প্রতিমা ঠাকুরবাড়িরই মেয়ে আবার ঠাকুরবাড়িরই বৌ। পাঁচ নম্বর আর ছ নম্বর, যারা কাছেই ছিল তাদের আরো কাছে এনে দিলেন তিনি। আসলে প্রতিমা বিনয়িনীর মেয়ে। সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখে কবিপত্নী মৃণালিনীর খুব ভাল লেগেছিল। অন্তরঙ্গদের বলেছিলেন, এই সুন্দর মেয়েটিকে আমি পুত্রবধু করব। আশা করি ছোটদিদি তার নাতনীটিকে আমায় দেবেন।
অতি অকালে চলে যাওয়ায় মৃণালিনী তার ইচ্ছেকে কাজে পরিণত করতে পারেননি। তাই মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই প্রতিমার বিয়ে হয়ে যায় গুণেন্দ্রের ছোটবোন কুমুদিনীর ছোট নাতি নীলানাথের সঙ্গে। তখন প্রতিমার বয়স সবে এগারো। এবাড়ির মেয়েদের একটু ছোট বয়সেই বিয়ে হত, প্রতিমারও হয়েছিল।
ফাল্গুন মাসে বিয়ে হল। বৈশাখ মাসে শুভদিন দেখে প্রতিমাকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নিয়ে গেলেন। তার কয়েকদিন যেতে না যেতেই গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হল নীলানাথের। শ্বশুরবাড়ি থেকে অপয়া অপবাদ নিয়ে ফিরে এলেন প্রতিমা। এ ঘটনার পাঁচ বছর পরে, রথীন্দ্র বিলেত থেকে ফিরলে রবীন্দ্রনাথ প্রতিমার পুনর্বিবাহ দেবার প্রস্তাব করেন। স্ত্রীর মনোবাসনা তার অজ্ঞাত ছিল না, তাছাড়া বিধবা বিবাহের প্রতিবন্ধক মহর্ষি তখন পরলোকে। কবিও বাল্যবিধবাদের অবহেলিত জীবন ও দুভাগ্যের কথা চিন্তা করছিলেন। ঠিক সেই সময় ঢাকার গুহঠাকুরতা পরিবারের মেয়ে লাবণ্যলেখাও বিধবা হয়ে ফিরে এলেন। কন্যাসমা এই মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে আবার সংসারে ফিরিয়ে আনা যাবে না-কি? কবি পূর্বসংস্কার ভাঙবার জন্যে প্রস্তুত হলেন এবং তখনই স্থির করলেন নিজের ছেলের বিয়ে দেবেন বিধবার সঙ্গে। এছাড়া সমাধানের কোন পথ নেই। তিনি নিজে যদি নিজের ছেলের বিয়ে কোন বিধবার সঙ্গে না দেন তাহলে অন্য লোকে দেবে কেন? তিনি গগনেন্দ্রকে মনের কথা জানালেন।
তোমাদের উচিত প্রতিমার আবার বিয়ে দেওয়া। বিনয়িনীকে বলো যেন অমত না করে। ওর জীবনে কিছুই হল না। এ বয়সে চারিদিকের প্রলোভন কাটিয়ে ওঠা মুস্কিল। এখন না হয় মা বাপের কাছে আছে। এর পরে ভাইদের সংসারে কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকবে সেইটাই কি তোমাদের কাম্য? না, বিয়ে দেওয়া ভাল, সেটা বুঝে দেখ।
উদারহৃদয় গগনেন্দ্র তখনই রাজী হলেন। কিন্তু সমাজ রয়েছে। সমাজের কি সম্মতি পাওয়া যাবে? এ তো ব্রাহ্মসমাজ নয়। বিদ্যাসাগর ১৮৫৬-তে বিধবা বিবাহকে কাগজে-কলমে বৈধ করে গিয়েছেন। সমাজ সংস্কারের হিড়িকে কিছু বিধবার বিবাহ হয়েছে কিন্তু সাধারণ ভাবে এখনো সমাজে কেউ মেনে নিয়েছে কি? বিনয়িনী ভয় পেলেন :
আমাকে যে সমাজে একঘরে ঠেলবে। আমার আরও ছেলেমেয়ে আছে তাদের বিয়ে দিতে হবে।
ভয় পেলেন না গগনেন্দ্র। বললেন, তোমাদের ভয় নেই। তোমাদের পেছনে আমি আছি। তোমায় সমাজ ত্যাগ করলে আমিও সমাজ ত্যাগ করব। সমাজকে অগ্রাহ্য করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিমার বিয়ে দিলেন গগনেন্দ্র। ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বিধবা বিবাহ। অবশ্য ঠিক ঠাকুরবাড়ি বলা চলে না। মাত্র কয়েকমাস আগে পাথুরেঘাটা-ঠাকুরবাড়ির মেয়ে ছায়ার বিধবা বিবাহ হয়েছে। জোড়াসাঁকোতে প্রথম বিয়ে হল রথীন্দ্র ও প্রতিমার। কবি এর পরে লাবণ্যলেখার বিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয় শিষ্য অজিত চক্রবর্তীর সঙ্গে। গগনেরে ইচ্ছে ছিল তার নিজের বিধবা পুত্রবধূ গেহেন্দ্রের স্ত্রী মৃণালিনীরও আবার বিয়ে দেবেন। মৃণালিনীর প্রবল আপত্তিতে তা সম্ভব হয়নি।
প্রতিমার বিয়েতে সামাজিক বাবা কিছু এসেছিল। ঠাকুর পরিবারের কোন শরিক নিজের বাড়ির উৎসবে রবীন্দ্ৰপরিবারকে নিমন্ত্রণ করেননি এই সব। এদিকে বেশি মনোযোগ না দেওয়ায় সব ঝড় কেটে গেল। রবীন্দ্রপরিবারে গৃহলক্ষ্মী হয়ে প্রবেশ করলেন প্রতিমা; সত্যিই তিনি ছিলেন মূর্তিমতী লক্ষ্মীশ্রী, রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের মা-মণি, তার আদরের ব্রাইড মাদার (বৌমা)। দীর্ঘ বত্রিশ বছর ধরে রবীন্দ্র সান্নিধ্যে থেকে তার সেবা করে গিয়েছেন প্রতিমা। সেই সঙ্গে চলেছে আশ্রমের দেখাশোনা আর অতিথি সেবার কাজ। কবির সেবা করা খুব সহজ কাজ ছিল না। প্রতিমা করেছেন অসীম ধৈর্য নিয়ে।
শুধু সেবা নয়, প্রতিমা শিল্পক্ষেত্রে রেখে গেছেন অনেক। তার যা কিছু শিক্ষা রবীন্দ্রনাথের কাছেই। সেই শিক্ষা তার প্রতিভার স্পর্শে নতুন রূপ নিল। চলে যেতে যেতে রেখে গেল ঠাকুরবাড়ির মেয়ের আরো কিছু অসামান্য দান। প্রতিমা দুই পরিবারের শিক্ষা সংস্কৃতি নিয় এসেছিলেন। নিয়ে এসেছিলেন কল্যাণশ্রীর সঙ্গে আশ্চর্য নিরাসক্তি। তিনি ভাল লিখতে পারতেন, পারতেন ভাল ছবি আঁকতে। তাঁর লেখা গুরুদেবের ছবি রবীন্দ্রনাথের চিত্র বিচারের মাপকাঠি। বাস্তবিক চিত্র বিচারে প্রতিমা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলাকে তিনভাগ করে প্রতিমা দেখিয়েছেন কবির আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্য ও জীবজন্তু যেমন ফরাসী জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তেমনি মানুষের মুখের প্রতিকৃতি মনোহরণ করেছিল জার্মানদের। কিন্তু আসলে এসব ছবিকে বিশ্লেষণ করা যায় না। সৃষ্টির এমন এক সত্যকে এরা অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করছে যার ব্যাখ্যা চলে না। দিব্যদৃষ্টি দিয়ে কেউ যদি সে জিনিষ ধরতে পারল তো বুঝল, নইলে খনির ভিতর মণির মতো তার দীপ্তি রইল ঢাকা। রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে ছবি আঁকলেন দু হাজারেরও বেশি। ছবি তার শেষ বয়সের প্রিয়া—জীবন-সায়াহ্নে যে নায়িকা আসে সে যেন সবচেয়ে বেশি অভিনিবেশ দাবি করে। চোখের সামনে বুঝি ফুটে উঠল আর একটা জগৎ, রঙে-রেখায় কবি তাকে স্পষ্ট করে তুললেন। রবীন্দ্রনাথের এই ছবি আঁকার কথা লিখেছেন প্রতিমা। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ কবিতায় যেমন একটা সৃষ্টির সম্পূর্ণ চেহারা দিয়েছেন চিত্রেও তেমনি বস্তু প্রবাহের আবর্তনের ইতিহাস একেছেন। গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে যে ঘূর্ণমান গতি তেজের চাপে রচনার কাজে নিরন্তর নিযুক্ত, তারি জোয়ার ভাটার টানে রেখা হতে রেখান্তরে প্রাণী ও জড়জগতের চেহারা ছাঁচে ঢালাই হয়ে বেরিয়ে আসছে। শিল্পীর মনে লেগেছিল সেই স্রোতের ঢেউ। ব্যক্তিত্বের রসে মজে তাই তুলির টানে বেরিয়ে এল রূপ হতে রূপান্তরে সৃজিত অপরূপ মানুষ পশুপক্ষী ও দৃশ্য।
এ তো গেল প্রতিমার চিত্র সমালোচনার কথা। প্রতিমা নিজেও ভাল ছবি আঁকতেন। কিছু শিখেছিলেন ইতালিয়ান শিক্ষক গিলহার্ডির কাছে। কয়েকটি ছবিতে তার দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যাবে। ছবির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল কথার ছবি আঁকা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছদ্মনাম দিলেন কল্পিতাদেবী। এই নামে প্রতিমা অনেক কবিতা লেখেন প্রবাসীতে। প্রতিটি কবিতা লিখেই তিনি দেখাতে যেতেন কবিকে। বুক ঢিপঢিপ করত ভয়ে। কি জানি হয়ত হয়নি। অথচ না দেখিয়েও তৃপ্তি নেই। কবি বেশ মন দিয়েই দেখতেন। মাঝে মাঝে কলম চালিয়ে তাতে এনে দিতেন ঔজ্জ্বল্যের দীপ্তি। আবার কখনও কখনও প্রতিমার লেখা কবিতাটাকেই ভেঙেচুরে নতুন করে লিখে দেখাতেন কাব্যভাষা বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটাই কেমন নতুন হয়ে ওঠে। যেমন ধরা যাক স্মৃতি কবিতাটা প্রতিমা লিখলেন :
এই গৃহ এই পুষ্পবীথি
যারে ঘেরি একদিন তোমার কল্পনা
গড়েছিল ইমারত দীপ্তি গরিমার,
উত্তপ্ত কামনা তব যার প্রতি ধূলির কণায়
জীবন্ত করিয়াছিল তব মুহূর্তেরে।
যে বাসনা মনে ছিল পুরিল না।
অবসন্ন প্রাণ
গেল চলে ছায়া ফেলে অঙ্গনে প্রাঙ্গণে।
রবীন্দ্রনাথ ভাষা বদলে লিখলেন :
এই ঘর এই ফুলের কেয়ারি
একে ঘের দিয়ে তোমার খেয়াল
বানিয়েছিল পরীস্থানের ইমারৎ।
তোমার তপ্ত কামনা।
রাঙিয়েছিল তার প্রত্যেক ধূলিকণাকে
তার প্রত্যেক মুহূর্তকে করেছিল তোমার আবেগ দিয়ে অস্থির।
তুমি চলে গেলে,
অকৃতার্থ আকাঙ্ক্ষার ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে
অঙ্গনে প্রাঙ্গণে।
কবির সঙ্গে কল্পিতার এই ধরনের কবির লড়াই প্রায়ই হত। তার গদ্য রচনাতে চোখে পড়বে লিপিকার বিশিষ্ট ভঙ্গি। সে যেন গদ্য নয়, গদ্য কবিতা। নটী, মেজবৌ ১৭ই ফান, সিনতলা দুর্গ সবই এক সুরে বাঁধা। প্রতিমার লেখা স্বপ্নবিলাসী পড়ে কবি মুগ্ধ হয়ে লেখেন মন্দিরার উক্তি। পুত্রবধূকে অনুরোধ করেন তার পরের অধ্যায় নরেশের উক্তি লিখতে। অর্থাৎ কবি লিখবেন নারীর উক্তি আর প্রতিমা লিখবেন পুরুষের উক্তি। কিন্তু কবির সঙ্গে হাত মিলিয়ে গল্প লেখা? কল্পিতা রণে ভঙ্গ দিলেন।
এছাড়া প্রতিমা লিখেছেন কিছু স্মৃতিকথা। মায়ের ডায়রি কাহিনী অবলম্বনে লেখা হয় স্মৃতিচিত্র। এতে বেশ পাঁচ নম্বর বাড়ির মেয়েদের কথা আছে। যেমন উৎসবের সাজের কথা। দেবেন্দ্ৰপরিবারে মূর্তি পূজো বন্ধ হয়ে গেলেও গায়ে লাগানো পাশের বাড়িতে বেশ ঘটা-পটা করেই দোলদুর্গোৎসব হত। হবে নাই বা কেন? তখনকার কলকাতায় এই তো ছিল দস্তুর। প্রতিমা লিখেছেন :
প্ৰতি, উৎসবেই মেয়েদের তখন বিশেষ সাজ ছিল। বাসন্তী রঙে ছোপানো কালো পেড়ে শাড়ি, মাথায় ফুলের মালা, কপালে খয়েরের টিপ—এই ছিল বসন্ত পঞ্চমীর সাজ। দুর্গোৎসবে ছিল রঙবেরঙের উজ্জ্বল শাড়ি, ফুলের গয়না, চন্দন ও ফুলের প্রসাধন।
দোল পূর্ণিমারও একটি বিশেষ সাজ ছিল, সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর অতির গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন শাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে আবিরের লাল রঙ শাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।
প্রতিমার বিবরণে গয়নার কথা নেই। গগনেন্দ্রর ছোট মেয়ে সুজাতা আমাদের জানিয়েছেন, সে সময় দিনে সোনার গয়না, বিকেলে মুক্তোর গয়না এবং রাতে হীরে জহরতের জড়োয়া গয়না পরার রেওয়াজ ছিল। বিয়েবাড়িতে কিংবা উৎসবের দিনে তারা এভাবেই সাজতেন। দিনের সোনালি আলোয় সোনার জৌলুষ বাড়ে, রাতের আলো হীরে জহরতে ঠিকরে পড়ে, শুধু মুক্তোর ভূমিকাঁটাই তেমন স্পষ্ট হল না। বিকেলের আলো-আঁধারি আর মন-কেমনকরা গোধূলি আলোয় মুক্তোই বোধহয় সবচেয়ে ভাল দেখায়।
প্রতিমার আসল দান কিন্তু ছবি আঁকা বা লেখা নয়, শান্তিনিকেতনে মেয়েদের জন্যে নাচ শেখাবার ব্যবস্থা। যদিও বাঙালীদের মধ্যে নাচ শেখার একেবারেই কোন ব্যবস্থা ছিল না। সেকালে স্টেজের ওপর তাল রেখে দু পা চলাও ছিল রীতিমতো লজ্জার কথা। বাল্মীকি প্রতিভা বা মায়ার খেলার সবটাই ছিল অভিনয়, সামান্য হাত নেড়ে একটু আধটু নাচের ভাব আনার চেষ্টা করা হত। তবে দিন বদলাচ্ছে। মেয়েরা এগিয়ে এসেছেন সব কাজে উৎসাহ নিয়ে। নাচেই বা পিছিয়ে থাকলে চলবে কেন? শান্তিনিকেতনে এই পরীক্ষা চালানোও অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ। তাই আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রতিমা। নিজে তিনি মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন খুব কম। তার বিয়ের অল্প পরেই শান্তিনিকেতনে মেয়েদের প্রথম অভিনয় লক্ষ্মীর পরীক্ষা, প্রতিমা তাতে সেজেছিলেন ক্ষীরি। এরপর নিজে অভিনয় না করলেও যে কোন রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের তিনিই ছিলেন প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের নিজের মনেও চিত্রাঙ্গদা, পরিশোধ নিয়ে নৃত্যনাট্য রচনার কোন পরিকল্পনা ছিল না। প্রতিমাই একটা খসড়া খাড়া করে কবির কাছে নিয়ে গেলে কবি এই নতুন শিল্পরূপ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠেন।
কিন্তু নাচ কে শেখাবে? শান্তিনিকেতনে কিভাবে শেখান হবে? এ দেশের চোখ নাচ দেখতে অভ্যস্ত নয়। তাতে কি? প্রতিমা শুরু করলেন দুরূহ সাধনা। তিনি নিজে নৃত্যশিল্পী নন, কোনদিন নাচ শেখেননি। অসাধারণ শিল্পবোধের সাহায্যে কে এগোতে হয়েছে। তবে বাঙালীরা যে এ সময় নৃত্য-সচেতন হয়ে উঠেছে তার ইতস্ততঃ প্রমাণ দেখা যেতে লাগল উদয় শংকরের আবির্ভাবে। অবশ্য তখনও তার নৃত্যসঙ্গিনী কোনো ভারতীয় নন, বিদেশিনী সিমকি। ভদ্রবরের বাঙালী মেয়েদের নাচের পথ দেখিয়েছেন রে রায়। য়ুনিভারসিটি ইন্সটিটিউটে ঋতুচক্রের আয়োজন করেছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ও আরো অনেকে। উৎসবের শেষ গান যে কেবল পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে শুরু হতেই রেবা হঠাৎ গানের দল থেকে বের হয়ে এলেন উল্কার মতো স্টেজের মাঝখানে, গানের হালকা ছন্দের সঙ্গে শুরু করে দিলেন চপল নৃত্য! কাণ্ড দেখে সবাই তাজ্জব! চোখ কপালে উঠে গেল। ছি ছি ছি, ভদ্রঘরের মেয়েরা আবার নাচে নাকি? বিষোগারে কান পাতা দায়। এর উত্তর দিলেন সৌম্যেন্দ্র আরো কয়েকদিন পরে। জোড়াসাঁকোর বাড়ির উঠোনে নূপুর বেজে যায় রিণি রিণির সঙ্গে নাচলেন তিনটি মেয়ে চিত্রা, নন্দিত ও সুমিতা। এর বছরখানেক পরে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চস্থ করলেন নটীর পূজা। এই সময় ভদ্রঘরের মেয়েদের নাচার পথ আরো সুগম করে দিলেন কেশবচন্দ্র সেনের নাতনীরা। ১৯২৮ সালে ভিক্টোরিয়া ইটিটিউশনের সাহায্যের জন্যে মঞ্চস্থ করা হল শ্রী কৃষ্ণ! কৃষ্ণের বাল্যরূপ দিলেন নীলিনা আর তার পরবর্তী জীবন রূপায়ণের ভার পড়ল সাধনার ওপর। সাধনা পরবর্তী জীবনে মধু বসুকে বিয়ে করেন ও মঞ্চে-পর্দায় অনেকবার নর্তকীরূপে উপস্থিত হন। সাধনা শিখেছিলেন ভালো কথক নাচ। আলিবাবা, রাজনৰ্তকী, দালিয়া তার অভিনয়ের সাক্ষ্য হয়ে। আছে। রেবা রায়ও নিয়মিত ভাবে নাচ শেখাতে লাগলেন সঙ্গীত সম্মিলনীতে। বড় বড় নৃত্যনাট্যের অনুষ্ঠান শুরু করলেন কিছুদিন পরে। যাক সে কথা।
প্রতিমা শান্তিনিকেতনে যা শেখাচ্ছিলেন তাকে ভাবনৃত্য বলাই উচিত। বর্ষামঙ্গলের দু-একটা নাচে কিছু রূপ দেবার পর প্রতিমা কবিকে পূজারিণী কবিতার নৃত্যনাট্যরূপ লিখে দিতে অনুরোধ করেন। শুধু মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করবেন কবির জন্মদিনে। লেখা হল নটীর পূজা। দিনরাত খেটে প্রতিমা মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করালেন। শ্ৰীমতীর ভূমিকায় অপূর্ব নৃত্যাভিনয় করে চিরস্মরণীয় হয়ে রইলেন নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরী। অবশ্য এ অভিনয় আরো পরের ব্যাপার!
দীর্ঘ চোদ্দ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতিমা রাবীন্দ্রিক নৃত্যনাট্যের পাকা রূপ ফুটিয়ে তুললেন চিত্রাঙ্গদায়। এর আগে এসেছে শাপমোচন। নৃত্য নিয়ে প্রতিমা যে কত ভেবেছেন তার পরিচয় আছে তাঁর লেখা নৃত্য বইখানিতে। চিত্রাঙ্গদাতে যে বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠল তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল চণ্ডালিকাতে। এই বৈশিষ্ট্য কি? যা অন্য থেকে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যকে পৃথক করে রেখেছে। উদয়শংকরের নাচ তখন অনেকে দেখেছেন, দেখেছেন রেবা রায় ও সাধনা বসুর নাচের ধারা। এমন কি শ্ৰীমতীও মডার্ণ ডাসের আঙ্গিকে পরীক্ষামূলকভাবে রবীন্দ্র কবিতার সঙ্গে পরিবেশন করেছেন তার ভাবনৃত্য। চিত্রাঙ্গদা প্রথম মঞ্চায়িত হল ১৯৩৬ সালে নিউ এম্পায়ারে। এর পর ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চিত্রাঙ্গদার অভিনয় হয় চল্লিশবার। এ হিসেব শান্তিদেব ঘোষের রচনা থেকে পাওয়া, তিনি থাকতেন নাচ ও গান উভয় দলেই। অর্জুন, কুরূপা ও সুরূপা চিত্রাঙ্গদা সাজতেন নিবেদিতা, যমুনা ও কবির দৌহিত্রী নন্দিতা। অন্তরালে থাকতেন প্রতিমা। সমস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ-সাজ তাঁর নির্দেশেই পাননা হত। মঞ্চ-সজ্জাতেও তিনি শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাটক ও নৃত্যনাট্যে দৃশ্যসজ্জা ও রূপসজ্জায় যে একটি শালীন সৌন্দর্য আছে প্রতিমা সেটি। কঠোর ভাবে মেনে চলতেন। তাই নারী চরিত্রগুলির সুরুচিসম্মত রূপসজ্জা রচনায় তার নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। শেষ দিকে কবির নির্দেশে তিনি নাটকের মঞ্চসজ্জা কেমন হবে তার স্কেচ করে রাখতেন। কবি তার অনুরোধে আর উৎসাহেই নৃত্যনাট্যগুলির খসড়া করেন আগেই বলেছি। মায়ার খেলারও নতুন রূপ দিয়েছিলেন তিনি। প্রতিমা আবার কথা ও কাহিনীর সামান্য ক্ষতি, গল্পগুচ্ছের ক্ষুধিত পাষাণ ও দালিয়া গল্পকে ট্যাবলো ধরনের মূকাভিনয় আকারে রূপায়িত করে কবিকে দেখিয়েছিলেন। তাতেও অবশ্য অভিনয়ের চেয়ে ভাবনৃত্যের প্রাধান্য ছিল। প্রতিমার নিজের মতে রাবীন্দ্রিক নৃত্যনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য সংমিশ্রণ। শান্তিনিকেতনের নৃত্য কোন বিশিষ্ট নৃত্যকলার আঙ্গিককে গ্রহণ করেনি। মিশ্র তল ও ভঙ্গির সহযোগে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হয়েছে। তাই মণিপুরী আঙ্গিকে গড়ে ওঠা চিত্রাঙ্গদার নাচ সমস্ত মণিপুরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দক্ষিণী আঙ্গিকে তৈরি চণ্ডালিকাকে চেনা যাবে না দক্ষিণী নাচের মধ্যে। মিশ্রণের এমনি গুণ। এর পর এই মিশ্র নৃত্যকে দাড় করান হল সঙ্গীতের ভিত্তির ওপর। সেইটেই হল শান্তিনিকেতনের নতুন দান।
এই সঙ্গীতযোগে নৃত্যের পূর্ণবিকাশ আমাদের প্রাচীন নৃত্যে দেখা যায় না।
রবীন্দ্র-নৃত্যের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্য রক্ষার কথাও ভেবেছিলেন প্রতিমা। তাই গানের স্বরলিপির মতো নৃত্যলিপির কথাও তার মনে আসে। শিল্পী হারিয়ে যাবে। শিল্প হারাবে না। শিল্প যে অবিনশ্বর! রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনে যে শিল্প নৃত্যরূপ লাভ করল, তার মধ্যে আছে আপন স্বকীয়তা। একে যদি ধরে না রাখা হয় তাহলে যে হারিয়ে যাবে সেই নয়ননন্দন ভঙ্গিমা। তাই প্রতিমা আশ্রমের নতুন মেয়েদের নিয়ে নাচের ক্লাস করতেন। মেয়েদের দিয়ে নাচ তৈরি করিয়ে কবিকে দেখাতেন। কবির অনুমোদন না পেলে সন্তুষ্ট হতেন না। চলত অনুশীলনের পর অনুশীলন। তখন অবশ্য সব নৃত্যই ছিল ভাবনৃত্য। গানের ভাবই প্রকাশ পেত নৃত্যভঙ্গিমায়। প্রতিমা নিজেই নাচের মূদ্রা দেখিয়ে দিতেন; পুরোপুরি নাচ তৈরি করে দিতেন সুন্দরভাবে গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে। নাচের বোল ছাত্রীদের লিখে রাখতে বলতেন এবং কলা ভবনের শিল্পীদের দিয়ে নৃত্যের ভঙ্গি আঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন।
রবীন্দ্রনাথকে প্রতিমা যত গভীরভাবে বুঝতেন ততখানি বোধহয় কেউ বোঝেননি! বৃথীন্দ্রের সঙ্গে কবির আদর্শগত মতবিরোধ হত। কিন্তু প্রতিমার সঙ্গে নয়। তাই কবির শেষজীবনের অনুপুঙ্খ ঘটনায় পূর্ণ নির্বাণ প্রতিমার হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। এমন নির্লিপ্ত মৌখিক ভঙ্গিতে তিনি কবির সর্বশেষ পর্যায়টি বর্ণবিরল পরিচ্ছন্ন কয়েকটি হালকা রেখার টানের মতো ফুটিয়ে তুলেছেন যা নিজে না পড়লে বোঝা যায় না। শান্তিনিকেতনে তিনি নারীশিক্ষা ও নারীকল্যাণের দিকটাও দেখতেন। মেয়েদের নিয়ে গড়েছিলেন আলপিনী সমিতি। ইন্দিরা ও হেমলতা ছাড়াও সেখানে ছিলেন সুকেশী, কমলা, মীর ও আরো অনেকেই। মাঝে মাঝে ঘরোয়া এবং পুরোপুরি মেয়েলি অনুষ্ঠানে তারা লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেরাই নানারকম নাচের মুদ্রা অভিনয় করছেন, গান গাইতেন। আবার কখনো কখনো তেঁতুলতলায় ছোট চৌকি পেতে বসে তাঁরা বোলপুরের মেয়েদের শেখাতেন গান, বলতেন গল্প। চারপাশের গ্রামে কাজ করা পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ। তাই প্রতিমার ব্যবস্থায় আশ্রম থেকে মেয়ের পালা করে যেতেন গ্রামে—কখনো হেঁটে কখনো গরুর গাড়ি চড়ে। গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েদের তারা শেখাতেন, কি করে স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি করা যায়, শরীর ভাল করা যায় কিংবা টুকিটাকি হাতের কাজ করে তা থেকে দু পয়সা উপার্জন করে সংসারের সাশ্রয় হয়—এইসব! কবির সমস্ত ইচ্ছেকেই সাগ্রহে রূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন প্রতিমা।
আলাপিনী সমিতির আরেকজন সভ্য ছিলেন দিনেন্দ্রনাথের স্ত্রী কমলা। এরকম আমুদে, সবার মুখে সুখী মেয়ে খুব কমই ছিল। এখনো শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের মানুষেরা কমলা বৌঠানের কথায় খুশি হন। বলেন, তার মতো মানুষ হয় না। খুব আদর যত্ন করতেন। আসলে এক এক জন মানুষ থাকেন যারা অনেক কিছু না করেও জুড়ে থাকেন মনের অনেকখানি, কমলা ছিলেন তাই। কবির সঙ্গেও তার মধুর সম্পর্ক। পরিবারের সবচেয়ে বড় নাতবৌ। সেই সুবাদে কবি প্রায়ই ঠাট্টা-তামাশা করে লজ্জা দিতেন কমলাকে। সবার মাঝে হঠাৎ কমলাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বলতে শুরু করে দিতেন,
কমল তুমি এইখানটিতে বোসস! তোমার সঙ্গে আমার যে খুব ভাব, তা না-হয় ওরা দেখতেই পাবে, না-হয় কলকাতায় গিয়েই বলে দেবে।
ওরা হচ্ছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে সীতা ও শান্তা। আরেক দিনের কথা। তারও সাক্ষী সীত। রবির সঙ্গে কমলের সম্বন্ধটি নিয়ে কবি প্রায়ই ঠাট্টা করেন। তাঁর গানে ঘুরে ফিরে যে কমল কথাটা আসে কেন কে জানে? একজন জানালেন, দিনেন্দ্রনাথ নাকি এতে আপত্তি করছেন কারণ গান শেখাতে গেলে গানে কমল কথাটা থাকলে ছেলেরা হাসে। কবি জানেন সবই। ছেলেদের হাসির কারণ যে কবি নন, স্বয়ং দিনেন্দ্র, তাও জানেন। তাই কবি গম্ভীর হবার ভান করে বলেন, দোষটা মেয়েদেরই। তারাই এ কথাটা ছড়িয়েছে।
আলাপিনী সমিতির নিজস্ব কাগজ ছিল শ্রেয়সী। একদিন শোনা গেল কমলা তার জন্যে একটা গল্প লিখেছেন। কবির মহা উৎসাহ। কেমন গল্প? গল্পের মধ্যে কটা বিয়ে আছে? নেই? বিয়ে ভাঙাও নেই? কমলাকে বললেন, তুমি কোনো কর্মের নয়, একটা বিয়ে দিতে পারলে না?
এরপর প্রতিমা বলে দিলেন, গল্পের নায়ক একজন কবি। আর যায় কোথায়! কবি অত্যন্ত চটে ওঠার ভান করে বললেন, এ নিশ্চয় আমাকে লক্ষ্য করে লেখা, যাও, তোমার সঙ্গে আর কোনো কথা নয়—
শ্রেয়সী পত্রিকার সব কটা সংখ্যা আর পাওয়া যায় না। যে কটি আছে তাতে কমলার গল্পটি পাওয়া যায়নি, শুধু একটিমাত্র লেখা পাওয়া গেছে। গল্প নয়, ছোট্ট একটি রচনা গান। মনে হয় এতে তার স্বামীর হাতই বেশি। দিনেন্দ্রনাথ শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাণ্ডারী ছিলেন না, নিজেও কবিতা লিখতেন। তার প্রথম কবিতার বইটা প্রকাশিত হল নীরব বীণ নামে। বাকা মন্তব্য করলেন সুরেশ সমাজপতি, দাদামশাই আর নাতি এত জোর নীরব বীণা বাজাচ্ছেন যে দুদিন পরে গড়ের মাঠে আর ব্যান্ড পার্টির দরকার হবে না! লজ্জায় দুঃখে সব বই লুকিয়ে ফেললেন দিনেন্দ্রনাথ। তাঁর মৃত্যুর পরে সমস্ত অপ্রকাশিত রচনা একত্র করে সেগুলি প্রকাশ করে কমলা তার কর্তব্য পালন করেন। গান-এর ভাষা সহজ, সরল, প্রাণের ভেতরে প্রবেশ করে।
গানের ভিতর দিয়ে আমরা আপনাকেই উপলব্ধি করতে পারি। আমাদের ব্যথা আনন্দ-বিরহ মিলন এই সকলের সঙ্গেই গানের সুরের অনির্বচনীয়তা মিশ্রিত হয়ে তাদের অসীম সৌন্দর্য দান করে। অন্তরের বাহিরের এই সুরের দেওয়া নেওয়ার ভিতর দিয়েই আমরা বিরোধের মধ্যে ঐক্যকে আর বিচ্ছেদের মধ্যে মিলনকে লাভ করি।
কবির আরো কয়েকজন নাতবৌ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন অমিতা ও অমিয়া ঠাকুর। শ্ৰীমতী কাছে এসেছিলেন বিয়ের অনেক আগে। তবে এরা সবাই এসেছেন বেশ পরে। বরং তার আগে একবার গুণেন্দ্র পরিবারের খোঁজ নিয়ে আসা যাক।