১৩. মল্লিকবাবু ছাপানো প্যাডগুলো দিয়ে গেলেন

মল্লিকবাবু ছাপানো প্যাডগুলো দিয়ে গেলেন। কিন্তু যাবার সময় বললেন, “একখানা মাত্র কোম্পানি করবেন?”

মল্লিকবাবু ভেবেছেন কী? সোমনাথ কি মস্ত ব্যবসায়ী? “একটা কোম্পানি সামলাতে পারি কিনা দেখি।” সোমনাথ সলজ্জভাবে মল্লিকবাবুকে বললো।

অনভিজ্ঞ সোমনাথের কথা শুনে হেসে ফেললেন মল্লিকবাবু। চশমার মোটা কাঁচের ভিতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ফরটি ইয়ারস এ লাইনে হয়ে গেলো—একটা কোম্পানি করলে বিজনেসে টেকা যায় না।”

“মানে?” একটু অবাক হয়েই সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।

“আপনি বাঙালীর ছেলে, তাই বলছি। অন্তত তিনখানা কোম্পানি চাই। না হলে কোটেশন দেবেন কী করে? পারচেজ অফিসারকে পোষ মানাবেন আপনি—কিন্তু তিনি তো নিজের গা বাঁচিয়ে চলবেন। পোষ মানাবার পরে পারচেজ অফিসার নিজেই আপনাকে বলবে, তিনটে কোম্পানির নামে কোটেশন নিয়ে আসুন। দুটো কোটেশনে বেশি দাম লেখা থাকবে আর আপনারটায় দাম কম লেখা থাকবে।”

অর্ডার সাপ্লাই লাইনের গোড়ার কথাটাই যে সোমনাথ এখনও জানে না তা আবিষ্কার করে বৃদ্ধ মল্লিকবাবু বেশ কৌতুক বোধ করলেন।

“শুধু আলাদা কোম্পানি হলে তো চলবে না। ঠিকানাও তো আলাদা চাই?”সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।

“সে তো একশোবার,” মল্লিকবাবু একমত হলেন। “সাপ ব্যাঙ দুটো ঠিকানা লাগিয়ে দিলেই হলো। কলকাতায় ঠিকানার অভাব? অনেকে তো আমার ছাপাখানার ঠিকানা লাগিয়ে দিতে বলে। বিজ্ঞের মতো মল্লিকবাবু বললেন, “আপনি তিনখানার কথা ভাবছেন? আর আপনার পাশের শ্রীধরজীর এগারোখানা কোম্পানি। এগারো রকমের চালান, এগারো রকমের বিল, এগারো রকমের রসিদ, এগারো রকমের চিঠির কাগজ। আমার দুটে, পয়সা হয়।”

সোমনাথের মুখের অবস্থা দেখে মল্লিকবাবু বললেন, “টাকাকড়ির টানাটানি থাকলে এখন একটা কোম্পানিই করুন। তেমন আটকে গেলে আমার কাছে আসবেন, দু-চারখানা পুরানো কোম্পানির লেটারহেড এমনি দিয়ে দেবো। কত কোম্পানি হচ্ছে, কত কোম্পানি আবার ডকে উঠছে-আমার কাছে অনেক চিঠির কাগজের স্যাম্পেল থেকে যাচ্ছে।”

মল্লিকবাবু যে শ্রীধরজীর কথা বললেন তিনি ফিনফিনে পাঞ্জাবি, ফর্সা ধতি এবং চপল পরে সকালের দিকে মিনিট পনোরোর জন্যে অফিসে আসেন। চিঠিপর কিছু, এসেছে কিনা খোঁজখবর করেন। তারপর গোটাচারেক পান একসঙ্গে গালে পরে বাজারে বেরিয়ে যান।

শ্রীধরবাবুর এক পার্টটাইম খাতা রাখার বাব; আছেন। তিনি দু-তিনবার অফিসে ঘরে যান। এর নাম আদকবাবু। রোগা পাকানো চেহারা। বহু লেকের হিসেব রেখে বেড়ান। সোমনাথ শুনলো, এ-লাইনে আকবর খবে নামডাক—বিশেষ করে সেলস ট্যাক্স সমস্যা নাকি গলে খেয়েছেন। লোকে বলে সেলস ট্যাক্সের বিধান রায়! যত মর-মর কেসই হোক, আদকবাবু ঠিক পার্টিকে বাঁচিয়ে দেবেন।

আদকবাবু একদিন সোমনাথকে বললেন, “আপনি চালিয়ে যান। বেচাকেনা করে পয়সা আনুন—তারপর তো খাতা তৈরির জন্যে আমি আছি। ‘

সোমনাথ চুপচাপ ওঁর কথা শুনে যাচ্ছিল। কোথায় বিজনেস তার ঠিক নেই, এখন থেকে সেলস ট্যাক্স ইনকাম ট্যাক্সের চিত! আদকবাবু বোধহয় একটু মনঃক্ষম হলেন। সোমনাথকে বললেন, “বিজনেসে যখন নেমেছেন তখন এই খাতা জিনিসটাকে ছোট ভাববেন, স্যর। আপনার ওই টেবিলেই তো মোহনলাল নোপানি বসতো। বিজনেসের কটবদ্ধি তো খব ছিল। বম্বে থেকে প্লাস্টিক পাউডার আনিয়ে তার সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে বেশ টু-পাইস করছিল। কিন্তু হঠাৎ ঘটিবাটি ফেলে নোপানিকে উধাও হতে হলো কেন?”

উত্তরটা আদুকবাবু নিজেই দিলেন। “খাতা ঠিক মতো রাখেনি। ভেবেছিল ওটাও নিজে ম্যানেজ করবে। এখন ইনকাম ট্যাক্স ও সেলস ট্যাক্সের—শনি রহ, দুজনেই একসঙ্গে ছোকরার ওপর নজর দিয়েছেন!”

নোপানির কথাই তো বিশুবাবু বলেছিলেন, সোমনাথের মনে পড়লো। “মিস্টার বেস তো সেনাপতিকে ভদ্রলোকের বাড়িতেও পাঠিয়েছিলেন। নোপানি সেখানে নেই। কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছেন।” সোমনাথ বললো।

পানের ছোপধরা দাঁতের পাটি বার করে আদকব্যব; হাসলেন। ফিসফিস করে বললেন, “বাড়ি না ছেড়ে উপায় আছে? সাতাশ হাজার টাকার প্রেমপত্তর নিয়ে সেলস ট্যাক্স ঘোরাঘুরি করছেন। প্রেমপত্তর বোঝেন তো?” আদকবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

না বুঝে উপায় আছে? তপতীর চিঠিখানা গতকালই তো পাঁচবার পড়েছে সোমনাথ। কপাল কুঞ্চিত করে আদকবাবু বললেন, “আমাদের লাইনে প্রেমপত্তর মানে সার্টিফিকেট। ট্যাক্সো ঠিক সময় না দিলে আলিপরের সার্টিফিকেট অফিসার ঘটিবাটি বাজেয়াপ্ত করার জন্যে এই সাটিফিকেট ইস্য, করে। সার্টিফিকেট অফিসের বেলিফ রসময় হাজরাকে তো দেখেননি—সাক্ষাৎ চেঙ্গিজ খাঁ! টাকা না দিলে ভাতের হাঁড়ি পর্যন্ত ঠেলাগাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। কোনো মায়াদয়া করে না।”

কোনোরকম রোজগার না করেই সার্টিফিকেট অফিসের পেয়াদা রসময় হাজরার কাল্পনিক কালাপাহাড়ী মতি সোমনাথকে একটু বিমর্ষ করে তুললো। এতোদিন সার্টিফিকেট বলতে বেচারা পরীক্ষার সার্টিফিকেট এবং ক্যারেকটার সার্টিফিকেট বুঝতো। আলিপরের সার্টিফিকেট অফিসারের নাম সে কোনোদিন শোনেইনি।’আদকবাবু ফিসফিস করে খবর দিলেন, “আপনি ভাবছেন, নোপানি চম্পট দিয়েছে কলকাতা থেকে একেবারে বাজে কথা। এই কলকাতাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে এখন যদি নোপানি বলে ডাকেন। চিনতেই পারবে না। নাম নিয়েছে, প্রেমনিধি গুপ্ত!”

খাতা লেখা বন্ধ রেখে আদকবাবু বললেন, “আপনাকে সত্যকথা বলছি, এখন লকিয়ে লুকিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করছে, আমার হাতে ধরছে। বলছে, ‘আদকবাবু বাঁচান।’ রোগী মরে যাবার পর খবর দিলে ডাক্তার কী করবে বলুন?”

আদিকবাবু ওঁর চশমার ফাঁক দিয়ে সোমনাথের দিকে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “কী বুঝলেন?”

“বুঝলম নোপানি ফ্যাসাদে পড়েছে।”

সোমনাথের উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না আদকবাবু। বললেন, “নোপানি হচ্ছে জাত ব্যবসাদার—ওর বিপদ ও ঠিকই সামলাবে। আপনি কী বুঝলেন? আপনাকে দেখে শিখতে হবে—ঠেকে শিখতে গেলে এ লাইনে স্রেফ গাড়ী চাপা পড়ে যাবেন। শিক্ষাটা হলো এই যে শুধু রোজগারের চেষ্টা করলে হবে না—সেই সঙ্গে হিসেবের খাতাখানি পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন রেখে যেতে হবে।”

বুড়ো আদকবার যে সোমনাথের ওপর মায়া পড়েছে তা সেনাপতি দরজার কাছে বসে থেকেই বুঝতে পারছে। আদকবাবু ফিসফিস করে বললেন, “যে-লাইনে এসেছেন—পাইস আছে। অনেকে এখন রাতারাতি লাল হচ্ছে। এই যে শ্রীধরজী—কেমিক্যাল বেঁচে বেশ কামাচ্ছেন। কিন্তু এগারোখানা কোম্পানি-এর টুপি ওর মাথায় এমন কায়দায় পরিয়ে যাচ্ছেন যে আপনার মনে হবে রামকৃষ্ণ মিশনের অ্যাকাউন্ট। সেলস ট্যাক্স অফিসার নাক দিয়ে শকলে ধপধনোর গন্ধ পাবে!”

এ-লাইনের প্রথম বউনি আদকবাবুর অনগ্রহেই হলো। জয়সোয়ালদের স্টেশনারি দোকানের খাতা উনি রাখেন। ওখানকার ব্রিজবাবর সঙ্গে সোমনাথের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন আদকবাবু। বলেছিলেন, “বসে থাকবেন কেন? চেষ্টা করুন।”

ব্রিজবাব খুব বেশি ভরসা করেননি ছোকরা সোমনাথের ওপর। তবে বলেছিলেন, “ড়ুপ্লিকেটিং কাগজ এবং খামের স্টক রয়েছে। দেখুন যদি সেল করতে পারেন। আদকবাবু যখন এর মধ্যে রয়েছেন তখন আপনাকে অবিশ্বাস করবো না।”

রাস্তায় বেরিয়ে সোমনাথ একশ’ রিম ড়ুপ্লিকেটিং কাগজ এবং লাখখানেক খাম বারবার চোখের সামনে দেখতে লাগলো। একলক্ষ খাম কোথায় বেচবে সে ভেবেই পেলো না। সোমনাথের মাথায় নানা অদ্ভুত চিন্তা আসছে! একলক্ষ খাম মানে একলাখ চিঠি। সে কি সোজা ব্যাপার।

লালবাজারের সামনে বি কে সাহার প্রখ্যাত চায়ের দোকানের পাশে রেস্তরাঁয় বসে এক কাপ চা খেতে খেতে সোমনাথ হিসেব করতে লাগলো : নিজের সঙ্কোচ কাটিয়ে তপতীকে যদি প্রতিদিন একখানা চিঠি লেখে তাহলেও বছরে মাত্র ৩৬৫ খানা খাম লাগবে। দশ বছর ধরে অবিশ্রান্ত চিঠি লেখা চালিয়ে গেলেও মাত্র ৩৬৫০ খানা খাম খরচ হবে। অলরাইট—তপতীকেও যদি সোমনাথ কিছু, খাম পাঠিয়ে দেয় এবং সেও যদি রোজ একখানা করে চিঠি লেখে তাহলে সামনের দশ বছরে আরও ৩৬৫০ খানা খাম কাজে লাগবে। অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে সাত হাজার তিনশ’ খাম। অঙ্কটা নেশার মতো সোমনাথের মাথার ওপর চেপে বসেছে। একশ’ বছরেও তাহলে একলাখ খাম খরচ হচ্ছে না-লাগছে মাত্র তিয়াত্তর হাজার খাম।

আরও এক চুমক চা খেলো সোমনাথ! না, হিসেব ঠিক হচ্ছে না—কোথায় যেন ভুল থেকে যাচ্ছে। একশ’ বছরে অন্তত পঁচিশটা লিপ-ইয়ার পড়বে—তার অর্থ, বাড়তি পঁচিশ দিন, হইচ মিনস আরও পঞ্চাশখানা চিঠি।

হিসেবের ভারে মাথাটা যখন বেশ গরম হয়ে উঠেছে তখন হঠাৎ বাইরের দিকে নজর পড়লো সোমনাথের। একজন ছোকরা কোটপ্যান্ট পরে লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে। কলেজবান্ধবী শ্রীময়ীর নববিবাহিত হাজবেন্ড।

ভদ্রলোক বি কে সাহার দোকানের কাছে দাঁড় করানো একটা গাড়ির সামনে দাঁড়াতেই সোমনাথ দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। “মিস্টার চ্যাটাজি না? চিনতে পারছেন?”

অশোক চ্যাটার্জি গাড়ির মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিল। সোমনাথের গলা শুনেই থমকে দাঁড়ালো। সোমনাথের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসিমুখে অশোক চ্যাটার্জি বললো, “খুব চিনতে পারছি। আপনিই তো মিস্টার ব্যানার্জি? গড়িয়াহাটের মোড়ে সেদিন শ্রীময়ী আলাপ করিয়ে দিলো।”

লালবাজারের সামনে গাড়ি দাঁড়াতে দেয় না। তাই অশোক চ্যাটার্জি এবার সোমনাথকে গাড়ির মধ্যে তুলে নিলো।

মিশন রোয়ের ওপরেই ওদের অফিস। ওখানকার ভালো একটা পোস্টে রয়েছে অশোক চ্যাটার্জি। ভালো পোস্টে না থাকলে শ্রীময়ীর মতো চালু মেয়ে কেন অকালে টাক-পড়া শ্যামবর্ণের এই নাদুস-নুদুস ছোকরাকে বিয়ে করতে যাবে। কলেজ-জীবনে শ্রীময়ী যার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো সেই সমর ছিল সত্যিই সদশন। তপতীর কাছে শুনেছিল, শ্রীময়ী বলতো ছেলেরা সুদর্শন না হলে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আপেলের মতো টকটকে ফর্সা, স্মার্ট, লম্বা ছেলে ছাড়া শ্রীময়ী কিছুতেই বিয়ে করবে না। সিনেমার হিরোর মতো চেহারা ছিল সমরের, কিন্তু সে এ-জি-বেঙ্গলের লোয়ার-ডিভিসন কেরানি হয়েছে।

অশোক চ্যাটার্জির গাড়িতে বসে শ্রীময়ীর ভূতপবে বন্ধুদের কথা সোমনাথের ভাবা উচিত হচ্ছে না। সে বললো, “সেদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগলো।”

গাড়ি চালাতে চালাতে অশোক বললো, “একদিন বাড়িতে আসতে হবে। শ্রীময়ী খুব খুশী হবে। কিন্তু একলা এলে হবে না গিন্নিকে আনা চাই।”

হেসে ফেললো সোমনাথ। অশোক অপ্রস্তুত হলো। বোকা-বোকা হেসে বললো, “ওই পাট এখনও চোকানো হয়নি বুঝি?”

সোমনাথ এবার জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের অফিসে স্টেশনারি পারচেজ করেন কে?”

“আমি করি না। তবে যিনি করেন, তিনি আমার বিশেষ ফ্রেন্ড।” অশোক বললো।

ওঁর সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দেবেন? পার্টটাইম বিজনেস করছি। বিজনেস ছাড়া বাঙালীদের মুক্তি নেই বুঝতেই তো পারছেন, মিস্টার চ্যাটার্জি।”

“সে কথা বলতে?” অশোক উৎসাহ দিলো।

ছেলেটি সত্যিই ভালো। সোজা সোমনাথকে নিয়ে গেলো মিস্টার গাঙ্গুলীর কাছে। বললো, “আমার বিশেষ পরিচিত। যদি সম্ভব হয়, একটু সাহায্য করবেন।”

ভাগ্য ভালো। মিস্টার গাঙ্গুলী কাগজের নমুনা  দেখলেন। পঁচিশ রিম এখনই দরকার। রেট জানতে চাইলেন। মল্লিকবাবুর ছাপানো প্যাড বার করে সোমনাথ একটা কোটেশন ওখানেই লিখে দিলো।

মিস্টার গাঙ্গুলী কর্মচারীকে ডেকে বললেন, “দেখুন তো গতবার আমরা কী দামে কাগজ কিনেছিলাম।” ভদ্রলোক একটা ফাইল এনে মিস্টার গাঙ্গুলীর সামনে ধরলেন। দামটা গোপনে দেখে নিয়ে গাঙ্গুলী বললেন, “আপনার রেট ভালোই আছে। আমরা নগদ টাকায় কিনে নেবো।”

খামের ব্যাপারে একটু সময় লাগবে। নমুনা  এবং কোটেশন রেখে যেতে বললেন। স্টকের অবস্থা যাচাই করতে হবে।

বেলা পাঁচটার মধ্যে ব্যবসা খতম। সব হাঙ্গামা চুকিয়ে খরচখরচা বাদ দিয়ে কড়কড়ে তিনখানা দশ টাকার নোট হাজির হয়েছে সোমনাথ উদ্যোগ-এর মালিক সোমনাথ চ্যাটার্জির পকেটে। জীবনে প্রথম রোজগার। প্রথম প্রেমের মতোই সে এক অপব অভিজ্ঞতা। কলকাতা শহরের বিবর্ণ রপ মছে গিয়ে হঠাৎ সমস্ত শরীরটা সোমনাথের চোখের সামনে ঝকঝক করছে। ব্যবসায় যে রস আছে, তা সোমনাথ এবার বুঝতে পারছে। উত্তেজনা চাপতে না পেরে মানিব্যাগ বার করে সোমনাথ টাকাটা আবার গুণলো।

অফিসে ফিরে এসে বিশুবাবুর খোঁজ করলো সোমনাথ। তিনি নেই কোনো এক কাজে কলকাতার বাইরে গেছেন। আদকবাবু আসতেই মিষ্টি আনতে দিচ্ছিলো সোমনাথ। হাঁ-হাঁ করে উঠলেন আদকবাবু। “এই জন্যে বাঙালীর বিজনেস হয় না। এই তো আপনার প্রথম নিজস্ব ক্যাপিটাল হলো। এখনই খেয়ে উড়িয়ে দিলে চলবে কেন?—আগে হাজার দশেক টাকা হোক—তারপর আপনার কাছ থেকে জোর করে মিষ্টি খাবো।”

সোমনাথ খুশী মনে রয়েছে। বললো, “দেখুন না! যদি খামের কোটেশনটা লেগে যায়, তাহলে আমাকে পায় কে।”

ব্রিজ জয়গোয়ালের টাকাও যে সে মিটিয়ে দিয়েছে, তা সোমনাথ এবার আদকবাবুকে জানিয়ে দিলো। “উনি কী বললেন?” আদকবাবু জানতে চাইলেন।

“খুব খুশী হলেন। কীভাবে কোথায় বিক্রি করলাম সব বললম ওঁকে।”

“অ্যাঁ!” আঁতকে উঠলেন আদকবাবু। “করলেন কি মশায়। আপনার পার্টির নাম ব্রিজবারকে বলে দিলেন?”

তাতে মহাভারতের কী অশুচি হয়েছে সোমনাথ বুঝতে পারলো না। আদকবাবু বেশ বিরক্তভাবে বললেন, “আপনি বড় ফ্যামিলির ছেলে, বিজনেস করতে এসেছেন, আর আমি গরীব মানুষ খাতা লিখে খাই—আমার মুখে সব কথা মানায় না। তবু বলছি, এ-লাইনে কখনও নিজের তাসটি অন্য কাউকে দেখাবেন না। কাকে সাপ্লাই করছেন, তা ভুলেও কাউকে বলবেন না। যেখানে ঘোরাঘুরি করছি আমরা—এটা বাজারও বটে, জঙ্গলও বটে।”

 

ইতিমধ্যে তিরিশ টাকা রোজগার হয়েছে শুনে বেজায় খুশী হয়েছেন কমলা বউদি। লুকিয়ে বউদিকে খাওয়াতে চেয়েছিল সোমনাথ। বউদি রাজী হলেন না। খুব ধরাধরি করতে বউদি বললেন, “তার বদলে গাড়িটা বার করে আমাকে কবীর রোডে মামার বাড়িতে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে এসো।” দাদা সেলফ ড্রাইভ করেন। গাড়িটা মাঝে মাঝে স্টার্ট দিয়ে চাল রাখার কথা বউদিকে লিখেছেন। সোমনাথের অসুবিধে নেই। গাড়ি চালানোটা বউদি ও সোমনাথ দুজনে একসঙ্গে শুরু করেছিল। কমলা বউদি দু-দিন চালিয়ে আর সাহস পাননি। কিন্তু সোমনাথ ড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়ে ফেলেছিল সেই বি-এ পড়ার সময়েই।

বউদিকে সেদিন মামার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে একঘণ্টা পরে আবার ফিরিয়ে আনলে সোমনাথ। পথে লেকের ধারে গাড়ি থামিয়েছিল। সোমনাথ জোর করে বউদিকে কোকাকোলা খাওয়ালো কোনো আপত্তি শুনলো না। দেওরের প্রথম উপার্জনের পয়সায় কোকাকোলা খেতে কমলা বউদির খুব আনন্দ হচ্ছিলো। ওঁর ইচ্ছে, বাবার জন্যেও একটু মিষ্টি কেনা হোক। সোমনাথ কিন্তু এই অবস্থায় বাড়িতে কিছুই জানাতে চায় না। বউদিও সব ভেবে জোর করলেন না। বিজনেস লাইনে শেষ পর্যন্ত যদি সোমনাথ হেরে যায়, এবং সবাই যদি তা জানতে পারে, তাহলে বেচারার আত্মবিশ্বাস চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যাবে। ওর আত্মসম্মানে আঘাত লাগকে এমন কিছু করতে কমলা বউদি রাজী নন।

তবে শেষপর্যন্ত একটা রফা হলো। সোমনাথের পয়সায় বাবার জন্যে একশ’ গ্রাম ছানা কেনা হবে, কিন্তু কে পয়সা দিয়েছে বাবাকে বলা হবে না। এই ব্যবস্থায় সোমনাথের আপত্তি নেই।

জোড়ে-জোড়ে তরুণ-তরুণীদের লেকের ধারে ঘুরে বেড়াতে দেখে, কমলা বউদির একটু রসিকতা করতে ইচ্ছে হলো দেওরের সঙ্গে। কমলা বউদির খুব ইচ্ছে কম বয়সেই সোমনাথের বিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতে সাহস হলো না। যা দিনকাল, ছেলেদের কপালে বিধাতাপুরুষ কী লিখে রেখেছেন কে জানে?

পাইপের মধ্য দিয়ে কোকাকোলা টানতে টানতে কমলা বউদি বললেন, “আমার মন বলছে ব্যবসাতে তোমার খুব নাম হবে।”

“আপনার মুখে ফল-চন্দন পড়ুক বউদি।” সোমনাথ আন্তরিকভাবে বললো।

বউদি বললেন, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি যদি বিরাট বিজনেসম্যান হও কী করবে?”

মাথা চুলকে সোমনাথ বললো, আপনাকে কোম্পানির চেয়ারম্যান করবো। আর বেচারা সুকুমারকে একটা বড় পোস্ট দেবো। সুকুমার তদ্বির করে আমাকে একটা ইন্টারভিউ পাইয়ে দিয়েছিল। আমি ওর জন্যে কিছুই করতে পারিনি।”

কমলা বউদি বললেন, “শুনেছি ওদের বন্ড অভাব। ওর সঙ্গে দেখা হলে বোললা, চাকরির অ্যালিকেশনের জন্যে টাকাকড়ি লাগলে যেন আমাকে বলে। তোমার দাদার কাছ থেকে মাসে তিরিশ টাকা করে হাতখরচা আদায় করছি।”

 

আদকবাবুর কথা যে মিথ্যে নয়, তা তিনদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলো সোমনাথ। অশোক চ্যাটার্জির অফিস থেকে খামের অর্ডারটা পাবে এ সম্বন্ধে সে প্রায় নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু মিস্টার গাঙ্গুলী গম্ভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, হলো না। আপনার দামটা অনেক বেশি।”

মুখ শুকনো করে যখন সোমনাথ বেরিয়ে আসছিল, তখন মিস্টার গাঙ্গুলীর ডিপার্টমেন্টের সেই ক্লাকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। শিক্ষিত বেকারকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে দেখে ভদ্রলোকের বোধহয় একটু মায়া হলো। তিনি বলেই ফেললেন, “জয়সোয়াল কোম্পানির কাছে খাম কিনে বুঝি সাপ্লাই করছেন? ওরাই তো আপনার থেকে সন্তা কোটেশন দিয়ে গেল। বললো, সোজা ওদের কাছ থেকে নিলে আমাদের লাভ।”

সোমনাথ তাজব। ব্রিজবাবকে জিজ্ঞেস করতে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন! ব্যাপারটা মোটেই স্বীকার করলেন না। বরং বললেন, “বিজনেসে আমরা সবাই ভাই-ভাই। আমি কি করে আপনার পেছনে ছুরি লাগাবো?”

কুণ্ডুবাবু বলে এক কর্মচারি চুপচাপ ওদের কথাবার্তা শুনছিল। ব্রিজবাব চলে যেতেই ফিসফিস করে বললেন, “উনিই তো লোক পাঠিয়েছেন। কেন পাঠাবেন না। এইটাই তো বিজনেসের নিয়ম। আপনি যদি ব্লিজবাবর থেকে কম দামে অন্য কোথাও খাম পেতেনছাড়তেন?”

সব শুনে আদকবাবু বললেন, “এ তো আমি জানতাম। আপনি যদি জয়সোয়ালকে উচিত শিক্ষা দিতে চান তাহলে ঐ মিস্টার গাঙ্গুলীকে ম্যানেজ করুন। ব্রিজবাবর কাছে যদি প্রমাণ করতে পারেন আপনি না থাকলে ঐ কোম্পানি থেকে কিছুতেই অর্ডার আসবে না—তাহলে উনি আবার আপনার জুতোর সুখতলা হয়ে থাকবেন!”

“ওঁর অপমান হবে না?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করে।

“দূর মশায়! মান থাকলে তবে তো অপমান হবে। এটা তো বাজার, ল্যাং দেওয়া-নেওয়া চলবে জেনেই তো এরা মার্কেটে এসেছে।”

বেশ রাগ হচ্ছে সোমনাথের। ব্রিজবাবকে যোগ্য শিক্ষা দেবার একটা প্রচণ্ড লোভ হচ্ছে। কিন্তু আদকবাবু যে মতলব দিচ্ছেন তা সোমনাথ পারবে না। মিস্টার গাঙ্গুলী কেন তার কথা শুনবেন? তাছাড়া কম দামে যেখানে মাল পাওয়া যায় সেখান থেকে কেনবার জন্যেই তো কোম্পানি মিস্টার গাঙ্গুলীকে রেখেছেন।

আদিকবাবু ওসব বুঝলেন না। বললেন, “এ-লাইনে অনেকদিন হলো। পারচেজ অফিসারের কত গল্প কানে আসে। ওঁরা ইচ্ছে করলে যা খুশী তাই করতে পারেন।

বাড়িতে ফিরে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ব্রিজবাবকে হারিয়ে দেবার ব্যাপারটা সোমনাথের মাথায় ঘুরছে। বউদিকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে লাভ হলো না। সোমনাথ জানতে চেয়েছিল, প্রতিহিংসা জিনিসটা কেমন? বউদি যথারীতি মায়ের কথা তুললেন। মা বলতেন, কুকুর তোমাকে কামড়াতে এলে তুমি কুকুরকে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু তুমি কুকুরকে কামড়াতে পারে না।

তবু সোমনাথের মনটা শান্ত হচ্ছে না।

দেওর ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে দেখে কমলা বউদি ভরসা পেলেন।

 

সোমনাথ পরের দিন অশোক চ্যাটারি অফিস পর্যন্ত গিয়েছিল। ভাবলো একবার শ্রীময়ীকে ফোনে ধরবে কিনা। নববিবাহিতা বধূ কোনো অনুরোধ করলে অশোক চ্যাটার্জি তা ফেলতে পারবে না। কিন্তু ইচ্ছে করলো না সোমনাথের। যেখানে সন্ধ্যা হয় সেইখানেই বাঘের ভয়। অফিসের দরজার গোড়ায় অশোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বরটি ভালোই ম্যানেজ করেছে শ্রীময়ী। মনটি বেশ উদার। সোমনাথের সঙ্গে নমস্কার বিনিময় হলো।

অশোক চ্যাটার্জি আজও সৌজন্য প্রকাশ করলো-ব্যবসার খোঁজখবর নিলো। কিছু, অর্ডার পেয়েছে শুনে খুশী হলো—কিন্তু সোমনাথ খামের কথাটা তুলতে পারলো না।

সাদিক, আবার জিজ্ঞেস করলেন, “জয়সোয়ালকে একটু শিক্ষা দিলেন?”

সোমনাথ পরাজয় স্বীকার করলো। বললো, “মিস্টার গাঙ্গুলীর কাছে ছোট হতে পারলাম না।”

আদকবাবু বললেন, “এ-লাইনে যদি কিছু করতে চান পারচেজ অফিসারদের সঙ্গে ভাব করুন।”

 

চার নম্বর টেবিলের উমানাথ যোশী বেশ মনমরা হয়ে বসে আছে। ছোকরা কোনো লাইনেই তেমন সুবিধে করতে পারছে না। রাঠী নামে এক ভদ্রলোকের কোম্পানিতে সে কাজ করতো। মন কষাকষি হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুর করেছে। কিন্তু হাতে তেমন কাজকম্ম নেই।

যোশী যে-লাইনে কাজ-কারবার করে সেই একই লাইনে ব্যবসা করছেন দু নম্বর টেবিলের সুধাকর শর্মা। অথচ সুধাকরবাবুর নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই। একজন পার্টটাইম টাইপিস্ট রেখেছেন। কিন্তু সে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। সুধাকরবাবু একটা সারাক্ষণের টাইপিস্ট রাখবার কথা ভাবছেন। অনেক টেলিফোন আসে সুধাকরবাবুর নামে। ফকির সেনাপতি বারবার হাঁক দেয়-সায়েব আপনার টেলিফোন।

সুধাকর শর্মার সাফল্যের রহস্যটা বুঝতে পারে না সোমনাথ। যোশীর কাজকর্ম নেই তেমন—তাই সোমনাথের সঙ্গে মাঝে মাঝে কপ করে। যে.শী বলে, “শর্মাজী জাদ, জানেন। পারচেজ অফিসারকে মন্তর দিয়ে বশ করে ফেলেন?”

শমীজীর কাজ করেন না আদকবাবু। উনি বলেন, “পারচেজ অফিসার যদি গোখরো সাপ হয়—শর্মাজী হচ্ছেন, সাপড়ে। যতই ফণা তুলক, অফিসারকে ঠিক বশ করে শর্মাজী নিজের ঝাঁপিতে পরে ফেলবেন!”

কিসের যে ব্যবসা করেন না সুধাকরজী তা সোমনাথ বুঝতে পারে না। ঝোলাগড় থেকে আরম্ভ করে, সাবান, টয়লেট পেপার, কাঁচের গেলাস সব কিছুই সাপ্লাই করেন।

যোশী বলে, “সুধাকরজীর লক্ষ্মী হলো কোন্নগরের এক কারখানা। সেখানে সাড়েআটশ’ পিস সাবান প্রতি মাসে সাপলাই করতেন ভদ্রলোক। ওঁর গিন্নির সঙ্গে ওখানকার ম্যানেজারবাবুর দর সম্পর্কের আত্মীয়তা আছে। আগে প্রত্যেক ওয়াকারকে হাত রোবার জনো প্রতি মাসে একখানা সাবান দেওয়া হতো। এরপর সুধাকরজী নাকি ইউনিয়নের কোনো পাল্ডাকে পাকড়াও করেন। ওরা প্রতিমাসে দু’খানা সাবান দাবি করলো—কোম্পানি দিতে বাধ্য হয়েছে। সুধাকরজী মাসে সতেরোশ’ পিস সাবান সাপ্লাই করতে আরম্ভ করলেন। তারপর কীভাবে অন্য অনেককে ম্যানেজ করেছেন। সুধাকরজীর কাজ এত বেড়েছে যে নিজের আলাদা আপিসের কথা ভাবছেন।”

সোমনাথ মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখছে সেও সুধাকর শর্মার মতো কাজকর্ম বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু কী যে মন্তর সুধাকরবাবু জানেন—সে বুঝতেই পারে না। টো টো করে সেও সারাদিন অফিসে অফিসে ঘুরছে, কিন্তু সুবিধে করতে পারছে না।

সুধাকর শর্মা কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন না। শুধু ফিক করে হাসেন। আর সন্ধ্যা হলেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েন। ফকির সেনাপতি বলে, “শর্মাজী মাঝে মাঝে অনেক রাতে ফিরে আসেন। তখন নাকি একটু বেসামাল অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় তাঁকে।” সেনাপতি বিরক্ত হতে পারে না। কারণ সুধাকর শর্মা তাকে আলাদা করে প্রতি মাসে পঁচিশ টাকা দেন। অবশ্য সেনাপতিকে তার বদলে একশ টাকার ভাউচার সই করতে হয়। কিন্তু সেনাপতির তাতে আপত্তি নেই। কিছু টাকা তো মিলছে।

সুধাকর শর্মার জামাকাপড় বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বুশ শার্ট এবং টেরিলিন প্যান্ট পরেন। অফিসের আলমারিতে একটা কোট এবং টাইও আছে। বড় কোনো পার্টির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে অনেক সময় কোট চড়িয়ে নেন। সেনাপতি একটা ব্রাশ দিয়ে সুধাকরের কোট ঝেড়ে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *