১৩. মনোয়ারা গম্ভীর মুখে বললেন

মনোয়ারা গম্ভীর মুখে বললেন, বৌমা, আজ অফিসে যাবে না?

নীলু হাসিমুখে বলল, আজ টুনীর জন্মদিন, অফিসে যাব না। মনোয়ারী কিছু বললেন না। আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। নীলুর খুব

ইচ্ছা, টুনীর দ্বিতীয় জন্মদিনটি খুব ভালো মতো করে। প্রথমটি করা হয় নি।

শফিক কোনো রকম উৎসাহ দেখায় নি। বিরক্ত মুখে বলেছে, জন্মদিন আবার কী?

নীলু বলেছে, আমাদের জন্যে তো না, টুনীর জন্যে।

এক বছরের বাচ্চা, ও জন্মদিনের কি বোঝে? বাদ দাও।

এ বছর সে-রকম কিছু বলতে পারবে না। টুনীর বয়স এখন দুই। জন্মদিনটি সে কিছু কিছু বুঝতে পারবে। আর না পারলেও জানবে তাকে ঘিরে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। শফিক বলতে পারবে না, টাকা পয়সা নেই। এর জন্যে সে টাকা আলাদা করে রেখেছে। তেমন কোনো বড়ো উৎসব হবে না। একটা কেক কাটা হবে। কিছু ভালোমন্দ রান্না হবে! টুনীকে সঙ্গে নিয়ে সে এবং শফিক একটা ছবি তুলবে স্টুডিওতে। প্রতি বছর এ-রকম একটি করে, ছবি তোলা হবে। সেই ছবির এ্যালবামটি টুনীর বিয়ের সময় টুনীকে উপহাঁর দেওয়া হবে। প্রথম জন্মদিনের ছবিটি অবশ্যি তোলা হয় নি।

শফিক অফিসে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। নীলু এসে বলল, তুমি কি আজ একটু সকাল সকাল আসতে পারবো?

না।

একটু চেষ্টা করে দেখ না।

কেন?

টুনীর আজ জন্মদিন না? তুমি এলে তোমাকে নিয়ে স্টুডিওতে একটা ছবি তুলব।

শফিক জবাব দিল না। নীলু নরম স্বরে বলল, প্লীজ।

আচ্ছা দেখি।

দেখাদেখি না, আসতেই হবে। সন্ধ্যাবেলা কেক কাটা হবে। রাতে একটু খাওয়াদাওয়া হবে।

অনেককে বলেছি নাকি?

না, বন্যাকে বলেছি। ও তার হাসবেণ্ডকে নিয়ে আসবে। আনিসকে বলেছি। আনিস ম্যাজিক দেখাবে।

ও ম্যাজিক জানে নাকি?

শিখছে। জানে নিশ্চয়ই। তুমি যদি তোমার কোনো বন্ধবান্ধবকে বলতে চাও, বল।

কেউই নেই?

শফিক জবাব দিল না!

নীলুর ধারণা ছিল রফিককে বাজারে পাঠানো সমস্যা হবে। সে যেতে চাইবে না। ইদানীং সে অল্পতেই রেগে ওঠে। বাজারের কথা বললেই নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বাজার করাই শেষ পর্যন্ত আমার ক্যারিয়ার হবে। বাজার সরকারের কাজই পাব। অন্য কিছু পাব না!

আজ সে খুব আগ্রহের সঙ্গে রাজি হল। শার্ট পরতে পরতে বলল, সিরিয়াস একটা হৈচৈ হবে মনে হয়। বিরাট খাওয়াদাওয়া নাকি?

বিরাট কিছুনা। তোমার কোনো বন্ধুবান্ধবকে বললে বলতে পার।

বেকারের কোনো বন্ধুবান্ধব থাকে না। লিস্টি দাও। কী কী নিয়ে আসতে হবে বল। ঘর সাজানো হবে নাকি?

দও না সাজিয়ে। বেলুন-টেলুন দিয়ে সাজালে ভালোই লাগবে।

সাজিয়ে দিতে পারি, তবে এক শ টাকা ফিজ লাগবে।

দেব, ফিজ দেব।

সবচে আগ্রহ দেখা গেল শাহানার মধ্যে। তার উৎসাহের সীমা রইল না। সে কলেজে গেল না। নিজেই নিউমার্কেট থেকে রঙিন কাগজ কিনে আনল। হোসেন সাহেবও তার সঙ্গে জুটে গেলেন। শিশুদের উৎসাহ নিয়ে রঙিন কাগজের শিকল বানাতে বসলেন। মনোয়ারা বিরক্ত মুখে বললেন, তুমি বুড়ো মানুষ, রঙিন কাগজ দিয়ে মালা বানাতে বসছ?

বুড়ো মানুষেরা মালা বানাতে পারবে না। এ রকম কোনো আইন আছে নাादि?

বাজে তর্ক করবে না।

এত দিন পরে একটা উৎসব হচ্ছে বাড়িতে, আর তুমি ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করছি, এটা ঠিক না।

কি ঝগড়া বাধালাম?

এই তো বাধাচ্ছি। আমি এখন একটা কথা বলব, তুমি তার উত্তরে দশটা কথা বলবে। তারপর আমি আবার আরেকটা কথা বলব, তুমি তার উত্তরে বলবে বিশটা, তারপর

মনোয়ারা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মাথা ধরেছে এই অজুহাতে বিছানায় শুয়ে রইলেন। কোনো ব্যাপারেই কোনো রকম আগ্রহ দেখালেন না। নীলু যখন এসে বলল, পোলাওটা একটু বসিয়ে দিন না মা। তখন তিনি ভুরু কুচকে বললেন, কেন, তুমি কি পোলাও রান্না ভুলে গেছ নাকি? নীলুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

শফিকের জন্যে সে সেজেগুজে বিকাল থেকেই বসে ছিল। শফিক আসামাত্র ছবি তুলতে যাবে। টুনীও খুব আগ্রহ নিয়ে নতুন জামা পরে বসে আছে। সে বারবার বলছে, বারা কখন আসবে? বাৰ্বা হচ্ছে আরা। টুনী কিছু কিছু শব্দ তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে। আরা হল বাৰ্বা। পাচ্ছি হচ্ছে পাখি। সে আ বা পা উচ্চারণ করতে পারে না, তা নয়। ঠিকই পারে। তবু নতুন শব্দগুলি কেন বলে, কে জানে! শিশুদের মধ্যে অনেক দুর্বোধ্য ব্যাপার আছে।

সাড়ে ছটা বেজে গেল, শফিক এল না। শাহানা বলল, তুমি একাই টুনীকে নিয়ে ছবি তুলে আস ভাবী, ভাইয়া আসবে না।

বলেছিল তো আসবে।

আসার হলে এসে যেত। চল, আমরা তিন জনে একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাই। শ্যামলীতে একটা ভালো স্টুডিও আছে।

আরেকটু দেখি।

শুধু শফিক নয়, বন্যাও আসে নি। নীলুর মন খারাপ হয়ে গেল। এত চম ৎকার করে ঘর সাজানো হয়েছে, অথচ লোকজন কেউ নেই। কেউ আসুক না-আসুক, শফিক তো আসবে। হোসেন সাহেব বললেন, টুনী ঘুমিয়ে পড়বে বৌমা, কেকটা কাটাও। আনিস ম্যাজিক শুরু করুক, আমরা দেখি বসে বসে। উৎসবটা জমছে না মোটেই। নীলু মৃদুস্বরে বলল, আরেকটু অপেক্ষা করি, ও এসে পড়বে।

আনিস চূড়ান্ত রকমের নার্ভাস। আজই তাঁর জীবনের প্রথম ম্যাজিক শো। কে জুনে কী হবে। পাঁচটা আইটেম সে তৈরি করে রেখেছে। আইটেম হিসেবে পাঁচটাই চমৎকার। আজ সারা দিনে সে প্রতিটি আইটেমই প্ৰায় এক হাজার বার করে প্রাকটিস করেছে। তবু তার মনে হচ্ছে, আসল সময়ে একটা কিছু গণ্ডগোল হয়ে যাবে। সবচে বড়ো সমস্যা হচ্ছে তার কোনো কন-ফিডারেট নেই, যে দর্শকদের মধ্যে বসে থাকবে। প্রয়োজনের সময় বিশেষ সাহায্যটি করবে। এরকম এক জন কাউকে পাওয়া গেলে চমৎকার একটা ম্যাজিক দেখানো যেত। আনিস চিন্তিত মুখে বীণার সঙ্গে কথা বলতে গেল। বীণাকে বলে দেখা যেতে পারে। সে রাজি হবে কি হবে না কে জানে।

বীণা সঙ্গে সঙ্গেই রাজি। সে উৎসাহের সঙ্গে বলল, কী করতে হবে বলে দেন, নো প্রবলেম।

বিশেষ কিছুই না, টেবিলের উপর একটা রুমালে আঙটি লুকানো থাকবে। তুমি আঙটি আছে কিনা পরীক্ষা করতে গিয়ে আঙটিটি তুলে নিয়ে আসবে।

তুলে আনবার সময় কেউ দেখবে না?

না। সবার নজর থাকবে ম্যাজিসিয়ানের দিকে। সেই সময় একটা বক্তৃতা শুরু করব আমি। পারবে না?

পারব না কেন? নিশ্চয়ই পারব।

আনিস চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লতিফা বললেন, তোর ও বাড়িতে যাবার কোনো দরকার নেই।

দাওয়াত দিয়েছে, যাব না?

না।

এসব বলে তোমা লাভ নেই। আমি যাব।

লতিফা গম্ভীর হয়ে রইলেন। মেয়েকে আর কিছু বলতে সাহস করলেন না। কেন জানি তিনি বীণাকে কিছুটা ভয় পেতে শুরু করেছেন। বীণা দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। আনিসের সঙ্গে তার সম্পৰ্কটা কোন পর্যায়ে, এই নিয়ে তিনি খুব ভাবেন। তাঁর ধারণা বীণা আনিসকে মাঝেমধ্যে এটা-ওটা কিনে দেয়। এই ধারণাটা হয়েছে গত পরশু। বীণা একা এক নিউ মার্কেটে গিয়েছিল। নিউ মার্কেট থেকে ফিরেই সে বেড়াতে গেল ছাদে। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি দেখলেন, আনিস লাল রঙের একটি নতুন চেক শার্ট গায়ে দিয়ে হাসিমুখে নোমছে। এর মানেটা কী? সারাটা দিন লতিফার খুব খারাপ কাটল। সন্ধ্যার পর বীণাকে খুব সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আনিসের গায়ে একটা নুতন শার্ট দেখলাম। বীণা হাই তুলে বলল, আমিও দেখলাম। খুব মানিয়েছে।

লাল রঙ ব্যাটাছেলেদের মানাবে কি?

লাল হচ্ছে এমন একটা রঙ, যা সবাইকেই মানায়।

নিউ মার্কেট থেকে তুই কী কী কিনলি?

তেমন কিছু না। দু দিস্তা কাগজ। একটা বল পয়েন্ট পেন।

এসব কেনার জন্যে নিউমার্কেটে যেতে হল? সুরমা ষ্টোরেই তো পাওয়া যায়।

তা যায়। তবু গেলাম।

লতিফা খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, নিউ মার্কেট থেকে ফিরেই ছাদে গেলি কেন?

এমনি গেলাম। ছাদে যাওয়া নিষেধ নাকি? লতিফা এক বার ভাবলেন সরাসরি জিজ্ঞেস করেন শার্টটা বীণা কিনে দিয়েছে কিনা। সাহস হল না। ঘরে একটা বড়ো মেয়ে থাকার কত যে সমস্যা। চোখের আড়াল হলেই বুক ধড়ফড় করে। বীণা গিয়েছে শাহানাদের ওখানে। ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার, তবু ভালো লাগছে না। আনিসটাকে ঘাড় ধরে বিদেয় করে দিতে পারলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যেত। লতিফা দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেললেন।

টুনী বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল। রফিক বলল, ভাবী, আমি টেলিফোন করে দেখি ভাইয়া অফিসে আছে কিনা। টেলিফোনের কথাটা নীলুর মনে আসে নি। আগেই টেলিফোন করা যেত। কোত্থেকে করবে? রশীদ সাহেবের বাসা থেকে?

না, গ্রিন ফর্মেসি থেকে, চেনা লোক আছে। ভাইয়ার টঙ্গি অফিসের নাম্বার তোমার কাছে আছে?

না।

ঠিক আছে, আমি বের করে নেব!

টুনীকে শুইয়ে দিতে গিয়ে নীলুর চোখে পানি এসে গেল। মানুষ এমন হয়, আশ্চর্য! নীলুর ইচ্ছা করতে লাগল বাতিটাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকে টুনীর পাশে! কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাকে হাসিমুখে সবার সামনে ঘুরে বেড়াতে হবে, আনিসের ম্যাজিক দেখতে হবে।

ভাবী।

কী শাহানা?

তাড়াতাড়ি এস, কে এক জন মেয়ে এসেছে আমাদের বাসায়। পরীর মতো সুন্দর। না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না। উপহারের প্যাকেট আছে হাउठ।

বন্যা নাকি?

আরে না। ওনাকে বুঝি আমি চিনি না? তুমি তাড়াতাড়ি আসে।

নীলুও তাকে চিনতে পারল না। মেয়েটি বিব্রত মুখে বলল, আমার নাম শারমিন। রফিকের সঙ্গে পড়ি। ও আমাকে দাওয়াত দিয়েছে ভাতিজির নাকি জন্মদিন।

হ্যাঁ। তুমি বস।

আপনি ওর ভাবী?

হ্যাঁ।

আমি সবাইকে চিনি। ও হচ্ছে শাহানা, তাই না?

হ্যাঁ।

আমাদের জন্মদিনের মানুষটি কোথায়?

টুনী ঘুমিয়ে পড়েছে।

ওর উপহারটা হাতের কাছে রেখে আসি।

নীলু ভেবে পেল না, এই মেয়েটির কথাই কি রফিক মাঝেমধ্যে তাকে বলে? এমন চমৎকার একটি মেয়ে! শারমিন হোসেন সাহেব ও মনোয়ারা দু জনকেই বিনীতভাবে সালাম করল। হোসেন সাহেব তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে নিতান্ত পরিচিত জনের মতো গল্প শুরু করে দিলেন। এমনকি মনোয়ারা পর্যন্ত মিশুক স্বরে গল্পে যোগ দিলেন।

বাসা কোথায় তোমার?

পুরানো ঢাকায়।

এত দুর একা একা এসেছ?

গাড়ি নিয়ে এসেছি। আর রাত বেশি হয় নি। সাতটা মাত্র বাজে।

শাহানা শারমিনকে নিয়ে ছাদ দেখাতে গেল। সে তাড়াতাড়ি কারো সঙ্গে সহজ হতে পারে না। সেও চট করে সহজ হয়ে গেল। শাহানার খুব ইচ্ছা করতে লাগল। এই চমৎকার মেয়েটিকে ম্যাজিশিয়ান আনিসের কথা বলে। কাউকে তার কথা বলতে ইচ্ছা করে।

এখানে কেউ থাকে নাকি শাহানা?

আনিস ভাই থাকেন।

আনিস ভাই কে?

এক জন ম্যাজিশিয়ান। যা সুন্দর ম্যাজিক দেখান!

তুমি দেখেছ?

না।

তাহলে বুঝলে কী করে, সুন্দর?

শাহানা চুপ করে গেল। শারমিন হাসিমুখে বলল, আমি ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এক বার গিয়েছিলাম ইংল্যাণ্ড, সেখানে মিঃ স্মিথের ম্যাজিক দেখেছি। অপূৰ্ব।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ভদ্রলোক একটা ইউনিভার্সিটির অঙ্কের প্রফেসর। অথচ প্রফেশন্যাল ম্যাজিশিয়ানদের হার মানাতে পারেন।

শারমিন জন্মদিনের উৎসবে এসেছে, এটা শুনে রফিকের বিস্ময়ের সীমা রইল না। টেলিফোনে জন্মদিনের দাওয়াত অবশ্যি সে দিয়েছে। সেটাও তেমন কোনো জোরালো দাওয়াত নয়। শারমিনও আসবে এমন কোনো ইঙ্গিত দেয় নি। ঠিকানা অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল।

নীলু বলল, শাহানা ওকে ছাদে নিয়ে গেছে।

শীতের মধ্যে ছাদে কেন?

নীলু হেসে ফেলল, মমতা খুব বেশি মনে হচ্ছে।

তুমি যা ভাবছ তা না ভাবী, শারমিনের শিগগিরই বিয়ে হচ্ছে। আগস্টে হবার কথা ছিল, পিছিয়ে গেছে।

আমি অবশ্যি মনে মনে আশা করছিলাম, এ মেয়ে এই বাড়িতেই আসবে।

পাগল হয়েছ! এরা যে কী সিরিয়াস বড়োলোক এটা তুমি ধারণাও করতে পারবে না।

সিরিয়াস বড়োলোকদের মেয়েরা বুঝি বিয়ে করে না?

করে, তবে আমার মতো কাউকে করে না।

শফিক আধা ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে বলেছিল। এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল, তার দেখা নেই। হোসেন সাহেব বললেন, আনিসের ম্যাজিকটা শুরু হয়ে যাক, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি বরং টুনীকে ঘুম থেকে তোল।

টুনীর ঘুম ভাঙানো গেল না। আজ দুপুরে ঘুমায় নি। সহজে সে আর জাগবে না। ও ঘুমাক, আসুন, আমরা ম্যাজিক দেখি।

আনিস এই শীতেও রীতিমতো ঘামছে। হাত-পা কাঁপছে, কী অবস্থা হবে কে জানে! প্রতিটি আইটেমই অনেক বার করে করা। চোখ বন্ধ করেও এসব করা যাবে, কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছে এক্ষুণি একটা হাসির কাণ্ড হবে। শাহানা বলল, শুরু করুন আনিস তাই।

বীণা বসে আছে শাহানার পাশে। বীণার মুখ অস্বাভাবিক গভীর। কারো সঙ্গেই সে কোনো কথাবার্তা বলছে না। যে কোনো কারণেই হোক সে অস্বস্তি বোধ করছে। আনিস প্রায় এক শ ভাগ নিশ্চিত, সে আঙটি সরিয়ে দিতে পারবে না। আনিস ঘরের কোণের দিকে সরে গেল। তার হাতে কিছু নেই।

আমি তাহলে শুরু করছি। দেখুন আমার হাত। হাতে কিছু নেই।

হোসেন সাহেব চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছেন। ম্যাজিকের ব্যাপারে তিনি দারুণ উৎসাহ বোধ করছেন। আনিস তার খালি হাত দেখিয়ে মুহুর্তেই দুটি টকটকে লাল রুমাল তৈরি করল। হোসেন সাহেব মুগ্ধ হয়ে গেলেন।

শাহানা বলল, দেখি, রুমাল দুটি আমার হাতে দিন তো আনিস ভাই। পরীক্ষা করে দেখি।

ম্যাজিকের রুমাল তো দেওয়া যাবে না।

বলতে বলতেই আনিস রুমাল দুটি নিশানের মতো কিছুক্ষণ বাতাসে ওড়াল। সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হল একটি টকটকে লাল গোলাপ। আনিস গোলাপটি এগিয়ে দিল শাহানার দিকে। শাহানা কেন জানি খুব লজ্জা পেল। হোসেন সাহেব মুগ্ধকণ্ঠে বললেন, অদ্ভুত ম্যাজিক! এত সুন্দর ম্যাজিক আমার জীবনে আমি দেখি নি। বীণা শুধু কঠিন দৃষ্টি নিয়ে বসে রইল। সে আশা করেছিল এই গোলাপটি সে পাবে।

আনিস আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে কাজেই তার তৃতীয় ম্যাজিক লিংকিং রিং হল চমৎকার। রফিক বলল, এ তো দেখি সিরিয়াস ম্যাজিশিয়ান।! ঠিক না শারমিন?

হ্যাঁ, আমার নিজেরই এখন ম্যাজিক শিখতে ইচ্ছা হচ্ছে।

শাহানা বলল, মিঃ স্মিথের ম্যাজিকের মতো লাগছে আপনার কাছে?

হ্যাঁ, সেরকমই লাগছে।

শেষ ম্যাজিকে গণ্ডগোল হয়ে গেল। আঙটি হাওয়া করে দেওয়ার ম্যাজিক আনিস শারমিনের আঙটি নিয়ে রুমালে ভরে রাখল টেবিলে। হাসিমুখে বলল, এখানে একটি আঙটি আছে, এ বিষয়ে কি কারো কোনো সন্দেহ আছে? সন্দেহ থাকলে হাত রুমালে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে যান। বীণার দায়িত্ব হচ্ছে পরীক্ষা করতে এসে আঙটি উঠিয়ে নেওয়া। সে উঠে দাঁড়াল এবং সরু গলায় বলল, আমার মাথা ধরেছে, আমি বাসায় যাব। শাহানা বলল, আরে, এখন যাবে কি! দেখে যাও কী হয়।

যা ইচ্ছা হোক, আমার ভালো লাগছে না।

আনিস বীণার এই হঠাৎ রাগের কোনো কারণ খুঁজে পেল না। সে বলল, বীণা এসে দেখে যাও, আঙটি আছে কিনা।

অন্যরা দেখুক।

বীণা গম্ভীর মুখে বের হয়ে গেল। শেষ ম্যাজিকটি আনিসের দেখানো হল না। হোসেন সাহেব অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আনিস, আঙটিটির কী হল দেখাও।

ম্যাজিকের মাঝখানে কেউ উঠে গেলে সে ম্যাজিক আর দেখানো যায় না।

তাই নাকি, জানতাম না তো!

এইটি অন্য কোনোদিন দেখাব।

শাহানা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার মন বলছে-বীণার মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে, সে সম্পর্কে তার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, তবে সে একেবারেই যে বুঝতে পারছে না, তাও নয়।

মনোয়ারা ম্যাজিক শেষ হওয়ামাত্র নীলুকে ডেকে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, শারমিন মেয়েটি কেন এসেছে। এ বাড়িতে?

রফিক দাওয়াত করেছে, তাই এসেছে।

দাওয়াত করবে। আর হুঁট করে চলে আসবে? তাও একা একা এসেছে। আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।

ঐসব কিছু নামা।

তুমি বুঝলে কী করে ঐসব কিছু না? বড়োলোকের মেয়ে, নাকে দড়ি দিয়েঘোরাচ্ছে।

নীলু কিছু বলল না।

রফিক চাকরি-বাকরি কিছু খুঁজছে না। ঐ মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করে সময় কাটাচ্ছে।

না মা, চাকরির চেষ্টা ও ঠিকই করছে।

বাজে কথা বলবে না। চেষ্টা করলে এই অবস্থা হয়? হয় না। আর, কিছু যে হচ্ছে না, সেই নিয়ে কোনো মাথা ব্যথাও নেই। দিব্যি মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াচ্ছে। আজ আমি তাকে কিছু কথা শোনাব।

থাক মা, আজ আর কিছু না বললেন।

কেন? তাকে কথা শোনাতে হলে আগে দিনক্ষণ ঠিক করতে হবে? পঞ্জিকা দেখতে হবে?

আস্তে কথা বলুন মা, ওরা শুনবে।

শুনলে শুনুক, আমি কাউকে ভয় পাই নাকি? ওর রোজগারে আমি খাই?

ওদের খাবার দিয়ে আসি মা। রাত হয়ে যাচ্ছে।

 

শফিক ফিরল এগারটায়।

নীলু না-খেয়ে অপেক্ষা করছিল। সে কিছুই বলল না। শফিক বলল, জন্মদিন কেমন হল?

ভালোই।

লোকজন এসেছিল?

এসেছে কেউ কেউ। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে আস, খাবার গরম করছি। নাকি খেয়ে এসেছ?

না, খাব কোথায়? অফিসে একটা ঝামেলা হল।

নীলু কোনো আগ্রহ দেখাল না।

স্যুরেনসেন মনে হয় চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। অবশ্যি গুজবও হতে পারে।

নীলু নিঃশব্দে ভাত বেড়ে দিতে লাগল। শফিকের কথাবার্তা তার শুনতে ইচ্ছা করছে না। সারা দিনে অনেক পরিশ্রম হয়েছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। শফিক ভাত মাখতে মাখতে বলল, হুঁইঙ্কি খেয়ে ব্যাটা খুব হৈচৈ করছিল। আজ, কেলেঙ্কারি অবস্থা।

শফিক অনেক রাত পর্যন্ত বসার ঘরে বসে বসে সিগারেট টানল। নীলু যখন বলল, ঘুমুবে না? তখন সে নিয়ম ভঙ্গ করে চা খেতে চাইল।

কৃষ্ট না হলে একটু চা কর তো নীলু কাজের ছেলেটা কোথায়? ওকে দেখছি না কেন?

মা বিদায় করে দিয়েছেন।

কবে করলেন?

গত সপ্তাহেই করেছেন। তোমার চোখে পড়ে নি বোধহয়।

শফিক আর কিছু বলল না। চা খেতে খেতে এলোমেলোভাবে কিছু কথাবার্তা হল। যেমন, রফিকের কিছু হয়েছে? চেষ্টা করছে না বোধহয় সে-রকম। চাকরির বাজার এতটা খারাপ নিশ্চয়ই না। প্রশ্ন করার জন্যেই করা। নীলু বলল, আমি ঘুমুতে যাচ্ছি।

শফিক কিছু বলল না।

নীলু শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবতে লাগল, তারা দু জনে কি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে? বোধহয় যাচ্ছে। কিন্তু কেন? দোষটা কার? শফিকের একার নিশ্চয়ই নয়। তারও নিশ্চয়ই কোনো ভূমিকা আছে। সংসারের পেছনে শফিককে একা খাটতে হচ্ছিল। এখন সে কিছু সাহায্য করছে। শফিকের সেটা পছন্দ নয়। শুধু শফিক নয়, তার শাশুড়িরাও।

প্রথম বেতনের টাকা থেকে এক হাজার টাকা সে মনোয়ারাকে দিতে গেছে, তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, ঐ টাকা তোমার কাছেই রাখ বৌমা। আগে যদি শফিকের টাকায় চলে থাকে, এখনো চলবে। শফিকও বলেছে একই কথা, তবে একটু ঘুরিয়ে, রেখে দাও, দরকার হলে নেব।

প্রথম দিকের সেই অবস্থা এখন নেই। মনোয়ারা এখন টাকা নেন। গত মাসে  বললেন, সামনের মাস থেকে আরো কিছু বেশি দিতে পার কিনা দেখ তো বৌমা।

নীলু তার নিজের মাকে প্রতি মাসেই দু শ টাকা করে দিচ্ছে। তিনি বারবার লিখছেন, কোনো দরকার নেই। যখন দরকার হবে আমি চাইব। তিনি চাইবেন না কোনোদিন। তাঁর ধারণা, মেয়ের টাকায় তাঁর কোনো অধিকার নেই। এটা একটা মিথ্যা ধারণা। ছেলের টাকায় মার অধিকার থাকলে মেয়ের টাকায়ও থাকবে। কেন থাকবে না?

নীলুর চাকরি কেউ পছন্দ করছে না, কিন্তু তার টাকায় বাড়তি কিছু সুখ কি আসছে না? সে টাকা জমাচ্ছে। মাস তিনেকের ভেতরই একটি টিভি কেনার মতো টাকা জমে যাবে। এটা কম কী-নিশ্চয়ই কম নয়।

মশারির ভেতর কয়েকটা মশা ঢুকে গেছে। গুনগুন করছে কানের কাছে। নীলুর উঠতে ইচ্ছা করছে না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, কিন্তু পুরোপুরি ঘুম আসছে না। বিয়ের আগে এরকম হত। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হত। তখন সময়টাও খুব খারাপ ছিল। বিয়ে দেবার জন্যে মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু বিয়ের কোনো প্রস্তাবই আসে না। বড়ো ভাবী। খুব কায়দা করে কাটা-কাটা কথা শোনান। তাঁর প্রতিটি কথার তিন চার রকম মানে হয়। একেক বার প্রচণ্ড রাগ হত। কিন্তু কার উপর রাগ করবে? মার উপর? যার কেউ নেই, তার উপর রাগ করা যায় না।

টুনী কাঁদতে শুরু করেছে। কোনো ভয়ের স্বপ্ন-টপু দেখেছে বোধহয়।

কী হয়েছে মা। ভয় লাগছে?

না।

বাথরুম?

না।

পানি খাবে?

না।

তাহলে কাঁদছ কেন?

বাথরুম করব।

নীলু টুনীকে কোলে নিয়ে নামল। টুনী বলল, বাথরুম করব না। দাদুর সঙ্গে ঘুমোব।

কাল ঘুমিও।

না, আজ।

নীলু রাত—দুপুরে হোসেন সাহেবের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল। প্রায় রাতেই এখন এ-রকম হচ্ছে। টুনী ঘুমুতে যাচ্ছে দাদুর সঙ্গে। এখন গল্প বলে বলে ঘুম পাড়াতে হবে। মনোয়ারা বিরক্ত হবেন। খিটিমিটি বাঁধবে দুজনের মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *