বিজু মুরাদকে ধরে এনেছে।
কলেজে যাওয়ার পথে সে মুরাদকে প্রথম এক ঝলক দেখতে পায়। সে আমজাদের চায়ের দোকানে বসেছিল। বিজুকে দেখেই চট করে সরে পড়ল। বেশি দূর যেতে পারল না। বিজু ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল, পর মুহূর্তেই প্রচণ্ড এক চড় বসাল। এমন প্ৰচণ্ড চড় যে, মুরাদ উলটে পড়ে মাথায় চোট খেল। এক ভদ্রলোক আঁতকে উঠে বললেন, করেন কি?
বিজু বলল, কি করছি দেখতে পাচ্ছেন না, আর দিচ্ছি। আপনার বাসা থেকে টাকা নিয়ে পালালে আপনি কি করতেন? কোলে নিয়ে চুমু খেতেন? কি চুমু খেতেন কোলে নিয়ে?
ভদ্রলোক কথা বললেন না। বিজু মুরাদের চুল ধরে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে এল। তার মূর্তি ভয়ঙ্কর। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। মাঝে-মাঝে হিংস্র গলায় বলছে, তোর বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। এত বড় সাহস। বাজারের টাকা নিয়ে উধাও। মামদোবাজি?
সোমা ব্যাপার দেখে স্তম্ভিত। এক জন মানুষ অন্য এক জনকে এমনভাবে মারতে পারে? সোমা বলল, এই সব কী হচ্ছে?
বিজু বলল, আদর হচ্ছে। হারামজাদাকে আদর করছি।
সোমা কড়া গলায় বলল, ছাড়—ওর চুল ছাড়।
তুমি এখান থেকে যাও তো আপা।
তুই ওর চুল ছাড়।
বললাম তো–তমি এখান থেকে যাও।
ওকে ছেড়ে দে বিজু।
তুমি বড় যন্ত্রণা করছ আপা।
তুই ওকে না ছাড়লে আমি এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
বিজু চুল ছেড়ে ছিল। সোমা বলল, তুই এসব কী শুরু করেছিস?
চোরকে ধরে কয়েকটা চড় দিয়েছি, এর বেশি কী করলাম?
বড় চাচাকে তুই কী বলেছিস?
বড় চাচার কথা এখানে আসছে কেন?
তুই কী বলেছিস বড় চাচাকে?
কী বলব, কিছুই বলি নি।
কিছুই বলিস নি তা হলে উনি এরকম করছেন কেন?
কীরকম করছেন?
তাও জানিস না?
তুমি বড় চেঁচামেচি করছ আপা। এত চেঁচামেচি করার তো কিছু হয় নি, তুমি অনেক কিছু করছ যা আমার পছন্দ না। কিন্তু কই আমি তো চেঁচামেচি করছি না। আমি তো চুপ করে আছি।
সোমাচাপা স্বরে বলল, আমি কী করেছি?
ঐ হারামজাদা প্রফেসরের বাসায় তুমি যাও নি? এত কিছুর পরও তো গিয়েছ। হেসে হেসে গল্পগুজব করেছ। কর নি?
জাহানারা বের হয়ে এলেন। কঠিন স্বরে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। বিজু ঘরে যা।
বিজু ঘরে ঢুকে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে সহজ-স্বাভাবিক গলায় বলল, চা দে তো ঊর্মি। আজ ক্লাসটা মিস হয়ে গেল। ইম্পৰ্টেন্ট ক্লাস ছিল। তুই কলেজে যাস নি কেন রে?
কলেজ বন্ধ।
আজ আবার কীসের বন্ধ? যন্ত্রণা হল দেখি। দুই দিন পর পর বন্ধ? তোদর কলেজের অবস্থা তো দেখি আমাদেরটার চেয়েও খারাপ।
বিজু সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে। একটু আগের ঘটনার কোনো ছাপ তার মধ্যে নেই। আবার কলেজের দিকে রওনা হবার আগে সে সোমাকে বলল, আপা, তোমার টবের এই গাছ দুটা চমৎকার। বগনভিলিয়ার এত সুন্দর কালার হয় জানাই ছিল না। একসেলেন্ট।
সোমা জবাব দিল না।
বিজু নিচু গলায় বলল, মাঝে-মাঝে হট ব্রেইনে কি বলে ফেলি কিছু মনে রেখ। না আপা। আর ঐ পিচ্চিকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিয়েছি। দেখ গিয়ে ও দাঁত বের করে হাসছে। মারধরে ওদের কিছু হয় না। মারধর ওদের ডাল ভাত।
দুপুরে সোমা বড় চাচাকে দেখতে গেল। তিথি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবার বোধহয় মাথাই খারাপ হয়ে গেছে আপা। ঐদিন বিজু ভাই কি-সব বলে গেছেন। তারপর থেকে……
সোমা বলল, চাচি নেই?
মা সাত দিন আগে রাগারাগি করে ঐ যে বড় মামার বাসায় গেছেন আর আসছেন না। কী করি বল তো আপা?
বড় চাচার অবস্থার কথা চাচি জানেন?
জানেন। আমি নিজে গিয়ে বলেছি।
চাচি কী বললেন?
কিছুই বলেন না।
সোমা বড় চাচার ঘরে ঢুকল। তিনি একদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, কে, সোমা না?
জ্বি।
ভালো আছিস মা?
জ্বি ভালোই তো?
শরীরটা ভালো তো?
জ্বি ভালো।
শরীরটা ঠিক রাখবি। শরীর ঠিক রাখাটা খুবই দরকার। শরীরটা নষ্ট হয়ে গেছে—তাই আমার এই অবস্থা। শরীর ঠিক থাকলে তিথির তিন মামাকে কি করতাম দেখতে পেতিস। ধরে ধরে আছাড় দিতাম। তিনটাই বদ। মহা বদ। দুটো কাঁচাপয়সার মুখ দেখে মনে করছে দুনিয়া কিনে ফেলেছে। দুনিয়া কেনা এত সস্তা না। ফেরাউন বাদশা কিনতে পারে নি। তার তো টাকার অভাব ছিল না। ব্যাটা তোদের কটা টাকা হয়েছে বল দেখি? দুটো ব্যাঙের আধুলি পেয়ে মনে করেছিস কি? তোদের মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিইইয়েস পেচ্ছাব। স্ট্রেট পেচ্ছাব করে দেব। তখন বুঝবি কত ধানে। কত চাল? তোরা ভেবেছিস কী? দুই মণ ধানে দুই মণ চাল? উঁহু, এত সহজ না। দুই মণ ধানে এক মণ চাল–খুব বেশি হলে দেড় মণ……
বড় চাচা অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন। এক মুহূর্তের জন্যেও থামছেন না। তিথি ও মিথি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তাদের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মিথি হাত ইশারা করে সোমাকে ডাকছে।
সোমা উঠে গেল বড় চাচার কথা বলা বন্ধ হল না। তিনি কথা বলেই যাচ্ছেন। মিথি বলল, কি করব আপি?
বড় চাচিকে নিয়ে আয়। কিংবা তোর কোনো মামাকে আন। ভয় নেই আমি এখানে আছি।
বাবা কি পাগল হয়ে গেছেন?
আরে না, মানুষ এত সহজে পাগল হয় না। মাথাটা গরম হয়েছে। ওষুধপত্র খেলে ঠিক হয়ে যাবে। যা তোরা দুজনে মিলে চলে যা।
মিথিরা চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় চাচা বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। বেশ আরামের ঘুম। তাঁর নাক ডাকতে লাগল।
সোমা পাশেই বসে রইল। তার কিছুই করার নেই। একটা বই হাতের কাছে থাকলে বসে বসে পড়া যেত। অনেক দিন বই পড়া হয় না। বই পড়তে কেমন লাগবে এখন কে জানে। বিকেলের দিকে একবার কি যাবে বই আনতে? না থাক। যন্ত্ৰণা বাড়িয়ে লাভ নেই। এমনিতেই অনেক যন্ত্ৰণা।
সোমার বড় চাচি তাঁর ছোট ভাইকে নিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে ফিরলেন। বড় চাচা তখনো ঘুমে। সোমা নিজের ঘরে চলে এল। ঘুমন্ত মানুষের পাশে থেকে থেকে তারও ঘুম পাচ্ছে। সারা দিন সে কিছুই করে নি। তবুখুব ক্লান্ত লাগছে। সে খানিকক্ষণ ঘুমুবে। ঊর্মিকে বলে দেবে তাকে যেন ডাকা না হয়। রাতের খাবার সময়ও যদি দেখা যায় তার ঘুম ভাঙে নি তবু যেন ডাকা না হয়। এক রাত না খেলে কিছু হয় না।
সোমা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল সে বলতে পারবে না, তার কাছে মনে হল শুধু তার চোখ একটু লেগেছে ওমনি যেন ঊর্মি এসে তার গা ঝাঁকাচ্ছে, আপা ওঠ তো। প্লিজ ওঠ।
সোমা বিরক্ত গলায় বলল, তোকে কী বলেছিলাম?
আপা ওঠ, দরকার আছে। প্লিজ।
সোমা উঠে বসল। ঘর অন্ধকার। বারান্দায় বাতিও জ্বালানো হয় নি। দরজা-জানালা লাগানো।
তুমি অনেকক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছ আপা। এখন সাড়ে নটা বাজে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। তবে তোমাকে ঘুম থেকে তুলেছি অন্য কারণে। প্রফেসর সাহেব এসেছেন।
কে এসেছেন?
প্রফেসর সাহেব। ঐ যে দোতলা বাড়ির। সন্ধ্যার পর পর এসেছেন। আর যেতে চাচ্ছেন না। আমি এতক্ষণ গল্প করলাম। গল্প আমার পেটে যা ছিল সব শেষ। তিনিও চুপচাপ বসে। আমিও চুপচাপ। আপা হাত মুখে একটু পানি দিয়ে চলে এস।
সোমা কখনো ভাবে নি যে, সে বসার ঘরে ঢুকতেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবেন। যেন সোমা এক জন খুব সম্মানিত মহিলা। সোমার ভীষণ লজ্জা লাগল।
সে নিচু গলায় বলল, আপনি বসুন।
ঊর্মি বলছিল, তোমার শরীর ভালো না। সন্ধ্যা থেকে ঘুমুবার সময় বলে গেছ-তোমাকে যেন ডাকা না হয়। আমি তাই অপেক্ষা করছিলাম।
সোমা কি বলবে ভেবে পেল না। বসার ঘরের অবস্থা কি হয়ে আছে। উনি আসবেন জানলে সে ঘর গুছিয়ে রাখত।
প্রফেসর সাহেব নরম গলায় বললেন, তোমার ঘোটবোনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খুব হাসছিলাম। ও যে এত মজার মজার গল্প জানে—আশ্চর্য। মেয়েরা সাধারণত রসিকতা করতে পারে না। কিন্তু ও দেখলাম সুন্দর রসিকতা করে।
আপনাকে কি ও চা দিয়েছে?
হ্যাঁ তিন বার দিয়েছে। আর চা খাব না, তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে চলে যাব।
বলুন।
তুমি এত দূরে বসেছ কথা বলতে হলে তো চেচিয়ে বলতে হবে। কাছে এস।
সোমা এগিয়ে এল।
নিজেদের বাড়িতে তুমি এত লজ্জা পাচ্ছ কেন বল তো?
লজ্জা পাচ্ছি না।
আমি যে জন্যে এসেছি সেটা বলে চলে যাই। তুমি খুবই অস্বস্তি বোধ করছ। তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আচ্ছা শোন, ঐ দিন যে তুমি আমার বাসায় গিয়েছিলে তা নিয়ে কি কোন সমস্যা হয়েছে?
না। সমস্যা হবে কেন?
গত কাল সন্ধ্যায় তোমার বাবা আমার বাসায় এসেছিলেন। কাজেই মনে হল হয়তো কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে। তোমার বাবাকে সেটা বুঝিয়ে বললাম।
বাবা আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
তুমি জান না?
না।
হ্যাঁ গিয়েছিলেন। তিনি তোমাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত। তোমার আগের হাজব্যান্ড না-কি খুব বিরক্ত করছে তোমাকে?
না তো।
তোমার বাবা তোতাই বললেন। রাত দশটা-এগারটার দিকে বাসার সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। ক্রিমিনাল নেচারের মানুষ, তাই তোমার বাবা ভয় পাচ্ছেন। যদি কোনো ক্ষতিটতি করার চেষ্টা করে।
ও কোনো ক্ষতিটতি করার চেষ্টা করবে না।
না করলে তো ভালোই। তোমার বাবাকে সেই কথা বললাম। এবং আরো একটা কথা বললাম; সেই কথাটা তোমাকেও বলা দরকার। কথা ঠিক না, এক ধরনের আবেদন বলতে পার। আমি তোমার বাবাকে বলেছি যে, আপনার বড় কন্যাকে আমি খুবই পছন্দ করি। তার জীবনের ভয়াবহ দুর্যোগের জন্যে আমি পরোক্ষভাবে হলেও দায়ী, কাজেই…….
সোমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমা খুলে কাচ মুছতে মুছতে বললেন, আমার মনে হল তোমার বাবা আমার কথা শুনে খুশিই হয়েছেন। ওঁর খুশি হওয়াটা তেমন জরুরি নয়, তুমি খুশি কি না বা তুমি কী ভাবছ সেটা হচ্ছে জরুরি। জীবন নতুন করে শুরু করা অন্যায় কিছু না। পিছন দিকে তাকিয়ে বড় বড় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলার কোনো মানে হয় না। আজ উঠি। ভালো কথা, তোমার জন্যে দুটো বই এনেছি।
সোমা তাঁকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। ভদ্রলোক চলে যাবার পরও সে অনেকক্ষণ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। বড় চাচার কথা শোনা যাচ্ছে—এক নাগাড়ে তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। এখন কথা বলছেন আগের চেয়েও অনেক উঁচু গলায়।
সমস্যা আবার কী? কীসের সমস্যা? কার বাপের সমস্যা? কাকে আমি ডরাই? কোন ব্যাটাকে ডরাই? তারা আমাকে কী ভাবে? এখনো হাতে এমন জোর আছে যে, একটা চড় দিলে দ্বিতীয় চড় দেওয়া যাবে না। এক চড়েই পাউরুটি বিস্কুট হয়ে যাবে…..
বড় চাচা কথা বলছেন। আরেক জন কে যেন কাঁদছে। কে কাঁদছে বোঝা যাচ্ছে না—মিথি, তিথি না বড় চাচি? সব পুরুষের কান্নার শব্দ যেমন এক রকম, সব মেয়েদের কান্নার শব্দও এক। কে জানে যখন মানুষ কাঁদে তখন বোধহয় সবাই সমান হয়ে যায়।
সোমা দেখল বাবা আসছেন। হেঁটে হেঁটে আসছেন। আজকাল প্রায় রাতেই উনি দেরি করে ফিরছেন। পসার বোধহয় বাড়ছে। আগের বিমর্ষ ভাব এখন আর তাঁর মধ্যে নেই।
কে, সোমা?
জ্বি বাবা।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে মা?
তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। এত দেরি কেন?
একটা কলে গিয়েছিলাম। ওরা আবার চা-টা খাইয়ে দিল।
নামি ডাক্তার হয়ে যাচ্ছ মনে হয় বাবা।
বাবা হাসলেন। সোমা অবাক হয়ে লক্ষ করল—এই যে বড় চাচা চেঁচামেচি করছেন বাবার কানে তা যাচ্ছে না। তিনি হাসতে হাসতে কথা বলছেন।
এখানে তো বেশ বাতাস সোমা।
জ্বি।
দাঁড়াই খানিকটা গায়ের ঘাম মরুক, কী বলিস?
দাঁড়াও।
তিনি ইতস্তত করে বললেন, তোকে একটা কথা বলা হয় নি। প্রফেসর সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম। মানে এমনি হঠাৎ ভাবলাম….হাজার হলেও প্রতিবেশী। তাই না?
তা তো ঠিকই।
ভদ্রলোককে যেরকম ভেবেছিলাম সেরকম না। খুবই ভদ্রলোক। ধরতে গেলে আমি তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ। তোর মাকে বলেছি সেকথা। খুবই ভালো মানুষ। পাড়াতেও খুবই সুনাম।
ভালো মানুষ, সুনাম কেন হবে না বল?
নিরহঙ্কারী লোক। এক দিন পানি ছিল না, উনি নিজেই রাস্তার মিউনিসিপ্যালিটির কল থেকে বালতি করে পানি নিয়ে গেলেন। সবাই পারে না। সঙ্কোচ বোধ করে। তাই না?
তা ঠিক।
সম্মান যার আছে সে সম্মান যাওয়ার ভয় করে না। যার সম্মান নেই তার যত ভয়।
তোমার গায়ের ঘাম বোধহয় মরেছে, চল ভেতরে যাই।
দাঁড়া আরেকটু। বাতাসটা ভালোই লাগছে। সোমা, প্রফেসর সাহেব একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, মানে—ইয়ে—তোর মা কি কিছু বলেছে তোতাকে?
না।
আচ্ছা তোর মার কাছ থেকে শুনিস। প্রস্তাবটা আমার পছন্দ হয়েছে। একটা ফ্ৰেশ স্টার্ট হলে ভালো হয়। বেশ ভালো হয়। চেঁচামেচি কে করছে রে?
বড় চাচা।
যন্ত্রণা হল দেখি।
সাইফুদ্দিন সাহেব বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললেন।
রাত বারটা দশ। বিজু এখনো ফেরে নি। মাঝেমাঝে সে খুব রাত করে। তার না কি পার্টি মিটিং থাকে। আজও বোধহয় পার্টি মিটিং ছিল। জাহানারা ভাত বেড়ে ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
সোমা বলল, তুমি ঘুমিয়ে পড় মা। আমি জেগে আছি। আমি সন্ধ্যাবেলায় ঘুমিয়েছি। এখন আর ঘুম আসছে না।
জাহানারা সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমুতে গেলেন। বাড়ি নিঝুম হয়ে গেল। বড় চাচার কথাও শোনা যাচ্ছে না। সম্ভবত তিনিও ঘুমুচ্ছেন। মাঝেমাঝে একটা ঘুমন্ত বাড়িতে একা একা জেগে থাকতে ভালো লাগে। অদ্ভুত-অদ্ভুত সব চিন্তা আসে। আজ অবশ্যি তেমন কোনো অদ্ভুত চিন্তা সোমার মাথায় আসছে না। সে প্রফেসর সাহেবের রেখে যাওয়া বইটি কোলে নিয়ে বসে আছে।
এই ভদ্রলোককে সে কখনো কোনো নামে ডাকে নি। প্রথম পরিচয়ের দিন এক বার শুধু স্যার বলেছিল। উনি বলেছিলেন, সবার মুখে দিনরাত স্যার-স্যার শুনি। তুমি স্যার না বললে কেমন হয়?
সোমা বলেছিল, কী ডাকব?
তোমার যা ইচ্ছা তাই ডাকতে পার।
সোমা কিছু ডাকে নি।
দরজার কড়া নড়ছে। সোমা খুলে দিল। লজ্জিত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল বিজু।
দেরি করলাম আপা। সরি। পার্টি মিটিং ছিল।
তরকারি গরম করব, না যেমন আছে তেমনি খাবি?
কিছু খাব না আপা। বিরিয়ানি খেয়ে এসেছি।
চা খাবি? চা করে দেব?
দাও। বেশি করে বানিও। ফ্লাস্কে ভরে রাখব।
সোমা রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে। বিজু কাপড় ছেড়ে সিগারেট হাতে এসে বসল ববানের পাশে।
সোমা চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল, বিজু, ও নাকি রাতের বেলা বাসার সামনে দিয়ে হাঁটা হাঁটি করে?
কে বলেছে তোমাকে?
করে কি না বল।
আর করবে না। হেভি ধাঁতানি দিয়ে দিয়েছি।
মারধর করেছিস?
আরে না। তুমি কি ভাবো আমি রাতদিন মারামারি করে বেড়াই? আমি লোকটাকে কঠিন করে বলে দিয়েছি—আপনাকে তিন রাত এখানে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছি। আর যেন না দেখি। মামদোবাজি আমি সহ্য করব না।
সোমা শীতল গলায় বলল, এক জন লোক যদি বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তা হলে তোর অসুবিধা কী?
বিজু খুব অবাক হল।
সোমা বলল, এমন তো না যে সে কারোর কোনো ক্ষতি করছে।
ও একটা ক্রিমিন্যাল লোক আপা। বল, ক্রিমন্যাল না?
সোমা চুপ করে রইল।
বিজু বলল, একটা কথা সত্যি করে বল তো আপা, তুমি ওর কাছে ফিরে যেতে চাও?
না।
কখনো কি তোমার মনে হয়েছে যে, চলে এসে তুমি ভুল করেছ?
না।
শুনে ভালো লাগল আপা। তোমার কাণ্ডকারখানায় মাঝে-মাঝে কনফিউজড হয়ে যাই।
সোমা বলল, তুই যখন ঐ সব কথা ওকে বললি, তখনও ও কী বলল?
তুমি এখনো ও সব নিয়ে ভাবছ?
কী বলল ও?
কিছুই বলে নি।
এখানে আসত কেন, জিজ্ঞেস করেছিলি?
না। কথা বলার অবস্থা ছিল না।
কেন?
মাথায় ব্যাভেজফ্যাভেজ দেখলাম। কেউ বোধহয় হেভি পিটন দিয়েছে।
সোমার হাত থেকে চা ছলকে পড়ল।
বিজু বলল, ঠাট্টা করছিলাম আপা। তোমার রিঅ্যাকশন দেখছিলাম। লোকটা বহাল তবিয়েতেই আছে। তবে মার একদিন সে খাবে। পাবলিক তাকে পিটিয়ে লম্বা বানাবে। তোমার শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা সত্যি।
সোমা উঠে দাঁড়াল।
বিজুও উঠল। সোমার পিছনে পিছন আসতে আসতে বলল, তুমি খুব শক্ত মেয়ে, তবে তোমার আরো শক্ত হওয়া দরকার।
তোকে উপদেশ দিতে হবে না।
উপদেশ দিচ্ছি না আপা; আর শুধু একটা কথা বলব। তোমার ঐ প্রফেসর ভদ্রলোক-খারাপ না। ভালো। তুমি যদি এঁর বাসায় যাও, আমি রাগ করব না। বরং খুশিই হব। শুধু আমি একা না, এ-বাড়ির সবাই খুশি হবে।