১৩. ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট

ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট।

নুরুদ্দিনের পেটে সারাক্ষণ ভাতের খিদে লেগে থাকে। শরিফা রোজই বলে, আজরফ টেকাপয়সা লইয়া আসুক, দুই বেলা ভাত রানমু।

কোন দিন আইব?

কবে যে আসবে, তা শরিফাও ভাবে। কোনোই খোঁজ নেই। নুরুদ্দিন গয়নার নৌকায় রোজ দু বেলা খোঁজ করে। মাঝে মাঝে চলে যায় লালচাচীর বাড়ি।

দুপুরে কী রানছ চাচী? ভাত?

না রে, জাউ। খাবি জাউ? দেই এক বাটি?

নাহ্‌। নুরুদ্দিন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, রাইতে ভাত হইব নি চাচী?

দূর, ভাত আছে দেশটার মইধ্যে?

ভাত খাওয়নের ইচ্ছা হয় চাচী।

লালচাচী ঘোট নিশ্বাস ফেলে বলে, চাই চাউল ঘরে আছে। দিমু ফুটাইয়া?

আইচ্ছা দেও।

লালচাটী নুরুদ্দিনের কোলে বাচ্চা দিয়ে অল্প কিছু চাল বসায়। বাচ্চাটা অসম্ভব রুণ। ট্যা টা করে কাদে। কিছুতেই তার কান্না সামলান যায় না। লালচাচী শান্ত স্বরে বলে, ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট রে নূরা।

হ।

নতুন ধান উঠলে এই কষ্ট মনে থাকত না।

নুরুদ্দিন খেতে বসে হাসিমুখে বলে, অনুফা তিন বেলা ভাত খায়। ঠিক না চাচী?

হুঁ।

ফালাইয়াছড়াইয়া খায়। ঠিক না চাচী?

হুঁ। নিখল সাবের তো আর পয়সার অভাব নাই।

বিকালের দিকে নুরুদ্দিন তার মাছ মারার সাজসরঞ্জাম নিয়ে বের হয়। বাড়ির পেছনের মজা খালটাতে গোটা দশেক লার বড়শি পাতা আছে। বড়শি গুলির মাথায় জ্যান্ত লাটি মাছ। লাটি মাছের প্রাণ বড়ো শক্ত প্ৰাণ, এই অবস্থাতেও সে দশ-বার ঘন্টা বেঁচে থাকে। নুরুদ্দিনের কাজ হচ্ছে লাটি মাছগুলি মরে গেল কিনা, তাই দেখা। মরে গেলে সেগুলি বদলে দিতে হয়। মাছ কিন্তু ধরা পড়ে না। জংলা ভিটায় এই পরিশ্রম করলে রোজ দু-তিনটা মাছ ধরা পড়ত। নুরুদ্দিনের বড়ো ইচ্ছা করে জংলা ভিটায় যেতে–সাহসে কুলায় না। একটা ফর্সা হাতের ছবি চোখে ভাসে। হাতভর্তি গাঢ় লাল রঙের চুড়ি। এত লাল চুড়ি হয় নাকি!

আমিন ডাক্তারের স্কুলে যাওয়াও নুরুদ্দিন বন্ধ করে দিয়েছে। সারা সকাল বসে বসে স্বরে অ স্বরে আ করে চেঁচাতে খুব খারাপ লাগে। এর চেয়ে সরকারবাড়ির জলমহালের কাছে ঘোরাঘুরি করলে কত কি দেখা যায়। জলমহাল এই বৎসর মাছে ভর্তি। পরপর তিন বৎসর পাইল করা হয়েছে। সাধারণত পানি বেশি হলে মাছ কমে যায়, এই বৎসর হয়েছে উন্টো। নরহরি দাস বলেছে এত মাছ সে কোনো জলমহালে দেখে নি। নুরুদ্দিন সারা সকাল জলমহালের পাশে বসে থাকে। সরকাররা মাছ ধরার খুব বড়ড়া আয়োজন করছেন এই বৎসর। তাদের ঘোট জামাই আসবেন বলে শোনা যাচ্ছে। ছোট জামাই গান-বাজনায় খুব উৎসাহী। জামাই এলে নিশ্চয়ই কানা নিবারণকে আনা হবে। দু বছর আগে তিনি যাত্ৰাগান আনিয়েছিলেন, বৈকুণ্ঠের দল। পালার নাম মীনাকুমারী। তিন রাত যাত্ৰা হয়েছিল। সেই তিন রাত সোহাগীর কারো চোখে ঘুম ছিল না। ছোট জামাই আসার খবর হলে সোহাগীতে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করে। এই বার তেমন হচ্ছে না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে গানবাজনার কথা ভাবতে ভালো লাগে না।

আজরফ ফিরল আশ্বিন মাসে। শরিফার ধারণা আজরফ খালি হাতে আসে নি। বেশ কিছুটাকাপয়সা নিয়ে এসেছে। তার ধান বিক্রির টাকা আমিন ডাক্তারের কাছে। শরিফা চেয়েচিন্তে কিছু এনেছে। সেই টাকার প্রায় সবটাই রয়েছে, খরচ হয় নি। শরিফা ভেবেছিল, আজরফ আসামাত্র ধানটান কিনবে। খাওয়ার কষ্ট দূর হবে। আজরফ সেরকম কিছুই করছে না। অন্য সবার মতো ঘোরাঘুরি করছে জলমহালে। কাজ করবার জন্যে। এক দিন শরিফা বলেই ফেলল, টেকাপয়সা কিছু আনছস?

হুঁ।

কত টেহা?

আছে কিছু।

ধানটান কিছু কিনন দরকার। নুরা ভাত খাইত পারে না।

এই কয় দিন যখন গেছে, বাকি দিনও যাইব।

জমা টেহা তুই করবি কী?

জমি কিবাম। অভাবের লাগিন হস্তায় জমি বিক্রি হইতাছে।

আজরফ সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকে। তাকে ভরসা করে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করা যায় না। কখন কী করবে বাড়িতে কিছুই বলে না। আমিন ডাক্তার এক দিন এসে বলল, আজরফ নৌকাড়া তো খুব বালা কিনছে, দোস্তাইন।

শরিফা আকাশ থেকে পড়েছে। নৌকা কেনার কথা সে কিছুই জানে না।

আজরফ, তুই নি নাও কিনছ?

হ।

কই, কিছু তো কস নাই।

কওনের কী আছে?

সরকারবাড়িতে আজরফ রোজ দুবেলা করে যাচ্ছে, যেন জলমহালের কাজের উপর তার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে। সরকারদের অনেক লোক দরকার। মাছ মোহনগঞ্জ নিয়ে পৌঁছান, নীলগঞ্জ নিয়ে যাওয়া, মাছ কাটা, মাছ শুকান-কাজের কি অন্ত আছে? কিন্তু কাজ পাওয়টাই হচ্ছে সমস্যা। নিজাম সরকার সোহাগীর লোকদের কাজ না দিয়ে অন্য গ্রামের লোকদের কাজ দিচ্ছেন। এর পেছনে তাঁর একটি নিজস্ব যুক্তি আছে। অন্য গ্রামের লোকদের কাজের সময় একটা কড়া কথা বললে কিছু আসে-যায় না। কিন্তু নিজ গ্রামের লোকদের বেলা তা করা যাবে না। এদের সঙ্গে নিত্যদিন দেখা হবে। এরা যদি মনের মধ্যে কিছু পুষে রাখে সেটা খারাপ।

নিজাম সরকার অবশ্যি আজরফকে কাজ দিলেন। মাছের নৌকা নিয়ে নীলগঞ্জ যাওয়া।

রাইতে রওনা হইবা, সকালের ট্রেইনের আগে নিয়া পৌঁছাইবা। পারবা তো?

পারবাম।

তোমারে দেইখ্য অবশ্যি মনে হয় পারবা। তোমার বাপের বদ স্বভাব তোমার। মইধ্যে নাই। তোমার বাপ আছে কই ওখন?

ঢাকা জিলায়। নরসিংদি।

বুঝলা আজরফ, গরুর যে গু, তারও একটা গুণ আছে। তোমার বাপের হেইডাও নাই।

আজরফের সঙ্গে সঙ্গে আমিন ডাক্তারেরও চাকরি হয়। হিসাবপত্র রাখা। হিসাব রাখার জন্য মোহনগজ্ঞ থেকেও এক জনকে আনা হয়েছে। সেই লোক অতিরিক্ত চালাক। আমিন ডাক্তারকে চাকরি দেওয়ার সেটিও একটি কারণ। আমিন ডাক্তার এখন আর ডাক্তারী করে না। যদিও রুগী এখন প্রচুর। কিন্তু টাকাপয়সা কেউ দিতে পারে না। অষুধ পর্যন্ত বাকিতে কিনতে হয়। আমিন ডাক্তারের অষুধের বাক্সও খালি। অষুধ কিনে জমিয়ে রাখবে, সেই পয়সা কোথায়?

আমিন ডাক্তার এখনো খেতে যায় চৌধুরীবাড়ি। চৌধুরীবাড়ির খাওয়া আর আগের মত নেই। সকালবেলা রুটি হয়। রাতের বেলাতেই শুধু ভাত। বৌটি কুণ্ঠিত হয়ে থাকে, বড়ো শরম লাগে এই সব খাওয়াইতে।

না মা না, শরমের কিছু নাই।

এবার অবস্থা আর আগের মতো নাই। জমি বিক্রি করতাছে।

কও কি মা! খাস জমি?

লেচু বাগানটা বেচছে, কিছু খাস জমিও যাইব।

কিনে কে? সরকাররা?

জ্বি না। মতি মিয়ার ছেলে আজরফ, সেই রকম শুনছি।

বড়োই অবাক হয় আমিন ডাক্তার। সেই রাত্ৰেই মতি মিয়ার বাড়ি উপস্থিত হয়।

আজরফ জমি কিতাছস হুনলাম।

জ্বি চাচা।

কস কিরে বেটা।

সবটি টেকা একসাথে দিতাম পারতাম না। দুই বারে দিয়াম।

কত টেকা আছে তর, হেই আজরফ?

আজরফ যেন শরিফা শুনতে না পায় সে ভাবে নিচু স্বরে টাকার অঙ্কটা বলে। আমিন ডাক্তারের মুখ হাঁ হয়ে যায়।

 

দীর্ঘ দিন মতি মিয়ার কোনো খোঁজ নেই।

শরিফার কান্নাকাটিতে আমিন ডাক্তার নরসিংদির যাত্রাপার্টির অধিকারীকে একটি চিঠি দিয়েছে। দশ দিনের মধ্যে তার উত্তর এসে হাজির। কী সর্বনাশ! মতি মিয়া নাকি তিন শ টাকা চুরি করে পালিয়ে গেছে। আমিন ডাক্তার চিঠির কথা চেপে গেল। শরিফার সঙ্গে দেখা হলেই মুখ কালো করে বলে, চিডির উত্তর তো অখনো আইল না, বুঝলাম না বিষয়।

শম্ভুগঞ্জেও চিঠি লেখা হয়। সেখান থেকেও উত্তর আসে না। কাজকর্মে উজান দেশে যারা গিয়েছিল, সবাই ফিরে এসেছে। মতি মিয়ার কথা কেউ কিছু বলতে পারে না। শরিফা খুব চিন্তিত। আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। সংসারে কাজকর্মেও মন বসে না। তবু যন্ত্রের মতো সব কাজ করতে হয়। আজরফ ভর দিয়ে চলার জন্যে লাঠি বানিয়ে দিয়েছে। সেইটি বগলের নিচে দিয়ে সে ভালেই চলাফেরা করতে পারে। রহিমা মারা যাওয়ায় এখন সে কিছুটা নিঃসঙ্গ অনুভব করে। রাগারাগির জন্যেও হাতের কাছে এক জন কেউ দরকার। আজরফ এমন ছেলে, যাকে দশটা কথা বললে একটার উত্তর দেয়। তার বেশির ভাগ উত্তরই হাঁ- ই জাতীয়, আর নুরুদ্দিনের তো দেখাই পাওয়া যায় না। রাতের বেলাও সে মায়ের সঙ্গে ঘুমুতে আসে না। এক-একা বাংলা ঘরে শোয়। এইটুক ছেলের একা-একা শোয়ার দরকারটা কী? কিন্তু শরিফার কথা কে শুনবে?

নীলগঞ্জে শনিবারে হাট বসে। সেই হাটে মতি মিয়ার সঙ্গে নইম মাঝির হঠাৎ দেখা। নইম মাঝি বেশ কিছুক্ষণ চিনতেই পারে নি। হাত পা ফোলা-ফোলা। মাথার সেই কোঁকড়ান বাবড়ি চুল নেই। মুখভর্তি দাড়ি। খালি গায়ে একটা চায়ের স্টলের সামনে চুপচাপ বসে আছে।

কেডা, মতি ভাই না?

মতি মিয়া মুখ ঘুরিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বলল, নইম বালা আছ?

ও মতি ভাই, তুমি এইখানে করডা কী?

চা খাইলাম। বালা চা বানায়।

শইলা খারাপ নাকি মতি ভাই? তুমি না শম্ভুগঞ্জে আছিলা?

যাত্রার চাকরিডা নাই।

কর কী তুমি অখন?

করি না কিছু। গান বান্দি।

বাড়িত যাই না? লও আমার সাথে, নাও লইয়া আইছি।

না।

অখন যাইতা না তোত কোন সময় যাইবা?

অখন এটু অসুবিধা আছে।

কি অসুবিধা, বাড়িতে বেহেই চিন্তা করতাছে।

মতি মিয়া খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে থেমে থেমে বলল, একটা সাদি করছি নইম।

নইম মাঝির মুখে কথা সরে না। বলে কী মতি মিয়া!

কবে করলা?

মাস দুই হইল।

তাজ্জব করলা তুমি মতি ভাই।

মতি মিয়া ইতস্তত করে বলল, কেউরে হাইও না। তোমারে আল্লাহর দোহাই।

 

নইম মাঝি কাউকে বলল না, শুধু আজরফকে বলল।

পাঁচ কান করিম না আজরফ, নিজে গিয়া দেখ আগে। তর মারে হুনাইস না। মাইয়ামানুষ, বেহুদা চিন্নাইব।

আজরফের কোনো ভাবান্তর হয় না। যথানিয়মে কাজকর্ম করে। তারপর একদিন বাঁশ আর চাটাই দিয়ে রহিমার ঘর ঠিকঠাক করতে থাকে। শরিফার কাছে সমস্ত ব্যাপারটি খুব রহস্যময় মনে হয়। হঠাৎ কাজকর্ম ফেলে ঘর-দুয়ার ঠিক করার দরকারটা কী? নুরুদ্দিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ঘর ঠিকঠাক করে যে, বিষয় কী?

আমি কী জানি?

তুই গিয়া জিগা।

তুমি জিগাও গিয়া, আমার ঠেকা নাই।

শরিফার নিশ্চিত ধারণা হয়, আজরফ সম্ভবত বিয়ে করতে চায়। বিয়ে করতে চাওয়াটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু সব কিছুরই তো একটা সময়-অসময় আছে। চাইলেই তো আর বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায় না? দেশ জুড়ে আকাল। ঘরের মানুষটার কোন খোঁজ নেই। টাকাপয়সা অবশ্যি আছে। ভালোই আছে। ধানবেচা টাকা, উজান দেশ থেকে নিয়ে আসা টাকা। এদিকে সরকাররাও নিশ্চয়ই ভালো দিচ্ছে। গরুর মতো যে খাটে, তাকে দেবে না। কিন্তু টাকা থাকলেই বিয়ে করতে হবে? শরিফা বড়োই চিন্তিত বোধ করে। পরামর্শ করার লোক নেই। রহিমা থাকলে এই ঝামেলা হত না।

এক দিন নইম মাঝির বউ এসে বলল, আজরফরে দেহি চৌধুরীবাড়ির কোণায় কোণায় ঘুরে। এটু খিয়াল রাইখ্যো।

কথা সত্যি হলে খুবই ভয়ের কথা। চৌধুরীবাড়ির কোনো মেয়েকে মনে ধরলেও তা মুখ ফুটে বলা উচিত না। শরিফা কায়দা করে জানতে চায় ব্যাপারটা। আজরফকে ভাত বেড়ে দিয়ে হঠাৎ বলে বসে, চৌধুরীবাড়ির মাইয়ার লাখান মাইয়া পাইলে বৌ করতাম।

আজরফ নিরুত্তর।

হলদির লাখান শইলের রঙ।

আজরফকে দেখে মনে হয় না সে কিছু শুনছে।

চৌরীবাড়ির ছোড মাইয়ারে দেখছস নি আজরফ?

নাহ্।

শরিফার ঠিক বিশ্বাস হয় না। বড়ই অস্বস্তি বোধ হয় তার। তারপর এক দিন যখন আজরফ হঠাৎ ঘঘাষণা করে, আগামীকাল ভোরে সে নুরুদ্দিনকে নিয়ে নীলগঞ্জে যাবে তার বাবাকে আনতে, তখন সন্দেহ ঘনীভূত হয়। হঠাৎ বাপের খোঁজ বের করে আনবার জন্যে যাওয়া কেন? আর নুরুদ্দিনের জন্যেইবা নতুন গেঞ্জি কেনা হল কেন? নতুন গেঞ্জির দরকারটা কী ছিল?

 

মতি মিয়ার বৌটির নাম পরী।

মেয়েটির বয়স খুবই কম, এবং বড়োই রোগ। কথা বলে উজান দেশের মানুষদের মতো টেনে টেনে। নুরুদ্দিন খুব অবাক হল। সে ভাবতেও পারে নি, এ রকম আশ্চর্য একটি ব্যাপার তার জন্যে অপেক্ষা করছে। পরী নুরুদ্দিনের হাত ধরে তাকে পাশে বত্সল এবং টেনে টেনে বলল, ছোড মিয়ার গালে একটা লাল তিল, দেখছ নি কাণ্ড।

গালের লাল তিল যে একটি চোখে পড়ার জিনিস নুরুদ্দিন তা স্বপ্নেও ভাবে নি। তার লজ্জা করতে লাগল।

চা খাইবা ছোড মিয়া? চা বানাই? নতুন খেজুর গুড়ের চা।

নুরুদ্দিনের মতো বাচ্চা ছেলেকে চা খাওয়াবার জন্যে কেউ সাধাসাধি করে? তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে লজ্জিত মুখে চোখ ঘুরিয়ে ঘরবাড়ি দেখতে লাগল। দেখার মত কিছু নেই। ছোট্ট এক চিলতে ঘর, এক প্রান্তে দড়ির একটি খাটিয়ায় কাঁথা-বালিশ। ঘরের অন্য প্রান্তে একটি হারমোনিয়ামের উপর এক জোড়া ঘুঙুর। চা বানাতে বানাতে পরী বলল, নাচনিওয়ালী ছিলাম, বুঝছ নি ছোট মিয়া–হইলাম ঘরওয়ালী।

মতি মিয়া ধমক দিল, আহু, কী কও?

ক্যান, তোমার সরম লাগে?

পুরান কথার দরকার কী?

পরী খিলখিল করে হাসতে লাগল।

ফেরবার পথে মতি মিয়া গম্ভীর হয়ে রইল। তাকে বড়োই চিন্তিত মনে হল। কিন্তু পরীর ভাবভঙ্গি খুব স্বাভাবিক। নৌকার অন্য প্রান্তে নুরুদ্দিনের সঙ্গে সে ক্ৰমাগত কথা বলে যাচ্ছে, ঐটা কোন গ্রাম? ঘাসপোতা? ঘাসপোতা আবার কেমুন নাম?

ভাটি অঞ্চলে পানি কোন সময় হয়?  তোমরার জংলা-বাড়ির ভিটাতে তুমি নাকি একটা পেততুনী দেখছিলা? হাতে লাল চুড়ি? কথাডা সত্য?

চৌধুরীবাড়ির একটা পুলার নাকি মাথা খারাপ?

কে ধনী বেশি? চৌধুরীরা না সরকাররা?

মতি মিয়া তেমন কোনো কথাবার্তা বলল না। বড় গাঙ থেকে ছোট গাঙে নৌকা ঢেকবার সময় শুধু বলল, জমির কাজ-কাম শুরু করণ দরকার।

আজরফ বলল, আপনে আর যাইতেন না শম্ভুগঞ্জ?

দূর, গান-বাজনা ছাড়ান দিছি। পোষায় না।

আজরফ কিছু বলল না। মতি মিয়া নিজের মনেই বলল, ঘর-সংসার দেখুন দরকার। গান-বাজনায় কি পেট ভরে? ভাত কাপড় আগে, বুঝছ?

নৌকা সোহাগীর কাছাকাছি আসতেই মতি মিয়া উসস করতে লাগল।

আমরা যে আসছি, তরমায় জানে?

নাহ্‌।

কিছুই কস নাই?

নাহ্‌।

মাবুদে এলাহী, বড়ো চিন্তার কথা আজরফ। কামডা ঠিক হইল না। আমি ভাবছি, তর মা বোধহয় নেওনের লাগি পাঠাইছে।

মতি মিয়া গভীর হয়ে তামাক টানতে লাগল। নৌকা ঘাটে আসামাত্র। আজরফকে বলল, আমিন ডাক্তারের সাথে একটা জরুরী কথা আছিল। কথাডা সাইরা আইতাছি, তরা বাড়িত যা।

আজরফের কিছু বলার আগেই মতি মিয়া সরকারবাড়ির আমবাগানে অদৃশ্য হয়ে গেল।

শরিফার স্তম্ভিত ভাব কেটে যেতেই সে চেঁচাতে শুরু করল। সন্ধ্যাবেলাটা কাজকর্মের সময়, তবু তার চিৎকারে ভিড় জমে গেল। এমন ব্যাপার সোহাগীতে বহু দিন হয় নি। মতি মিয়া কোত্থেকে এক মেয়ে নিয়ে হাজির হয়েছে। সেই মাগীর লজ্জা-শরম কিছু নেই, ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে।

কিন্তু যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, সে নির্বিকার। যেন কিছুই হয় নি। শরিফার চিৎকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে ভরসন্ধ্যায় ঘাটে গা ধুতে গেল। হারিকেন হাতে তার পিছু পিছু গেল নুরুদ্দিন। গাঙের পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বলল, আমারে না। দেখলে চিল্লানিটা কিছু কমব, কী কও নুরুদ্দিন?

চিৎকার অবশ্যি কমল না। পরী ফিরে এসে দেখে শরিফা নিজের মাথার চুল ছিড়ছে। নইম মাঝির বউ তাকে সামলাবার চেষ্টা করছে।

পরী বলল, এখন চিল্লাইয়া তো কোনো লাভ নাই। চিল্লাইলে কী হইব কন আপনে? আমি এইখানেই থাকবাম। আমার যাওনের জায়গা নাই।

শরিফা পরপর দু দিন না খেয়ে থাকল। খুনখুন করে কাঁদল পাঁচ দিন, তারপর জ্বরে পড়ে গেল। এই সময় পরী সম্পর্কে তার ধারণা হল, মেয়েটি খারাপ নয়। মতি মিয়ার মতো একটি অপদার্থের হাতে কেন পড়ল, কে জানে।

নুরুদ্দিনকে এখন আর লালচাচীর কাছে ভাত খেতে যেতে হয় না। পরী শুধুমাত্র নরুদ্দিনের জন্যেই ভাতের ব্যবস্থা করেছে। অবশ্যি লালচাচী কিছুদিন হল বাচ্চা রেখে চলে গিয়েছে বাপের বাড়ি। সিরাজ মিয়া আরেকটি বিয়ে করেছে। এই বৌটি বোকাসোকা। বড়ো আদর করে লালচাচীর ছেলেকে। ছেলেটি তবুও রাত-দিন ট্যাট্যা করে। এই বৌনুরুদ্দিনকে খুব আদর করে। নুরুদ্দিনকে দেখলেই বলে, লাড়ু খাইবা? তিলের লাড়ু আছে।

নুরুদ্দিন না বললেও সে এনে দেবে। কাজকর্মে সে লালচাচীর চেয়েও আনাড়ি। এই বৌটিকেও নুরুদ্দিনের খুব ভালো লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *