তের
প্রিয়তোষের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, ‘কেমন লাগছে?’
ঘাড় নাড়লেন প্রিয়তোষ, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এরা কারা?’
প্রশ্নটা শোনামাত্র মাধবীলতার হাত একটু স্থির হয়েই আবার সচল হল। অনিমেষ লক্ষ্য করল পাখার হাওয়ার বেগ এখন কম। সে বলল, ‘এটা বোঝা উচিত ছিল।’
প্রিয়তোষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকালেন, ‘তোমরা বিয়ে থা করেছ কিন্তু এই খবরটা দাদাকে দাওনি কেন? ওঁরা তো কিছুই জানেন না।’
মাধবীলতা কোন উত্তর দিল না কিন্তু তার হাত এবার স্থির হল। প্রিয়তোষ অনিমেষের দিকে তাকালেন। হ্যারিকেনের আলোয় অনিমেষকে আরও বেশী রোগা দেখাচ্ছে। অনিমেষ বলল, ‘বাবার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। আমি ওখানেই শুনলাম তুই জেলে গিয়েছিলি। দাদা সেই খবর পেয়ে মাঝে মাঝেই জেলে এসে খোঁজ খবর করত।’
‘তাই নাকি!’ অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল, ‘আমার সঙ্গে দেখা হয়নি কখনও।’
‘ইচ্ছে করেই নাকি করেনি। ভেবেছিল তুই রিলিজড হলে জলপাইগুড়িতে ফেরত নিয়ে যাবে। কিন্তু তারপরেই ওই ঘটনাটা ঘটল।’
‘কি ঘটনা?’
‘তুই কিছুই জানিস না?’
‘না।’
‘জেল থেকে বেরিয়ে কোথায় ছিলি?’
‘এখানে, এই ঘরে।’
‘আশ্চর্য! দাদা প্যারালাইজড হয়ে রয়েছে। ডানদিকটায় কোন সেন্স নেই। চা বাগানের চাকরি ছেড়ে এখন জলপাইগুড়ির বাড়িতে রয়েছে। লাঠি নিয়ে কোনরকমে বাথরুম বারান্দায় যেতে পারে।’
অনিমেষ হোঁচট খেল। বাবা-! বাবার কথা ভাবলেই চোখের সামনে একটাই দৃশ্য ভেসে ওঠে। সন্ধ্যের অন্ধকার যখন তিরতিরিয়ে স্বৰ্গছেঁড়ার মাঠে ছড়িয়ে যেত তখন সাইকেলের ঘন্টি বাজাতে বাজাতে বাবা ফিরতো বাড়িতে, হাফ প্যান্ট আর শার্ট পরে। সাইকেল রেখে আলতো আঙ্গুলে অনিমেষের চুল এলোমেলো করে ভেতরে চলে যেত! এখন সেই মানুষ অর্ধেক অবশ শরীরে পড়ে আছে অথচ সে কিছুই জানে না।
অনিমেষ কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘পিসীমা?’
‘দিদির শরীর খুব খারাপ, বেশীদিন বাঁচবে না। তুই তো ওদের চিঠি দিতে পারতিস। এই বস্তির ঘরে থাকার কোন মানে হয়?’
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘না। আমি আর কারো দায় হয়ে থাকতে চাই না।’
মাধবীলতা চকিতে অনিমেষকে দেখল তারপর ইশারায় অর্ককে ডেকে বাইরে চলে গেল। অর্ক এতক্ষণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল। মা ডাকামাত্র সে বেরিয়ে এল। মাধবীলতা দ্রুতগলায় বলল, ‘দুটো সন্দেশ আর রসগোল্লা নিয়ে আয়।’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘এখন পাড়ার দোকান বন্ধ। সেই মোড়ে যেতে হবে।’
‘তাই যা। আমি টাকা দিচ্ছি।’ আবার ঘরে ঢোকার জন্যে মাধবীলতা পা বাড়াতে অর্ক বাধা দিল, ‘আমার কাছে টাকা আছে।’
‘কোথায় পেলি টাকা?’ সন্দেহের, সুর ফুটে উঠল মাধবীলতার গলায়।
‘পেয়েছি। কিন্তু এই লোকটাকে এত খাতির করছ কেন?’
‘ওইভাবে কথা বলবি না। তোর ছোট দাদু উনি, মনে রাখিস। তুই প্রণাম করেছিস?’
‘না।’
মাধবীলতা দাঁতে দাঁত চাপল, ‘তুই এত অবাধ্য! লজ্জা লজ্জা, যা প্রণাম কর।’
অর্ক গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাধবীলতা ওর হাত ধরে ঘরের দিকে টানতেই সে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি প্রণাম করতে পারব না।’ তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল। মাধবীলতা পাথর, অন্ধকার প্যাসেজে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছিল সে। না পেতে পেতে যখন অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে তখন ছোট্ট একটা পাওয়া এমন করে যে কেন নাড়িয়ে দেয়!
মাধবীলতা ঘর ছেড়ে যাওয়ামাত্র প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই বিয়ে করেছিস কবে?’
অনিমেষ হিসেব করার চেষ্টা করে মুখ নামাল, ‘অনেকদিন।’
‘সন্তানাদি?’
‘ওই তো দেখলে, এখানে দাঁড়িয়েছিল।’
‘অতবড় ছেলে তোর?’ চমকে উঠলেন প্রিয়তোষ।
‘পনের বছর বয়স।’
‘আমি ভাবতে পারছি না। তোর শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’
‘কোলকাতাতেই, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই।’
‘তোদের চলছে কি করে?’
‘ও স্কুলে পড়ায়।’
প্রিয়তোষের মুখচোখে এবার বিস্ময় ফুটে উঠল, ‘শিক্ষিতা মেয়ে? তোর সঙ্গে পড়ত নিশ্চয়ই?’
‘হ্যাঁ।’
এইসময় মাধবীলতা দরজায় এসে দাঁড়াল। মুখ যদিও অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তবু অনিমেষের মনে হল ওর কিছু হয়েছে। প্রিয়তোষ মাধবীলতাকে বললেন, ‘না, তোমাকে আর হাওয়া করতে হবে না। তুমি বরং আমার সামনে এসো।’ হাত দিয়ে খাট দেখিয়ে দিলেন তিনি।
মাধবীলতা আলোর সামনে এলে প্রিয়তোষ বললেন, ‘আমি তোমাদের সব কথা জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি অন্য জাতের মেয়ে। কি নাম তোমার?’
‘মাধবীলতা।’
‘বাঃ, সুন্দর। তুমি যা রোজগার কর তাতে এর চেয়ে একটু ভাল পরিবেশে থাকা যায় না?’
‘যেত। কিন্তু এত ধার হয়ে গিয়েছে—।’
‘ধার! কেন?’
অনিমেষ বলল, ‘ওসব কথা ছেড়ে দাও। এই পাদুটো কখনই সারবে না অথচ ও সারাবেই। অসম্ভবের পেছনে ছোটার কোন মানে হয়?’
সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়তোষের মুখ শক্ত হল, ‘সেটা তোর খেয়াল ছিল না?’
‘আমার?’ অনিমেষ বিস্মিত হল।
‘বিপ্লব করবি, এই দেশে সেটা যে অসম্ভব তা জানতিস না?’
অনিমেষ পূর্ণ-দৃষ্টিতে ছোটকাকাকে দেখল, ‘এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমি আলোচনা করতে চাই না।’
প্রিয়তোষ যেন নিজেকে ফিরে পেলেন, ‘আমরা অন্যের সমালোচনা করি কিন্তু নিজের ত্রুটি দেখতে পাই না। এটা যদি বুঝতিস তাহলে আজ এই অবস্থা হতো না।’
অনিমেষ নিচু গলায় বলল, ‘সেটা তুমি অনেক আগেই বুঝেছিলে।’
‘তার মানে?’ চমকে উঠলেন প্রিয়তোষ।
‘আমি তোমার কাছেই প্রথম মার্কসের নাম শুনেছিলাম।’
এই সময় মাধবীলতা বলে উঠল, ‘ওসব পুরোনো কথা এখন তুলছ কেন?’
প্রিয়তোষের কিছুটা সময় লাগল সুস্থির হতে। অনিমেষের কথায় একটা স্পষ্ট খোঁচা ছিল তা তিনি জানেন। পুরোনোকথার সূত্র ধরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের কত টাকা ধার আছে?’
‘আছে, একসময় শোধ করে দেব।’ মাধবীলতা অঙ্কটা বলতে চাইল না।
‘কিন্তু এই পরিবেশে বাস করলে তোমাদের ছেলে মানুষ হতে পারবে না।’
মাধবীলতা বলল, ‘জানি। কিন্তু এর বেশী কিছু করার সঙ্গতি আমার নেই।’
‘তোমরা জলপাইগুড়িতে ফিরে যেতে পার। চেষ্টা করলে ওখানকার স্কুলে তোমার কাজ হতে পারে। পরিবেশ আর পরিস্থিতিও পাল্টে যাবে।’
‘দেখি।’
‘এতে দেখাদেখির কি আছে?’
‘ধার শোধ না হওয়া পর্যন্ত এখানকার চাকরি ছাড়া সম্ভব নয়।’
‘বেশ তো, আমাকে বল কত টাকা দরকার?’
এবার অনিমেষ উত্তর দিল, ‘যে প্রয়োজনে নিজের বাবা মায়ের কাছে হাত পাতেনি সে তোমার সাহায্য নেবে এটা ভাবছ কেন?’
‘ও।’ প্রিয়তোষ নড়েচড়ে বসলেন। তারপর মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে তোমার ছেলেকে ওখানে পাঠিয়ে দাও। আমাদের বংশের মুখ চেয়ে এটা কর। গাড়িতে বসে যা দেখেছি তা আমার ভাল লাগেনি।’
‘কি দেখেছ?’ অনিমেষের বুকের ভেতর অস্বস্তি।
‘লরির সামনে আমার গাড়ি আটকে গিয়েছিল বলে পাড়ার ছেলেরা ঝামেলা করার চেষ্টা করছিল। আমি লক্ষ্য করছিলাম ওরা কতটা বাড়ে। এই সময় তোর ছেলে এল। কথাবার্তায় বুঝলাম পাড়ার ছেলেদের ওপর ওর বেশ কর্তৃত্ব আছে। কথা বলার ধরনটাও ভাল লাগল না। রকবাজ ছেলে আগেও দেখেছি, কিন্তু এবার এসে যে শ্রেণীর ছেলেদের দেখছি তাদের আগে দেখিনি।’
মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, ‘এই জ্বালায় তো জ্বলছি। আসলে ওর বয়সের তুলনায় চেহারাটা বড় কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি একটুও পাকেনি।’
এইসময় অর্ককে দরজায় দেখতে পেয়ে মাধবীলতা চট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর ছেলের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে প্রিয়তোষের পেছনে চলে গিয়ে প্লেটে সাজাতে বসল। মাধবীলতা দেখল দুটো করে নয়, অনেক বেশী মিষ্টি নিয়ে এসেছে অর্ক। অন্তত দশ টাকার তো হবেই। এত টাকা ও পেল কোথায়? তারপরেই মনে পড়ল দুপুরে ওর হাতে টাকা ছিল। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো মাধবীলতা। হঠাৎ খেয়াল হল অর্ক নিজে থেকে বাড়তি মিষ্টি এনেছে সেটাও অভিনব।
প্রিয়তোষ অর্ককে দেখলেন, ‘তোমার নাম কি?’
‘অর্ক।’
‘বাঃ চমৎকার নাম। কি পড়ছ?’
জিজ্ঞাসা করামাত্র মা এবং বাবার চোখ যে তার ওপর পড়ল সেটা টের পেয়ে একটু সংকুচিত গলায় উত্তর দিল অর্ক।
‘এখানকার ছেলেদের সঙ্গে মিশতে তোমার ভাল লাগে?’
‘কেন লাগবে না?’
‘এরা কি তোমার মত পড়াশুনো করে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কি?’
প্রিয়তোষ আবার পূর্ণদৃষ্টিতে অর্ককে দেখলেন। এই সময় মাধবীলতা প্লেটটা প্রিয়তোষের পাশের টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। প্রিয়তোষ সেদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, ‘এসব করতে গেলে কেন?’
‘কিছুই তো করিনি।’ মাধবীলতার কণ্ঠস্বর নরম।
‘আমার ব্লাডসুগার চারশোতে উঠেছিল। মিষ্টি বিষের সমান। হ্যাঁ অনিমেষ, তোর নিজের কি করার ইচ্ছে?’
‘বুঝতে পারছি না। কিছু তো করতেই হবে।’
প্রিয়তোষ উঠলেন, ‘আমি আরও দিন দশেক এখানে আছি। এর মধ্যে তুই চিন্তাভাবনা করে নে। এখানে আমাদের মত মানুষ বাঁচতে পারবে না। আর বউমা, তোমাকে যা বললাম, ভেবে দ্যাখো। ওর জন্যে যা করছ তার তুলনা নেই কিন্তু তোমার অসুস্থ শশুর কি দোষ করল।’ তারপর অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।’
অর্ক একটু উদ্ধতভঙ্গীতে তাকাল। প্রিয়তোষ বললেন, ‘কাল বিকেল তিনটে নাগাদ আমার হোটেলে ওকে পাঠিয়ে দিও বউমা।’
অনিমেষ মনে করার চেষ্টা করল, ‘কোন হোটেল যেন?’
‘এবার আমি পার্ক হোটেলে উঠেছি। পার্ক স্ট্রীটে। রিসেপসনে আমার নাম বললেই হবে।’ ঘর ছেড়ে যাওয়ার ভঙ্গী করে আবার দাঁড়ালেন প্রিয়তোষ। তারপর মাধবীলতার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি তো তোমাদের কথা জানতাম না। আমাদের বংশের নতুন বউ প্রণাম করল অথচ শুধু হাতে বউ-এর মুখ দেখে যাব তা হয় না। কিন্তু—।’
মাধবীলতার গলার স্বর কাঁপল, ‘আপনি আশীর্বাদ করুন তাতেই হবে। তাছাড়া আমি তো আর নতুন বউ নই।’
‘আমি তো তোমাকে প্রথম দেখলাম। আমাদের বংশের নিয়ম তুমি জানবে কি করে?’ প্রিয়তোষ বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুললেন, ‘যদিও আমার আঙ্গুল সরু তবু তোমার হবে কিনা জানি না। পুরোনো জিনিস বলে কিছু মনে করো না।’
মাধবীলতা একদৃষ্টে প্রসারিত হাতটিকে দেখল। আঙ্গুলের ডগায় আংটি থেকে আলো ঠিকরে বার হচ্ছে। খুব দামী পাথর নিঃসন্দেহে। সে অনিমেষের দিকে তাকাল, অনিমেষের মুখ মাটির দিকে।
প্রিয়তোষ বললেন, ‘আশীবাদ প্রত্যাখ্যান করলে অপমান করা হয়।’
শেষপর্যন্ত মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘আপনি এসেছেন এই আমার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ পাওয়া।’
প্রিয়তোষ ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে আংটিটাকে পকেটে ফেলে দিলেন। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাওয়ার আগে জানাস।’
মাধবীলতা অর্ককে ইশারা করল এগিয়ে দিতে।
অন্ধকার গলিতে পা ফেলতে প্রিয়তোষের অসুবিধে হচ্ছিল। একটা চাপা ঘেমো গন্ধ যেন বাতাসে ভাসছে। অর্ক বলল, ‘আপনি আমার হাত ধরুন।’
প্রিয়তোষ মাথা নাড়লেন, ঠিক আছে, তুমি সামনে হাঁটো।’
ঈশ্বরপুকুর লেনে অবশ্য অন্ধকার নেই। রাস্তার আলোর তলায় এখন জোর তাসের আড্ডা বসে গেছে। প্রিয়তোষের ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে রাখায় ওপারে যেতে হবে। অর্ক গাড়ি অবধি পেছন পেছন এল। দরজা খুলে প্রিয়তোষ বললেন, ‘কাল ঠিক সময়ে চলে এসো আমি অপেক্ষা করব।’
ঠিক তখনই একটা চিৎকার ভেসে এল, ‘আরে অক্ক, মাল খেয়ে আমাদের ঢপ দিয়ে ফুটে গেলি, এখন দেখি কোন খানকির বাচ্চা তোকে বাঁচায়!’
চকিতে পিছু ফিরে তাকিয়ে অর্ক দেখল কোয়া ফুটপাথে টলছে। দুটো পা কখনই স্থির থাকছে না। আচমকা মুখে রক্ত জমল। সে আড়চোখে দেখল প্রিয়তোষ বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। খুব লজ্জা লাগছিল অর্কর। এবং এই প্রথম ওইসব খিস্তি শুনে তার লজ্জাবোধ হল। প্রিয়তোষ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছেলেটি কে?’
‘এখানে থাকে।’ অর্কর মনে হচ্ছিল প্রিয়তোষ যত তাড়াতাড়ি চলে যান তত ভাল।
‘তোমার বন্ধু?’ প্রিয়তোষ আড়চোখে ওকে দেখলেন।
মাথা নাড়ল অর্ক, না।
‘তাহলে ওই ভাষায় ওকে কথা বলতে দিচ্ছ কেন?’
‘ওরা ওইরকম কথাই বলে।’
ততক্ষণে কোয়া এগিয়ে এসেছে কাছে। জড়ানো গলায় সে চিৎকার করল, ‘চলে আয় বে! মাল পেলে আমি আজ ছাড়ছি না।’
হঠাৎ অর্কের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে কয়েক পা এগিয়ে প্রচণ্ড জোরে কোয়ার গালে চড় মারল। মাটিতে পড়ে গিয়েও কোয়া সমানে খিস্তি করে যাচ্ছিল। দৃশ্যটা দেখে ফুটপাথে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে। অর্ক কোয়াকে উপেক্ষা করে বলল, ‘আপনি যান।’
প্রিয়তোষের মুখে হাসি ফুটল, ‘খুশি হলাম। কাল দেখা হবে।’
গাড়িটা ট্রাম রাস্তার দিকে চলে যাওয়ার পর অর্ক কোয়াকে কলার ধরে টেনে দাঁড় করাল, ‘কি বলছিস বল!’
টলতে টলতে কোয়া বলল, ‘তুমি আমাকে মারলে গুরু! আমার গায়ে হাত তুললে?’
‘বেশ করেছি।’
‘না গুরু। এর বদলা হবে। আমার গায়ে হাত তুলে কেউ-কেউ—!’ জড়িয়ে গেল গলা। অর্ক বলল, ‘বাড়ি যা।’
‘আগে বদলা চাই।’
‘ঠিক আছে বাড়ি যা।’
‘গুরু তুমি কথা দাও বদলা নেবে।’
‘ঠিক আছে, বাড়ি যা।’
এবার কোয়া অর্ককে জড়িয়ে ধরল, ‘সব শালা হারামি, শুধু তুই ছাড়া।’ কথাটা শুনে হেসে উঠল দর্শকরা। অর্ক কোয়াকে নিয়ে গলির মধ্যে ঢুকল। কিন্তু গলিতে পা দেওয়ামাত্র জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল কোয়া। সে কিছুতেই আর এগোবে না। অনেক বোঝানোর পর অর্ক ওকে ছেড়ে দিয়ে পা বাড়াল। কোয়া আবার টলতে টলতে গলি ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকে অর্ক দেখল মা চেয়ারে বসে বাবার সঙ্গে কথা বলছে। অর্ককে দেখামাত্র ওদের কথা থেমে গেল। অনিমেষ আচমকা প্রশ্ন করল, ‘হ্যাঁ রে, সেই ভদ্রলোক কেমন আছেন এখন?’
‘কোন ভদ্রলোক?’ অর্ক বুঝতে পারল না।
‘যাঁর অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছিল, লেকটাউন না কোথায় থাকেন বলেছিলি।’
‘ভাল।’ কথাটা বললেও অর্ক খুব দুর্বল হয়ে পড়ল। সে জানে না বিলাস সোম এখনও বেঁচে আছে কি না। একবার খোঁজ নেওয়া খুব দরকার ছিল। আর তখনই তার হারখানার কথা মনে পড়ল। যে করেই হোক সেই মেয়েটার কাছ থেকে হারখানা উদ্ধার করতেই হবে।
মাধবীলতা বলল, ‘তোর ছোটদাদু কি বলে গেলেন শুনেছিস?’
‘কি ব্যাপারে?’
‘জলপাইগুড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে। আমি ভাবছি সেই ভাল, তুই আগে জলপাইগুড়িতে চলে যা, আমরা পরে এদিকটা সামলে যাব।’
‘কেন?’
‘ওখানে আরও ভাল থাকতে পারবি।’
‘দূর! ওখানে তোমাকেই কেউ চেনে না আমাকে চিনবে কেন?’
মাধবীলতা এতক্ষণ তরল গলায় কথা বলছিল। এই বাক্যটি শোনামাত্র সে শক্ত হল। অর্ক তো ঠিকই বলছে। তার পরিচয় কি? অনিমেষের স্ত্রী? অথচ ওই বাড়ির লোক তাকে এত বছরে চোখেই দ্যাখেনি। অনিমেষ নিজে তার পরিচয় না করিয়ে দিলে কেউ স্বীকার করতেই চাইবে না। এত করেও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, পিতা স্বামী এবং সন্তান ছাড়া মেয়েদের আলাদা কোন ভূমিকা নেই, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। সমস্ত শরীরে অসহ্য জ্বলুনি কিন্তু কিছু করার নেই। সে অনিমেষের দিকে তাকাল। ভাবখানা এমন, হায়, তোমরা এদেশে বিপ্লব আনতে গিয়েছিলে অথচ তোমাদের ঘরগুলো সব অন্ধ সংস্কারে ঠাসা এই খেয়াল কি কখনও করেছ!
কথাটা অনিমেষের কানেও কট করে বেজেছিল। হঠাৎ ওর চোখের ওপর একটা ছবি ভেসে উঠল। জ্যাঠামশাই যেদিন জেঠিমাকে নিয়ে নিঃসম্বল অবস্থায় জলপাইগুড়ির বাড়িতে এসেছিল চোরের মতন সেদিন ওরা কেউ জেঠিমাকে চিনতো না। কৌতূহল ছিল কিন্তু সেই সঙ্গে অবজ্ঞামেশানো দূরত্ব কম ছিল না। আজ মাধবীলতাকে নিয়ে এত বছর পরে জলপাইগুড়ির বাড়িতে ফিরলে সবাই কি ওকে মেনে নিতে পারবে? নতুন যে তাকে গ্রহণ করার জন্যে একটা মন সবসময় উদ্গ্রীব থাকে কিন্তু দীর্ঘসময় যে জুড়ে বসেছে তাকে মানতে অনেক অসুবিধে।
মাধবীলতা বলল, ‘না। তবু তোমাকে যেতে হবে। এখানে থাকলে আমি তোমাকে মানুষ করতে পারব না। আজ কিছুক্ষণের জন্যে এসেও ওই মানুষটা তোমার স্বরূপ বুঝে গেছেন। এতোদিন কেউ আমাদের ওখানে যেতে বলেনি কিন্তু এখন উনি যখন বলছেন তখন আর বাধা কি!’ কথাটা শেষ করে সে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কি বল?’
অনিমেষ গম্ভীর মুখে বলল, ‘দেখি!’
কথাটা শোনামাত্র মাধবীলতার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি চলকে উঠল। আর তখন অর্ক বলল, ‘লোকটা অ্যাদ্দিন আসেনি কেন?’
অনিমেষ মুখ তুলল, ‘লোকটা নয়, উনি আমার কাকা। এতদিন বিদেশে ছিলেন। বয়স্ক লোকের সম্পর্কে যখন কথা বলবে তখন সমীহ করে বলতে শেখ।’
অর্ক খোঁচা খেয়ে হজম করল, ‘উনি ছিলেন না কিন্তু আর যাঁরা ছিলেন তাঁরাও তো খবর নিতে পারতেন। এখন ডাকলেই যেতে হবে?’
মাধবীলতা বলল, ‘তোমাকে এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আমি দেখতে চাই তুমি নিজেকে শুধরে নিয়েছ।’
আর তখনই দপ করে আলো জ্বলে উঠল। পুরো বস্তিটায় একটা চাপা উল্লাস উঠল। মাধবীলতা বলল, ‘যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। কদিন তো একেবারে বই-এর সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। খেয়ে দেয়ে আমি যতক্ষণ খাতা দেখব ততক্ষণ তুমি পড়বে।’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে।’
মাধবীলতা বলল, ‘কোন কথা শুনতে চাই না। সারাদিন টো টো করার সময় খেয়াল থাকে না? মনে করো না চেহারায় বড় হয়ে গিয়েছ বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছ। যাও।’
অর্ক উঠল। তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে চাপা গলায় বলল, ‘তুমি মাইরি মাঝে মাঝে ঠিক মাস্টারনি হয়ে যাও।’
অর্ক বেরিয়ে যাওয়ামাত্র অনিমেষ হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। বালিস বুকে চেপে সশব্দে হেসে উঠল সে। মাধবীলতা গম্ভীর গলায় বলল, ‘চমৎকার!’ তারপর সামান্য হাসল, ‘আর কত কি শুনব! তুমি তখন এমনি করে হেসো।’
আজ রবিবার। ভোরবেলা থেকে যেন একটা ঝড়ের মধ্যে কাটাল অর্ক। ছুটির দিনেও মায়ের সাতসকালে ওঠা চাই। কলঘরের কাজ সেরে চা বানিয়ে তাকে ডেকে তুলেছে। তারপর বাধ্য করেছে বই নিয়ে বসতে। ছোটবেলা থেকে চিৎকার না করে পড়ার অভ্যেস হয়েছে অর্কর। মা বলে ওটা নাকি ফাঁকিবাজি। সে পড়ছে কিনা তা আর কেউ টের পাবে না। পড়তে পড়তে অর্কর মনে হচ্ছিল ওগুলো পড়ার কোন মানে হয় না। কবে কে কখন যুদ্ধ করেছিল, কে কি রকম ভাল শাসক ছিল তা এখন তার জেনে কি লাভ! ওসব যাদের দরকার তারা পড়ুক। পড়তে পড়তে ওর নজর ছিল ঘরের কোণে রাখা খালি দুধের কৌটোর দিকে। ওর মধ্যে কাল রাত্রে এক ফাঁকে টাকাগুলো লুকিয়ে রেখেছে। বইপত্তর গোটালো অর্ক।
মাধবীলতার খাতা দেখা হয়ে গিয়েছিল। উনুনে এখন সুজি ফুটছে। ছেলেকে উঠতে দেখে বলল, ‘কি হল?’
‘আর পড়তে ইচ্ছে করছে না।’
‘কেন? এটুকু পড়লে হবে?’
‘হবে।’
মাধবীলতা চকিতে ছেলের দিকে তাকাল, ‘মুখে মুখে তর্ক করছিস?’
‘তর্ক করছি না তো। আমার এখন পড়তে ভাল লাগছে না।’ অর্ক বইপত্র টেবিলে রেখে দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল অনু এদিকে আসছে। তাদের ঘরে এই বস্তির কেউ খুব প্রয়োজন ছাড়া আসে না। সে একটু অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি চাই?’ অনু বোধ হয় অর্ককে ঘরে আশা করেনি। একটু থতমত হয়ে বলল, ‘না, কিছু না।’ তারপর ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
‘তুমি কিছু বলবে?’
‘থাক, পরে আসব।’
ভেতর থেকে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘কে রে?’
অর্ক উত্তর দিল, ‘অনু। কিছু বলতে এসে ফিরে যাচ্ছে।’
মাধবীলতা এবার দরজায় চলে এল, ‘তুই ভেতরে যা।’
অর্ক ঘরে ঢুকে গেলে অনু এগিয়ে এল মাধবীলতার কাছে। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার?’
একটু ইতস্তত করে অনু বলল, ‘বউদি, একটা উপকার করবেন?’
‘কি?’
‘আপনাদের স্কুলে লোক নিচ্ছে?’
‘আমাদের স্কুলে?’ মাধবীলতা অবাক হল, ‘টিচার?’
‘না। অফিসের কাজ করবার লোক।’
‘জানি না, কেন বল তো?’
‘আমার চেনাশোনা একজন দরখাস্ত করেছে, তাই।’
মাধবীলতা বলল, ‘দ্যাখো, আমি প্রথমত জানি না কোন ক্লারিকাল স্টাফ নেবে কিনা! আর নিলেও ও-ব্যাপারে আমার কোন হাত নেই।’
অনু মাথা নাড়ল, ‘কিন্তু আপনাদের স্কুল যখন তখন সবার সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই চেনাজানা আছে। একটু চেষ্টা করলে হয়তো কাজটা হয়ে যাবে।’
মাধবীলতা দেখল অনুর মুখে আকুতি স্পষ্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে দরখাস্ত করেছে?’
অনু এবার ঢোক গিলল, ‘আমার পরিচিত একজন।’
‘তোমার বাবা চেনেন তাকে?’
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল অনু, না।
মাধবীলতা মনে মনে হাসল, হায় রে! সেই এক ভুল, মেয়েগুলো এমনি করেই মরে! তারপরেই সে নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করল, এভাবে না মরেও যে মেয়েদের কোন উপায় নেই।
‘তোমাদের আত্মীয় নয় যখন তখন এত চিন্তা করছ কেন?’
এবার অনু তাকাল তারপরেই মুখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওর একটা কাজ না হলে আমার কোনদিন বিয়ে হবে না বউদি।’
মাধবীলতা এবার যেন ছোট্ট ধাক্কা খেল। এই মেয়েটিকে সে অনেকদিন থেকে দেখছে। নেহাত অশিক্ষিত নির্বোধ এবং শরীরে বেড়ে ওঠা মেয়ে বলেই মনে হত। ও যে জীবনের চরম সত্য এত নগ্নভাবে জেনে গেছে তা ভাবতে পারেনি মাধবীলতা। তার বলতে ইচ্ছে করছিল, চাকরি হয়ে যাওয়ার পর সেই ছেলে ওকে বিয়ে নাও করতে পারে। কিন্তু ওর মনে সন্দেহের কাঁটাটা ঢুকিয়ে দিয়ে কি লাভ! সে হাসল, ‘ঠিক আছে, তুমি একটা কাগজে ছেলেটির নাম ঠিকানা লিখে দিয়ে যেও। আমি কথা দিতে পারছি না তবে যাঁরা চাকরি দেবেন তাঁদের অনুরোধ করব।’ অনুপমার চলে যাওয়া পর্যন্ত মাধবীলতা ওর দিকে তাকিয়ে ছিল; হঠাৎ শুনল, ‘সরো।’
ও দেখল অর্ক সেজেগুজে বের হচ্ছে। বিরক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘হাসপাতালে।’
‘এত ঘন ঘন হাসপাতালে যাওয়ার কি দরকার?’
‘বাঃ, লোকটা বেঁচে আছে কিনা দেখব না?’
মাধবীলতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অনিমেষ সেই একই ভঙ্গীতে মুখের ওপর পথের পাঁচালি রেখে শুয়ে আছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘সুজি খেয়ে যা।’
খাওয়ার মোটেই ইচ্ছে ছিল না অর্কর। খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাকে এড়ানোর জন্যে ও গরম সুজিতে হাত দিল। অনিমেষের জন্যে প্লেটে ঢালতে ঢালতে মাধবীলতা বলল, ‘তুই দাঁড়া, আমি তোর সঙ্গে যাব।’ অর্কর গলায় যেন আচমকা সুজি আটকে যাচ্ছিল, কোন রকমে বলল, ‘তুমি যাবে মানে?’
‘বাঃ, তোর মা হিসেবে আমারও তো দেখতে যাওয়া উচিত।’
‘দূর! ওরা খুব বড়লোক, ওখানে তুমি গিয়ে কি করবে?’
‘বড়লোক তো কি হয়েছে? তুই রোজ যাচ্ছিস কেন?’
অর্ক দেখল, এইভাবে কথা বললে সে মায়ের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তাই কথা চাপা দেবার জন্যে বলল, ‘বেশ, আমি গিয়ে দেখে আসি টেঁসে গেল কিনা তারপর তুমি যেও।’
মাধবীলতাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চটপট ডিশ নামিয়ে অর্ক বেরিয়ে এল বাইরে। ওর হঠাৎ খেয়াল হল, সকাল থেকে বাবার গলা শোনা যায়নি। কাল রাত্রে বুড়োটা আসার পর থেকেই যেন বাবার হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেছে।
ট্রামরাস্তায় চলে এসে চারপাশে তাকাল অর্ক। না, ঝুমকি এখনও আসেনি। ওর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে এলে ভাল হত। ঘড়ি-হাতে একটা লোককে সময় জিজ্ঞাসা করে অর্ক সমস্যায় পড়ল। পনের মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছে। ঝুমকি কি ঠিক সময়ে এসে চলে গেছে? তার জন্যে অপেক্ষা করেনি? অর্ক কি করবে বুঝতে পারছিল না এমন সময় ন্যাড়াকে দেখতে পেল। মাতৃদায়ের কোন চিহ্ন নেই শরীরে। তবে গা খালি। সিগারেটের দোকানের সামনে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে বিড়ি খাচ্ছে লুকিয়ে। সে চিৎকার করল, ‘এই ন্যাড়া?’
ন্যাড়া চকিতে বিড়িটাকে হাতের আড়ালে সরিয়ে মাথা নাড়ল ‘কি?’
কয়েক পা এগিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘ঝুমকিকে দেখেছিস?’
আবার মাথা নাড়ল ন্যাড়া। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘একটু আগে চার নম্বর ট্রামে উঠেছে।’
চার নম্বর। তার মানে চিৎপুরেই গেছে। ঠিকানাটা মনে করার চেষ্টা করল অর্ক। পনের মিনিট অপেক্ষা করতে পারল না, আচ্ছা হারামি! ডান দিকে তাকাল সে, একটাও ট্রাম নেই। ট্রাম ছাড়া চিৎপুরে যাওয়া অসম্ভব। অস্বস্তিতে খানিকটা এগোতেই টালা পার্কের দিক থেকে আসা একটা ট্যাক্সি থেকে কেউ যেন চেঁচিয়ে কিছু বলল। অর্ক দেখল ট্যাক্সিটা একটু এগিয়ে থেমে গেছে। এর পেছনের জানলায় সুরুচি সোমের মুখ, হাত নেড়ে ডাকছেন।
দৌড়ে এল অর্ক এবং এসেই ওর বুক ধক্ করে উঠল। না এলেই পারত। সুরুচি বললেন, ‘কি ব্যাপার, তোমার কোন খবর নেই কেন?’
‘এমনি।’
‘বাঃ, বেশ ছেলে যা হোক। এদিকে ও তো তোমার জন্যে হেদিয়ে মরচে। দুবেলা জিজ্ঞাসা করছে তুমি এসেছ কিনা!’
আতঙ্কিত গলায় অর্ক জানতে চাইল, ‘উনি কেমন আছেন?’
‘ভাল। মনে হচ্ছে আজ বিকেলে ছেড়ে দেবে। উঠে এসো।’
মাথা নাড়ল অর্ক, ‘না। খুব জরুরী কাজে যাচ্ছি। বিকেলে যাব।’
‘ঠিক যাবে তো? একদিনের আলাপে বিলাস দেখছি তোমাকে খুব পছন্দ করেছে। আমি ওকে বলব তুমি আসছ।’
ট্যাক্সিটা চলে গেলে অর্ক অবশ হয়ে গেল। বিকেলে তার পার্ক হোটেলে যাওয়ার কথা, মনে ছিল না। কিন্তু লোকটা সুস্থ হয়ে গিয়েছে। আর কোন উপায় নেই, যেমন করেই হোক হারখানা ফেরত চাই। অন্যমনস্ক অর্ক হঠাৎ দেখল একটা চার নম্বর ট্রাম সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
মরিয়া হয়ে হ্যাণ্ডেল ধরার জন্যে সে ছুটল।