১৩. ভাগ্যচক্র

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ভাগ্যচক্র

সপ্তগ্রামের দুর্গমধ্যে তোরণের পশ্চাতে আমীর-উল-বহর আসদ্‌ খাঁ বিষন্ন বদনে দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহার পশ্চাতে রাদন্‌ দাজখাঁ, আলীনকী খাঁ প্রমুখ মুসলমান সেনানায়ক ও শেঠ গোকুলবিহারী, তাহার পুত্র গোষ্ঠবিহারী, চিন্তামণি মজুমদার, হরিনারায়ণ শীল প্রভৃতি সপ্তগ্রামের প্রধানগণ দাঁড়াইয়া আছেন। সকলের মুখই বিষন্ন, আহত সেনাগণ আসদ্‌ খাঁর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, আসদ্‌ খাঁ তখনও ময়ূখের সন্ধান করিতেছেন। গোকুলবিহারী বলিলেন, “হুজুর, সপ্তগ্রামের লোকে যখন শুনিল যে ফিরিঙ্গির ভয়ে ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁ পলাইয়াছেন, তখন লোকে সমস্ত আশা ভরসা বিসর্জ্জন দিয়া মরণের জন্য প্রস্তুত হইল। ফৌজদারী সেনা পলায়নের উদ্যোগ করিতেছিল, তখন সেই সিংহবিক্রম যুবা সাহস দিয়া ভরসা দিয়া সপ্তগ্রাম রক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছিল; সেই ডাকুন্‌হার তোপ দখল করিয়াছিল, তাহার ভয়ে কুটিন্‌হোর বহর কিল্লার সম্মুখে আসিতে পারে নাই; সেই জন্য ত্রিবেণী রক্ষা হইয়াছিল; তাহারই উপদেশে আমি ডিসুজাকে আক্রমণ করিতে গিয়াছিলাম। কে জানিত যে আর তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে না!” আসদ্‌ খাঁ কহিলেন, “হরিনারায়ণ, সেই যুবা কে জান?”

হরি। না হুজুর।

আসদ্‌। সে দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র।

চিন্তামণি। কে? ভীমেশ্বরের মহারাজ দেবেন্দ্রনারায়ণ?

আসদ্‌। হাঁ, যাঁহার বীরত্ব দেখিয়া একদিন শাহজাদা খুর্রমও বিস্মিত হইয়াছিলেন।

এই সময়ে একজন হরকরা আসিয়া কহিল, “বন্দানওয়াজ, হকিম্‌ আবুতোরাব খাঁ জনাবের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন।” আসদ্‌ খাঁ কহিলেন, “লইয়া আইস।” ক্ষণকাল পরে হরকরার সহিত সেই বৃদ্ধ হকিম আসিয়া আসদ্‌ খাঁকে অভিবাদন করিলেন। আসদ্‌ খাঁ কহিলেন, “হকিম সাহেব, আজি সপ্তগ্রামে হকিমের বড়ই প্রয়োজন।”

“জনাব, বন্দা বাদশাহের কার্য্যের জন্য সর্ব্বদাই প্রস্তুত। শুনিলাম যে এক কাফের যুবা ফিরিঙ্গির সহিত লড়াই করিয়া সপ্তগ্রাম রক্ষা করিয়াছিল, আপনি নাকি তাঁহার সন্ধান করিতেছেন?”

“হাঁ হকিম, সে যুবা কাফের হইলেও বীর এবং সে আমার বন্ধুপুত্র। আপনি কি তাহার সন্ধান পাইয়াছেন?” “কল্য সন্ধ্যাকালে শাহ্‌নওয়াজখাঁর বজ্‌রায় এক গৌরবর্ণ যুবকের চিকিৎসা করিতে গিয়াছিলাম, তাহার পোষাক দেখিয়া তাহাকে কাফের বলিয়াই বোধ হইল।” “তাহার আকার কিরূপ?” “গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকার, বলিষ্ঠদেহ।” “তাহার নাসিকায় কি অস্ত্রক্ষতের চিহ্ন আছে?” “আছে।” “সেইই, চিন্তামণি, নবাব শাহ্‌নওয়াজ খাঁ কোথায়?”

রাদন্দাজ খাঁ কহিলেন, “কল্য সন্ধ্যাকালে পিতা বজ্‌রায় সপ্তগ্রাম ত্যাগ করিয়াছেন, তাহার পর আর তাঁহাদিগের সন্ধান পাওয়া যায় নাই।” চিন্তামণি মজুমদার কহিলেন, “বন্দরের দারোগা সংবাদ দিয়াছে যে কল্য সমস্ত রাত্রি কোন নৌকা বা বজ্‌রা হুগলী হইতে সপ্তগ্রামের দিকে আসে নাই।”

আসদ্‌। হরিনারায়ণ, তুমি নাওয়ারার একখানি কোশা লইয়া দক্ষিণদিকে যাও, দেখ সপ্তগ্রাম অবধি শাহ্‌নওয়াজখাঁর বজরা দেখিতে পাওয়া যায় কিনা? রাদন্দাজ খাঁ, আপনি ত্রিবেণীর বন্দরে গিয়া নাওয়ারার যে কয়খানি ছিপ্‌ ও কোশা আছে তাহা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করিয়া রাখুন, আবশ্যক হইলে অদ্যই হুগ্‌লী আক্রমণ করিতে হইবে।

রাদন্দাজ। আমার পিতার সহিত আমার স্ত্রী আছেন, তাঁহাকে রক্ষা করিতে হইলে এখনই হুগ্‌লী আক্রমণ করা আবশ্যক।

আসদ্‌। এক প্রহরের মধ্যে হুগ্‌লী আক্রমণ করিব। গোকুলবিহারী, তোমার সেনা প্রস্তুত আছে?

গোকুল। হুজুর, আমার সেনা সারারাত্রি সপ্তগ্রাম পাহারা দিয়াছে, তাহারা কেহ গৃহে ফিরিয়া যায় নাই। ফৌজদারী আহদী সেনা প্রস্তুত হইতে বিলম্ব হইবে।

আসদ্‌। আলীনকী খাঁ, আপনার সেনা কি প্রস্তুত নাই?

আলী। না, তবে একপ্রহরের মধ্যে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইতে পারে।

আসদ্‌। আমাদের সমস্তই আছে, কেবল তোপ নাই। নাওয়ারা যদি জহাঙ্গীরনগরে না পাঠাইয়া দিতাম তাহা হইলে হয়ত সপ্তাহ মধ্যে হুগলী দুর্গ অধিকার করিতে পারিতাম; কিন্তু কেল্লা দখল উপযোগী একটি তোপও নাই।

গোকুল। একটা সুবিধা আছে, ফিরিঙ্গির জাহাজ সমস্ত হিজলীতে আটক থাকিবে, কারণ এ বৎসর গঙ্গার জল বাড়ে নাই।

এই সময়ে হরকরা আসিয়া সংবাদ দিল যে জহাঙ্গীর নগর হইতে দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় আসিয়াছেন, তিনি এখনই সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। আসদ্‌ খাঁ বিস্মিত হইয়া কছিলেন, “খালসার দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় জহাঙ্গীর নগর ছাড়িয়া সপ্তগ্রামে আসিল কেন? রাদন্দাজ খাঁ, দেওয়ান হরেকৃষ্ণ সেহ্‌হাজারী মনসব্‌দার; তুমি কলিমুল্লাখাঁর তরফ্‌ হইতে তাঁহাকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা করিয়া লইয়া আইস।”

হরকরা ও রাদন্দাজ খাঁ প্রস্থান করিলেন ও ক্ষণকাল পরে সুবা বাঙ্গালার রাজস্ব বিভাগের দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায়কে সঙ্গে লইয়া আসদ্‌ খাঁর নিকটে ফিরিয়া আসিলেন। দেওয়ান যথারীতি অভিবাদন করিয়া কহিলেন, “জনাবে আলী, নবাব নাজিম নবাব মক্‌রমখাঁর ফৌৎ হইয়াছে, শাহান শাহ্‌ বাদ্‌শাহের আদেশ ইক্‌লিম্ বাঙ্গালায় যতদিন না পৌঁছে ততদিন আপনিই সুবা বাঙ্গালা বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার।” দেওয়ান হরেকৃষ্ণ এই বলিয়া পুনরায় অভিবাদন করিলেন। আসদ্‌ খাঁ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি প্রকারে নাজিম নবাব মকরম্ খাঁর ফৌৎ হইল?” হরেকৃষ্ণ পুনরায় কুর্ণিস করিয়া নিবেদন করিলেন, “নবাব নাজিম বজ্‌রায় সফর করিতে গিয়াছিলেন, হঠাৎ ঝড় উঠিয়া বজ্‌রা মারা গিয়াছে।”

“উড়িষ্যা বা বিহারের ফৌজদারকে সংবাদ দিলে না কেন?” “আপনি ব্যতীত সুবা বাঙ্গালা উড়িষ্যায় পঞ্চ্‌ হাজারী মনসব্‌দার আর কেহ নাই।”

হরেকৃষ্ণ রায়ের আদেশে সুবাদারের চিহ্নস্বরূপ ছত্র, নিশান, আশা, সোটা, দুর্ব্বাশ্‌, মহি, মরাতব প্রভৃতি রাজচিহ্ন আনীত হইল। হরিনারায়ণ শীল পেশ্‌কার স্বরূপ উড়িষ্যা, জহাঙ্গীর নগর, সপ্তগ্রাম ও পাটনার নায়েব নাজিমদিগকে নবাব আসদ্ খাঁর নাজিমী গ্রহণ সংবাদ জানাইয়া পত্র লিখিলেন। চিন্তামণি মজুমদার মীর মুন্‌সী রূপে বাদশাহের দরবারে সংবাদ প্রেরণ করিলেন। তখন আসদ্‌খাঁ কহিলেন, “দেওয়ান্‌জী, তুমি যদি নাজিমী না আনিয়া নাওয়ারার একখানা গরাব্‌ বা দুইটা বড় তোপ আনিতে তাহা হইলে বড় খুসী হইতাম, আমি এখন হুগ্‌লী আক্রমণ করিতে যাইতেছি।”

“কেন হুজুর?”

“তিন দিন পূর্ব্বে হুগলীর ফিরিঙ্গিরা সপ্তগ্রাম আক্রমণ করিয়াছিল, বহুকষ্টে বাদ্‌শাহী বন্দর রক্ষা করিয়াছি, কল্য সন্ধ্যাকালে নবাব শাহ্‌নওয়াজ খাঁ হজরৎ জলালী পুত্রবধূ লইয়া বজরায় সফর করিতে গিয়াছেন আর ফিরিয়া আসেন নাই, সম্ভবতঃ ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদ্‌ তাঁহার বজ্‌রা মারিয়াছে।”

“এইবার হুজুর যখন স্বয়ং নিজাম হইয়াছেন, তখন বাঙ্গালা মুলুক হার্ম্মাদের অত্যাচার হইতে রক্ষা পাইবে।” “দেওয়ান, যে কয়দিন আমি নাজিম থাকিব, সে কয়দিন হার্ম্মাদের অত্যাচার নিবারণ করিব বটে, কিন্তু তাহার পরে খোদাতালার ইচ্ছা আর শাহন্‌ শাহ্‌ বাদশাহের মর্জ্জি।”

এই সময়ে দুর্গের তোরণে দামামা বাজিয়া উঠিল, ফৌজ্‌দারী আহদীসেনা সজ্জিত হইয়া বাহির হইল। নবাব নাজিম কহিলেন, “দেওয়ানজী, আপনি এখন বিশ্রাম করুন।” যদি হুগলী হইতে ফিরিয়া আসি তাহা হইলে জহাঙ্গীর নগর যাইব।”

নবাব নাজিম্‌, আলীনকী খাঁ ও গোষ্ঠবিহারী দুর্গ হইতে যাত্রা করিলেন। দুর্গের তোরণে একজন বৃদ্ধ ধীবর নবাব নাজিমকে অভিবাদন করিল। আহদীরা তাহাকে তাড়াইয়া দিতে ছিল, কিন্তু আসদ্‌ খাঁ তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া কহিলেন, “বৃদ্ধ কি বলিতে আসিয়াছে বলিতে দাও।” তখন বৃদ্ধ অগ্রসর হইয়া কহিল, “হুজুর, আমি বুড়া মানুষ, চোখে ভাল দেখিতে পাই না। আমি ভীমেশ্বরের স্বর্গীয় মহারাজ দেবেন্দ্রনারায়ণের নৌকায় ছিলাম, বড় বিপদে পড়িয়া আপনার নিকটে আসিয়াছি।”

আসদ্‌ খাঁ বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “দেবেন্দ্রনারায়ণ? তুমি কি তাহার পুত্রের সহিত আসিয়াছিলে?” উত্তর দিবার পূর্ব্বে ভুবন আসদ্‌ খাঁর মুখের দিকে ভাল করিয়া চাহিল, তাহার পরে ধীরে ধীরে কহিল, “হুজুর, আমি বুড়া মানুষ, ছোটলোক, আমার অপরাধ গ্রহণ করিবেন না। আপনি কি আসদ্‌ খাঁ? পিপলী ও আকবরনগরের যুদ্ধে আপনাকে দেখিয়াছি।” আসদ্‌ খাঁ হাসিয়া কহিলেন, “আমিই আসদ্‌ খাঁ। তুমি দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্রের সংবাদ বলিতে পার?”

ভুবন আসদ্‌ খাঁ পদতলে লুটাইয়া পড়িয়া কহিল, “হুজুর, সেই সংবাদ লইয়াই আসিয়াছি।”

ভুবন গৌরীপুরের ঘাট হইতে ললিতাহরণের কাহিনী, ময়ূখের যাত্রা প্রভৃতি সমস্ত বলিয়া গেল। অবশেষে সে কহিল, “সেই বুড়া আমীরের নৌকা হইতে মহারাজ যখন আমাকে ডাকিলেন তখনই হার্ম্মাদের কেল্লার গোলা বজ্‌রা ও আমাদের নৌকা ডুবাইয়া দিল। আমাদের নৌকার ভট্টাচার্য্য মহাশয়, এক বৈরাগী ও দুই তিন জন লোক ধরা পড়িয়াছিল, কিন্তু বজ্‌রার সকলেই বন্দী হইয়াছে।” আসদ্‌ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “বজ্‌রা হুগলীতে গেল কেন?”

“হার্ম্মাদের ছিপ্‌ ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল।” “আলীনকী খাঁ, সমস্তই শুনিলে, এখন হুগলী আক্রমণ করা ব্যতীত উপায় নাই।”

এই সময়ে আসদ্‌ খাঁ দেখিলেন যে, দূরে একজন বৃদ্ধ মুসলমান রাদন্দাজ খাঁর সহিত দ্রুতপদে অগ্রসর হইতেছেন। নাজিম বলিয়া উঠিলেন, “শোভান আল্লা, নবাব শাহ্‌নওয়াজ খাঁ ফিরিঙ্গির হাত হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছেন।” শাহ্‌নওয়াজ খাঁ আসিয়া বলিলেন যে ফিরিঙ্গি আমীর-উল্‌-বহর ডিসুজা তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া দিয়াছেন। তখন আসদ্‌ খাঁ দুর্গে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *