১৩. পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট 

জিজ্ঞাসু পড়ুয়ার চিঠি – ১

রবিবার দুপুরবেলা। মফসসলের শহরতলিতে সকালবেলায় খবরের কাগজ পাবার উপায় নেই। শরীরটাও বিশেষ ভালো নেই। তাই শুয়ে-শুয়ে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে ‘মোহনবাগানের অপরাজিত আখ্যা’ চোখে পড়তেই শরীরটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। খেলার খবর শেষ করেই আবার শরীর এলিয়ে দিলাম। আলস্যবশে পাতা ওলটাতে ওলটাতে চোখে পড়ল কবিতার ক্লাস। আগেও চোখে পড়েছে। কিন্তু কোনও দিন ওই ক্লাসে পাঠ নিতে উৎসাহ হয়নি। আমাদের প্রধান অধ্যাপক মহাশয় বাংলা কবিতা পড়ান। তার কাছে পাঠ নিতে-নিতে কবিতার ক্লাসের প্রতি আমার কেমন একটা অ্যালার্জি হয়ে গেছে। তার ক্লাসে পাঠ নিতে গেলেই গায়ে যেন জুর এসে যায়। তাই আনন্দবাজাক-এর কবিতার ক্লাসের চৌকাঠ মাড়াবার ইচ্ছাও হয়নি কোনও দিন। কিন্তু আজকের অলস দুপুরে ওদিকে তাকাতেই চোখে পড়ে গেল। কয়েকটি ছড়া। ছড়ার টানেই ঢুকে পড়লাম ক্লাসে। ভারী আশ্চর্য লাগল। এ তো কবিকঙ্কণের ক্লাস নয়, স্বয়ং ছন্দ-সরস্বতীর ক্লাস। মনে হল, কবি সত্যেন্দ্রনাথ যে ছন্দ-সরস্বতীর কাছে পাঠ নিয়েছিলেন, আমিও যেন তার কাছেই পাঠ নিচ্ছি। এ হল কী? আমার ছন্দাতঙ্ক রোগটা সেরে গেল কী করে? এই রোগটার একটু ইতিহাস আছে। আমাদের অধ্যাপক মশাই নিজে কবি, তার উপরে গুরুতরভাবে ছন্দ-ভক্ত। আমি বলি, ছন্দের অন্ধভক্ত। তিনি যখন কবিতা পড়েন, তখন কবিতা পড়েন না ছন্দ পড়েন, বোঝা ভার। পড়ানোও তথৈবচ। তার বাইবেল হচ্ছে প্ৰবোধ সেনের ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ বইখানি। আমি বলি, বাইবেল নয়, ছন্দোগ্য উপনিষদ। তাঁর টিউটোরিয়াল ক্লাসের জ্বালায় বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। বইটার গুরুত্ব অস্বীকার করবার উপায় নেই। নাড়াচাড়া করবার পক্ষে রীতিমতো গুরুভার। দুৰ্বহ বা দুঃসহ বললেই ঠিক হয়। তাঁর এই বইটা পড়বার চেষ্টা করতে গিয়ে ডি.এল. রায়ের একটি হাসির গান মনে পড়ে গেল। আমনি ওটাকে একটু বদলে নিয়ে দাঁড় করালাম। এই চারটি লাইন :

প্ৰবোধচন্দ্র ছিলেন একটি
ছন্দশাস্ত্ৰ-গ্ৰন্থকার;
এমনি তিনি ছন্দতত্ত্বের
করতেন মর্ম ব্যক্ত–
দিনের মতো জিনিস হত
রাতের মতো অন্ধকার,
জলের মতো বিষয় হত
ইটের মতো শক্ত।

এতেও মনের ঝাল মিটাল না। গ্রন্থকার-অন্ধকার মিলটাও জুতসই নয়। তাই প্রথম লাইনটাকে আরও বদলে দিলাম–

প্ৰবোধচন্দ্র ছিলেন একটি
অপখ্যাত ছন্দকার।

এবার অপখ্যাত আখ্যা দিয়ে মনের ঝালাও মিটাল, ছন্দকার-অন্ধকার মিলে কানও খুশি হল।

প্ৰবোধচন্দ্রের বইটার আরও একটা বিশেষত্ব আছে। এই বইতে রবীন্দ্রনাথের ও অন্যান্য কবিতের ভালো-ভালো কবিতাকে ছন্দের ছুরি দিয়ে এমন কাটাছেঁড়া করা হয়েছে যে, এই বই পড়ার পরে কবিতার উপরেই অশ্রদ্ধা জন্মে যায়। কোনও কোনও বন্ধু এই বইটাকে বলেন কবিতার ডিসেকশান রুম বা পোস্ট মরটেম রুম। আমি বলি কসাইখানা। ভালো-ভালো কবিতার উপরে এরকম নৃশংস উৎপাত দেখে প্ৰবোধ সেন সম্বন্ধেই একটা ছড়া বানিয়েছি। কবিতা-ক্লাসের অন্যান্য পড়ুয়াদেরও যদি আমার মতো। এ-বই পড়বার দুর্ভাগ্য হয়ে থাকে, তবে আমার ছড়াটা শুনে তাঁরাও কিছু সান্ত্বনা পেতে পারেন। তাঁদের তৃপ্তির জন্য ছড়াটা নিবেদন করলাম :

পাকা ধানে মই দেন, ক্ষেত্ৰ চাষেন।
বাংলা কাব্যক্ষেতে তিনিই প্র-সেন।

বলা উচিত যে, ছড়া বানাবার কিছু অভ্যাস আমার ছিল। কিন্তু ছন্দের হিসেব রাখার বালাই ছিল না। কেন-না, আমি মনে করি, ছন্দ গোনার বিষয় নয়, শোনার বিষয়। চোখে ছন্দ দেখা যায় না, কানে শুনতে হয়। কোন রচনাটার কী ছন্দ, কোন বৃত্ত, কয় পর্ব বা মাত্রা, এসব শুনলেই আমার আতঙ্ক উপস্থিত হয়। এই নিয়ে আমার ছন্দো-পাওয়া সহপাঠী কবি-বন্ধুর (সে আবার অধ্যাপক মহাশয়ের পেয়ারের ছাত্র) সঙ্গে প্রায়ই হাতাহাতি হবার উপক্ৰম হত। একদিন অবসথা। চরমে পৌঁছোলা। আমার ক্ষমাগুণে সেদিন শান্তি রক্ষা হয়েছিল। সে একখণ্ড কাগজে আমাকে শাসিয়ে একটি ‘কবিতা” রচনা করে আমার দিকে ছুড়ে দিল। কবিতাটি এই :

ওরে হতভাগা হলধর পতিতুণ্ড।
মুখটি খুলিলেই গুড়িয়ে দেব মুণ্ড।
ফের যদি তুই বানাতে চাস রে ছন্দ,
সব লেখা একদম করে দেব বন্ধ।

এই কবিতা পড়ে আমার শুধু দম বন্ধ হবার নয়, পেট ফাটবারও উপক্ৰম হয়েছিল। কিন্তু কিছু না-বলে ক্ষমা করতে হল। কবি-বন্ধুর কথা দিয়ে কথা রাখার সৎসাহস সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্ৰ সন্দেহ ছিল না। সহপাঠী বন্ধুরা একবাক্যে বললেন, এই কবিতাটির ছন্দ নির্ভুল, মাত্ৰাসংখ্যার হিসেব ঠিক আছে। কিন্তু আমার–

কান “তা শুনি গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া কহে—
‘নহে, নহে, নহে।’”

কান ও জ্ঞানের বিবাদভঞ্জন করতে না পেরে তখন থেকেই ছড়া বানানো একদম বন্ধ করে দিলাম। বন্ধুবরও আমার এই সত্যনিষ্ঠা ও নৈতিক সাহসের তারিফ করেছিল। তার এই গুণগ্রাহিতার প্রশংসা না করে পারিনি।

ছড়া বানানো বন্ধ করার আরও একটা কারণ ঘটেছে। অধ্যাপক মহাশয় একদিন ক্লাসে এসেই প্ৰবোধ সেনের আর-একখানি সদ্য-প্রকাশিত বই সকলের সামনে তুলে ধরলেন। তারপর চলল প্রশস্তি-বচন। আমি মনে মনে ভাবলাম৷- “এক রামে রক্ষা নাই, সুগ্ৰীব দোসর।”

বইটির নাম ছন্দ-পরিক্রমা। প্রথমে মনে হল, ছন্দ-পরিশ্রমা। অধ্যাপক মহাশয়ের নির্দেশে এই বইটাও নাড়াচাড়া করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে হল “ছন্দ-পণ্ডশ্রমা”। আমার মতো স্বভাবকবিকে ছন্দ বোঝাবার সমস্ত চেষ্টাই পণ্ডশ্রম, এ কথা স্বীকার করতে লজা নেই। বইটির প্রথমেই পরিভাষা, শেষেও তা-ই। পরিভাষার ইটপাটকেলে হোঁচটা খেতে-খেতে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। এগোনো আর হয় না। কোনও পরিভাষা কেন মানতে হবে বা কেন ছাড়তে হবে, তার যুক্তিজালে জড়িয়ে গিয়ে দিশেহারা হতে হয়। প্ৰবোধ সেনই একসময়ে ছন্দের তিন রীতির নাম দিয়েছিলেন- অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। আর তিনিই বারবার নাম-বদল করে চলেছেন। এই বই পড়তে গিয়ে ডি.এল. রায়ের আর-একটা হাসির গান মনে পড়ে গেল :

“ছেড়ে দিলাম পথটা
বদলে গেল মতটা,
এমন অবস্থাতে পড়লে
সবারই মত বদলায়।”

এই মত-বদল নাম-বদলের পালা কবে শেষ হবে কে জানে। ততদিন ছন্দ শেখার ও ছন্দ লেখার কাজটা মুলতুবিই থাক না। তা ছাড়া যেটুকু সহজাত ছন্দবোধ আমার ছিল, এই বই পড়ে তা-ও ঘুলিয়ে গেল। সুতরাং ছড়া বানাবার অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর উপায় কী?

এমন সময়ে কবিকঙ্কণের কবিতার ক্লাসে ঢুকে যেন দিব্যদৃষ্টি পেয়ে গেলাম। ছন্দতঙ্ক অ্যালার্জি কেটে গেল। উৎসাহিত হয়ে আগের সপ্তাহের রবিবাসরীয় আনন্দবাজার খুঁজে-পেতে বার করলাম। সে-সপ্তাহের কবিতার ক্লাসেও পাঠ নেওয়া গেল। দুই ক্লাসের পাঠ নিয়েই ছন্দবোধের কুয়াশা যেন অনেকটা কেটে গেল। আরও পাঠ নেবার জন্য মনটা উৎসুক হয়ে উঠেছে। আশা হয়েছে, পাঠ নেওয়া শেষ হলে ছন্দো-পাওয়া কবিবন্ধুকে একবার দেখে নিতে পারব। আর প্রবোধচন্দ্রের অন্ধভন্তু অধ্যাপক মহাশয়কেও…। না সে-কথা থাক। ইতিমধ্যে ভালো করে পাঠ নিয়ে রাখা দরকার। আর তা হাতে-কলমে হলেই ভালো। ভরসার কথা এই যে, অধ্যাপক সরখেল মহাশয়ের নাতি ও ভৃত্যটির ছড়া শুনে আমার সেই ছড়া বানাবার ছেড়ে-দেওয়া অভ্যাসটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন কবিতার ক্লাসের মনোযোগী ছাত্রের মতো পাঠ নিতেও পারব, প্রশ্ন করতেও পারব। প্রশ্নগুলি বোকার মতো না হলেই হল।

অধ্যাপক সরখেলের দৃষ্টান্ত নিয়েই নূতন ছড়া বানিয়ে প্রশ্ন করব :

স্বৰ্ণপাত্র নয় ওটা উধৰ্ব নীলাকাশে,
বিশ্বের আনন্দ নিয়ে পূৰ্ণচন্দ্ৰ হাসে।

এটা কোনরীতির ছন্দ? অক্ষরবৃত্তের? ভুল করিনি তো? এবার ছন্দের রীতিবদল করা যাক।

স্বৰ্ণপাত্র নয় সুনীল আকাশে,
পূর্ণিমা-চাঁদ হোথা সুখভরে হাসে।

এটা মাত্রাবৃত্ত তো? আমার কান তো তাই বলে। কর্ণধাররা কী বলেন, জানতে চাই। কানমলার ভয় যে একেবারেই নেই, তা বলতে পারি না। আবার রীতিবদল করা যাক :

সোনার থালা নয় গো ওটা
সুদূর নীলাকাশে,
বিশ্বপ্রাণে জাগিয়ে পুলক
পূৰ্ণিমা-চাঁদ হাসে।

এটাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলা যায় কি? আমার কান তো তা-ই বলে। জ্ঞানের বিচারে কানের দণ্ডবিধান না হলেই বঁচি। জ্ঞানের এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ালে প্ৰাণটাও ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। হাকিমের রায় শূনে কানও অনেক সময়ে লাল হয়ে ওঠে। তবু অধ্যাপক সরিখেল মহাশয়ের পরীক্ষার হলে হাজির হয়েছি। যদি তার কাছে পাস-মার্কা পেয়ে যাই, তাহলে ছন্দো-পাওয়া কবি-বন্ধু ও প্রসেন-ভক্ত ছন্দঅধ্যাপককে…। না, এখনও সে-কথা বলবার সময় হয়নি। আগে তো কবিতার ক্লাসে রীতিমতো পাঠ নিতে হবে, প্রশ্নও করতে হবে সন্দেহ দূর করবার জন্য।

এবার মনের দুঃখে নিজের দুরবস্থার কথা ফলাও করে বলতে হল। ভবিষ্যতে সরখেল মহাশয়ের বিরক্তি ঘটাব না। সংক্ষেপেই প্রশ্ন করব।

 

কবিকঙ্কণের উত্তর

নাম যদিও জানা গেল না, তবু আমার বিন্দুমাত্ৰ সন্দেহ নেই যে, ‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’ একজন পাকা ছান্দসিক। আমার ধারণা ছিল নেহাতই পাঠশালা খুলেছি, প্রথম পড়ুয়ারা যাতে ছন্দের ব্যাপারটাকে মোটামুটি ধরতে পারেন তার জন্যে সহজ করে। সব বুঝিয়ে বলব, জটিলতার পথে আদীে পা বাড়াব না। বাড়াবার সাধ্যও আমার নেই। একজন পাকা ছান্দসিক যে হঠাৎ সেই পাঠশালায় ঢুকে, পড়ুয়ার ছদ্মবেশে, পাটির উপরে বসে পড়বেন, এমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তার পদার্পণে আমি কৃতাৰ্থ, কিন্তু ক্লাস নেবার কাজটা এবারে আরও কঠিন হয়ে উঠল।

‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’ কিছু প্রশ্ন করেছেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তর আমি এখুনি দিচ্ছিনে। ভাবছি, গোলমেলে কেস হাতে এলেই ছোটো ডাক্তাররা যেমন বড়ো ডাস্তারের সঙ্গে কনসালট করেন, তেমনিই আমাকেও হয়তো বড়ো ডাক্তারের শরণ নিতে হবে। এ-ব্যাপারে। আমি যাঁকে সেরা ডাক্তার বলে মানি, তিনি কলকাতায় থাকেন না। উত্তর পেতে তাই হয়তো দেরি হবে।

ইতিমধ্যে একটা কথা অকপটে নিবেদন করি। সেটা এই যে, ‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’ যদিও আমরা দারুণ প্ৰশংসা করেছেন, তবু আমি খুশি হতে পারছিনে। খুশি হতে পারতুম, যদি তঁর চিঠিতে শ্ৰীপ্ৰবোধচন্দ্ৰ সেন সম্পর্কে কোনও বক্লোক্তি না থাকত।

কথাগুলি আমার জানা নেই। প্রথম কথাগুলি যদি জেনে থাকি, তবে শ্ৰীযুক্ত সেনের কাছ থেকেই জেনেছি। পরে আরও দু-এক জন প্রখ্যাত ছান্দসিকের কাছে পরোক্ষে পাঠা নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু শ্রীযুক্ত সেনের কাছে আমার ঋণের পরিমাণ তাতে লাঘব হয় না। এই স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল। ‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’ যদি এর ফলে আমার উপরেও চটে যান, তো আমি নিরুপায়।

 

‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’র চিঠি-২

সশ্রদ্ধ নিবেদন এই। যে শ্রদ্ধা নিয়ে আপনার কবিতার ক্লাসে আসন নিয়েছি, প্ৰত্যেক পাঠের পরে সে-শ্রদ্ধা ক্ৰমে বাড়ছে। গত রবিবারের পাঠ শুনে এবং আমার প্রশ্নের উত্তরে আপনার বক্তব্য জেনে আমার ছন্দবোধের কুয়াশা আরও অনেকখানি কেটে গেল। যাঁকে আমি ‘কবিঘাতক ছান্দসিক’ আখ্যা দিতেও কুষ্ঠাবোধ করিনি, আপনি সেই প্ৰবোধচন্দ্র সেনের প্রতি খুবই অনুকুল মনোভাব প্রকাশ করেছেন। চটে যেতাম, যদি আপনার সম্বন্ধে অটুট। শ্রদ্ধা না থাকত। তাই চটে না গিয়ে তঁর সম্বন্ধে আমার মনোভাবটা ঠিক কি না তা-ই যাচাই করে দেখতে হল। আপনার শেষ পাঠের সঙ্গে প্ৰবোধচন্দ্রের ‘ছন্দ পরিক্রমা’ বইটির মতামতটা মিলিয়ে দেখলাম। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ সম্বন্ধে দুইজনের মতের মিল দেখে আমার বক্লোক্তিগুলির জন্য একটু কুষ্ঠাবোধই হল। এই বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে অক্ষরবৃত্তের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি দিয়েছেন :

“পশমী শাল গায়ে দিয়ে
গেলাম কাশ্মীরে,
রেশমী জামা-গায়ে শেষে
আগরা এনু ফিরে।”

আপনার দৃষ্টান্তগুলির মিল দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দুই জনের হিসাব দেবার রীতিতেও যথেষ্ট মিল। … কিন্তু একটা জায়গায় একটু খটকা লাগল। রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতায় আছে :

“আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।”

এখানে ‘আকবর’ শব্দে। আপনি ধরেছেন তিন মাত্রা, ‘বাদশার’ শব্দেও তাই। ‘বাঁশি’ কবিতাটি পড়ে আমার মনে হল, ওই দুই শব্দে চার-চার মাত্ৰাই ধরা হয়েছে। কেন-না, ওই কবিতাটিতে টিকটিকি, ট্রামের খরচা, মাছের কানকা’, ‘আধমরা’ প্রভৃতি সব শব্দেরই মধ্যবর্তী হসবৰ্ণকে একমাত্রা বলে ধরা হয়েছে, কোথাও ব্যতিক্ৰম নেই। সুতরাং ‘আকবর’ ও ‘বাদশা’ শব্দের ক ও দ-কে একমাত্রা হিসেবে ধরা হবে। না কেন?

সবশেষে বলা উচিত যে, এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য কবিতা-ক্লাসের সহায়তা করা, বাধা সৃষ্টি করা নয়। প্ৰবোধচন্দ্রও তীর ছন্দ-পরিক্রমা” বইটির নিবেদন অংশে জিজ্ঞাসু ছাত্রের প্রশ্নকে তাঁর চিন্তার সহায়ক বলেই স্বীকার করেছেন। তাই আশা করি আপনিও আমার প্রশ্নকে সেভাবেই গ্ৰহণ করবেন। ইতি ২০ আশ্বিন ১৩৭২।

অনুলেখ : আজকের পাঠের একটি দৃষ্টান্ত সম্বন্ধেও মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে। সেটাও নিবেদন করি।–

‘কালকা মেলে টিকিট কেটে সে
কাল গিয়েছে পাহাড়ের দেশে।’

এটা অক্ষরবৃত্ত রীতিতে পড়তে গিয়ে যতটা কানের সায় পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি সায় পেয়েছি স্বরবৃত্ত রীতিতে পড়ে। এরকম সংশয়স্থলে কী করা উচিত? ইতি ২৩ আশ্বিন ১৩৭২।

 

কবিকঙ্কণের উত্তর :

গত সপ্তাহের রবিবাসরীয় আলোচনীতে ‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’র চিঠি পড়লুম।

(১) তাঁকে যে আমি প্ৰবোধচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে পেরেছি আপাতত এইটেই আমার মস্ত সাফল্য।

(২) ‘ছন্দ-পরিক্রমা’ আমি এখনও পড়িনি। পড়তে হবে। ছন্দ নিয়ে যখন আলোচনা করতে বসেছি, তখন প্ৰবোধচন্দ্রের সব কথাই আমার জানা চাই। শুনেছি প্ৰবোধচন্দ্ৰ এখন বাংলা কবিতার মূল ছন্দ তিনটির অন্য প্রকার নামের পক্ষপাতী। কেন, তা আমি জানিনে। জানতে হবে। ছিন্দ-পরিক্রমা” গ্রন্থে ব্যক্ত মতামতের সঙ্গে আমার ধারণার যদি বিরোধ না ঘটে, তবে সে তো আমার পক্ষে পরম শ্লাঘার বিষয়।

(৩) ‘বাঁশি’ কবিতার লাইন দুটির প্রসঙ্গে জানাই, স্মৃতি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার স্মৃতিতে লাইন দুটির স্বাতন্ত্র্য বজায় ছিল না, তারা এক হয়ে গিয়েছিল, এবং সেইভাবেই, অর্থাৎ টানা লাইন হিসেবে, তাদের আমি উদ্ধৃত করেছিলাম। টানা লাইন হিসেবে গণ্য করলে দেখা যাবে, ‘আকবর’ ও ‘বাদশার’— এই দুই শব্দের কাউকেই তিন-মাত্রার বেশি মূল্য দেওয়া যায় না। দোষ আমার বিচারের নয়, অসতর্কতার।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আকবর বাদশার সঙ্গে’- এই লাইনটিকে যদি পরবর্তী লাইনের সঙ্গে জুড়ে না-ও দিই, অর্থাৎ তাকে যদি আলাদাই রাখি, তবে তাতেই কি নিঃসংশয় হওয়া যায় যে, ‘আকবর’ ও ‘বাদশার’— এরা চার-মাত্রারই শব্দ? বলা বাহুল্য, পুরো লাইনটিকে দশ-মাত্রার মূল্য দিলে তবেই এরা চার-চার মাত্রার শব্দ হিসেবে গণ্য হবে। জিজ্ঞাসু পড়ুয়া সে-দিক থেকে ন্যায্য কথাই বলেছেন। কিন্তু পুরো লাইনটির মাত্ৰা-সংখ্যা যে দশের বদলে আটও হতে পারে, এমন কথা কি ভাবাই যায় না? যে-ধরনের বিন্যাসে এই কবিতাটি লেখা, সেই ধরনের বিন্যাসে রবীন্দ্ৰনাথ অনেক ক্ষেত্রে চার-মাত্রা কিংবা আট-মাত্রার লাইন রাখতেন। ‘বাঁশি’ কবিতাটিতেও আট-মাত্রার লাইন অনেক আছে।

মুশকিল এই যে, ‘আকবর বাদশার সঙ্গে’- এই লাইনও যে সেই গোত্রের, অর্থাৎ আট-মাত্রার, তা-ও আমি জোর করে বলতে পারছিনে। জিজ্ঞাসু পড়ুয়া এটিকে দশ-মাত্রার মূল্য দিয়েছেন : দিয়ে ‘আকবর’ এবং বাদশার’— এই শব্দ দুটিকে চার-চার মাত্রার শব্দ বলে গণ্য করেছেন। তিনি ভুল করেছেন, এমন কথা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। শুধু অনুরোধ জানাই, তিনিও একবার ভেবে দেখুন, পুরো লাইনটিকে আট-মাত্রার মূল্য দিয়ে, যদি কেউ ওই শব্দ দুটিকে তিন-তিন মাত্রার শব্দ হিসেবে গণ্য করে, তবে সেটা অন্যায় হবে কি না।

জিজ্ঞাসু পড়ুয়া অবশ্য তাঁর সিদ্ধান্তের সপক্ষে একটি জোরালো যুক্তি দিয়েছেন। সেটা এই যে, ওই কবিতাটিতে “সব শব্দেরই মধ্যবর্তী হস্বৰ্ণকে এক-মাত্রা বলে ধরা হয়েছে, কোথাও ব্যতিক্ৰম নেই।” সুতরাং ‘আকবর’ ও ‘বাদশার’ শব্দের মধ্যবর্তী ‘ক’ ও ‘দ’-কেও একটি করে মাত্রার মূল্য দেওয়া উচিত।

ঠিক কথা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি এমন কবিতা লেখেননি, যাতে শব্দের মধ্যবর্তী হস্বৰ্ণ কোথাও-বা মাত্রার মূল্য পায়, কোথাও-বা পায় না? এমন কথা কেমন করে বলি? “আরোগ্য’ গ্রন্থের ‘ঘণ্টা বাজে দূরে” কবিতাটি দেখা যাক। সেখানে দেখছি, “হেথা হোথা চরে গোরু শস্যশেষ বাজরার খেতে’- এই লাইনটিতে বাজরার” শব্দের মধ্যবর্তী জ’-কে একটি মাত্রার মূল্য দিতে হয় বটে, কিন্তু তার পরের লাইনেই (“তরমুজের লতা হতে”) তরমুজ শব্দের মধ্যবতী ‘র’-কে মাত্রার মূল্য দিতে হয় না।

বলা বাহুল্য, এতেই প্রমাণিত হয় না যে, ‘ঘণ্টা বাজে দূরে কিংবা অন্যান্য কবিতায় যে-হেতু ব্যতিক্ৰম আছে, অতএব বাঁশি’ কবিতাতেও ব্যতিক্ৰম আছে, এবং “আকবর বাদশার সঙ্গে”- এই লাইনটিকেও আট-মাত্রার লাইন হিসেবে গণ্য করে। ‘ক’ আর “দ”-কে মাত্রার মূল্য থেকে বঞ্চিত করতেই হবে। না, এমন অদ্ভুত দাবি আমি করি না। বরং বলি, সম্ভবত জিজ্ঞাসু পড়ুয়ার কথাই ঠিক, সম্ভবত ‘আকবর’ ও বাদশার’— এরা চার-চার মাত্রার শব্দই বটে। কিন্তু একই সঙ্গে অনুরোধ জানাই, অন্য রকমের বিচারও সম্ভব কি না, জিজ্ঞাসু পড়ুয়া যেন সেটাও একবার সহৃদয় চিত্তে ভেবে দেখেন।

ইতিমধ্যে আর-একটা কথা বলা দরকার। অক্ষরে-অক্ষরে অসবর্ণ মিলনের দৃষ্টান্ত হিসেবে জিজ্ঞাসু পড়ুয়ার দরবারে ‘আকবর’ এবং বাদশার যদি একান্তই পাস-মার্ক না পায়, তাহলে রবীন্দ্রকাব্য থেকেই আর-একটি দৃষ্টান্ত আমি পেশ করতে পারি। “জন্মদিনে” গ্রন্থের “ঐকতান” কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “ভালো নয়, ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজদুরি।” মজদুরি’ শব্দটিতে “জীয়ে দিয়ে অসবর্ণ মিলন ঘটেছে, জিজ্ঞাসু পড়ুয়া এ কথা আশা করি স্বীকার করবেন। শব্দটিকে কোনওক্রমেই তিন-মাত্রার বেশি মূল্য দেওয়া সম্ভব নয়। এমন দৃষ্টান্ত আরও কিছু আমার সংগ্রহে আছে।

(৪) “কালকা মেলে. পাহাড়ের দেশে”- এই লাইন দুটিকে অক্ষরবৃত্ত রীতিতে পড়ে কনের যতটা সায় পাওয়া যায়, তার চাইতে বেশি সায় যদি পাওয়া যায় স্বরবৃত্ত রীতিতে, তবে তো বুঝতেই হবে যে, শব্দের বিন্যাসে আমার আরও কুঁশিয়ার থাকা উচিত ছিল। প্রসঙ্গত জিজ্ঞেস করি, জিজ্ঞাসু পড়ুয়া তীর চিঠিতে প্ৰবোধচন্দ্রের গ্রন্থ থেকে অক্ষরবৃত্তের দৃষ্টান্ত হিসেবে, যে-দুটি লাইন তুলে দিয়েছেন (“পশমী শাল.আগরা এনু ফিরে”), তাদেরও কি স্বরবৃত্ত রীতিতে পড়া যায় না? এ-সব ক্ষেত্রে পাঠকের বিভ্ৰাট ঘটে। মূলত শব্দের গাঁটের জন্য। গাঁটগুলিকে অক্লেশে পেরোতে পারলে যা অক্ষরবৃত্ত, হোঁচটি খেলে তাকেই অনেকসময়ে স্বরবৃত্ত বলে মনে হয়। যদি সম্ভব হয়, এই গাঁটগুলি নিয়ে পরে আলোচনা করব।

 

ড. ভবতোষ দত্তের চিঠি

সবিনয় নিবেদন, আপনার ‘কবিতার ক্লাস’-এর আমি একজন উৎসুক পড়ুয়া। কবিতার ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এল। আপনার শেষের দুটি ক্লাস সম্বন্ধে আমার দু-একটি কথা মনে হয়েছে। নিবেদন করি।

স্বরবৃত্ত ছন্দ যে চার সিলেবল-এর কম অথবা বেশি স্বীকার করে, এ-কথা। আপনি নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন। আপনার দেওয়া দৃষ্টান্ত কয়টি লক্ষ করলাম— হয় তারা মৌখিক ছড়া অথবা ইয়ে-শব্দযুক্ত কাব্যপঙক্তি। ইয়েকে যুগ্মস্বর ছাড়া কী বলা যায় ইংরেজি ডিপথং-এর মতো। বাংলাতেও ঐ অথবা ঔ-এর মতো। আমার ধারণা, আপনি রবীন্দ্রনাথ অথবা সত্যেন্দ্রনাথের অথবা আধুনিক কোনও কবির কবিতায় চার সিলেবল-এর ব্যতিক্রম পাবেন না। কিংবা পেলেও সেটা এতই বিরল যে, তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দের সাধারণ প্রকৃতি বলে নির্দেশ করতে পারেন না। ছড়ার ছন্দে যে-সব দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, তা যদি এর সাধারণ প্রকৃতিই হত, তবে পরবর্তী আদর্শ শিল্পী-কবিরা তার ব্যবহার নিশ্চয়ই করতেন। তাঁরা চার সিলেবল-এর পর্বকেই আদর্শরূপে গণ্য করেছেন। তার অর্থ নিশ্চয়ই এই যে, পাঠযোগ্য কবিতায় বাঙালির উচ্চারণ-প্রকৃতি চার সিলেবলকেই স্বীকার করে মাত্র।

আপনি বলেছেন, স্বরবৃত্ত ছন্দ গানের সুরের ছন্দ। ছড়া ইত্যাদিতে মধ্যযুগে ব্যবহৃত এই-জাতীয় ছন্দকে ছড়ার ছন্দই বলা উচিত; সেকালে একে ধামালী ছন্দ বলা হত। রবীন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথ-ব্যবহৃত এই ছন্দের আধুনিক শিল্পসম্মত রূপকেই খাঁটি স্বরবৃত্ত বলা উচিত। মধ্যযুগের ধামালী অযত্নকৃত- এর প্রকৃতি সম্বন্ধে কেউ অবহিত ছিলেন না। সে-জন্য তিন সিলেবল বা পাঁচ সিলেবল নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। বিশেষত কোনও বড়ো প্রধান গুরু কাব্যেই এই ছন্দের ব্যবহার নেই।

ছড়া সুরে উচ্চারিত হত, এ-কথা সত্য। আপনি বলেছেন, স্বরবৃত্ত ছন্দ এই জন্যই গানের ছন্দ। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সুরে গাওয়া বা উচ্চারিত হত না হেন বস্তু মধ্যযুগে ছিল না। বৈয়ব পদাবলির কথা ছেড়ে দিন, বৃহৎকায় মঙ্গলকাব্যগুলিও সুর করে পড়া হত। মঙ্গলকাব্য তো স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা হত না, হত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। কিন্তু এখানেও বলতে পারি, ভারতচন্দ্রের আগে অক্ষরবৃত্ত পয়ার ছন্দেও চোদ্দ অক্ষরের (বা মাত্রার) নানা ব্যতিক্রম হামেশাই দেখা যেত। সেজন্যে কি বলবেন ব্যতিক্ৰমটাই সাধু পয়ার রীতির প্রকৃতি? অক্ষরবৃত্তও গানের সুরেরই ছন্দ? এর পরবর্তী সিদ্ধান্ত, ছন্দ মাত্রেই গানের সুর থেকে উদ্ভূত। সেটা অবশ্য আলাদাভাবেই আলোচ্য।

স্বরবৃত্ত ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে এর হসন্ত-প্ররণত। হসন্ত-ধ্বনি থাকার জন্যই শব্দের প্রথমে ঝোক পড়ে। শব্দের প্রথম দিকে ঝোক এবং শব্দের প্রান্তের হসন্ত-ধ্বনি চলিতভাষারও বিশেষত্ব। এ বিষয়ে খুব একটা মতভেদের অবকাশ আছে বলে মনে করি না। বস্তৃত স্বরবৃত্ত ছন্দের হসন্ত-প্রবণতা ভাষার মৌখিক রীতির জন্যই। রবীন্দ্ৰনাথ বলেছিলেন—

‘চলতি ভাষার কবিতা বাংলা শব্দের স্বাভাবিক হসন্তরূপকে মেনে নিয়েছে।’

এটা লক্ষ্য করলে গানের সুর থেকে স্বরবৃত্ত ছন্দের উদ্ভব হয়েছে। এ-কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। চলতি মুখের ভঙ্গি আর সুরের ভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা বস্তু। একটাতে থাকে বেঁক, আর-একটাতে প্রবাহ। ইতি ২৪, ৩, ৬৬

 

কবিকঙ্কণের উত্তর :

সবিনয় নিবেদন,

আপনার চিঠি যথাসময়ে পেয়েছি। উত্তর লিখতে অসম্ভব দেরি হল, তার জন্য মার্জনা চাই।…

আপনার প্রতিটি কথাই ভাববার মতো। তা ছাড়া, এমন অনেক তথ্য আপনি জানিয়েছেন, যা আমার জানা ছিল না। জেনে লাভবান হয়েছি। শুধু একটি ব্যাপারে। আমার একটু খটকা লাগছে। স্বরবৃত্তে রচিত “পাঠযোগ্য কবিতায় বাঙালির উচ্চারণ প্রকৃতি” যে শুধু চার সিলেবল-এর পর্বকেই স্বীকার করে, এই সিদ্ধান্তের যুক্তি হিসেবে আপনি জানিয়েছেন, “রবীন্দ্রনাথ অথবা সত্যেন্দ্রনাথের অথবা আধুনিক কোনও কবির কবিতায় চার সিলেবল-এর ব্যতিক্ৰম” পাওয়া যাবে না। “কিংবা পেলেও সেটা এতই বিরল যে, তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দের সাধারণ প্রকৃতি বলে নির্দেশ” করা উচিত হবে না।

অনুমান করি, আপনি যেহেতু “পাঠযোগ্য” কবিতার উপরে জোর দিতে চান, তাই—ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত হিসেবে— ‘মৌখিক ছড়ার দৃষ্টান্ত আপনার মনঃপূত নয়।

এ-বিষয়ে আমার বক্তব্য সংক্ষেপে সবিনয়ে নিবেদন করি।

(১) ‘মৌখিক ছড়াগুলি তো একালে শুধুই মুখে-মুখে ফেরে না, লিপিবদ্ধও হয়ে থাকে। এককালে সেগুলি হয়তো শুধুই কানে শোনবার সামগ্ৰী ছিল, এখন সেগুলিকে আকছার চোখে দেখছি। এবং পড়ছি। অগত্যা তাদের আর ‘পাঠযোগ্য’ সামগ্ৰী হিসেবেও গণ্য না-করে উপায় নেই। তবে আর সেগুলিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করায় আপত্তি কেন?

(২) ‘বাঙালির উচ্চারণ-প্রকৃতি’র পক্ষে সত্যিই কি স্বরবৃত্তে শুধুই চার সিলেবল-এর পর্বকে স্বীকার করা সম্ভব? সর্বত্র সম্ভব? ক্ৰমাগত যদি চার-চারটি ক্লোজড সিলেবল দিয়ে আমরা পর্ব গড়তে চাই, পারব কি?

(৩) রবীন্দ্রনাথ কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ স্বরবৃত্তকে প্রধানত কীভাবে ব্যবহার করেছেন, সেটা আমার বিচার্য ছিল না; স্বরবৃত্তকে কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, সেইটেই ছিল আমার দেখবার বিষয়। দেখতে পাচ্ছি, ছয় থেকে দুয়ে এর ওঠানামা। কাজিফুল ‘কুড়োতে কুড়োতে” আমরা ছয়ে উঠতে পারি, আবার ঝুপকুপা’ করে দুয়ে নামতে পারি। উচ্চারণে যে-ছন্দ ইলাসটিসিটিকে এতটাই প্রশ্রয় দেয়, তাকে ঠিক কবিতার ছন্দ বলতে আমার বাধে। ডিপথং-এর কথাটা আমি ভেবে দেখেছি, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই ওঠানামার সর্বত্র ব্যাখ্যা মেলে না। বরং সন্দেহটা ক্ৰমেই পাকা হয়ে দাঁড়ায় যে, নিজেদের অগোচরে পর্বকে কখনও আমরা টেনে বড়ো করি, কখনও-বা অতিদ্রুত উচ্চারণে তাকে কমিয়ে আনি। শব্দের উচ্চারণে হ্রাসবৃদ্ধির এতখানি স্বাধীনতা কবিতার ব্যাকরণ স্বীকার করে কি?

পরিশেষে বলি, সম্ভবত আপনার কথাই ঠিক। তবু অনুরোধ করি, আমার কথাটাও দয়া করে একবার ভেবে দেখবেন। আপনি সহূদয় পাঠক। উপরন্তু যুক্তিনিষ্ঠ। সেইজন্যেই এই অনুরোধ।…

সপ্রীতি শুভেচ্ছা জানাই। ইতি।

 

কবি শ্ৰীশঙ্খ ঘোষের চিঠি

কাজটা কি ভালো করলেন? এতো সহজেই যে ছন্দ-কাণ্ডটা জানা হয়ে যায়, এটা টের পেলে ছেলেমেয়েরা কি আর স্কুল-কলেজের ক্লাস শুনবে? ক্লাস মানেই তো সহজ জিনিসটিকে জটিল করে তুলবার ফিকির।

এ-লেখার এই একটি কৌশল দেখছি যে, আপনি শুরু করতে চান সবার-জানা জগৎ থেকে। তাই এখানে ‘যুক্তাক্ষর’ কথাটিকে ব্যবহার করতে একটুও দ্বিধা করেননি, দেখিয়েছেন কোন ছন্দে এর কীরকম মাত্রা মূল্য। বোঝানোর দিক থেকে এ একটা উপকারী পদ্ধতি।

কিন্তু এর ফলে ছোটো একটি সমস্যাও কি দেখা দেবে না? যুক্তাক্ষর তো শব্দের চেহারা-বৰ্ণনা, তার ধ্বনিপরিচয় তো নয়। ছন্দ যে চোখে দেখবার জিনিস নয়, কানে শুনবার- এটা মনে রাখলে ধ্বনিপরিচয়টাই নিশ্চয় শেষ পর্যন্ত আমাদের কাজে লাগবে? যেমন ধরা যাক, ছন্দ” শব্দটি। মাত্রাবৃত্তে যুক্ত-অক্ষর দু-মাত্রা পায়। এখন এ-শব্দটি যদি মাত্রাবৃত্তে থাকে তো দু-মাত্রার মূল্য দেব এর কোন অংশকে? যুক্তাক্ষর ‘দ’-কে, নাকি বুদ্ধিদল ছিন’-কে? মাত্রার হিসেবটা কেমন হবে? ১+২ (ছ+ন্দ), না ২+১ (ছন + দ)? চোখ বলবে প্রথমটি, কান বলবে দ্বিতীয়।

তাহলে দল বা সিলেবল কথাটাকে এড়িয়ে থাকা মুশকিল। কিন্তু বেশ বোঝা যায়, আপনি ইচ্ছে করেই অল্পে-আল্পে এগিয়েছেন। স্বরবৃত্ত আলোচনার আগে একেবারেই তুলতে চাননি সিলেবল-এর প্রসঙ্গ।

আর সেইজন্যেই মাত্রাবৃত্তের একটি নতুন সূত্রও আপনাকে ভাবতে হল। শব্দের আদিতে না থাকলে এ-ছন্দে যুক্তাক্ষর দু-মাত্রা হয়! আপনি এর সঙ্গে আরও একটু জুড়ে দিয়ে বলেছেন যে, শব্দের ভিতরে থাকলেও কখনও কখনও যুক্তাক্ষর একমাত্রিক হতে পারে। কোথায়? যেখানে তার ঠিক আগেই আছে হস্বৰ্ণ কিংবা যুক্তস্বর। আপনি বলবেন, ‘আশ্লেষ’ শব্দের ‘শ্নে’ আর সংশ্লেষ’ শব্দের ‘শ্লে’মাত্রাবৃত্তে দু-রকম মাত্রা পাচ্ছে। প্রথমটিতে দুই, পরেরটিতে এক। অথবা বলবেন এ-ছন্দে সমান-সমান হয়ে যায়। ‘চৈতী’ ‘চৈত্র’?

ঠিক কেন যে তা হচ্ছে, এ-ও আপনি জানেন। জানেন যে, এ-সব ক্ষেত্রে সিলেবল দিয়ে ভাবলে ব্যাপারটাকে আর ব্যতিক্ৰম মনে হয় না, মনে হয় নিয়মেরই অন্তর্গত। যদি এভাবে বলা যায় যে, মাত্রাবৃত্তে বুদ্ধদল দু-মাত্রা পায়, মুক্তদল এক-মাত্ৰা— তাহলেই ওপরের উদাহরণগুলির একটা সহজ ব্যাখ্যা মেলে। উদাহরণের দিক থেকে দেখলে শব্দগুলি তো ‘সং + শ্লেষ’, ‘আস+ লেষ’ ‘চৈ + তী’ ‘চৈৎ + ‘র’- এইরকম দাঁড়ায়?

কিন্তু সেভাবে আপনি বলতে চান না; চান না যে, সিলেবল-এর বোঝাটা গোড়া থেকেই পাঠকের ঘাড়ে চাপুক। যুক্তাক্ষর বলেই যদি কাজ মিটে যায় তো ক্ষতি কী! ফলে আপনি তো দিব্যি টগবগিয়ে চলে গেলেন, কিন্তু ক্লাসে যারা ছন্দ পড়াবেন। তাদের কী দশা হবে?

 

কবিকঙ্কণের উত্তর

প্রতিভাজনেষু,

শঙ্খ, আপনার চিঠি পেয়ে বড়ো ভালো লাগল।

সত্যি, আমি ঠিকই করেছিলুম যে, সিলেবিক ছন্দ স্বরবৃত্তের এলাকায় ঢুকবার আগে সিলেবল-কথাটা মুখেও আনিব না। আমার ভয় ছিল, ছন্দের ক্লাসের যাঁরা প্রথম পড়ুয়া, গোড়াতেই যদি ‘মোরা’ সিলেবল ইত্যাদি সব জটিল তত্ত্ব তাঁদের বোঝাতে যাই, তাহলে তাঁরা পাততাড়ি গুটিয়ে চম্পট দেবেন। কিন্তু ‘অক্ষর’ সম্পর্কে সেই ভয় নেই। অক্ষর তারা চেনেন। তাই, প্ৰাথমিক পর্যায়ে, অক্ষরের সাহায্য নিয়ে আমি তাদের ছন্দ চেনাবার চেষ্টা করেছি। তবু, তখনও আমি ইতস্তত বলতে ভুলিনি যে, ধ্বনিটাই হচ্ছে প্রথম কথা; বলেছি যে, চোখ নয়, কানই বড়ো হাকিম। এমনকি, এ-ও আমি স্পষ্ট জানিয়েছি যে, অক্ষর আসলে ধ্বনির প্রতীক- মাত্র। ‘কবিতার ক্লাস’-এর পাণ্ডুলিপি তো আপনি দেখেছেন। অক্ষর ও ধ্বনি-বিষয়ক এসব মন্তব্য নিশ্চয় আপনার চোখ এড়ায়নি।

যুক্তাক্ষরের রহস্যটা আপনি ঠিকই ধরেছেন। এবং যেভাবে সেই রহস্যের আপনি মীমাংসা করেছেন, তাতে সমস্ত সংশয়ের নিরসন হওয়া উচিত। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে, ‘চৈত্র’কে চৈৎ + র’ হিসেবে বিশ্লিষ্ট করেই আপনি নিস্কৃতি পাবেন? বুদ্ধ সিলেবল চৈৎ কে আপনি দু-মাত্রার মূল্য দিচ্ছেন, মুক্ত সিলেবল রিকে দিচ্ছেন এক-মাত্রার। ফলত সব মিলিয়ে এই শব্দটি তিন-মাত্রার বেশি মূল্য পাচ্ছে না। আপনার এই হিসেবে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কারও-কারও হয়তো আপত্তি থাকতে পারে। “মাত্রাবৃত্তে বুদ্ধিদল দু-মাত্রা পায়, মুক্তদল একমাত্ৰা”, এই বিধান মেনে নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, চৈত্র’ কি বস্তৃত একটি বুদ্ধিদল ও একটি মুক্তদলের সমষ্টি? তারা দাবি করতে পারেন যে, চৈত্র’কে আসলে চ + ইৎ + ‘র হিসেবে বিশ্লিষ্ট করা উচিত, এবং সেই অনুযায়ী এই শব্দটিকে মোট চার-মাত্রার মূল্য দিতে হবে। (প্রথম ও শেষের দুটি মুক্তদলের জন্য দ-মাত্রা ও মধ্যবর্তী একটি বুদ্ধিদলের জন্য দু-মাত্রা।) সৈন্য’ দৈন্য ‘মৈত্রী’ ‘বৌদ্ধ’ ইত্যাদি শব্দের বেলাতেও আপনার হিসেবের বিরুদ্ধে এই একই রকমের দাবি উঠতে পারে। আপনি এদের সৈন্য + নি, দৈন্য + নি, মৈৎ + রী, বৌদ + ধ হিসেবে দেখাবেন। তাঁরা দেখাবেন স + ইন্‌ + ন, দ + ইন্‌ + ন, ম + ইৎ + রী, ব +উদ্‌ + ধ হিসেবে। আপনি এদের একভাবে বিশ্লিষ্ট করবেন; তারা করবেন আর-একভাবে।

আমি অবশ্য আপনার পন্থাতেই এসব শব্দকে বিশ্লিষ্ট করবার পক্ষপাতী। তার কারণ, আমি জানি যে, যুক্তস্বরের পরে হস্বৰ্ণ থাকলে (সেই হিসাবর্ণটি যুক্তাক্ষরের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকলেও কিছু যায়-আসে না)। ধ্বনিসংকোচ আনিবাৰ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ এ-তথ্য অনেক আগেই জেনেছিলেন। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, মাত্রাবৃত্তে ‘পৌষকে পুরো তিন-মাত্রার মূল্য দেওয়া চলে না; নইলে চিত্রা’ গ্রন্থের ‘সিন্ধুপারে কবিতায় (যা কিনা মাত্রাবৃত্তে লেখা) ‘পৌষ-শব্দটার চলতি বানান ছেড়ে তিনি “পউষ, প্রখর শীতে জর্জর..” লিখতে গেলেন কেন? উদ্দেশ্য যে পৌষ-এর উচ্চারণকে আর-একটু বিবৃত করে নিশ্চিন্ত চিত্তে ওকে তিন-মাত্রার পার্বণী ধরিয়ে দেওয়া, তাতে আমার সন্দেহ নেই।

বুঝতেই পারছেন, যুক্তাক্ষর-রহস্যের মীমাংসা যদি আমি সিলেবল ভেঙে করতে যৌতুম, তাহলে, প্রসঙ্গত, এসব প্রশ্ন উঠত। শব্দের বিশ্লেষণ-পদ্ধতি নিয়ে তর্ক বাধত। ধন্ধ দেখা দিত। ছন্দের প্রথম-পড়ুয়াকে সেই ধন্ধ থেকে আমি দূরে রাখতে চেয়েছি। যেভাবে বোঝালে তাঁরা চটপট ধরতে পারবেন, প্রাথমিক ব্যাপারগুলিকে সেইভাবেই তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি।

বাকিটা আপনারা বোঝান। আপনার ভাষায় দিব্যি টগবগিয়ে আমি চলে গেলুম। কিন্তু যাবার আগে, চৌরাস্তায় ড়ুগড়ুগি বাজিয়ে যেসব পড়ুয়া আমি জোগাড় করেছিলুম, আপনাদের ওই ক্লাসঘরের মধ্যেই তাদের আমি ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছি। এবারে আপনাদের পন্থায় আপনারা তাদের গড়েপিটে নিন। আমার পড়ুয়াদের আমি চিনি। তাই হলফ করে বলতে পারি, যে-পন্থাতেই পড়ান, তাদের নিয়ে বিন্দুমাত্র বেগ আপনাদের পেতে হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *