১৩. পরিবার
অতীতের উত্তরাধিকাররূপে আমরা যতগুলি প্রতিষ্ঠান লাভ করেছি, তার মধ্যে, বর্তমানে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে বিশৃঙ্খল এবং লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছে, এমন আর কোনওটি হয়নি। সন্তানের প্রতি বাবা-মার স্নেহ এবং বাবা মার প্রতি সন্তানের ভালবাসা সুখের একটি শ্রেষ্ঠ উৎস। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে বর্তমানে বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে সম্পর্ক দশের মধ্যে নয়টি ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষের দুঃখের উৎস হয়ে পড়েছে এবং শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে অন্তত একপক্ষের দুঃখের কারণ হয়েছে। নীতিগতভাবে পরিবারের পক্ষে মৌলিক তৃপ্তি দিতে পারার ব্যর্থতা, আধুনিক যুগের অসন্তোষের একটি গভীর কারণ, যে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বা নারী নিজের সন্তানদের সাথে সুখের সম্পর্ক রাখতে চায় অথবা তাদের একটা সুখী জীবনে রাখতে চায়, তার পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত এবং ভাবনার পর বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করা উচিত। পারিবারিক বিষয় এত ব্যাপক বিশাল যে এই গ্রন্থে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এর সাথে জড়িত বিশেষ সমস্যার সাথে সুখের সন্ধান-এর সম্পর্ক রয়েছে তা নিয়ে কিছু আলোচনা করব। যে সমস্যা নিয়ে আমরা ভাবছি তার মধ্যেও পরিবার সম্পর্কে শুধু সেটুকুই আলোচনা করতে পারি, যেখানে সামাজিক কাঠামো পরিবর্তন না করেও পরিবারের উন্নতি বিধানের ক্ষমতা প্রত্যেকটি ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে।
এই সীমাবদ্ধতা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুতর, কারণ আমাদের কালে পারিবারিক অসন্তোষের কারণ বিচিত্র ধরনের মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাবিষয়ক এবং রাজনৈতিক। ধনী সমাজের নারীদের কাছে এখন মাতৃত্বকে পূর্বের তুলনায় দুটি কারণে অনেক বোঝা বলে মনে করা হয়। এই দুটি কারণ হচ্ছে– একদিকে অবিবাহিতা মেয়েদের নিজস্ব জীবিকার পথ খুলে যাওয়া, অন্যদিকে গৃহ-পরিষেবার জন্যে লোকের অভাব। আগের দিনের মেয়েরা চিরকুমারী জীবনের অসহনীয় অবস্থার কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে বাধ্য হত। অবিবাহিতা মেয়েদের বাড়িতে অর্থনৈতিক নির্ভরতার ওপর বাঁচতে হত প্রথম জীবনে বাবার ওপর, পরে অনিচ্ছুক ভাইদের ওপর। দিন যাপনের মতো কোনও কাজ ছিল না তাদের এবং বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে আনন্দ উপভোগের কোনও স্বাধীনতাও ছিল না। তাদের যৌনজীবনে উৎসাহিত হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না, আসক্তিও ছিল না। তাছাড়া বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম ঘৃণ্য বলেই তারা বিশ্বাস করত। তবু এমন সব পারিবারিক রক্ষা-ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও যদি কোনও ফন্দিবাজ লুব্ধকের ছলাকলায় পড়ে তার চরিত্র নষ্ট হত, তাহলে তার দুর্দশার সীমা থাকত না। ভিকার অফ ওয়েকফিল্ড’ বইয়ে এরকম অবস্থায় একটি নির্ভুল বর্ণনা আছে।
“তার অপরাধ লুকাবার
তার লজ্জা সবার দৃষ্টি থেকে ঢেকে রাখার
তার দয়িতের অন্তরে অনুতাপ জাগাবার,
এবং তার অন্তর ভাঙার একটাই পথ–
তার মৃত্যুকে আলিংগন।”
আধুনিক কুমারী মেয়েরা এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করে না, যদি তার ভাল শিক্ষা থাকে তাহলে সাধারণভাবে সুখে থাকার মতো একটা জীবিকার ব্যবস্থা করা কঠিন নয় এবং সে বাবা-মার অধীনতা থেকে মুক্ত হতে পারে। বাবা-মা কন্যাদের ওপর অর্থনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বলে তারা এখন কন্যাদের নৈতিকতা অনুমোদন না করার ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধান হয়েছে। যে মেয়ে গঞ্জনা সহ্য করার জন্যে অপেক্ষা করবে না, তাকে গঞ্জনা দিয়ে লাভ নেই। উচ্চপেশাজীবী অবিবাহিতা তরুণী তাই বর্তমানকালে বুদ্ধিমত্তা এবং আকর্ষণীয়তায় যদি সাধারণ মানের নিচে না হয়, যতদিন সে সন্তানলাভের কামনা থেকে মুক্ত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সে সম্পূর্ণভাবে নিজের মতো করে জীবনকে উপভোগ করতে পারবে। কিন্তু সন্তানকামনা প্রবল হলে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয় এবং তার কাজটিও হারাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এতদিন যে আরামের জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে তার থেকে অনেক নিচের স্তরে নেমে যায়, কারণ তার স্বামীর উপার্জন, সে আগে যা উপার্জন করত কোনওভাবে তার চেয়ে বেশি নয়। যে আয় থেকে এখন সংস্থান করতে হয় একটি পরিবারের, শুধুমাত্র একজন রমণীর নয়। স্বাধীনভাবে চলার পর এখন প্রয়োজনীয় খরচের জন্যে প্রতিটি পয়সা অন্যের কাছে চেয়ে নেওয়া তার জন্যে পীড়াদায়ক। এইসব কারণে এইরকম নারী মাতৃত্বলাভে দ্বিধাগ্রস্ত।
কোনও নারী তবুও যদি সব দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে উঠে মা হতে চায়, সে আগের প্রজন্মের নারীদের তুলনায় একটি নতুন এবং আতঙ্কজনক সমস্যার মুখোমুখি হয় এবং তা হল গৃহ পরিষেবার অভাব অথবা নিম্নমানের পরিষেবা। এর ফলে সে বাড়ির সাথে বাঁধা পড়ে যায়, হাজাররকম সব তুচ্ছ কাজ করতে সে বাধ্য হয়, যা তার দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের পক্ষে অনুপযুক্ত। অথবা এসব যদি সে নিজে নাও করে তবু কাজে অবহেলাকারী পরিচারিকাদের তিরস্কার করতে করতে নিজের মেজাজ নষ্ট করে। সন্তানদের লালন-পালনের ভার কার ওপর দেওয়া হবে সে বিষয়ে যদি তার ভাল জ্ঞান থাকে, তবে নার্সদের হাতে তাদের সপে দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। কারণ তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়, তার ওপর পরিচ্ছন্নতা এবং শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ সতর্কতার ব্যাপার তো রয়েছেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে উচ্চ প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাপক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন নার্স রাখতে সমর্থ হয়। এইসব ছোট-বড় তুচ্ছ নানা বিষয়ের চাপে যদি সে তার সমস্ত লাবণ্য এবং কমনীয়তা এবং বুদ্ধিমত্তার তিন-চতুর্থাংশ হারিয়ে না ফেলে, তবে তাকে ভাগ্যবর্তী বলতে হবে। এইসব কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রায়ই দেখা যায় যে, এরকম নারী তাদের স্বামীদের কাছে ক্লান্তিকর এবং সন্তানদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে স্বামী যখন বাড়ি ফিরে আসে, স্ত্রী তখন সারাদিনের কষ্টের কাহিনী বলতে শুরু করে, তখন তা বিরক্তিকর। কিন্তু যে স্ত্রী এসব বলে না সে অন্যমনস্ক থাকে। সন্তানদের সম্পর্কে, সে তাদের পাওয়ার জন্যে যেসব স্বার্থত্যাগ তাকে করতে হয়েছে সে বিষয়ে সবসময় সে এমনই সচেতন, যার ফলে সে এর জন্যে আশার-অতীত যে পুরস্কার তা দাবি করবেই। সব সময়ে নানা তুচ্ছ বিষয়ে মনোসংযোগ করতে হয়েছে বলে সে ব্যস্তবাগীশ এবং সংকীর্ণমনা হয়ে গেছে। সে যতরকম অবিচার ভোগ করেছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর কারণ পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সে তাদের ভালবাসা হারিয়েছে। কিন্তু যদি সে তাদের অবহেলা করত এবং মনের আনন্দ ও দেহের লাবণ্য ধরে রাখত তাহলে তারা সম্ভবত তাকে ভালবাসত।
এইসব দুর্ভোগ প্রধানত অর্থনৈতিক, তাছাড়া আরও একটা সমস্যা রয়েছে যা সমান গুরুতর। সেটা হচ্ছে গৃহসমস্যা। বড় বড় নগরে অনেক লোক কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যযুগে শহর এখনকার গ্রামাঞ্চলের মতোই ছিল। শিশুরা এখনো যে শিশু-ভোলানো ছড়াটি গায়,
“পলের গির্জার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ
গাছটি একেবারে আপেলে ভরা
লন্ডন শহরের ছোট ছেলেরা
তারা লাঠি নিয়ে ছুটছে সেগুলি পাড়তে
ছুটে চলেছে বেড়ার পর বেড়া পার হয়ে
যতক্ষণ না তারা পৌঁছে লন্ডন ব্রিজের কাছে।”
পলের গীর্জা আর নেই। আমি জানি না সেন্ট পল গীর্জা ও লন্ডন ব্রিজের মধ্যে যত বেড়া ছিল কখন তা অদৃশ্য হয়েছে। বহু শতাব্দী আগে লন্ডন শহরের ছোট ছোট ছেলেরা এরকম আনন্দ উপভোগ করতে পারত। এই শিশুতোষ ছড়া তাই নির্দেশ করে। কিন্তু খুব বেশি দিনের কথা নয় যখন অধিকাংশ মানুষ পল্লীঅঞ্চলে বাস করত, শহরগুলি এত বড় ছিল না। শহর ছেড়ে আসা যেত খুব সহজে এবং শহরের অনেক বাড়ির সাথে বাগান দেখা খুব সাধারণ দৃশ্য ছিল, কিন্তু এখন ইংল্যান্ডে শহরের লোকসংখ্যা গ্রামের তুলনায় অনেকগুণ বেশি বেড়েছে। আমেরিকাতে এই বৃদ্ধি এখনো কম, কিন্তু খুব দ্রুত তা বেড়ে চলেছে। লন্ডন এবং নিউইয়র্কের মতো নগর এতই বড় যে, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে প্রচুর সময় লাগে। নগরে যারা বাস করে তারা সাধারণভাবে একটি ফ্ল্যাট নিয়েই তৃপ্ত থাকে, তার সাথে অবশ্য এক বর্গ ইঞ্চি মাটিও সংলগ্ন থাকে না। মধ্যবিত্তদের খুশী থাকতে হয় ন্যূনতম জায়গা নিয়ে। ছোট ছোট শিশুরা থাকলে ফ্ল্যাটে জীবন কাটানো কঠিন। সেখানে তাদের খেলার জায়গা নেই। তাদের কোলাহল থেকে দুরে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই তাদের বাবা-মার। এজন্যে উচ্চপেশাজীবীরা ক্রমেই শহরতলিতে থাকার দিকে ঝুঁকছে। শিশুদের কথা বিবেচনা করলে নিঃসন্দেহে এটা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু এতে মানুষের ক্লান্তি আরো বেড়ে যায় এবং পরিবারের জন্যে যতটুকু ভূমিকা সে পালন করতে পারত ততটুকু করার ক্ষমতা তার থাকে না।
এ ধরনের বড় বড় অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আমরা যে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তার বাইরে। আমরা আলোচনা করছি। বর্তমানকালে সুখী হওয়ার জন্যে কী করতে হতে পারে তা নিয়ে। বর্তমান কালে বাবা-মা ও সন্তানদের সম্পর্কের ভিতর যেসব মনস্তাত্ত্বিক বাধা রয়েছে সেইখানে যেতে পারলে আমরা এই সমস্যার কাছাকাছি চলে আসব। এই সমস্যা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র থেকে জাত সমস্যাসমূহের একটি অংশ। প্রাচীনকালে ছিল মালিক এবং দাস। মালিক ঠিক করত কী করতে হবে এবং মোটামুটিভাবে তাদের দাসদের পছন্দ করত। কারণ তারাই ছিল তাদের সুখ-বৃদ্ধির যন্ত্র। দাস সম্ভবত তার মালিককে ঘৃণা করত। যদিও গণতান্ত্রিক মতবাদ এই ঘৃণা যতটা ব্যাপক ও সার্বজনীন বলে আমাদের বিশ্বাস করাতে চায়, ততটা ছিল না। কিন্তু তবু তারা মালিকদের ঘৃণা করত এটা সঠিক হলেও, মালিকরা তা বুঝতে পারত না এবং যে কোনও ভাবেই হোক মালিকরা সুখী ছিল। গণতান্ত্রিক মতবাদ সাধারণভাবে গৃহীত হওয়ায় এর সব কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যেসব দাস আগে মালিকদের নীরবে মেনে চলত, তারাই এখন আর মালিকদের মানে না। যেসব মালিকদের নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ ছিল না, তারা এখন দ্বিধা এবং অনিশ্চয়তার দোলায় দুলছে। ফলে সংঘর্ষ বেধেছে এবং উভয়পক্ষই অসুখী হয়েছে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এসব আমি যুক্তি হিসাবে তুলে ধরছি না, কারণ যেসব অসুবিধার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে তা যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলে অনিবার্যভাবে দেখা দেয়। সেই সময় পৃথিবী থেকে সুখ যে বিদায় নেয়, সে বিষয়ে চোখ বুজে থাকা অর্থহীন।
বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে সম্পর্কের যে পরিবর্তন সাধারণভাবে তা গণতন্ত্র প্রসারের একটি উদাহরণ। বাবা-মা সন্তানদের ওপর তাদের অধিকার বিষয়ে আগের মতো আর নিশ্চিত নয়। সন্তানেরা বাবা-মাকে যে শ্রদ্ধা করতেই হবে তেমন করে আর অনুভব করে না। বাধ্যতা নামে গুণটি আগের দিনে প্রশ্নহীনভাবে আদায় করে নেওয়া হত। এখন তা রীতি-বিরুদ্ধ হয়েছে এবং ঠিকই হয়েছে। শিক্ষিত বাবা-মাকে মনোবিশ্লেষণ ভীত করে তুলছে, যদি তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনও ক্ষতি করে ফেলে সন্তানদের। তাদের চুম্বন করলে তাদের মনে ইডিপাস গূঢ়ৈষণা জাগতে পারে, আর না করলে তাদের মনে প্রবল ঈর্ষা সৃষ্টি হতে পারে। যদি তারা সন্তানদের আদেশ করে কাজ করতে বলে, তা হলে তাদের মনে এক ধরনের পাপবোধ জন্মাতে পারে, যদি তা না করা হয় তাহলে তাদের সন্তানেরা এমনসব অভ্যাসের অধীন হবে যা বাবা-মার কাছে বাঞ্ছনীয় নয়। শিশুকে বুড়ো আঙুল চুষতে দেখলে তারা তার ভয়ংকর পরিণামের কথা ভাবে, কিন্তু তারা জানে না কী করে তা বন্ধ করতে হয়। যে পিতৃত্ব-মাতৃত্ব একসময় ছিল শক্তির সুখময় প্রয়োগ, তা এখন হয়ে পড়েছে ভীরু, উদ্বিগ্ন এবং বিবেকতাড়িত সন্দেহ। পুরোনো দিনের নির্মল আনন্দ হারিয়ে গেছে, ঠিক এমন সময়ে যখন অবিবাহিতা মেয়েরা নতুন পাওয়া স্বাধীনতার জন্যে, মাতৃত্ব লাভের সিদ্ধান্ত নিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বার্থত্যাগ করছে। এই পরিস্থিতিতে সচেতন জননীরা সন্তানের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করে না। কিন্তু অসচেতন জননীদের আশা অনেক বেশি। সচেতন জননীরা তাদের প্রকৃতিদত্ত স্নেহকে সংযত করে এবং সতর্ক হয়। অসচেতন জননীরা তাদের সন্তানের জন্যে যে আনন্দকে ত্যাগ করতে হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ পেতে চায়। এক ক্ষেত্রে সন্তানদের স্নেহ উপবাসী থাকে অন্য ক্ষেত্রে তা আর্ত উদ্দীপক হয়। কোনও ক্ষেত্রেই এখানে পরিবার তার সবচেয়ে সেরাটা যা দিতে পারত, ছিল নির্মল এবং স্বাভাবিক আনন্দ তা পাওয়া যাবে না।
এইসব অসুবিধার জন্যে জন্মহার যদি নেমে যায়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই। মানুষের জন্মহার সাধারণভাবে কমতে কমতে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যাতে মনে হচ্ছে অল্পদিনের মধ্যেই জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করবে। সে সীমারেখা সচ্ছল লোকেরা অনেকদিন আগেই পার করে গেছে এবং তা শুধু কোনও একটা দেশে নয়, বিশেষভাবে সব উন্নতিপ্রাপ্ত সভ্য দেশসমূহে। সচ্ছল শ্রেণীতে জন্মহারের পরিসংখ্যান খুব বেশি পাওয়া যায় না। কিন্তু পূর্বে উল্লেখিত জীন আইলিনের গ্রন্থ থেকে দুটি বিষয় উদ্ধৃত করা যেতে পারে। দেখা যায় স্টকহোম নগরে ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সালের ভিতর পেশাজীবী মহিলাদের উৎপাদিকা শক্তি সাধারণ জনসংখ্যার হিসাবে মাত্র একতৃতীয়াংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলেসলি কলেজের চার হাজার স্নাতকদের মধ্যে ১৮৯৬ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত নবজাত শিশুদের মোট সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। অথচ প্রজন্মকে হ্রাস পাওয়ায় হাত থেকে বাঁচাতে আট হাজার শিশুর প্রয়োজন ছিল, যাদের মধ্যে এটাও কম সময়ে মারা যায়নি। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, যে সভ্যতা শ্বেতকায়দের হাতে সৃষ্ট, তার একক একটি বৈশিষ্ট্য হল, তাদের নারী পুরুষরা যে অনুপাতে আত্মভূত করে সেভাবেই তারা বন্ধ্যাত্বপ্রাপ্ত হয়। সবচেয়ে যারা বেশি সভ্য, সবচেয়ে বন্ধ্যা তারা। সবচেয়ে কম সভ্য যারা সবচেয়ে বেশি ঊর্বর তারা। অবশ্য এদের মধ্যবর্তী অনেকগুলি স্তর রয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্য জাতিদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমত্তায় সবচেয়ে অগ্রবর্তী, তারা বিদায় নিচ্ছে। অল্প কয়েক বছরের ভিতর তারা সামগ্রিকভাবে সংখ্যায় কমে যাবে, যদি অবশ্য তুলনায় কম সভ্য অঞ্চল থেকে লোকজন অভিবাসন নিয়ে এসে সেই ঘাটতি পূরণ করে। আবার অভিবাসিতরা যখন পাশ্চাত্যের সভ্যতাকে পুরোপুরি আত্মস্থ করে নেবে তাদেরও বন্ধ্যাত্ব লাভের পালা চলে আসবে। এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে কোনও সভ্যতার যদি এটাই বিশেষত্ব হয়, তাহলে তা স্থায়ী হয় না। এদের মধ্যে জন্মহার বাড়াতে যদি প্রেরণা সৃষ্টি করা না যায়, তা হলে কিছু আগে না হয় পরে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং স্থান নেবে অন্য আরেক সভ্যতা, যেখানে পিতৃত্ব-মাতৃত্ব প্রেরণার ভিতরেই এমন শক্তি থাকবে যা জনসংখ্যা কমতে দেবে না।
প্রত্যেক পাশ্চাত্য দেশের পেশাদার নীতিবাগীশরা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন ধর্মোপদেশ এবং ভাবপ্রবণতার সাহায্যে। একদিকে তারা বলেন প্রত্যেক বিবাহিত দম্পতির কর্তব্য হল ততগুলি সন্তানলাভ করা, ঈশ্বর যা ইচ্ছা। করেন। সন্তানদের স্বাস্থ্য ও সুখ নিয়ে তাদের কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই। অপরদিকে পুরুষ ধর্মতাত্ত্বিকেরা মাতৃত্বের পবিত্র আনন্দের কথা প্রচার করে থাকেন এবং ভনিতা করে বলেন, রুগ্ন দারিদ্রপীড়িত বড় পরিবার হল সুখের আকর। রাষ্ট্র তাদের সাথে যোগ দেয় এই যুক্তিতে যে কামানের জন্যে প্রচুর খাদ্য চাই, নইলে এমন চমৎকার নিখুঁত সব মারণাস্ত্র যদি হত্যার জন্যে প্রচুর লোক না পায় তা হলে তাদের উদ্ভাবনী দক্ষতা বহাল থাকবে কীভাবে। আশ্চর্য হওয়ার কথা, ব্যক্তিগতভাবে কোনও বাবা-মা এই যুক্তি যদি অন্যের প্রযুক্ত বলে যদিওবা মেনে নেয় নিজেদের বেলায় পুরোপুরি বধির হয়ে থাকে। ধর্মতাত্ত্বিক ও দেশপ্রেমিকদের মনস্তত্ব ভ্রমে ভরা। ধর্মতাত্ত্বিকরা যতক্ষণ নরকানলের ভয় দেখাতে পারবেন ততক্ষণ সফল হবেন। কিন্তু বর্তমানে খুবই কম লোক এই ভয়কে গুরুত্ব দেয় এবং এই রকম কোনও ভয়ই যে আচরণ, একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার তা নিয়ন্ত্রণ করতে যথেষ্ট নয়। আর রাষ্ট্রের সম্পর্কে বলা যায় তাদের যুক্তি অত্যন্ত হিংস্র। জনগণ একমত হতে পারে যে, অন্যেরা কামানের খাদ্য হোক, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের এভাবে ব্যবহার করা হোক তা তারা চায় না। সুতরাং রাষ্ট্র যা করতে পারে তা হচ্ছে দরিদ্র লোকদের অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় এই চেষ্টা একমাত্র অনুন্নত পাশ্চাত্য দেশ ছাড়া অন্য জায়গায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। খুব কম নর-নারীই জনগণের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে সন্তান লাভ করতে চাইবে। এই বিষয়ে তাদের ধারণা যত স্পষ্টই হোক যখন কোনও দম্পত্তি সন্তান লাভ করে তখন তারা হয় এই বিশ্বাস থেকে করে যে সন্তান তাদের সুখের সাথে যুক্ত হবে, না হয় কী করে জন্মনিরোধ করা যায় তা তারা জানে না। শেষের কারণটাই এখনো বেশি কার্যকর কিন্তু ক্রমশ তার শক্তি কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্র অথবা গীর্জা যাই করুক এই কমানো আটকানো যাবে না। সুতরাং শ্বেত জাতিদের যদি অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পিতৃত্ব মাতৃত্ব যাতে পিতা-মাতাকে আবার সুখ দিতে পারে তা করা প্রয়োজন।
বর্তমানের পরিস্থিতির কথা না ভেবে যদি মানব-প্রকৃতির কথা ভাবা যায়, তাহলে আমার মনে হয়, একথাটা সকলে বুঝতে পারবেন যে পিতৃ-মাতৃত্ব মনস্তত্ত্বের দিক থেকে জীবনকে দান করতে পারে শ্রেষ্ঠ এবং সর্বাপেক্ষা স্থায়ী আনন্দ। এটা অবশ্য পুরুষ অপেক্ষা নারীর ক্ষেত্রে বেশি সত্যি। আধুনিক-পূর্ব যুগের প্রায় সব সাহিত্যেই এই ধারণাকে গ্রহণ করা হয়েছে। হেকুবা প্রিয়াম অপেক্ষা তার সন্তানদের বেশি যত্ন নেন। ম্যাকডাফ তার স্ত্রী অপেক্ষা সন্তানদের প্রতি বেশি যত্নশীল। ওল্ড টেস্টামেন্টে নারী-পুরুষ উভয়েই বংশধর রেখে যাওয়ার জন্যে অত্যন্ত উদগ্রীব। চীনে এবং জাপানে এখনো পর্যন্ত এই মনোভাব টিকে রয়েছে। অনেকে বলতে পারেন এই কামনা এসেছে পূর্বপুরষ পূজা থেকে। আমি কিন্তু এর বিপরীতটাকেই সত্যি বলে মনে করি। বলা যায় মানুষের অন্তরে পরিবারের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার যে কামনা থাকে, পূর্বপুরুষ তারই প্রতিফলন। পেশাজীবী মহিলাদের কথা কিছু আগেই বলা হয়েছে। আবার বলি, তাদের মধ্যেও সন্তান লাভের কামনা প্রবল, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কেননা তা না হলে তারা সেই কামনা পূর্ণ করতে যে পরিমাণ আত্মত্যাগ করে তা কেউ করত না। আমার দিক থেকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে, যত অভিজ্ঞতাই আমি অর্জন করি, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুখ পেয়েছি পিতৃত্ব-লাভে। আমার বিশ্বাস পরিস্থিতির কারণে কোনও নারী অথবা পুরুষকে সন্তানলাভ থেকে যদি বঞ্চিত থাকতে হয়, তখন তাদের একটি গভীর অভাব অপূর্ণ থাকে আর তা থেকে এমন এক অতৃপ্তি ও উদাসীনতা জন্ম নেয় যার কারণ সম্পূর্ণ অজানা থেকে যায়। এই পৃথিবীতে সুখী হতে হলে, বিশেষ করে যৌবন অতিক্রান্ত হলে নিজেকে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, যার দিন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, এইভাবে না ভেবে ভাবা উচিত সৃষ্টির প্রথম বীজ থেকে যে জীবনধারা প্রবাহিত হয়ে এক অজ্ঞাত এবং সুদূর ভাবীকালের দিকে এগিয়ে চলেছে সে তারই অংশ। নির্দিষ্ট ভাষায় প্রকাশিত এই সচেতন অনুভূতি জগতের প্রতি অতি সভ্যতাসূলভ এবং মননশীল দৃষ্টিভংগীর সাথে সম্পর্কযুক্ত, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি অস্পষ্ট, সহজাত আবেগরূপে এটি আদিম এবং প্রকৃতিজাত এবং এর অভাবটাই উচ্চসভ্যতাসূলভ। যে মানুষ এমন কোনও মহৎ এবং উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব অর্জন করতে সমর্থ, যার অবদান প্রসারিত হবে আগামীকালে, তিনি তার কাজের ভিতর দিয়েই তৃপ্ত করতে পারেন তার অনুভূতিকে। কিন্তু যেসব পুরুষ ও নারীর এমন অসাধারণ প্রকৃতির দেওয়া উপহার নেই, তাদের তৃপ্তির একমাত্র পথ সন্তানলাভ। যারা তাদের সৃজনীশক্তিকে নষ্ট হতে দিয়েছে তারা জীবনপ্রবাহ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে এবং তা করতে গিয়ে তারা নিজেদের শুকিয়ে যাওয়ার এক প্রবল ঝুঁকির সম্ভাবনাকে বেছে নিয়েছে। তাদের জন্যে, যদি তারা বিশেষভাবে নৈর্ব্যক্তিক হতে না পারে, মৃত্যু অবধারিত। যে পৃথিবীটা তাদের পরে আসবে তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই আর এই কারণে তাদের নিজেদেরই কাছে নিজেদের যা কিছু কাজ সব তুচ্ছ এবং মূল্যহীন মনে হবে। যেসব নর-নারীর সন্তান এবং সন্তানের সন্তানরা রয়েছে এবং তাদের সহজাত স্নেহের উৎস থেকে ভালবাসেন, তাহলে আগামী দিনগুলি তাদের কাছে মূল্যবান মনে হবে, অন্তত তারা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এবং শুধু কোনও নৈতিকতা বা কল্পনার প্রয়াসে নয়, সহজাত এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এবং যে ব্যক্তির সব প্রভাব তাঁর ব্যক্তিজীবন ছাড়িয়ে যতদূর বিস্তৃত হয়েছে সেই প্রভাবের পরম্পরা আরো অনেক দূর প্রসারিত হতে পারে। আব্রাহামের মত, যিনি এই ভাবনা থেকে তৃপ্তিলাভ করবেন যে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীরা প্রতিশ্রুত সেই ভূমির অধিকার লাভ করবে, যদি তা পরে বহু প্রজন্মে নাও ঘটে এই অনুভূতি থেকেই তিনি ব্যর্থতাবোধের যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাবেন, না হলে তাঁর সব আবেগ নষ্ট হয়ে যাবে।
পরিবারের ভিত্তি হল বাবা-মার তাদের সন্তানদের জন্যে এক বিশেষ রকমের স্নেহের অনুভূতি। তারা পরস্পরকে যেভাবে ভালবাসে, বা অন্যের সন্তানদের, তার চেয়ে আলাদা। এটা সত্যি যে কোনও কোনও বাবা-মার সন্তানদের প্রতি স্নেহের অনুভূতি কম থাকে অথবা থাকেই না। কিন্তু একথাও সত্যি কোনও কোনও নারী নিজের সন্তানের প্রতি যে প্রবল বাৎসল্য অনুভব করে, ঠিক অনুরূপ বাৎসল্য অন্যের সন্তানের জন্যে অনুভব করে। এই ব্যাপারে সহজ করে বলা যায়, বাৎসল্য এক বিশেষ ধরনের অনুভূতি, যা সাধারণ মানুষ নিজের সন্তানের প্রতি অনুভব করে, অন্য কোনও মানুষের প্রতি নয়। এই আবেগ আমরা পেয়েছি আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাণীদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। এই বিষয়ে ফ্রয়েডের দৃষ্টিভঙ্গী আমার কাছে খুব বেশি জৈব-বিজ্ঞান সম্মত বলে মনে হয় না, কারণ যে কোনও লোক কোনও মা-প্রাণীকে দেখলেই বুঝতে পারবে তার শাবকদের জনকের প্রতি তার যে আচরণ তা তার শাবকদের সাথে তুলনায় একেবারেই আলাদা। মানুষের মধ্যে যা দেখতে পাওয়া যায় তা একই সহজাত প্রবৃত্তির পরির্তিত এবং কম নির্দিষ্ট রূপ। এই বিশেষ সহজাত আবেগের জন্যে তা না হলে প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিবার সম্পর্কে আর কিছুই প্রায় বলার প্রয়োজন হত না। কারণ তা হলে সন্তানদের লালন-পালনের ভার পেশাদার পালকের হাতে ছেড়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যে জিনিস রয়েছে অর্থাৎ সন্তানদের প্রতি বাবা-মার বিশেষ স্নেহ, তাহলে বাবা-মার সহজাত আবেগ নষ্ট হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত, তাদের কাছে এবং সন্তানদের কাছে। সমান মূল্যবান। সন্তানের প্রতি বাবা-মার স্নেহের মূল্য প্রধানত এটা যে, তা অন্য যে কোনও স্নেহের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। বন্ধু বন্ধুকে ভালবাসে তার গুণের জন্যে প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে ভালবাসে মোহনীয় শক্তির জন্যে। এই গুণ এবং শক্তি যদি কমে যায় তা হলে বন্ধু ও প্রেমিক পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একমাত্র বিপদের সময়েই জনক-জননীর পর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করা যায়, অসুস্থ হলে, এমন কি ম বিনষ্ট হলেও, যদি বাবা-মা আদর্শবান হন। আমরা যখন গুণের জন্যে প্রশংসিত হই, তখন আনন্দ নাই, যদি আমরা অনেকেই যথেষ্ট বিনয়ী বলে মনে মনে অনুভব করি যে এমন প্রশংসা বিপদজনক। বাবা-মা আমাদের ভালবাসেন কারণ আমরা তাঁদের সন্তান এবং এই ঘটনা অপরিবর্তনীয়। কাজেই তাদের কাছেই আমরা অন্যের তুলনায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করি। সাফল্য পাওয়া গেলে এই জিনিস মূল্যবান মনে হতে পারে, কিন্তু ব্যর্থ হলে তা এমন সান্ত্বনা এবং নিরাপত্তা যা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সব মানবিক সম্পর্কের মধ্যে সাধারণভাবে এক পক্ষের সুখ পাওয়া সহজ। কিন্তু দুপক্ষের জন্যে তা অনেক কঠিন। কারারক্ষক কয়েদিকে পাহারা দিয়ে সুখ পেতে পারে, মনিব তার অধীনস্থ কর্মীকে ভয় দেখিয়ে সুখ পেতে পারে, শাসক প্রজাদের শক্ত হাতে শাসন করে সুখ পেতে পারে এবং রক্ষণশীল পিতাও যে তাঁর পুত্রকে নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্যে বেতের ব্যবহার করে সুখ পান, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এইসব কিছু হল একপক্ষের সুখ, এর সাথে জড়িত অপরপক্ষের তাতে অসন্তোষ ছাড়া অন্য কিছু নেই। এই ধরনের পক্ষপাতমূলক সুখে যে ভুল আছে আমরা তা বুঝি। আমরা বিশ্বাস করি সুস্থ মানবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে উভয়পক্ষের যাতে তৃপ্তি তাই হওয়া উচিত। এই কথা বিশেষভাবে বাবা-মা এবং সন্তানদের সম্পর্কে প্রযোজ্য। কিন্তু তার ফলে মা বাবারা আগে যেমন সন্তানদের কাছ থেকে আনন্দ পেতেন এখন তা পান না, অন্যদিকে সন্তানেরা আগে যেমন মা-বাবার কাছ থেকে দুঃখ-যন্ত্রণা পেত এখন তা পায় না। আমি মনে করি না, আগের দিনের তুলনায় মা-বাবা কেন এখন কম। আনন্দ পাচ্ছে তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, যদিও বর্তমানে একথা বাস্তব, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি এটাও মনে করি না, কেন মা-বাবা সন্তানদের আনন্দকে বাড়াতে পারবেন না তার কোনও কারণ আছে। আধুনিক পৃথিবীর সমসম্পৰ্কর্তার যেটা উদ্দেশ্য অর্থাৎ মননীয়তা এবং সুন্দর আচরণ, অন্যের ব্যক্তিত্বের প্রতি কিছু শ্রদ্ধা, তা এখানেও প্রয়োজন। আর এটাই বর্তমানে সাধারণ জীবনের কলহপ্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে। পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বের সুখ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমে জৈবিক উপাদান থেকে তারপর সমতায় বিশ্বাসী বিশ্বের পক্ষে অন্যের প্রতি যে মনোভাব থাকা প্রয়োজনীয় বলে আমরা মনে করি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে তা বাবা-মা কীভাবে গ্রহণ করে সেইদিক থেকে।
পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের যে আনন্দ তার মৌল উৎস দ্বিধাবিভক্ত। তার একটি হচ্ছে উত্তরপ্রজন্মের ভিতর নিজেরই দৈহিক বিস্তারের অনুভূতি, যা বেঁচে থাকবে নিজের দৈহিক মৃত্যু হলেও এবং তা সম্ভব তার যখন পালা আসবে সেও ঠিক একইভাবে নিজেকে বিস্তার করবে পরবর্তী প্রজন্মের ভিতর এবং এইভাবেই সে তার বংশধারার প্রাণ-বীজকে অমরত্ব দিয়ে যাবে। অপরটি হচ্ছে ক্ষমতা এবং কোমলতার ঘনিষ্ঠ মিশ্রণ। নবাগত শিশুটি অসহায়, তার অভাব পূরণের জন্যে রয়েছে সহজাত আবেগ এবং তা শুধু সন্তান স্নেহকে তৃপ্ত করে না, মা-বাবার প্রভুত্ব করার ইচ্ছাকেও তৃপ্ত করে। যতদিন শিশুকে অসহায় মনে হবে ততদিন তার প্রতি যে স্নেহ বর্ষিত হয় তাকে স্বার্থহীন মনে করা যায় না, কেন না এর মধ্যে থাকে নিজেরই দুর্বল অংশকে রক্ষা করার আবেগ। কিন্তু সন্তানের শৈশব থেকেই মা বাবার মনে মাতৃ-পিতৃসুলভ স্নেহ এবং সন্তানের মঙ্গল। এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়, সন্তানের ওপর ক্ষমতা বিস্তার কিছুটা সহজাত প্রকৃতিপ্রদত্ত হলেও। সন্তান যত দিক থেকে সম্ভব স্বাধীন হতে শিখুক এটাই চাওয়া উচিত, কিন্তু তা মা-বাবার ক্ষমতা বিস্তারের প্রবৃত্তি থাকলে অপ্রীতিকর মনে হবে। কোনও কোনও মা-বাবা এই দ্বন্দ্ব নিয়ে সচেতন নন এবং সন্তানেরা বিদ্রোহ না করা পর্যন্ত তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যান। কিন্তু অন্যেরা এই বিষয়ে সচেতন বলেই পরস্পর বিরোধী আবেগের শিকার হন। এই দ্বন্দ্বে তাদের পিতৃ-মাতৃত্বের সুখ হারিয়ে যায়। সন্তানের ওপর সব যত্ন মমতা ঢেলে দেওয়ার পর তারা দুঃখের সাথে বুঝতে পারেন তারা যা আশা করেছিলেন, সন্তান তার চেয়ে একেবারেই অন্যরকম হয়েছে। তারা চেয়েছিলেন ছেলে সৈনিক হোক, কিন্তু দেখেন সে যুদ্ধবিরোধী হয়ে উঠেছে। অথবা টলস্টয়ের মতো তাঁরা ছেলেকে যুদ্ধবিরোধী হবে বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু সে যোগ দিয়েছে ব্ল্যাক হানড্রেডস সেনাদলে। কিন্তু পরের পরিণতির জন্যে মোটেই নয়, যে শিশু নিজেই খেতে শিখেছে তাকে যদি আপনি খাইয়ে দেন তাহলে শিশুর কল্যাণের ওপর আপনি নিজের ভালবাসার ক্ষমতাকে চাপিয়ে দিচ্ছেন যদিও আপনি ভাবছেন স্নেহবশত আপনি তার কষ্ট কমিয়ে দিচ্ছেন। যদি আপনি বিপদ সম্পর্কে তাকে খুব বেশি সচেতন করে দেন তা হলে মনে হবে সম্ভবত আপনি তাকে আপনার ওপর নির্ভরশীল রাখার কামনা থেকে তা করছেন। আপনি যে প্রতিপাদক মেহ তাকে দিয়ে থাকেন, আপনি তাতে সাড়া চান, তাহলে মনে হবে আপনি সম্ভবত তার আবেগের সাহায্যে তাকে ধরে রাখতে চান। হাজার রকমভাবে ছোট অথবা বড়, মা-বাবার অধিকারবোধের চেতনা তাদের বিপথে চালিত করে, যদি না তারা খুব সতর্ক এবং মনের দিক থেকে নির্ভেজাল হয়। আধুনিক মা-বাবারা এ বিষয়ে সচেতন। তবুও মাঝে মাঝে সন্তানদের সাথে আচরণে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, তার ফলে তাদের খুব বেশি উপকারে আসতে পারতেন না। কিন্তু যদি তারা তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভুল করতে দিতেন তাহলে বেশি উপকারে আসতে পারেন। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যদি তারা নিশ্চয়তা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখে তা হলে তাদের মনে যে দুশ্চিন্তা আসে, অন্য কিছুতে তা আসে না। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অন্তরে পবিত্র হওয়া অনেক ভাল। মা-বাবা যথার্থই সন্তানের ওপর তাদের প্রভাবের চেয়ে ওদের। কল্যাণ কামনাই বেশি করেন। তা হলে তাদের কী করা উচিত বা কী করা উচিত নয় তার জন্যে মনোবিশ্লেষণের লেখা পাঠ্য বই পড়ার প্রয়োজন নেই। তাঁরা নিজের অন্তরের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে তার নির্দেশ খুঁজে পাবেন এবং এসব ক্ষেত্রে মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মধুর থাকবে এবং তাতে সন্তানের মনে বিদ্রোহ তৈরী হবে না এবং বাবা-মার মনেও হতাশার বোধ তৈরী হবে না। সন্তানের ব্যক্তিত্বকে সম্মান দেখানোর জন্যে প্রথম থেকে মা-বাবার কাছে যে দাবি, যা শুধুমাত্র একটা নীতি নয় তা নৈতিক অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক যাই হোক। এর গভীরে আছে একটা অনুভূতি যা অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসের সমতুল্য, যা অধিকার-মনোভাব এবং নির্যাতনকে অসম্ভব করে তুলবে। এই মনোভাব শুধুমাত্র সন্তানদের ক্ষেত্রেই আচরণীয় তা নয়, এটা সমভাবেই প্রযোজ্য বিবাহের ক্ষেত্রে এবং বন্ধুত্বেও। যদিও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এটা তত কঠিন নয়। সুন্দর পৃথিবীতে রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এই মনোভাব খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এটা এমন একটা দুরাশা যে এই সম্বন্ধে আর কোনও আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রে যখন এই বিশ্বজনীন মনোভাবের প্রয়োজন, তাই এর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি শিশুদের ক্ষেত্রে কারণ তাদের অসহায়তার জন্যে, কারণ তাদের ছোট আকার এবং ক্ষীণ শক্তির জন্যে অমার্জিত লোকেরা তাদের অবজ্ঞা করে।
কিন্তু এই গ্রন্থে আলোচিত সমস্যাগুলির দিকে আবার ফিরে তাকানো যেতে পারে। আধুনিক বিশ্বে মাতৃত্ব-পিতৃত্বের পূর্ণ আনন্দ একমাত্র তারাই পেতে পারেন যারা, আমি এতক্ষণ ধরে যা বলে আসছি, অর্থাৎ সন্তানদের প্রতি সম্মানের মনোভাবকে গভীরভাবে অনুভব করেন। তাহলে তাদের আর ক্ষমতা প্রীতিকে ক্লান্তিকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে না এবং সন্তানেরা স্বাধীনতা পেলে উৎপীড়ক মা-বাবা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তার তিক্ত মোহমুক্তির যে আতংক তার কোনও প্রয়োজন নেই। যে মা-বাবার এই মনোভাব তাঁরা বাৎসল্যে অনেক বেশি আনন্দ পান, যে আনন্দ মাতৃত্ব-পিতৃত্বের ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশের দিনে উৎপীড়ক মা-বাবার পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। এই পিচ্ছিল ভুবনে যিনি এখনো নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে সগ্রাম করে চলেছেন, তার পক্ষে যে আবেগ সম্ভব তার চেয়ে তিনি ভালবাসাকে কোমলতার সাহায্যে উৎপীড়ন থেকে মুক্ত করেছেন তিনি অনেক বেশি আনন্দ পেতে পারেন যা আরো বেশি সুন্দর, আরো বেশি কোমল যা জীবনের সস্তা ধাতুকে অতীন্দ্রিয় আনন্দের বিশুদ্ধ সোনায় রূপান্তরিত করতে পারে।
মাতৃ-পিতৃসুলভ হৃদয়াবেগকে খুব উচ্চ মূল্য দিলেও আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই না, যা প্রায় সকলেই করে থাকেন, যে জননীরাই তাদের সন্তানের জন্যে নিজেরাই যথাসাধ্য করবেন। এই বিষয়ে কিছু প্রচলিত রীতিনীতি রয়েছে বহু প্রাচীনকাল থেকে। তখনকার যুগে প্রাচীনারা নবীনাদের যে কয়েকটি অবৈজ্ঞানিক ভালমন্দ উপদেশ দিয়ে যেতেন, তার বাইরে সন্তান পালন সম্পর্কে আর বেশি কিছু জানা ছিল না। বর্তমান কালে সন্তান পালনের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে এবং যিনি এই বিষয়ের কোনও বিশেষ বিভাগে যে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তার হাতেই এই ভার তুলে দিলে সবচেয়ে ভাল হয়। তাদের শিক্ষার যে বিভাগ সমাজে শিক্ষা’ কথাটি ব্যবহার করা হয় সেখানে তা অনুমোদিত। মা ছেলেকে ক্যালকুলাস শেখাবে এটা আশা করা যায় না, তা সে ছেলে মায়ের যত প্রিয়ই হোক। বই-পড়া শিক্ষা বিষয়ে এটা মোটামুটিভাবে স্বীকৃত যে, যে মা এই বিষয়ে কিছু জানেন না, তার চেয়ে যারা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের কাছেই তা বেশি শিখতে পারে। কিন্তু সন্তান বিষয়ে অন্যান্য অনেক বিভাগে এটি অনুমোদিত নয়, কেন না তার জন্য যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তা এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায় নি। নিঃসন্দেহে কিছু জিনিস মা-ই ভাল করতে পারে, কিন্তু সন্তান যত বড় হতে থাকে। ততই তাকে আরো বেশি জিনিস শেখাতে হয় যা অন্যেরা ভাল শেখাতে পারেন। সাধারণভাবে যদি সকলে স্বীকার করত, তা হলে মায়েরা অনেক পরিশ্রম থেকে। বেঁচে যেত যা তাদের জন্যে ক্লান্তিকর, কারণ এটা এমন বিষয় নয় যাতে তাদের পেশাগত দক্ষতা রয়েছে। যে নারী নিজের জন্যে অথবা তার সমাজের জন্যে কোনও বিশেষ রকম পেশাগত দক্ষতা অর্জন করেছে তা মাতৃত্বলাভ করার পরও যাতে সেই দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে সেই স্বাধীনতা তার থাকা উচিত। গর্ভধারণের শেষ কটি মাস এবং শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময় সেই কাজে অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু শিশুর বয়স যখন নয় মাস হয়ে যায় তখন সেই শিশু মায়ের পেশাগত কাজে অলঙ্নীয় বাধা হতে পারে না। সমাজ যখনই মায়ের ওপর তার সন্তানের জন্যে যুক্তির অতিরিক্ত ত্যাগ স্বীকারের দাবি তুলে ধরে তখন মা, যদি তিনি অস্বাভাবিক ধরনের সাধু স্বভাবের না হন, তাহলে সন্তানের কাছে তার যা প্রাপ্য তার অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ প্রত্যাশা করবেন। যে জননীকে চলিত রীতিতে আত্মত্যাগী বলা হয়, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানের প্রতি অস্বাভাবিকরকম স্বার্থপর, কারণ মাতৃত্ব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হওয়াতে তাকে জীবনের সবটুকু মনে করলে তৃপ্তি পাওয়া যাবে না এবং অতৃপ্ত জনক-জননীর আবেগের দিক থেকে সন্তানের ওপর অধিকারি-বিস্তারী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
অতএব এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, সন্তান ও তার জননী- উভয়ের স্বার্থে মাতৃত্ব যেন জীবনের অন্যসব স্বার্থ এবং কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়, তা দেখতে হবে যদি শিশুপালনের প্রকৃত প্রশিক্ষণ তিনি গ্রহণ করে থাকেন এবং যদি তাঁর নিজের সন্তানদের পালন করার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন হয়ে থাকে, তাহলে তার এই দক্ষতা আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত এবং শিশুপালনকে তার পেশা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। যে শিশুদের মধ্যে তাঁর নিজের সন্তানও অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আশা করা যায়। বাবা-মার কাছ থেকে রাষ্ট্র ন্যূনতম যেটুকু যদি তারা পূরণ করে তাহলে তাদের সন্তানদের কীভাবে বড় করে তুলবে এবং কে করবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকার তাদের থাকা উচিত। অবশ্য ধরে নিতে হবে যে, সন্তানেরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের তত্ত্বাবধানের বাইরে যাবে না। কিন্তু এমন রীতি চালু হওয়ার দাবি জানানো উচিত নয়। অন্য নারীরা যে কাজ খুব ভালভাবে করতে পারে প্রত্যেক জননী নিজেই তা করবে। যেসব মা সন্তানপালনে ব্যর্থতা ও অক্ষমতা অনুভব করে, যেমন অনেক মা করে থাকে তাদের উচিত যারা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেয়েছে এবং যাদের স্বাভাবিক দক্ষতা রয়েছে কোনও দ্বিধা না করে তাদের হাতে সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। সন্তানদের মঙ্গলের জন্যে ঠিক কী করা উচিত, তা মেয়েদের শিখিয়ে দেওয়ার জন্যে স্বর্গ-প্রেরিত কোনও প্রেরণা নেই। মানসিক উদ্বেগ যখন একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন তা অধিকার-প্রবণতার ছদ্মবেশ হয়ে যায়। জননীর ভাবাবেগপূর্ণ ব্যবহারে এবং অজ্ঞতার কারণে অনেক শিশুরই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঘটে। বাবারা যে শিশুর জন্যে বেশি কিছু করতে পারে না এটা সবসময় স্বীকৃত হয়ে এসেছে, তবু সন্তানেরা মাকে যতটা ভালবাসতে পারে, বাবাকেও ততটাই পারে। যদি নারীদের জীবনকে অপ্রয়োজনীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হয় এবং শিশুদের মন এবং দেহ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান যেভাবে বাড়ছে, তার সুবিধা যদি শিশুদের দিতে হয়, তা হলে সন্তানের সাথে জননীর সম্পর্ক আগামী দিনে ক্রমেই সন্তানের সাথে জনকের সম্পর্কের তুল্য করতে হবে।
——-
১. ভিকার অব ওয়েকফিল্ড (Vicar of Wakefield), অলিভার গোল্ডস্মিথ, Oliver gold smith (১৭৩০-১৭৭৪), রচিত কালজয়ী উপন্যাস। এই উপন্যাসের রচনাকাল ১৭৬১ ৬২ এবং প্রকাশিত হয় ১৭৬৬ সালে। অলিভার গোল্ডস্মিথ এ্যাংলো আইরিশ লেখক এবং কবি। পেশায় চিকিৎসক।
২. জীন আইলিন, Jean Ayling (১৮৯৪-১৮৭৬)। তার আসল নাম Dorothy Mand Wincln মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাসেক্সে জন্ম, বিখ্যাত গবেষক। তাঁর গবেষণা গ্রন্থে, ‘The Retreat from Parenthood’ উচ্চবিত্ত, পেশাজীবীদের মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের সমস্যাকে অন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখা হয়েছে।