১৩. পরিকল্পনা

১৩. পরিকল্পনা

পরের দুই সপ্তাহে টুশি এবং তপু খুব বড় একটা জিনিস আবিষ্কার করল, সেটা হচ্ছে। পৃথিবীর সব মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগের নাম হচ্ছে ছোট মানুষ, অন্য ভাগের নাম হচ্ছে বড় মানুষ। ছোট মানুষদের বড় মানুষের সব কথা শুনতে হয় কিন্তু বড় মানুষেরা ছোট মানুষের কোনো কথাই শোনে না।

কাবিল কোহকাফীকে ধরে নিয়ে যাবার পর কী করবে বুঝতে না পেরে টুশি আর তপু অনেক চিন্তাভাবনা করে একদিন পুলিশকে ফোন করল। মোটা গলার স্বরে একটা মানুষ বলল, “হ্যালো।”

টুশি বলল, “এটা কি পুলিশের অফিস?”

মোটা গলার মানুষটা বলল, “কার সাথে কথা বলতে চাও খুকি?”

“পুলিশের সাথে।”

মোটা গলার মানুষটি তখন একটা ঢেকুর তুলল। তুলে বলল, “কেন কথা বলতে চাও?”

টুশি বলল, “একজন মানুষ কিডন্যাপ হয়েছে সেটা রিপোর্ট করতে চাই।”

টুশি ভেবেছিল সেটা শুনে পুলিশ অফিসার চমকে উঠে বলবে, “কে কিডন্যাপ হয়েছে? কখন কিডন্যাপ হয়েছে? কীভাবে কিডন্যাপ হয়েছে?” কিন্তু সেরকম কিছু হল না, মানুষটা এবারে আরেকটা ঢেকুর তুলে বলল, “ও আচ্ছা। বেশ বেশ। খুকি এখন তো আমরা খুব ব্যস্ত–তুমি পরে ফোন কর।”

টুশি অবাক হয়ে বলল, “পরে ফোন করব?”

“হ্যাঁ। তুমি না করে তোমার আব্বাকে ফোন করতে বলো। ঠিক আছে? আর খুকি–এখন যাও, তুমি পড়াশোনা করতে যাও।”

টুশি টেলিফোনটা রেখে কিছুক্ষণ দাঁত কিড়মিড় করে ঘরের ভেতর পা দাপদাপি করল। তপু বলল, “টুশি আপু, প-পত্রিকায় ফোন করো।

তখন খবরের কাগজ দেখে টেলিফোন নাম্বার বের টুশি সেখানে ফোন করল। পুলিশের ওখানে ফোন ধরেছিল খুব মোটা গলার একজন পুরুষমানুষ। এখানে ফোন ধরল খুব মধুর গলার একজন মেয়ে, বলল, “হ্যালো।”

টুশি বলল, “আমরা একটা কিডন্যাপ রিপোর্ট করতে চাই।”

 “ভেরি গুড। খুকি তুমি একটু ধরো।”

এরপর কিছুক্ষণ বাজনা শোনা গেল তারপর একজন মানুষ নাকি গলায় বলল, “এ্যালো। ছোটদের পাতা–”

“আমরা একটা কিডন্যাপ রিপোর্ট করতে চাই।”

মানুষটা নাকি গলায় বলল, “বেরি গুঁড। বেঁরি গুঁড। এ ফোর কাগজে ডাবল স্পেস দিয়ে লিখে পাঠিয়ে দাও।”

 “লিখে পাঠিয়ে দেব?”

“এ্যা। সুন্দর দেখে একটা নাম দিও। কিডন্যাপারের শাস্তি। কিংবা দুষ্ট কিডন্যাপার। ইচ্ছা করলে একটা উঁড়াও দিতে পার।”

“ছড়া?”

“এ্যা। বিও পাঠাতে পার। রঙিন জেঁয়োন দিয়ে আঁকবে। বেরি গুঁড।”

টুশি আমতা-আমতা করে বলল, “আমরা ছড়া কিংবা ছবি পাঠাতে চাই না। সত্যিকারের একটা কিডন্যাপ হয়েছে সেটা রিপোর্ট করতে চাই। আপনাদের পত্রিকায় সেটা ছাপাবেন।”

উত্তরে নাকি গলায় মানুষটা ঘোড়ার মতো শব্দ করে হাসল, “ইহ হি হি হি “

টুশি তখন রেগেমেগে ফোনটা রেখে দিল।

 তপু বলল, “আপু অন্য পত্রিকায় ফো-ফোন করো।”

তখন দুজনে মিলে খোঁজাখুঁজি করে আরেকটা পত্রিকা অফিসে ফোন করল। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর একজন মানুষ টেলিফোন ধরে বলল, “হ্যালো।”

টুশি এবারে গলার স্বর একটু মোটা করে বড় মানুষের মতো ভঙ্গি করে বলার চেষ্টা করল, “দেখেন আমি খুব জরুরি একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই। কার সাথে কথা বলব?”

“একটু ধরেন”

টুশি এবারে একটু ভরসা পায়, মানুষটি তাকে আপনি করে বলছে। খানিকক্ষণ পর আরেকজন ফোন ধরে বলল, “বার্তা-সম্পাদক–

টুশি আবার গলার স্বর একটু মোটা করে বড় মানুষদের মতো করে বলল, “আমরা আপনাদের কাছে একটা কিডন্যাপিং রিপোের্ট করতে চাই।”

“পুলিশকে জানানো হয়েছে?”

 “পুলিশকে জানিয়েছিলাম তারা শুনতে রাজি হয় নাই।”

“হুম।” বার্তা-সম্পাদক বলল, “কে কিডন্যাপ হয়েছে? আপনার কী হয়?”

টুশি ইতস্তত করে বলল, “আমাদের কেউ না। মানুষটা মানে ইয়ে আসলে”।

“কত বয়স?”

 “এ-এক হাজার”।

 “কী বললেন? এক হাজার? আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?”

টুশি তাড়াতাড়ি বলল, “না-না-না ঠাট্টা করছি না। আসলে হয়েছে কি ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক। যাকে কিডন্যাপ করেছে সে আসলে অদৃশ্য–”

উত্তেজনার কারণে টুশি গলার স্বর মোটা রাখতে ভুলে গেল–আর অন্য পাশের মানুষটা রেগে গিয়ে বলল, “শোনো মেয়ে, আমরা খুব ব্যস্ত মানুষ, তোমার ইয়ার্কি করার অনেক সময় থাকতে পারে, আমাদের এরকম জিনিস নিয়ে নষ্ট করার সময় নেই।”

টুশি ব্যস্ত হয়ে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি কথা বলছি। সবকিছু শোনেন তা হলে বুঝতে পারবেন।”

বার্তা-সম্পাদক বলল, “এক হাজার বছরের অদৃশ্য মানুষের কিডন্যাপিং হওয়ার খবর ছাপানোর কিছু ট্যাবলয়েড পত্রিকা আছে। সেখানে ফোন করো, তারা তোমার ইন্টারভিউ পর্যন্ত ছাপিয়ে দেবে।”

টুশি উত্তরে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বার্তা-সম্পাদক খটাশ করে টেলিফোন রেখে দিয়েছে। টুশির যা মেজাজ খারাপ হল সেটি আর বলার মতো নয়।

.

পুলিশ আর পত্রিকার সাথে বেশি সুবিধে করতে না পেরে টুশি আর তপু শেষ পর্যন্ত একদিন চাচা-চাচিকে ব্যাপারটা খুলে বলার চেষ্টা করল। সকালবেলা সবাই নাস্তা করছে, তখন টুশি বলল, “চাচা, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”

“কী কথা?”

“আপনার মনে আছে, একরাতে আমি আর তপু বাসায় একা একা ছিলাম?”

 চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “হ্যাঁ, কী হয়েছে তখন?”

“সকালবেলা বাসায় এসে আপনি একটা অদৃশ্য জিনিসের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলেন, মনে আছে?”

চাচা সরু চোখে বললেন, “আমি কোনো অদৃশ্য জিনিসের সাথে ধাক্কা খাই নি। আমি ডাক্তারকে দেখিয়েছি, ডাক্তার বলেছে মাইল্ড স্ট্রোকের মতো। ব্লাডপ্রেশার খুব বেশি ছিল বলে–”

“না, চাচা। ব্লাডপ্রেশার না, আপনি আসলে একটা অদৃশ্য মানুষের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলেন। ঠিক মানুষ না, জিন। একটা শিশি থেকে বের হয়েছে।”

চাচা একটা কথাও না বলে চোখ বড় বড় করে টুশির দিকে তাকিয়ে রইলেন, খানিকক্ষণ কোনো শব্দ নেই। চাচা খুব সাবধানে চাচির দিকে একবার তাকালেন তারপর আবার টুশির দিকে তাকালেন তারপর আবার চাচির দিকে তাকালেন। চাচি ভুরু দিয়ে একটা ইঙ্গিত করলেন যার অর্থ “এই-মেয়ে-পাগল-একে-ঘাঁটিও না।” চাচা তখন টুশির দিকে তাকিয়ে মুখে একটা অত্যন্ত মধুর হাসি ফুটিয়ে বললেন, “অবশ্যই শিশি থেকে বের হয়েছে। জিন যদি শিশি থেকে বের না হয় তা হলে কি মশা বের হবে?”

টুশি একটুকু অস্থির হয়ে বলল, “চাচা আপনি বিশ্বাস করছেন না? আমি সত্যি কথা বলছি। তা-ই নারে তপু?”

তপু মাথা নাড়ল, চাচি মাথা নাড়লেন এবং চাচাও মাথা নাড়লেন। চাচা জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “কে বলেছে আমি বিশ্বাস করছি না? আমি অবশ্যই বিশ্বাস করেছি। অদৃশ্য জিন তো থাকতেই পারে। জিন যদি অদৃশ্য না হয় তা হলে কে অদৃশ্য হবে? তা হলে কি মানুষ অদৃশ্য হবে?”

টুশি হঠাৎ করে কেমন যেন হাল ছেড়ে দেয়। চাচা-চাচি কোনোভাবেই এটা বিশ্বাস করবেন না, লাভের মাঝে লাভ হল যে চাচা-চাচি তাকে একটা পাগল ভেবে নিলেন।

টুশি আবিষ্কার করল চাচা আর চাচি ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে তার দিকে তাকাচ্ছেন, কে জানে এখন তাকে জোর করে একটা পাগলা-গারদে ভরতি না করে দেন। টুশি কী করবে বুঝতে পারল না, রাগে-দুঃখে তার নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল।

.

এই ঘটনার দুইদিন পর খবরের কাগজ খুলে টুশি আর তপু স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। খবরের কাগজের ভিতরে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বিজ্ঞাপন, সেখানে বড় বড় করে লেখা :

অদৃশ্য দানব! অদৃশ্য দানব!! অদৃশ্য দানব!!!

বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে বড় অলৌকিক ঘটনা। নিজের চোখে দেখুন, ইতিহাসের অংশ হোন। মানুষরূপী একটি ভয়ংকর রক্তপিপাসু হিংস্র প্রাণী সম্প্রতি ধরা পড়েছে। এই প্রাণীটি পুরোপুরি অদৃশ্য–তাকে প্রথমবারের মতো মঞ্চে নিয়ে আসা হচ্ছে।

নিজের চোখে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনাটি দেখুন। এই অদৃশ্য দানবের উপর বিশেষ প্রতিবেদন আজকে রাত সাড়ে আটটায় টেলিভিশনে।

টিকিটের জন্যে অবিলম্বে যোগাযোগ করুন।

.

টুশি আর তপু অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে না। তপু শেষ পর্যন্ত বলল, “কা কাবিল কোহকাফী মোটেই ভ-ভয়ংকর না।”

টুশি মাথা নাড়ল, “না।”

 “অনেক ভালো।”

 “হ্যাঁ। অনেক ভালো আর সুইট।”

তপু মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কেন লি-লিখেছে অনেক ভ ভয়ংকর? অনেক হি-হিংস্র?”

টুশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মনে হয় কী জানিস? তাকে তো বেঁধে রেখেছে সেইজন্যে লিখেছে হিংস্র, লিখেছে রক্তপিপাসু। ভালো মানুষকে কি বেঁধে রাখা যায়?”

তপু বলল, “ঠি-ঠিক বলেছ।”

 “তা ছাড়া হিংস্র বললে, কেউ কাছে আসবে না। বদমাইশগুলো নিশ্চয়ই চায় না কেউ কাছে আসুক। নিশ্চয়ই চায় সবাই দূর থেকে দেখুক।”

“ইশ! বেচারা কা-কাবিল কোহকাফী! এখন কী হবে?”

টুশি খুব দুশ্চিন্তিত মুখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কিছু-একটা করতে হবে। সাহায্য করার জন্যে আমাদের যেতে হবে।”

“ কিন্তু কে-কেমন করে যাব? ক-কত টাকা টিকেট দেখেছ?”

 “যত টাকাই হোক যেতে হবে।”

 “টা-টাকা কোথায় পাবে?”

“আমার নানা ট্রাস্ট করে আমার জন্যে টাকা রেখে গেছে, সেখান থেকে নেব।”

তপু মুখ শুকনো করে বলল, “কিন্তু তা-তারপর কী হবে?”

টুশি বলল, “দেখি কী করা যায়। কিছু-একটা আমাদের করতেই হবে।”

.

রাত্রিবেলা টুশি আর তপু টেলিভিশনে অদৃশ্য-দানবের ওপর বিজ্ঞাপনটি দেখল। ছোট এক মিনিটের বিজ্ঞাপন। প্রথমে মন্তাজ ওস্তাদ কীভাবে সুন্দরবন অভিযানে গিয়ে সেখানে জলের ভেতর থেকে এই ভয়ংকর হিংস্র প্রাণীটা ধরেছে সেটা নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে দুই-একটা কথা বলল। তারপর একটা খচা নিয়ে আসা হল–তার ভেতরে নাকি অদৃশ্য দানব। তখন হিংস্র জন্তুর গর্জন শোনা যেতে লাগল, ভয়ের ছবিতে যেরকম ভূত-প্রেত-দানব দেখা যায় সেরকম ভয়ংকর কিছু দাপাদাপি করল, ভয়-পাওয়া মানুষের আতঙ্ক এবং চিৎকার শোনা গেল। তারপর একজন সুন্দরী মেয়ে এসে বলল, “এই আদিম ভয়ংকর রক্তপিপাসু হিংস্র দানবটিকে আপনারা দেখতে পারবেন প্রদর্শনী শোতে। এই দেখাঁটি আপনারা ভুলতে পারবেন না– কারণ প্রাণীটি অ-দৃশ্য!”

টুশি রিমোট চেপে টেলিভিশনটি বন্ধ করে দিয়ে বলল, “কত বড় বদমাইশ! কাবিল কোহকাফী হচ্ছে একটা সুইট জিন। আর তাকে বানিয়েছে হিংস্র দানব।”

“কেউ তো দে-দেখতে পায় না তাই।”

টুশি তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি সবাই দেখতে পারত তা হলে আর কেউ বদমাইশি করতে পারত না।”

তপু টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা যদি সেই ম-মন্ত্রটা খুঁজে বের করতে পারতাম!”

“কোন মন্ত্রটা?”

“যেটা বললে কা-কাবিলের বাণ কেটে যাবে!”

টুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটা আমরা কোথায় পাব! কত হাজার বছর আগের কথা!”

তপু টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু।”

 “কী হল?”

 “তুমি ও-ওষুধের শিশি দেখেছ?”

 “দেখেছি। কেন?”

“ওষুধের শি-শিশির উপরে স-সবসময় লেখা থাকে ক-কখন খেতে হয়, সেরকম তার বোতলটিতে কি কা-কাবিল কোহকাফীর উপর লে-লেখা আছে?”

টুশি বলল, “কিছু লেখা থাকলে কি চোখে পড়ত না?”

“কিন্তু আমরা তো ভা-ভালো করে দেখি নাই।”

 টুশি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আয় তা হলে ভালো করে দেখি।”

টুশি আর তপু কাবিল কোহকাফীর শিশিটা বের করে খুব ভালো করে দেখল। শিশিটা মনে হয় পাথরের তৈরি, বেশ ভারী। ছিপিটা ভেঙে খোলা হয়েছে, সেটা মনে হয় কোনো একটা ধাতুর তৈরি। এত বছর পরেও ধাতুটিতে জং ধরে নি– কাজেই মনে হয় খুব ভালো কোনো ধাতু হবে! টুশি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কোনোকিছু না পেয়ে তপুর হাতে দিল। তপু টেবিল-ল্যাম্পের নিচে ধরে ভালো করে দেখে হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, “আ-আপু।”

“কী হয়েছে?”

 “মনে হয় উপরে কিছু লেখা আছে–”।

 “কোথায়?”

 “এই দ্যাখো-খুব হালকা, বো-বোঝা যায় না এরকম।”

টুশিও এসে দেখল, খুব ভালো করে তাকালে মনে হয় সত্যিই কিছু-একটা লেখা আছে। খুব অস্পষ্ট লেখা। টুশি বলল, “মনে হয় এক হাজার বছরের ময়লা লেগে এই অবস্থা। পরিষ্কার করে নিই।”

“কী দিয়ে প-পরিষ্কার করবে আপু?”

 “নেল পালিশ রিমুভার।”

ছোট একটা টিসু পেপারে চাচির নেলপালিশ রিমুভার লাগিয়ে টুশি পাথরের শিশিটা ঘষতেই বাদামি রঙের ময়লা উঠে নিচের লেখা পরিষ্কার বের হয়ে এল। তপু হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেয়ে গেছি! লে-লেখা পেয়ে গেছি!”

টুশি বলল, “আগেই এত খুশি হয়ে যাস নে।”

“কেন?”

 “লেখাটা আগে দ্যাখ।”

তপু দেখল এবং সমস্যাটা বুঝতে পারল। লেখাটি কোনো পরিচিত ভাষায় লেখা নয়। আরবির মতো–কিন্তু আরবি নয়। জিজ্ঞেস করল, “কী ভাষা এটা?”

“জানি না।”

“তা-তা হলে পড়ব কেমন করে?”

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “সেটাও জানি না।”

দুজনে মিলে খানিকক্ষণ জল্পনা-কল্পনা করল। মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে নেয়া যায় কি না আলোচনা করল কিন্তু তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। ইউনিভার্সিটিতে অনেক জ্ঞানীগুণী থাকে তাদের কাছে নিয়ে গেলে হয়তো কেউ-একজন এটা পড়ে দিতে পারে কিন্তু সেখানে কার কাছে নিয়ে যাবে তারা। বুঝতে পারল না। মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া যায়, সেখানকার কিউরেটর হয়তো বলতে পারবে। কিন্তু ছোট মানুষ বলে তাদের কোনো পাত্তা দেবে বলে মনে হয় না। লাইব্রেরিতে অনেক বইপত্র থাকে, সেখানে গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে হয়তো এটা কোন ভাষা বের করে ফেলতে পারবে। কিন্তু সেই ভাষাটা শিখে ওপরের লেখাটা পড়তে পারবে বলে মনে হয় না। টুশি এবং তপু নূতন করে ছোট থাকার সমস্যাটা বুঝতে পারল, তারা যদি বড় মানুষ হত কিংবা কোনো একজন বড় মানুষের সাথে তাদের পরিচয় থাকত তা হলে হয়তো এই সমস্যাটার সমাধান বের করে ফেলত। যখন দুজনে প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন তপু চোখ বড় বড় করে বলল, “আপু”।

“কী হল?”

 “ই-ই-ইন্টারনেট!”

 “ইন্টারনেট?”

“হ্যাঁ।” তপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “ই-ইন্টারনেটে খোঁজ করি–সে-সেখানে হয়তো খোঁজ পাওয়া যাবে।”

টুশি হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!” পরমুহূর্তে চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু ইন্টারনেট পাব কোথায়?”

 “ম-মনে নাই” তপু হড়বড় করে বলল, “স্কুলে যা-যাবার সময় রা-রাস্তায় একটা সা-সাইবার কাফে আছে?”

টুশি আবার হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস।”

পরমুহূর্তে আবার সে চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু এই শিশিটা ইন্টারনেটে কেমন করে পাঠাব?”

“শিশিটাতো পা-পাঠানো যাবে না। শিশির উপরের লে-লেখাটা স্ক্যান করে পা-পাঠাব।”

টুশি আবার হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস! আয় তা হলে কাজ শুরু করে দিই।”

একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুব সাবধানে পরীক্ষা করে টুশি আর তপু শিশির উপরের লেখাটা প্রথমে একটা কাগজে লিখে নিল। তারপর দুজন ছুটলো। সাইবার কাফের দিকে।

টুশি আর তপু এর আগে কখনও সাইবার কাফেতে আসে নি। কী করে কী করতে হয় দুজনের কেউই জানে না। সাইবার কাফের কর্মচারীটি তাদের দুজনকে একটা কম্পিউটারের আসনে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল, দুজনে মিলে যখন কী-বোর্ড আর মাউস নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে তখন পাশের কম্পিউটারে বসে থাকা এলোমেলো চুলের তেরো-চোদ্দ বছরের টিশার্ট পরা একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী করছ?”

টুশি এবং তপু দুজনেই একটু সন্দেহের চোখে ছেলেটার দিকে তাকায়। কিন্তু ছেলেটা সেটা লক্ষ করল বলে মনে হল না, গলা নামিয়ে বলল, “এই সাইবার কাফে মহা গিরিংগিবাজ–কী করতে চাও যদি না জান হলে ছিল খেয়ে যাবে।”

টুশি আর তপু কিছু বলল না। ছেলেটা তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মেশিনের মতো কি-বোর্ডে কিছু-একটা টাইপ করতে করতে বলল, “তোমরা নূতন মক্কেল। কোন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করছ?”

“না মানে”

ছেলেটা বাম হাত দিয়ে মাউস ক্লিক করে কিছু-একটা ঘটিয়ে দিয়ে বলল, “কী করতে চাও?”

টুশি তখন কাগজটা বের করে সেই বিচিত্র লেখাটা দেখিয়ে বলল, “এইখানে কী লেখা সেটা বের করতে চাই!”

টুশি নিশ্চিত বড় কোনো মানুষকে এই কথা বললে সে হয় হা হা করে হেসে উঠত নাহয় ধমক দিয়ে বসত। কিন্তু টিশার্ট পরা এলোমেলো চুলের ছেলেটা তার কিছুই করল না, মুখটা ছুঁচালো করে বলল, “ভেরি ইন্টারেস্টিং। এনক্রিপশান প্রবলেম। তিনটা ইউজার গ্রুপ আছে তার মাঝে দুইটা সুপার।”

টুশি আর তপু কী বলবে বুঝতে পারল না। ছেলেটা কাগজটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানাদিক থেকে দেখে বলল, “কোথায় পেয়েছ?”

“এটা একটা খুব পুরানো ভাষায় লেখা।”

ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলল, “কসম?”

 টুশি বলল, “কসম।”

ছেলেটা এবারে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “মাইয়ারে মাইয়া।”

কথাটার মানে কী টুশি কিংবা তপু কেউই বুঝতে পারল না বলে দুজনেই চুপ করে রইল। ছেলেটা কম্পিউটারে খুটখাট করতে করতে বলল, “তোমাদের ই মেইল অ্যাড্রেস আছে?”

তপু মাথা নাড়ল, “না–নাই।”

 “এই লেখাটা স্ক্যান করেছ?”

তপু মাথা নাড়ল, “না।”

“যাও, আগে স্ক্যান করিয়ে আনো। আমি ততক্ষণে তোমাদের একটা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট খুলে দিই।”

 টিশার্ট পরা উশকো-খুশকো চুলের ছেলেটা থাকার কারণে আধা ঘণ্টার মাঝে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ভাষায় বিশেষজ্ঞ এরকম অনেক মানুষের কাছে এই লেখাটা পাঠানো হয়ে গেল। ছেলেটা বলল, যদি কেউ এর সমাধান বের করতে পারে তা হলে আজ কালকের মাঝেই তাদের সেটা জানিয়ে দেবে। টুশি আর তপুকে সাইবার কাফেতে এসে প্রত্যেক দিন তাদের ই-মেইল পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোনো উত্তর এসেছে কি না।

সত্যি কথা বলতে কি কোনো উত্তর চলে আসবে সেটা টুশি কিংবা তপু কেউই একেবারে আশা করে নি। তাই পরের দিন স্কুল থেকে আসার সময় যখন সাইবার কাফেতে গিয়ে তাদের ই-মেইল এসেছে কি না পরীক্ষা করতে গেল তখন তারা অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি চারটা ই-মেইল চলে এসেছে। প্রথম ই-মেইলটাতে লেখা :

“তোমরা যে লেখাটি পাঠিয়েছ আমি সেটা সম্পর্কে পরিচিত নই। লেখার গঠনভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এটা প্রাচীন হিব্রু ভাষায় একটি অপভ্রংশ।” দ্বিতীয় ই-মেইলটাতে লেখা :

“তোমাদের লেখাটি দেখে মনে হচ্ছে এটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে তাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে-ওঠা একটি সভ্যতার লিপি। এই লিপিটি বর্তমানে মৃত। তোমরা কোথায় এটি পেয়েছ জানার জন্যে খুব আগ্রহী। তৃতীয় ই-মেইলটাতে লেখা :

“তোমাদের পাঠানো ই-মেইলে সংযুক্ত লিপিটি পেয়ে আমি চমৎকৃত হয়েছি। এটি অধুনালুপ্ত কিফুস ভাষার লিখনলিপি। আমি দীর্ঘদিন থেকে এই ভাষার উপরে গবেষণা করছি। এখানে লেখা : কাবিল তুমি দুই হস্ত প্রসারণ করে মস্তিষ্ক নত করো, উচ্চারণ করে উচ্চকণ্ঠে, মাগারুফাস মাগারুফাস এবং মাগারুফাস। এই লিপিটি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছ আমাকে জানাও। আমাদের জাতীয় মিউজিয়াম এর প্রকৃত কপিটি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হবে।”

চতুর্থ ই-মেইলটি পাঠিয়েছে একজন বদমেজাজি প্রফেসর, সে লিখেছে : “ভবিষ্যতে আমাকে এই ধরনের আজেবাজে জিনিস পাঠালে মাথা ভেঙে দেব। দূর হও হতভাগা সকল।”

অন্য তিনটি ই-মেইল পেয়ে টুশি আর তপু এত খুশি হয়ে গেল যে বদমেজাজি প্রফেসরের ই-মেইলটির জন্যে তারা কিছু মনে করল না। যিনি এই রহস্যময় লেখাটার অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন টুশি আর তপু তাঁকে বিশাল লম্বা একটা চিঠিতে সবকিছু লিখে পাঠাল। মানুষটা নিশ্চয়ই কিছু বিশ্বাস করবেন না কিন্তু টুশি আর তপু সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। অন্য যে-দুজন তাদের কাছে ই-মেইল পাঠিয়েছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ দিয়ে সাথে সাথে উত্তর পাঠিয়ে দিল।

বদমেজাজি প্রফেসরকেও তারা একটা ই-মেইল পাঠাল, সেখানে লিখল :

“হে বদমেজাজি প্রফেসর জন্মের সময় তোমার মা কি তোমার
মুখে মধু দিতে ভুলে গিয়ে আলকাতরা দিয়েছিল?”

 তারপর তারা ছুটল বাসায়। কাবিল কোহকাফীকে অদৃশ্য থেকে উদ্ধার করার মন্ত্র তারা এখন পেয়ে গেছে!

১৩. পরিকল্পনা

১৩. পরিকল্পনা

১৩. পরিকল্পনা

পরের দুই সপ্তাহে টুশি এবং তপু খুব বড় একটা জিনিস আবিষ্কার করল, সেটা হচ্ছে। পৃথিবীর সব মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগের নাম হচ্ছে ছোট মানুষ, অন্য ভাগের নাম হচ্ছে বড় মানুষ। ছোট মানুষদের বড় মানুষের সব কথা শুনতে হয় কিন্তু বড় মানুষেরা ছোট মানুষের কোনো কথাই শোনে না।

কাবিল কোহকাফীকে ধরে নিয়ে যাবার পর কী করবে বুঝতে না পেরে টুশি আর তপু অনেক চিন্তাভাবনা করে একদিন পুলিশকে ফোন করল। মোটা গলার স্বরে একটা মানুষ বলল, “হ্যালো।”

টুশি বলল, “এটা কি পুলিশের অফিস?”

মোটা গলার মানুষটা বলল, “কার সাথে কথা বলতে চাও খুকি?”

“পুলিশের সাথে।”

মোটা গলার মানুষটি তখন একটা ঢেকুর তুলল। তুলে বলল, “কেন কথা বলতে চাও?”

টুশি বলল, “একজন মানুষ কিডন্যাপ হয়েছে সেটা রিপোর্ট করতে চাই।”

টুশি ভেবেছিল সেটা শুনে পুলিশ অফিসার চমকে উঠে বলবে, “কে কিডন্যাপ হয়েছে? কখন কিডন্যাপ হয়েছে? কীভাবে কিডন্যাপ হয়েছে?” কিন্তু সেরকম কিছু হল না, মানুষটা এবারে আরেকটা ঢেকুর তুলে বলল, “ও আচ্ছা। বেশ বেশ। খুকি এখন তো আমরা খুব ব্যস্ত–তুমি পরে ফোন কর।”

টুশি অবাক হয়ে বলল, “পরে ফোন করব?”

“হ্যাঁ। তুমি না করে তোমার আব্বাকে ফোন করতে বলো। ঠিক আছে? আর খুকি–এখন যাও, তুমি পড়াশোনা করতে যাও।”

টুশি টেলিফোনটা রেখে কিছুক্ষণ দাঁত কিড়মিড় করে ঘরের ভেতর পা দাপদাপি করল। তপু বলল, “টুশি আপু, প-পত্রিকায় ফোন করো।

তখন খবরের কাগজ দেখে টেলিফোন নাম্বার বের টুশি সেখানে ফোন করল। পুলিশের ওখানে ফোন ধরেছিল খুব মোটা গলার একজন পুরুষমানুষ। এখানে ফোন ধরল খুব মধুর গলার একজন মেয়ে, বলল, “হ্যালো।”

টুশি বলল, “আমরা একটা কিডন্যাপ রিপোর্ট করতে চাই।”

 “ভেরি গুড। খুকি তুমি একটু ধরো।”

এরপর কিছুক্ষণ বাজনা শোনা গেল তারপর একজন মানুষ নাকি গলায় বলল, “এ্যালো। ছোটদের পাতা–”

“আমরা একটা কিডন্যাপ রিপোর্ট করতে চাই।”

মানুষটা নাকি গলায় বলল, “বেরি গুঁড। বেঁরি গুঁড। এ ফোর কাগজে ডাবল স্পেস দিয়ে লিখে পাঠিয়ে দাও।”

 “লিখে পাঠিয়ে দেব?”

“এ্যা। সুন্দর দেখে একটা নাম দিও। কিডন্যাপারের শাস্তি। কিংবা দুষ্ট কিডন্যাপার। ইচ্ছা করলে একটা উঁড়াও দিতে পার।”

“ছড়া?”

“এ্যা। বিও পাঠাতে পার। রঙিন জেঁয়োন দিয়ে আঁকবে। বেরি গুঁড।”

টুশি আমতা-আমতা করে বলল, “আমরা ছড়া কিংবা ছবি পাঠাতে চাই না। সত্যিকারের একটা কিডন্যাপ হয়েছে সেটা রিপোর্ট করতে চাই। আপনাদের পত্রিকায় সেটা ছাপাবেন।”

উত্তরে নাকি গলায় মানুষটা ঘোড়ার মতো শব্দ করে হাসল, “ইহ হি হি হি “

টুশি তখন রেগেমেগে ফোনটা রেখে দিল।

 তপু বলল, “আপু অন্য পত্রিকায় ফো-ফোন করো।”

তখন দুজনে মিলে খোঁজাখুঁজি করে আরেকটা পত্রিকা অফিসে ফোন করল। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর একজন মানুষ টেলিফোন ধরে বলল, “হ্যালো।”

টুশি এবারে গলার স্বর একটু মোটা করে বড় মানুষের মতো ভঙ্গি করে বলার চেষ্টা করল, “দেখেন আমি খুব জরুরি একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই। কার সাথে কথা বলব?”

“একটু ধরেন”

টুশি এবারে একটু ভরসা পায়, মানুষটি তাকে আপনি করে বলছে। খানিকক্ষণ পর আরেকজন ফোন ধরে বলল, “বার্তা-সম্পাদক–

টুশি আবার গলার স্বর একটু মোটা করে বড় মানুষদের মতো করে বলল, “আমরা আপনাদের কাছে একটা কিডন্যাপিং রিপোের্ট করতে চাই।”

“পুলিশকে জানানো হয়েছে?”

 “পুলিশকে জানিয়েছিলাম তারা শুনতে রাজি হয় নাই।”

“হুম।” বার্তা-সম্পাদক বলল, “কে কিডন্যাপ হয়েছে? আপনার কী হয়?”

টুশি ইতস্তত করে বলল, “আমাদের কেউ না। মানুষটা মানে ইয়ে আসলে”।

“কত বয়স?”

 “এ-এক হাজার”।

 “কী বললেন? এক হাজার? আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?”

টুশি তাড়াতাড়ি বলল, “না-না-না ঠাট্টা করছি না। আসলে হয়েছে কি ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক। যাকে কিডন্যাপ করেছে সে আসলে অদৃশ্য–”

উত্তেজনার কারণে টুশি গলার স্বর মোটা রাখতে ভুলে গেল–আর অন্য পাশের মানুষটা রেগে গিয়ে বলল, “শোনো মেয়ে, আমরা খুব ব্যস্ত মানুষ, তোমার ইয়ার্কি করার অনেক সময় থাকতে পারে, আমাদের এরকম জিনিস নিয়ে নষ্ট করার সময় নেই।”

টুশি ব্যস্ত হয়ে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি কথা বলছি। সবকিছু শোনেন তা হলে বুঝতে পারবেন।”

বার্তা-সম্পাদক বলল, “এক হাজার বছরের অদৃশ্য মানুষের কিডন্যাপিং হওয়ার খবর ছাপানোর কিছু ট্যাবলয়েড পত্রিকা আছে। সেখানে ফোন করো, তারা তোমার ইন্টারভিউ পর্যন্ত ছাপিয়ে দেবে।”

টুশি উত্তরে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বার্তা-সম্পাদক খটাশ করে টেলিফোন রেখে দিয়েছে। টুশির যা মেজাজ খারাপ হল সেটি আর বলার মতো নয়।

.

পুলিশ আর পত্রিকার সাথে বেশি সুবিধে করতে না পেরে টুশি আর তপু শেষ পর্যন্ত একদিন চাচা-চাচিকে ব্যাপারটা খুলে বলার চেষ্টা করল। সকালবেলা সবাই নাস্তা করছে, তখন টুশি বলল, “চাচা, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”

“কী কথা?”

“আপনার মনে আছে, একরাতে আমি আর তপু বাসায় একা একা ছিলাম?”

 চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “হ্যাঁ, কী হয়েছে তখন?”

“সকালবেলা বাসায় এসে আপনি একটা অদৃশ্য জিনিসের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলেন, মনে আছে?”

চাচা সরু চোখে বললেন, “আমি কোনো অদৃশ্য জিনিসের সাথে ধাক্কা খাই নি। আমি ডাক্তারকে দেখিয়েছি, ডাক্তার বলেছে মাইল্ড স্ট্রোকের মতো। ব্লাডপ্রেশার খুব বেশি ছিল বলে–”

“না, চাচা। ব্লাডপ্রেশার না, আপনি আসলে একটা অদৃশ্য মানুষের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলেন। ঠিক মানুষ না, জিন। একটা শিশি থেকে বের হয়েছে।”

চাচা একটা কথাও না বলে চোখ বড় বড় করে টুশির দিকে তাকিয়ে রইলেন, খানিকক্ষণ কোনো শব্দ নেই। চাচা খুব সাবধানে চাচির দিকে একবার তাকালেন তারপর আবার টুশির দিকে তাকালেন তারপর আবার চাচির দিকে তাকালেন। চাচি ভুরু দিয়ে একটা ইঙ্গিত করলেন যার অর্থ “এই-মেয়ে-পাগল-একে-ঘাঁটিও না।” চাচা তখন টুশির দিকে তাকিয়ে মুখে একটা অত্যন্ত মধুর হাসি ফুটিয়ে বললেন, “অবশ্যই শিশি থেকে বের হয়েছে। জিন যদি শিশি থেকে বের না হয় তা হলে কি মশা বের হবে?”

টুশি একটুকু অস্থির হয়ে বলল, “চাচা আপনি বিশ্বাস করছেন না? আমি সত্যি কথা বলছি। তা-ই নারে তপু?”

তপু মাথা নাড়ল, চাচি মাথা নাড়লেন এবং চাচাও মাথা নাড়লেন। চাচা জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “কে বলেছে আমি বিশ্বাস করছি না? আমি অবশ্যই বিশ্বাস করেছি। অদৃশ্য জিন তো থাকতেই পারে। জিন যদি অদৃশ্য না হয় তা হলে কে অদৃশ্য হবে? তা হলে কি মানুষ অদৃশ্য হবে?”

টুশি হঠাৎ করে কেমন যেন হাল ছেড়ে দেয়। চাচা-চাচি কোনোভাবেই এটা বিশ্বাস করবেন না, লাভের মাঝে লাভ হল যে চাচা-চাচি তাকে একটা পাগল ভেবে নিলেন।

টুশি আবিষ্কার করল চাচা আর চাচি ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে তার দিকে তাকাচ্ছেন, কে জানে এখন তাকে জোর করে একটা পাগলা-গারদে ভরতি না করে দেন। টুশি কী করবে বুঝতে পারল না, রাগে-দুঃখে তার নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল।

.

এই ঘটনার দুইদিন পর খবরের কাগজ খুলে টুশি আর তপু স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। খবরের কাগজের ভিতরে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বিজ্ঞাপন, সেখানে বড় বড় করে লেখা :

অদৃশ্য দানব! অদৃশ্য দানব!! অদৃশ্য দানব!!!

বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে বড় অলৌকিক ঘটনা। নিজের চোখে দেখুন, ইতিহাসের অংশ হোন। মানুষরূপী একটি ভয়ংকর রক্তপিপাসু হিংস্র প্রাণী সম্প্রতি ধরা পড়েছে। এই প্রাণীটি পুরোপুরি অদৃশ্য–তাকে প্রথমবারের মতো মঞ্চে নিয়ে আসা হচ্ছে।

নিজের চোখে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনাটি দেখুন। এই অদৃশ্য দানবের উপর বিশেষ প্রতিবেদন আজকে রাত সাড়ে আটটায় টেলিভিশনে।

টিকিটের জন্যে অবিলম্বে যোগাযোগ করুন।

.

টুশি আর তপু অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে না। তপু শেষ পর্যন্ত বলল, “কা কাবিল কোহকাফী মোটেই ভ-ভয়ংকর না।”

টুশি মাথা নাড়ল, “না।”

 “অনেক ভালো।”

 “হ্যাঁ। অনেক ভালো আর সুইট।”

তপু মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কেন লি-লিখেছে অনেক ভ ভয়ংকর? অনেক হি-হিংস্র?”

টুশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মনে হয় কী জানিস? তাকে তো বেঁধে রেখেছে সেইজন্যে লিখেছে হিংস্র, লিখেছে রক্তপিপাসু। ভালো মানুষকে কি বেঁধে রাখা যায়?”

তপু বলল, “ঠি-ঠিক বলেছ।”

 “তা ছাড়া হিংস্র বললে, কেউ কাছে আসবে না। বদমাইশগুলো নিশ্চয়ই চায় না কেউ কাছে আসুক। নিশ্চয়ই চায় সবাই দূর থেকে দেখুক।”

“ইশ! বেচারা কা-কাবিল কোহকাফী! এখন কী হবে?”

টুশি খুব দুশ্চিন্তিত মুখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কিছু-একটা করতে হবে। সাহায্য করার জন্যে আমাদের যেতে হবে।”

“ কিন্তু কে-কেমন করে যাব? ক-কত টাকা টিকেট দেখেছ?”

 “যত টাকাই হোক যেতে হবে।”

 “টা-টাকা কোথায় পাবে?”

“আমার নানা ট্রাস্ট করে আমার জন্যে টাকা রেখে গেছে, সেখান থেকে নেব।”

তপু মুখ শুকনো করে বলল, “কিন্তু তা-তারপর কী হবে?”

টুশি বলল, “দেখি কী করা যায়। কিছু-একটা আমাদের করতেই হবে।”

.

রাত্রিবেলা টুশি আর তপু টেলিভিশনে অদৃশ্য-দানবের ওপর বিজ্ঞাপনটি দেখল। ছোট এক মিনিটের বিজ্ঞাপন। প্রথমে মন্তাজ ওস্তাদ কীভাবে সুন্দরবন অভিযানে গিয়ে সেখানে জলের ভেতর থেকে এই ভয়ংকর হিংস্র প্রাণীটা ধরেছে সেটা নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে দুই-একটা কথা বলল। তারপর একটা খচা নিয়ে আসা হল–তার ভেতরে নাকি অদৃশ্য দানব। তখন হিংস্র জন্তুর গর্জন শোনা যেতে লাগল, ভয়ের ছবিতে যেরকম ভূত-প্রেত-দানব দেখা যায় সেরকম ভয়ংকর কিছু দাপাদাপি করল, ভয়-পাওয়া মানুষের আতঙ্ক এবং চিৎকার শোনা গেল। তারপর একজন সুন্দরী মেয়ে এসে বলল, “এই আদিম ভয়ংকর রক্তপিপাসু হিংস্র দানবটিকে আপনারা দেখতে পারবেন প্রদর্শনী শোতে। এই দেখাঁটি আপনারা ভুলতে পারবেন না– কারণ প্রাণীটি অ-দৃশ্য!”

টুশি রিমোট চেপে টেলিভিশনটি বন্ধ করে দিয়ে বলল, “কত বড় বদমাইশ! কাবিল কোহকাফী হচ্ছে একটা সুইট জিন। আর তাকে বানিয়েছে হিংস্র দানব।”

“কেউ তো দে-দেখতে পায় না তাই।”

টুশি তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি সবাই দেখতে পারত তা হলে আর কেউ বদমাইশি করতে পারত না।”

তপু টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা যদি সেই ম-মন্ত্রটা খুঁজে বের করতে পারতাম!”

“কোন মন্ত্রটা?”

“যেটা বললে কা-কাবিলের বাণ কেটে যাবে!”

টুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটা আমরা কোথায় পাব! কত হাজার বছর আগের কথা!”

তপু টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু।”

 “কী হল?”

 “তুমি ও-ওষুধের শিশি দেখেছ?”

 “দেখেছি। কেন?”

“ওষুধের শি-শিশির উপরে স-সবসময় লেখা থাকে ক-কখন খেতে হয়, সেরকম তার বোতলটিতে কি কা-কাবিল কোহকাফীর উপর লে-লেখা আছে?”

টুশি বলল, “কিছু লেখা থাকলে কি চোখে পড়ত না?”

“কিন্তু আমরা তো ভা-ভালো করে দেখি নাই।”

 টুশি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আয় তা হলে ভালো করে দেখি।”

টুশি আর তপু কাবিল কোহকাফীর শিশিটা বের করে খুব ভালো করে দেখল। শিশিটা মনে হয় পাথরের তৈরি, বেশ ভারী। ছিপিটা ভেঙে খোলা হয়েছে, সেটা মনে হয় কোনো একটা ধাতুর তৈরি। এত বছর পরেও ধাতুটিতে জং ধরে নি– কাজেই মনে হয় খুব ভালো কোনো ধাতু হবে! টুশি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কোনোকিছু না পেয়ে তপুর হাতে দিল। তপু টেবিল-ল্যাম্পের নিচে ধরে ভালো করে দেখে হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, “আ-আপু।”

“কী হয়েছে?”

 “মনে হয় উপরে কিছু লেখা আছে–”।

 “কোথায়?”

 “এই দ্যাখো-খুব হালকা, বো-বোঝা যায় না এরকম।”

টুশিও এসে দেখল, খুব ভালো করে তাকালে মনে হয় সত্যিই কিছু-একটা লেখা আছে। খুব অস্পষ্ট লেখা। টুশি বলল, “মনে হয় এক হাজার বছরের ময়লা লেগে এই অবস্থা। পরিষ্কার করে নিই।”

“কী দিয়ে প-পরিষ্কার করবে আপু?”

 “নেল পালিশ রিমুভার।”

ছোট একটা টিসু পেপারে চাচির নেলপালিশ রিমুভার লাগিয়ে টুশি পাথরের শিশিটা ঘষতেই বাদামি রঙের ময়লা উঠে নিচের লেখা পরিষ্কার বের হয়ে এল। তপু হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেয়ে গেছি! লে-লেখা পেয়ে গেছি!”

টুশি বলল, “আগেই এত খুশি হয়ে যাস নে।”

“কেন?”

 “লেখাটা আগে দ্যাখ।”

তপু দেখল এবং সমস্যাটা বুঝতে পারল। লেখাটি কোনো পরিচিত ভাষায় লেখা নয়। আরবির মতো–কিন্তু আরবি নয়। জিজ্ঞেস করল, “কী ভাষা এটা?”

“জানি না।”

“তা-তা হলে পড়ব কেমন করে?”

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “সেটাও জানি না।”

দুজনে মিলে খানিকক্ষণ জল্পনা-কল্পনা করল। মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে নেয়া যায় কি না আলোচনা করল কিন্তু তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। ইউনিভার্সিটিতে অনেক জ্ঞানীগুণী থাকে তাদের কাছে নিয়ে গেলে হয়তো কেউ-একজন এটা পড়ে দিতে পারে কিন্তু সেখানে কার কাছে নিয়ে যাবে তারা। বুঝতে পারল না। মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া যায়, সেখানকার কিউরেটর হয়তো বলতে পারবে। কিন্তু ছোট মানুষ বলে তাদের কোনো পাত্তা দেবে বলে মনে হয় না। লাইব্রেরিতে অনেক বইপত্র থাকে, সেখানে গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে হয়তো এটা কোন ভাষা বের করে ফেলতে পারবে। কিন্তু সেই ভাষাটা শিখে ওপরের লেখাটা পড়তে পারবে বলে মনে হয় না। টুশি এবং তপু নূতন করে ছোট থাকার সমস্যাটা বুঝতে পারল, তারা যদি বড় মানুষ হত কিংবা কোনো একজন বড় মানুষের সাথে তাদের পরিচয় থাকত তা হলে হয়তো এই সমস্যাটার সমাধান বের করে ফেলত। যখন দুজনে প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন তপু চোখ বড় বড় করে বলল, “আপু”।

“কী হল?”

 “ই-ই-ইন্টারনেট!”

 “ইন্টারনেট?”

“হ্যাঁ।” তপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “ই-ইন্টারনেটে খোঁজ করি–সে-সেখানে হয়তো খোঁজ পাওয়া যাবে।”

টুশি হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!” পরমুহূর্তে চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু ইন্টারনেট পাব কোথায়?”

 “ম-মনে নাই” তপু হড়বড় করে বলল, “স্কুলে যা-যাবার সময় রা-রাস্তায় একটা সা-সাইবার কাফে আছে?”

টুশি আবার হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস।”

পরমুহূর্তে আবার সে চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু এই শিশিটা ইন্টারনেটে কেমন করে পাঠাব?”

“শিশিটাতো পা-পাঠানো যাবে না। শিশির উপরের লে-লেখাটা স্ক্যান করে পা-পাঠাব।”

টুশি আবার হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস! আয় তা হলে কাজ শুরু করে দিই।”

একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুব সাবধানে পরীক্ষা করে টুশি আর তপু শিশির উপরের লেখাটা প্রথমে একটা কাগজে লিখে নিল। তারপর দুজন ছুটলো। সাইবার কাফের দিকে।

টুশি আর তপু এর আগে কখনও সাইবার কাফেতে আসে নি। কী করে কী করতে হয় দুজনের কেউই জানে না। সাইবার কাফের কর্মচারীটি তাদের দুজনকে একটা কম্পিউটারের আসনে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল, দুজনে মিলে যখন কী-বোর্ড আর মাউস নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে তখন পাশের কম্পিউটারে বসে থাকা এলোমেলো চুলের তেরো-চোদ্দ বছরের টিশার্ট পরা একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী করছ?”

টুশি এবং তপু দুজনেই একটু সন্দেহের চোখে ছেলেটার দিকে তাকায়। কিন্তু ছেলেটা সেটা লক্ষ করল বলে মনে হল না, গলা নামিয়ে বলল, “এই সাইবার কাফে মহা গিরিংগিবাজ–কী করতে চাও যদি না জান হলে ছিল খেয়ে যাবে।”

টুশি আর তপু কিছু বলল না। ছেলেটা তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মেশিনের মতো কি-বোর্ডে কিছু-একটা টাইপ করতে করতে বলল, “তোমরা নূতন মক্কেল। কোন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করছ?”

“না মানে”

ছেলেটা বাম হাত দিয়ে মাউস ক্লিক করে কিছু-একটা ঘটিয়ে দিয়ে বলল, “কী করতে চাও?”

টুশি তখন কাগজটা বের করে সেই বিচিত্র লেখাটা দেখিয়ে বলল, “এইখানে কী লেখা সেটা বের করতে চাই!”

টুশি নিশ্চিত বড় কোনো মানুষকে এই কথা বললে সে হয় হা হা করে হেসে উঠত নাহয় ধমক দিয়ে বসত। কিন্তু টিশার্ট পরা এলোমেলো চুলের ছেলেটা তার কিছুই করল না, মুখটা ছুঁচালো করে বলল, “ভেরি ইন্টারেস্টিং। এনক্রিপশান প্রবলেম। তিনটা ইউজার গ্রুপ আছে তার মাঝে দুইটা সুপার।”

টুশি আর তপু কী বলবে বুঝতে পারল না। ছেলেটা কাগজটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানাদিক থেকে দেখে বলল, “কোথায় পেয়েছ?”

“এটা একটা খুব পুরানো ভাষায় লেখা।”

ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলল, “কসম?”

 টুশি বলল, “কসম।”

ছেলেটা এবারে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “মাইয়ারে মাইয়া।”

কথাটার মানে কী টুশি কিংবা তপু কেউই বুঝতে পারল না বলে দুজনেই চুপ করে রইল। ছেলেটা কম্পিউটারে খুটখাট করতে করতে বলল, “তোমাদের ই মেইল অ্যাড্রেস আছে?”

তপু মাথা নাড়ল, “না–নাই।”

 “এই লেখাটা স্ক্যান করেছ?”

তপু মাথা নাড়ল, “না।”

“যাও, আগে স্ক্যান করিয়ে আনো। আমি ততক্ষণে তোমাদের একটা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট খুলে দিই।”

 টিশার্ট পরা উশকো-খুশকো চুলের ছেলেটা থাকার কারণে আধা ঘণ্টার মাঝে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ভাষায় বিশেষজ্ঞ এরকম অনেক মানুষের কাছে এই লেখাটা পাঠানো হয়ে গেল। ছেলেটা বলল, যদি কেউ এর সমাধান বের করতে পারে তা হলে আজ কালকের মাঝেই তাদের সেটা জানিয়ে দেবে। টুশি আর তপুকে সাইবার কাফেতে এসে প্রত্যেক দিন তাদের ই-মেইল পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোনো উত্তর এসেছে কি না।

সত্যি কথা বলতে কি কোনো উত্তর চলে আসবে সেটা টুশি কিংবা তপু কেউই একেবারে আশা করে নি। তাই পরের দিন স্কুল থেকে আসার সময় যখন সাইবার কাফেতে গিয়ে তাদের ই-মেইল এসেছে কি না পরীক্ষা করতে গেল তখন তারা অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি চারটা ই-মেইল চলে এসেছে। প্রথম ই-মেইলটাতে লেখা :

“তোমরা যে লেখাটি পাঠিয়েছ আমি সেটা সম্পর্কে পরিচিত নই। লেখার গঠনভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এটা প্রাচীন হিব্রু ভাষায় একটি অপভ্রংশ।” দ্বিতীয় ই-মেইলটাতে লেখা :

“তোমাদের লেখাটি দেখে মনে হচ্ছে এটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে তাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে-ওঠা একটি সভ্যতার লিপি। এই লিপিটি বর্তমানে মৃত। তোমরা কোথায় এটি পেয়েছ জানার জন্যে খুব আগ্রহী। তৃতীয় ই-মেইলটাতে লেখা :

“তোমাদের পাঠানো ই-মেইলে সংযুক্ত লিপিটি পেয়ে আমি চমৎকৃত হয়েছি। এটি অধুনালুপ্ত কিফুস ভাষার লিখনলিপি। আমি দীর্ঘদিন থেকে এই ভাষার উপরে গবেষণা করছি। এখানে লেখা : কাবিল তুমি দুই হস্ত প্রসারণ করে মস্তিষ্ক নত করো, উচ্চারণ করে উচ্চকণ্ঠে, মাগারুফাস মাগারুফাস এবং মাগারুফাস। এই লিপিটি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছ আমাকে জানাও। আমাদের জাতীয় মিউজিয়াম এর প্রকৃত কপিটি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হবে।”

চতুর্থ ই-মেইলটি পাঠিয়েছে একজন বদমেজাজি প্রফেসর, সে লিখেছে : “ভবিষ্যতে আমাকে এই ধরনের আজেবাজে জিনিস পাঠালে মাথা ভেঙে দেব। দূর হও হতভাগা সকল।”

অন্য তিনটি ই-মেইল পেয়ে টুশি আর তপু এত খুশি হয়ে গেল যে বদমেজাজি প্রফেসরের ই-মেইলটির জন্যে তারা কিছু মনে করল না। যিনি এই রহস্যময় লেখাটার অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন টুশি আর তপু তাঁকে বিশাল লম্বা একটা চিঠিতে সবকিছু লিখে পাঠাল। মানুষটা নিশ্চয়ই কিছু বিশ্বাস করবেন না কিন্তু টুশি আর তপু সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। অন্য যে-দুজন তাদের কাছে ই-মেইল পাঠিয়েছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ দিয়ে সাথে সাথে উত্তর পাঠিয়ে দিল।

বদমেজাজি প্রফেসরকেও তারা একটা ই-মেইল পাঠাল, সেখানে লিখল :

“হে বদমেজাজি প্রফেসর জন্মের সময় তোমার মা কি তোমার
মুখে মধু দিতে ভুলে গিয়ে আলকাতরা দিয়েছিল?”

 তারপর তারা ছুটল বাসায়। কাবিল কোহকাফীকে অদৃশ্য থেকে উদ্ধার করার মন্ত্র তারা এখন পেয়ে গেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *