মিজান সাহেব ফরিদাকে বিয়ের কথা ভেঙে কিছুই বলেন নি।
তবু ফরিদা সবই জেনে গেলেন। ছেলের এক ফুপু এসে সব রহস্য ফাঁক করে দিলেন। ছেলে দেশে থাকে না থাকে নিউ অরলিন্সে। ডাক্তারী পাশ করেছে জন সেন্ট লুক থেকে। বয়স একত্রিশ। আমেরিকার রেসিডেন্সশিপ গত বছর পেয়েছে। সে বড় হয়েছে আমেরিকাতে। আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্র হিসেবে আমেরিকায় গিয়েছিল পনের বছর বয়সে, এর মধ্যে দেশে আসে নি। এখন তিন মাসের জন্যে এসেছে। বিয়ে করে চলে যাবে। বউ মাস তিনেক পর যাবে। ভিসা টি ঠিক করতে এই সময়টা লেগে যাবে।
ছেলের ফুপু নিজেও ডাক্তার। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ করেন। ডাক্তার হয়ে যাওয়া মেয়েদের কথাবার্তা খানিকটা রুক্ষ ধরনের হয়। এই ভদ্রমহিলার তা না। তিনি বেশ মজা করে কথা বলছেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর হাসছেন। তিনি বললেন, তৌফিককে পাঠিয়ে দেব। আপনারা কথা বলে দেখুন পছন্দ হয় কিনা। কখন পাঠাব বলে দেবেন। আমরা আপনাদের খুব কাছেই থাকি। বাড়ির নাম পদ্মসখা হলুদ রঙা তিনতলা বাড়ি। দেখেছেন না?
ফরিদা সেই বাড়ি দেখেন নি তবু মাথা নাড়লেন যেন দেখেছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আমাদের ছেলে কিন্তু আপনার মেয়েকে দেখেছে। এদের মধ্যে কি সব কথাও নাকি হয়েছে। ছেলে খুবই ইমপ্রেসড। পরে যখন খোঁজ নিয়ে জানা গেল আপনার মেয়ে ছাত্রী হিসেবেও খুব ভালো তখন সে আরো ইমপ্রেসড হল। এখন বলুন ছেলেকে কখন পাঠাব?
ফরিদা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। বুলুর বাবার সঙ্গে কথা না বলে কিছুই করা। যাবে না। এখন অবস্থা এমন যে বুলুর বাবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগই পাওয়া যাচ্ছে না। অফিস থেকে বাসায় এসে রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাসপাতালে যায়। সারা রাত থাকে হাসপাতালে। বুলুর অবস্থা নাকি ভালো না। কেন ভালো না তা ফরিদা ঠিক বুঝতে পারেন না। তিনি একবার হাসপাতালে বুলুকে দেখতে গেলেন, সে তো বেশ অনেক কথা টথা বলল। বুলু সুস্থ থাকলে বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে নেয়া যেত। অসুস্থ হয়ে হয়েছে যন্ত্ৰণা।
মেয়েদের বিয়ের কথাবার্তা হলে মেয়ের মায়েদের মনে তীব্র আনন্দ হয়। ফরিদার হচ্ছে। তাঁর বুকের ব্যথা পর্যন্ত এখন হয় না। শুধু একটিই কষ্ট, বীণার বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে কারো সঙ্গেই কথা বলতে পারছেন না। অথচ কথা বলতে ইচ্ছা করে। কথা যা বলার বীণার সঙ্গেই বলেন। বীণা লজ্জা পায় তবে চুপ করে থাকে না, মার কথার জবাব দেয়। ফরিদার ধারণা বীণাকে বাইরে থেকে যতটা লাজুক মনে হয় ততটা লাজুক সে না। লাজুক হলে আগ বাড়িয়ে কোন মেয়ে কি যুবক একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলে।
ছেলের ফুপু যখন বললেন, ওদের দুজনের কথা হয়েছে তখনই ফরিদার মনে সামান্য সন্দেহ ঢুকেছিল এই ভদ্রমহিলা হয়ত অন্য কোনো মেয়ের কথা বলছেন। ছেলের ফুপু চলে যাবার পর পরই বীণাকে তিনি বললেন, সে কোনো ছেলের সঙ্গে কথা-থা বলেছে কি না। তৌফিক নাম। বিদেশে থাকে।
বীণা বলল, হ্যাঁ। ফরিদা বললেন, কেন গায়ে পড়ে কথা বললি?
উনি আমাদের বাসার সামনে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি শুধু বললাম, আপনি কী চান? উনি তখন হড়বড় করে এক গাদা কথা বললেন। কেন মা?
ফরিদা হাসি মুখে বললেন, এই ছেলে তোকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। ছেলেটা কেমন বল তো? তোর কি পছন্দ হয়?
বীণা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ফরিদা বললেন, মুখটা এমন শুকনো করে দিলি কেন? বয়স হয়েছে বিয়ে করবি না? পরের সংসারে কতদিন আর থাকবি? এখন নিজের সংসার হবে। বীণা থমথমে গলায় বলল, এটা পরের সংসার?
পরের সংসার না তো কি? মেয়েদের নিজের সংসার একটাই, স্বামীর সংসার।
বীণা কোনো কথা না বলে উঠে গেল। তবে ফরিদার মনে হল বিয়ের এই আলাপে। বীণার তেমন আপত্তি নেই। ছেলেটিকে তার বোধ হয় পছন্দই হয়েছে।
ফরিদার অনুমান খুব ভুল হয় নি। ছেলেটিকে বীণার পছন্দ হয়েছে। বীণার মনে হয়েছে—ছেলেটা ভালো। কেন এরকম মনে হল সে সম্পর্কে বীণার কোনো ধারণা নেই। প্রবাসী মানুষদের মধ্যে আলগা ধরনের যে স্মার্টনেস থাকে এর মধ্যে তা নেই, কেমন যেন টিলাটলা ধরনের। চোখে মোটা কাচের চশমার কারণেই বোধ হয় তার মধ্যে প্রফেসর প্রফেসর ভাব চলে এসেছে। এই ভাবটা বীণার খুব ভালো লাগে। তাদের কলেজের এক জন প্রফেসর অজিত বাবুর চশমার কাঁচ খুব মোটা। তিনি ক্লাসে ঢুকেই বলেন, মা জননীরা, তোমরা একটু হাস। তোমাদের হাসি দেখে ক্লাস শুরু করি। এই অজিত বাবুকে বীণার খুবই ভালো লাগত। সেই ভালো লাগার অংশ বিশেষ মোটা চশমার কারণে তৌফিক ছেলেটা পেয়ে গেল। এক জন মানুষকে ভালো লাগা এবং মন্দ লাগার পেছনে অনেক বিচিত্র এবং রহস্যময় কারণ থাকে।
তৌফিক ছেলেটির প্রতি ভালোলাগার পরিমাণ আরেকটু বাড়ল দ্বিতীয়বার যখন দেখা হল। বীণা হাসপাতাল থেকে ফিরছে বাড়িতে ঢোকার গলির মাথায় আসতেই দেখা। তৌফিক রাস্তার একপাশে বিব্রতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার প্রথম কথা বলল বীণা। লাজুক গলায় বলল, কী হয়েছে?
তৌফিক বিব্রত স্বরে বলল, তেমন কিছু না। গর্তের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। দেখুন না কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে কী অবস্থা।
বীণা দেখল। বাঁ পায়ের প্যান্টে থিকথিক ময়লা লেগে আছে। বীণা বলল, বাসায় গিয়ে পা ধুয়ে ফেলুন।
এই বলেই বীণার মনে হল সে এত কথা বলছে কেন? এত কথা বলার কি আছে? কথা শুরু করে চট করে চলে যাওয়া যায় না। বীণা কিছুটা অস্বস্তি এবং কিছুটা অনিশ্চয়তায় বাড়ির দিকে পা বাড়াল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটি তার সঙ্গে-সঙ্গে আসছে। গেটের কাছাকাছি আসার পর বীণার মনে হল তার হয়ত বলা উচিত—ভেতরে আসুন। কথার কথা। ভদ্রতার জন্যেই বলা। মুশকিল হচ্ছে বলার পর সে যদি সত্যি-সত্যি বাড়িতে ঢোকে তখন? সেটা কি ঠিক হবে?
বীণা চোখ মুখ লাল করে বলল, ভেতরে আসুন।
তৌফিক হেসে বাড়িতে ঢুকল। বীণা কী করবে ভেবে পেল না।
বীণার দাদী চেঁচাতে শুরু করলেন-কে আসল? লোকটা কে? ও বীণা লোকটা কে? কি চায় এই লোক।
বীণা তৌফিকের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, আমার দাদী। উনার মাথার ঠিক
নেই।
তৌফিক বলল, বাসায় আর কেউ নেই?
মা আছেন। আপনি বসূন মাকে ডেকে আনছি।
ফরিদা মাছ কাটছিলেন। তৌফিক এসেছে শুনে এতই উত্তেজিত হলেন যে বটিতে হাত কেটে ফেললেন।
তৌফিক অনেকক্ষণ এ বাড়িতে রইল। ফরিদার সঙ্গে সহজ ভঙ্গিতে গল্প করল। বীণার দাদীর সঙ্গে দেখা করতে গেল। নরম গলায় বলল, দাদী আপনি কেমন আছেন?
বীণার দাদী বললেন, মর হারামজাদা।
তৌফিক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শব্দ করে হেসে উঠল। এই সহজ সরল হাসি বড় ভালো লাগল বীণার।
সেইদিন বিকেলেই ছেলের ফুপু এসে বললেন, শুনলাম ছেলেকে আপনি দেখেছেন। আপনার কি ছেলে পছন্দ হয়েছে?
ফরিদা বললেন, হ্যাঁ পছন্দ হয়েছে।
আমরা কি বিয়ের তারিখ নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারি? আমরা এই মাসেই কিংবা সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চাই।
বীণার বাবার সঙ্গে কথা বলেন।
হ্যাঁ বলব। দুএক দিনের মধ্যেই বলব। আপনার বড় ছেলেটা শুনলাম অসুস্থ।
জ্বি। পায়ে কী যেন হয়েছে।
বাড়ির বড় ছেলে অসুস্থ এই অবস্থায় তো বিয়ের আলাপ চলতে পারে না। ও কবে নাগাদ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে কিছু জানেন?
জ্বি না।
এখন সে আছে কেমন?
একটু ভালো আছে।
একদিন যাব দেখতে। আপনার মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।
আপত্তি কিসের। মেয়ে তো এখন আপনাদের।
ফরিদা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। আনন্দে তাঁর চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। চোখের পানি সামলাতে তাঁকে খুব কষ্ট করতে হল।