পৃথিবীর শুরু
‘আচ্ছা, একটা কথা বলো দেখি, ডিম আগে না মুরগি আগে?’
কলেজের সেমিস্টার এগজাম চলছিল, তাই বেশ কয়েক সপ্তাহ ভবেশদার সঙ্গে দেখা হয়নি আমাদের। কাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে সন্ধের দিকে আমি আর পিজি বেনুদার দোকানে গিয়েছিলাম চা খেতে। দেখি ভবেশদা বসে আছেন। আমাদের দেখে বললেন,
‘আরে, মানিকজোড় যে, অনেকদিন পরে। পরীক্ষা কেমন হল?’
আর পরীক্ষা, সে কেমন হয়েছে নিজেরাই ভালো জানি না। তাই আমি আর পিজি যেভাবে মাথা নাড়লাম তার মানে ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। তবে ভবেশদা মনে হয় না সেটা খেয়াল করেছেন বলে, আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন,
‘ডিমের অমলেট চলবে নাকি? অনেক খাটনি গেছে তোমাদের, চলো আজকে আমিই খাওয়াই। বেনুউউউ…’
সবার জন্য ডবল ডিমের অমলেট এল, আর এক কাপ করে চা। তারপর চামচ দিয়ে অমলেটের একটা টুকরো কেটে মুখে পুরতে পুরতে কথাটা বললেন ভবেশদা।
‘ডিম আগে না মুরগি আগে?’
‘এ তো খুব বোকা বোকা ধাঁধা, ভবেশদা। এর কোনো ঠিক উত্তর হয় নাকি?’
‘বোকা বোকা বলছ? এই ধাঁধার জনক কে জানো? গ্রিক ফিলোজফার প্লুটার্ক। এখন প্লুটার্ক কে সেটা জানতে চেয়ে তোমাদের লজ্জা দেব না। অমলেটটা দেখে একটা কথা মনে পড়ে গেল তাই প্রশ্নটা করলাম। আমি যদি বলি ডিম আগে তাহলে বিশ্বাস করবে?’
ভবেশদার ট্রেডমার্ক হাসিটা দেখেই বুঝলাম একটা দারুণ গল্প শুরু হল বলে। পিজির মনেও নির্ঘাত এটাই এসেছিল। পাশ থেকে বলল,
‘কে বলল এরকম?’
‘কে আবার বলবে, হিন্দুরাই এমন বলে গেছে। প্রাচীন ইজিপশিয়ানরাও বলেছে। পৃথিবীর সৃষ্টিই তো হল ওইভাবে।’
‘তাই নাকি!’
‘হুম, ইজিপশিয়ানদের গল্পটা শোনো তবে, সব কিছু শুরুর আগে কিছুই ছিল না। আলো, বাতাস, মাটি, আকাশ কিচ্ছু না। ছিল শুধু জল। তার গভীরতা কেউ জানে না। কেউ জানে না কোথায় সেই জলের শেষ। এর নাম ছিল নান, একদিন এই জলেই ভেসে উঠল একটা ডিম। আর হঠাৎ করে ডিমের খোলসটায় চিড় ধরল, এই চিড় ধরার আওয়াজই হল প্রথম শব্দ। ডিমটা ফেটে যেতেই তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল জীবনের প্রথম স্পন্দন। দেখা গেল সেই ডিমের মধ্যে থেকে গজিয়ে উঠছে একটা মাটির ঢিবি। তার ওপরে বসে আছেন একজন পুরুষ। ইনিই প্রথম দেবতা। এঁর নাম আতুম। যিনি নিজেই নিজেকে তৈরি করলেন।’
‘স্বয়ম্ভু!’
‘বাহ, স্পন্দন ভাই! এই নামটা কোথা থেকে শুনলে?’
‘ছোটোবেলায় দাদুর কাছে শুনেছিলাম, ব্রহ্মার আরেকটা নাম, যিনি নিজেই নিজেকে তৈরি করেছেন।’
‘ঠিক বলেছ। মৎস্যপুরাণে আছে মহাপ্রলয়ের কথা, যার পরে চারিদিকে শুধু অন্ধকার ছিল। তারপর সৃষ্টির আদি বীজ ধারণ করে তৈরি হল একটা ডিম, যার নাম হিরণ্যগর্ভ। এই ডিম থেকে জন্ম নিলেন স্বয়ম্ভু। দুটো মিথোলজির মধ্যে কী অদ্ভুত মিল, তাই না!’
‘কিন্তু, এরকম মিল কী করে হতে পারে, ভবেশদা? অত হাজার বছর আগে কি দুটো সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগ ছিল?’
‘ভারতবর্ষ আর মিশরের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হয় যিশুর জন্মের ১৪০০ বছর আগে। কিন্তু বেদের বয়স আরও বেশি। কীভাবে দুটো মিথোলজি এতটা এক হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে, বুঝলে। হয়তো কোনোদিন কেউ এই রহস্যের সমাধান করতে পারবে। যাই হোক, হিন্দু দেবদেবীদের গল্প তো আগেও অনেক শুনেছ। এবারে মিশরের ঈশ্বরদের কথা শোনো, আতুমের কথায় ফিরে আসি।
‘ডিম ফেটে জন্ম নেওয়ার পরে আতুমই তৈরি করলেন সূর্যকে। সেই থেকে সৃষ্টি হল আলোর। এরপরে আতুমেরই শরীরের রস থেকে জন্ম নিল ওঁর দুই সন্তান শু আর তেফনুত। শু হলেন শুকনো বাতাসের দেবতা আর তেফনুত হলেন আর্দ্রতার দেবী। এঁরা তিনজনে মিলে সেই মাটির ঢিপির পৃথিবীতে বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু একদিন হঠাৎ শু আর তেফনুত ঢিপি থেকে পড়ে গিয়ে তলিয়ে গেলেন নান-এর জলের গভীরে।
‘দেবতা আতুম তাঁরর চোখকে পাঠালেন যমজ সন্তানদের খুঁজে আনতে। আতুমের চোখ নানের অতল থেকে তুলে আনল শু আর তেফনুতকে। সন্তানদের খুঁজে পাওয়ার খুশিতে আতুমের চোখ দিয়ে যে জল পড়ল তা থেকে তৈরি হল পুরুষ আর নারীর। এরপরে শু আর তেফনুতের সন্তান হল…’
‘অ্যাঁ! বলেন কী? ভাই বোনের মধ্যে…’
‘হ্যাঁ, এতে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। আগেও তো বলেছিলাম। মিশরের পুরাণে এমন ইন্সেসচুয়াস রিলেশনের ঝুড়ি ঝুড়ি উদাহরণ আছে। ফারাওরা নিজেরাই নিজেদের বোনেদের বিয়ে করতেন। সেকথা পরে বলব ’খন। এখন এই গল্পটা শোনো।
‘শু আর তেফনুতের সন্তান হল গেব আর নুত। গেব হল পৃথিবীর দেবতা আর নুত হল আকাশের দেবী। গেবের শরীরেই জন্ম হল নীল নদের, তার পাঁজর থেকে তৈরি হতে থাকল শস্য। গেব খুব জোরে হেসে উঠলে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়, গেবের রাগে তৈরি হয় খরা। এই গেব আর নুতেরও অনেক সন্তান ছিল। সেই সন্তানেরা ছিল আকাশের তারা। একদিন খুব খিদের মাথায় নুত ওর সন্তানদের খেয়ে ফেলল। স্বাভাবিক কারণেই গেব গেল রেগে। গেবের রাগ কমানোর জন্য তখন নুত গেবের ওপরে ছাতার মতো উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল। ওর দুই হাত আর দুই পায়ের পাতা স্পর্শ করে থাকল উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব আর পশ্চিম দিক। যাতে এরা দু-জনে ঝগড়া না করে তাই এবারে শু দু-জনের মাঝে হাঁটু গেড়ে বসলেন। তাই পৃথিবীকে ঢেকে রেখেছে আকাশ। আর এই দুইয়ের মাঝে আছে বাতাস। নুত হাসলে বাজ পড়ে আর কাঁদলে বৃষ্টি হয়।’
‘বাহ! গল্পটা কিন্তু দারুণ ভােলা!’
‘সবই মানুষের উর্বর মস্তিষ্কের ফসল, ভায়া।’
‘আচ্ছা, আতুমকে দেখতে কেমন ছিল?’
‘গুগলে আতুম লিখে সার্চ করো।’
তাই করলাম, বেশ কয়েকটা ছবি এল।
‘পেলে?’
আতুম
‘হুমম, কিন্তু এটা তো একটা মানুষের ছবি।’
‘হ্যাঁ, তাই তো হওয়ার কথা। মিশরের বেশির ভাগ দেবদেবীর আকারই একদম মানুষের মতো। মাথা বা শরীরের কোনো অংশ কখনো কখনো অন্য পশু বা পাখির হয়। যেমন, এই ছবিটায় দেখো।
‘এটা আতুমের মানুষের রূপ। মাথায় মিশরের ফারাওয়ের মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ ফারাওরা নিজেদের দেবতার অবতার বলে মনে করতেন। তাই ছবি আঁকার সময় অনেক ক্ষেত্রেই ফারাও আর ভগবান মিলেমিশে এক হয়ে যেত। মুকুটের কালো অংশটাই যদি কেউ পরে থাকে তার মানে সে শুধু দক্ষিণ মিশরেরই রাজা। এর নাম ছিল দেশরেত। আর কেউ যদি শুধু সাদা অংশটা পরে থাকে তার মানে সে শুধু উত্তর মিশরের রাজা। এর নাম হেদজেত। এখানে দেখো, আতুম দুটোই পরে আছে। এই মুকুটটার নাম হল শেন্ত। মানে আতুম গোটা দেশটারই সম্রাট।’
‘আর হাতে এগুলো কী?’
আঁখ
‘লম্বা লাঠির মতো যেটা, সেটা হল রাজদণ্ড। দেশশাসনের ক্ষমতা যে তাঁরর হাতেই এটা বোঝানোর জন্য। একে বলে ‘‘ওয়াস’’। ওয়াসের হায়রোগ্লিফিক সাইনও দেখবে এঁকেছিলাম আগের দিন। এরকমই দেখতে। আর অন্য হাতে চাবির মতো যেটা আছে তার নাম ‘‘আঁখ’’। এটা হল জীবনের প্রতীক। এই আঁখ হাতে থাকলেই সে অমর হবে। মৃত্যুর পরের জীবনেও তার শরীরে প্রাণ আসবে। তাই অনেক দেবতার পাশাপাশি ফারাওদেরও দেখবে এই ‘‘আঁখ’’ ধরে আছে। তবে আতুমের কিন্তু আরও অনেক রকমের রূপ হয়, শরীরটা মানুষের থাকলেও মাথাটা বদলে হয়ে যেতে পারে সাপ, ছারপোকা বা পাহাড়ি ভেড়ার।’
‘অ্যাঁ, ছারপোকা!’
‘ঠিকই শুনেছ, কেন সেটা একটু পরেই বলছি। প্রথমের দিকে মিশরের মানুষ সূর্যদেব হিসেবে আতুমেরই পুজো করত। পরে তার জায়গাতে এল ‘‘রে’’ বা ‘‘রা’’।’
‘হ্যাঁ এই ‘‘রে’’-এর নাম তো শুনেছি।’
‘হ্যাঁ, বাইরের জগতে মিশরের যে কয়েকজন দেবতা খুব পপুলার তাদের মধ্যে ‘‘রে’’ একজন। সূর্যর তিন দশার জন্য তিনজন দেবতা তৈরি হয়। আতুম হয়ে যায় অস্তমিত সূর্য, রে হয় মাঝ আকাশের গনগনে সূর্য, আর ভোরবেলার সূর্যের নাম হয় খেপরি। এই খেপরির অবতার ছিল গুবরেপোকা। আরও ভালো করে বলতে গেলে বলতে হয় স্কারাব প্রজাতির বিটল। এদের আমাদের দেশেও দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যের প্রতীক গুবরেপোকা হওয়ার কারণটা এবারে বলি, শোনো।
‘স্কারাব বিটল গোবরের ছোটো ছোটো বল বানিয়ে মাটির ওপর দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়। ওই গোবরের বলের মধ্যে থাকে ওদের নিষিক্ত ডিম, সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে আর উড়ে যায়। মিশরীয়রা এটা জানত না যে এই বিটলদের ছেলে মেয়ে দু-রকমেরই ভাগ হয়। ওরা ভাবত গুবরেপোকাগুলো শুধু পুরুষ প্রজাতিরই হয়। তারা নিজেরাই বাচ্চা তৈরি করে। আর গোবরের বলগুলো অনেকটা সূর্যের মতো গোল। ব্যস, অমনি গুবরেপোকারা জাতে উঠল। নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টি করে। তাই ছারপোকা হয়ে গেল সূর্যদেবের প্রতীক।’
‘বোঝো ঠেলা।’
‘আরও কয়েকটা মজার গল্প শোনো তাহলে, আতুমের চোখের কথা বললাম না একটু আগে, যাকে আতুম পাঠিয়েছিল…’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বললেন তো, শু আর তেফনুতকে খুঁজে আনতে পাঠিয়েছিল।’
স্কারাব বিটল
‘ঠিক, এই চোখ আতুমের শরীরের অংশ, তাই এ আবার আতুমের মেয়েও। আতুমের এই চোখ শু আর তেফনুতকে খুঁজে নিয়ে বাবার কাছে এসে দেখল যে বাবা তার জায়গায় অন্য একটা নতুন চোখ লাগিয়ে নিয়েছে। ব্যস, সে তো রেগে কাঁই। আতুম তাই মেয়েকে ঠান্ডা করার জন্য ওকে একটা কোবরার রূপ দিলেন। সেই কোবরার মিশরীয় নাম হল ইউরেয়াস। এই সাপের ঠাঁই হল আতুমের কপালে, দুই চোখের মাঝখানে। অনেক ফারাওয়ের মুকুটে দেখবে এই সাপ আছে। তুতানখামেনের সোনার মুখোশে দেখতে পাবে ইউরেয়াসকে। আবার অন্য একটা গল্পতে বলা আছে যে এই চোখ রেগে গিয়ে একটা সিংহীর রূপ ধারণ করে, সে তখন একের পর এক মানুষকে মারতে থাকে আর খেতে থাকে। এই সিংহকে বাগে আনে ওর ভাই শু, তাকে সাহায্য করে দেবতা থথ। তারপরে নীল নদের জলে চুবিয়ে ওর মাথা ঠান্ডা করা হয়।’
‘থথ? ইনি কোন দেবতা?’
থথ
‘থথ হলেন জ্ঞান আর জাদুর দেবতা। থথই নাকি ইজিপশিয়ানদের লিখতে শিখিয়েছিলেন। থথের শরীরটা মানুষের হলেও মাথাটা ছিল আইবিস পাখি বা বেবুনের। তোমাদেরকে ‘‘রা’’-এর নৌকোর কথা বলেছিলাম মনে আছে? থথ এই নৌকোর একদিকে দাঁড়িয়ে থাকেন।’
‘আচ্ছা, বুক অফ দ্য ডেড-এও থথের কথা ছিল না?’
‘বাহ, তোমার মনে আছে দেখছি, পিজি ভাই। ঠিকই বলেছ। মৃতের যখন বিচার হয় তখন থথ দাঁড়িপাল্লার পাশে বসে সেই বিচারটা প্যাপিরাসে লিখে রাখেন। এই থথের একটা গল্প বলে আজকের আড্ডাটা শেষ করব।
আইবিস পাখি
‘তেফনুত যে আর্দ্রতার দেবী ছিলেন সেটা আগেই বললাম তোমাদের। এই তেফনুত একবার বাবা ‘‘রা’’-এর ওপরে রাগ করে মিশর ছেড়ে চলে গেলেন। তার ফলে গোটা দেশ শুকিয়ে গেল। তেফনুতকে ফিরিয়ে আনার জন্য রা পাঠালেন থথকে। থথের সঙ্গে যখন তেফনুতের দেখা হল তখন তেফনুত একটা ভয়ংকর সিংহীর রূপ ধরে আছেন, অনেকটা সেই আতুমের চোখের মতো গল্পটা। যাই হোক, থথ বুঝলেন যে তেফনুতের সঙ্গে শক্তিতে পারা যাবে না। তাই কথা দিয়ে থথ তেফনুতকে ভোলাতে শুরু করলেন। এইভাবে তেফনুতকে বশ মানিয়ে থথ ওঁকে মিশরে ফিরিয়ে আনলেন, দেশে আবার জল ফিরে এল। থথ তেফনুতকে অনেকগুলো গল্প বলেছিলেন, তার একটা শুধু বলি তোমাদের।
‘একটা জঙ্গলে একটা বিশাল বড়ো সিংহ থাকত। তার প্রবল পরাক্রম। সবাই তাকে ভয় পেত। একদিন একটা পাহাড়ের নীচে সিংহর সঙ্গে দেখা হল একটা চিতাবাঘের। আধমরা হয়ে শুয়ে আছে। গায়ের চামড়া কেউ একটা ছাড়িয়ে নিয়েছে। সিংহ ওকে জিজ্ঞাসা করল, কে করল এমন তোমার সঙ্গে?
‘‘চিতাবাঘ কোনোরকমে জবাব দিল, মানুষ।’’
‘‘মানুষ?”
‘‘হ্যাঁ, মানুষ, খুব ধূর্ত এরা, তুমি কখনো ভুলেও ওদের পাল্লায় পোড়ো না।”
আইবিস পাখির মমি
‘সিংহর তো মাথা গেল গরম হয়ে। এই মানুষকে দেখতে পেলেই শায়েস্তা করতে হবে। এই ভেবে সিংহ আর কয়েক পা এগিয়েছে, দেখল একজোড়া গাধা, ওদেরকে একটা জোয়াল দিয়ে কেউ বেঁধে দিয়েছে।
‘‘কে করল এরকম?”
‘‘মানুষ।”
‘‘মানুষ!”
‘‘হ্যাঁ, ওরা ভয়ানক প্রাণী! ভুলেও ওদের সামনে এসো না!”
‘সিংহর রাগ তো আরওই বেড়ে গেল। ও সব জায়গায় মানুষকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। সেই সময় আরও বেশ কিছু জানোয়ারের সঙ্গে দেখা হল ওর। একটা ষাঁড় আর একটা গোরু যাদের নাকে ফুটো করা, একটা ভল্লুক যার নখগুলো কাটা, একটা অন্য সিংহ যার একটা পা একটা গাছের ফাঁকে আটকানো। সবই নাকি সেই মানুষের কীর্তি।
‘এই মানুষ নামের জীবকে হাতে পেলে মেরেই ফেলব, এই ভাবল সিংহ।
‘একদিন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সিংহ হাঁটছে, এমন সময় একটা ছোটো ইঁদুর এসে ওর সামনে পড়ল। সিংহ থাবা উঁচিয়ে ইঁদুরটাকে মারতে যাবে এমন সময় ইঁদুরটা বলল,
‘‘দয়া করে আমাকে মারবেন না। এই এতটুকু শরীরটা খেয়ে তো আপনার খিদে মিটবে না। কিন্তু আপনি যদি আমাকে না মারেন তাহলে ভবিষ্যতে কখনো আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।”
‘এইটুকু একটা প্রাণী আর কী-বা সাহায্য করবে, এই ভাবল সিংহ। কিন্তু দয়া পরবশ হয়ে ইঁদুরটাকে ছেড়েও দিল।
‘সেইদিনই সিংহ একটা শিকারির জালের ফাঁদে পড়ল। অনেক চেষ্টা করেও আর নিজেকে কিছুতেই ছাড়াতে পারল না। এমন সময় সেই ইঁদুরটা ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। সিংহর এই অবস্থা দেখে ও এগিয়ে এল। তারপরে দাঁত দিয়ে জাল কেটে সিংহকে মুক্ত করল। সিংহ জাল থেকে বেরিয়ে বুঝল মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না। এই ভেবে জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে গেল।’
আমি আর পিজি চুপ করে গল্পটা শুনছিলাম, পিজি এবারে প্রায় বেঞ্চ থেকে লাফিয়ে উঠল,
‘আরিব্বাস! এই সিংহ আর ইঁদুরের গল্পটা অনেকটা ইশপের গল্পটার মতো না!’
‘হ্যাঁ ভাই, ইশপ কে ছিল বলো তো?’
‘সেটা তো জানি না।’
‘ইশপ ছিল একটা গ্রিক ক্রীতদাস। সে নাকি গল্পগুলো মুখে মুখে বলত। ইশপ যে সময়কার মানুষ সেই সময় গ্রিসের সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক বেশ শক্তপোক্ত ছিল। তাই এটা একেবারেই অসম্ভব নয় যে মিশরের পুরাণের গল্পগুলোই ইশপের মুখে ফিরে এসেছে। তবে তোমাদের ডাক্তারির সঙ্গেও কিন্তু ইজিপশিয়ান মাইথোলজি জড়িয়ে আছে।’
‘বলেন কী!’
ভবেশদা এবারে একটা ভ্রূ তুলে বললেন,
‘একটা এমন চিহ্ন, যেটাকে তোমরা বার বার দেখেছ। তবুও কখনো ভাবনি এটা এল কোথা থেকে। দেখো, গুগল করে কিছু পাও কি না। কাল সন্ধের দিকে দোকানে এসে উত্তরটা বলে দিয়ে যেয়ো।’