ফরিদার চোখ দু’টি আজ যেন উজ্জ্বল আরো তীক্ষ্ণ। চুলার গানগনে কয়লার মত ঝকঝকি করছে। তার পরনের শাড়িটাও লাল। মাথার চুলগুলিও কেন জানি লালচে দেখাচ্ছে। শুধু মুখের চামড়া আরো হলুদ হয়েছে। এমন হলুদ যে মনে হয় হাত দিয়ে ছুঁলে হাতে হলুদ রঙ লেগে যাবে। ফরিদা বললেন, বস তিথি। চেয়ার টেনে বস।
তিথি বলল, আপনি আমাকে ডেকেছেন?
ফরিদা চুপ করে রইলেন তবে খুব আগ্রহ নিয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর জ্বলজ্বলে চোখের মণিতে এক ধরনের কৌতুক। এক সময় হাসিমুখে বললেন, তুমি কি চোখে কাজল দিয়েছ না-কি?
তিথি শান্ত স্বরে বলল, হ্যাঁ দিয়েছি। কেন, আমার মত মেয়ের কি চোখে কাজল দেয়া নিষেধ?
ফরিদা তিথির প্রশ্নের প্রতি মোটেই গুরুত্ব দিলেন না। নিজের মনে বললেন, বিয়ের আগে আমারও চোখে কাজল দেয়ার সখ ছিল। খুব কাজল দিতাম। এক’দিন আমার মামা আমাকে বললেন, চোখে কাজল দেয়া ঠিক না। কাজল হচ্ছে কারবন। কারবনের সূক্ষ্ম কণা চোখের ক্ষতি করে। ঐ মামার কথা আমরা খুব বিশ্বাস করতাম…
তিথি ফরিদাকে থামিযে বলল, আপনি আমাকে কি জন্যে ডেকেছেন?
গল্প করার জন্যে। কেন তুমি কি রাগ করছ? আমি পুষিয়ে দেব।
কিভাবে পুষিয়ে দেবেন? গল্পের শেষে টাকা দেবেন ঘণ্টা হিসেবে?
ফরিদা হেসে ফেললেন। যেন তিথি খুব মজার কিছু বলেছে। তিথি বিস্মিত হল। ফরিদা কেন হেসে ফেলেছে তা বুঝতে না পেরে খানিকটা বিব্রত ও বোধ করল।
ফরিদা বললেন, ঐ দিন তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। তারপব থেকে আমার মনটা খারাপ ছিল। নিজের পরিচিত মানুষজন, আত্মীয়-স্বজন যদি রাগ করে আমার খারাপ লাগে না। তুমি বাইরের একটি মেয়ে। তুমি কেন আমার ওপর রাগ করবে?
আপনি কি এটা বলার জন্যে ডেকেছেন?
হ্যাঁ। আমার আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে। সেটা তোমাকে পরে বলছি। তার আগে তোমার জন্যে একটা ধাঁধা আছে। এখানে একটা ছবি আছে। এই ছবিতে তিনটি মেয়ে বসে আছে। এই তিনজনের একজন আমি। সেই একজন কে তুমি বের করে দেবে।
যদি বের করতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই টাকা-পয়সা দেবেন?
তুমি চাইলে দেব। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে এমন কঠিন ভাষায় কথা বলছ কেন? খানিকক্ষণ সহজভাবে আমার সঙ্গে কথা বল। অসুস্থ একজন মানুষের এই কথাটা রাখ।
তিথি ছবিটা হাতে নিল। দেখেই মনে হচ্ছে তিন স্কুল বান্ধবী কোনো উপলক্ষে প্রথম শাড়ি পরেছে। তিনজনই হাত ধরাধরি করে বসে আছে। পেছনে গোলাপ ঝাড়ে অনেক গোলাপ ফুটে আছে। ফটোগ্রাফার নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে এই কম্পোজিশন বের করেছেন।
দেরি করছ কেন? বল কোন মেয়েটি আমি?
বলতে পারছি না।
মেয়েগুলি দেখতে কেমন?
রূপবতী।
কি রকম রূপবতী সেটা বল।
খুব রূপবতী।
এই তিনটি মেয়ের মধ্যে আর কোনো মিল দেখতে পাঁচ্ছ?
না!
খুব ভাল করে দেখা। আলোর কাছে নিয়ে দেখ।
আমি আর কোনো মিল দেখতে পাচ্ছি না। তিনটি মেয়ের মুখ তিন রকমের।
আরেকটা মিল আছে। এই তিনজনের চিবুকের কাছে তিল আছে। ছবিতেও বোঝা যায় আমরা খুব বন্ধু ছিলাম। গলায় গলায় বন্ধু। ধর আমাদের মধ্যে একজনের অসুখ হয়েছে সে স্কুলে যায়নি। আমরা দু’জন স্কুলে গিয়ে যখন দেখতাম একজন আসেনি তখন আমরাও স্কুল ফেলে বাসায় চলে আসতাম।
আপনাদের চিবুকে তিল ছিল বলেই আপনাদের এত বন্ধুত্ব ছিল?
শুধু তিল না। আরো অনেক মিল ছিল আমাদের মধ্যে। আমরা তিনজনই বেশ ভাল ছাত্রী ছিলাম। একজন তো ছিল খুবই ভাল ছাত্রী। স্কুলে বরাবর ফাস্ট সেকেন্ড হত। অথচ ম্যাট্রিক রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল। তিনজনই সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছি।
তাই নাকি?
কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ার সময়ই তিনজনের বিয়ে হয়ে গেল। তার পরেও মিল আছে। বল তো মিলটা কি?
আপনারা তিনজনই এখন অসুস্থ?
না। দু’জন মারা গেছে। আমি শুধু বেঁচে আছি। এই বাঁচা তো মৃত্যুর মতই। তাই না?
হ্যাঁ তাই! আপনার ঐ দুই বান্ধবী কিভাবে মারা গেলেন?
প্রথম মারা গেল তৃণা। বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেল। তারপর মারা গেল বরুনা। ম্যানিনজাইটিস হয়েছিল।
কথা বলতে বলতে ফরিদা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। হাতের ইশারায় তিনি তিথিকে পানির গ্লাস আনতে বললেন। তিথি পানি এনে দিল। সবটা খেতে পারলেন না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। তিথি বলল, আপনার কি কষ্ট হচ্ছে?
হ্যাঁ।
কোনো ওষুধপত্র কি আছে যা খেলে কষ্ট কমবে?
না।
আমি কি চলে যাব? নাকি আপনি আমাকে আরো কিছু বলবেন?
ফরিদা চোখ না মেলেই বললেন, যাও।
তিথি বলল, আপনার কি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?
হুঁ।
আমি বরং আপনার পাশে বসে থাকি। ব্যথা যখন আরেকটু কমবে তখন যাব।
ব্যথা কমবে না। তুমি যাও।
তিথি উঠে দাঁড়াতেই ফরিদা বললেন, একটু বস। তিথি বসল না। দাঁড়িয়ে রইল। ফরিদা চোখ মেলে তাকালেন। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, তোমার নিচের চিবুকেও তিল আছে এটা কি তুমি কখনো লক্ষ্য করেছ? তিথি কিছু বলল না। ফরিদা কঠিন কণ্ঠে বললেন, তোমার ভাগ্য ও আমার মতই হবে।
হলে কি আপনি খুশি হন?
না খুশি হই না।
তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তার বন্ধ চোখের পাতা উপচে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। মানুষের মন বড় বিচিত্র। তিথি ফরিদার চোখের পানি দেখে হঠাৎ অভিভূত হয়ে গেল। তার নিজের বুক ঠেলে কান্না উঠে আসতে লাগল।
ফরিদা বললেন, তুমি কি একটু অজন্তার বাবাকে ডেকে আনবে? পাঁচটার মধ্যে সে আসে। এখন পাঁচটা দশ বাজে। সে নিচে আছে।
তিথি দবির উদ্দিনকে পেল না। বসার ঘরে অজন্তা একা একা বসে ছিল। সে বলল, বাবা ছিলেন, আপনি এসেছেন শুনে শার্ট গায়ে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। বলতে বলতে অজন্তা মুখ টিপে হাসল। এবং একটু যেন লজ্জাও পেল। এই লজ্জার কারণ তার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়।