১৩. প্লাতনের মতবাদের উৎস
আধুনিক মধ্য কিংবা প্রাচীন যুগ নির্বিশেষে সমস্ত দার্শনিকদের ভিতর প্লাতন এবং আরিস্ততেলেস ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রভাবসম্পন্ন, পরবর্তী যুগে দুজনের মধ্যে প্লাতনেরই প্রভাব ছিল অধিক। দুটি কারণে আমার এ কথা বলা- প্রথমত, আরিস্ততেলেস নিজে প্লাতনেরই পরিণতি, দ্বিতীয়ত, অন্ততপক্ষে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিষ্টিয় দর্শন এবং ধর্মতত্ত্ব যতটা প্লাতনীয় ছিল ততটা অরিস্ততেলেসীয় ছিল না। সেইজন্য দার্শনিক চিন্তাধারার ইতিহাসে প্লাতন সম্পর্কে এবং স্বল্পাধিক পরিমাণে আরিস্ততেলেস সম্পর্কে তাঁদের পূর্বজদের কিংবা অনুজদের তুলনায় পূর্ণাঙ্গতর আলোচনা করা অবশ্য প্রয়োজনীয়।
প্লাতনের দর্শনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো- প্রথমত, তাঁর স্বপ্নরাজ্য (Utopia), এটা ছিল তাঁর দীর্ঘ ধারাবাহিক রচনাসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম। দ্বিতীয়ত, ধারণা সম্পর্কীয় তত্ত্ব- এ তত্ত্ব সার্বিক (universal- সামান্য?) সম্পর্কীয় সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাগুলোর পথিকৃৎ, এ সমস্যা এখনও অমীমাংসিত। তৃতীয়ত, অমরত্ব সম্পর্কে তাঁর যুক্তি। চতুর্থত, তাঁর সৃষ্টিরহস্য। পঞ্চমত, জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর কল্পন অর্থাৎ সমস্ত জ্ঞানই স্মৃতি, অনুভূতি নয়। এর কোনো বিষয় সম্পর্কে আলোচনার প্রাক্কালে আমি তাঁর জীবনের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলব এবং যে সমস্ত প্রভাব তাঁর রাজনৈতিক এবং দার্শনিক মতবাদ নির্ধারিত করেছিল বলব সে সম্পর্কেও।
৪২৮-৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্লাতনের জন্ম, পেলপনেশীয় যুদ্ধের প্রথম দিকে। তিনি ছিলেন ত্রিশজন স্বৈরাচারী শাসকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানারকম লোকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একজন সচ্ছল অভিজাত। আথিনা যখন পরাজিত হয় তখন তিনি তরুণ এবং পরাজয়ের জন্য গণতন্ত্রকে দায়ী করেন তাঁর পরিবারের সামাজিক অবস্থান এবং তাঁর পারিবারিক সম্পর্কের ফলে গণতন্ত্রকে তাঁর অপছন্দ করার সম্ভাবনা ছিল। তিনি ছিলেন সাতেসের একজন ছাত্র, সক্রাতেসকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। সক্রাতেসকে হত্যা করেছিল গণতন্ত্র। সুতরাং তাঁর আদর্শ কমনওয়েলথ (সাধারণতন্ত্র)-এর অস্পষ্ট আভাসের জন্য তিনি যে স্পার্তার দিকে ঝুঁকবেন তাতে আশ্চার্য হওয়ার কিছু নেই। ভবিষ্যৎ যুগকে প্রতারিত করতে পারে এমন অনুদার প্রস্তাবকে সুসজ্জিত করে পরিবেশন করার শিল্প তার আয়ত্তে ছিল। রিপাবলিক পুস্তকের প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে কী জড়িত সেটা না জেনেই লোকে যুগ যুগ ধরে রিপাবলিকের প্রশংসা করে গেছে। প্লাতনকে প্রশংসা করা সবসময়ই ঠিক কাজ বলে মনে করা হয়েছে কিন্তু তাকে বোঝা নয়। বিরাট পুরুষদের ভাগ্যে সাধারণত এরকম হয়ে থাকে। আমার উদ্দেশ্য ঠিক বিপরীত। আমি তাঁকে বুঝতে চাই কিন্তু আধুনিক ইংরেজ কিংবা আমেরিকান স্বৈরতন্ত্রের একজন প্রবক্তার প্রতি আমার যতটুকু শ্রদ্ধা থাকতে পারে বিচারকালে তাঁকে ততটুকু মাত্র সম্মান প্রদর্শন করব।
প্লাতনের উপর বিশুদ্ধ দার্শনিক প্রভাবগুলো এমনই ছিল যা তাঁকে স্পার্তার অনুকূল করে তোলে। এই প্রভাবগুলো ছিল মোটামুটিঃ পীথাগোরাস, পার্মেনিদেস, হেরাক্লিডস এবং সক্রাতেস।
পীথাগোরাস থেকে প্লাতন পেয়েছিলেন তাঁর দর্শনের অফীয় উপাদান (হয়তো সক্রাতেসের মাধ্যমে, হয়তো নয়)ঃ ধর্মীয় প্রবণতা, অমরত্বে বিশ্বাস, অপার্থিব চিন্তা, পুরোহিতসুলভ সুর এবং গুহার উপমার সঙ্গে যতকিছু জড়িত আছে সেগুলো, তাছাড়াও গণিতশাস্ত্র সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা এবং তাঁর বুদ্ধির সঙ্গে অতীন্দ্রিয়বাদের ঘনিষ্ঠ সংমিশ্রণ করা।
পার্মেনিদেসের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন এই বিশ্বাস যে, বাস্তব চিরন্তন ও কালনিরপেক্ষ এবং যুক্তি অনুসারে সমস্ত পরিবর্তনই মায়া।
হেরাক্লিডসের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন অপরা (negative) মতবাদ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্বে চিরস্থায়ী কিছু নেই। এর সঙ্গে পার্মেনিদেসের মতবাদ যুক্ত করে এই সিদ্ধান্ত এসেছিলেন যে, জ্ঞান আহরিত হয় বুদ্ধি দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে নয়। এই মতবাদও আবার পীথাগোরীয় মতবাদের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে গিয়েছিল।
সক্রাতেসের কাছ থেকে সম্ভবত তিনি নৈতিকতা নিয়ে তাঁর নিবিষ্টচিত্ততা শিখেছিলেন এবং তাঁর প্রবণতা ছিল অধিযান্ত্রিক ব্যাখ্যা না খুঁজে জগতের উদ্দেশ্যবাদী ব্যাখ্যা খোঁজা। শুভ। (The Good) তার চিন্তাকে অধিকার করে রাখত প্রাক সাতেসের যুগের চেয়েও অধিকভাবে এবং এই তথ্য সক্রাতেসের প্রভাবের জন্য নয় এটা মনে করা কঠিন।
এই সবের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদের কী সম্পর্ক?
প্রথমত, শুভত্ব (Goodness) এবং বাস্তবতা কালনিরপেক্ষ হওয়ায় সেই রাষ্ট্রই সর্বোত্তম- সে রাষ্ট্র স্বর্গীয় প্রতিরূপের নিকটতম অর্থাৎ তাতে পরিবর্তনের পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন এবং নিখুঁত স্থিরত্ব থাকবে সর্বাধিক ও তার শাসক তাঁরাই হবেন যারা শাশ্বত শুভকে সবচাইতে ভালো বোঝেন।
দ্বিতীয়ত, অন্যান্য অতীন্দ্রিয়বাদীদের মতো প্লাতনেরও বিশ্বাসের কেন্দ্রে ছিল একটি নিশ্চয়তা, সে নিশ্চয়তা একমাত্র একধরনের জীবনযাত্রা ছাড়া কোনোভাবেই অপরকে জানানো সম্ভব নয়। পুথাগোরীয়রা চেষ্টা করেছিলেন দীক্ষিতদের (initiate) শাসন প্রবর্তন করতে এবং প্লাতনের যা ইচ্ছা ছিল তা মূলত এটাই। উত্তম রাষ্ট্রনেতা হতে গেলে তাকে অবশ্যই জানতে হবে শুভ কাকে বলে, সেটা করার একমাত্র উপায় বৌদ্ধিক এবং নৈতিক নিয়মানুবর্তিতার সমন্বয়ে। যারা এই নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা পাননি তাঁদের যদি দেশ শাসনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় তাহলে তাঁরা শাসন ব্যবস্থাতে দুর্নীতি আনবেন- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
তৃতীয়ত, প্লাতনের নীতি অনুসারে একজন ভালো শাসক হতে গেলে যথেষ্ট শিক্ষা প্রয়োজন। আমাদের মনে হয় ভালো রাজ্য তৈরি করার জন্য সুরাকুজে-র (Syracuse) স্বৈরাচারী ঘোট দিওনিসিয়স (Dianysius) কে শিখতে জবরদস্তি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় কিন্তু প্লাতনের মত অনুসারে এ শিক্ষা অবশ্য প্রয়োজনীয়। গণিতশাস্ত্র ছাড়া কোনো সত্যকার প্রজ্ঞা সম্ভব নয়-এ বিশ্বাস হওয়ার মতো যথেষ্ট পুথাগোরীয় শিক্ষা তাঁর ছিল। এ বিশ্বাসের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো নির্দিষ্ট অল্পসংখ্যক ব্যক্তি দ্বারা শাসন পরিচালনা।
চতুর্থত, গ্রিকের অধিকাংশ দার্শনিকদের মতো প্লাতনেরও ধারণা ছিল প্রজ্ঞা (wisdom)-র জন্য অবসর অত্যাবশ্যক, সুতরাং যারা পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করেন তাঁদের প্রজ্ঞা থাকার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যাদের নিজস্ব আর্থিক সঙ্গতি আছে প্রজ্ঞা থাকার সম্ভাবনা শুধুমাত্র তাঁদেরই কিংবা যাদের জীবনধারণের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করছে-তাঁদের। এ দৃষ্টিভঙ্গি মূলত অভিজাতশ্রেণির।
আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্লাতনকে বিচার করলে দুটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। প্রথমটি, প্রজ্ঞা বলে কোনো পদার্থ আছে কি? দ্বিতীয়টি, যদি ধরে নেওয়া যায় আছে, তবে এমন কোনো সংবিধান তৈরি করা কি সম্ভব যে সংবিধানে প্রজ্ঞাবানেরাই রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবেন?
প্রস্তাবিত অর্থে প্রজ্ঞা কোনো বিশেষ কারিগরি কুশলতা নয়, যেমন থাকে পাদুকা প্রস্তুতকারী, চিকিৎসক কিংবা সামরিক কৌশল উদ্ভাবকের। প্রজ্ঞা হবে আরও সার্বিক একটা কিছু। কারণ, প্রজ্ঞার অধিকারী হলেই মানুষ জ্ঞান ও বুদ্ধিসম্পন্ন শাসক হবে। মনে হয়, প্লাতন হয়তো বলতেন, এ হলো শুভ সম্পর্কে জ্ঞান এবং এই সংজ্ঞাকে তিনি পরিপূরণ করতেন সক্রাতেসীয় মতবাদ দিয়ে অর্থাৎ জ্ঞাতসারে কেউ পাপ করে না- এ থেকে প্রসূত হয় যে, শুভ সম্বন্ধে যার জ্ঞান আছে সে নির্ভুল কাজ করে। আমাদের কাছে এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তব থেকে বহু দূরে অবস্থিত মনে হয়। আরও স্বাভাবিকভাবে আমাদের বলা উচিত যে বিবিধ ভিন্নমুখী স্বার্থ রয়েছে এবং একজন রাষ্ট্রনেতাকে সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ সমন্বয় খুঁজে বার করতে হবে। একটি জাতি কিংবা একটি শ্রেণির স্বার্থ অভিন্ন হতে পারে কিন্তু সাধারণত তার সঙ্গে অন্য জাতি কিংবা শ্রেণির স্বার্থে দ্বন্দ্ব হয়ে থাকে। সমগ্র মানব সমাজের কিছু সাধারণ স্বার্থ রয়েছে সন্দেহ নেই কিন্তু রাজনৈতিক কর্ম স্থির করার পক্ষে সেগুলোই যথেষ্ট নয়। হয়তো কোনো ভবিষ্যকালে এরকম সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু যতদিন বহু সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে ততদিন এটা সম্ভব নয়। এবং তখনও সার্বিক স্বার্থ অনুসরণের কঠিনতম অংশ হবে পরস্পরবিরোধী বিশেষ স্বার্থসমূহের সমন্বয়সাধন।
প্রজ্ঞা-র অস্তিত্ব যদি মেনে নেওয়া যায় তবু এমন কোনো সংবিধান আছে কি যা প্রজ্ঞাবানের হাতে শাসনক্ষমতা তুলে নেবে? এটা পরিষ্কার যে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা, যেমন সাধারণ মন্ত্রিসভা (general council) ভুল করতে পারে এবং করেছেও। অভিজাতরা সর্বদা সুবুদ্ধিসম্পন্ন হন না। রাজারা প্রায়শই নিবোধ। পোপেরা অকাট্য হলেও অনেক সময় মারাত্মক ভুল করেছেন। কেউ কি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক কিংবা ধর্মতত্ত্বের ডক্টরেটের হাতে রাষ্ট্রশাসনের ভার অর্পণ করার সুপারিশ করবেন? অথবা, যারা দরিদ্র সংসারে জন্মে অগাধ অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছেন। তাঁদের হাতে? এটা পরিষ্কার যে, সমগ্র গোষ্ঠীর চেয়ে আইন দ্বারা সংজ্ঞিত, নির্বাচিত কোনো নাগরিক গোষ্ঠী অধিক প্রজ্ঞাবান হবেন না।
এটা মনে করা যায় যে, উপযুক্ত শিক্ষণের সাহায্যে মানুষকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, উপযুক্ত শিক্ষণ কাকে বলে? এবং সেটা দাঁড়াবে দলীয় প্রশ্নে।
সেইজন্য কয়েকজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি সংগ্রহ করে তাঁদের হাতে শাসনভার অর্পণ করার সমস্যা মীমাংসার অতীত। গণতন্ত্রের সপক্ষে সেটাই চরম যুক্তি।