জোসেফাইনের মন ভেজানর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বুড়ি পরিষ্কার বলে দিয়েছে, কাজ তোমাকে দেব না। মাথা-বেঠিক লোক আমি রাখি না। লুনাটিকদের বিষয়ে আমার এলাৰ্জি আছে।
আমাকে তো তাহলে না খেয়ে থাকতে হয় জোসেফাইনা! তুমি ছাড়া কে আমাকে কাজ দেবে? উপোস দিতে হবে। আমাকে।
একেবারে কিছুই না জুটলে এখানে এসে হামবার্গার খেয়ে যাবে, চার্জ লাগবে না। কিন্তু চাকরি তোমাকে দিচ্ছি না।
ফার্গোতে বিদেশীদের কাজ পাওয়া ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এ্যাড দেখে টেলিফোন করলেই জিজ্ঞেস করে।–গ্রীন কার্ড আছে? নেই শুনলেই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখে। যারা কিছুটা ভদ্র, তারা মিষ্টি সুরে বলে, এখানে ওপেনিং নেই। তুমি ঠিকানা রেখে যাও, আমরা ওপেনিং হলে খবর দেব।
ওপেনিং নেই তো, এ্যাড দিলে কেন?
কয়েকটি ওপেনিং ছিল, সেগুলি ফিল্ড আপ!
দি মেঘনা রেস্টুরেন্টের জন্যে যে-টাকা পয়সা উঠেছে (সর্ব মোট সাত শ এগার ডলার), সেখানে হাত পড়েছে। রেস্টুরেন্টের চিন্তা এখন আর তেমন নেই। কারণ রহমান তার ইণ্ডিয়া হাইস নিয়ে পিছিয়ে পড়েছে। তার ধারণা, এত ছোট শহরে বিদেশী রেস্তোর চলবে না। সে খোঁজ নিয়ে দেখেছে। এখানে যে কটি চীনা রেস্তোরা আছে, সেখানে শুক্র-শনি এই দু দিনই যা লোকজন হয়, অন্য দিন রেস্তোরা খা-খাঁ করে। তাছাড়া এই প্রচণ্ড শীতে কার এমন মাথাব্যথা যে, কাঁপতে কাঁপতে বাইরে খেতে আসবে?
এদিকে ইমিগ্রেশনের লোকজনও বেশ ঝামেলা করছে। তিন-চারটে চিঠি এসেছে, কোন দিন হুঁট করে হয়তো পুলিশ এসে হাজির হবে। ঠিকানা বদলাতে হল সেই কারণেই। নিক্স প্লেসের উল্টোদিকে ছোট একটা ঘর। শুধু শোয়ার ব্যবস্থা। খাওয়াদাওয়া নিক্স প্লেসে। বুড়ি তার কথা রেখেছে। খাওয়ার পর বিল দিতে গেলে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করে, কাজ পেয়েছ?
না।
নো চার্জ
বেশ, খাতায় লিখে রাখ, চাকরি পেলে সব একসঙ্গে দেব।
বাকির কারবার আমি করি না, ভাগো।
কাজ শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল।
ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের সেই চাকরি। গোটা দশেক বাঁদর, কয়েকটি কুকুর আর প্রায় শ দুয়েক গিনিপিগের দেখাশোনা। সময়মতো খাবারদাবার দেওয়া। খাঁচা পরিষ্কার করা। পশুগুলিকে পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত রাখা। কাজ অনেক, সেই তুলনায় বেতন অল্প। নব্বই ডলার প্রতি হপ্তায়। নব্বই ডলারই সই। মহা উৎসাহে কাজে লেগে গেল শফিক।
কাজটা যত খারাপ মনে হয়েছিল তত নয়। বাঁদরের খাঁচায় একটিকে পাওয়া গেল একেবারে শিশু। শফিককে দেখেই সে দাঁত বের করে ভেংচে দিল। শফিক অবাক!
আরে, তুই এইসব ফাজলামি কোত্থেকে শিখলি?
বানরের বাচ্চাটি কথা শুনে উৎসাহিত হয়েই বোধহয় থু করে এক দল থুথু ছিটিয়ে দিল শফিকের দিকে।
মহা মুসিবত হল তো শালাকে নিয়ে। মারব থাপ্পড়।
বাচ্চাটা গালি শুনে উৎসাহিত হয়ে খুব লাফালাফি শুরু করল। তার আনন্দের সীমা নেই।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে।
আনিস সবেমাত্র ফিরেছে ইউনিভার্সিটি থেকে। হাতমুখও ধোওয়া হয় নি, শফিক এসে হাজির। এক্ষুণি যেতে হবে তার সঙ্গে।
কী ব্যাপার আগে বল।
আগে বললে আপনি আর যাবেন না।
যাব। ঘরে তেমন কিছু নেই। এখন বল ব্যাপারটা কী?
জং বাহাদুরের শয়তানিটা দেখাব আপনাকে। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, শালা ওয়ান নাম্বার হারামী।
জং বাহাদুরটা কে?
ও, আপনাকে তো বলা হয় নি। বাচ্চা একটা বাঁদর। বাচ্চা হলে কী হবে, শয়তানের হাড্ডি। দেখবেন নিজের চোখে।
নিজের চোখে কিছু দেখা গেল না। জং বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েছে। শফিক খুব মনমরা হয়ে পড়ল। আনিস হাসিমুখে বলল, কালকে এসে দেখব।
সকাল-সকাল আসবেন। খাবার দেওয়ার সময় হলে কী করে দেখবেন। বিকালবেলা একটা কলা, একটা আপেল আর একটা ডিম সেদ্ধ দেওয়া হয়েছে। শালা কলা ডিমটা খেয়ে আপেলটা আমাকে সাধছে। দেখেন কাণ্ড!
তুমি না বললে শয়তানের হাড্ডি? আমার কাছে তো বেশ ভালোমানুষই মনে হচ্ছে।
আরে না-না, তার বজ্জাতির কথা তো কিছুই বললাম না।
আনিস হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার কি কোনো কাজ আছে শফিক? তোমার গাড়িতে আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে?
কোথায়?
আনিস খানিক ইতস্তত করে বলল, একটি মেয়ের সঙেগ আমার কিছু পরিচয় হয়েছে। অনেক দিন তার খোঁজ নেই। ভাবছিলাম একটু খোঁজ নেব।
শফিক বেশ অবাক হল। আনিস থেমে বলল, আমি দেশে ফিরে যাব শফিক। আমার ভালো লাগছে না। আমি ঐ মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।
সে কোথায় থাকে?
সাউথ ফার্গো।
চলুন যাই। ফুলের দোকান হয়ে যাবেন? ফুল নেবেন?
ফুল কেন?
শফিক হাসিমুখে বলল, আমেরিকান মেয়েকে বিয়ের কথা কি ফুল ছাড়া বলা যায়? একগাদা গোলাপ নিয়ে যান। ডাউনটাউনে ফুলের দোকান সারা রাত খোলা থাকে।
আনিস দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ফুল তো কিনতেই হবে।
মালিশাকে পাওয়া গেল না। বাড়িওয়ালী সরু গলায় বলল, ওর মা মারা গেছে। ও গেছে টাকা পয়সা কিছু দিয়ে গেছে কিনা দেখতে।
কবে গিয়েছে?
এক সপ্তাহ হল।
আনিস বলল, ও কি টাকা পয়সা কিছু পেয়েছে?
আমি কী করে জানব? এক শ ডলার রেন্ট বাকি রেখে গেছে সে। আমি চিন্তায় অস্থির, টাকাটা মার গেল কি না।
আমি কি এই গোলাপগুলি তার ঘরে রেখে যেতে পারি?
পারবে না কেন? রেখে যাও। তুমি কি ওর বন্ধু?
হ্যাঁ।
ভালো। আমার ধারণা ছিল, ওর কোনো বন্ধু নেই। আমার দু জন ভাড়াটে আছে, যাদের কোনো ছেলে বন্ধু নেই। এক জন হচ্ছে মালিশা, অন্য জন এমিলি জোহান।
এমিলি জোহান?
হ্যাঁ, কবি এমিলি জোহান, নাম শুনেছ? খুব বড়ো কবি। রাইটার্স গিল্ড এওয়র্ড পাওয়া।
আমি কি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি?
না, পার না। সে এখন মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে।
ফেরার পথে আনিস একটি কথাও বলল না।