ভিটাবাড়িতে লিচুগাছ লাগানো নিষেধ।
যে ভিটাতে ফলবান লিচুবৃক্ষ থাকে সেই ভিটা জনশূন্য হয়— এই প্রবাদ আছে। তারপরেও শহরবাড়ির সামনে সিদ্দিকুর রহমান দুটি লিচু গাছ লাগিয়েছেন। দশ বছরেই গাছ দুটি বিশাল আকৃতি নিয়েছে। গত তিন বছর থেকে ফল দিচ্ছে। বৈশাখে গাছ দুটি লাল টকটকে হয়ে যায়। দূর থেকে মনে হয়। গাছে আগুন ধরে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান হুকুম দিয়েছেন, গাছের লিচু গাছেই থাকবে। কারোর লিচু খেতে ইচ্ছা হলে সে গাছ থেকে ছিড়ে নিয়ে খাবে।
গত বছর সিদ্দিকুর রহমান লিচুতলা বঁধিয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ হঠাৎ তিনি এখানে এসে বসেন। তাঁর বসার সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই বলেই লিচুতলা সবসময় ঝকঝকে রাখা হয়। বাঁধানো অংশে একটা শুকনো পাতাও পড়ে থাকে না।
মঞ্জু, লিচুতলায় বসে আছেন। তার সামনে জইতরী। দু’জন গভীর মনোযোগে সাপলুড়ু খেলছে। কইতরী বসে আছে মঞ্জুর গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে। সাপলুড়ু খেলা জটিল আকার ধারণ করেছে। দুটি গুটিই পাশাপাশি যাচ্ছে। জইতরী সাপের মুখে পড়ে পিছিয়ে পড়েছিল, কিছুক্ষণ আগে সিঁড়ি পেয়েছে।
বাজির খেলা হচ্ছে। বাজির পরিমাণ সামান্য না, এক টাকা। জাইতরীর কাছে টাকা নেই। সে বলেছে, সে যদি হারে তবে টাকাটা দেবে ঈদের পরে। ঈদে সে সালামি পায়। সালামির টাকা থেকে দেবে। মঞ্জু। এই শর্তে রাজি আছেন। কইতরী বোনের গুটি চালানো কঠিন চোখে লক্ষ করছে। জাইতরীর নাকি চোরামি করার স্বভাব আছে। চার উঠলে সে পাঁচ চেলে গুটিকে সিড়ির মুখে নিয়ে যায়। কইতরীর কঠিন চোখের সামনে জইতরী এই সুযোগ পাচ্ছে r।।
দুটি গুটিই এখন নিরানব্বই-এর ঘরে আটকে আছে। এক না উঠলে খেলা জেতা যাবে না। যার আগে উঠবে সে-ই জিতবে। মঞ্জু প্রতিবারই দোয়া-দরুদ পড়ে ফু দিয়ে দান দিচ্ছেন। লাভ হচ্ছে না।
খেলার এই পর্যায়ে মঞ্জু বললেন, আমি আর টেনশন নিতে পারছি না। একটা কাজ করলে কেমন হয়— এসো লটারি করি। একটা কাগজে তোমার নাম লেখা থাকবে। একটাতে থাকবে আমার নাম। কইতরী কাগজ টানবে। যার নাম উঠবে সে-ই জিতবে। জাইতরী, রাজি আছো?
জইতরী বলল, হুঁ।
যাও তাহলে কাগজ-কলম নিয়ে আসো। আমার লটারির ভাগ্য অবশ্যি খুবই ভালো। আমার জিতে যাওয়ার কথা। তার উপর আজ রবিবার।
রবিবারে কী হয়?
রবিবার হলো আমার জন্মবার। জন্মবারে মানুষের ভাগ্য থাকে সবচে ভালো। আমি যে জিতব এটা নিয়েও এখন বাজি রাখতে পারি।
লুড়ুর বাজিতে জইতরী জিতল। মঞ্জুর এমন মনখারাপ হলো যে জইতরীর মনখারাপ হয়ে গেল। এত বড় মানুষ কিন্তু কী ছেলেমানুষ! বাজিতে হেরে কাদো। কাদো মুখ হয়ে গেছে। জাইতরীর ইচ্ছা করছে, এক টাকার নোটটা ফেরত দিয়ে দেয়।
মঞ্জু বললেন, আরেক দান খেলবে? এইবার দুই টাকা বাজি। তুমি হারলে এখন দিবে এক টাকা, বাকি এক টাকা দিবে। ঈদের দিন।
ঈদ পর্যন্ত আপনি থাকবেন?
না থাকলেও ঈদের দিন টাকা নিতে আসব।
দ্বিতীয় দফায় খেলা শুরু করার আগেই বদু এসে খবর দিল, চাচাজি আপনারে ডাকে। জাইতরী এবং কইতরী দুই বোনের মুখ একসঙ্গে কালো হয়ে গেল। বাবার ভয়ে এরা সবসময় অস্থির হয়ে থাকে।
সিদ্দিকুর রহমান পুকুরঘাটে বসেছিলেন। তার পেছনে লোকমান ছাতা ধরে আছে। আকাশ মেঘলা। ছাতা ধরার প্রয়োজন নেই। এই সত্য লোকমানও জানে। তারপরেও সে ছাতা ধরে আছে। এমনভাবে ধরেছে যেন সত্যি সত্যি রোদ আটকাচ্ছে।
সিদ্দিকুর রহমান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, মঞ্জু, তুমি সোনালু গাছ চেনো?
মঞ্জু বললেন, জি না।
চল তোমাকে গাছ দেখায়ে আনি।
সোনালু গাছ দেখার চেয়ে জইতরী-কইতরীর সঙ্গে লুড়ু খেলতে পারলে মঞ্জুর ভালো লাগত। তার মতে গাছপালা আয়োজন করে দেখার কিছু না। মানুষটা এমন যে মুখের উপর না করা যায় না। মেজাজি মানুষ। ছেলেকে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছে। কারোর তাতে কিছু যাচ্ছে। আসছে এমনও মনে হচ্ছে না। সবাই এমন ভাব করছে যেন এটা কোনো বিষয়ই না। কারোর কাছে যখন বিষয় না। তখন মঞ্জুর কাছেও বিষয় না। সে এই কারণেই মহানন্দে লুড় খেলে বেড়াচ্ছে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, হলুদ রঙের লতানো ফুল হয়। চৈত্রমাসে ফুল ফোটে। তখন মনে হয় হলুদ চুলের কোনো মেয়ে চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার খুবই পছন্দের গাছ। তোমার কি কোনো পছন্দের গাছ আছে?
জি না। সব গাছ আমার কাছে একরকম মনে হয়। ডালপালা, পাতা।
বটগাছও আমার পছন্দ। তবে সব বট না— মহাবট।
মহাবট কোনটা?
বটগাছেরও নানান রকমফের আছে। মহাবট দেখার জিনিস। কালিগঞ্জে একটা মহাবট আছে। আমি যখন দেখতে গিয়েছিলাম তখন দেখেছি। একশ আঠারোটা ঝুড়ি
আপনি বসে বসে ঝুড়ি গুনেছেন?
বসে বসে গুনি নাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুনেছি। গাছভর্তি হরিয়াল পাখির আস্তানা। হরিয়াল পাখি চেনো?
জি না।
হরিয়াল পাখি বটের ফল ছাড়া কিছু খায় না। সব পাখি মাংসাশী, শুধু হরিয়াল নিরামিষ পাখি। এই পাখি ফল ছাড়া কিছু খায় না বলে এর মাংসও অতি স্বাদু। তুমি হরিয়ালের মাংস খেয়েছ?
জি না।
আচ্ছা তোমাকে হরিয়ালের মাংস খাবার ব্যবস্থা করব।
আপনার সোনালু গাছ আর কত দূরে?
এই তো এসে গেছি।
মঞ্জু প্রায় বলেই ফেলছিল, এতদূর এসে গাছ দেখে পোষায় না। কথা মুখে আটকে গেল। সোনালু গাছ দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি তিনটা গাছ। গাছের গা ঘেঁসে যাচ্ছে নদীর পানি।
নদীর নাম ভোমরা। শীতের সময় পানি থাকে না, বর্ষায় পানি হয়, সেই পানি থাকে। ভাদ্র পর্যন্ত।
মঞ্জু বৃক্ষপ্রেমিক কিংবা প্রকৃতি-প্রেমিক কোনোটাই না, তারপরেও মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল— বাহ!
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, জায়গাটা তোমার পছন্দ হয়েছে?
অবশ্যই। অবশ্যই পছন্দ হয়েছে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি বলেছিলাম তোমাকে সামান্য সম্মান করতে চাই, মনে আছে না?
জি মনে আছে।
এই জায়গাটা আমার। তিন বিঘার মতো জমি। জমিটা আমি তোমাকে লিখে দিতে চাই। যদি তোমার আপত্তি না থাকে।
মঞ্জু, হতভম্ব গলায় বললেন, কী বলেন এইসব!
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি এখন চলে যাব। তুমি একা কিছুক্ষণ থাকো। দেখ কেমন লাগে। দুপুর একটার সময় ভোমরা ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন যাবে। অতি সুন্দর দৃশ্য।
মঞ্জুর চোখ থেকে হতভম্ব ভাব এখনো দূর হয় নি। সিদ্দিকুর রহমান মানুষটাই বিচিত্র প্রকৃতির— এটা ঠিক আছে। যত বিচিত্ৰই হোক কোনো মানুষই নিতান্ত অপরিচিত একজনকে তিন বিঘা জমি দিয়ে দেয় না।
সিদ্দিকুর রহমান ডাকলেন, নিরঞ্জন আছ?
সোনালু গাছের আড়াল থেকে নিরঞ্জন বের হয়ে এলো। ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা খালি গায়ের একজন বয়স্ক মানুষ। মাথার চুল সবই পাকা। সে বের হয়েই হাতজোড় করে আছে।
নিরঞ্জন!
জে আজ্ঞে!
মঞ্জুকে জায়গা দেখাও। সীমানা কোন পর্যন্ত বুঝায়ে বলো।
জে আজ্ঞে।
রান্নাবান্না করেছ না?
নিরঞ্জন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, অতিথি রেখে গেলাম, যত্ন করে খাওয়াবে।
নিরঞ্জন আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। সে এখনো জোড় হাত করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি মাটির দিকে।
সিদ্দিকুর রহমান নদীর পাড ঘেঁসে হাঁটছেন। তিনি কোথায় যাবেন সেটা লোকমান ধরার চেষ্টা করছে। হয়তো তিনি নদী পার হবেন। নদী পার হবার সাঁকো অনেক দূরে। কোনো কোনো দিন উনার হাঁটতে ভালো লাগে। আজ কি সেরকম একটা দিন? তিনি দ্রুত হাঁটছেন। এত দ্রুত যে লোকমান তাল মিলিয়ে আসতে পারছে না। মাঝে মাঝেই পিছিয়ে পড়ছে।
লোকমান!
জি।
মঞ্জু, মানুষটা কেমন বলো দেখি।
ভালো।
কী কারণে ভালো?
লোকমান জবাব দিতে পারল না। চাচাজি মাঝে-মধ্যেই এমন সব প্রশ্ন করেন যার জবাব দেয়া যায় না। অথচ তিনি জবাব শোনার জন্যে অপেক্ষা করেন।
কেন ভালো বলতে পারলা না?
জে না।
মানুষটার মধ্যে মায়া বেশি। সে জইতরী-কইতরীকে কেমন মায়া করে, দেখো নাই?
জি দেখেছি।
পশুপাখির মধ্যে কি মায়া আছে লোকমান?
জি দেখেছি।
সামান্য ভুল বলেছ। পশুর মধ্যে মায়া আছে। পাখির মধ্যে নাই। পাখি মায়ার বশ হয় না। পশু হয়। ঠিক বলেছি?
জি।
এইখানে একটা কথা কিন্তু আছে লোকমান। মানুষ মায়া দিয়ে পশু বশ করার চেষ্টা করেছে। পাখি বিশের চেষ্টা কখনো করে নাই। কেন করে নাই জানো?
জে না।
পশুর কাছ থেকে মানুষ উপকার পায়। পাখির কাছ থেকে পায় না। পাখির কাছ থেকে উপকার পাওয়া গেলে মানুষ পাখি বশ করার চেষ্টা নিত। এখন বুঝেছ?
জি।
এখন বলো মঞ্জু নামের লোকটাকে আমি জমি দিতেছি কেন?
জানি না।
আমি মায়া দিয়ে লোকটাকে বশ করার চেষ্টা নিতেছি। আমার নিজের মধ্যে কিন্তু মায়া নাই। তারপরেও আমি মায়ার খেলা খেলি। কেন খেলি জানো?
জি না।
মায়ার খেলা বড় মজার খেলা এইজন্যে খেলি। আরেকটা মজার খেলা হলো ঘৃণার খেলা। এই খেলাটা আমি আমার ছেলের সঙ্গে খেলতেছি।
নদী পারাপারের সাঁকো এসে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান সাঁকোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। সাঁকো পার হবেন কি হবেন না। এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তার মাথার উপর চিল উড়াউড়ি করছে। তিনি এখন আগ্রহ নিয়ে চিলের উড়াউড়ি দেখছেন।
লোকমান!
জি।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পাখি বশ করার চেষ্টা নিব। ভালো হবে না?
জি ভালো হবে।
গাইড়ার ভিটায় রোজ একবেলা ধান ছিটায়ে দিবা। যেন পাখি এসে ধান খেতে পারে। প্রতিদিন একটা বিশেষ সময়ে আধমণ ধান।
জি আচ্ছা।
আজ কি বার?
বুধবার।
শুক্রবার থেকে শুরু করব।
জি আচ্ছা।
ধান ছিটায়ে দিয়ে চলে আসবা। কেউ থাকবা না।
গরু-ছাগল ধান খাইয়া ফেলবে।
কাঁটাতারের বেড়া থাকবে। গরু-ছাগল ঢুকবে না।
জি আচ্ছা।
চল গাইড়ার ভিটার দিকে যাই।
সিদ্দিকুর রহমান হাঁটতে শুরু করেছেন। লোকমান চিন্তিত বোধ করছে। গাইড়ার ভিটার মতো এত বড় এলাকায় কাটাতার দিয়ে বেড়া দেয়া অতি কঠিন কাজ। এক-দুই দিনের কাজ না। কাঁটাতার আনতে ময়মনসিংহ যেতে হবে। খুঁটি পুততে হবে। বিরাট ঝামেলা।
গাইড়ার ভিটায় এসে লোকমান ধাক্কার মতো খেল। অনেক লোকজন সেখানে খুঁটি পোতার কাজ করছে। কাটাতার লাগাচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমানকে দেখে হেড মিস্ত্রি রশিদ এগিয়ে এলো। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, শুক্রবারের মধ্যে কাজ শেষ হবে না?
রশিদ বলল, অবশ্যই।
লোকমানের মনটা খারাপ হয়েছে। বেশ খারাপ। এমন বিশাল কর্মকাণ্ড অথচ সে কিছুই জানে না।
মঞ্জু দুপুরে খুব আরাম করে খেয়েছেন। সবই নিরামিষ— বেগুন, ভাজি, শাক, আলু ভর্তা, ডাল। প্রতিটি খাবারই অতি সুস্বাদু। মঞ্জু বললেন, নিরঞ্জন ভাই, আপনি কি দ্ৰৌপদী বলে কারোর নাম শুনেছেন?
নিরঞ্জন না-সূচক মাথা নাড়ল।
মঞ্জু বললেন, দ্ৰৌপদী ছিল এই পৃথিবীর সেরা রাধুনি। আপনার রান্না খেয়ে বুঝেছি সে আপনার দাসী হবার যোগ্যও না। বুঝেছেন আমার কথা?
হুঁ।
আপনি আমার কথা কিছুই বুঝেন নাই। যাই হোক, না বুঝলে নাই। আপনার কাছে আমি রান্না শিখব। বুঝেছেন?
হুঁ।
প্রতিদিন আমি আসব। একটা করে আইটেম আমাকে শিখাবেন। পারবেন না?
হুঁ।
প্রথম শিখাবেন আলুভর্তা। এইটাই মনে হয় সবচে সোজা। সোজাটা দিয়েই শুরু হোক। ঠিক আছে?
হুঁ।
আপনার কাছে সব রান্না শিখে আমি একটা ভাতের হোটেল দিব। হোটেলের নাম দিব।— নিরঞ্জনের ভাতের হোটেল। ঠিক আছে?
হুঁ।
আপনি কি মাছ-মাংস রাঁধতে পারেন?
পারি।
কাল মাছ খাওয়াবেন। পারবেন না?
হুঁ।
কাল আমি দুজন অতিথি নিয়ে আসব। জাইতরী কইতরী। ঠিক আছে?
হুঁ।
সকালবেলা এই দুইজনকে নিয়ে চলে আসব, সন্ধ্যাবেলা যাব। নদীর পাড়ে বসে লুড়ু খেলিব। জাইতরী-কইতরী এই দুইজনকে চিনেন?
না।
সিদ্দিক সাহেবের দুই মেয়ে। এমন লক্ষ্মী মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। দেখব বলেও মনে হয় না। আর না দেখাই ভালো। ভালো জিনিস কম দেখতে হয়। ভালো জিনিস বেশি দেখলে ভালোর মান থাকে না।
নিরঞ্জন বলল, হুঁ।
মঞ্জু বললেন, আপনি হুঁ ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন?
নিরঞ্জন জবাব দিল না। মঞ্জু বলল, করেন কী আপনি? এইখানে একা থাকেন?
হুঁ।
বউ ছেলেমেয়ে নাই?
আছে।
তাহলে একা থাকেন কেন?
নিরঞ্জন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি পতিত হইছি, আমার জাইত গেছে। আমারে সমাজ থাইক্যা বাইর কইরা দিছে। এইজন্যে একলা থাকি। বড় সােব আমারে পালে।
পতিত হয়েছেন কেন?
বড় সাহেবের জন্যে একদিন গো-মাংস রান্না করছিলাম, এইজন্যে পতিত হইছি।
বলেন কী? শুধু রান্না করার জন্যে সমাজ থেকে বের করে দিয়েছে! খেয়ে দেখেন নি!
আমি নিরামিষ ছাড়া কিছু খাই না।
মঞ্জুর মন মায়ায় ভরে গেল। আহা বেচারা। তার জন্যে কিছু করা উচিত।
জইতরী। দুপুরে খায় নি। সে খুবই মন খারাপ করেছে। কারণ মঞ্জুমামা লুড়ু খেলা নিয়ে একটা অন্যায় করেছেন। ইচ্ছা করে বাজিতে হেরে জাইতরীকে জিতিয়ে দিয়েছেন। লটারির দুটা কাগজেই জইতরীর নাম লিখেছেন। সে কাগজ দেখে টের পেয়েছে। জাইতরী এভাবে বাজি জিততে চায় নি। জাইতরী ঠিক করেছে, সে আর কোনো দিনই মঞ্জুমামার সঙ্গে কথা বলবে না। বড় পীর সাহেবের কসম— কথা বন্ধ। জাইতরী জানে সবচে কঠিন কসম— বড় পীর সাহেবের কসম। এই কসম ভাঙা মানেই মৃত্যু। কিছুক্ষণ পরই জইতরীর মনে হলো, সে একটা ভুল করে ফেলেছে। বড় ভুল। মঞ্জুমামার সঙ্গে কথা না বলে সে থাকতে পারবে না। তাকে যা করতে হবে তা হলো কসম ভাঙানোর ব্যবস্থা। একেক কসম একেকভাবে ভাঙাতে হয়। শুধু আল্লাহর নামে যে কসম সেটা ভাঙতে কিছু করতে হয় না। আল্লাহপাক কসম ভাঙলে রাগ করেন না। নাপাক অবস্থায় আল্লাহর নাম নেয়া যায়। কিন্তু বড়পীর সাহেবের নাম নেয়া যায় না।
জইতরী মন খারাপ করে ঘুরছে। পীর সাহেবের নামের কসম ভাঙানোর উপায় বের করতে পারছে না। এইসব জিনিস সবচে ভালো জানেন মা। তাকে আজ কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। তার মাথা আজ অতিরিক্ত গরম। যখন তার মাথা অতিরিক্ত গরম থাকে তখন তিনি কাউকে চিনতে পারেন না। আজ জইতরী কয়েকবার তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে গিয়েছে। তিনি জইতরীকে চিনতে পারেন নি।
এই বিষয় নিয়ে সে নতুন বউকেও জিজ্ঞেস করতে পারে। পরীবানু নামের এই মেয়েটা নিশ্চয়ই কসম ভাঙার বিষয় জানে। সমস্যা একটাই, নতুন বউয়ের সঙ্গে তার এখনো কোনো কথা হয় নি। জাইতরী আগ বাড়িয়ে কারোর সঙ্গে কথা বলে না। পরীবানুও মনে হয় তার মতো। সেও আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরে বসে থাকে। ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করে। জাইতরী দেখেছে। হাঁটাহাঁটির সময় এই মেয়ে নিজের মনে কথা বলে। বিড়বিড় করে কথা। জইতরীর সঙ্গে এখানেও তার মিল আছে। জাইতরীও নিজের মনে কথা বলে।
পরীবানু খাটে পা বুলিয়ে বসে ছিল। তার ঘরের দরজা খোলা। খোলা দরজা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে পরীবানুর গায়ে। অন্ধকার ঘরে পরীবানুর গায়ে রোদ পড়ার কারণে ঝলমল করছে। বারান্দা থেকে এই দৃশ্য দেখে জইতরীর এতই ভালো লাগল যে সে ঘরে ঢুকে পড়ল। পরীবানু বলল, জাইতরী কিছু বলবে?
জইতরী বলল, না।
পরীবানু বলল, তোমার সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয় নাই। মন এত খারাপ থাকে, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তুমি মনে কিছু নিও না। আসো আমার পাশে বসে। দুইজনে কিছুক্ষণ গল্প করি।
জইতরী খাটে উঠে বসল। পরীবানু বলল, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। তুমি যখন শাড়ি পরা ধরবে তখন তোমাকে নিয়া আমি একটা গীত বাধব।
জইতরী বলল, তুমি গীত বাধতে জানো?
পরীবানু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জানি। গীত বাধতে জানি, গাইতেও জানি। সবেরে অবশ্যি মিথ্যা কইরা বলি আমি কিছু জানি না।
মিথ্যা বলো কেন?
নিজেকে আড়ার রাখার জন্যে মিথ্যা বলি। মেয়েছেলেদের নিজেদের আড়াল করার জন্যে অনেক কিছু করতে হয়। তুমি নিজেও করো। করো না?
জইতরী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। পরীবানুকে তার সামান্য পছন্দ হতে শুরু করেছে। জাইতরী বলল, আমি বড় পীর সাহেবের নামে কসম কাটছি! এখন কসম ভাঙব। আমার কী করা লাগবে তুমি জানো?
জানি।
জানলে বলে।
বড়পীর সাহেবের উপরে যিনি তাঁর নামে কসম ভাঙতে হবে। বড়পীর সাহেবের উপরে আছেন আমাদের নবী-এ করিম। তার নামে কসম ভাঙবা। কী নিয়া কসম কাটছিলা?
জইতরী কসমের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লক্ষ করল, কথা বলতে তার ভালো লাগছে। শুধু যে ভালো লাগছে তা না, যতই কথা বলছে পরীবানু মেয়েটাকে তার ততই ভালো লাগছে। পরীবানু বলল, তুমি কি মঞ্জু নামের মানুষটারে খুব ভালো পাও?
হুঁ। খুব বেশি ভালো পাও?
হুঁ।
তোমারে একটা উপদেশ দেই, মন দিয়া শোনো। নিকট আত্মীয়ের বাইরে কোনো পুরুষমানুষরে মেয়েদের বেশি ভালো পাওয়া উচিত না।
জইতরী বলল, উচিত না কেন?
মেয়েছেলের মন অন্যরকম। মেয়েছেলে সবসময় ভালো যারে পায় তারে নিয়া সংসার করতে চায়। তুমি যখন আরেকটু বড় হইবা তখন বুঝবা। এখন বুঝবা না। তুমি বড়পীর সাহেবের নামে কসম কাটছ, মঞ্জু নামের মানুষটার সাথে কথা বলবা না। কসম না ভাঙাই ভালো। কসম ভাঙাইবা না।
পরীবানু পা দোলাচ্ছে। তার আচার-আচরণ স্বাভাবিক। সে কথা বলার সময় জাইতরীর দিকে তাকাচ্ছেও না। কথা বলছে সহজ-স্বাভাবিক গলায়। অথচ এমনভাবে কথা বলছে যেন সে সবই জানে।
জইতরী।
হুঁ।
আমার কথায় তুমি কিছু মনে নিও না। আমার মন মিজাজ ভালো না। কখন কী বলি তার নাই ঠিক।
পরীবানু চোখ মুছল। সহজ-স্বাভাবিকভাবে যে মেয়ে কথা বলছিল মুহুর্তেই তার চোখে পানি। জাইতরী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পরীবানু চোখ মুছে হোসে ফেলে বলল—
ক্ষণেকে চোখে পানি ক্ষণেকে হাসি
সেই কন্যা হয় রাক্ষস রাশি।