩৩ হিজরী (খৃঃ পৃঃ ১৩৩৩) জিব্রাল্টার দখল করা হয়। জিব্রাল্টার তখন বর্তমান অবস্থায় ছিল না। আমাদের ভূতপূর্ব অধিপতি আবুল হাসান। দূর্গশীর্ষে প্রকাণ্ড একটি সুরক্ষিত গৃহ নির্মাণ করেন। পূর্বে এখানে ছিল ছোট একটি মিনার মাত্র এবং তাও ক্ষেপণযন্ত্রের সাহায্যে নিক্ষিপ্ত প্রস্তরের আঘাতে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। সে-ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানেই তৈরী হয় এ নূতন সুরক্ষিত এমারত। এখানকার আয়ুধাগারটিও ‘তার তৈরী। কারণ এখানে আগে কোন আয়ুধাগার ছিল না। এ ছাড়া, লাল পাহাড় আবেষ্টনকারী প্রকাণ্ড প্রাচীরটি, যা আয়ুধাগার থেকে টালির উঠান অবধি বিস্তৃত, তিনিই তৈরী করান। পরবর্তী কালে আমাদের খলিফা আবু ইনান (রাঃ) পুনরায় এর সুরক্ষণ ও শোভাবর্ধনের কাজ নিজ হাতে গ্রহণ করেন ও পাহাড় পর্যন্ত প্রসারিত প্রাচীরটি সুদৃঢ় করেন। এ প্রাচীরটিই সবচেয়ে সুদৃঢ় এবং প্রয়োজনীয়। তিনি সেখানে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধোপকরণ ও খাদ্য সামগ্রীও সরবরাহ করেন। তিনি এভাবে তার কর্তব্য সম্পাদন করে খোদার প্রতি তার অসীম আনুগত্যের পরিচয় দান করেন। জেবেলের ব্যাপারে তার এতদূর আগ্রহ ছিল যে, তিনি জেবেল তারিক বা জেবেল পর্বত শৃঙ্গের একটি মডেলে তৈরী করতে হুকুম দেন। সেই মডেলে জেবেলের প্রাচীর, মিনার, কিল্লা, প্রবেশদ্বার, আয়ুধাগার, মসজিদ, বারুদাগার, শস্যভাণ্ডার প্রভৃতি সবই হুবহু দেখানো হয়। তার আকৃতিও লেবেলের মতোই করা হয়। এবং তাতে রেল মাউণ্ড বা লাল পাহাড়টিও দেখানো হয়। মডেলটি প্রাসাদের এক প্রান্তে অবস্থিত। এটি একটি অবিকল অনুকরণ ও নিখুঁত শিল্পনৈপুণ্যের নিদর্শন। জেবেল দেখে এলে যে ব্যক্তি এ মডেলটি দেখেছে সেই শুধু এর মূল্য বুঝতে পারে। জেবেলে কখন কি ঘটছে না-ঘটছে তা জানবার এবং জেবেলকে শক্তিশালি করা ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করার আগ্রহেই তিনি এ মডেলটি এভাবে তৈরী করান। সর্বশক্তিমান খোদা তার অছিলায় পশ্চিম উপদ্বীপে (স্পেন) ইসলামকে বিজয়ী করুণ এবং তাঁর যে আদেশ ছিল, তিনি বিধর্মীদের দেশ অধিকার এবং ক্রুশ পূজারীদের শক্তি হ্রাস করবেন, সে আশাও ফলবতী হোক।”

আমাদের শেখের বিবৃতি আবার শুরু হল। জিব্রাল্টারের বাইরে আমি রন্ডা শহরে এলাম। রপ্তা অতি সুন্দর জায়গায় অবস্থিত মুসলমানদের একটি সুদৃঢ় কেল্লা। এখানকার কাজী ডাক্তার আবুল কাসিম মোহাম্মদ বিন এয়াহিয়া ইব্‌নে বতুতা আমার খুল্লতাত ভাই। রাস্তায় পাঁচ দিন কাটিয়ে আমি এলাম মারবালা (মারবেল্লা) শহরে। এই দুটি শহরের মধ্যবর্তী চলাচলের রাস্তাটি অত্যন্ত বন্ধুর ও দুর্গম। একটি উর্বর জেলায় অবস্থিত মারবালা সুন্দর ছোট শহর। সেখানে গিয়ে একদল ঘোড় সওয়ারকে পোলাম মালাকা যাওয়ার জন্য তৈরি। আমিও তাদের সঙ্গেই রওয়ানা হবার ইচ্ছা করেছিলাম কিন্তু খোদা সে যাত্রা আমাকে রক্ষা করলেন। তারা আমার আগেই রওয়ানা হয়ে গিয়েছিল এবং পথে শক্রর হাতে বন্দী হয়েছিল। সে বিবরণ পরে বলছি।

ঘোড় সওয়ারদের পরে রওয়ানা হয়ে আমি যখন মারবালা জেলা ছাড়িয়ে সুহাইল ২ জেলার সীমান্তে গিয়ে পৌচেছি তখন দেখতে পেলাম রাস্তার পাশের একটি গর্তে একটা ঘোড়ার মৃতদেহ। আরও কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম এক ঝাঁকা মাছ রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। আমার মনে কেমন সন্দেহের উদ্রেক হল। সামনেই ছিল একটা উঁচু মিনার যার উপর থেকে পাহারাদাররা চারদিকে নজর রাখত। আমি আপন মনেই বলে উঠলাম, “যদি কোনো শত্রুর আক্রমণের ভয় থাকে এখানে তাহলে মিনারের পাহারাওয়ালা আমাকে হুঁশিয়ার করে দেবে।” তারপর কাছেই একটা বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম একটা ঘোড়াকে মেরে রাখা হয়েছে সেখানে। আমি যখন সেখানে আছি তখন একটা চীৎকার শুনতে পেলাম আমার পেছনে (আমি দলের লোকদের ছেড়ে তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছি)। পিছন ফিরে দেখতে পেলাম, তাদের সঙ্গে রয়েছেন সুহাইল দূর্গের সেনাপতি। তিনি। আমাকে জানালেন, শত্রুপক্ষের চারখানা ক্ষুদ্র জাহাজ সেখানে পৌচেছে। মিনারে যখন। পাহারাদার ছিল না তখন কিছু সংখ্যক লোকও জাহাজ থেকে নেমেছে। মারবালা থেকে যে বারো জন ঘোড়সওয়ার এসেছিলো তাদের সঙ্গে মোকাবেলা করেছে এই আক্রমণকারীরা। খৃষ্টানরা একজনকে হত্যা করেছে, একজন গেছে পালিয়ে। বাকি দশজন হয়েছে বন্দী। সে সঙ্গে তারা একজন জেলেকেও হত্যা করে। সেই জেলের। মাছের চুপড়ীই আমি পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখেছি।

অফিসারটি তার বাসায় আমাকে রাত কাটাতে পরামর্শ দিলেন। তাহলে তিনি পরে আমাকে মালাকা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবেন। ঘোড়সওয়ার সীমান্ত রক্ষীদের কেল্লায় আমি রাত কাটালাম। তারা সুহাইল বাহিনী নামে পরিচিত। যে ক্ষুদ্র জাহাজগুলির কথা বলেছি সেগুলো তখনও ওখানেই ছিল। পরের দিন তিনি ঘোড়ায় চড়ে আমার সঙ্গে রওয়ানা হলেন এবং আমরা যথাসময়ে মালাকা গিয়ে পৌঁছলাম। মালাকা আন্দালুসিয়ার অন্যতম সুন্দর ও বড় শহর। সমুদ্রের এবং স্থলভাগের উভয় প্রকার সুবিধাই এ শহরটির রয়েছে। তাছাড়া ফলমূল ও খাদ্য সম্ভারও এখানে প্রায় পাওয়া যায়। আমি দেখলাম এখানকার বাজারে একটি ছোট দেরহামের বিনিময়ে আট পাউণ্ড আঙ্গুর বিক্রি হচ্ছে। এখানকার পদ্মরাগ সদৃশ লাল মার্সিয়ান আনারের তুলনা দুনিয়ায় বিরল। তা ছাড়া ডুমুর জাতীয় ফল ও বাদাম মালাকা এবং মালাকার উপকণ্ঠ থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশসমূহে প্রচুর চালান হয়ে যায়। মালাকায় গিল্টি করা প্রচুর। হাঁড়ি-বাসন তৈরি হয় এবং সে সবও দূর-দূরাঞ্চলে চালান হয়। বিস্তৃত পরিধি বিশিষ্ট এর মসজিদটির পবিত্রতার যথেষ্ট সুনাম আছে। মসজিদের চত্বরটি সৌন্দর্যে অতুলনীয়। চত্বরে কমলা লেবুর কয়েকটি সুউচ্চ গাছ রয়েছে।

মালাকায় পৌঁছে কাজীকে দেখলাম মসজিদে বসে আছেন কিছু সংখ্যক আইনজীবি ও শহরের গণ্যমান্য লোকজন নিয়ে। তারা সবাই পূর্বোক্ত বন্দীদের মুক্তিপণ দিবার জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন। আমি তাকে বললাম, “খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ যিনি আমাকে বন্দীদের দশা থেকে রক্ষা করেছেন। ঘোড়সওয়াররা রওয়ানা হয়ে আসবার পর যা-কিছু ঘটেছে তাকে বললাম। সব শুনে তিনি খুব বিস্ময়-বোধ করলেন। তিনি এবং শহরের ইমাম আমাকে অতিথ্য-উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন।

মালাকার পর আমি চব্বিশ মাইল দূরে বাল্লাশ (ভেলেজ) শহরে এলাম। বাল্লাশও সুন্দর শহর। এখানে চমৎকার একটি মসজিদ আছে। মালাকার মত এখানেও প্রচুর আঙ্গুর, ডুমুর জাতীয় ফল ও অন্যান্য ফল-মূল পাওয়া যায়। সেখান থেকে আমরা এলাম আল্ হামমা (আলহামা) শহরটি ছোট হলেও এখানকার মসজিদটি মনোরম একটি জায়গায় অবস্থিত। শহরের কাছেই, প্রায় মাইল খানেক দূরে নদীর পারে আছে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ (তার থেকেই এ শহরের নাম করণ হয়েছে আল হাম্মা)। এখানে পুরুষদের জন্যে একটি এবং মেয়েদের জন্যে একটি গোসলখানা আছে।

সেখান থেকে আমরা পৌঁছলাম গারণাটা (গ্রানাডা)। আন্দালুসিয়ার প্রধান নগর গ্রানাডা সব শহরের রাণী। গ্রানাডার শহরতলীও এত সুন্দর যে দুনিয়ার কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা হয় না। প্রায় চল্লিশ মাইল বিস্তৃত এ শহরতলীর ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে বিখ্যাত সান্নিল (জেনিল) নদী এবং আরও বহু শহর। শহরের চারদিক ঘিরে রয়েছে ফুলফলের বাগান শস্যশ্যামল মাঠ, সুরম্য অট্টালিকা ও আঙ্গুর ক্ষেত। সবচেয়ে সুন্দর যে সব জায়গা তার ভেতর উল্লেখযোগ্য হলো আইন-আদ-দামা (অশ্রু ঝরণা) –ফলফুলের বাগানে ঘেরা একটি পাহাড়। অন্য কোনো দেশে তার সমতূল্য জায়গা দেখা যায় না। আমি যখন গারণাটায় যাই তখন সুলতান ছিলেন আবদুল হাজ্জাজ ইউসুফ। তিনি তখন অসুখে ভুগছিলেন বলে আমি তার সঙ্গে দেখা করিনি ৫। তার মহীয়সী পুণ্যবতী মাতা আমাকে কিছু স্বর্ণ দিনার উপহার দিয়েছিলেন। আমি তার সদ্ব্যবহার করেছি।

গারণাটায় কিছু সংখ্যক বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি ও প্রধান শেখের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আমার হয়েছিল। প্রধান শেখ সেখানকার সুফী সম্প্রদায়ের প্রধান। গারণাটা শহরের বাইরে তার আস্তানায় আমি কয়েকদিন তার সহবাসে কাটাই। তিনি আমাকে বিশেষ সমাদর করেন এবং আমার সঙ্গে বিখ্যাত অতিথিশালায় আল্-আকাব (ঈগল পাখী)ঘাটী দেখতে যান। আল-আকাব একটি পাহাড়। শহর থেকে আট মাইল দূরে এ পাহাড়ের উপর থেকে গারণাটার আশপাশ দেখা যায়। আল-আকাবের কাছেই রয়েছে আল্-বেরা শহরের ধ্বংসাবশেষ। পারস্য-সূফী মতাবলম্বী একজন দরবেশও গারণাটায় রয়েছেন। তাদের নিজ-নিজ দেশের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বলে তারা এখানে ঘর বাড়ী তৈরি করে বসবাস করেছেন। একজন এসেছেন সমরখন্দ থেকে, আরেকজন তাব্রিজ ও তৃতীয় জন কুনিয়া (কনিয়া) আরেক জন খোরাশান, দু’জন হিন্দুস্তান ইত্যাদি।

গারণাটা থেকে ফেরবার পথে আবার আল-হামা বাব্বাশ ও মালাকা হয়ে ঢাকওয়ান কেল্লায় এলাম। প্রচুর পানি গাছপালা ও ফলমূলে সমৃদ্ধ চমৎকার জায়গা ঢাকওয়ান। ঢাকওয়ান ছেড়ে এলাম রন্ডা, রন্ডা থেকে জিব্রালটার। জিব্রালটারে একটি জাহাজে উঠলাম। এ জাহাজটির সাহায্যে আগেও আমি পার হয়েছিলাম। আর্সিলার (আরজিলা) অধিবাসীরা এ জাহাজের মালিক। আমি সাবটা (সিউটা) হয়ে এলাম আসিলা। আসিলায় কয়েক মাস কাটালাম। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে এলাম সালা (সালি)। সালা থেকে এলাম মারাকুশ শহরে। বিশালায়তন মারাকুশ একটি সুন্দর শহর। এখানে কয়েকটি মনোরম মসজিদ রয়েছে। প্রধান মসজিদটি কুতুবাইন মসজিদ বা পুস্তক-বিক্রেতাদের মসজিদ নামে পরিচিত। এখানে একটি সুউচ্চ মিনার রয়েছে। সেই মিনারে আরোহন করায় সারা শহরটি আমার দৃষ্টি গোচর হল। শহরের বেশী অংশই এমনভাবে ধ্বংসের কবলে পড়েছে যে বাগদাদের সঙ্গে এর তুলনা চলে। অবশ্য বাগদাদের বাজারগুলো অপেক্ষাকৃত ভাল ৮। মারাকুশেও সুবৃহৎ একটি কলেজ আছে। সুন্দর পরিবেশে সুদৃঢ়ভাবে গঠিত এ কলেজটি। আমাদের খলিফা আমির-উল-মোমেনিন আবুল হাসান (মরক্কোর ভূতপূর্ব সুলতান) এ কলেজের স্থাপয়িতা।

***

টিকা

পরিচ্ছেদ ১৩

১। একাদশ আলফন্সস এবং জিব্রন্টারের অবরোধ সম্বন্ধে ১২ পরিচ্ছেদ এবং ৪ টীকা দ্রষ্টব্য। এ পরিচ্ছেদের অস্বাভাবিক তিক্ত সুরে প্রতিবিম্বিত হয়েছে মুর এবং স্টেনিয়ার্ডদের সে সময়ে মেজাজ ও মনোবৃত্তি যা তাদেরকে উদ্ধৃদ্ধ করেছিল আন্দালোসিয়া পুনরায় জয় করার সময়ে। এবং পরবর্তী শতাব্দী কালে।

২। ইদ্রিসিতে সুহেইল নামক স্থানের উল্লেখ নেই। মাকারি’তে একে বর্ণনা করা হয়েছে মালাকার পশ্চিমে অসংখ্য গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি বৃহৎ জেলা রূপে (১ম খণ্ড, ১০৩)। এর ভিতরে রয়েছে সুহেইল পর্বত এবং এটাই আন্দালুসের একমাত্র পর্বত। এখান থেকে দেখা যায় সুহেইলের কনাষ্টিলেশন (Conopus)। ইব্‌নে বতুতার বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে স্থানটি হচ্ছে মারবেলা এবং মালাগারের মধ্যভাগে উপকূলের বিস্তৃতি।

৩। আল-হাম্ম, অর্থাৎ উষ্ণপ্রস্রবণ, কিম্বা থার্মা। এটা একটি স্থানের নাম। সমস্ত আরব দেশগুলিতে প্রায়ই এ নামের ব্যবহার দেখা যায়। ইব্‌নে বতুতার একজন সমসাময়িক ব্যক্তি এ শহর সম্পর্কে বলেছেনঃ “আলহাম্মার বুর্গ অবস্থিত রয়েছে একটি পর্বতের চূড়ায়। যারা সমস্ত পৃথিবী ভ্রমন করেছেন তারা বলছেন এ শহরের নির্মাণ কার্যের দৃঢ়তা এবং এর পানির উষ্ণতার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনো স্থানের তুলনা হয় না। সমস্ত অঞ্চল থেকে রোগীগণ এখানে আসে এবং রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত তারা এখানেই অবস্থান করে। বসন্তকালে আল্ মেরিয়ার অধিবাসীগণ সেখানে যান তাদের স্ত্রী এবং পরিজনদের নিয়ে এবং খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যের উপরে যথেষ্ট ব্যয় করে থাকেন।” (মাসালিক আল্-আবসার)।

৪। স্থানটি এখনো তার বিকৃত আরবী নাম দিনামার কিম্বা আদিনামার রক্ষা করে চলেছে। স্থানটি বেশ সুন্দর এবং লোক-সমাগমে মুখর। এটা গ্রানাডার নিকটবর্তী (স্পেনে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ৩৪৯)।

৫। সুলতান আবুল হাজাজ ইউসুফ প্রথম ইনি ছিলেন গ্রানাডার নারিদ রাজত্বের সপ্তম শাসক। এর রাজত্ব কাল ১৩৩৩ থেকে ১৩৫৪ পর্যন্ত। অন্য সব লেখকের গ্রন্থে তার রোগের প্রকৃতি বৃিত হয়েছে বলে দেখা যায় না। যেহেতু ইব্‌নে বতুতা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি, সেজন্য মনে হয় তিনি আল হামরার অভ্যন্তর ভাগ দেখেননি। অন্য সব সমকালীন প্রাসাদের তুলনায় আহামরার গাঠনিক বৈশিষ্ট সম্বন্ধে তার মতামত জানতে পারলে সেটা খুব উপাদেয় হতো।

৬। একটি পাণ্ডুলিপিতে যে বিরা নামক স্থানটি পরিদৃষ্ট হচ্ছে সেটা মুদ্রিত গ্রন্থের টিরা অপেক্ষা অধিক গ্রহনীয়। টিরা নামক কোনো স্থানের উল্লেখ কোনো স্পেনীয় আরবী গ্রন্থে দেখা যায় না। আল্-বিরা হচ্ছে পুরাকালের এবিরা-মুরদের যুগে এর স্থান দখল করেছিল গ্রানাডা। বর্তমানে এটা গ্রানাডা থেকে পনেরো মাইল পশ্চিমে। ইব্‌নে বতুতা স্থানটিকে দেখলেন ধ্বংসাবস্থায়। এ ধ্বংসের কারণ ছিল বোধহয় এবিরার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলিমগণ। ক্যাষ্টিলিয়ানদেরকে ১৩১৯ খ্রীস্টাব্দে পরাস্ত করেন। সম্ভবতঃ শহরটি পরবর্তীকালে পুনঃ নির্মিত হয়েছিল। কেন না গ্রানাডার বিরুদ্ধে ফার্ডিনাণ্ডের শেষ অভিযানের ইতিহাসে এটার উল্লেখ দেখা যায়। ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দে এ শহরটি তিনি অধিকার করেন (প্যাসকুয়াল দ্য গেয়াংগোস, ২য় খণ্ড, ৩৫০-১, ৩৭৭; মাক্কারি, ২য় খণ্ড, ৮০৫; আল ওমারি, দেমোমবাইন্দ অনুদিত, ২৪৫ পৃঃ)।

৭। ধাওয়ান কিম্বা আওয়ানকে একটি গ্রাম বলে বর্ণনা করেছেন একজন প্রথম যুগের লেখক। এ স্থানটি হচ্ছে মালাকার পশ্চিমে এবং ১৪৮৫ খ্রীস্টাব্দে ফার্ডিনাও কর্তৃক স্থানটি অধিকৃত হওয়ার সময়ে এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে একটি বৃহৎ জনবহুল দূর্গবেষ্টিত শহর রূপে (ইব্‌নে আল্-আবার, তামিলা, ৩৪৮; পি দ্যা গেয়াঙ্গোস, ২য় খণ্ড, ৩৭৪; মাক্কারি, ২য় খণ্ড, ৮০৩)।

৮। মারকুশের প্রতিষ্টা হয়েছিল ১০৭৭ খ্রীস্টাব্দে আমুরভিদ রাজত্বের রাজধানী রূপে। ইদ্রিসির বিবরণ অনুসারে শহরটির দৈর্ঘ্য ছিল এক মাইল এবং তার প্রস্থও ছিল প্রায় অনুরূপ। শহরের যে প্রাচীর এখনো বর্তমানে রয়েছে তার দৈর্ঘ্য প্রায় সাত মাইল। ম্যারিনিদৃগণ কর্তৃক এর অবরোধ এবং অধিকারের এবং রাজধানী ফেজে স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে শহরটি ধ্বংসমুখে পতিত হয়। এখানকার কুতুবিয়া মজিদের মিনার এখনো বর্তমান রয়েছে এবং মুর-শিল্পের শ্রেষ্ঠ কীর্তি রূপে এটা এখনো প্রশংসিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *