বাঙালীর ছেলেরা ঘর ছেড়ে বেরুতে চায় না বলে একদল পেশাদার অন্ধ রাজনীতিবিদ অভিযোগ করেন। অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা। মহেঞ্জোদাড়ো বা হরপ্পার যুগের কথা আমি জানি না। তবে ইংরেজ রাজত্বের প্রথম ও মধ্যযুগে লক্ষ লক্ষ বাঙালী সমগ্ৰ উত্তর ভারতে ছড়িয়েছেন। রুজি-রোজগার করতে বাঙালী কোথাও যেতে দ্বিধা করে নি। সুদূর রাওয়ালপিণ্ডি, পেশোয়ার, সিমলা পৰ্যন্ত বাঙালীরা গিয়েছেন, থেকেছেন, থিয়েটার করেছেন, কালীবাড়ী গড়েছেন।
এই যাওয়ার পিছনে একটা কারণ ছিল। প্ৰথমতঃ বাঙালীরাই আগে ইংরেজী শিক্ষা গ্ৰহণ করে সরকারী অফিসে বাবু হবার বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করেন। সবাই যে কুইন ভিক্টোরিয়ায় অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট লেটার হাতে করে হাওড়া স্টেশন থেকে পাঞ্জাব মেলে চাপতেন, তা নয়। তবে রাওয়ালপিণ্ডি মিলিটারী একাউণ্টস অফিসে কোন না কোন মেশোমশাই পিসেমশাই-এর আমন্ত্রণে অনেকেই বাংলা ত্যাগ করেছেন।
পরে বাঙালী ছেলেছোকরার বোমা-পাটকা ছুড়ে ইংরেজদের ল্যাজে আগুন দেবার কাজে মেতে ওঠায় সরকারী চাকুরির বাজারে বাঙালীর দাম কমতে লাগল। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের দিকে দিকে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার হওয়ায় সরকারী অফিসের বাবু যোগাড় করতে ইংরেজকে আর শুধু বাংলার দিকে চাইবার প্ৰয়োজন হলো না। বাঙালীর বাংলার বাইরে যাবার বাজারে ভাঁটা পড়ল।
জীবনযুদ্ধে ধীরে ধীরে বাঙালীর পরাজয় যত বেশী প্ৰকাশ হতে লাগল, মিথ্যা আত্মসন্মানবোধ বাঙালীকে তত বেশী পেয়ে বসল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর এই আত্মসম্মানবোধ তাকে প্ৰায় বাংলাদেশে বন্দী করে তুললে। বাংলাদেশের নব্য যুবসমাজ চক্রান্ত ভাঙতে পারত, গড়তে পারত নিজেদের ভবিষ্যৎ, অগ্ৰাহ করতে পারত অদৃষ্টের অভিশাপ। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা সম্ভব হলো না। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, সুচিত্ৰা-উত্তম, সন্ধ্যা মুখুজ্যে-শ্যামল মিত্তির, বিষ্ণু দে-সুধীন দত্ত, সত্যজিৎ-তপন সিংহ থেকে শুরু করে নানাকিছুর দৌলতে বেকার বাঙালীও চরম উত্তেজনা ও কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে জীবন কাটায়। এই উত্তেজনা, কর্মচাঞ্চল্যের মোহ আছে সত্য কিন্তু সার্থকতা কতটা আছে তা ঠিক জানি না।
কলকাতায় রিপোর্টারী করতে গিয়ে বাংলাদেশের বহু মনীষীর উপদেশ পেয়েছি, পরামর্শ পেয়েছি কিন্তু পাইনি অনুপ্রেরণা। নিজেদের আসন অটুট রেখে, নিজেদের স্বাৰ্থ বজায় রেখে তাঁরা শুধু রিক্ত নিঃস্ব বুভুক্ষু বাঙালী ছেলেমেয়েদের হাততালি চান। সাড়ে তিন কোটি বাঙালীকে বিকলাঙ্গ করে সাড়ে তিন ডজন নেতা আনন্দে মশগুল।
উদার মহৎ মানুষের অভাব বাংলাদেশে নেই। প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায়, গ্রামে-শহরে-নগরে বহু মহাপ্ৰাণ বাঙালী আজও রয়েছেন। কিন্তু অন্যায়, অবিচার, অসৎ-এর অরণ্যে তাঁরা হারিয়ে গেছেন।
কলকাতার এই বিচিত্র পরিবেশে থাকতে থাকতে আমার মনটা বেশ তেঁতে হয়েছিল। আশপাশের অসংখ্য মানুষের অবহেলা আর অপমান অসহ্য হয়ে উঠেছিল। সবার অজ্ঞাতে, অলক্ষ্যে মন আমার বিদ্রোহ করত। কিন্তু রাস্তা খুজে পেতাম না। এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে যেতাম! সমাজ-সংসার-সংস্কারের জাল থেকে নিজেকে ভক্ত করে বেরুতে গিয়ে ভয় করত। ঘাবড়ে বোতাম।
নিজের মনের মধ্যে যে এইসব দ্বন্দ্ব ছিল, তা মেমসাহেবকেও বলতাম না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম। তাইতো নিয়তির খেলাঘরে মেমসাহেবকে নিয়ে খেলতে গিয়ে যেদিন সত্যিসত্যিই ভবিষ্যতের অন্ধকারে ঝাঁপ দিলাম, সেদিন মুহুর্তের জন্য পিছনে ফিরে তাকাইনি। মনের মধ্যে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল। হয়ত প্ৰতিহিংসা আমাকে আরো কঠোর কঠিন করেছিল।
আর? মেমসাহেবকে আর দূরে রাখতে পারছিলাম না। জীবনসংগ্রামের জন্য প্রতিটি মুহুর্ত তিলে তিলে দগ্ধ হওয়ায় দিনের শেষে রাতের অন্ধকারে মেমসাহেবের একটু কোমল স্পর্শ পাবার জন্য মনটা সত্যি বড় ব্যাকুল হতো। জীবনসংগ্ৰাম কঠোর থেকে কঠোরতর হতে পারে, সে সংগ্রামে কখনও জিতব, কখনও হারব। তা হোক। কিন্তু দিনের শেষে সূৰ্যাস্তের পর কর্মজীবনের সমস্ত উত্তেজনা থেকে বহু দূরে মানসলোকের নির্জন সৈকতে বন্ধনহীন মন মুক্তি চাইত মেমসাহেবের অন্তরে।
স্বপ্ন দেখতাম আমি ঘরে ফিরেছি। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আমি সুইচটা অফ করে দিয়ে মেমসাহেবকে অকস্মাৎ একটু আদর করে তার সর্বাঙ্গে ভালবাসার ঢেউ তুলেছি। দুটি বাহুর মধ্যে তাকে বন্দিনী করে নিজের মনের সব দৈন্য দূর করেছি, সারাদিনের সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলেছি।
মেমসাহেব আমার দুটি বাহু থেকে মুক্তি পাবার কোন চেষ্টা করে না, কিন্তু বলে, আঃ ছাড় না।
ঐ দুটি একটি মুহুর্তের অন্ধকারেই মেমসাহেবের ভালবাসার জেনারেটরে আমার মনের সব বালবগুলো জালিয়ে নিই।
তারপর মেমসাহেবকে টানতে টানতে ডিতানের পর ফেলে দিই। আমিও হুমডি খেয়ে পড়ি ওর উপর। অবাক বিস্ময়ে ওর দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মেমসাহেবও স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে। অত নিবিড় করে দুজনে দুজনকে কাছে পাওয়ায় দুজনেরই চোখে নেশা লাগে। সে নেশায় দুজনেই হয়ত একটু মাতলামি করি।
হয়ত বলি, জান মেমসাহেব, তোমার ঐ দু’টো চোখের দিকে তাকিয়ে যখন আমার নেশা হয়, যখন আমি সমস্ত সংযম হারিয়ে মাতলামী পাগলামি করি, তখন জিগর মুরাদাবাদীর একটা শের মনে পড়ে।
পাশ ফিরে আর শোয় না মেমসাহেব। চিৎ হয়ে শুয়ে দু’হাত দিয়ে আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে, বল না, কোন শেরটা তোমার মনে পড়ছে।
আমি এবার বলি, তেরী আঁখো কা কুছ কাসুর নেহি, মুঝকো খারাব হোনা থা।–বুঝলে মেমসাহেব, তোমার চোখের কোন দোষ নেই, আমি খারাপ হতামই।
চোখটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু ঢলঢল ভাবে ও বলে, তাতো একশবার সত্যি! আমি কেন তোমাকে খারাপ করতে যাব?
আমি কানে কানে ফিসফিস করে বলি, আমার আবার খারাপ হতে ইচ্ছে করছে।
ও তিড়িং করে একলাফে উঠে বসে আমার গালে একটা ছোট্ট মিষ্টি চড় মেরে বলে, অসভ্য কোথাকার।
আরো কত কি ভাবতাম। ভাবতে ভাবতে আমি পাগল হবার উপক্রম হতাম। শত-সহস্ৰ কাজকর্ম চিন্তা-ভাবনার মধ্যেও মেমসাহেবের ছবিটা সবসময় আমার মনের পর্দায় ফুটে উঠত। তাইতো দিল্লী আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলাম করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে হয়ে অদৃষ্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেকে প্ৰতিষ্ঠা করতে হবে কর্মজীবনে। আর? মেমসাহেবকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমার জীবনে।
দোলাবৌদি, আমি শিবনাথ শাস্ত্রী বা বিদ্যাসাগর নই যে আত্মজীবনী লিখব। তবে বিশ্বাস কর দিল্লীর মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি একেবারে পাল্টে গিয়েছিলাম। যেদিন প্ৰথম দিল্লী স্টেশনে নামি, সেদিন এক’জন নগণ্যতম মানুষও আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন না। এতবড় রাজধানীতে একটি বন্ধু বা পরিচিত মানুষ খুজে পাইনি। একটু আশ্ৰয়, একটু সাহায্যের আশা করতে পারিনি কোথাও। দিল্লীর প্রচণ্ড গ্রীষ্মে ও শীতে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে আমি যে কিভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি তা আজ লিখতে গেলেও গা শিউরে ওঠে। কিন্তু তবুও আমি মাথা নীচু করিনি।
একটি বছরের মধ্যে রাতকে দিন করে ফেললাম। শুধু মনের জোর আর নিষ্ঠ দিয়ে অদৃষ্টের মোড় ঘুরিয়ে দিলাম। পার্লামেণ্ট হাউস বা সাউথ ব্লকের এক্সটারন্যাল অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্র থেকে বেরুবার মুখে দেখা হলে স্বয়ং প্ৰাইম মিনিস্টার আমাকে বলতেন, হাউ আর ইউ?
আমি বলতাম, ফাইন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!
তুমি ভাবছহিয়ত গুল মারছি। কিন্তু সত্যি বলছি। এমনিই হতো। একদিন আমার সেই অতীতের অখ্যাত উইকলির একটা আর্টিকেল দেখাবার জন্য তিনমূৰ্তি ভবনে গিয়েছিলাম। আর্টিকেলটা দেখাবার পর প্রাইম মিনিস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, আর ইউ নিউ টু দেলহি?
ইয়েস স্যার।
কবে এসেছ?
এইত মাস চারেক।
তারপর যখন শুনলেন আমি ঐ অখ্যাত উইকলির একশ টাকার চাকরি নিয়ে দিল্লী এসেছি, তখন প্রশ্ন করলেন, আর ইউ টেলিং এ লাই?
নো স্যার।
এই মাইনেতে দিল্লীতে টিকতে পারবে?
সার্টেনলি স্যার!
শেষে প্ৰাইম মিনিস্টার বলেছিলেন, গুড লাক টু ইউ। সী মী ফ্রম টাইম টু টাইম।
দেখতে দেখতে কত অসংখ্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো। কত মানুষের ভালবাসা পেলাম। কত অফিসার, কত এম-পি, কত মিনিস্টারের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। নিত্যনতুন নিউজ পেতে শুরু করলাম। উইকলি থেকে ডেইলীতে চাকরি পেলাম।
আমি দিল্লীতে আসার মাসিকয়েকের মধ্যেই মেমসাহেব একবার দিল্লী আসতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, না এখন নয়। একটি মুহুর্ত নষ্ট করাও এখন ঠিক হবে না। আমাকে একটু দাঁড়াতে দাও, একটু নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ দাও। তারপর এসো।
ভাবতে পার মুহুর্তের জন্য যে মেমসাহেবের স্পর্শ পাবার আশায় প্রায় কাঙালের মত ঘুরেছি, সেই মেমসাহেবকে আমি দিল্লী আসতে দিইনি। মেমসাহেব রাগ করে নি। সে উপলব্ধি করেছিল। আমার কথা। চিঠি পেলাম
ওগো, কি আশ্চৰ্যভাবে তুমি আমার জীবনে এলে, সেকথা ভাবলেও অবাক লাগে। কলেজ-ইউনিভার্সিটির জীবনে, সোশ্যালরি-ইউনিয়ন বা রবীন্দ্রজয়ন্তী-বসন্তোৎসবে কত ছেলের সঙ্গে আলাপপরিচয় হয়েছে। কাউকে তাল লেগেছে, কাউকে ভাল লাগে নি। দু’এক’জন হয়ত আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে। আশুতোষ বিল্ডিং-এর ঐ কোণার ঘরে গান-বাজনার রিহার্সাল দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মদন চৌধুরী হঠাৎ আমার ডান হাতটা চেপে ধরে ভালবাসা জানিয়েছে। বিয়ে করতেও চেয়েছে। তালতলার মোড়ের সেই যে ভাবতোলা দেশপ্রেমিক, তিনিও একদিন আত্মনিবেদন করেছিলেন আমাকে।
মুহুর্তের জন্য চমকে গেছি। কিন্তু থমকে দাঁড়াই নি। তারপর যেদিন তুমি আমার জীবনে এলে, সেদিন কে যেন আমার সব শক্তি কেড়ে নিল। কে যেন কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এই সেই।
তুমি তো জান আমি আর কোনদিকে ফিরে তাকাই নি। শুধু তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছি। তোমাকে আমার জীবনদেবতার আসরে বসিয়ে পূজা করেছি, নিজের সর্বস্ব কিছু দিয়ে তোমাকে অঞ্জলি দিয়েছি। মন্ত্র পড়ে, যজ্ঞ করে সর্বসমক্ষে আমাদের বিয়ে আজও হয় নি। কিন্তু আমি জানি তুমি আমার স্বামী, তুমি আমার ভবিষ্যত সন্তানের পিতা।
মেমসাহেব বেশী কথা বলত না কিন্তু খুব সুন্দর সুন্দর বড় বড় চিঠি লিখতে পারত। এই চিঠিটাও অনেক বড়। সবটা তোমাকে লেখার প্রয়োজন নেই। তবে শেষের দিকে কি লিখেছিল জান? লিখেছিল–…তুমি যে এমন করে আমাকে চমকে দেবে, আমি ভাবতে পারিনি। ভেবেছিলাম ঘুরে-ফিরে একটা কাগজে চাকরি যোগাড় করবে। কিন্তু এই সামান্য কমাসের মধ্যে তুমি এমন করে নিজেকে দিল্লীর মত অপরিচিত শহরে এত বড় বড় রখীমহারথীদের মধ্যে নিজেকে প্ৰতিষ্ঠা করতে পারবে, সত্যি আমি তা কল্পনা করতে পারিনি। তোমার মধ্যে যে এতটা আগুন লুকিয়ে ছিল, আমি তা বুঝতে পারিনি।…
যাই হোক তোমার গর্বে আমার সারা বুকটা ভরে উঠেছে। মনে হচ্ছে আমার চাইতে সুখী স্ত্রী আর কেউ হতে পারবে না। আমি সত্যি বড় খুশী, বড় আনন্দিত। তোমার এই সাফল্যের জন্য তোমাকে একটা বিরাট পুরস্কার দেব। কি দেব জান? যা চাইবে তাই দেব। বুঝলে? আর কোন আপত্তি করব না। আর আপত্তি করলে তুমিই বা শুনবে কেন?…
দোলাবৌদি, তুমি কল্পনা করতে পার মেমসাহেবের ঐ চিঠি পড়ে আমার কি প্রতিক্রিয়া হলো? প্ৰথমে ভেবেছিলাম দু’একদিনের জন্য কলকাতা যাই। মেমসাহেবের পুরস্কার নিয়ে আসি। কিন্তু কাজকর্ম পয়সাকড়ির হিসাবনিকাশ করে আর যেতে পারলাম না।
তবে মনে মনে এই ভেবে শান্তি পেলাম যে আমাকে বঞ্চিত করে কৃপণের মত অনেক ঐশ্বৰ্য ভবিষ্যতের জন্য অন্যায়ভাবে গচ্ছিত রেখে মেমসাহেবের মনে অনুশোচনা দেখা দিয়েছে। আমি হাজার মাইল দূরে পালিয়ে এসেছিলাম। মেমসাহেব সেই আদর, ভালবাসা, সেই মজা, রসিকতা কিছুই উপভোগ করছিল না। আমাকে যতই বাধা দিক, আমি জানতাম রোজ আমার একটু আদর না পেলে ও শান্তি পেত না। আমি বেশ অনুমান করছিলাম ওর কি কষ্ট হচ্ছে; উপলব্ধি করছিলাম। আমাকে কাছে না পাবার অতৃপ্তি ওকে কিভাবে পীড়া দিচ্ছে।
মনে মনে অনেক কষ্ট পেলেও ওর আসাটা বন্ধ করে ভালই করেছিলাম। দিল্লীতে আসার জন্য ও যে বেশ উতলা হয়েছিল সেটা বুঝতে কষ্ট হয় নি। তাইতো আরো তাড়াতাড়ি নিজেকে প্ৰস্তুত করবার জন্য আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করলাম। ঠিক করলাম ওকে এনে চমকে দেব।
ভগবান আমাকে অনেকদিন বঞ্চিত করে অনেক কষ্ট দিয়েছেন। দুঃখে অপমানে বছরের পর বছর জ্বলে।পুড়ে মরেছি। কলকাতার শহরে এমন দিনও গেছে। যখন মাত্র একটা পয়সার অভাবে সেকেণ্ড ক্লাস ট্রামে পৰ্যন্ত চড়তে পারিনি। কিন্তু কি আশ্চৰ্য। দিল্লীতে আসার পর আগের সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। সে পরিবর্তনের বিস্তৃত ইতিহাস তোমার এই চিঠিতে লেখার নয়। সুযোগ পেলে পরে শোনাব। তবে বিশ্বাস কর অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এলে আমার কর্মজীবনে। সাফল্যের আকস্মিক বন্যায় আমি নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
মাস ছয়েক পরে মেমসাহেব যখন আমাকে দেখবার জন্য দিল্লী এলো, তখন আমি সবে বোর্ডিং হাউসের মায়া কাটিয়ে ওয়েস্টার্ন কোর্টে এসেছি। নিশ্চিত জানতাম মেমসাহেব আমাকে দেখে, ওয়েস্টার্ন কোর্টে আমার ঘর দেখে, আমার কাজকর্ম, আমার জীবনধারা দেখে চমকে যাবে। কিন্তু আমি চমকে দেবার আগেই ও আমাকে চমকে দিল।
নিউদিল্লী স্টেশনে গেছি। ডিলুক্স এয়ার কণ্ডিশনড এক্সপ্রেস অ্যাটেণ্ড করতে। মেমসাহেব। আসছে। জীবনের এক অধ্যায় শেষ করে নতুন অধ্যায় শুরু করার পর ওর সঙ্গে এই প্ৰথম দেখা হবে।
লাউডস্পীকারে অ্যানাউন্সিমেণ্ট হলো, এ-সি-সি এক্সপ্রেস এক্ষুনি একনম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছবে। আমি সানগ্লাসটা খুলে রুমাল দিয়ে মুখটা আর একবার মুছে নিলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে দু’একটা টান দিতে না দিতেই ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল। এদিক-ওদিক দেখতে না দেখতেই মেমসাহেব দু নম্বর চেয়ার কার থেকে বেরিয়ে এলো।
কিন্তু একি? মেমসাহেবের কি বিয়ে হয়েছে? এত সাজগোছ? এত গহনা? মাথায় কাপড়, কপালে অতবড় সিঁদুরের টিপ।
মেসাহেবকে কোনদিন এত সাজগোছ করতে দেখিনি। গহনা? শুধু ডানহাতে একটা কঙ্কণ। ব্যাস, আর কিছু না। গলায় হার? না, তাও না। কোন এক বন্ধুর বিপদে সাহায্য করার জন্য গলায় হার দিয়েছেন। তাছাড়া মাথার কাপড় আর কপালে অতবড় একটা সি দুরের টিপ দেখে অবাক হবার চাইতে ঘাবড়ে গেলাম বেশী। মুহুর্তের জন্য পায়ের নীচে থেকে যেন মাটি সরে গেল। গলাটা শুকিয়ে এলো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দে দিল। দুনিয়াটা ওলট-পালট হয়ে গেল।
প্ৰথমে ভাবলাম স্টেশন প্ল্যাটফর্মে ঐ কয়েক হাজার লোকের সামনে ওর গালে ঠাস করে একটা চড়, মারি। বলি, আমাকে অপমান করবার জন্য এত দূরে না এসে শুধু ইনভিটেশন লেটারটা পাঠালেই তো হতো।
আবার ভাবলাম, না, ওসব কিছু করব না, বলব না।
বিশেষ কথাবার্তা না বলে সোজা গিয়ে ট্যাক্সি চড়লাম।
ট্যাক্সিতে উঠেই মেমসাহেব আমাকে প্ৰণাম করল। আমার বাঁ হাতটা টেনে নিল নিজের ডান হাতের মধ্যে। জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?
আমার কথা ছেড়ে দাও। এখন বল তুমি কেমন আছ? তোমার বিয়ে কেমন হলো? বর কেমন হলো? সর্বোপরি তুমি দিল্লী এলে কেন?
মেমসাহেব একেবারে গলে গেল, সত্যি বলছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। এমন হঠাৎ সবকিছু হয়ে গেল যে কাউকেই খবর দেওয়া হয় নি।…
ছেলেটি কেমন?
বেশ গর্বের সঙ্গে উত্তর এলো, ব্রিলিয়াণ্ট!
কোথায় থাকেন।
এইত তোমাদের দিল্লীতেই।
আমি চমকে উঠি, দিল্লিতে?
ও আমার গালটা একটু টিপে দিয়ে বলে, ইয়েস স্যার। তবে কি আমার বর আদি সপ্তগ্রাম বা মছলন্দপুর থাকবে?
ট্যাক্সি কনটপ্লেস ঘুরে জনপদে ঢুকে পড়ল। আর এক মিনিটের মধ্যেই ওয়েস্টার্ন কোর্ট এসে যাবে। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কোথায় যাবে?
কোথায় আবার? তোমার ওখানে।
ট্যাক্সি ওয়েস্টার্ন কোর্টে ঢুকে পড়ল। থামল। আমরা নোমলাম। তাড়া মিটিয়ে ছোট্ট সুটকেসটা হাতে করে ভিতরে ঢুকলাম। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে লিফট্-এ চড়লাম। তিন তলায় গেলাম। আমার ঘরে এলাম।
মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে দু’হাত দিয়ে মেমসাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আঃ কি শান্তি।
আমার বুকটা জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল। ওর সিথিতে সিন্দুর না দেখে বুঝলাম…
এবার আমিও আর স্থির থাকতে পারলাম না। দু’হাত দিয়ে টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। আদর করে, ভালবাসা দিয়ে ওকে। ক্ষতবিক্ষত করে দিলাম। আমি। মেমসাহেবও তার উন্মত্ত যৌবনের জোয়ারে আমাকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমার দেহে, মনে ওর ভালবাসা, আবেগ উচ্ছলতার পলিমাটি মাখিয়ে দিয়ে গেল। আমার মন আরো উর্বরা হলো।
এতদিন পরে দুজনে দুজনকে কাছে পেয়ে প্ৰায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম। কতক্ষণ যে ঐ জোয়ারের জলে ডুবেছিলাম, তা মনে নেই। তবে সম্বিত ফিরে এলো, দরজায় নক করার আওয়াজ শুনে। তাড়াতাড়ি দুজনে আলাদা হয়ে বসলাম। আমি বললাম, কোন?
ছোট সাব, ম্যায়।
ও জিজ্ঞেসা করল, কে?
আমি বললাম, গজানন।
উঠে গিয়ে দরজা খুলে ডাক দিলাম, এসো, ভিতরে এসে। মেমসাহেবকে দেখেই গজানন দু’হাত জোড় করে। প্ৰণাম করল, নমস্তে বিবিজি!
ও একটু হাসল। বলল, নমস্তে।
আমি বললাম, গজানন, বিবিজিকে কেমন লাগছে? বহুত আচ্ছা, ছোট সাব। এক সেকেণ্ড। পরে আবার বলল, আমার ছোট-সাহেবের বিবি কখনও খারাপ হতে পারে?
আমরা দুজনেই হেসে ফেলি। মেমসাহেব বলল, গজানন, বাবুজি প্ৰত্যেক চিঠিতে তোমার কথা লেখেন।
গজানন দু’হাত কচলে বলে, ছোটসাবকা মেহেরবানি।
আমি উঠে গিয়ে গজাননের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলি, জান মেমসাহেব, গজানন আমার লোক্যাল বস। আমার গার্ডিয়ান।
কিয়া করেগা বিবিজি, বাতাও। ছোটসাব এমন বিশ্ৰী কাজ করে যে কোন সময়ের ঠিক ঠিকানা নেই। তারপর কিছু সংসারী বুদ্ধি নেই। আমি না দেখলে কে দেখবে বল? গজানন প্ৰায় খুনী আসামীর মত ভয়ে ভয়ে জেরার জবাব দেয়।
গজানন এবার মেমসাহেবকে জিজ্ঞাসা করে, বিবিজি, ট্রেনে কোন কষ্ট হয় নি তো?
মেমসাহেব বললো, না, না, কষ্ট হবে কেন? গজানন চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের দুজনের ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। ব্রেকফাস্টের ট্রে নামিয়ে রেখে গজানন চলে যায়, আমি যাচ্ছি। একটু পরেই আসছি।
গজানন চলে যাবার পর আমি মেমসাহেবের কোলে শুয়ে পড়লাম। আর ও আমাকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিতে লাগল।
দোলাবৌদি, মেমসাহেব। আর আমি অনেক কাণ্ড করেছি। বাঙালী হয়েও প্রায় হলিউড ফিল্মে অভিনয় করেছি। শেষপর্যন্ত অবশ্য শরৎ চাটুজ্যের হিটু বই-এর মত হয়ে গেছে। আস্তে, আস্তে, ধীরে ধীরে সব জানবে। বেশী ব্যস্ত হয়ে না।