নারীরা রাজনীতি জানেনা, অর্থনীতি বোঝে না, ক্রিকেট বোঝে না, নারীরা কঠিন কাজ পারে না। নারীরা পারেনা, নারীরা জানেনা, নারীরা বোঝেনা—সবসময় শুনছি। অথচ নারীরা বারবার প্রমাণ করেছে তারা জানে পারে বোঝে। শুধু তাই নয়, তারা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি জানে, পারে এবং বোঝে। তারপরও নারীবিদ্বেষী সমাজের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয় নারীকে। নারীর সব জানা পারা বোঝাকে গায়ের জোরে অস্বীকার করে পুরুষেরা গদিতে বসে আরাম করছে। নারীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরুষের আরাম আয়েশের সব আয়োজন করতে। নারী থাকবে নেপথ্যে, পর্দার আড়ালে। সবার পিছে সবার নিচে সবহারাদের মাঝে। কিছু নারী কিন্তু পুরুষের বেঁধে দেওয়া নিয়ম ভেঙে সামনে চলে আসে। তারা দেখিয়ে দিতে পারে যে সংকটকালে তারাই সহায়। মমতা, মহাশ্বেতা আর মেধা—এই তিন নারী, তাঁদের যা কিছুই হোক না কেন রাজনৈতিক আদর্শ, যা কিছু ভুল ভ্রান্তি তাঁরা জীবনে করুন না কেন, মানুষের দুঃসময়ে তাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ঝুঁকি নিয়েছেন যে কোনও দুর্ঘটনার, আপোস করেননি কোনও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় কোনও ঘটনা নেই। এর চেয়ে বড় কোনও সত্য নেই। এর চেয়ে বড় কোনও মানবতা নেই।
নারী পথ থেকে পাথর সরিয়ে দেয়। পুরুষ এসে সে পথে রাজার মতো হাঁটে। পুরুষ গিয়ে মসনদে বসে রাজ্য শাসন করে। পুরুষেরা অরাজকতা করলে, বিশৃঙ্খলা করলে, পুরুষেরা যুদ্ধ করলে, মানুষ-হত্যা করলে শান্তির পতাকা হাতে এগিয়ে আসে নারী। নারীই ঘরে ঘরে চোর,ডাকাত, মাতাল, লুম্পেন, খুনী পুরুষের মুখোমুখি হচ্ছে, তাদের সামলাচ্ছে, তাদের বদলাচ্ছে, তাদের মানুষ করছে। নিজেরা অসুখ নিয়ে অন্যকে সুখ দিচ্ছে। নারীর এই চরিত্রকে মনে হতে পারে নারী কেবল সেবার জন্য আর দেবার জন্য জন্ম নিয়েছে। তা কিন্তু নয়, যুদ্ধ নারীও করতে পারে, করে। নারীও চাইলে কুৎসিত কদাকার হতে পারে, স্বৈরাচারী শাসক হতে পারে। ইতিহাসে তার নজীর আছে। নারী মানেই যে শান্তির প্রতীক, তা নয়। নারীরা কম ধ্বংস, কম নির্মমতা, কম খুন জানে না।
ঘরে বাইরে শান্তি রক্ষা করছে নারী। অথচ এই নারীকে জগতের সব ধর্মই বলেছে নারী নরকের দ্বার। এই নারীকে অনাদরে, অবহেলায়, অসুখে, অশান্তিতে রাখছে পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা। নারীকে দূরে সরিয়ে রাখছে রাজনীতি। ক’জন নারী আজ মন্ত্রী? ক’জন নারী সংসদ সদস্য? পলিটব্যুরোয় ক’জন নারী? ক’জন নারী প্রশাসন চালায়? ক’জন নারী অ্যাকাডেমির উঁচুপদে? অবশ্য নারীশিক্ষাই বা শুরু হয়েছে কবে থেকে আর! গোটা সমাজ তো এই সেদিন অবধি নারীশিক্ষার বিরুদ্ধেই ছিল। অবশ্য এখনও কি নারীশিক্ষাবিরোধী মানুষ নেই! খুব আছে। এখনও কি ভাবা হয় না যে ছেলেদের ইস্কুলে পাঠানো উচিত, মেয়েদের নয়। মেয়েদের রান্নাবান্না কাজকম্ম শিখে বিয়ে হয়ে যাওয়াই ভালো। যদি ইস্কুলে পাঠানোই হয় মেয়েদের, সে কি আর সত্যিকার শিক্ষিত হওয়ার জন্য? বিয়ের বাজারে মেয়ের দর বাড়ানোর জন্য ছাড়া আর কী! শহুরে লোকেরা তো মনে করে শহরে বুঝি মেয়েরা খুব শিক্ষিত। হায় শিক্ষা! ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার পরও কি খুব বেশি মানুষ জানে যে নারী ও পুরুষ উভয়ে মানুষ এবং তাদের অধিকার সমান? শিক্ষিত শহুরে মেয়েরা তো বাচ্চাকে ইস্কুলে ঢুকিয়ে ইস্কুলের দরজার কাছে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকে। সারাদিন পর বাচ্চা কী শিখে বেরোয়? বছর গেলে অংক বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোলের পাশাপাশি কি এই শিক্ষা কোনওদিন তারা অর্জন করে যে নারী পুরুষ উভয়ের স্বাধীনতা এবং অধিকার সমান? আর যে মেয়েরা দশটা পাঁচটা আপিস করছে? তারাও কি জানে? পুরুষ কর্তার সব আদেশ নির্দেশ তারা মাথা নত করে পালন করছে। বসতে বললে বসতে হয়, শুতে বললে শুতে। নিজের যোগ্যতার মূল্য নেই, দক্ষতার দাম নেই, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে পয়সা উপার্জন করতেও মেয়েদের দেওয়া হয় না। কেবল তো বাইরে নয়, ঘরেও ওই একই অবস্থা। কেবল পরিশ্রম করলেই চলবে না, বিসর্জনও দিতে হবে। মান, সম্মান, ব্যক্তিত্ব — যা কিছুই মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়— সবকিছুরই বিসর্জন। বিসর্জন দিতে চায় না এমন নারীকে ভালো বলার রেওয়াজ এই সমাজে নেই। তাই বিসর্জন দিয়েই তাদের ভালোর খাতায় নাম লেখাতে হয়। ভালোর খাতায় নাম লেখানোয় আর বেশ্যার খাতায় নাম লেখানোয়, আমার বিশ্বাস, তেমন কোনও পার্থক্য নেই।
নারীরা পারে না এমন কিছু নেই। অশান্তি করতে চাইলে করতে পারে, শান্তি চাইলে শান্তি পারে। ভালোবাসা যেমন পারে, ঘৃণাও তেমন পারে। এই পৃথিবীতে যতবার পুরুষেরা পচন ধরিয়েছে, ততবারই নারী এসে পচন সারিয়েছে। ততবারই ফসল ফলিয়েছে। সৌহার্দে স্নেহে সিক্ত হয়েছে সব। এই নারীকেই নেপথ্যে রেখে পুরুষ কৃতিত্ব নিয়েছে। নারীই রচনা করে, আর পুরুষেরা সমৃদ্ধ হয় নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে। নারীর জন্য এরকম কি কিছু শব্দ আছে? ভগ্নিত্ব? না নেই। এর চলও নেই, চর্চাও নেই। নারীদের তো আলাদা করে দেওয়া হয়। মা থেকে, বোন থেকে, বন্ধু থেকে। নারীর সঙ্গে নারীর যোগ সংযোগ বারবারই নষ্ট করে দেওয়া হয়। ইতিহাসের শুরু থেকেই নারী-বন্ধন নানা ধর্মে পড়ে, তন্ত্রে পড়ে, মন্ত্রে পড়ে নষ্ট হয়েছে। নারীকে পুরুষেরা বাঁধে, কিন্তু নারীর সঙ্গে নারীর বন্ধনের কোনও যো নেই। নারী যে নিজের প্রাপ্য অধিকার না পেলে আওয়াজ ওঠাবে, এক আওয়াজ শুনে একশ আওয়াজ, হাজার আওয়াজ ফাটবে তার জন্য, তার উপায় নেই। নারীর কোনও শক্তিশালী সংগঠন নেই। যা আছে তা ওই মধ্যবয়সী গৃহবধূ অথবা প্রায়-গৃহবধূদের দল, মাসে বা বছরে মিলিত হয়ে গুনগুনিয়ে গান গায়, আর নিজেদের স্বাধীনতার প্রসার দেখে নিজেরাই মুগ্ধ হয় বা মূর্চ্ছা যায়।
পুরুষেরা সুন্দরী নারীর সংত্তা তৈরি করেছে, সেই সংত্তা অনুযায়ী নারীরা উন্মাদের মতো সাজে, নিজেকে সুন্দরী হিসেবে প্রদর্শন করতে হবে, না হলে মান থাকে না, সমাজে দাম থাকে না। স্বনির্ভর নারী যে ক’টা টাকা উপার্জন করে, তার বেশির ভাগ চলে যায় সাজগোজের পেছনে। নিজের জন্য যে সময় তার জোটে, তার অধিকাংশই যায় অনুসন্ধানে, কী পরলে বা না পরলে লোকে তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। পুরুষেরা ভালো একটি কাজ দিয়েছে বটে নারীকে ব্যস্ত থাকার জন্য। রান্নাবান্না সন্তান-পালন ঘরসংসার ছাড়াও বড় একটি কাজ। এহেন ব্যস্ত নারীর যেন সময় না থাকে রাজনীতি বোঝার বা অর্থনীতি বোঝার। এমনকী ওই ক্তিকেট বোঝার সামান্য সময়ও যেন কেউ না পায়। নিজের অধিকারের অ-ও বোঝার তো প্রশ্নই ওঠে না। এত প্রতিবন্ধকতা, এত বাধা। ষড়যন্ত্রের শত জাল। নারীকে পিষে নিশ্চিহ্ন করার সব আয়োজন মজুত। তারপরও নারীকেই দেখি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে। এই নারীবিদ্বেষী সমাজেই জন্ম নেয় মহাশ্বেতা, মেধা আর মমতার মতো নির্ভীক নারী।
আমরা তো আশা করতে পারি আরও মহাশ্বেতার, আর মেধার! নারীর তো মেধা আছে মেধা হওয়ার! মমতা আছে মমতা হওয়ার। শক্তি আছে মহাশ্বেতা হওয়ার। তবে নারী কেন পিছিয়ে থাকে, নারী কেন গৃহবধূ হয়ে থাকে! নারী কেন শুধু সন্তানের মা হয়ে বসে থাকে! নারী কেন নির্জীব, নির্বুদ্ধি, নিষ্প্রভ, নিঃসাড়, নিস্তেজ, নিস্পৃহ, নিষিক্তয়, নিশ্চুপ, আর নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে! নারী তো আগুন হতে জানে। তবে আগুন কেন সে জ্বালায় না! যে আগুনে এই সমাজের যাবতীয় বৈষম্য পুড়ে খাক হয়ে যেতে পারে!
দুঃসময়কে সুসময়ের কাছে নিয়ে যেতে নারীই হাত বাড়িয়েছে। এই হাতে শত সহস্র নারী রাখুক তাদের মশলাপেশা চালধোয়া হাত, এই হাতে সুঁইসুতোর হাত, শিশুপালনের হাত, এই হাতে কলমপেষার হাত, এই হাতে হাতুড়ি বাটালির হাত, কাস্তে কোদালের হাত, এই হাতে সকল নারীর হাত।