ফ্রান্সের বেতারবাণী আরম্ভ হয় ইসি পারি অর্থাৎ হেথায় প্যারিস দিয়ে। কাবুল ইয়োরোপীয় কোনো জিনিস নকল করতে গেলে ফ্রান্সকে আদর্শরূপে মেনে নেয় বলে কাবুল রেডিয়ো দুই সন্ধ্যা আপন অভিজ্ঞান-বাণী প্রচারিত করে ইন্ জা কাবুল অর্থাৎ হেথায় কাবুল বলে।
মোটরেও বেতারবাণী হল ইন্ জা কাবুল। কিন্তু তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে বলে বেতারযোগে প্যারিস অথবা কাবুলের যতটা দেখবার সুবিধা হয়, আমার প্রায় ততটাই হল।
হেডলাইটের জোরে কিছু যে দেখব তারও উপায় ছিল না। পূর্বেই বলেছি বাসখানার মাত্র একটি চোখ— সাঁঝের পিদিম দেখাতে গিয়ে সর্দারজী তার উপর আবিষ্কার করলেন যে, সে চোখটিও খাইবারের রৌদ্রদাহনে গান্ধারীর চোখের মত কানা হয়ে গিয়েছে। সর্দারজীর নিজের জন্য অবশ্য বাসের কোনো চোখেরই প্রয়োজন ছিল না, কারণ তিনি রাতকানা। কিন্তু রাস্তার পঁয়তাল্লিশ নম্বরীদের উপকারের জন্য প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে একটা হারিকেন যোগাড় করা হল। হ্যাণ্ডিম্যান সেইটে নিয়ে একটা মাডগার্ডের উপর বসল।
আমি সভয়ে সর্দারজীকে জিজ্ঞেস করলুম, হারিকেনের সামান্য আলোতে আপনার মোটর চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না তো?
সর্দারজী বললেন, হচ্ছে বই কি, আলোটা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ওটা না থাকলে গাড়ি জোর চালাতে পারতুম। মনে পড়ল, দেশের মাঝিরাও অন্ধকার রাত্রে নৌকার সম্মুখে আলো রাখতে দেয় না।
কিন্তু ভাগ্য-বিধাতা অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তো কবি তারই হাতে গোটা দেশটার ভার ছেড়ে দিয়ে গেয়েছেন–
পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থা।
যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী,
হে চির-সারথি, তব রথচক্রে
মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
কিন্তু কবির তুলনায় দার্শনিক ঢের বেশী হুশিয়ার হয়। তাই বোধ হয় কবির হাতে রাষ্ট্রের কি দুরবস্থা হতে পারে, তারই কল্পনা করে প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে ভালো মন্দ সব কবিকেই অবিচারে নির্বাসন দিয়েছিলেন।
এ সব তত্ত্বচিন্তা না করা ছাড়া তখন অন্য কোনো উপায় ছিল না। যদিও কাবুল উপত্যকার সমতল ভূমি দিয়ে তখন গাড়ি চলেছে তবু দুটো একটা মোড় সব সময়েই থাকার কথা। সে সব মোড় নেবার সময় আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করছিলুম এবং সেই খবরটি সর্দারজীকে দেওয়াতে তিনি যা বললেন, তাতে আমার সব ডর ভয় কেটে গেল। তিনি বললেন, আম্মা চোখ বন্ধ করি। শুনে আমি যা চোখ বন্ধ করলুম তার সঙ্গে গান্ধারীর চোখ বন্ধ করার তুলনা করা যায়।
সে যাত্রা যে কাবুলে পৌঁছতে পেরেছিলুম তার একমাত্র কারণ বোধ হয় এই যে, রগরগে উপন্যাসের গোয়েন্দা শত বিপদেও মরে না— ভ্রমণকাহিনী-লেখকের জীবনেও সেই সূত্র প্রযোজ্য।
গুমরুক বা কাস্টম-হাউস তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে–বিছানাখানা পর্যন্ত ছাড়ল না। টাঙ্গা নিয়ে ফরাসী রাজদূতাবাসের দিকে রওয়ানা হলুম–কাবুল শহরে আমার একমাত্র পরিচিত ব্যক্তি সেখানেই থাকতেন। শান্তিনিকেতনে তিনি আমার ফার্সীর অধ্যাপক ছিলেন ও তখন ফরাসী রাজদূতাবাসে কর্ম করতেন।
টাঙ্গা তিন মিনিট চলার পরেই বুঝতে পারলুম মস্কো রেডিয়ো কোন্ ভরসায় তাবৎ দুনিয়ার প্রলেতারিয়াকে সম্মিলিত হওয়ার জন্য ফতোয়া জারি করে। দেখলুম, কাবুল শহরে আমার প্রথম পরিচয়ের প্রলেতারিয়ার প্রতীক টাঙ্গাওয়ালা আর কলকাতার গাড়িওয়ালায় কোনো তফাত নেই। আমাকে উজবুক পেয়ে সে তার কর্তব্য শেয়ালদার কাপ্তেনদের মত তখনি স্থির করে নিয়েছে।
বেতারওয়ালা তাকে পই পই করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ফরাসী দূতাবাস কি করে যেতে হয়, সেও বার বার চশ, বস ও চশম অর্থাৎ আমার মাথার দিব্যি, আপনার তামিল এবং হুকুম আমার চোখের জ্যোতির ন্যায় মূল্যবান ইত্যাদি শপথ-কসম খেয়েছিল, কিন্তু কাজের বেলায় দু মিনিট যেতে না যেতেই সে গাড়ি দাড় করায়, বেছে বেছে কাবুল শহরের সবচেয়ে আকাট মূর্খকে জিজ্ঞাসা করে ফরাসী দূতাবাস কি করে যেতে হয়।
অনেকে অনেক উপদেশ দিলেন। এক গুণী শেষটায় বললেনফরাসী রাজদূতাবাস? সে তো প্যারিসে। যেতে হলে—
আমি বাধা দিয়ে বললুম, বোম্বাই গিয়ে জাহাজ ধরতে হয়। চল হে টাঙ্গাওয়ালা, পেশোয়ার অথবা কান্দাহার–যেটা কাছে পড়ে। সেখান থেকে বোম্বাই।
টাঙ্গাওয়ালা ঘড়েল। বুঝল,
বাঙাল বলিয়া করিয়ো না হেলা,
আমি ঢাকার বাঙাল নহি গো
তখন সে লব-ই-দরিয়া, দেহ-আফগানান, শহর-আরা হয়ে ফরাসী রাজদূতাবাস পৌঁছল। কাবুল শহর ছোট কম করে তিনবার সে আমাকে ঐ রাস্তা দিয়ে আগেই নিয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে পাহাড়–এর চেয়ে প্যাচালো কেপ অব, গুড হোপ চেষ্টা করলেও হয় না।
আমি কিছু বললে এতক্ষণ ধরে সে এমন ভাব দেখাচ্ছিল যে আমার কঁচা ফার্সী সে বুঝতে পারে না। এবার আমার পালা। ভাড়া দেবার সময় সে যতই নানারকম যুক্তিতর্ক উত্থাপন করে আমি ততই বোকার মত তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাই আর একঘেয়ে আলোচনায় নূতনত্ব আনবার জন্য তার খোলা হাত থেকে আমারই দেওয়া দুচার আনা কমিয়ে নিই। সঙ্গে সঙ্গে আমার ভাঙ্গা ফার্সীকে একদম ক্ষুদ্র বানিয়ে দিয়ে, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলি, বুঝেছি, বুঝেছি, তুমি ইমানদার লোক, বিদেশী বলে না জেনে বেশী দিয়ে ফেলেছি, অত বেশী নিতে চাও না। মা শা আল্লা, সোন আল্লা, খুদা তোমার জিন্দেগী দরাজ করুন, তোমার বেটাবেটির।
পয়সা সরালেই সে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, আল্লা রসুলের দোহাই কাড়ে, আর ইমান-ইনসাফ সম্বন্ধে সাদী-রুমীর বয়েৎ আওড়ায়। এমন সময় অধ্যাপক বগদানফ এসে সব কিছু রফারফি করে দিলেন।
যাবার সময় সে আমাকে আর এক দফা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত মেপে নিয়ে, অত্যন্ত মোলায়েম ভাষায় শুধাল, আপনার দেশ কোথায়?
বুঝলুম, গয়ার পাণ্ডার মত। ভবিষ্যৎ সতর্কতার জন্য।
কে বলে বাঙালী হীন? আমরা হেলায় লঙ্কা করিনি জয়?
রাতের বেলাই বগদানফ সায়েবের সঙ্গে আলাপ করার সুবিধা। সমস্ত রাত ধরে পড়াশোনা করেন, আর দিনের বেলা যতটা পারেন ঘুমিয়ে নেন। সেই কারণেই বোধ হয় তিনি ভারতবর্ষের সব পাখির মধ্যে পেঁচাকে পছন্দ করতেন বেশী। শান্তিনিকেতনে তিনি যে ঘরটায় ক্লাশ নিতেন, নন্দবাবু তারই দেয়ালে একটা পেঁচা একে দিয়েছিলেন। বগদান সায়েব তাতে ভারি খুশী হয়ে নন্দবাবুর মেলা তারিফ করেছিলেন।
বগদান জাতে রুশ, মস্কোর বাসিন্দা ও কট্টর জারপন্থী। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের সময় মস্কো থেকে পালিয়ে আজরবাইজান হয়ে তেহরান পৌঁছান। সেখান থেকে বসরা হয়ে বোম্বাই এসে বাসা বাঁধেন। ভালো পেহলেভী বা পৰী জানতেন বলে বোম্বায়ের জরথুস্ত্রী কামা-প্রতিষ্ঠান তাকে দিয়ে সেখানে অনেক পুথিপত্রের অনুবাদ করিয়ে নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে রুশ পণ্ডিতদের দুরবস্থায় সাহায্য করবার জন্য এক আন্তর্জাতিক আহ্বানে ভারতবর্ষের পক্ষ থেকে সাড়া দেন এবং বোম্বায়ে বগদানফের সঙ্গে দেখা হলে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই তাকে ফার্সীর অধ্যাপকরূপে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন।
১৯১৭ সালের পূর্বে বগদানফ রুশের পররাষ্ট্রবিভাগে কাজ করতেন ও সেই উপলক্ষ্যে তেহরানে আট বৎসর কাটিয়ে অতি উৎকৃষ্ট ফার্সী শিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন পরবর্তী কালে ইরান যান, তখন সেখানে ফার্সীর জন্য অধ্যাপক অনুসন্ধান করলে পণ্ডিতেরা বলেন যে, ফার্সী পড়াবার জন্য বাগদানফের চেয়ে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত পাওয়া অসম্ভব। কাবুলের অন্য জহুরীদের মুখেও আমি শুনেছি যে, আধুনিক ফার্সী সাহিত্যে বগদানফের লিখনশৈলী আপন বৈশিষ্ট্য দেখিয়ে বিদগ্ধ জনের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছে।
ইউরোপীয় বহু ভাষা তো জানতেনই— তাছাড়া জগতাই, উসমানলী প্রভৃতি কতকগুলো অজানা অচেনা তুর্কী ভাষা উপভাষায় জবরদস্ত মৌলবীও ছিলেন। কাবুলের মত জগাখিচুড়ি শহরের দেশী বিদেশী সকলের সঙ্গেই তিনি তাদের মাতৃভাষায় দিব্য স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারতেন।
একদিকে অগাধ পাণ্ডিত্য, অন্যদিকে কুসংস্কারে ভর্তি। বাঁ দিকে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের চাঁদ দেখতে পেয়েছেন না তো গোখনোর ফণায় যেন পা দিয়েছেন। সেই দুর্ঘটনার তিন মাস পরেও যদি তাঁর পেয়ারা বেরাল বমি করে, তবে ঐ বাঁ কাঁধের উপর দিয়ে অপয়া চাঁদ দেখাই তার জন্য দায়ী। মইয়ের তলা দিয়ে গিয়েছ, হাত থেকে পড়ে আরশি ভেঙে গিয়েছে, চাবির গোছা ভুলে মেজের উপর রেখেছিলে— আর যাবে কোথায়, সে রাত্রে বগদানফ সাহেব তোমার জন্য এক ঘণ্টা ধরে আইকনের সামনে বিড়বিড় করে নানা মন্ত্র পড়বেন, গ্রীক অর্থডক্স চার্চের তাবৎ সেন্টদের কাছে কান্নাকাটি করে ধন্না দেবেন, পরদিন ভোরবেলা তোমার চোখে মুখে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিয়ে তিন বৎসর ধরে অপেক্ষা করবেন তোমার কাছ থেকে কোনো দুঃসংবাদ পাবার জন্য। তিন বছর দীর্ঘ মিয়াদ, কিছু-নাকিছু একটা ঘটবেই। তখন বাড়ি বয়ে এসে বগদানফ সায়েব তোমার সামনে মাথা নিচু করে জানুতে হাত রেখে বসবেন, মুখে ঐ এক কথা বলিনি, তখনি বলিনি?
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, বড় বড় সাধক মহাপুরুষ যেন এক একটা কাঠের গুড়ি হয়ে ভেসে যাচ্ছেন। শত শত কাক তারই উপরে বসে বিনা মেহন্নতে ভবনদী পার হয়ে যায়।
বগদানফের পাল্লায় পড়লে তিন দিনে দুনিয়ার কুল্লে কুসংস্কারের সম্পূর্ণ তালিকা আপনার মুখস্থ হয়ে যাবে, এক মাসের ভিতর সেগুলো মানতে আরম্ভ করবেন, দুমাসের ভিতর দেখতে পাবেন, বগদানফ-কাঠের গুড়িতে আপনি একা নন, আপনার এবং সায়েবের পরিচিত প্রায় সবাই তার উপরে বসে বসে ঝিমোচ্ছন। ঘোর বেলেল্লা দু-একটা নাস্তিকের কথা অবিশ্যি আলাদা। তারা প্রেম দিলেও কলসীর কানা মারে।।
দয়ালু বন্ধুবৎসল ও সদানন্দ পুরুষ। তার মুক্ত হস্তের বর্ণনা করতে গিয়ে ফরাসী অধ্যাপক বেনওয়া বলেছিলেন, ইল আশেৎ লে মাশিন আ পের্সে লে মাকারনি। অর্থাৎ মাকারনি ফুটো করার জন্য তিনি মেশিন কেনেন। সোজা বাঙলায় কাকের ছানা কেনেন।
কাবুলের বিদেশী দুনিয়ার কেন্দ্রস্থল ছিলেন বগদানফ সায়েব একটি আস্ত প্রতিষ্ঠান বললেও অত্যুক্তি হয় না। তাই তার সম্বন্ধে এত কথা বলতে হল।